#টার্নিং_পয়েন্ট
#দ্বিতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
…এত সকালে ছাদে কী করছিস?
…ঘুমটা তাড়াতাড়ি ভে ঙে গেল তো, তাই ভাবলাম একটু ছাদে এসে বসি। তুমিও তো দেখছি আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছো বৌদি।
…হুম রে, কদিন ধরেই একটা কথা বলবো ভাবছিলাম তোকে।
…আমাকে?
…হ্যাঁ তোকে, বাড়িতে সবসময় কেউ না কেউ থাকে, তাই সে ভাবে একা তোকে পাই না। আমার কয়েকটা প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিবি মন?
…তুমি কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
…আমি মাত্র ২ বছর হলো এই বাড়িতে এসেছি। কিন্তু এই ২ বছরে এই বাড়ির সকলের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি, তাই খুব সহজেই এই বাড়িটা ‘আমার’ হয়ে উঠেছে। তোর আমার সম্পর্ক ননদ-বৌদির হলেও, তোকে আমি আমার নিজের বোনের মতো ভালোবাসি। তাই আজ আমার কাছে কিছু লুকাবি না।
…(মনামী কিছুটা ঘাবড়ে গেল) ঠিক আছে বলো, কী জানতে চাও?
…তোর আর মানবের ব্যাপারে। আমার মনে হয় তোদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
…তুমি কী করে জানলে? তুমি এইসব দাদাকে বলো নি তো?
…না, তোর দাদার সাথে আমার কোনো কথা হয় নি এই ব্যাপারে। তবে তোকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি। ওই ছেলেটার জালে একদম ফাঁ’সবি না। আমার ওকে মোটেও ভালো লাগে না। বিয়ের আগে, তোর দাদার সাথে যতবার ঝ’গড়া হয়েছে, তা ওর জন্য। কিছু না কিছু ভাবে আমাদের ঝ’গড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল ও।
…এইসব তো আমাকে আগে বলো নি তুমি।
…আমি এইসব তোকে কোনোদিনই বলতে চাই নি। কিন্তু আজ আমি বাধ্য হচ্ছি। নিজের কি অবস্থা করেছিস, দেখেছিস আয়নাতে? বাড়ির কেউ না বুঝতে পারুক, আমি ঠিকই পেরেছি।
কয়েকমাস আগেই বুঝতে পেরেছিলাম তোর আর মানবের হাবভাব দেখে। তখনই তোর সাথে কথা বলা উচিত ছিল আমার।
…কিন্তু বৌদি ও আমার সাথে এত বড় অ’ন্যায় করলো কী ভাবে? আমি তো সত্যিই ওকে ভালোবেসেছিলাম।
…আমি তোর অবস্থাটা বুঝি। তুই একটু নিজেকে সময় দে। সময় সব ঠিক করে দেয়। আর হ্যাঁ একটা রিকুয়েষ্ট আছে তোর কাছে, একটা ফালতু ছেলের জন্য বোকা বোকা কোনো ডিসিশন নিবি না।
বৌদি চলে যাওয়ার পর, আরও কিছুক্ষণ মনামী ছাদেই বসে থাকলো। শরতের সকালের রোদ গায়ে এসে পড়লো। এখন আর কোনটা ঠিক কোনটা ভু’ল, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না মনামী।
অনিমেষদার লেখা এখন মনামীর জীবন যেন চালনা করছে।
দুপুরের দিকে খাওয়ার পর বৌদি আর মায়ের সাথে গল্প চলছিল, পুজোর পরেই হোস্টেলে শিফট করবে মনামী। তাই পুজোর কেনাকা’টার সাথে মনামীরও দরকারী জিনিস কেনাকা’টা চলছে। পরিচিত এক বন্ধুর ফোন এলো, বিকেলে সব বন্ধু মিলে দেখা করার কথা বলতেই, মনামী না করে দিল। পাশ থেকে বৌদি জো’র করতে লাগলো, তাই বাধ্য হয়ে মনামী রাজি হলো।
বিকেল দিকে বৌদি নিজেই মনামীকে অল্প একটু সাজিয়ে দিল। সব বন্ধুদের সাথে ভালোই বিকেলটা কা’টলো। মনামী যেন এতদিন নিজেকে একটা খাঁচাতে জো’র করে আটকে রেখেছিল। বৌদি ঠিকই বলেছে, একটা ফালতু ছেলের জন্য নিজের জীবন ন’ষ্ট করা উচিত নয়। আজ না হলেও, সময় সব ক্ষ’ত সারিয়ে দেয়। বিশ্বাস ঘা’ত’কতা তো মনামী করে নি, করেছে মানব, তাহলে কেন সে নিজেকে ক ষ্ট দেবে?
বাড়ি ফিরতে একটু সন্ধ্যে হয়ে গেল মনামীর। মনটা আজ আগের থেকে ভালো আছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আর সকালে বৌদির সাথে মন খুলে কথা বলতে পেরে আজ অনেকটা হালকা লাগছে তার। রাত্রি ১০টার দিকে পরিচিত নাম্বার থেকে ফোনটা এলো। ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার টা দেখেই, কেমন যেন হাত পা কাঁ’পতে লাগলো মনামীর। ফোনটা রিসিভ করতেই,
…তুমি আজ কাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলে? খুব তো হেসে হেসে কথা বলছিলে, তোমার ছেলে বন্ধুদের সাথে, এর মধ্যে কার সাথে সম্পর্কে জড়ালে?
মানবের কথা শুনে রা গে ফে’টে পড়লো মনামী।
…তাতে তোমার কী? আর যাই হোক, কোনো সম্পর্কে থাকাকালীন তো আর সম্পর্কে জড়াই নি। তোমার মতো তো আমি নই। আর আমাকে এই ভাবে বলার সাহস হয় কী করে তোমার? কী ভেবেছিলে? তুমি এইভাবে প্র’তারণা করার পর আমি শে’ষ হয়ে যাবো। তোমার ধারণা ভুল মানবদা। আর যদি আমাকে ফোন করো, আমি দাদাকে বলতে বাধ্য হবো।
ফোনটা রেখে দিল। কা ন্নাতে ভে ঙে পড়লো মনামী। কেন এমন করছে মানব? মনামীতে কোনো অভিযোগ ছাড়াই সরে গেছে। তাহলে এখন কী চাইছে মানব?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর টেবিলে রাখা খাতাটার দিকে নজর গেল। কেমন যেন একটা টান জন্মেছে খাতাটার প্রতি। এই মুহুর্তে মানব বা চারপাশের জগৎ ভুলে এগিয়ে গেল সে টেবিলের দিকে। যেখানে পড়া শেষ হয়েছে, ঠিক তার পরের তিনটে পাতাতে কিছু লেখা নেই, তারপরের পাতাতে লেখা আছে,
জীবনের সব থেকে নি’ষ্ঠুর কাজ, তিলে তিলে মে রে ফেলা। একটা বন্দুকের গু’লি এক নিমেষে একটা মানুষকে শে’ষ করে দেয়। কিন্তু কিছু মানুষ তিলে তিলে মা র তে ভালোবাসে। কখনো ভালোবেসে কাছে টেনে নেয়, আবার কখনো অবহেলা আর অপমানে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। একটা ভ য় ঙ্ক র মস্তিষ্ক কতবার যে তার ভাবনায় একটা মানুষকে মে রে ফেলে তার হিসেব নেই। আসলে তারা নিজেরাও জানে না, তারা কি করছে।
এরপরের পাতাতে আবার শুরু হচ্ছে অনিমেষের নতুন একটা অধ্যায়।
অনিমেষ, স্নেহাকে পেয়ে নতুন করে জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। দুজনে ভালোই আছে। বাবা মায়ের সাথে খুব বেশি কথা না হলেও, ঠাকুমা আগলে আর আদরে রেখেছেন অনিমেষকে। ডায়েরিতে কবিতা লিখতে লিখতে পাতা প্রায় শেষের দিকে। অনিমেষের ইচ্ছে সব পাতা শেষ হয়ে গেলে তারপর এই ডায়েরিতে লিখে রাখা অনিমেষের জীবন উপহার দেবে স্নেহাকে।
সম্পর্কের বয়স ২ বছর। ইদানীং স্নেহার সাথে দেখা একটু কমই হয়। তবুও কাজ বাদে যেটুকু সময় পায় অনিমেষ, সেটুকু সময়ই স্নেহার সাথে কা’টাতো। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতো স্নেহাকে নিয়ে। দিন এগিয়ে যেতে লাগলো। স্নেহা আগে চাকরিটা পেয়ে গেল। সেদিন অনিমেষ কি খুশি। দুজনে একসাথে সেলিব্রেট করলো। আরও একটা বছর পার হলো। স্নেহা ধীরে ধীরে কাজের দোহাই দিয়ে অনিমেষের থেকে দূরত্ব বাড়াতে চাইলো, অনিমেষ তা বুঝতেই পারতো না, সে সাহিত্য চর্চাতে মশগুল তখন। হঠাৎই এক বন্ধুর ফোন এলো অনিমেষের কাছে, সে নাকি স্নেহাকে একটা ছেলের সাথে কদিন ধরেই ঘুরতে দেখেছে। অনিমেষ সেই মুহুর্তে চুপ থাকলো। বিগত কয়েকদিন স্নেহার ব্যবহার আর আচরণ আরও একবার ভেবে নিল। তারপর স্নেহাকে দেখা করতে বললো।
…তুমি তো জানো, আমি অনেক ব্যস্ত।
…আমি জানি স্নেহা। কী নাম ছেলেটার?
…কী সব বলছো?
…আমি শুধু নাম জিজ্ঞাসা করেছি। আমাদের বি’চ্ছেদটা আর চার-পাঁচটা সম্পর্কের মতো কেন হবে? আমরা হেসে হেসে বিদায় নেবো।
…তুমি কী বলছো, তুমি জানো?
…হ্যাঁ জানি, ভালোবাসার প্রথম শর্ত হলো মুক্ত। আমি তোমায় জো’র করতে চাই না। তাছাড়া আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সব কিছু আর আগের মতো নেই।
…যাক তুমি তাহলে বুঝতে পারছো। আগের মতো কানেকশন আমাদের মধ্যে আর নেই। বাবা মায়ের পছন্দ অনুযায়ী আমি একজনের সাথে কথা বলা শুরু করেছি। একটা এটাচমেন্ট শুরু হয়েছে দুজনের।
…ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো।
…আর কিছু বলবে না?
…দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার। আমাদের গল্প এখানেই শেষ হলো।
পরের পাতা গুলো ওল্টাতে গিয়ে মনামী বুঝতে পারলো, চোখের জলে খাতাটা ভিজে যাচ্ছে। পরের পাতাতে দুটো লাইন লেখা ছিল শুধু
“কা টে না মায়া সহজেই, কিছু মুহুর্তের কাছে ঋণী।
সবটা জেনেও চুপ থাকার, এখন অভিনয়টা জানি।”
তার নীচে লেখা, ‘আজ এইটুকুই’…
সেই রাত নির্ঘুম কা টলেও, ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনামী। স্বপ্নের মধ্যে দেখছে, কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই চাহনি এক পুরুষের। চোখগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মনামী। যেন কিছু বলতে চাইছে। মায়ের ডাকে ঘুমটা ভে ঙে গেল, ঘড়িতে তখন সকাল ৮ টা।
মনামী একটা জিনিস খেয়াল করে দেখলো, সকালে উঠেই আর মানবের কথা ভাবছে না, এমনকি রাতেও, একবারও তার কথা মনে পড়ে নি। অনিমেষদার লেখা যেন তার জীবন এখন চালনা করছে। ফ্রেশ হয়ে যখন সকলের সাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো সে, লক্ষ্য করলো, কেমন যেন চুপচাপ সবাই আজ।
দাদা প্রথমে বললো, কোনো কিছু মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা ঠিক না। কোনো স’মস্যা থাকলে বাড়ির সকলকে বলা উচিত।
তারপর মা বললো, এইজন্যই তো পরিবার। সবাই সবার যে কোনো পরিস্থিতিতে সাথ দেবে।
তারপর বাবা বললো, মন, তোর মনে কী চলছে? তা আমাদের বল।
মনামী একবার তার বৌদির দিকে তাকালো, বৌদি ইশারা করে বোঝালো, সে কিছুই কাউকে জানায়নি। মনামীর বিশ্বাস আছে বৌদির উপর।
সে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, জো’রে জো’রে হাসতে লাগলো, সবাই অবাক হয়ে গেল, মনামীর এমন আচরণ দেখে।
তারপর মনামী হাসি থামিয়ে বললো, তাহলে বলো অভিনয়টা কেমন ছিল আমার? আমার তো কিছুই হয়নি। আমি এমনি চুপ থাকার অভিনয় করছিলাম। যাতে তোমরা আমায় অ্যাটেনশন দাও। পুজোর পরেই তো চলে যাবো হোস্টেলে, তখন তো আর এইভাবে জ্বা’লাতে পারবো না। তাই আর কি একটু মজা করছিলাম। বাড়ির সকলে হাঁ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কোনোরকমে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মনামী আবারও বললো, আরে বৌদি তো সবই জানতো, সবই বলেছি তাকে। এবার সবার নজর মনামীর বৌদির দিকে পড়লো। বৌদি তখন ঢোঁক গিলে বললো, আসলে ওই হয়েছে কি, মন আমাকে বারবার বললো, ও একটু সবার সাথে মজা করবে, তাই আর কি, আর ও খুব শ য় তা ন মেয়ে, আমাকে ফুচকার লোভ অব্দি দেখিয়েছিল।
বাড়ির লোক স্বস্তির একটা শ্বাস নিল। যাক বাবা সব তাহলে ঠিক আছে। মনামী টা খুব দু’ষ্টু হয়েছে, এত বড়ো হলো, এখনও তার ছেলেমানুষী গেল না। মনামী আর বৌদি তখন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
মনামী বহু চেষ্টার পরও, সারাদিনে একবারও অনিমেষদার লেখা আর পড়তে পারলো না। বাড়ির সকলের মনে কোনো স’ন্দে’হ ঢোকানো যাবে না। সবাই তার আচরণ দেখে কিছু একটা ভাবছে। সকালে অনেক ক’ষ্টে সে আর বৌদি মিলে ব্যাপারটা ধামা’চাপা দিয়েছে। কেমন যেন খাতাটার প্রতি একটা টান জন্মেছে। আর কয়েকটা মাত্র পাতা, তারপর গল্প শে’ষ। ডায়েরিটাই বা কোথায়? ওখানে তো অনিমেষদা সব কবিতা লিখে রেখেছে। সেটা পেলে ভালো হতো। এইসব ভাবতে ভাবতেই, আবার মানবের ফোন। দু-তিনবার কল ডিসকানেক্ট করার পরও ফোন করে যাচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে মনামী ফোন ধরতেই,
…মনামী আমার কথাটা একবার শোনো।
…আর কিছু শোনার বাকি আছে নাকি?
…আমি নিরুপায়। আমি বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছি। ভালোবাসি আমি তোমাকে।
…আবার নতুন নাটক।
…নাটক নয় মনামী। আমি যদি তোমাকে ভালো না বাসতাম, তাহলে বারবার ফোন করতাম নাকি?
…তাহলে এখন কী চাইছো?
…বিয়েটা আমাকে করতে হবে। তবে ওর প্রতি কোনো ফিলিংস আমার নেই। তোমাকে আমি ছাড়তে পারবো না। আমরা গোপনে সম্পর্কটা রাখি।
…ফের যদি আমাকে ফোন করার চেষ্টা করো, তাহলে আমি সবার সামনে তোমার মুখোশ খুলে দেবো।
“কিছু ভ য় ঙ্ক র মস্তিষ্ক তিলে তিলে মা র তে বেশি ভালোবাসে।” অনিমেষদার এই লেখাটার তাৎপর্য খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে মনামী, এই মুহুর্তে। তারমানে স্নেহাও কি এইরকম ছিল?
ফোনটা বন্ধ করে টেবিলে রাখা খাতাটা নিয়ে বসলো। পরের পাতা থেকে আবার শুরু হলো অনিমেষদার জীবন।
ভালোবাসাকে জো’র করে আটকে রাখা যায় না ঠিকই, তবে ছেড়ে যাওয়া মানুষ গুলো, সবটুকু নিয়ে কেন যায় না?
অনিমেষ একবারও স্নেহাকে ফোন করেনি। একদম চুপচাপ। ভিতরের র*ক্ত*ক্ষ*রণ প্রকাশ পায় না। তবুও নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে রাখার চেষ্টা করছে। এইভাবে দিন এগিয়ে যেতে লাগলো। ওদের বি’চ্ছেদের ঠিক ৩ মাস পর হঠাৎ একদিন রাতে স্নেহার ফোন। কা’ন্না’কা’টি করে, ক্ষ’মা চেয়ে আবার অনিমেষের জীবনে ফিরতে চাইলো। সেই রাতে অনিমেষও কেমন দুর্বল হয়ে গেল ওর কা’ন্না শুনে। আবার আগের মতো সব শুরু হলো। সেই পুরোনো স্নেহাকে ফিরে পেয়ে অনিমেষ বর্ষার সবুজ সতেজ বৃক্ষ হয়ে উঠলো। লিখে ফেললো নতুন কবিতা। তবে একমাস যেতে না যেতেই আবার স্নেহা ব’দলে গেল। এইভাবে দুটো বছর কা’টলো। কখনো সব ফেলে স্নেহা ছুটে আসতো, আবার কখনো সব ত’ছ’ন’ছ করে চলে যেত। বারবার এমন ঘটনা ঘটলেও স্নেহাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অনিমেষের ছিল না। যতবার স্নেহা ফিরতে চাইতো, ততবার যেন অনিমেষ নিজের মৃ*ত্যুকে একটু একটু করে কাছে টানতো। অবশেষে ৩ মাস পর পাকাপাকি ভাবে জানতে পারলো, স্নেহা তার বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করছে।
মনামী খাতার পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখলো এটাই খাতার শেষ পাতা। আর কোনো পাতা নেই। গল্পের শেষ পর্যায়। শেষ পাতায় লেখা আছে, “মানুষ একবার ধা’ক্কা খেলে, আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পায়। তবে বারবার একই ধা’ক্কা পেতে পেতে মানুষ ভিতর থেকে শে’ষ হয়ে যায়। একটা ভ য় ঙ্ক র মস্তিষ্ক কখনো একজনের মন বুঝতে পারে না। তারা শুধু নিজের ভালোথাকাটা বোঝে। মানুষ যখন বুঝে নেয় এবার তাকে একলা একটা পথ পার হতে হবে, সব সিন্ধান্ত নেওয়ার পর যখন কেউ এসে তার হাতটা ধরে, তখন সে একটা আশার আলো দেখে। কিন্তু পথ চলতে চলতে বারবার হাত ছেড়ে দিলে, তখন আর নিজের প্রতি আস্থা থাকে না। বাকি পথটা তখন দুর্গম লাগে। আশা-ভরসা সবটুকু কারোর উপর রাখা উচিত নয়। মানুষ ব’দলায়, প্রতি মুহুর্তে ব’দলায়।”
মনামী এই লেখাটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে। তারও অবস্থাও এখন একইরকম। আবারও শেষটা পড়তে লাগলো সে।
“আজ স্নেহার বিয়ে, আমাকে বারবার যেতে বলা হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। নিজের চোখে ওর বিয়ে হতে দেখলাম। একদম হাসি মুখে সামনেই বসে ছিলাম। লাল বেনারসিতে লাল শাড়িতে অপরূপ সুন্দরী লাগছিল তাকে।
এখন রাত্রি ২ টো, শেষ একটা কথা বলার ছিল তোমাকে, পৃথিবীটা সুন্দর, অনেক সুন্দর।
আর আমাকে পড়ার কিছু নেই। আমাকে আর খুঁজে পাবে না। তবে ডায়েরির শেষ পাতাতে লেখা আছে কিছু। আমি না থাকলে হয়তো সেটা অবহেলিত হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে, নয়তো কেউ যত্ন করে তুলে রাখবে। সেই ডায়েরির খোঁজ না করায় ভালো। ভালো থেকো। আরও একবার বলছি, পৃথিবীটা সুন্দর, শুধু একবার সব ভুলে নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে ঘুরে দাঁড়াও।”
গল্প শেষ, আর কোথাও কিছু লেখা নেই, মনামী পাগলের মতো অনিমেষদার সব পুরোনো খাতা উল্টেপাল্টে দেখলো, কোথাও কিছু নেই। না না গল্প এখানে শেষ হতে পারে না। পৃথিবীটা যদি সুন্দর হয় তার কাছে, তাহলে কেন আ* ত্ম হ* ত্যা করেছিল অনিমেষদা? ডায়েরিটা খুঁজে পেতেই হবে মনামীকে।
সকাল হলো, নিজের রুম থেকে রেডি হয়ে যখন মনামী বের হলো, তখন সকাল ৯ টা।
বেরোতে যাওয়ার সময় ধাক্কা খেল মানবের সাথে। এতদিন পর দেখা হলো। তবে আগের মতো কোনো অনুভুতি কাজ করছে না মনামীর, বরং একটু বির’ক্ত হলো সে। বাবা পাশ থেকে বললো, কোথায় যাচ্ছিস মন? মনামী বললো, একটু কাজ আছে বাবা, ফিরতে দেরি হতে পারে।
চলে যাওয়ার মুহুর্তে মানব পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললো, এই সকালে তোমার কী কাজ আছে মনামী?
মনামী এবার বির’ক্ত হয়ে বললো, আমার বাবা যখন আর দ্বিতীয় বার জিজ্ঞাসা করলো না, তখন তুমি কেন জিজ্ঞাসা করছো? বললাম তো একটু কাজ আছে।
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লো মনামী। মাথার মধ্যে এখন একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ডায়েরিটা এখন কোথায়? অনিমেষদা লিখেছে হয়তো মাটিতে মিশে গেছে নয়তো কেউ যত্ন করে রেখে দিয়েছে। যত্ন করে কে রাখবে? স্নেহা? হয়তো স্মৃতি হিসাবে রাখতেও পারে। কিন্তু এই স্নেহাকে পাবে কোথায় মনামী? আগে অনিমেষদার মা অনন্যা আন্টির সাথে কথা বলতে হবে।
মনামীর বৌদি মনামীর এই আচরণ দেখে সন্দেহ হওয়ায়, সেও মনামীকে ফলো করার জন্য বেরিয়ে পড়লো।
(পরের পর্বে শেষ হবে গল্পটি…)