প্রেমনেশা পর্ব-০৯

0
1

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৯.

দুইদিন ঝিম এর সাথে কাটিয়ে আজকের রাতটা চারুর জন্য কষ্টকর। ব্যথায় সারারাত একাই বিছানায় পরে ছটফট করল। বৃষ্টি গভীর রাতে কমে এসেছে। রুমে ব্যথার মলম ছিল সেটা লাগিয়েছিল এজন্য ব্যথা কমেছে কিন্তু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। জ্বরে সারারাত ছটফট করেছে মাথায় একটু পানি দেবার লোক ছিল না। চারু একাই উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাথরুমে থেকে মাথায় পানি দিয়েছে। সকাল হবার ভয়ে ফজরের নামাজ পরে বসে আছে। সকালটা ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে সেই ভয়ে আছে চারু। ঝিমের পরিবার ওকে না বকতে চলে আসে চাচির সামনে মুখ তুলে দাঁড়াবে কীভাবে? ঝিম যদি ধ্রুবর কথা বলে দেয়? সবাই কি ভাববে? একা বাসায় একটা ছেলে এসেছিল লজ্জা ভয়ে বসে র‌ইল। সকাল গড়িয়ে যেতে লাগল। চারু রান্না বান্না করল না।
চারু অপেক্ষা করতে লাগল ঝিমের কিন্তু ঝিম আসল না। কেউ এসে ওর উপর চিৎকার চেঁচামেচি করল না বকলো না। চারু অবাক হলো।
এমনটা তো হ‌ওয়ার কথা না!
চারু লাল চোখ মুখে বিস্মিত হয়ে বসে আছে। কলিং বেলের শব্দে চারুর ধ্যান ভাঙল। চারু উঠল না ওর মনে হচ্ছে এখনো ধ্রুব শয়তানটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা পেয়েছে কি যখন তখন এসে ঝামেলা শুরু করে দিবে আর ও সহ্য করব অসম্ভব ও আজ দরজা খুলবে না। কয়েকবার শব্দ হলো খুলছে না ওমনি ময়না বেগমের নাম্বার থেকে কল আসলো।
চারু ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ককর্শ কন্ঠে বলে উঠলেন,’ কিরে ক‌ই গিয়ে ম র ছি স দরজা খুলছিস না কেন?’
চারুর চমকে উঠল,’ মা আমি এখনি দরজা খুলছি।’
বলেই‌ চারু উঠে দাঁড়াল। শরীর কাঁপছে জ্বরের তাপে খুঁড়িয়ে এসে দরজা খুলতেই ময়না বেগমের রাগী চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করল।
‘ এতো সময় লাগে কেন দরজা খুলতে?’
চারু বলল,’ বৃষ্টিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম বেশি হাঁটতে পারি না।’
‘ ভালোই হয়েছে মরতে বৃষ্টিতে ভিজছিস এখন ভোগ।’ ময়না বেগম গমগম কন্ঠে বলে রুমে চলে গেলেন।
সিঁথি ফোন টিপতে টিপতে নিজের রুমে চলে গেল। দুজনে চলে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু। ওকে দেখে কি একটু মায়া হয় না দুজনের? এইযে ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না শরীর কাঁপছে থরথর করে। কিন্তু দু’জনের একজন ও ওকে একবার জিজ্ঞেস করল না ও এখন কেমন আছে? দুইদিন একা বাসায় কিভাবে কাটাল।
চারুর চোখে জলে টাইটুম্বুর হয়ে উঠল। চারু দরজা আটকে ভেতরে আসতেই দুজনেই ঠান্ডা পানি চাইল। চারু ব্যথা শরীর নিয়ে দুজনের জন্য ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে গ্লাসে ঢেলে নিয়ে গেল।

গলির মাথায় একটা মদি দোকান আছে। সেখানে থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনে থাকে চারু রা। ময়না বেগম বাসায় এসেই কি খাবেন চিন্তা পরে গেলেন কারণ কিছুই নেই। তার মেয়ে সিঁথি ভালো কিছু ছাড়া খেতে পারে না। চারুর হাতে একশ টাকা দিয়ে বললেন এক হালি ডিম নিয়ে আসতে। চারু হতবুদ্ধি চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’মা আমার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে এই অবস্থায় আমি দোকানে কিভাবে যাব?’
ময়না বেগম ওর বাহানা শুনে রাগে ফেটে পড়লেন,’ আরামেই তো ছিলি জ্বর আসলো কেন? তোর শরীর আরাম পছন্দ করে না তোকে কাজে না রাখলে তুই ঠিক হবি না। চুপচাপ তাল বাহানা বাদ দিয়ে যা ডিম নিয়ে আয়। সিঁথি ডিম ছাড়া ভাত খেতে পারবে না।’
চারুর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগল।
‘ তোমার কি একটুও মায়া হয়না আমার জন্য মা? আমি তোমার পেটের মেয়ে নাই হতে পারি কিন্তু ছোটো বেলা থেকে তোমার চোখের সামনে বড়ো হয়েছি একটু ও মায়া মহব্বত আমার জন্য অবশিষ্ট নেই?’
‘ দেখ ন্যাকা কান্না করে আমার মাথা খাইস না। এমনিতেই অনেক দূরে থেকে এসেছি‌। তোর জন্য চিন্তা করি বলেই এখন দোকানে পাঠাচ্ছি নয়ত বাজারে পাঠাতাম।’
চারু নিজের চোখের পানি মুছে ফেলল। চাপা অভিমান জড়িয়ে ধরল ওকে। কেউ ওর জন্য মায়া করে না। ও কি এতোটাই খারাপ? ওর কষ্ট কারো চোখে কেন ধরা পরে না? নিজের ভাগ্য কে আর কতো দোষারোপ করবে? ময়না বেগম ওকে কখনোই মহব্বত করেনি আর করবেও না তার কাছে কেন মায়ের ভালোবাসা স্নেহ চায় বারবার ভিক্ষার মতো।
চারুর চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। চারু ঝিমদের বাড়ির পাশ থেকে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝিমের রুমের জানালা দেখা যাচ্ছে। ঝিমের বাবারা তিন ভাই ওদের বাসাটা তিন তলা। ঝিম রা নিচ তলায় থাকে। রাস্তার সাথে রুমটা ওর জানালা খোলা আছে চারু উঁকি মারল রুমে। ঝিম বসে আছে বিছানায় চারু ওকে ডাকল,’ এই ঝিম।’
ঝিম ওর দিকে ফিরল না।
চারু আবার ডাকল,’ ঝিম ওই ঝিম শোন না।’
ঝিম উঠে দাঁড়াল তারপর ওর মুখের উপর দড়াম করে জানালা আটকে দিল‌। চারু ব্যর্থ মুখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
আরেকবার ডাকল দরজায় টোকা দিয়ে,’ রিমঝিম শোন না। রাগ করে থাকিস না আমার উপর। তুই বাসায় আমার কথা জানাইস নাই তাই না? এতেই তো বোঝা যায় তুই আমায় এখনো ভুল বুঝিস নাই।’
ঝিম জানালা কান লাগিয়ে ওর কথা শুনছিল। চারু দুই মিনিট দাঁড়িয়ে র‌ইল ঝিমের জানালা খোলার জন্য কিন্তু ঝিম দরজা খুলল না চারু চলে গেল। মাথা ব্যথা করছে খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে না‌ একটুও। চোখের সামনে বারবার অন্ধকার হয়ে আসছে। কপালে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে মদি দোকানে আসলো। দুই মিনিটের রাস্তা চারুর পাড় করতে দশ মিনিট লেগে গেল। কষ্ট করে জোর করে হাঁটার ফলে ওর শরীর ঘেমে উঠল। জ্বরের মধ্যেও ঘাম হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠল চারু।
দোকানের সামনে এসে চারু দেখল অনেক লোক। ও নিজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে যাবে কিন্তু সুযোগ‌ই পাচ্ছে না বলার।
হাঁপিয়ে উঠল সেকেন্ড এ।
অনেক কষ্টে চারু দোকানদার কে বলতে পারল ডিম পলিথিনে মুড়িয়ে দিল। চারু হাতে নিয়েই স্বস্তি অনুভব করল। কিন্তু এখন টাকা ফেরত নিতে পারছে না। কারণ ও একটু সরে দাড়াতেই আরেকজন ঢুকে গেছে। বাকি টাকা নেওয়ার জন্য লোকটাকে সরতে বলছে সে নড়ছে না চারু বলল,’ আঙ্কেল আমার টাকা নিতে দিন আমার ডিম নেওয়া শেষ।’
‘ দুই মিনিট দাঁড়াও না।’ বিরক্তিকর মুখে বললেন লোকটা।
চারু সরে দাঁড়াল। মাথা ঘোরাতে লাগল কেমন জানি চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা হয়ে এলো। চারু চমকে উঠল পাশে একটা মহিলা ছিল তার বাহু চেপে ধরল ভয়ে।
তারপর চোখের সামনে সবটাই অন্ধকার হয়ে গেল। চারুর হাত থেকে ডিমের পলিথিন পরে ডিম ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। চারু অজ্ঞান হয়ে সেই মহিলাটার উপর পরে গেল।
চারু কে অজ্ঞান হতে দেখে দোকানে থাকা সবাই চমকে উঠল। ওদের মহল্লার কয়েকজন ছিল তারা এগিয়ে এলো।
‘ আরে এটা তো আমাদের চারু কি হলো ওর?’
মহিলাটা চারুর গা স্পর্শ করে বলল,’ মেয়েটার গায়ে তো খুব জ্বর। মনে হচ্ছে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে গেছে।’

মহিলাটা চারুকে ধরে রেখেছে তখনি পাশ থেকে কেউ একজন তার হাতের তল থেকে টেনে নেয় চারু কে। মহিলাটা চমকে উঠে।
ধ্রুব পাশেই ছিল। এদিকে দিয়ে ও যাচ্ছিল গাড়ি নিয়ে চারুকে হেঁটে আসতে দেখে ধ্রুব গাড়ি থামিয়ে নজর রাখছিল ওর উপর। দূর থেকে চারু কে অসুস্থ লাগছিল। হঠাৎ ওর চোখের সামনেই চারু অচেতন হয়ে পরে যায় চমকে উঠে ধ্রুব। কোন কিছু না ভেবেই গাড়ি থেকে নেমে ছুটে আসে। চারু কে পরে যেতে দেখে ও কেন ছুটে এলো ও নিজেও জানে না। মহিলাটা সহ চারুর মহল্লার লোকগুলো অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তাদের প্রতিবেশী চারু কে অপরিচিত একটা ছেলে ধরে রেখেছে বিষয়টা তাদের হজম হচ্ছে না।
ধ্রুব চারুকে টাচ করে ছিটকে উঠল। আগুনের মতো গরম চারুর শরীর। মাত্রাতিরিক্ত জ্বরের জন্য এই অবস্থা বুঝতে বাকি র‌ইল না ওর। চারুকে এই অবস্থায় দোকানে এসে কেনাকাটা করার জন্য ভীষণ রাগ হলো।
মনে মনে বলল, পাগল নাকি? এই শরীরে বাইরে বের হয়েছে কেন? কালকের আঘাতের জন্য জ্বর হতে পারে। কাল তো উঠে দাঁড়াতে পারছিল না অপারগ হয়ে বসে ছিল। আজ সকাল হতেই এতো জোর চলে এলো গায়ে যে বাইরে ঘোরাফেরা করছে‌। অদ্ভুত।
ধ্রুব অচেতন চারুর জ্বরে লাল হ‌ওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে র‌ইল।
ধ্রুব কে দেখে একজন পুরুষ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,’ কে তুমি?’
ধ্রুব চারুর কপালে গালে স্পর্শ করে জ্বর মাপছিল তখন। তারপর বলল,’ আমি ধ্রুব।’
‘ ওহ চারু তোমার পরিচিত?’
চারুর নাম লোকটা মুখে শুনে ধ্রুব বুঝতে পারল লোকটা ওদের এলাকার। ধ্রুব কিছু না বলে চট করেই অচেতন চারু কে নিচে থেকে তুলে নিল কোলে। লোকটা বিস্মিত হয়ে চারু আর ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব চারুকে নিয়ে সবার সামনেই ওদের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। কেউ কিছু বলার সুযোগটাই পেল না সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

#চলবে…?