অন্তঃপুর পর্ব-২৩+২৪

0
3

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২৩.

রাফি একবার ভাবলো যাবে না নিচে। এতে আফরিনের আদেশ ছুঁড়ে ফেলা হবে। গোসল করে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইলো সে। চোখ বন্ধ করেও অন্য চিন্তা করতে পারল না। নিচে যাওয়ার জন্য একটা অন্যরকম তাড়া অনুভব করলো রাফি। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় তাকে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে দেখা গেল।

আফরিন খাবার সামনে দিল। সে মনে মনে কথা গোছাচ্ছে। আজকে রাফির সাথে একটু কথা বলা দরকার।
রাফি প্লেট এগিয়ে নিল। সে ভেতরে ভেতরে অস্থির বোধ করছে। আফরিন ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আফরিন জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা?”
“হুঁ?”
“খাচ্ছেন না যে?”
“খাচ্ছি।”
ভাতে হাত রাখল রাফি। একপাশে ভাত আরেক পাশে কি যেন একটা ভাজি রাখা। যত্ন করে বেড়ে দিয়েছে। বাম হাতের কাছে পানি ভরতি গ্লাস। দুটো পদের তরকারি সামনে রাখা। ধোঁয়া উঠছে। এই মাত্র গরম করে এনেছে? তার জন্য? রাফি অনুভব করল তার হাতটা ভার ভার লাগছে।

আফরিন লোকটাকে পরোখ করছিল। মানুষটা শান্ত ধরনের। যা হয় সব ভেতরে ভেতরে। মনের অবস্থা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। সে হাত বাড়ালে কি ফিরিয়ে দেবে?

“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।”
রাফি এক পলক আফরিনের দিকে তাকালো। তার চোখের নরম দৃষ্টি আফরিন খেয়াল করল। লোকটার কি মন খারাপ?
“বলুন।”
“আপনি খান। আমি বলছি।”
রাফি এক লোকমা ভাত মুখে তুলল।
“মিহাদের সমস্যাটা আসলে কি?”
“মেন্টাল এজ বাড়েনি। ছয় সাতেই আটকে আছে।”
“ওকে অনেক বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড মনে হয়।”
“হ্যাঁ। ও বেশ অস্থির।”
“কেন?”
এই পর্যায়ে রাফি থেমে গেল। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে ও ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যেত। খুব ঘন ঘন এমন হওয়ায় ও ওরকমই হয়ে গেছে।”
“এর কোনো চিকিৎসা নেই?”
“ওখানে করা হয়।”
আফরিন কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “ওর কি উন্নতি হয়েছে? গতকালও ওকে অস্থির হতে দেখেছি।”
রাফি বলল, “আমি খোঁজ নেব।”

আফরিন চুপ করে গেল। রাফি আজকেও তাকে খেতে বলেনি। তার খাওয়া শেষের দিকে। আফরিন শুকনো ঢোক গিললো।
“আপনি কি কিছু ভেবেছেন?”
রাফি উঠে যাচ্ছিল। আফরিনের প্রশ্নে থামলো।
“কোন বিষয়ে?”
এক পলক রাফির দিকে তাকিয়ে আফরিন বলল, “আমাদের বিষয়ে।”
রাফির চোখের জিজ্ঞাসা দুর হয়ে গেলো। সে সদর দরজার দিকে তাকালো।
রাফি কোনো উত্তর দিল না। আফরিন বলল, “এভাবে একটা সংসার চলে না। আমি তো..”
রাফি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, “আমি উঠছি।” হনহন করে উপরে উঠে গেল সে।
আফরিন নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল। এমন অপমানিত শেষ কবে হয়েছিল তার মনে নেই। নিজেকে বেহায়া বলে মনে হচ্ছে তার। মরে গেলেও আর এই বিষয়ে কিছু বলবে না সে। চলুক সব এমন। এর শেষটা কি হবে আফরিন দেখতে চায়।

_________________

ভার্সিটিতে যেয়ে সাদমানের দেখা পেল না আফরিন। কাল কথা হয়েছিল। বলেছিল যে আসবে। কেন এলো না কে জানে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ক্লাস থেকে বের হলো আফরিন। রিকশা খুঁজতে খুঁজতে অনেকটা হাঁটলো। একটা রিকশা পেয়ে অন্যমনস্ক হয়েই বলল, “মহিলা কলেজের সামনে যাবেন?”
লোকটা রাজি হলে আফরিন উঠে পড়ল। বাড়ির সামনে এসে যখন রিকশাওয়ালা বলল, “কই নামেন?”
আফরিন চমকে চারদিকে তাকালো। সে এখানে এসেছে কেন? অভ্যাসবশত কখন এই বাড়ির ঠিকানা বলেছে খেয়ালই নেই। অগত্যা সে নেমে গেল। এসেছে যখন দেখা করেই যাওয়া যাক।
ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই আফসানা অবাক হলেন।
“কেমন আছো রিনি?” আফরিনের বুকটা ভরে গেল। ঐ বাড়িতে কেউ তাকে রিনি বলে ডাকে না।
“ভালো আছি মা।” শক্ত করে আফসানাকে জড়িয়ে ধরল সে। নাক ডুবিয়ে দিল আজন্ম পরিচিত ঘ্রাণের মাঝে।
আফসানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“জামাই এসেছে?”
“নাহ।” আফরিনের টনক নড়ল। মা কি টেনশন করবেন?
“আসবে না?”
“আমি তো কাউকে বলিনি। ভার্সিটি থেকে চলে এলাম।”
“হাসপাতালের কাজটা আর করছ না?”
“ছুটি নিয়েছি কয়েকদিন।”
“ওহ।”
“সাদ কোথায়?”
“কি জানি কোথায় গেল।”
আফসানা মেয়েকে আপ্যায়ন করতে শুরু করলেন। একটা বড় কই মাছ ভেজে দিলেন। চটপট সেমাই রান্না করলেন। আফরিনের মনে হলো সে আজীবন আফসানাকে শক্ত ভেবে ভুল করে এসেছে। আজকের আফসানাকে দেখে কেউ বলবে না তিনি গম্ভীর। হৃদয়ে লুকানো ভালোবাসার সবটা ঢেলে দিলেন তিনি। আফরিনের সব মন খারাপ নিমিষে দুর হয়ে গেল।

。。。。。。。。。。。

সেদিনের পর থেকে রাফির সাথে কম কম কথা বলে আফরিন। পারতপক্ষে মুখোমুখি হয় না। ঘর গুছিয়ে চলে আসে রাফি আসার আগেই। খাবার টেবিলে দিয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকে। রাফি টের পায় সবই। নিজের বানানো নীরবতার দেয়াল টপকে কিছু বলে উঠতে পারে না। আদৌ কি কিছু বলতে চায় সে?

শুক্রবারে আফরিন তিতলির সাথে কোমর বেঁধে নামল। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার মিশন নিয়ে। সবকিছু মোটামুটি পরিষ্কার থাকায় সেসব গোছাতে সময় লাগল না। আফরিন মাথায় হাত দিল সিলিং ফ্যানগুলো দেখে।
“এগুলো এত নোংরা কেন?”
“কি করব ভাবি? ঐগুলো কেমন করে পরিষ্কার করব?”
আফরিন ওড়না বেঁধে নিল। “একটা ছেঁড়া কাপড় নিয়ে আসো।”
তিতলি তার পুরাতন জামা নিয়ে এলো। সেটার এক পাশ ছিঁড়ে খাটের উপর চেয়ার নিয়ে উঠল আফরিন।
তিতলি ভীত কণ্ঠে বলল, “পড়ে যাবেন ভাবি।”
“তুমি শক্ত করে চেয়ার ধরে রাখো।”
মিশন শুরু হলো দাদীর ঘর থেকে। নিচের ঘর শেষ করে উপরে গেল সে। রাফিকে ঘরে না দেখে আফরিন বলল, “আগে এই ঘরেরটা পরিষ্কার করি। ঐদিকে পরে যাবো।”
তিতলি চেয়ার ধরল। আফরিন একটা পাখা মুছে যখন আরেকটা পাখা ধরল ঠিক তখনই ফ্যানটা ঘুরতে শুরু করল। তাল হারিয়ে সে ছিটকে পড়ল বিছানার উপর। বেকায়দায় পড়ার কারণে কাঠের চেয়ারের সাথে পায়ে লাগল ঠিক ডান পায়ের টাখনুর হাড়ে। আর্তনাদ করে পা চেপে ধরলো আফরিন।
ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে তিতলি বুঝতেই পারল না সে আসলে কি করবে। জামার চেরা টুকরোটা তখনও ফ্যানের সাথে ফুল স্পিডে ঘুরছে।

আফরিনের কাছে ছুটে গেল তিতলি, “ভাবি! কোথায় ব্যাথা পেয়েছেন?”
কোত্থেকে রাফি এগিয়ে এলো। শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারটা বিছানা থেকে নামিয়ে বলল, “কি করছিলি?”
তিতলির দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেও তার দৃষ্টি ব্যাথাতুর মুখে পা চেপে বসে থাকা আফরিনের দিকে।
“ভাবি ফ্যান মুছতে উঠেছিল।” রাফির কণ্ঠের শীতলতায় ভয় পেল তিতলি।
শক্ত রাফি কণ্ঠে বলল, “সব কিছুতে এত মাতব্বরি করতে হবে কেন? সারা দুনিয়াকে নিজের কাজ দেখা হবে? নিজেকে কি মনে করে? সর্বেসর্বা?” শেষদিকে তার কন্ঠ উঁচু হয়ে এলো। আফরিন অবাক হয়ে রাফির দিকে তাকালো। ব্যাথাটা এতক্ষণ চেপে রাখলেও এই ক্ষণে এসে তার চোখ ছলছল করে উঠল। কথা তো বলেই না যেটুকু বা বলল এমন নিষ্ঠুর বাক্য?
“আর কক্ষনো যেন এসব করতে না দেখি।” চোয়াল শক্ত করে বলে চলে গেল রাফি।
আফরিন কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, “তিতলি আমাকে একটু ধরতে পারবে?”
তিতলি ভয় পেল, “বেশি ব্যাথা লেগেছে ভাবি? পা কি মচকে গেছে?”
“জানিনা। উঠে দেখি।”
উঠে দাঁড়িয়ে আফরিন বুঝল পা মচকায়নি বটে কিন্তু অসম্ভব ব্যথায় পুরো পায়ের পাতা অবশ হয়ে আছে। তিতলির ঘাড়ে হাত রেখে সে বিড়বিড় করে আহত কণ্ঠে বলল, “নিষ্ঠুর লোক!”

রাফি তিতলিকে দিয়ে মলম পাঠিয়ে দিল। তার প্রত্যেকটা বাক্যকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করল আফরিন। সেদিন আফরিনের কথার মাঝখানে রাফি উঠে যাওয়ার পর রান্নাঘরের বাইরে তার ছায়াটুকু অন্তত দেখতে পেত রাফি। ইদানিং আর সেটাও পায় না। মুখ বুজে চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক করে সে। আফরিন যে নিভৃতবাসিনী হয়েছে তাকে আর কোনোভাবেই আশপাশে দেখতে পায় না।

~চলমান~

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২৪.

রাফি মোটামুটি ভালো রকম অস্থির সময় কাটাচ্ছে। এক মাসের মাঝে মেয়েটা তার আশপাশ দখল করে ফেলেছে। অনুমতি না নিয়েই তার ব্যাচেলর জীবনে হস্তক্ষেপ করে সব গোছগাছ করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে।
এখন নিজের বিছানার চাদর টানটান দেখে অভ্যস্ত রাফি। বেড সাইড টেবিলের জগটা সবসময় ভরা থাকবে এটা সে জানে। আগামী দিন সে অফিসে কি পরে যাবে এটা নিয়েও তাকে আলাদা করে সময় ব্যয় করতে হয় না। কাপড় চোপড় ধোয়া নিয়ে তিতলিকে ডাকাডাকি করতে হয় না। রাফি বুঝতে পারছে সে ধীরে ধীরে আফরিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

সেদিন ধমক দেয়ার পর থেকে মেয়েটা তার ছায়া অবধি মাড়ায় না। ধমক কি সে আনন্দ নিয়ে দিয়েছে? ওরকম বেখেয়াল একটা কাজ করে কীভাবে মেয়েটা? আরেকটু এদিক সেদিক হলেই.. ভাবতে চায় না রাফির। বুকটা কেঁপে ওঠে।

রাফি আরো একটা জিনিস বুঝতে পারছে। দাদীমার পর এই মেয়েটাই তাকে এভাবে যত্ন করছে। তবে দাদীমার যত্ন আর আফরিনের যত্নের মাঝে একটা সূক্ষ্ম অথচ তীব্র পার্থক্য আছে। রাফি এড়িয়ে যেতে চায় সেটা। অথচ চোখ বুজলেও সে ওটাই দেখতে পায়।

গোসল সেরে আসতেই বিছানার উপরে নেভি ব্লু রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট ইস্ত্রি করা পেল রাফি। ভুরু কুচকে গেল টাই না দেখে। শার্ট সরাতেই পেছনে সেটা উকি দিল। প্রথম কয়েকদিন সে অবাক হয়েছে। মাঝের কয়েকদিন এই সাহায্যের বিপরীতে মেয়েটা কি চাইতে পারে ভেবে ভেবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তবুও আফরিনের টিকিটির দেখাও মেলেনি। ততদিনে রাফি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অন্তঃবাসীনি তার সবকিছুতে নিজের ছাপ রেখে যাবে কিন্তু নিজে ধরা দেবে না।
গোছগাছ করে নিচে নামতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। হাতে যথেষ্ট সময় আছে। সাড়ে নয়টায় বের হলেই চলবে। আজকে তার একটা পরিকল্পনা আছে। দেখা যাক সেটা কতটুকু সফল হয়।

আফরিন ধীরে সুস্থে রুটি বানাচ্ছে। কেবল বাজে সাড়ে আটটা। রাফি নিচে নামবে নয়টায়। ততক্ষণে তার সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর একদম বাথরুমে ঢুকে পড়বে সে। গোসল করে গুছিয়ে সোজা ভার্সিটি। রাফি ততক্ষণে অফিসে চলে যাবে। এভাবেই চলছে গত একমাস।
মিষ্টি কুমড়া ভাজি নামিয়ে ডিম ভাজি করল আফরিন। তিতলি এখনো এদিকে আসেনি। ঘুমাচ্ছে বোধহয়। গতকাল রাত প্রায় একটা পর্যন্ত তার সাথে গল্প করেছে। সে যে বেদে পাড়ার ছেলে মেয়েদের পড়াত এটা শুনেই তাকে চেপে ধরেছে। ওসব আলাপ করতে করতে কখন যে অত রাত হয়ে গেল খেয়াল করেনি আফরিন। একটার সময় ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। ধমক টমক দিয়ে তিতলিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমাক তিতলি। সে যাওয়ার আগে বলে যাবে যেন রাফি খাওয়ার সময় একটু সামনে সামনে থাকে। কিছু লাগলেও তো লোকটা বলবে না। তাকে মনের ভেতরে ঢুকে সেই খবর জেনে নিতে হবে। তা বাপু এজন্য মনে দরজা একটু খোলা তো রাখতে হয় নাকি? যক্ষের ধন সংরক্ষণের মতো সেটা যদি মস্ত তালা দিয়ে আটকে রাখে তাহলে আফরিন ঐ মনের খোঁজ পাবে কীভাবে? সে তো অন্তর্যামী না।
প্লেটে রুটি নিয়ে গুনল আফরিন। দশটা। মাহমুদ আর আসিফার জন্য দুটো দুটো করে চারটা। রুমিলা একটাও খান দুটোও খান। রাফি কখনও দুটো কখনও তিনটে। বাকি থাকলে কখনও সেটা তিতলি খায় কখনও বা আফরিন বিকেলে একটু গরম করে খেয়ে ফেলে। নাবিলা রুটির থেকে ভাত পছন্দ করে। এক চামচ ভাত হলেই পাঁচ ছ ঘণ্টার জন্য তার মুখ ব্লক হয়ে যায়।
প্লেট ডাইনিং টেবিলে রেখে রান্নাঘরে ফিরে এলো আফরিন। চারপাশে কেউ নেই। বাগানে পাখি ডাকছে। সুন্দর নরম একটা বাতাস চারপাশে বয়ে যাচ্ছে। আফরিনের বড় ভাল লাগে। আনমনেই সে গুনগুন করে ওঠে, “দুর হতে আমি তারে সাধিব, গোপনে বিরহ ডোরে বাধিব।”
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামছে রাফি। জুতার খটখট শব্দ যেন না হয় এজন্য সতর্ক থাকতে হচ্ছে। শব্দ পেলেই তো আফরিন উড়ে যেয়ে হ্যালির ধূমকেতুর মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে। তারপর তাকে দুই হাজার একষট্টি সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অসম্ভব! মজলিশে মোহর পরিশোধ করে নিজের বিয়ে করা বউকে দেখতে কত কষ্ট করতে হচ্ছে! আহারে বেচারা! রাফির নিজের উপর মায়া হলো। মায়া করতে যেয়ে সে টের পেলো না মস্তিষ্কের অবচেতন অংশ কি ভয়ংকর বিষয়টা অবলীলায় মেনে নিয়েছে।
কাছাকাছি আসতেই আফরিনের গুনগুন কানে এলো। রাফি রোষপূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো। এই তাহলে এই মেয়ের ফন্দি? গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধা? সে তো সফলভাবে সেই কাজ করে চলেছে।

ডিম ভাজি একটা প্লেটে নিয়ে মিষ্টি কুমড়া আর ডিম ডাইনিংয়ে রাখতে এলো আফরিন। রাফি কি মনে করে চট করে লুকিয়ে গেল। আফরিন আবার রান্নাঘরে ফেরত গেলে নিঃশব্দে রান্নাঘরের দরজায় যেয়ে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কেমন আছেন মিসেস আফরিন?”
কড়াই ধরা হাতটা নিমিষেই থেমে গেল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আফরিন।
রাফি ভীষণ মজা পেল আফরিনের স্থির মূর্তি দেখে। আরেকটু বিরক্ত করতে এগিয়ে এসে একদম আফরিনের পিছে দাঁড়ালো। তার ঘাড়ের উপর দিয়ে উকি দিয়ে বলল, “কী রান্না করছেন?”
“আপনার কলিজা ভুনা!” মনে মনে বলল আফরিন। মুখ দিয়ে বলার মতো পরিস্থিতে সে তো নেই। লোকটা একেবারে ঘাড়ের উপর এসে দাঁড়িয়েছে। নিশ্বাসটাও বন্ধ করে রেখেছে আফরিন। মনে হচ্ছে নিশ্বাস নিলেই নড়ে যাবে আর রাফির সাথে ধাক্কা খাবে।
“এ কি! আপনি স্ট্যাচু হয়ে গেলেন কেন?”
আফরিন ঝট করে সরে যেয়ে সিঙ্কের সাথে ঘেষে দাঁড়াল। পারলে সিঙ্কের উপরেই উঠে পড়ে সে।
“এমনি।” ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলল আফরিন। এই লোক এখন এখানে কেন? নয়টা কি বেজে গেছে? সে যে মাত্র দেখল সাড়ে আটটা। আড়চোখে একবার দেখল আফরিন। লোকটা মুখে একহাত সমান হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নাকাল করতে পেরে খুব মজা পাচ্ছে।
“কী রান্না করলেন?” রাফিকে এগিয়ে আসতে দেখে আফরিন দ্রুত সরে উল্টোদিকে ফ্রিজের কাছে চলে গেল। বিনা কারণে নরমালের পাল্লা খুলে বলল, “মিষ্টি কুমড়া আর ডিম ভাজি।”
“ওহ। আলু ভাজি করেননি?”
“না।”
“আপনার হাতের আলু ভাজিটা দারুন।”
আফরিন ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করল। এই লোক আজ হঠাৎ তার প্রশংসা করছে কেন? এমনিতে তো মুখটাও দেখতে চায় না।
“থ্যাংকস।”
“এভাবে শক্ত শক্ত করে কথা বলছেন কেন?”
“আমি নরম করে কথা বলতে পারি না।”
“তাই? কে যেন রাতভোর তিতলিকে গল্প শোনায়। নরম করে।”
আফরিনের মনে হলো সে মাটির নিচে ঢুকে যাক। এই লোক তো দেখা যাচ্ছে তার উপরে রীতিমত নজরদারি করেছে।
“আমার তো মনে হচ্ছে আপনি আমার সাথেই শুধু কথা বলতে চান না।”
আফরিন ঘুরে তাকাল। সোজা তাকালো রাফির চোখের দিকে। রাফি এই দৃষ্টি নিতে পারে না। চোখ ঘুরিয়ে ফেলে।
“কথাটা উল্টো হবে না?”
“কেমন?”
“আপনিই আমার সাথে কথা বলতে চান না।”
“এখন তাহলে বলছি কেন?”
“আমিও সেটাই ভাবছি। বকাঝকা করতে চাইলে করে চলে যান। এত টাইম ওয়েস্ট করার কি দরকার?”
রাফি থমথমে মুখে বলল, “আমি আপনাকে সবসময় বকাঝকা করি?”
“ফর ইওর কাইন্ড ইনফর্মেশন! এই এক মাসে আপনি আমার সাথে যেচে কথা বলেছে দুদিন। সেদিন বকা দিলেন আর আজ।”
রাফি কি লজ্জা পেল? আফরিনের কেন যেন তাই মনে হল।
আফরিনের দিকে তাকাল রাফি, “আমি তো অকারণে বকিনি। ফ্যানের সুইচ দেয়া ছিল। কারেন্ট আসায় ঐ অবস্থা হয়েছে। একটু খেয়াল করা উচিত ছিল না আপনার? আর এসব কাজ আপনার করারই কী দরকার? বাড়িতে কি কাজের লোকের অভাব?” প্রথম দিকে নরম কণ্ঠে বললেও শেষটায় রাফির কন্ঠ কিছুটা শক্ত হয়ে এল।
আফরিন ভেজানো কড়াইটা ধুয়ে ফেলল। হাত ধুয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, “এ বাড়িতে কাজের লোক আছে। তাদের কাজ আছে। ড্রাইভার, দারোয়ান, মালি সবাই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে, কাজ করছে। আমি কী উদ্দেশ্যে এসেছি? আমার কাজ কী?”
রাফি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। উত্তর দিতে পারল না। আফরিন তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল, “টেবিলে খাবার রাখা আছে। খেয়ে নিয়েন।”

⁠。。。。。。。。

অফিসের পুরোটা সময় অস্থির হয়ে কাটাল রাফি। আফরিনের সাথে কি সে অন্যায় করছে? সেও কি মাহমুদের মতো হয়ে যাচ্ছে? প্রশ্নটা তাকে কুড়ে কুড়ে খেল। উপায় না পেয়ে অনিকের কাছে ফোন দিল সে। অনিক কল রিসিভ করেই বলল, “রাফি মিটিংয়ে আছি। তোকে দশটা মিনিট পরে ফোন দেই।”
দশ মিনিট পার হওয়ার আগেই অনিক কল দিল। রাফি ফোন ধরে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, “অনিক?”
“বল ব্যাটা! বিবাহিত জীবন কেমন যাচ্ছে?”
“বুঝতে পারছি না।” চোখ বন্ধ করে ঘাড় এলিয়ে দিল রাফি।
“কেন? টক, ঝাল নাকি মিষ্টি? আসলেই বুঝতে পারছিস না! তোর তো সেন্সর নষ্ট হয়ে গেছে রে!”
রাফি উত্তর দিল না। অনিক নিচু কণ্ঠে বলল, “রাফি বুঝিস কিন্তু! সমস্যা হলে আগে থেকে বল। এখন দুই এক ফাইলে কাজ হলে পরে লাগবে চার পাঁচ ফাইল। ঝামেলার কাজ। এখনই ডিটেইল বল। কি সমস্যা?”
“চুপ কর তো! সবসময় বাজে বকা!”
“তুইই তো বললি বুঝতে পারছিস না। মানুষের ভাল করলেও দোষ।”
“খারাপ ভাল কিছুই তোকে করতে হবে না।”
“তাহলে আমাকে ফোন দিয়েছিস কীসের জন্য?”
রাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অনিক নরম কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে রাফি?”
“আফরিন মনে হয় আমার উপর রাগ করে আছে।”
“ওয়াইফ হাজবেন্ডের উপরে রাগ করবে এটা পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠার মতো স্বাভাবিক। উল্টোটা হলেই বরং বিপদ।”
“ছোটখাট রাগ না। প্রায় এক মাস ধরে সামনেই আসে না।”
“বলিস কি!” তারপরই অনিকের টনক নড়ল, “তোর বিয়েই তো হয়েছে এক মাস।” অনিকের কণ্ঠে সন্দেহ।
“হুঁ। তারপর থেকেই।”
“কী করেছিস তুই?”
“কিছুই না। একদিন একটু বকেছিলাম।”
“সরি বলেছিলি?”
“সরি বলব কেন? অকারণে তো বকিনি।”
“সাইয়েদ সাহেব! আপনার বুকে কত বড় পাটা শুনি? বিয়ের এক মাস হতে না হতেই বউকে বকে বসে আছেন। তার উপরে বলেননি সরি। আপনাকে পাঁচ রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ডের সাথে ঝুলিয়ে রাখা উচিত। পৃথিবী দেখুক এখনও এমন মানুষ দুনিয়ায় আছে।”
“অনিক!”
“এই এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড! বললি সামনেই আসে না। আসলেই?”
“হুঁ।”
“কেন? আলাদা ঘরে থাকে নাকি?” অনিকের কণ্ঠে তুমুল সন্দেহ।
রাফি আমতা আমতা করল। কিছু বলল না।
অনিকের সন্দেহ বাড়ল, “বেশি পার্সোনাল প্রশ্ন করার জন্য আমি মোটেও দুঃখিত না। কী ঘোট পাকিয়েছিস শিগগির বল!”
“সবসময় কি ঝামেলা আমিই পাকাই?”
“সবসময়। তুই কি তোর বউকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিস?”
“আরে না।”
“তাহলে?”
“ও ও তো দাদীমার সাথে থাকে।”
“মানে!” অনিক চিৎকার করে উঠল। আশপাশ তাকিয়ে নিজেকে দমাতে চাইলেও পারল না। ছাগলটা করেছে কি!
“চেচাচ্ছিস কেন?”
“আফরিন দাদীর সাথে থাকে মানে কি?”
“প্রথম দিন থেকেই ও দাদীমার সাথে থাকে।”
“তুই কি কিছু বলেছিলি?”
“না।”
“কি আজব! ও আসেনি কেন তাহলে? বাড়িতে কি একটা মানুষ ছিল না ওকে তোর ঘর অবধি পৌঁছে দেয়ার জন্য?”
“আমি যখন বাইরে থেকে যাই তখন ও ডাইনিংয়েই বসে ছিল। আমার ভাল লাগছিল না তাই দরজা আটকে দিয়েছিলাম। ও আর যায়নি।”
“রাফি শুকরিয়া আদায় কর তুই আমার সামনে নাই। নাহলে আমার জুতা অফ কোর্স তোর গালেই থাকত। কি রাবিশ মার্কা কথাবার্তা বলছিস তুই জানিস? তোর মা এই দুনিয়ার খবর রাখে না। আত্মীয় একটাও ক্লোজ না। মেয়েটা ঐ অবস্থায় কীভাবে ছিল বুঝতে পারছিস তুই? ও কেন তোর ঘরে একা একা যাবে? তোর কি উচিৎ ছিল না ওকে নিয়ে যাওয়া? বাপের বাড়ি থেকে এনে ফেলে রেখেছিস। এটুকু করতে পারবি না তাহলে বিয়ে করেছিস কেন?”
রাফি কিছু বলল না। এই বিষয়ে সে ভেবেছে। শেষ পর্যন্ত নিজেকেই দোষী পেয়েছে। অনিক কিছু ভুল বলছে না।
“আফরিন কি পরিমান হীনম্মন্যতা নিয়ে ওখানে আছে তুই বুঝতে পারছিস! বরের বদলে দাদী শাশুড়ির সাথে থাকাটা নিশ্চয়ই সুখের না। এই তোর শ্বশুরবাড়ির লোক তোকে চার্জ করেনি?”
“আফরিন সম্ভবত কিছু বলেনি। আমার শ্বশুর আজকেও ফোন দিয়েছিলেন। স্বাভাবিক কথাবার্তা বললেন।”
“রাফি! কত বড় বাঁচা বেচেছিস তুই নিজেও জানিস না। তোর বউ চাইলেই পারত এসব নিয়ে বিচার দিতে। শুধুমাত্র তোর মানসম্মানের জন্য বলেনি। খেতে না পেরে নিশ্চয়ই ও তোকে বিয়ে করেনি যে তিন বেলা পেট ভরে খেয়ে চুপ থাকবে। কাম অন রাফি! মাথাটা এবার কাজে লাগা! বড় কোনো ডিজাস্টার হওয়ার আগে ওয়েক আপ!”
রাফি ফোন রেখে দিল। জানালার স্বচ্ছ থাই গ্লাসের আয়নায় তাকাতেই সে মাহমুদকে দেখতে পেল।

~চলমান~