“এমনই এক দিনে” (পর্ব-২)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩.
বারিধারায় বেশ কয়েক বছর হলো একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে নীরদ। মাঝে দুই বছর ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়। এর আগে দেশে থাকতে যতবারই চেয়েছে একেবারের জন্য নতুন এই ফ্ল্যাটে শিফট করবে ততবারই দেখা গেছে কোনো না কোনো ভাবে সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে। যার বেশিরভাগই মায়ের জন্য করতে হয়েছিল। মা কখনোই নীরদকে একা ছাড়তে চান না। তবে এবার ছাড়ল, ছাড়তে বাধ্য হলো অবশ্য। নীরদের কাজকর্ম সবই এখানে। তাই মাকে এবার একটু বোঝানো গেল। মা যদিও বারবার বলছিলেন ধানমন্ডি থেকে বারিধারা আর কতটুকুই বা দূর? ঘরে থাকলেই তো হয়। নীরদ তখন না পারতেই বলে ফেলল তার প্রাইভেসি দরকার। সে একা থাকতে চায়। মা বুঝলেন, ছেলে তো বড় হয়েছে। আর কদিন তার আঁচলে বাঁধা থাকবে? তাই তিনি এবার ছেলেকে ছাড়লেন তবে অন্যদিকে খুব তোড়জোড় করে ছেলেকে নতুন আঁচলে বাঁধার জন্যও লেগে পড়লেন। এই যেমন গত দুই সপ্তাহ ধরে নীরদের কোনো পছন্দ আছে কি না তা জিজ্ঞেস করে করেই তাকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। নীরদ প্রথমে কিছু না বললেও পরে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এসব নিয়ে ভাবার সময় তার নেই। সে এমনিতেই খুব ব্যস্ত সময় পার করছে তারমধ্যে এখন আর নতুন কোনো ব্যস্ততায় জড়ানোর আগ্রহ তার নেই। মা মাঝে তিন চারদিন সত্যিকার অর্থেই চুপ ছিলেন। এ বিষয়ে আর কিছু বলেননি। তবে গতকাল রাত থেকেই তিনি আবারও বিয়ে নিয়ে বেশ চাপ দিচ্ছেন। কাল সামিহার বিয়েতে যাওয়ার পর থেকেই তিনি তাকে নিয়ে একবার এদিকে ছুটছিল তো একবার ওদিকে ছুটছিল। নীরদ প্রথমে কয়েক বার কি হয়েছে জানতে চাইলেও তিনি কিছু বললেন না। অগত্যা এক সময় হতাশ হয়ে বলতে লাগলেন,
-‘একটা মেয়ে বুঝলি! আমি ওকে দোতলা থেকে দেখেছিলাম। ও নিচ তলায় বসা ছিল। আমার না ওকে তোর জন্য খুব পছন্দ হয়েছে। একটু ভাবলাম ওর সাথে গিয়ে কথা বলব তোর বাবা তখন কোথা থেকে এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেলেন অতিথিদের সাথে পরিচয় করাতে। সেখান থেকে এসে দেখি মেয়েটা নেই। ভাবলাম এখনও তো অনেক সময় আছে একটু পরে নাহয় আবার খুঁজে দেখব, এখন যত খুঁজছি আর পাচ্ছি না। ওর কথা কাউকে বললেও কেউ চিনতে পারছে না। এবার কী করি বল তো?’
নীরদ রেগে গিয়ে বলল,
-‘মা তোমাকে আমি বারবার বলেছি এসব নিয়ে মাথা না ঘামাতে। তারপরও এমন করছ কেন? আর তোমার এভাবে যখন তখন যাকে তাকে পছন্দ হলেই তাকে আমার বিয়ে করতে হবে? অদ্ভুত!’
মা তখন আর কিছু বললেন না। দেখে বোঝা গেল রাগ করেছেন। তবে নীরদ আর কিছু বলেনি চলে আসে। আজ সকাল থেকে মা আবারো বারবার মেয়েটার কথা বলছেন ইনিয়ে বিনিয়ে। নীরদ সেসব শুনেও না শোনার ভান করে থাকল। একসময় মা নিজেই ছেলের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে দু চারটা কথা শুনিয়ে দিয়ে কল কেটে দিলেন।
সরোদ তখন সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে এসেছে। জেঠির চেঁচামেচি শুনে নীরদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ফোন চার্জে রেখে নীরদ বলল,
-‘বাড়ি যাবি কখন?’
-‘দেখি, যখন ইচ্ছে হয় যাব।’
-‘আজ তো সামিহার ওয়ালিমা। বাড়ি যেতে হবে। সেখানেও তো কিছু কাজ আছে না কি!’
সরোদ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি অন করল। তারপর নীরদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘গত কয়েকদিন আমি একটুও রেস্ট নিতে পারিনি। খুব টায়ার্ড লাগছে। আজকে সব তুমি করো। যদিও আজ তেমন কোনো কাজ নেই। চাপ পড়বে না তেমন একটা।’
নীরদ কিছু বলল না। আসলে সে হসপিটালের কাজে এতই ব্যস্ত ছিল যে ছোট বোনের বিয়েতে বড় ভাই হিসেবে তেমন কোনো দায়িত্ব পালন করা হয়নি। এ নিয়ে মনে মনে তার আফসোস আছে। সে কথা না বাড়িয়ে কিচেনে গিয়ে সকালের নাস্তা তৈরি করতে লাগল। সরোদ পেছন পেছন এসে বলল,
-‘কাল গাড়ির হেডলাইট ভাঙলে কি করে? এত বার জিজ্ঞেস করলাম কিছুই তো বললে না। আমার এত খারাপ লাগছে! গত সপ্তাহেই তো পছন্দ করে কিনে আনলাম দুজনে গিয়ে।’
নীরদের মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মেয়ে সে আর দুটো দেখেছে বলে তার মনে পড়ছে না। তাছাড়া ভদ্রতা বলতেও কিছু নেই ওর মধ্যে। সামান্য স্যরি বলতেও সে পারেনি বরং পালিয়ে গেছে। মেয়েটা তার গাড়ির হেডলাইট ভেঙেছে ঠিক আছে, অসাবধানতাবশত এমন কিছু ঘটতেই পারে। তাই বলে এমন অদ্ভুত আচরণ কেন? নীরদ তো আর তাকে চিবিয়ে খেতে যাচ্ছিল না!
__________________________________
শর্বরীদের বাড়িতে সকাল থেকেই হৈ হুল্লোড় শুরু হয়েছে। আজ যেহেতু ছেলেদের বাড়ির আয়োজন তাই ব্যস্ততাও সবার একটু বেশি। বাড়ির পুরুষরা সব বাইরের কাজে ব্যস্ত আর মহিলারা সব ঘরের কাজে ব্যস্ত। শর্বরী রান্নাঘরে এসে দাঁড়াতেই মা বললেন,
-‘কী? একদিন পর কিছু খাওয়ার কথা মনে পড়ল?’
শর্বরী রাতভর ঘুমোতে পারেনি। চোখে ঘুম নেই, পেটে ক্ষুধা নেই—মনটা শুধু খারাপ অনুভবে ভরা। গতকালের সেই ঘটনা যেন বারবার মাথায় ফিরে আসছে। ওর হেলদোল না দেখে মা জোর করে ধমক দিয়ে খাওয়ালেন—দুটো রুটি আর ডিম ভাজি।
ঘরে ফিরে টেবিলের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল সে। জানালার পাশ দিয়ে আলো এসে পড়েছে টেবিলের ওপর, কিন্তু শর্বরীর চোখে কেমন যেন কালো ছায়া। একটু পর পরই তার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই লোকটার কথা—যার গাড়ির হেডলাইট সে অসাবধানে ভেঙে ফেলেছিল। লোকটা রেগে কিছু বলার আগেই শর্বরী ভ’য়ে পালিয়ে এসেছিল। খুব বেশি ভ’য় পেয়েছিল লোকটার চোখের চাহনি দেখে। কী ছিল সেখানে? শুধুই রা’গ? আজব! রা’গ ছাড়া আর কী হবে? সে লোকটার এত বড় একটা ক্ষ’তি করে দিয়ে এলো!
শর্বরী নিজের আচরণে এখনও ল’জ্জিত। একটা সরল ভাবে ক্ষমা চাওয়া, একটা দায়িত্ব নেওয়া—এটুকু সে পারেনি। বোকার মতো শুধু পালিয়ে এসেছে। মাথার ভেতর একটা চাপা অপরাধবোধ পাথরের মতো বসে আছে।
হঠাৎ কী এক অদ্ভুত তাগিদে পেন্সিল তুলে নিল সে। ডায়েরির ফাঁকা পাতায় আঁকল সেই লোকটার চোখ দুটো। চোখে সেই চাহনি, যেটা তাকে ভয়ে থমকে দিয়েছিল। আঁকা শেষ হতেই শর্বরী চমকে উঠল। নিজেই বেশ অবাক হলো নিজের কাজ দেখে। সে পেছনে হেলে চেয়ারে বসে রইল কিছুক্ষণ। ভাবল—এমন কেন করল সে? কে জানে!
তবে একটা কথা সে ঠিক করে ফেলল—একদিন, ঠিক একদিন সে খুঁজে বের করবে সেই মানুষটিকে। ক্ষমা চাইবে এবং ক্ষতিপূরণ দেবে। সেই দিনটা তার জন্য শুধু দায়মুক্তির নয়, আত্মমুক্তিরও দিন হবে।
৪.
গতকালের ঘটনার ভয়ে অনুর জ্বর এসে গেছে। রাত থেকেই শরীরটা গরম, চোখে ঘুম নেই। রিমা তার পাশে বসে ধীরে ধীরে বলছে, ‘যা হওয়ার হয়েছে, এখন আর কিছু করার নেই। কাল শুরু থেকেই সবটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। ভুলে যা, ভালো থাকবি। আমিই তো দ্যাখ সব ভুলে বিন্দাস মজা করছি। আফসোস হচ্ছে কালকে আর বিয়েতে গিয়ে মজা করতে পারলাম না, দুটো ছবি তুলতে পারলাম না। শিলা আহমেদের মতো ছেলেদের ভেংচি কাটত পারলাম না।’
অনু চুপচাপ শুয়ে থাকে, কিছু বলে না। কালকের কথা মনে পড়লেই তার মাথা ব্যথা করে। ধুর! রিমা ওকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলে,
-‘দ্যাখ, আমার মতে সবার সুন্দর মুহূর্তগুলোই মনে রাখতে হয়। তুই কালকের খারাপ টা ভুলে ভালো টা মনে কর না। দেখবি সব ঠিক লাগছে।’
অনুর শুধু মনে পড়ে কালকের সেই লোকটার কথা—যিনি তাদের সাহায্য করেছিলেন। তার বাইরে আর কোনো ভালো মুহূর্ত ওর মনে পড়ছে না। আশ্চর্য! এখন আবার কি হলো! জ্বর বাড়ছে নিশ্চয়ই। উফ!
_________________________________
রামিশা চৌধুরী লিভিং রুমে বসে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ধরে একের পর এক ফাই-ফরমাশ খাটাচ্ছেন। মাজেদের মা ধুর থেকে তা উঁকি দিয়ে দেখছে। একটু পর তার প্রিয় সিরিয়াল শুরু হবে। অন্যদিন এই সময়ে পায়ের উপর পা তুলে তিনি টিভি দেখেন। সাথে চা ও খান। বাড়ির বউ মেয়েরা সিরিয়াল তো দূরের কথা টিভিও দেখে না এখন আর। সবার হাতেই এখন ছোট ছোট টিভি। মাজেদের মা মনে মনে সবাইকে সেটা নিয়ে গা’লি দেয়।
রামিশা চৌধুরী দেওয়ালে টাঙানো বড় আয়নায় চোখ পড়লে দেখেন মাজেদের মা তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। তিনি তা দেখে ভরাট গলায় ডাক দিলেন,
-‘মাজেদের মা, এই মাজেদের মা!’
মাজেদের মা পেছন ফিরে চলে যেতে নিলে ফুফু আবার ডাক দিয়ে বলেন,
-‘মাজেদের মা আমি তোমাকে এখানে ডাকছি তুমি ওদিকে কোথায় যাচ্ছ!’
মাজেদের মা তব্দা খেয়ে তখন আর না পালিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্যাবড্যাব করে রামিশা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবে, -‘আল্লাহ্ পাক কি এই বুড়িরে চাইর চোওখ দিল না কি? তানি এত কিছু দেখবার পায় ক্যামনে? পিছনে মনে হয় চোওখ আছে তারার। ডাইনি বুড়ি একটা!’
-‘তুমি এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি না করে কাজের কাজ কিছু করতে পারো না?’
-‘জ্বে আমি তো কাজই করি। আমার নামই কাজের বেডি।’
-‘দেখা হয়েছে আমার তুমি কেমন কাজ করো। যাও, আমার জন্য গিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসো। চিনি বেশি করে দেবে।’
-‘চিনি বেশি খাইবেন?’
-‘হ্যাঁ, তোমার কোনো সমস্যা?’
-‘না মানে আপনে তো এমতেই যে মোডার মোডা! চিনি খাইলে আরো মোডা হইবেন। আবার দুই দিন পর ম’ইরাও যাইবেন। কিন্তু তহন তো সমইস্যা হইব।’
রামিশা চৌধুরী হাতের ম্যাগাজিন মুঠ করে ধরলেন, রা’গে হিসহিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘তখন কী সমস্যা হবে?’
-‘আপনেরে তো কেহ তুলতেই পারব না। হে হে হে!’
-‘মাজেদের মা, তোমার এত বড় স্প’র্ধা!’
মাজেদের মা খেয়াল করল আজকে সে ভুল বশত মনের কথা বলে ফেলেছে। নিশ্চয়ই আজ এই বাড়িতে তার শেষ দিন হতে চলেছে।
#চলবে।