#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২১.
খাবার গুছিয়ে রুমে যেতে আফরিনের খানিকটা দেরি হলো। রুমিলার ঘরে যাওয়ার পথে আসিফার সাথে দেখা হলো আফরিনের। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “কিছু লাগবে মা?”
“না এমনি এলাম।”
আফরিন শাশুড়ির নড়চড় খেয়াল না করে চলে যাচ্ছিল। ভেবেছিল তাকে দেখেই হয়তো তিনি থেমে গেছেন।
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
ঘুরে তাকাল আফরিন, “রুমে।”
“কোন রুমে?” আসিফার কপালে ভাঁজ পড়ল।
আফরিন আড়ষ্ট বোধ করল, “দাদীমার রুমে।”
আসিফার চোখে বিস্ময় দেখা গেল, “কেন!”
আফরিন চুপ করে রইল। সে কি বলবে? বিয়ের দিন এক ঘর ভর্তি লোকের সামনে আপনার ছেলে আমাকে ফেলে দরজা দিয়েছে। গতকাল কোথায় থেকেছি সেটা জানার চেষ্টা করেনি। আজও আমার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করেছে। আমি ওখানে যাবো? কার কাছে?
“চুপ করে আছো কেন?” আসিফা বিরক্ত হলেন। ছেলের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এর মধ্যে ঝগড়াও হয়ে গেল?”
আফরিনের হাসি পেল। যার মাথায় যেটা আসে। স্বাভাবিক কণ্ঠে সে বলল, “উনি বোধহয় আমার সাথে থাকতে পছন্দ করছেন না।” আফরিনের কণ্ঠের বিমর্ষ ভাব আসিফা খেয়াল করলেন না।
“এটা কোনো কথা হলো? পছন্দ অপছন্দের কি আছে? বিয়ে হয়েছে এখন এসব কথা বললে হবে? তুমি চলো আমার সাথে।” আফরিনের হাত ধরলেও সে নড়ল না। আসিফা অবাক হয়ে তাকালেন।
“যাবে না?”
“এখন গেলে উনার ঘর দখলই হবে। এছাড়া আর কিছু না। উনার সাথে একটা বোঝাপড়া হোক। আমি যাবো।” আফরিন বাকিটুকু বলল না। সে তো রাফির কেবল রুমমেট হতে চায় না। লাইফমেট হওয়ার ইচ্ছে নিয়েই তার জীবনে এসেছে। সেটা বোধহয় এখুনি হচ্ছে না। পথ দীর্ঘ, মনজিল আরও দূরে।
আসিফা চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হলো যথেষ্ট বলেছেন। এক দম্পতির মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না।
আফরিন ঘরে চলে গেলেও তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আশপাশে কেউ নেই বুঝতে পেরে উপরে উঠে গেলেন।
রাফি কখনও দরজা বন্ধ করে না। সিটকিনি সবসময় খোলা থাকে। ইয়েল লকটা থেকে থেকে অকেজোই হয়ে গেছে বোধহয়। এতে আসিফার বরং সুবিধাই হয়। দিনের আলোয় যে ছেলেটার চোখে চোখ রাখতে পারেন না রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে সেই ছেলের মুখটা একটু দেখে যান। দরজা বন্ধ করলে এই সুবিধা পেতেন কিভাবে?
গতকাল যখন এসেছিলেন তখন ভেবেছিলেন আজই শেষ। পরদিন থেকে রাফি বউ নিয়ে থাকবে। কীভাবে ছেলেকে দেখবেন তিনি? আজকে আসতে পারবেন চিন্তা করেননি।
এই মন্দের ভালো। ছেলেকে দেখতে পেয়ে যেই স্বস্তিটুকু বোধ করছেন সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না আসিফার মনে। বিয়ে করেও দুজন দুদিকে থাকলে কেমন দেখা যায়?
রাফি কপালে হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে ছিল। এসির টেম্পারেচার কমিয়ে রাখার কারণে ঘর ঠান্ডা হয়ে আছে। রাফির হাতে হাত রেখে আসিফা দেখলেন শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। পায়ের কাছ থেকে কম্বল টেনে গায়ে জড়িয়ে দিলেন। রাফি সেটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো ঘুমের মাঝেই। আসিফা আরো কিছুক্ষণ বসলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চিন্তা করলেন আফরিনের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করবেন। ছেলের সাথে কথা বলতে লজ্জা পান। তার দুটো ছেলেমেয়ে সামনে নিজের এমন চিত্র তৈরি করেছে যে ছেলেমেয়ে দুটো বিপদে পড়ে কখনও মায়ের কথা ভাবে না, স্বস্তির জন্য কখনও তাদের মাথায় মায়ের সান্নিধ্যের কথা আসে না। আসিফার মাঝে মাঝে মনে হয় এর চেয়ে মাহমুদের সাথে তার যদি ডিভোর্সও হয়ে যেত তবুও হ্য়তো পরিস্থিতি এমন হতো না। যেই ছেলেমেয়ের জন্য এই অশান্তির মাঝেই থেকে গেলেন তাদের সাথেই নিজের কান্ডজ্ঞানহীনতার কারণে সম্পর্ক নষ্ট করলেন।
ড্রয়িং রুমের লাইট বন্ধ করতে এসেছিল আফরিন। তখন আসিফা থাকায় বন্ধ করেনি। রুম থেকে আলো দেখে ফেরত এসে দেখল আসিফা দোতলায়। রাফির রুমের সামনে। দরজা ঠেলে তাকে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখে চলে এলো আফরিন। আলো বন্ধ না করেই।
。。。。。。。。。
রাতে ভালো ঘুম হয়নি আফরিনের। কেন যে ঘুম আসেনি এটাও বলতে পারবে না সে। কতক্ষন এপাশ ওপাশ করে ঘুমিয়েছে সম্ভবত তিনটার দিকে।
ফজরের আজান দিতেই রুমিলার ডাকে উঠে পড়লেও মাথা ব্যথাটা পিছু ছাড়ছিল না।
এক কাপ চা নিয়ে রান্নাঘরেই বসেছিল সে। তখন হয়তো সাতটা বেজেছে কি বাজেনি। আসিফাকে দেখা গেল মিহাদকে সাথে নিয়ে উপরে উঠছেন। আফরিন তিতলিকে জিজ্ঞেস করল, “মিহাদ কখন ঘুম থেকে ওঠে?”
“সবার আগে। দাদীর আগে উঠে বসে থাকে।”
“সাড়াশব্দ করে না?”
“না। রাগলেই অশান্তি শুরু করে।”
তার ঠিক আধা ঘণ্টা পর উপর থেকে চিৎকার শোনা গেল।
তিতলি কণ্ঠে বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল, “আপনার শ্বশুর শাশুড়ির শুরু হয়ে গেছে।”
আফরিন হতবিহ্বল হয়ে শুনল। সকালের নীরবতায় অল্প আওয়াজও কানে তীক্ষ্ম হয়ে বাজে। কিন্তু আটটার ঘরে কাঁটা গেলেও আওয়াজ থামার বদলে বাড়তেই থাকল। আফরিন ইতস্তত করছিল রুমিলার সামনে বসেই। বুঝতে পারছিল না তার যাইয়া উচিত কি না।
রুমিলা তাকে উদ্ধার করলেন।
“ছটফট কইরো না বউ। এসব নিত্যদিনের রুটিন। মানুষের যেমন এক প্লেট ভাত না হইলে চলে না তেমন ওদের দিনে ঝগড়া না করলেও চলে না। এক কান দিয়ে শুনবা আরেক কান দিয়ে বের করে দিবা।”
আফরিন কিন্তু আরেক কান দিয়ে বের করতে পারল না। অস্বস্তি বোধ নিয়েই পায়চারি করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে। বারবার চোখ উপরে চলে যাচ্ছে। রাফির ঠিক বিপরীত দিকের রুমটায়। খানিকক্ষণ পর মিহাদকে দেখা গেল নিচে নেমে আসছে। আফরিন অবাক হলো। ছেলেটা এসবের মাঝে ওখানে ছিল?
মিহাদ আফরিনের পাশ দিয়েই চলে গেল। আফরিন শুনল সে বিড়বিড় করে বলছে, “একটা বল। একটা বল।” ভ্রু কুচকে তাকালো আফরিন।
বেলা গড়াতেই ঘটনা পাঁচ কান হয়ে গেল। আসিফা মিহাদের জন্য একটা বল কিনে দিতে বলেছিলেন মাহমুদকে। বলা বাহুল্য এসব মাহমুদের কোনোকালেই পছন্দ না। তিনি নিষেধ করেছেন। আসিফা জোর করেছেন। পরিবারের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ব পালন করে না বলে বকাবকি করেছেন। মাহমুদের নীরবতার ধৈর্য ঐ পর্যন্তই ছিল। তারপর তিনি চিৎকার শুরু করলেন। আসিফা তাল মিলিয়ে গেলে তার পরিবার তুলে ধমকা ধমকি করলেন।
সব শুনে আফরিন নিশ্বাস ছাড়ল। তিল থেকে তাল বোধহয় একেই বলে।
রাফির কানেও সবটা গেল। সে সকালে খেল না। লোকটার মুখ দেখে আফরিন জোরও করতে পারল না। যাওয়ার সময় যখন মিহাদকে গুছিয়ে নিচ্ছিল তখন আফরিন বলল, “ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“ওর ঠিকানায়। যেখানে ও থাকলে কোনো অশান্তি হবে না।”
মিহাদের সাথে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না আফরিন। তাকে নিয়ে চলে গেল রাফি।
সারাটা দিন কোনো রকমে পার করল আফরিন। শ্বশুর শাশুড়ির মন মেজাজ ভালো না। মাহমুদ বেরিয়েছেন সেই সকালে। আসিফা এই পর্যন্ত নিচে নামেননি। রুমিলার সাথে আর কতক্ষন গল্প করা যায়?
অবসর পেয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে ফেলেছে আফরিন। নাবিলার সাথেও টুকটাক গল্প করেছে। কিন্তু রাফির ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই থমকে গেছে। এই ঘরে ঢোকার পাসপোর্ট তার নেই। মাঝের কাঁটাতার তো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।
。。。。。。。。。。
নাবিলা একেবারেই ঘরের বাইরে আসতে চায় না। বিকেলে আফরিন জোর করেই তাকে বাইরে বের করে আনল। নাবিলা মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলেনি। পরিবারের নতুন সদস্য তার উপরে বড় ভাইয়ের বউ। চাইলেই ধমক দেয়া যাচ্ছে না।
আফরিন তাকে টেনে নিয়ে গেল বাগানে। ওখানে বসার একটা কাঠের বেঞ্চি আছে। সেটার অবস্থা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বেহাল হয়েছে। শ্যাওলা জমেছে খানিকটা। তাই আদেইন ওদিকে গেল না। ফুলগাছের মাঝে বেড়ে ওঠা ঘাসের উপরে নাবিলাকে ধপ করে বসিয়ে দিল।
নাবিলা যথেষ্ট বিরক্ত হলো এবং কিছুটা চেহারায় প্রকাশও করে ফেললো। এই ঘাসের ভেতরে পোকামাকড় থাকলে কেমন হবে তখন?
আফরিন হাসি হাসি মুখে বলল, “বিরক্ত হচ্ছেন?”
“না না।” নাবিলা বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল।
আফরিন গলা নিচু করে বলল, “একটা সিক্রেট বলি! আমি কিন্তু মানুষের চোখ দেখে অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারি। আপনার চোখ দেখেও বুঝছি। এই যে আপনি কাচুমাচু করে ঘাসের দিকে তাকাচ্ছেন। অস্থির ভঙ্গিতে এদিক ওদিক দেখছেন। আমার দিকেও একবার আড়চোখে তাকিয়েছেন। আপনি যে বিরক্ত সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি।”
নাবিলা চরম লজ্জা পেলো।
আফরিন হেসে ফেলল, “এবার আপনি লজ্জা পাচ্ছেন! আপনাকে বিরক্ত করতেই কিন্তু এখানে নিয়ে এসেছি।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কিন্তু তোমার ননদ। জ্বালিয়ে একেবারে হাড় মাংস আলাদা করে ফেলব!”
“তার জন্য হলেও আপনাকে ঘর ছেড়ে বের হতে হবে।”
নাবিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “ভালো লাগে না।”
“পৃথিবীর অর্ধে জিনিস আমাদের ভালো লাগে না। বাকি অর্ধেক ভালো লাগার দিকে তাকিয়ে আমরা জীবনটা কাটিয়ে দিই।”
“যেমন?”
“রাস্তায় হাঁটার সময় খোলা ড্রেনের দিকে তাকালে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমরা দ্রুত চোখ সরিয়ে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকাই। অপছন্দের একটা খাবার খেয়ে মুখ নষ্ট হলে আবার তাড়াতাড়ি করে পছন্দের কিছু একটা খেয়ে নিই। ভালো না লাগা আর ভালো লাগা দিয়ে কাটাকাটি।”
“তুমি তো অনেক সুন্দর করে কথা বলো!”
“আপনি সুন্দর করে শুনছেন বলে ভালো লাগছে। বাই দ্যা ওয়ে! তিতলি এর চেয়েও বেশি সুন্দর করে কথা বলে। আপনি ওর সাথে নিয়মিত আধা ঘণ্টা কথা বলবেন। মন ফ্রেশ থাকবে।”
“এটা কতো দিনের ফাইল?” নাবিলা হেসে বলল।
“আপনি অনুমতি দিলে আপনাকে কিছু জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলব আপু।”
“বলো। বলতেই তো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলে।”
আফরিন হাসল, “তার জন্য আমি মোটেও দুঃখিত নই।” নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আমার পাশেই একটা নয়নতারা ফুল গাছ আছে। খেয়াল করেছেন? করেননি। কারণ সব জীবন্ত রঙিন ফুলের মাঝে এই গাছটা প্রাণ হারিয়ে ম্লান হয়ে গেছে। মানুষের যত্নের অভাবে। আমাদের মনও এমন। গাছের মতো। নিজে নিজে যত্ন নিতে পারে না। আরেকজনকে যত্ন নিয়ে দিতে হয়। সে উনিশ থেকে বিশ করলেই অযত্নে, অবহেলায় নিঃশব্দে সেই মন মরে যায়।”
নাবিলা তন্ময় হয়ে শুনছিল। আফরিনের ভালো লাগলো। কেউ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনলে বলেও শান্তি।
“আপনার মনটা একান্তই আপনার। ওটাকে সার পানি দিয়ে যত্নে রাখার দায়িত্বও আপনার। এখন আপনি যদি এই জিনিসকে অবহেলা করে জীবন কাটিয়ে দেন তাহলে জবাব দেবেন কীভাবে?”
“জবাব?” নাবিলার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“হ্যাঁ। আমানতের খিয়ানত হবে না?”
“বুঝলাম না।”
“কোন একটা বইয়ে যেন পড়েছিলাম আমাদের জীবনের সবকিছুই আমাদের কাছে আমানত। এর প্রত্যেকটার হিসাব দিতে হবে। প্রত্যেকটা সম্পর্ক আমানত, নিজের কাছে নিজে আমানত। জানেন আল্লাহ নিজের উপরে জুলুম করাকে হারাম করেছেন!”
নাবিলার প্রতিক্রিয়া না দেখে আফরিন বলল, “আপনি রাগ হলেই নিজের গালে দুটো থাপ্পড় মা-রতে পারবেন না, কষ্টে কাতর হয়ে হাত কাটতে পারবেন না। নিজেকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে পারবেন না। আল্লাহ হারাম করেছেন।”
“এতে আল্লাহর লাভ?” বিহ্বল ভঙ্গিতে শুনল নাবিলা।
আফরিন রহস্য করে হাসল, “এটা আপনার হোমওয়ার্ক। দরজা জানালা আটকে এই হোমওয়ার্ক পুরো করবেন। নাহলে আপনাকে চার চামচ চিনি দেয়া শরবতের মতো ঠান্ডা এক কাপ চা খাওয়াবো।”
রাফি বাড়িতে এসেছে একটা ফাইল নিতে। সদর দরজা দিয়ে গাড়িটা ঢুকতেই খোলা জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেল সে। ফুল বাগানে মাঝে দুটো ফুল বসে আছে।
~চলমান~
#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২২.
নাবিলাকে কতদিন পর এমন খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে দেখল রাফি বলতে পারবে না। রঙ্গন গাছের সাথেই বসে আছে নাবিলা। গাছে থোকা থোকা লাল রঙ্গন ফুটেছে। পাশাপাশি দুটো ফুলকে এতো দারুন লাগল রাফির কাছে! সে চটপট ফোনের ক্যামেরা অন করল। ছবি তোলার পর তার ভুরু কুচকে গেল। অনাকাঙ্খিতভাবে আফরিনের মুখের এক পাশ চলে এসেছে। ওভাবেই রেখে দিল রাফি। ফোকাসে নাবিলার হাসি মুখ যে এনেছে তার ছবির একাংশ রাখাই যায়।
রাফি এদিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো। আফরিন নাবিলার দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। হঠাৎ এই সময়ে কেন? সে উঠে যাবে কি না ভাবতে ভাবতেই আবার রাফিকে গাড়ি ঘোরাতে দেখা গেল।
“কোথায় যাচ্ছিস আবার?” আফরিনের হয়ে নাবিলা প্রশ্ন করল।
রাফি গাড়ির ভেতর থেকেই হাত উঁচু করে দেখলো, “ফাইল নিতে এসেছিলাম।”
গাড়ি বেরিয়ে গেলে নাবিলা বলল, “ভাইয়া কি তোমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করে?”
“কোনো ব্যবহারই করে না আবার স্বাভাবিক।” বিড়বিড় করে বললেও নাবিলা শুনে ফেলল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
“জোর করে বিয়ে দেয়ার কোনো দরকার ছিল বলো? এক সময় নিজেই বিয়ে করত।”
আফরিন জানে রাফি কোনোদিন নিজে থেকে বিয়ে করত না। রুমিলা ধরে বেঁধে দিয়েছে বলেই করেছে। তার মনে যেই পরিমাণ বিতৃষ্ণা বাসা বেঁধে আছে তাতে ঐ লোক নিজে থেকে বিয়ে করবে এটা ভাবাও বোকামি। নাবিলা সেই বোকা বোকা চিন্তাভাবনা করছে।
“তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল নাবিলা।
আফরিন মাথা নাড়ল, “না।” একবার বলতে চাইল আমরা আলাদা ঘরে থাকি। দেখা হয় অপরিচিতের মতো। আপনার ভাই কোন উসিলায় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে?
নাবিলা যেন হাঁফ ছাড়ল, “আসলে দাম্পত্য জীবন বলতে আমরা শুধু ঝগড়াই দেখে এসেছি। এজন্য একটা প্রভাব থেকে গেছে।”
“দাদা মারা গেছে কবে?”
“আট বছর আগে।”
“তার মানে তখন আপনার ভাইয়ের বয়স একুশ ছিল। একুশ বছর ধরে দাদা দাদীর দাম্পত্য কেমন দেখেছে সে? আপনি?”
নাবিলা বলল, “দাদা দাদীমা ছিল জন্যই হয়তো এমরা এখনও সুস্থ স্বাভাবিক আছি।”
আফরিনের রাগ হলো। বিয়ে করে বউকে আরেক ঘরে পাঠায় যেই লোক সে সুস্থ কীভাবে হয়? স্বাভাবিক তো বহু দূরের বিষয়।
“তবুও সেটা আপনাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারল না।” আফরিনের খেদোক্তি নাবিলা বুঝতে পারল। সে বিব্রত হল। তার ভাই তো খারাপ নয়।
“ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। পড় নি?”
আফরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “পড়েছি। এখন দেখছি।” প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলো আফরিন। নাবিলাকে বলল, “আপনি এভাবে আর আইসোলেশনে থাকবেন না আপু।”
“কী করব তাহলে? বিয়ে করব? দাদীমা তো বলে আমার রোগের একমাত্র ওষুধ বিয়ে।” নাবিলা হাসল।
আফরিন কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “একেকজনের চিন্তা ভাবনা একেকরকম। দাদীমার এমন মনে হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার এখন বিয়ে করা উচিৎ হবে না।”
“কেন?”
“আপনি নিজেকেই সামলাতে পারছেন না। বিয়ে হলে পুরো একটা সংসারের দায়িত্ব কীভাবে নেবেন? আগে নিজেকে চিনুন, বুঝুন। তারপর আরেকজনকে বোঝার কথা চিন্তা করবেন।”
“আমার অদূর ভবিষ্যতে কোথাও বিয়ে নেই।”
“তাহলে আমি মামী ডাক শুনবো কীভাবে?” আফরিন মন খারাপের ভান করে বলল।
নাবিলা হেসে ফেললো, “তোমার সাথে টাইম স্পেন্ড না করে ভাই যে কি মিস করছে বুঝতেও পারছে না।”
。。。。。。。。。。
তিতলির অসহ্য লাগছে এসব দেখে। বর বউ দুজন দুই মেরুতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মন চাচ্ছে ভাবিকে নিয়ে রাফি ভাইয়ের ঘরে ঢুকিয়ে দুইজনকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আটকে রাখতে। এটা কোন ধরনের বিয়ে হ্যাঁ? ভাবতে গেলে তার মাথার তালু গরম হয়ে যায়।
ঐ বুড়ি সব নষ্টের গোড়া। আরেক বাড়ি থেকে মেয়ে ধরে এনেছে তার নাতির মনের আগাছা সাফ করতে। কথাবার্তা শুনলে গায়ে আগুন ধরে যায়। কেন? ঐ মেয়ের কি সংসার করার ইচ্ছা নেই? সে আগাছা পরিষ্কার করতে যাবে কোন দুঃখে?
এসব রুমিলা বেগমকে বলাও যাবে না। মহিলা নাতি কথাবার্তা না বলার কারণে এমনিতেই দুঃখে আছে। সে সুযোগ বুঝে আফরিনকেই ধরল। তখন সবে সন্ধে হয়েছে।
“ভাবি আপনি ভালো আছেন?”
হঠাৎ এমন ধারা প্রশ্নে আফরিনের অবাক হলো।
“হ্যাঁ ভালই তো আছি।”
“ছাই আছেন। বিয়ে করে মাটি খেয়েছেন। না যেতে পারলেন হানিমুন, না যেতে পারলেন নাইওর, না যেতে পারলেন বরের ঘরে। ভাবতে গেলে আমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। আর সবাই এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। আপনারা দুইজন দুই প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বিয়ে করেছেন।”
আফরিন হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেল।
আফরিনের চেহারা দেখে তিতলি বলল, “ভাবি আমি এসব বলছি বলে কি রাগ করছেন?”
আফরিন দুদিকে মাথা নাড়ল, “সব তো সত্যি।”
“আমি জানি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নাক গলাতে হয় না। কিন্তু নাক গলিয়েই আপনাদের বিয়ে হয়েছে। এখন আমি আপনাকে কিছু উপদেশ দিবো। ছোট মুখে বড় বড় কথা বলব। আপনি কিছু মনে নিতে পারবেন না।”
আফরিন তিতলির দিকে তাকাল, “বলো তিতলি।”
“রাফি ভাই ভালো মানুষ কিন্তু আপাতত সে নির্বোধের মতো আচরণ করছে। তাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। বাপ মার সূত্র যে দুনিয়ার সব জায়গায় ফলে না এটা বোঝাতে হবে।”
“আমি কি করব?”
“আপনিই সব করবেন।” তিতলি দম ছাড়লো। আফরিন তিতলির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তিতলি দু দশক ধরে সংসার করে এখন তাকে সংসারের খুঁটিনাটি শেখাচ্ছে।
“ভাবি আপনি প্রথমে ভাইয়ের সাথে একটু বন্ধুত্ব করবেন। পারবেন না?”
“তোমার ভাই তো ঠান্ডা মেরে আছে।”
“খালি ঠান্ডা না। জমে বরফ হয়ে গেছে। আমি আপনাকে সাহায্য করব। ভাইয়ের সাথে ভালো খাতির করবেন। বেশিদিন লাগবে না। ভাই একটু কাঙাল ধরনের মানুষ। আপনি যদি দুই একদিন নরম সরম করে ভাইয়ের সাথে কথা বলেন তৃতীয় দিন ভাই নিজেই আপনাকে খুঁজবে।”
আফরিন বিড়বিড় করল, “ঐ লোক তো নরম কথার মানুষ না। ডান্ডা না মারলে যেন মুখ দিয়ে কথাই বের হয় না।”
“একা একা কথা বইলেন না ভাবি। আমার কাছে বলেন। মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়ে তো মাঝ রাস্তায় থামা যাবে না। আচ্ছা শোনেন তারপর কি করবেন।”
“বলো।”
“খাতির তো করবেন। যখন ভালো খাতির হয়ে যাবে ফট করে একদিন বাপের বাড়ি চলে যাবেন। তারপর ভাইকে ফোন দিয়ে বলবেন আপনি আর আসবেন না। বিয়ে করেছিলেন সংসার করতে বন্ধু বন্ধু খেলার জন্য না। বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি?”
“তুমি তো সংসার ভাঙার বুদ্ধি দিচ্ছ দেখি!”
“আরে না। তখনই না ভাই বুঝবে কী পেয়েছিল আর কী হারাচ্ছে। তারপরই না আপনার কাছে ছুটে যাবে।”
“তুমি কি সিরিয়াল দেখো নাকি?” কপাল কুচকে বলল আফরিন।
তিতলি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “একদম না। আপনাদের দুই জনের কাহিনী দেখেই সময় পাচ্ছি না সিরিয়াল দেখব কখন?” একটু পর আবার বলল, “আমার বুদ্ধি কি আপনার পছন্দ হয়েছে ভাবি?”
আফরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মেয়েটা আগ্রহ করে বলেছে। সে না বলে কীভাবে?
“হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সব তো এত সহজ না। তুমি আমার জন্য দোয়া করো।”
“পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে দশবার করি ভাবি। আপনি এই যুদ্ধে জয়ী হন।”
。。。。。。。。。。
তিতলির কথা ভেবেছে আফরিন। সবটায় গুরুত্ব না দিলেও রাফির সাথে বন্ধুত্ব করার বিষয়টা তার মনে ধরেছে। এই লোকের সাথেই তো সংসার করতে হবে। কিন্তু তার তো মনে হয় না সংসার নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা আছে। যা করার আফরিনকেই করতে হবে। নিজে থেকে যেচে পড়ে কথা বলতে হবে। লোকটা বেহায়া ভাববে না? ভাবুক। একটা চেষ্টা করবে আফরিন। এভাবে হাল ছেড়ে বসে থাকার মানে হয় না।
রাতে রাফির ঘরে গেল আফরিন। আদর্শ ব্যাচেলরের মতো ঘর। বিছানা আলমারির কাজ করছে। বারান্দার দরজা কতদিন ধরে খোলা হয় না আল্লাহ জানেন। পুরো ঘর অগোছালো। তিতলি বলছিল সপ্তাহে দুই তিনদিন এসে সে ঘর মুছে যায়। গোছালেও আবার ওরকম হয় বলে আর গোছগাছ করে না। আফরিন ওড়না ভালোভাবে বেঁধে কাজে নামলো। শত্রুর গণ্ডি দখলে নিয়েই তাকে হা-ম-লা করতে হবে।
কাল থেকে সে ভার্সিটিতে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা দিনের ভেলা এসব গোছগাছ করলে রাফিকে দেখাবে কীভাবে? এই গোছগাছ সে করছে মূলত রাফির সাথে একটা সাক্ষাতের আশায়।
আফরিনের আশা পূরণ হলো। পুরো বিছানার কাপড় গুছিয়ে সে সোফায় রেখেছে। যেগুলো বেশি নোংরা মনে হচ্ছিল সেগুলো আলাদা করে এক পাশে রেখে বিছানার চাদর উঠিয়ে ফেলেছে। তখনই পড়েছে বিপদে। নতুন চাদর কোথায় পাবে সে?
ফ্যান বন্ধ ছিল বিধায় ঘেমে নেয়ে আফরিনের একাকার অবস্থা হয়েছে। ওড়না খুলে মুখ, গলা মুছে একটু হাঁফ ছাড়ল সে। তিতলির কাছে যেতে হবে এখন।
তাকে সাহায্য করতেই সেই মুহূর্তে রাফির উদয় হলো। আফরিন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরের তুমুল অস্বস্তি বুঝতে না দিয়ে সোফার উপর থেকে ওড়না টেনে গায়ে দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “চলে এসেছেন?”
রাফির চোখ দুটো আরেকটু হলেই কোটর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে বলে আফরিনের ধারণা। সে কপালের চুল সরাতে সরাতে বলল, “সাজগোজ না করেই এই অবস্থা? এজন্যই বিয়ের দিন আমার দিকে তাকাননি? নাহলে তো ফিট খেয়ে পড়ে থাকতেন।”
রাফি আশ্চর্য হয়ে গেল।
“কি বলছেন আপনি এসব?”
“আবার শুনতে চাচ্ছেন?”
“এসব ফালতু কথা আপনাকে কে বলেছে?”
“আপনার চেহারার মানচিত্র দেখে বললাম। যাই হোক ভালো আছেন?”
রাফি চরম বিরক্ত হলো। শেষমেষ বলেই ফেলল, “আপনাকে তো এমন ভাবিনি।”
“কেমন ভেবেছেন? আমাকে নিয়ে আপনি ভেবেওছেন! ওহ আল্লাহ! ভেবে ভেবে বিয়ের দিন ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে দরজা আটকে দিয়েছেন তাই না? আর সবাই ভাবছে বউ পছন্দ হয়নি। কি একটা অবস্থা বলেন তো।”
রাফি বলার মতো কিছু পেল না। এই মেয়েটাকে স্বল্পভাষী গম্ভীর ভেবেছিল সে।
“স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে আলমারির চাবি দিন।”
“কি করবেন?” রাফি কপালে কুচকে শুনল।
“আপনার সামনে যেহেতু দাঁড়িয়ে আছি চুরি করব না। দাদীমার ঘরে থাকছি তাই জিনিসপত্রও রাখব না। দিন চাবি দিন।”
চাবি টেবিলের ড্রয়ারে ছিল। বের করে দিল রাফি। তার চোখের সন্দেহ ভাব তখনও দুর হয়নি। আফরিন নিজের উপরে হতাশ হলো। একটু খুঁজে দেখলেই হতো।
আলমারি খুলে একে একে সব ভাঁজ করা কাপড় রেখে একটা ট্রাউজার আর গেঞ্জি রাফির হাতে ধরিয়ে দিল আফরিন।
“যান হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পাল্টে আসুন।”
“এগুলো আমি নিজেই করতে পারি।” থমথমে কণ্ঠে বলল রাফি।
“আমি কি আপনাকে কিছু করে দিতে চেয়েছি নাকি?” বিরক্তি ঝরে পড়ল আফরিন কণ্ঠ থেকে।
“আমি আলমারি গোছানোর কথা বলছি।”
“এজন্যই এসব জমা করে রেখেছিলেন খাটের উপরে? নাকি আপনাদের গার্মেন্টস আছে বলে শো করছেন?”
রাফি ক্ষুব্ধ চোখে তাকালো। আফরিন হেসে বলল, “আপনার পারাপারির নমুনা দেখবেন? দেখুন পুরো ঘরের ফ্লোরে ফুল ছিটানো। তিতলি আসেনি গোছানোও হয়নি। এবার আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে না থেকে বাথরুমে যান।”
রাফি চলে গেলে বুকে হাত দিয়ে দম ছাড়ল আফরিন। সারাজীবন ছেলে মানুষের সাথে খটমট করে কথা বলে এসেছে। কথার কোনায় এছিল ত্যাড়ামির সুর। নিজের বরের সাথেও যে এভাবে কথা বলতে হবে ভাবতে পারেনি। লোকটার জন্য এই ত্যাড়ামিই দরকার। কত বড় সাহস বিয়ে করে তাকে রেখেই দরজা আটকে দেয়! এই পর্যন্ত এক বারও এই ঘরে আসার কথা বলেনি। মগের মুল্লুক নাকি?
দ্রুত চাদর বিছিয়ে আফরিন বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “খাবার বাড়ছি। এখন দশটা পঁচিশ বাজে। পয়ত্রিশের আগে নিচে নামবেন।”
গোসল করতে করতেই রাফি ভাবনার সাগরে ডুবে গেল। আফরিন হঠাৎ এমন করছে কেন?
~চলমান~