“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১০.
সিঁথি উঠানে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিল। মামাবাড়ি থেকে সিঁথি কয়েকটা ফুলের চারা নিয়ে এসেছে উঠানে ওগুলো রেখে দিয়েছে। চারু কে পেলেই লাগিয়ে দিতে বলবে। আসার সময় ফুল নিয়ে এসেছিল সেগুলো কানে গুঁজে পিক তুলছিল। হঠাৎ সিঁথির নজর জোড়া আটকে যায় গেইটের বাইরে দূরে থেকে এগিয়ে আসা ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর কোলে চারু কে দেখে সিঁথি থমকে যায়। বিস্ময় এ সিঁথির চোখ দুটো আকারে বড়ো হয়ে উঠে। মুখটা বিস্মিত করে থমকানো চোখে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। সিঁথি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল ওর সামনেই গেইট খোলে ভেতরে প্রবেশ করল ধ্রুব।
সিঁথি বিড়বিড় করে উঠল,’ এটা তো সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা। চারু কে কোলে নিয়ে আসলো কেন?’
কপাল কুঁচকে নিল সিঁথি এই ছেলেটাকে সেইদিন এর পর থেকে খোঁজে চলেছে। আজকে দেখা পেল তাও চারুর সঙ্গে রাগে গজগজ করে উঠল সিঁথি। দুজনের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই তো?
নিজের কথায় নিজেই বিদ্রুপ করে বলল,’ কিসব ভাবছি ওমন সুদর্শন ছেলে চারু কে চয়েজ করবে ইম্পসিবল।’
কিন্তু দুজনকে একসাথে দেখে তো ওর একদম ভালো লাগছে না। রাগ লাগছে প্রচুর বিশেষ করে চারুর উপর।
সিঁথি রাগে গজগজ করে ভেতরে গেল। ময়না বেগম অপরিচিত ছেলের কোলে চেপে চারু কে বাড়ি আসতে দেখে মাথায় নিয়েছে ঘর চিৎকার করে।
সিঁথি বিস্মিত মুখে ভেতরে প্রবেশ করেই মায়ের কথা শুনল।
‘ দেখছিস সিঁথি চারুর অধঃপতন? ও পুরুষ মানুষ নিয়ে বাড়ি এলো। লাজ লজ্জার মাথা খেয়েছে একদম।’ ময়না বেগমের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে সিঁথি ফিসফিস করে বলল,’ মা আস্তে কথা বলো এই ছেলেটাই তো সেই ছেলেটা যার নিজের কার আছে। আমি একে খুব পছন্দ করি। এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে পারলে তুমি কোটিপতি বাড়ির মেয়ের জামাই পাবে।’
ময়না বেগম চমকে উঠলেন,’ কি বলছিস? এই পোলা না তোকে পছন্দ করে তাইলে চারুর সাথে এতো মাখামাখি কেন?’
‘ আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। এমন হ্যান্ডসাম ছেলে কখনোই চারুর মতো গাইয়া ভূত কে পছন্দ করবে না আমার বিশ্বাস। ঘটনা কি ভালো করে বুঝার ট্রাই করো। আর এমন চিৎকার করে কথা বলো না সে তোমার হবু মেয়ের জামাই তাকে খাতির দারি করতে হবে বুঝেছ?’
ময়না বেগম মিনিটেই মুখোশ পাল্টে নিল।
এদিকে সিঁথি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস পাউডার মাখতে লাগল।
ধ্রুব অচেতন চারু কে কোলে তুলেই চারুর রুমে গিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিল। গতবার এসে চারুর রুম চিনে গিয়েছে ধ্রুব সেদিন বাকি দুই রুমে তালা দেওয়া ছিল। ধ্রুব চারু কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রুমের চারপাশে পলক ফেলল। সেরকম আহামরি জিনিস নেই চারুর রুমে। ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চলে যাবে নাকি বুঝতে পারছে না। এ কেমন বাড়িতে এলো চারু মা বোন কেউ চারু কে এমন অবস্থায় বাসায় ফিরতে দেখেও অস্থির হয়ে এগিয়ে এলো না। এদিকে ময়না বেগমের রিয়েক্ট দেখে ধ্রুবর কপাল কুঁচকে এসেছে। হ্যাঁ মেয়েকে একটা ছেলের কোলে দেখে তিনি বিস্মিত হতেই পারে। কিন্তু তার মেয়ে অসুস্থ অজ্ঞান অবস্থায় এসেছে সে কোথায় মেয়ের জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবে তা না ওকে দেখে চিল্লাচিল্লি করছে।
ধ্রুব বিরক্তিকর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এমন পরিবার খুব কম দেখেছে তাই আরো অবাক হচ্ছে। ধ্রুব নিজেই চারুর দিকে এগিয়ে গেল কপালে হাত রাখল জ্বর অনেক মুখে একটু পানির ছিটা দেওয়া উচিত এতে সজ্ঞানে ফিরতে পারে। ধ্রুব দেখল চারুর রুমে এডজাস্ট বাথরুম নেই। ও রুম থেকে বাইরে হাঁটা ধরল। যাকে অপছন্দ করে তাকে নিয়ে এমন হাইপার কেন হচ্ছে ও নিজেও বুঝতে পারছে না কিন্তু এই অবস্থায় চারুকে ফেলে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না।
ধ্রুব বাইরে বের হচ্ছিল তখনি ময়না বেগম এগিয়ে এলো কপাল কুঁচকে চাইল ধ্রুব। একটু আগেই মহিলাটার মুখটা রাগে গজগজ করছিল। ওকে বাসায় ঢুকতে দেখে সেকি চিৎকার এখনি তার মুখের রাগ সরে গেছে অদ্ভুত।
ময়না বেগম বললেন,’ বাবা কেমন আছো?’
ধ্রুব নাক গুছিয়ে চাইল। ময়না বেগমের আহ্লাদি কন্ঠ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেল ধ্রুব। এমন ভাবে কথা বলছে যেন ময়না বেগম তার কত আপনের আপন।
ধ্রুব ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল,’ হোয়াট?’
ময়না বেগম হকচকিয়ে গেলেন। সিঁথি এগিয়ে এলো।
‘ চারুর কি হয়েছে? ওকে কোলে করে আনলেন যে?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল সিঁথি।
ধ্রুব রাগে ফেটে পড়ে বলল,’ এতোক্ষণে চারুর কথা মনে পড়ল বুঝি?’
সিঁথি ধ্রুবর খোঁচা মারা কথায় থতমত খেল।
‘ না আসলে আপনাকে দেখে আমরা কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। চারুর কি হয়েছে?’ ঢোক গিলে বলল সিঁথি।
ধ্রুব আরো রেগে উঠল।
‘ তোমাদের বাড়ির মেয়ে তোমরা জানো না ওর কি হয়েছে? অদ্ভুত তো!’
ধ্রুব ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনাদের বাথরুম কোনদিকে?’
ময়না বেগম ধ্রুবর থমথমে মুখের কথা শুনে আমতা আমতা কন্ঠে বললেন,’ ওইযে ওই দিকে।’
বলেই বাথরুম কোনদিকে দেখিয়ে দিল। ধ্রুব মগে করে পানি এনে ওদের দুজনের সামনে দিয়েই চারু কাছে গিয়ে চারুর মুখে পানির ঝাপটা দিল। মা মেয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।
ধ্রুব অসহ্য চোখে তাকাল ময়না বেগমের দিকে তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,’ আপনি চারু আম্মু না?’
চমকে উঠলেন ময়না বেগম ঢোক গিলে কি বলবেন ভুলে গেলেন।
সিঁথি উত্তর দিল মায়ের হয়ে,’ হ্যাঁ আর আমি বোন।’
ধ্রুব উচ্চ স্বরে বলল,’ আপনি কেমন মা? মেয়ের গা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে আপনি জানেন ই না! আমি ওকে জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করছি আর আপনি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে কি ড্রামা দেখছেন? আপনার মধ্যে আমি তো একটুও মেয়ে জন্য চিন্তা দেখতে পেলাম না। একজন মানুষ এমন অচেতন হয়ে পরে আছে আপনারা দুজনে নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়িয়ে দেখছেন জাস্ট। কোন উত্তেজনা দুশ্চিন্তা নেই আজব পরিবারের তো আপনারা।’
ময়না বেগম বিব্রতবোধ করলেন ধ্রুবর কথায়। বড়োলোক ঘরের ছেলে এবং মেয়ের পছন্দের তাই তিনি এই ছেলের কথা চুপ করে হজম আছে নয়ত কখনোই সহ্য করত না।
ধ্রুব দুজনের থেকে মনোযোগ সরিয়ে তাকাল চারুর দিকে। চারু চোখ মেলে তাকাচ্ছে।
ধ্রুব চারুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বলল,’ যান বালতি করে পানি এনে ওর মাথায় পানি ঢালুন।’
ময়না বেগম ধমক খেয়ে রাগী চোখে তাকাল সিঁথির দিকে। সিঁথি করতে বলল যা বলছে তাই।
ময়না বেগম পানি আনতে চলে গেল।
চারু ঘোলা চোখে তাকাল ধ্রুবর দিকে। অতিরিক্ত জ্বরে ও ধ্রুব কে চিনতে পারল না। ও ভাবল ময়না বেগম ওর পাশে বসে আছে। চারুর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগল। ধ্রুব বিস্মিত চোখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চারু গরম হাতে ধ্রুবর হাত জড়িয়ে ধরল।
আদো আদো কন্ঠে বলে উঠল,’ মা..’
ধ্রুব চমকে উঠল। ওকে মা ভেবে ধরেছে বুঝতে পারল ধ্রুব কিন্তু চারুর মা ডাক ব্যতিত আর কোন কথা বুঝতে পারল না।
চারু বিড়বিড় করে কি যেন বলছে কোন কথাই স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে না।
এদিকে সিঁথি এগিয়ে এসে ধ্রুবর সাথে ভাব করতে চাইছে।
সিঁথি বলল,’ আপনার নাম কি?’
ধ্রুব চারুর হাত নিজের বাহু থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল ওর বুক ধুকপুক করছে। সিঁথির কথায় বলল,’ হোয়াই?’
সিঁথি বলল,’ না মানে আসলে আরেকদিন আপনাকে আমাদের বাড়ি উঁকিঝুঁকি মারতে দেখেছিলাম।’
বলেই লাজুক হাসলো সিঁথি।
‘ তুমি ব্রাশিং হচ্ছ কেন?’ কপাল কুঁচকে বলল ধ্রুব।
ধ্রুবর কথায় চমকে উঠল সিঁথি। হাত মুচড়ামুচড়ি করে বলল,’ না আসলে …’
ধ্রুব বলল,’ আমার নাম নিয়ে না পরে, যাও বোনের কাছে যাও। ওর সেবা যত্ন করো।’
সিঁথি জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে চারুর দিকে এগিয়ে গেল। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে দেখে সিঁথি চারুকে কে ডাকতে লাগল,’ এই চারু।’
ধ্রুব এক পলক চারুর দিকে চেয়ে বাইরে চলে এলো। ময়না বেগম ধ্রুব কে চলে যাওয়া ধরতে দেখে এগিয়ে এলো ছুটে।
ধ্রুব হতবুদ্ধি চোখে তাকাল। অসুস্থ মেয়ের থেকে যেন ওকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত মহিলাটা।
ধ্রুবর সামনে এসে ময়না বেগম বললেন,’ কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
‘ মানে কি?’ এই মহিলা ওর যাওয়া নিয়ে এমন ভাবে প্রশ্ন তুলছে যেন কোথায় যাবে না যাবে তাকে বলে যেতে হবে।
‘ চলে যাচ্ছ কেন এতো তাড়াতাড়ি? একটু বসো তোমার সাথে তো আলাপ পরিচয় কিছুই হলো না।’
‘ আপনি আমার সাথে কি আলাপ পরিচয় করবেন?’
ময়না বেগম বললেন,’ না মানে আমার মেয়েটাকে এমন যত্ন করে বাড়ি নিয়ে এলে একটু তোমার পরিচয় জানব না?’
‘ দরকার নেই জানার আমি আসছি।’
ময়না বেগম চিৎকার করে উঠলেন,’ নাহ।’
ধ্রুব বলল,’ কি হলো?’
‘ কিছু মুখে দিয়ে যাও।’
‘ আপনার মেয়ের কাছে যান আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।’
বলেই ধ্রুব গটগট করে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ময়না বেগম ধ্রুব কে বাসা থেকে চলে যেতে দেখেই বালতি রেখেই চারুর রুমে এসে চারুর হাত ধরে টেনে চারু কে ফ্লোরে ফেলে দিল।
দুই মিনিট হবে চারু পুরোপুরি সজাগ হয়েছে। সজাগ হয়েই চমকে উঠেছে রুমে এভাবে বিছানায় শোয়া অবস্থায় নিজেকে দেখে। ও তো দোকানে ছিল ওর হাতে ডিম ছিল তারপর হঠাৎ চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল তারপর আর কিছুই মনে নেই।
চারু মাথা ধরে মনে করার চেষ্টা করছিল তখনি আচমকা ঝড়ের মতো ময়না বেগম এগিয়ে এসেই ওকে টেনে বিছানা থেকে ফ্লোরে ফেলে চিৎকার করে উঠে।
চারু ফ্লোরে পরে ঠোঁট কেটে ফেলেছে। জ্বরের মধ্যে এমন আক্রমণে স্তব্ধ চারু। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে চারু ময়না বেগমের দিকে।
চারু দেখল ময়না বেগম ক্রোধে ওর দিকে এগিয়ে এলো চারু আক্রমণ কীভাবে সামলাবে বুঝতে পারছে না ভয়ে খিচে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। তখনি একটা পুরুষ কন্ঠস্বর ওর কর্ণকুহরে ঝনঝন শব্দের মতো বেজে উঠল। হতবিহ্বল চোখে সামনে তাকাতেই কেঁপে উঠল চারু।
ময়না বেগম তোতলানো কন্ঠে বললেন,’ তুমি এখনো যাওনি?’
#চলবে..?
“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১১.
ধ্রুব কে ফিরে আসতে দেখে ময়না বেগমের মাথায় বাজ পড়ল। ধ্রুব বিস্মিত চোখে ময়না বেগম ও চারুর দিকে তাকিয়ে আছে। ময়না বেগম মুখটা ভয়ে শুকিয়ে ফেলল। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ফ্লোরে বসে থাকা চারু কে ধরল।
তারপর আহ্লাদি কন্ঠে বললেন,’ কি হয়েছে নিচে বসে আছিস কেন?’
বলেই ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আর বলো না মেয়েটাকে নিয়ে পারি না। জ্ঞান ফিরতেই উঠতে গিয়েছিল তারপর আর কি মাথা ঘুরিয়ে নিচেই বসে পড়েছে। বললাম কত করে বিছানা থেকে নামিস না।’
চারু ময়না বেগমের মিষ্টি কথা ও মিথ্যা গল্প ধ্রুব কে শোনাতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ধ্রুব আবার বাসায় এসেছে কেন? কি করছে সে? ময়না বেগম কোন রিয়েক্ট না করে কেমন কৈফিয়ত দিতে শুরু করেছে অদ্ভুত সব কিছু চারুর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ময়না বেগমের দিকে তাকাতেই আরো চমকাল, ময়না বেগমের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি কথা বলতে তোতলাচ্ছেন। চারু হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর মুখমণ্ডল দেখে মনের খবর বোঝা যাচ্ছে না। ধ্রুব দাঁড়িয়েই আছে ময়না বেগম চারু কে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। চারু বিছানায় বসে আছে স্তব্ধ মুখে। হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর চারপাশে। চারু দেখল ময়না বেগম কে পাস করে ধ্রুব ওর দিকে এগিয়ে আসছে। চারু ঢোক গিলল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। আড়চোখে ময়না বেগমের দিকে তাকাল চারু।
ধ্রুব চারুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। কেমন জানি জহুরি নজরে চারুর দিকে তাকিয়ে আছে।চারু ময়না বেগমের সামনে কিছু বলতেও পারছে না কিন্তু ধ্রুবর কে হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাগে ফেটে পড়ল চারু। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে।
ধ্রুব চট করেই চারুর দিকে ঝুঁকে এলো। চারু হকচকিয়ে গেল। হাত দুটো বিছানায় ভর দিয়ে পিছনে ঝুঁকে গেল চারু। ধ্রুব আরো এগিয়ে এসে ওর মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
হাত বাড়িয়ে চারুর ঠোঁটের কোণায় স্পর্শ করতেই চারু কেঁপে উঠল। এবং ছিটকে উঠে ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’ অসভ্য।’
ধ্রুব চারুর কথায় পাত্তা না দিয়ে ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,’ এসব কি?’
ময়না বেগম চমকে উঠলেন। ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন,’ কী?’
‘ আপনি অসুস্থ মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন?’ রাগ ঝড়ে পড়ল ধ্রুবর কন্ঠে। চারুর ঠোঁটের কোনায় দূর থেকেই রক্তের দলা দেখছিল কিন্তু সুনিশ্চিত ছিল না। কাছে এসে স্পর্শ করে আঙুলে লাগাতেই টাটকা রক্তের দলা হাতে চলে এলো। শক্ত হয়ে এলো ধ্রুবর চোখ মুখ।
চেয়াল শক্ত করে ময়না বেগম কে জিজ্ঞেস করল।
ময়না বেগম কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।
ধ্রুব বলল,’ আপনি কাজটা একদম ঠিক করেন নি।’
ময়না বেগম জবাব দেওয়ার ভয়ে সিঁথির রুমে চলে গেল।
সিঁথি মাকে দেখেই বলল,’ উফ মা এখনি কেন মারামারি করতে গেলে? এখন কি বলব ভয়ে তো আমি কাছেই ঘষতে পারছি না।’
ময়না বেগম রাগী কন্ঠে বললেন,’ তোর জন্য ওই পোলারে আমি কিছুই বলতে পারছি না। ওই পোলা তো তোরে চেয়েও দেখছে না। খালি চারু কে নিয়ে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাচ্ছে। আমি কিন্তু আর সহ্য করতে পারছি না। ওই পোলার জন্য আমাকে বিড়াল হয়ে থাকতে হচ্ছে।’
সিঁথি মায়ের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে মাথা ঠান্ডা করিয়ে বলল,’ মা মাথা ঠান্ডা করো। রাগ করে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না প্লিজ। একটু সহ্য করে নাও।’
‘ পরে যদি পোলায় তোরে বিয়ে না করে?’
‘ মা নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করছো কেন? তুমি আছো কি করতে ছেলেকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে দাও। তুমি চিন্তা করো তোমার মেয়ে কত সুখে থাকবে। কত টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি সব থাকবে স্বপ্নের মতো তুমি এসব চাও না?’
ময়না বেগম মেয়ের জন্য এবং লোভে পড়ে মাথা ঠান্ডা করতে উঠেপড়ে লাগল। সিঁথি কি বলে পরিস্থিতি ম্যানেজ করবে ভাবছে।
চারু ময়না বেগম কে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে রাগী কন্ঠে বলল,’ আপনি আবার এখানে কেন এসেছেন?’
ধ্রুব চারুর কথায় বলল,’ তোমাকে তো আমি যথেষ্ট সাহসী ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমার দেখা পুরোটাই ভিন্ন। বাসায় একদম ভীতু।’
চারু আঙুল তুলে বলল,’ আপনি বাসায় এসেছেন মা তবুও কিছুই বলছে না। এসব কি হচ্ছে? কি করেছেন আপনি?’
ধ্রুব চারুর আঙুল ধরে বলল,’ চুটপাট শুধু আমাকেই করতে পারো। মায়ের সামনে তো মুখ ফুটে কথা বলতে সাহস পাওনি।’
চারু টেনে আঙুল ছাড়িয়ে নিল।
ধ্রুব চারুর ঠোঁটের ক্ষতের দিকে চেয়ে বলল,’ ঠোঁট কাটলে কীভাবে?’
‘ আপনাকে বলব কেন?’
ধ্রুব চারুর কথায় হো হো করে হেঁসে উঠল। চারু চোখ ছোটো ছোটো করে ধ্রুবর হাসি দেখছে। হঠাৎ হাসির কি হলো?
রাগে ওর গাল লাল হয়ে উঠল। জ্বরের জন্য বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তবুও শুতে পারছে না।
ধ্রুব পেট চেপে ধরে কিছুক্ষণ হাসল তারপর থেমে তাকাল চারুর বোকা মুখের দিকে।
‘ তাই তো আমাকে বলবে কেন? ইউ আর রাইট। আমিই বা জিজ্ঞেস করছি কেন?’
চারু কয়েক সেকেন্ড ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে থেকে চট করে বলল,’ আপনি বাসায় এসেছেন কেন?’
ধ্রুব বলল,’ প্রতিবার তোমাকে জ্বালাতন করতে আসলেও আজকে তোমায় হেল্প করতে এসেছিলাম।’
চারু কপাল কুঁচকে বলল,’ আপনি আবার আমাকে কি হেল্প করলেন?’
চারুর কথায় ধ্রুব বলল,’ আচ্ছা তুমি তো রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে বাসায় কীভাবে আসলে একবার ও স্মরণ হয়নি?’
চারু থতমত খেয়ে গেল। আসলেই তো ও বাসায় কীভাবে আসলো মাথায় এসেছে কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি।
ধ্রুবর প্রশ্নে চারু বিস্মিত কন্ঠে বলল,’ কীভাবে আসলাম?’
ধ্রুব খুব গর্বিত কন্ঠে বলল,’ সেই দোকান থেকে এক মাইল রাস্তা তুমি আমার কোলে চেপে এসেছ। নেহাৎ ই আমি ভালো ছেলে তাই তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলে যেতে পারিনি বাসায় নিয়ে এসেছি। নয়ত তুমি আমার সাথে যা করেছ যেভাবে কথায় কথায় আমাকে চর মেরেছ অন্য সব ছেলে থাকলে ফেলে চলে যেত।’
এমন ভাবে ধ্রুব বলছে কথাগুলো। ও না নিয়ে আসলে চারু কে বাসায় আনার কেউ ছিল না। ওকে রাস্তায় পরে থাকতে হতো ধ্রুব না এগিয়ে আসলে।
চারু কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,’ আপনি দোকানের ওখানে কি করছিলেন? এখন আবার বলবেন না ওখানে আপনিও কাঁচা বাজার নিতে আসছিলেন।’
‘ পাগল নাকি আমি এসব বাজার করতে যাব কেন? আমি কি তোমার মতো মেড নাকি? এসব মেড দের কাজ ধ্রুব করবে?’ আশ্চর্য কন্ঠে বলল ধ্রুব।
চারু বলল,’ সেটাই তো। তাহলে আপনি আমাদের অলি গলিতে কি করেন সর্বক্ষণ?’
‘ বিশাল একটা সড়ক আছে সামনে। আমি যেখান দিয়ে যাওয়া আসা করি। তোমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করবো কেন আমার কি আর কাজ নেই? নিজেকে কি মহারানী ভিক্টোরিয়া মনে হয়? তোমার পিছু পিছু আমি ঘুরব!’ তাচ্ছিল্য করে বলল ধ্রুব।
ধ্রুবর কথায় চারু বলল,’ হ্যাঁ নিজেকে মহারানী মনে করি আপনার সমস্যা? আর আপনার কাজ নেই বলেই অধিকাংশ সময় আমার বাড়ি এসে আমাকে জ্বালাতে থাকেন। কাজ থাকলে আসতেন নাকি? যত্তসব।’
চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল ধ্রুবর। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,’ বসে থাকতে পারছ না। কথা বলতে হাঁপাতে হচ্ছে তবুও আমার সাথে ঝগড়া না করলে তোমার শান্তি লাগে না তাই না?’
চারু মুখ ফিরিয়ে নিল।
ধ্রুব বলল,’ নিজের মায়ের অত্যাচারে তো মুখে কুলুপ এঁটে থাকো। এখন মুখ এতো চলছে কেন? আর তোমার মায়ের মতো মা ও আমি কম দেখেছি। সে তোমায় ওভাবে বিছানা থেকে টেনে ফেলল কেন? এ আবার কেমন মা?’
চারু থমকে গেল সমস্ত শব্দ, গলার জোর নিস্তেজ হয়ে গেল।
ধ্রুব তারমানে সবটাই দেখেছে মায়ের ওর প্রতি নির্মমতা।
লজ্জায় চারু মুখটা নামিয়ে নিল। চোখ টলমল করে উঠল। নিজের মায়ের সাথে নিজের এই তিক্ত সম্পর্ক ও কারো সামনে তুলে ধরতে চায় না। বাইরে একজন লোক ওদের ভেতরের খবর দেখে ফেলল। মাথা নিচু করে চারু বসে আছে মাথা তুলে ধ্রুবর দিকে তাকাতে পারছে না।
ধ্রুব কিছু বলতে যাবে সিঁথি এসে ডাকে ধ্রুব কে।
চারুর ঝুঁকিয়ে রাখা মাথার দিকে এক পলক চেয়ে ধ্রুব বেরিয়ে গেল। চারু অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা তুলে তাকাল। বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে চারু বালিশে মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়ল।
বালিশে মাথা রেখে চারু কাঁদছিল। হঠাৎ পিঠের নিচে কিছু লাগতেই চমকে উঠে। হাত বাড়িয়ে দেখে ফোন। কপাল কুঁচকে নেয় চারু এই টা কার ফোন?
হঠাৎ ধ্রুবর আওয়াজে চমকে উঠল চারু।
ধ্রুব ওর দিকে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে। চারু চোখ মুছে রাগী কন্ঠে বলল,’ আবার কি?’
‘ কাঁদছ নাকি?’
কটমট করে তাকালো চারু ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব চারুর হাতে থেকে নিজের ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,’ এটা আমার ফোন।’
চারু থমকানো চোখে তাকিয়ে আছে। বিষ্ময় এ ওর মুখটা হা হয়ে গেছে। ধ্রুবর ফোন ওর পিঠের নিচে গেল কীভাবে? বিস্মিত গলায় চারু বলল,’ এখানে ছিল কেন?’
‘ আমিই রেখেছিলাম।’ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল ধ্রুব।
চারু বলল,’ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘ বুঝতে হবে না।’
চারু ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,’ আর দুই সেকেন্ড আগেও যদি জানতাম ওটা আপনার ফোন ওটা আর অক্ষত থাকত না।’
‘ তাই নাকী? এতো সাহস তোমার?’
‘ এখনো বুঝতে বাকি আছে বুঝি?’
‘ দেখতেই পাচ্ছি কেমন সাহসী তুমি।’ ধ্রুবর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রুপ। চারু দেখল সিঁথি এগিয়ে আসছে। ধ্রুব চলে গেল। সিঁথি কে দেখে চারুর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। সিঁথির হাবভাব ভালো ঠেকছে না। চারু বিস্মিত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
বাইরে থেকে ময়না বেগমের আহ্লাদি কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। কিছু খাওয়ার জন্য তোষামোদ করছে হয়ত ধ্রুব কে। এতো আদ্যিখেতা করার কারণ এখনো মাথায় আসছে না চারুর।
তাদের কথোপকথন,’ একটু মুখে দাও বাবা।’
ধ্রুব বিস্মিত হয়ে বলল,’ আপনি আমায় এতো আদর আপ্যায়ন করছেন কেন?’
‘ এতো উপকার করলে বাবা তুমি একটু আদর আপ্যায়ন করব না?’ বললেন ময়না বেগম।
ধ্রুব বলল,’ নিজের বাড়ির মেয়েকে যত্ন করতে পারেন না। বাইরের একটা ছেলেকে এতো আহ্লাদ করছেন! আপনার মতলবটা আমি বুঝতে পারছি না আন্টি।’
থতমত খেয়ে গেলেন ময়না বেগম।
‘ কি বলছো বাবা?’ অবুঝ সেজে বললেন ময়না বেগম।
‘ একটু আগের ঘটনা আমি সবটাই দেখেছি আন্টি। তাই ড্রামা করবেন না আমার কাছে।’ ধ্রুবর কথায় সিঁথি হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,’ আপনি বসুন না তারপর বলছি ঘটনা খুলে। উপর থেকে দেখে আপনি বুঝতে পারবেন না।’
ধ্রুব বসলো। কেন জানি শুনতে ইচ্ছে করছে। চারুর সাথে ওমন ঘটনা ঘটতে দেখে ধ্রুবর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল। কোলে করে আনার সময় বুঝতে পেরেছে কতটা দূর্বল ও অসুস্থ চারু। কোলে নিয়েও বিস্মিত হয়েছিল দেখতে তেমন পাতলা মনে না হলেও ওজন নেই। এমন অসুস্থ সন্তান কে কোন মা ওভাবে বিছানা থেকে টেনে ফ্লোরে ফেলতে পারে? এ কি মা নাকি অন্য কিছু এসব চিন্তা বারবার ধ্রুবর মাথায় আসছে।
সিঁথি কথা গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল,’ চারু তো আমার আপন বোন না। আমার সৎ বোন। খুব খারাপ ও একদম ভালো না। ইচ্ছে জ্বর আনিয়েছে। মায়ের কথা শুনে না উঠেই মায়ের সাথে গালিগালাজ করেছে। ওর মুখ খুব খারাপ। সৎ মা হলে আমার মাকে খুব অত্যাচার করে মা বলে মানে না। মা অতিষ্ঠ হয়েই তখন ওমন রাগ দেখিয়ে ফেলেছে। মা অনেক সহ্য…’
কথায় মাঝেই ধ্রুবর ফোনটা বেজে উঠল ধ্রুব লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং ফোন কানে ধরেই চলে গেল। সিঁথি আধ কথা গিলে বসে রইল।
ময়না বেগম ভালো করে দরজা লক করে এলো কারণ ধ্রুব চলে গিয়েছে। এবার রেগে এগিয়ে গেল চারুর ঘরে।
#চলবে…..?