প্রেমনেশা পর্ব-০৬

0
2

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৬.

চারু স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলে রুমে শুয়ে আছে। অনেকদিন পর একটু শান্তি অনুভব করছে চারু। কারণ একটু আগেই সকালের নাস্তা করে ময়না বেগম মেয়ে সহ ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছে। আহান শয়তান থাকার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। কারণ থাকবে কীভাবে? ময়না বেগম ই তো থাকবে না। তখন আহানের মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। ময়না বেগম বলেছে কয়েকদিন থাকবেন সেখানে কয়দিন নিশ্চিত করে বলেনি। যাওয়ার আগেই ফ্রিজে থাকা সব কিছু খেয়ে গেছে বাসায় এখন মাছ মাংস না থাকলেও চারু শান্তি পাচ্ছে।
ঘুমিয়ে নিল চারু। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নামাজ পরে বাসায় তালা দিয়ে পাশের বাসায় চলে গেল। কারো বাসায় যাওয়ার উপায় নেই মায়ের জন্য। তিনি কোথাও গেলেই মনে করেন চারু তার নামে বদনাম করে বেড়ায়। অনেক দিন চারুকে বাসায় আসতে দেখে প্রতিবেশী চাচি ভাবিরা দেখে খুশি হলো। চারুকে এটা ওটা অনেক কথা জিজ্ঞেস করছিল চারু কোন বদনাম করেনি চুপচাপ নিজের কথা বলে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাল। রাতে বাসায় একা থাকতে হবে এজন্য ওর চাচাতো বোন ঝিম কে নিয়ে এলো সাথে করে রাতে দুজনে একসাথে ঘুমাল।
একা বাসায় থাকতে ভয় লাগে চারুর।
দুই বোন বাসায় মজা করেই কাটাল।
ভোরে উঠেই ঝিম চলে গেল। একটু বেলা করেই উঠবে ভাবল চারু। আজকে তো তাড়া দিয়ে বকার কেউ নাই। চারু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল দরজায় খটখটে শব্দে। ধরফরিয়ে উঠে বসল চারু। চোখ ঢলে নিল কে এলো?
বুক ধক করে উঠল চারুর মা চলে এলো নাকি? ঘড়িতে দেখল দশটা বাজে আল্লাহ ও এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাল? মা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে কোন কাজ করা হয়নি বাসার এই অবস্থা দেখলে ওকে কি করবে? রাতে ঝিম আর ও দুইজনে জেগে ছিল ভালোই এজন্য সকালে এতো ঘুমালো।
ভয়ে চারু লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঝাড়ু নিয়ে ঝটপট কাজে লেগে পড়ল। ওদিকে দরজা ধাক্কাধাক্কি বেড়েই চলেছে। আল্লাহ দেরি করে দরজা খুললেও বিপদ আবার এই অবস্থায় বাসায় ঢুকলেও বিপদ। তড়িঘড়ি করে কোনরকম সব কিছু গুছিয়ে ঝাড়ু দিয়ে চারু ঘেমে অস্থির হয়ে উঠল। ওরনা কোমরে বাঁধা ছিল ঝাড়ু রেখে ওভাবেই দরজা খুলতে এলো তাড়াহুড়ো করে।
চারু ঢোক গিলে দরজা খুলতেই শক খেল। দরজার সামনে রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুব। তার পরনে নীল ট্রিশার্ট ও কালো প্যান্ট। চারু যতটা ভয় পেয়েছিল ধ্রুব কে দেখে ততটাই কঠিন হয়ে গেল ওর মুখটা।
মুখশ্রী রাগে লাল করে চারু বলল,’ আপনি..?’
ধ্রুব ওকে এলিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে বলল,’ কেন অন্য কাউকে আশা করছিলে‌ নাকি?’
চারু ধ্রুবর সামনে দরজা আটকে দিতে চাইছিল ধ্রুব হাত দিয়ে দরজা ধাক্কা দিল চারু ওর সাথে শক্তিতে কুলাতে পারল না। পিছিয়ে গেল ধাক্কা খেয়ে। দরজা খুলে যথার্থ জায়গা তৈরি করে ধ্রুব সাহেবি ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করল।

বাসা নিস্তব্ধ দেখে কপাল কুঁচকে ধ্রুব বলল,’ আমি আসব বলে বাড়ি ফাঁকা করে রেখেছ নাকি?’
চারু দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। এই
অ স ভ্য টার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার শান্তিতে বেগড়া দিতে চলে এসেছে। বুকে ফুঁ দিয়ে চারু ভাবল, মা বাসায় নেই খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। মা বাসায় থাকলে কি হতো? আল্লাহ ভয়ে এখনি ওর হাত পা কাঁপছে।
ধ্রুব পুলিশের মতো বাড়ি ঘর পর্যবেক্ষণ করছে।
চারু এগিয়ে এসে বলল,’ আপনি এখানে কেন এসেছেন? কি চান আপনি? দেখুন বাসায় কেউ নেই আমি একা একটা মেয়ে বাড়িতে দয়া করে চলে যান।’
চারু চেঁচিয়ে বলে উঠল। চারুর কথায় ধ্রুব ওর দিকে ফিরে তাকাল। চারু দেখল ধ্রুব ঠোঁটে শয়তানি হাসি।‌ ধ্রুব ওর দিকে এগিয়ে এলো। চারু পিছিয়ে গেল না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নিজেকে কোন ভাবেই দূর্বল দেখাতে চাইছে না।
ধ্রুব ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’ তুমি বাসায় একা?’
চারু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ চলে যান নয়ত আবার আমার হাতে থাপ্পর খাবেন।’
যথেষ্ট সাহসী কন্ঠে বলল চারু। ধ্রুব ওর কথায় আরো এগিয়ে এলো চারু এবার না পিছিয়ে উপায় পেল না। ভয়ে ওর হাঁটু কাঁপছে। শুকনো ঢোক গিলে চারু এক এক করে পিছিয়ে একদম দেয়ালের সাথে লেগে গেল। ধ্রুব এক হাত দেয়ালে রেখে ওর চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসলো।
চারু ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,’ কি করছেন? সরে দাড়ান প্লিজ।’
ধ্রুব চারুর ভয় যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ধ্রুব বলল,’ ভয় লাগছে মিস চারু?’
চারু আতঙ্কিত হয়ে বলল,’ আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন!’
ধ্রুব বলল,’সামান্য একটু জড়িয়ে ধরায় তোমার খুব রাগ হয়েছিল তাই না? এখন যদি আরো বেশি কিছু করি কি করবে তুমি? বাসায় তো কেউ নাই ও যে তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। হা হা হা এখন তোমার কি হবে চারু?’
চারু কাঁপা হাত মুঠো করে চট করেই ঘুসি মারতে উদ্যত হলো ধ্রুব কে। ধ্রুব যেন বুঝতেই পারছিল পরের আক্রমণ তাই তো ঠিক সময় মতো চারুর হাত খামচে শক্ত করে ধরে নেয়।
হাতটা ধরেই মুচড়ে দেয়।‌ চারু ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে। চোখ খিচে আর্তনাদ করে উঠে। ধ্রুব হাত মুচড়ে ধরেছে যে হাতে সেদিন খুন্তির ছ্যাঁকা খেয়েছিল। এখনো সেই জায়গা টাতে কালসেটে দাগ পড়ে আছে।
পোড়া জায়গায় যেন আরো ব্যথা লাগল। চারুর চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রুর ধারা নামতে লাগল।
ধ্রুব হাত মুচড়ে রেখেই বলল,’ তোমার হাতটা অনেক বেশিই চলছে মিস চারু। এটাকে কীভাবে কাবু করতে হয় আমি খুব ভালোই জানি।’
চারু কথা বলছে না নিশ্চুপ চোখের পানি ফেলছে।

চারুর মুখটা ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। চোখের পানিকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই লোকটার সামনে পানি ফেলতে চাইছে না কিন্তু চোখের পানি ওর বারণ শুনছে না। অঝোরে ঝড়েই যাচ্ছে। ধ্রুব চট করেই ওর হাত ছেঁড়ে দিল এবং সোফায় গিয়ে আয়েশ করে বসল। চারু হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। ওর কি সারাজীবন সবার অত্যাচার সহ্য করে যেতে হবে? এইজন্য কি ও বেঁচে আছে কে কীভাবে ওকে অত্যাচার নির্যাতন করতে পারে দেখার জন্য!
চারু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কাঁদছে। হঠাৎ ধ্রুবর কথায় চমকে উঠল।
‘ হয়েছে ন্যাকা কান্না এবার অফ করো। শোনো তোমাকে কাঁদতে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে জানো? আমি তো এটাই চাইছিলাম তুমি অসহায় হয়ে আমার সামনে কাঁদবে। সামনে আরো কাঁদতে হবে তাই চোখের পানি অবশিষ্ট রাখো।’ ধ্রুবর কথায় চারু চোখ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকাল ধ্রুবর দিকে।
ধ্রুব ওর চোখে চোখ রেখে ভয় পাওয়ার মতো ভঙ্গিমা করে বলল,’ মিস চারু দেখছি খুব রেগে গেছে!’
বলেই হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে বলল,’ আমি আর থাপ্পর খেতে চাই না প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।’
চারু রাগে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওখানে দাঁড়িয়ে রাগে কটমট করতে লাগল।
ধ্রুব কাকে যেন কল দিল। চারু ধ্রুবর কথা শুনে চমকে উঠল।
তেড়ে এসে বলল,’ কাকে আসতে বললেন?’
‘ আমার ফ্রেন্ডদের।’
‘ তারা এখানে আসবে কেন?’
‘ তোমার এই মুখটা ওদের দেখাতে হবে না?’
চারু নিস্তেজ কন্ঠে বলল,’ আপনি সত্যি করে বলবেন কি চান আমার কাছে? কেন আমার পেছনে লেগেছেন?’
‘ এইতো লাইনে এসেছ।’
‘ দেখুন আমি চর মারায় যদি এতো অপমানিত বোধ হয় আপনার। আমাকে দুইটার বদলে পাঁচটা চর মারুন। তবুও চলে যান। আমার পিছু ছাড়ুন। একটু শান্তি দেন আমাকে প্লিজ। আমার জীবনের অশান্তির শেষ নেই আপনি আর এই নতুন নতুন ঝামেলা অশান্তি নিয়ে আসবেন না। আমি এতো কিছু বয়ে বেড়াতে পারছি না।’ হাত জোর করে বলল চারু।
বলতে বলতে চারু ফ্লোরে ধ্রুবর পায়ের কাছে বসে পড়ল।
‘ আপনি আমাকে কি করলে ছাড়বেন? আমি আসলে সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম আমার মতো একটা গরীব মেয়ের আপনার মতো ছেলের সাথে টক্কর নেওয়া উচিত হয়নি। আপনি ভুল করলেও আমার সেটা দেখানো উচিত হয়নি। আপনি ঠিক ভুল যাই করেন সেটাই ঠিক। আমি প্রতিবাদ করে চরম অপরাধ করেছি। আমার ভুলের জন্য আমি কি করতে পারি বলুন? আপনার পা ধরে মাফ চাইতে হবে? তাহলে আমাকে শান্তি দিবেন? আচ্ছা আমি তাই করব। কিন্তু তবুও আমি চাই আপনি আমায় এই অশান্তি থেকে মুক্তি দেন‌। এতো আতংকের মধ্যে আমি আর নতুন এই ভয় নিতে পারছি না।’
চারু বলতে বলতে ফট করেই দুহাতে ধ্রুবর পা চেপে ধরল। লজ্জায় ঘৃণায় ওর মরে যেতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু প্রতিদিন এই ভয় নিয়ে ও বাঁচতে চায় না।
ধ্রুব কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।‌ বিষ্ময় এ হতবিহ্বল হয়ে গেছে ধ্রুব। আচমকাই চারু এভাবে ওর পা চেপে ধরে বসবে ধ্রুব কল্পনা করেনি। চারু ফুঁপিয়ে কাঁদছে ওর পা দুহাতে জাপ্টে ধরে। ধ্রুব কিংকিতৃব্যবিমূঢ় হয়ে ওর কান্নার শব্দ শুনছিল। কেমন রিয়েক্ট করা উচিত এই মুহূর্তে ধ্রুবর বুঝে আসছে না। কিন্তু ওর প্রচন্ড খারাপ লাগছিল এই পরিস্থিতিতে। কেন এই খারাপ লাগা অস্থিরতা আচমকাই ওর হৃদস্পন্দন জুড়ে জায়গা করে নিচ্ছিল ও জানে না কিন্তু চারু কে এভাবে অসহায় হয়ে কাঁদতে দেখে ওর দাম্ভিকতা প্রতিশোধ স্পৃহা থমকে গিয়েছিল। ধ্রুব বাক্য হারা হয়ে উঠেছে কোন শব্দ ওর কন্ঠ গহ্বর হতে বের হতে পারছিল না। এমন একটা কঠিন পরিস্থিতিতে জীবনে প্রথম বার পড়েছে। এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে হয় ধ্রুব জানে না। কিন্তু এই মুহূর্ত ওর জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়।
ধ্রুব অনেক কষ্টে বলল,’ সরো।’
চারু সরছে না তাই এবার ধ্রুব চিৎকার করে উঠল,’ সরো বলছি। পা ছাড়ো আমার।’
চারু ছিটকে উঠল। পা ছেড়ে বিস্মিত নয়নে তাকাল ধ্রুবর মুখের দিকে।
ধ্রুব উঠার চেষ্টা করছে। চারু ওকে উঠতে দিল না‌।
গাল এগিয়ে দিল ওর দিকে তারপর চোখ বন্ধ করে চারু বলল,’ মারুন এবং আপনার মনের জ্বালা মিটিয়ে নিন।’
ধ্রুবর মুখমণ্ডল রাগে লাল হয়ে উঠল চারু কে ধাক্কা দিয়ে পায়ের কাছে থেকে সরিয়ে দিল। চারু পিছিয়ে গেল। ধ্রুব উঠে দাঁড়াল এবং গটগট করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। চারু ফ্লোরে হাঁটু উঁচু করে বসে কাঁদতে লাগল।

ঝিম এলো দৌড়ে। এসেই চারু কে ফ্লোরে বসে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করল,’ আপু কি হয়েছিল তোমার?’
ঝিম আর সিঁথি সমবয়সী। চারু চোখ মুছে মেকি হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,’ ক‌ই কি হবে আমার?’
ঝিম সন্দেহ চোখে চেয়ে বলল,’ মিথ্যা বলছো কেন? না কাঁদলে কারো চোখে জল আসে?’
চারু ঝিমের গাল টেনে বলল,’ বাবার কথা মনে পড়ছিল তাই একটু কাঁদছিলাম।’
‘ শোন যে কারনে এসেছি আম্মু বলেছে তোমাকে আমাদের বাসায় খেতে যেতে। একা আর কষ্ট করে রান্না করা লাগবে না‌। চলো আমার সাথে।’
চারু যাবে না কিন্তু জোর করেই চারুকে টেনে নিয়ে এলো। চারু হাতে করেই ব্রাশ নিয়ে এলো।
ঝিম বলল,’ আপু জানো সিঁথি কিন্তু প্রেম করছে।’
চারু বলল,’ করুক আমার কি?’
‘ ছেলেটা বেশি ভালো না। আমার আম্মু তো চাচির কাছে বলেছে চাচি কিছুই বলল না।’
চারু বলল,’ তাদের বিষয়ে আমি কিছুই শুনতে চাই না ঝিম।’
ঝিম আরো অনেক কথা বলল। সকালের নাস্তা ওদের বাসায় করা হলো।‌ ঝিম চলে গেল কলেজে। এতো দেরি করায় বলল আজ ক্লাস নাই শুধু প্রাইভেট পড়বে। চারু নিজের বাসায় চলে এলো। কিন্তু বাসায় এসেও আতংক কমছে না। ধ্রুব যদি আবার আসে? সেই ভয়ে ভীত হচ্ছে চারু।
#চলবে…?