“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১৭.
সময়টা হঠাৎ করেই এমন পাল্টে যাবে চারু কল্পনা ও করতে পারেনি। বাসায় এসে ধ্রুব ওর নামে বাজে কথা বলায় ময়না বেগম প্রথমদিন রাগ দেখালেও দুইদিন পরই সেটা চলে যায় কারণ টা পূর্ণতার অজানা কিন্তু ময়না বেগম ভেতরে ভেতরে কোন ছক আঁকছে সেটা ও আন্দাজ করতে পারে না। দুইদিন পরই সেটা বেরিয়ে আসে। চারুর বিয়ে ঠিক করেছেন তিনি। চারু কে নিজে থেকেই কাজে যেতে দিলেন না চারু কাজে যাবে না ভেবেও ছিল কিন্তু অগ্রিম বেতন পায়। অগ্রিম টাকা নিয়ে কাজ করবে না এমন মন মানসিকতা চারুর নেই। সেদিনের পর ধ্রুব ওই বাসা ছেড়েছে এখন আর আসে না। ওর জীবনের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়ে লোকটা পালিয়েছে। এখন বাসায় ওর বিয়ের ধুম পড়েছে। একটা আধবয়স্ক লোকের তৃতীয় স্ত্রী করে পাঠাতে চায় ময়না বেগম চারু কে। আজকে একটু আগেই পাত্র এসেছিল একাই ওকে দেখতে। মোটা ভুঁড়ি ওয়ালা লোকটা। এক গাদা ফল মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছিল ওদের ছোটো বাসাটার সামনে লোকটার সাদা কার ছিল। চারুকে দেখেই একটা চেক দিয়েছে। সেখানে বিশ হাজার টাকা লেখা ছিল পাত্র চলে যেতেই চারুর হাত থেকে এক টানে চেক কেড়ে নেয় সিঁথি।
তারপর আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,’ ও মাই গড কত টাকা দিল রে চারু তোকে..! তুই তো ওই আঙ্কেল কে বিয়ে করে রাজ রাণী হয়ে যাবি।’
চারু ময়না বেগমের পায়ে পড়ে বলল,’ মা দয়া করে এসব করো না আমাকে বিয়ে দিও না।’
ময়না বেগম ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললেন,’অসম্ভব। বিয়ে দেব না তোকে আমি বাইরে নষ্টামি করতে পাঠাব তাই না? এই লোকের তৃতীয় বউ হয়েই এই বাড়ি ছাড়বি তুই। এই লোক অনেক ধনী বিয়ের জন্য আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিবে বলেছে। সেই টাকা দিয়ে আমি সিঁথির বিয়ে দেব।’
সাজানো পরিকল্পনা জানালো ময়না বেগম চারু কে। চারু কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথা বলল। কিন্তু ময়না বেগম নিজের কথায় অনড় বারবার বুঝাতে লাগল।
চারু ফ্লোরের বসেই কাঁদতে লাগল কেউ ওর কান্না থামাতে এগিয়ে আসলো না। এতো অসহায় লাগছিল তখন চারুর ও নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে ফ্লোরে পড়ে চিৎকার করতে লাগল।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ করেই ওর চোখের সামনে ধ্রুবর মুখটা ভেসে উঠল। কান্না থেমে গেল চারুর। চোখের জল মুছে চারু বিড়বিড় করল,’ এই সব কিছু হয়েছে শুধুমাত্র ওই লোকটার জন্য। সে আমার জীবনে আসার পর থেকে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই চলেছে আমার জীবনে। এখন আমার জীবনের সর্বনাশ করে সে উধাও হয়েছে। এভাবে তাকে আমি কীভাবে শান্তিতে থাকতে দিয়েছি। আমার জীবনের সব শান্তি কেড়ে নিয়ে সে শান্তিতে বন্ধুবান্ধব পরিবার নিয়ে আনন্দে দিন পাড় করবে অসম্ভব আমি কিছুই সেটা হতে দেব না। মায়ের কাছে যদি আমার নামে বাজে কথা না বলতো মা কখনোই আমাকে এতো তাড়াতাড়ি ওই আধবয়স্ক লোকটার কাছে বিয়ে দিতে চাইত না। সব কিছুর মূলে ওই লোকটা।’
চারু রাগে কাঁপতে লাগল। কিন্তু ওর চোখ দিয়ে অধরে শ্রাবণ ধারায় নোনাজল পড়ছে।
পরদিন কাজে আগে আগেই বের হতে চাইল কিন্তু ময়না বেগম ওকে বের হতে দিল না। সে স্পষ্ট স্বরে বললেন,’ কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ কাজে যাচ্ছি।’
‘ আর কাজে যেতে হবে না। যা আজকে সিঁথির সাথে পার্লারে যা।’ সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে ভাবছে চারু।
চারুর বিস্মিত মুখ থেকে সিঁথি বলল,’ এতো অবাক হচ্ছিস কেন? এসব আমরা করছি না। তোর হবু জামাই তোকে পার্লারে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক টাকা পাঠাইছে। এজন্য নিয়ে যাচ্ছি নয়ত তোর পেছনে বাড়তি টাকা খরচ করতে আমাদের বয়েই গেছে।’
চারু বলল,’ এই বিয়েটা বন্ধ করো মা প্লিজ।’
‘ চুপ একদম বিয়ের বিরুদ্ধে কোন কথা বলবি না। এই বিয়েটা তোকে করতেই হবে।’ ময়না বেগম ধমকে উঠলেন।
চারুকে টেনেই সিঁথি পার্লারে নিয়ে এলো। চারু কে আর কি করাবে ও নিজেই হেয়ার কাট করল, ফেসিয়াল করল। তারপর চারু কে ও করতে বলেছে কিন্তু চারু চুল কাটতে দিবে না বলে চিল্লাচিল্লি করছে।
জোর করে সিঁথি ধরে বলল,’ বস্তির মেয়েদের মতো আচরণ করছিস কেন চারু। ওনাদের কে ওনাদের কাজ করতে দে। তুই চুপচাপ বসে থাক।’
চারুর কে জোরাজুরি করেই চুল স্ট্রেট করে দিল তারপর ফেসিয়াল ও জোর করেই করলো। চারু যখন আয়নার দিকে তাকাল নিজেকে কেমন জানি অপরিচিত লাগতে শুরু করল। ও নিজেকে চিনতেই পারছে না নিজের মাথার সিল্কি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল অবাক হয়ে। মুখ ওতো আগের তুলনায় উজ্জ্বল ও মসৃন লাগছে ও অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। পার্লার থেকে বেরিয়ে চারু দেখল সেই মোটা ভুঁড়ি ওয়ালা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। কালো লোকটা কালো চশমা পরে স্টাইল করে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা বের হতেই ওর দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল। চারুর মন চাচ্ছিল চোখ দুটো গেলে দিতে।
চারু লোকটাকে দেখেই চোখ মুখ শক্ত করে নেয় দাঁত কিড়মিড় করতে লাগে।
চারু সিঁথির দিকে ফিসফিসিয়ে বলল,’ এই লোক এখানে কি করছে?’
‘ আরে তোর হবু জামাই এখন আমাদের নিয়ে মার্কেটে যাবে। আর মাত্র একদিন তাই তো বিয়ে কেনাকাটা করা লাগবে না?’ সিঁথির মুখে হাসি।
চারুর মাথায় বাজ পড়ল। চারু সিঁথির হাত চেপে ধরে বলল,’ কিসব বলছিস এক দিন পর বিয়ে মানে?’
‘ আরে এতো অবাক হচ্ছিস কেন? এই বুইড়া ব্যাটা তোর মতো অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে পেয়ে কি বেশি ওয়েট করতে পারবে বিয়ে নিয়ে বল.?
চারু টেনে নিয়ে সিঁথি লোকটার গাড়িতে উঠল। চারু কে কারের সামনে বসাতে চাইছিল কিন্তু চারু পেছনে বসেছে জোর করে। সিঁথি লোকটার সামনে ওর সাথে জোরাজুরি করতে পারেনি।
শপিং মলে গিয়ে চারু গাড়িতে থেকে কোন ভাবেই নামছেনা দেখে সিঁথি বলল,’ সিনক্রিয়েট না করে নাম চারু মা কিন্তু নয়ত তোর খবর করবে।’
চারু দাঁতে দাঁত চেপে নেমে বলল,’ এই বিয়ে আমি মরে গেলেও করব না মনে রাখিস যা খুশি করে নে।’
‘ তোকে বিয়ে করতেই হবে বিয়ে ছাড়া তোর কোন গতি নেই চারু।’
ওরা শপিং মলে এসে দাঁড়িয়েছে। চারু কিছুই ধরছে না বুইড়া ব্যাটা হলে কি হবে মনে খুব ফুর্তি দেখা যাচ্ছে। নিজেই পছন্দ করছে শাড়ি লেহেঙ্গা।
চারুর হাতে একটা একটা দিয়ে বলছে পরে দেখতে চারু খাম্বার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না এদিকে সিঁথি নিজের পছন্দ মতো এক গাদা ড্রেস সিলেক্ট করে ফেলেছে আর চারু পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে লোকটা ওর সাথে কথা বলছে চারু কথার কোন উত্তর ও দিচ্ছে না।
সিঁথি এসে দেখল সব তারপর তাড়াতাড়ি লোকটার পছন্দ করা লাল টকটকে শাড়ি এনে চারুর হাতে দিয়ে বলল,’ যা ট্রাই কর।’
‘ তোর এতো শখ তুই কর। অনেক টাকা বুঝছিস। একে বিয়ে করলে এমন দামি দামি জিনিসপত্র তোর থাকবে।’
সিঁথি বলল,’ আমার তো আছেই তুই নে।’
বলেই সিঁথি ওকে জোর করেই টয়াল রুমে ঢুকিয়ে দিল। চারু চুপ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে ওর নিজের চুল নিজেকেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আর মাত্র একদিন তারপর এই বিয়ে ও কী করবে? কীভাবে এই বিয়ে থেকে রক্ষা পাবে?
কিছুই মাথায় আসছে না নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।
এতো সহজেই ও হেরে যাবে সবসময় মায়ের কথায় উঠেছে বসেছে কি পেল এতো অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে? এখন ওকে আরেক নরকে ঠেলে দিচ্ছে?
এই সব কিছু ওই ধ্রুবর জন্য হচ্ছে। ওকে আমি ছাড়ব না। এই বিয়ে থেকে আমাকে পালাতে হবে? কিভাবে পালাব? বাসা থেকে এক সেকেন্ডের জন্য ও বের হতে পারে না ও কি করবে এখন!
দরজায় টোকা দিতেই চারু চমকে উঠল বাইরে থেকে সিঁথি ওকে ডাকছে ও কথা বলল না।
সিঁথি চিৎকার করে উঠল,’ বের হ তাড়াতাড়ি ঢং বাদ দিয়ে। শোন আমি পাশেই আছি তুই ভেতরে থেকে লক করে নে।’
চারু উঁকি মেরে দেখল সিঁথি আরেক সাইডে দাঁড়িয়ে একটা লেহেঙ্গা দেখছে। সেই লোকটাকে ও দেখা যাচ্ছে না এই তো সুযোগ ও বাসা থেকে পালাতে পারবে না এখানেই থেকেই যদি ও পালিয়ে যায় খুব ভালো হবে। লোকটার এই বয়সে বিয়ে করার শখ মিটে যাবে। চারু শাড়িটা ভেতরের রেখেই ওরনা দিয়ে মাথা ও মুখ ঢেকে বেরিয়ে এলো দুই কদম বাড়াতেই সামনে লোকটা এসে দাঁড়িয়ে বলল,’ নাক মুখ ঢেকে কোথায় যাও সুন্দরী?’
চমকে উঠল চারু ওর বুক ধক করে উঠল। লোকটা তো এখানে ছিল না কোথায় থেকে এলো। চারু ভয়ে মুখের কাপড় সরিয়ে আমতা আমতা করতে লাগল।
ব দ মা ইশ লোকটা তো খুব সে য়া না কেমন ওকে ধরে নিল।
#চলবে….?