এমনই এক দিনে পর্ব-০৫

0
1

“এমনই এক দিনে” (পর্ব-৫)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৯.
সকাল থেকেই কাজের খুব চাপ পড়ছে। আজ দুই বার বোর্ডের সাথে জরুরী মিটিং এ বসতে হয়েছে। সামনের মাসের ছয় তারিখে উপজেলা পর্যায়ের ক্যাম্পিং শুরু হতে চলেছে। এর আগে একবার জেলা পর্যায়ের ক্যাম্পিং এ যাওয়া হয়েছিল নীরদের। তখন যদিও পনেরো দিনের ছিল তবে এবার ঠিক দেড় মাসের। তার এবার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ডিরেক্টর এর মুখের উপর না ও করতে পারেনি। অগত্যা তাকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। কেননা আজ ঊনত্রিশ তারিখ হাতে আর অল্প কিছুদিন সময় আছে। মা কে জানানো হয়নি এখনও। ভেবেছিল জানাবে কিন্তু মা ওঁর সাথে রাগ করে আছে। কথা বলছেন না প্রায় দুই সপ্তাহ হলো। নীরদ প্রথম কয়েকদিন খুব চেষ্টা করেছে কথা বলার এরপর কোনো উন্নতি না দেখে হাল ছাড়ল। তার রাগ হয়, দুদিনের একটা মেয়ের জন্য নিজের ছেলের সাথে এ কেমন ব্যবহার করছেন তিনি! অত্যন্ত বেয়াদব একটি মেয়ে যার মধ্যে কোনো রকম ভদ্রতা সভ্যতার বালাই নেই তার সাথে কি না নীরদের বিয়ে দিতে চলেছিলেন তিনি! সেই রাতে মেয়েটার সাথে কথা বলার পরপরই সে মাকে কল করে এই ব্যাপারে আর এগোতে বারণ করে দেয়। তা নিয়ে বেশ কিছু সময় মা ছেলের কথা কাটাকাটি হয় এক পর্যায়ে তিনি “আচ্ছা, ঠিক আছে। তোদের ভবিষ্যৎ তোরা বোঝ।” বলে কল কেটে দেন। ব্যাস; এখান থেকেই মান অভিমানের শুরু।

গাড়িতে বসে বাসায় ফেরার পথে তার মনে পড়ল সেদিনের কথা। মেয়েটা যাকে তাকে বলাতে তার ইগো হার্ট হয়েছিল যা একদম স্বাভাবিক। আর মেয়েটা যে ভয়ের মধ্যে ছিল এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে তাই শাস্তি হিসেবে ভয়ের মাত্রাটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে এই যা। তবে একটা সময় সে নিজেকেই চিনতে পারেনি। কিছু কথা সে আনমনেই বলে ফেলেছিল। তখন ঠিক মনে হলেও একটু সময় যেতেই বুঝতে পারল বড্ড বোকামি করে ফেলেছে। আর ক্ষতিপূরণ এর কথা? সেটা নীরদ কখনো আশাও করেনি। অন্তত ওই মেয়ের থেকে তো কখনোই না!
_________________________________

দাদু মা’রা যাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর হলো শর্বরীদের গ্রামে যাওয়া হয় না। গেলেও বাবা চাচারা যান, দুই একদিন থেকে চলে আসেন। তাদের নেয়না অথবা তারাও যাওয়ার সেই অবকাশ পায় না। তবে মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করত একটু গ্রামীণ পরিবেশ ঘুরে দেখার। সেই সাথে একটু স্বস্তির শ্বাস নিতে ইচ্ছে করত খুব। প্রায় তিন বছর পর হঠাৎ আজ গ্রামে এসে তার ভালো লাগছে। তবে নিজেদের গ্রামে নয় সে তার বান্ধবী অরিনদের গ্রামের বাড়িতে এসেছে। ভার্সিটি লাইফ শেষ হতে চলেছে অথচ তারা এখনও কোনো ট্যুর দেয়নি একসাথে, এ নিয়ে সবারই বেশ আক্ষেপ ছিল। কারো পরিবারই কখনো কোথাও যেতে দেয় না। তবে এবার ব্যাপারটা ভিন্ন। সামনের মাসে অরিনের বিয়ে আর বিয়ের পরপরই তাকে জাপান চলে যেতে হবে। তাই ওদের খুব মন খারাপ ছিল, অরিন চেয়েছিল যাওয়ার আগে সবার সাথে একটা সুন্দর সময় কাটাতে। তাই নিজে গিয়ে সবার বাবা মাকে বলে রাজি করায়। শর্বরীর বাবা অরিনকে স্নেহ করেন, তাছাড়া ওঁরা একা নয় অরিনের মাও যাচ্ছেন তাই তিনি এবার অনুমতি দিলেন। শর্বরীর বিশ্বাস হচ্ছিল না বাবা রাজি হয়েছেন। আজ পর্যন্ত সে কোথাও যেতে পারেনি, স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটি থেকে পিকনিকে বাকিরা গেলেও তার কখনো যাওয়া হয়নি। সে ভেবেছিল এবারো বোধহয় পারবে না। কিন্তু পেরেছে। এখানে আসা অব্দি তার মন স্থির থাকতে পারছিল না এক মুহুর্তের জন্যও। বারবার মনে হচ্ছিল এই না বাবা আবার মানা করে দেয়!

তারা এখানে এসেছে গতকাল রাতে। একদম সাত ঘন্টার জার্নি শেষে তারা এসেই কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই অরিনদের পুকুরে গিয়ে বসল। নিরিবিলি পরিবেশ, বাড়ির চারপাশে দেওয়াল তুলে দেওয়া। পুকুরটাও অরিনদের নিজেদের, একদম পাকা করা, বসার জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। আশেপাশে প্রচুর গাছপালা থাকায় এই তীব্র গরমেও বেশ আরাম লাগছে। একটু পর পরই শীতল কোমল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঢাকার বাতাসেও ছিল উত্তাপ। সেই বাতাসে শান্তির বদলে অশান্তি লাগত। সারাক্ষণ ভ্যাপসা গরম পড়ত, এখানে আসার পর এই আবহাওয়া আর পরিবেশ ছেড়ে তার একটুও আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। পুকুরের পানি কমে গেছে যদিও তবুও ওরা একদম নিচের সিঁড়িতে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে দিল। আহা! এখন আরো ভালো লাগছে। পানি আরেকটু বেশি হলে ও এখনই নেমে পড়ত সাঁতার কা টার জন্য।

সকালের নাশতা সেরে ওরা বের হলো আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। অরিন ওদেরকে তার এক চাচীর বাড়ি নিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা ওদেরকে বেশ আপ্যায়ন করলেন। গাছ থেকে আম পেড়ে সেগুলো পুড়িয়ে শরবত করে দিলেন। এত মজা হয়েছিল খেতে! শর্বরী দুই গ্লাস খেয়েছে। তাদেরকে আবার ফেরার সময় উনি এক ব্যাগ আমি দিয়ে দেন। এরপর ওরা ধানক্ষেতে যায়, সেখানে গিয়ে ওর চোখ জুড়িয়ে যায়। এই তো সেই সোনার বাংলা! মৃদু বাতাসে রোদে ঝিকমিক করা সোনালি ধানের শীষ গুলো দুলে উঠছে বারবার। আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল নীল চাদর, যার মাঝে মাঝে ভেসে যাচ্ছে সাদা মেঘের পাল। দূরে দেখা যাচ্ছে কৃষকরা ধান কাটছে, তাঁদের চোখে মুখে প্রশান্তির ছোঁয়া। সারাটা বছর কষ্ট করে, ঘাম ঝরিয়ে মাঠে কাজ করে তাঁরা। দিনের পর দিন হয় রোদে পুড়ে না হয় বৃষ্টিতে ভিজে অবিরত তাঁরা কাজ করে যায়। ধান পাকে, সোনালি হয় মাঠ, তখনই তাদের মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি। ছোট ঘরে ফসলের গন্ধে তারা যেন খুঁজে পায় সোনার খনি। মুঠো ভরা ধান হাতে পেয়ে চাষা ভাবে “এটাই তো আমার স্বপ্ন!”
তাদের আনন্দ হয়তো অন্যদের তুলনায় খুব দামি নয়, কিন্তু খাঁটি। ছেলে-মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিতে পারা, ঋণের বোঝা একটু হালকা হওয়া, কিংবা নতুন একটা লুঙ্গি কেনার সামর্থ্য—এই ছোট ছোট সুখেই গরীব চাষাদের বড় আনন্দ।

পরদিন শর্বরীদের নিয়ে অরিন তাদের বাড়ির পেছনের দিকে হাঁটতে বের হলো। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। তাই কাঁদা মাটিতে একটু সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল। সবাই সাবধানে থাকলেও ফিহা অসাবধানতাবশত পা পিছলে পড়ে যায় আর সাথে সাথেই একটা ভাঙা গাছের রুক্ষ ডালের খোঁচায় তার হাত ছিলে যায়। ক্ষতটা বোধহয় একটু বেশিই গাঢ় হয় কেননা অনবরত র”ক্ত ঝরছিল। ওঁরা বাড়িতে ফেরে ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি, এখান থেকে শহরে যেতে ওদের বিশ মিনিট লাগবে। শর্বরী আর অরিন ঠিক করল ওঁরা দুজন যাবে। তারা যখন বের হতে নিবে তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা এসে জানান দুই দিন আগে এখানে শহর থেকে দুই তিন জন ডাক্তার এসেছে। তারা বিনা পয়সায় বেশ ভালো চিকিৎসা দিচ্ছে তাই এখানেই সরকারি ক্লিনিকটায় নিয়ে যেতে বলছেন তিনি। ওখানে যেতে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। ফিহা নিজেই বারবার বলছিল ওখানেই যেতে। শর্বরী আর অরিন যদিও চাইছিল শহরেই যেতে কিন্তু এখন ক্ষতটা গভীর, আর বেশি সময় অপেক্ষা করলে যদি ইনফেকশন হয়ে যায় তাহলে তো আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই অন্য উপায় না পেয়ে সেখানেই গেল।

১০.
নীরদের মেজাজ বিগড়ে আছে, তার থাকার কথা ছিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিন্তু তাকে এখন থাকতে হচ্ছে ইউনিয়ন পর্যায়ে। যে ডাক্তারের এখানে আসার কথা ছিল তিনি আকস্মিক পারিবারিক ঝামেলায় আটকা পড়েছেন। তাই এই এক সপ্তাহ নীরদকে এখানে থাকতে হবে। নীরদের কাছে এখানে থাকা নিয়ে কিংবা এখানকার মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তার মূল সমস্যা হলো কিছু উঠতি বয়সী হাই স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের নিয়ে। মেয়ে গুলো প্রতিদিন অযথা এসে ভীড় জমাচ্ছে আর উল্টাপাল্টা অসুখের কথা বলছে। নীরদ কিছু বললেই হা হা হি হি করে হেসে রীতিমত মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আজকে তো সীমা ছাড়িয়ে গেছে একদম, একটা মেয়ে এসেছিল, খুব করুন গলায় বলল, তার বুকে ব্যথা করছে। নীরদ জানতে চাইল,

“কবে থেকে?”

“তিনদিন হলো।”

পাশ থেকে মেয়েটার বান্ধবী ফট করে বলল উঠল, “কেন এমন হচ্ছে সেটা তো বল।”

নীরদ কিছুটা বি’র’ক্ত হয়ে বলল,
-“কেন হচ্ছে সেটা জানলে কি আর উনি আমার কাছে আসতেন!”

সেই মেয়েটা এবার বলল,
“আমি জানি ডাক্তার, কেন এমন হচ্ছে।”

নীরদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন?”

“আপনার জন্য। আপনিই তো আসল কারণ।”

মেয়েটার পেছনে ছোট বড় অনেক জনই দাঁড়িয়ে ছিল। এমন কথা শুনে সবাই হাসাহাসি করছিল। নীরদ খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল তাতে। অনেক চেষ্টার পরও সে নিজের রাগ ধরে রাখতে পারল না, ধ’ম’কে উঠল,

“যাও এখান থেকে!”
_________________________________

ফিহার হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ডাক্তার রোকসানা কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। আর বললেন আবার এসে যেন ব্যান্ডেজ বদলে যায়, সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে ক্ষ”তস্থানে যেন ময়লা না লাগে এবং শুকিয়ে না আসা পর্যন্ত পানিতে না ভেজে। ওদেরকে দেখে উনি শুরুতেই বুঝতে পারলেন এখানকার স্থানীয় নয় তাই আলাপ শুরু করলেন। ওরা যখন জানালো ঘুরতে এসেছে তখন তিনি সাবধান করলেন এভাবে বনে জঙ্গলে না ঘোরার জন্য। অচেনা জায়গায় স’তর্কতা অবলম্বন করতে হয়, তাছাড়া তিনি শুনেছেন সা’পের খুব উপদ্রব ওদিকে, তাই আরেকটু সাবধানে চলাফেরা করতে বললেন‌।

তাদের কথার মাঝখানেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো নীরদ। ভেতরে ঢুকেই সে সোজা নিজের ডেস্কের দিকে চলে গেল। আশপাশে কোথাও তাকালো না। তার চোখ মুখের অবস্থা দেখেই রোকসানা বুঝতে পারলেন আবারো কিছু একটা হয়েছে। তিনি হেসে জানতে চাইলেন,

“আবার কি হলো ডক্টর আশহাব?”

সেদিকে না তাকিয়েই নীরদ বলল,
“ডোন্ট লাফ, ডক্টর রোকসান।”

“আজ আবারো?”

“দিস ইজ আনবেয়ারেবল‌। আই ক্যান্ট টেক ইট এনিমোর।”

বলেই পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিলতে লাগল। রোকসানা বললেন,

“আসলে দোষটা আপনার বুঝলেন। আপনাকে কে বলল এত হেলথ কনশাস হতে? মেয়ে গুলোর অল্প বয়স, চোখের সামনে এমন ফিটফাট ইয়াং ডাক্তার দেখে তো তারা পাগল হবেই‌। ডক্টর ফারহানকে দেখুন, উনি তো বিন্দাস চলছেন। ঘুরছেন ফিরছেন কেউ তো তাকে বিরক্ত করছে না।”

ডক্টর ফারহান মাত্রই ভেতরে এসেছিলেন। কথা গুলো শুনে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। রোকসানা তাকে এভাবে বলে দিতে পারল? তিনি লক্ষ্য করলেন ভেতরে তিনটি মেয়ে বসে আছেন। তাদের সামনে এভাবে কীভাবে বলে দিলেন এমন কথা!

নীরদ রোকসানার এমন কথা শুনে তার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। চোখের ভ্রম কি না তা বোঝার চেষ্টা করল। আজকাল ভাবাভাবির সাথে এখন মেয়েটাকে নিয়ে তার হ্যালুসিনেশন ও শুরু হয়ে গেল কি না সে বুঝতে পারল না।

শর্বরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরটা শিরশির করে উঠল। লোকটা তার দিকে তাকালেই এমন হয়। এ নিয়ে যতবারই সে তাকিয়েছে ততবারই ভয়ের চোটে শর্বরীর যাই যাই অবস্থা হয়েছে। কি একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ল সে! ঘুরে ঘুরেই লোকটার সাথে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে— চাইলেও এড়ানো যাচ্ছে না, ভাগ্যই যেন বারবার মুখোমুখি করে দিচ্ছে তাদের।

#চলবে।