“এমনই এক দিনে” (পর্ব-৪)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৭.
রেবেকা সুলতানা সেই সকাল থেকে সরোদের পেছন পেছন একটা বড় ধরনের আবদার নিয়ে ঘুরছেন। ছেলেটাকে একবারও রাজি করানো যাচ্ছে না। বারবার বলছে, “ভাইয়া জানলে আমার খবর আছে!” এতবার বোঝানোর পরেও সে বুঝতে রাজি না। অগত্যা তিনি সরোদ অফিসে যাওয়ার সময় হাল ছাড়লেন। বুঝতে পারলেন আর কিছু করার নেই। রাতুল ভার্সিটিতে যাচ্ছিল তাকে দেখে কি মনে করে বলল,
“রাতুল আমার সাথে এক জায়গায় যেতে পারবি? তোর মা সুস্থ থাকলে তাকে নিয়েই যেতাম।”
“কোথায় বলো তো!”
রেবেকা সুলতানা ভুলে যাবেন দেখে আগেই একটা কাগজের মধ্যে ঠিকানা লিখে রেখেছিলেন। রাতুলকে দিতেই দেখা গেল সে চমকে উঠল। বলল,
“এখানে তোমার কাজ কী?”
“আছে কাজ। তুই এমন অবাক হচ্ছিস কেন? তুই চিনিস?”
“চিনব না কেন। এটা আমার স্কুল ফ্রেন্ড অনুদের বাসার ঠিকানা।”
সরোদ জুতার ফিতা বাঁধছিল, রাতুলের কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো। ইতস্তত কন্ঠে বলল,
“অনু?”
“আরে সেদিন আপির বিয়েতে এলো না! আমি যে কথা বললাম তোমার সামনে একটা মেয়ের সাথে।”
এরপর সে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে সোফায় ফেলে বলল, “চলো বড় মা, যাই। কিন্তু ওদের বাসায় কী কাজ!”
“কাজ কী এখন বলব না। গেলেই বুঝবি। দাঁড়া আমি আগে তৈরি হয়ে আসি। তুই ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল।”
“বড় মা, রাতুলের শুধু শুধু ক্লাস মিস দেওয়ার দরকার নেই। আমি যাচ্ছি।”
“সে কী রে! তুই না একটু আগেও পারবি না বললি?”
“তখন বলেছি, ভেবেছি তুমি যাবে না আর। এখন তুমি যেহেতু যাবে বলে ঠিক করেই ফেলেছ তখন আমিই যাই সাথে। রাতুলের যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“সমস্যা নেই, আমি যেতে পারব।”
“না, তুই ইউনিভার্সিটিতে যাবি।”
রাতুল জানে আর কিছু বলে লাভ নেই। তাই ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রেবেকা সুলতানা উপরে নিজের ঘরে চলে গেলেন কাপড় বদলাতে। আর সরোদ কাগজটা নিয়ে বেশ কয়েকবার ঠিকানাটা আওড়াতে থাকে।
_________________________________
শর্বরী বাড়ির সামনের বৈঠকখানায় বসে আছে। অনু ছাদে গেছে কয়টা আম পেড়ে আনতে। রিমা কলেজে। খোকন আর মাজেদের মা বড় চাচীর সবজি বাগান থেকে করলা তুলছে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে খোকন মাজেদের মাকে বলছে,
“এতা খায়?”
“হ খায়। তুমিও খাও। কী যে মজা! কী যে মিঠা! খাও খাও।”
শর্বরী সেদিকে তাকিয়ে দেখল খোকন সত্যি সত্যি করলা মুখে দিয়ে দিয়েছে। শর্বরীর একবার মাজেদের মায়ের উপর রাগ হলো আবার খোকনকে তিতা করলা মুখে দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠতে দেখে বেশ হাসিও পেল। ততক্ষণে অনু আম ধুয়ে কে”টে সাথে লবণ, মরিচ আর চিনি দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে এনেছে। টেবিলে বাটি রেখে সে লক্ষ্য করল খোকন বার বার থু থু ফেলছে। ও চেঁচিয়ে উঠল,
“মাজেদের মা! খোকনের কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। পণ্ডিত পোলায় এই তিতা করল্লা খাইতে গেসে।”
অনু খোকনকে নিয়ে ওর মায়ের কাছে দিয়ে ফিরে এলো। শর্বরী বলল,
“মাজেদের মায়ের হাতে খোকন অনিরাপদ।”
“সেটাই তো মনে হচ্ছে।”
অনু হেসে ফেলল। আম খাওয়া শেষে এবার ওরা ঝোলটা কে খাবে সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে লাগল। অনু বলল,
“এত কষ্ট করে বানিয়ে এনেছি। এটা আমাকে দে আমি খাই। প্লিজ আপা!”
শর্বরী ছেড়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা নে।”
অনু বসে বাটিটা যখন মুখের সামনে নিয়ে একটা মস্ত বড় হা করল তখনই একটা গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল। ভেতরে বসা দুটো মানুষের একটাকে দেখে সে চিনতে পারল এবং সাথে সাথেই তার হাত থেকে বাটি ফসকে সবটা ঝোল তার গায়ে পড়ল। সে স্পষ্ট খেয়াল করল চেনা মানুষটা মাথা নিচু করে হাসছে।
সরোদ খুব চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারেনি। রেবেকা সুলতানা গাড়ি থেকে নামার পর সে নিজের হাসি সামলে নিল। শর্বরী রেবেকা সুলতানাকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ও ভাবতেই পারছে না মহিলা ওঁর বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। তখনই ওঁর ভুল হয়েছে। ঠিকানা জিজ্ঞেস করায় কিছু বলা উচিত হয় নি। ততক্ষণে অনু উঠে এক ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। তা দেখে সরোদ আবারো হাসি আটকাতে ব্যর্থ হলো।
৮.
শর্বরী ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে, সে ভাবতেও পারছে না ব্যাপারটা এত দূর অব্দি পৌঁছে গেছে। একটু আগেই অনু এসে বলল রেবেকা সুলতানা না কি নিজের ছেলের জন্য শর্বরীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। বাবা আর চাচারা এখনও কি কথা বলছেন সে জানে না। কিন্তু সে বারবার চাইছে উনারা যেন বারণ করে দেয়। এমন কিছু ঘুনাক্ষরেও হতে পারে না। তার রাগ হচ্ছে কেন কাল ওই মহিলার সাথে কথা বলল। উনার ছেলে মানে ওই ভ”য়া”নক অ”ভদ্র লোকটা। অসম্ভব! ওই লোকটাকে সে তো আর কখনোই দেখতে চায় না। সে ঠিক করে রেখেছে ক্ষতিপূরণ দিতে হলেও তা নিজে গিয়ে দেবে না। প্রথমে যদিও ভেবেছিল নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে তারই সাথে ক্ষমাও চাইবে কিন্তু গতকালের পর আর সেটাও করতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষমা চাইবে না সে। কোনো ভাবেই না!
এরপর কি হলো শর্বরী আর কিছু জানে না। উনারা চলে যাওয়ার পর অনু ওর রুমে এসে বলল ওর বাবা নাকি ভাবার সময় চেয়েছেন। সে বুঝতে পারল না এখানে ভাবাভাবির কি আছে! সরাসরি না করে দিলেই তো হতো। তাছাড়া ওঁরা হ্যাঁ বললেও শর্বরী থোড়াই যাচ্ছে ওই লোককে বিয়ে করতে!
রাতে খাবার টেবিলে শর্বরীর বাবা শফিক সাহেব বললেন, “ছেলের খোঁজ খবর যা পেলাম ভালোই মনে হচ্ছে। ডাক্তার হিসেবে তার আলাদা খ্যাতি আছে। ব্যবহার ও খুব ভদ্র মার্জিত।”
শর্বরী মুখ বাঁকায়। ভদ্র মার্জিত? ওই অ”ভদ্রের ব্যবহার! লোক দেখানো সব, লোকটা ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে নিশ্চয়ই। ওর একবার বাবাকে বলতে ইচ্ছে করল, “তুমি উনার গাড়ির হেডলাইট ভেঙে দিয়ে এসো তো। দেখবে উনার আসল রূপ প্রকাশ পাবে।”
রাতে শর্বরীর ঘুম আসছিল না। বাবার কথা শোনার পর তার মনে ভ”য় ঢুকে পড়েছে। এই না আবার হ্যাঁ বলে দেয়। ছোট থেকেই তারা বেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে তাদের জীবনের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত তাদের বাবা নিয়েছেন। যদিও বাবার সিদ্ধান্ত কখনো ভুল হয় নি। তবুও! এই ব্যাপারে সে চাইছে না বাবা মত দিক। সে দেখা গেল আগের অভ্যাস অনুযায়ী না করতে পারবে না।
বেশ কিছু সময় চিন্তা ভাবনা করতে করতে ওর মাথায় একটা কথা এলো। গতকাল লোকটার ব্যবহার দেখে মনে হয়েছিল সে শর্বরীকে অপছন্দ করে। একমাত্র তার মা খুব আগ্রহ দেখাচ্ছিল ওঁকে নিয়ে। আর সেই লোকটাও তাতে বিরক্ত ছিল। শর্বরীর মন বলছে লোকটা এ ব্যাপারে কিছু জানে না। জানলে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে। এখন তাকে জানালে কেমন হয়?
স্পার্ক হসপিটালের পোর্টালে গিয়ে সে তাদের নাম্বার বের করল। রিসিপশনে কল দিয়ে নীরদের ফোন নাম্বার চাইলে তারা কোনো ভাবেই দিচ্ছিল না। অগত্যা সে নিজেকে নীরদের খুব সিরিয়াস পেশেন্ট হিসেবে পরিচয় দিল। এমন ভাবে কথা বলল ওই মহিলা তখন নাম্বার দিতে বাধ্য হলো।
নীরদ তখন সবে মাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। হুট করেই কল আসায় ভেবেছে ইমার্জেন্সি বোধহয়। সে কল রিসিভ করতেই শুনতে পেল ওপাশ থেকে কেউ বলছে, “আপনার সামান্য একটা হেডলাইট ভাঙার কারণে আপনি তো আমার লাইফ লাইটই কেড়ে নিবেন মনে হচ্ছে!”
নীরদ মুহূর্তের মধ্যে চিনে ফেলল শর্বরীকে। কিন্তু এটা বুঝতে পারল না মেয়েটা কি বলছে? কীসের লাইফ লাইট!
“আপনার কত টাকা ক্ষতিপূরণ এসেছে আমাকে বলুন। আমি দিয়ে দিচ্ছি।”
নীরদ কিছু বলল না। শর্বরী অধৈর্য গলায় বলল, “কি হলো? বলুন! কত টাকা?”
“নট মাচ, অ্যারাউন্ড ওয়ান অ্যান্ড আ হাফ ল্যাক।”
নট মাচ? শর্বরী ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। অ’ভদ্র লোকটা বলে কী? নট মাচ! সামান্য হেডলাইট অসামান্য হলো কী করে? ওর আতংকে গলা শুকিয়ে গেল। এই টাকা ও কীভাবে পরিশোধ করবে? বাবাকে জানালে ও আস্ত থাকবে? কাকে বলবে? উফ! কিছু করার নেই। এটা ওর একাই ডিল করতে হবে। ও আমতা আমতা করে বলল,
“দেখুন, আপনার নট মাচ আমার কাছে টু মাচ। এই টু মাচ আমার পক্ষে এখনই শোধ করা সম্ভব না। তবে আমি কথা দিচ্ছি আমি দেব। আমাকে দুই সপ্তাহ সময় দিন। আমি আপনাকে আপনার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব। আই প্রমিজ। কিন্তু আপনি আমাকে একটা হেল্প করুন।”
“হেল্প?”
“হ্যাঁ, হেল্প। আপনি হয়তো জানেন না আপনার মা একটা সাংঘাতিক কাজ করে ফেলেছেন।”
“যেমন?”
“যেমন উনি আমার বাড়িতে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।”
“তো?”
“তো মানে? উনি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আপনি আমার কথা ভালো করে শুনে রাখুন। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে আমি এমন যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলতে রাজি হবো। আশা করি বুঝতে পারছেন। আমার মনে হয়েছিল আপনি এ ব্যাপারে জানেন না। আপনার জানা দরকার। আপনি প্লিজ উনাকে বোঝান। উনি যেন আমার ফ্যামিলির সাথে এ বিষয়ে আর যোগাযোগ না করে।”
শর্বরী যখন থামল ঠিক তখনই তাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে চমকে দিয়ে নীরদ বলল,
“আপনাকে কে বলেছে আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না?”
“আপনি জানেন?”
“না জানার মতো কিছু দেখছি না।”
“তারপরও আপনি বারণ করলেন না?”
“বারণ করার মতো তো কিছু দেখছি না! আফটার অল, আমার বিয়ের বয়স হয়েছে, আই নিড আ ফ্যামিলি। আর এখন আমার লাইফের গোল্ডেন পিরিয়ড চলছে, আমি এটা ভালো করেই উপভোগ করতে চাই।”
শর্বরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তো করুন না, আপনাকে আটকে রেখেছে কে? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব? হোয়াই মি?”
“হোয়াই নট ইউ?”
“অসহ্য! আপনি একটা অসহ্য! ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। যা বলছি তাই করুন। নইলে!”
“নইলে?”
“নইলে ক্ষতিপূরণ তো দিব না উল্টো আরেকটা হেডলাইট ও ভেঙে দিয়ে আসব।”
“শিউর, গো এহেড!”
“অ’ভদ্র লোক! তোর এক টাকাও আমি দিব না। দেখিস তুই।”
“সমস্যা নেই। মোহরানা মনে করে মাফ করে দেব।”
শর্বরী কল কেটে দিল। তার বিশ্বাস করতে ক’ষ্ট হচ্ছে যে ওটা নীরদ ছিল। গাম্ভীর্য পূর্ণ চেহারার পেছনে এমন কেউ আছে ও ভাবতেই পারছে না। ওর খুব ভ”য় করছে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে বারবার। বাড়িতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ও আঁচ করতে পেরেছে। না, ও বিয়ে করবে না। আর কত চুপচাপ ও সবার সব কথা মেনে চলবে? এবার ও তাই করবে যা ও চাইবে।
#চলবে।