এমনই এক দিনে পর্ব-০৯

0
1

“এমনই এক দিনে” (পর্ব-৯)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

(ক’পি করা নিষেধ।)

১৭.
বছরের এই সময়ের আবহাওয়া বোঝা মুশকিল। এই যেমন, সকালে ভীষণ রোদ, দুপুরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। যেদিন দেখা যায় সকাল থেকেই মেঘ করে, এই একটু পরেই বৃষ্টি নামবে এমন অবস্থা হয়, সেদিন আর বৃষ্টিই হয় না। ছাতা নিয়ে বের হতে বিরক্ত লাগে, তাও কয়েকদিন অনু ছাতা নিয়ে বের হয়েছে। তখন বৃষ্টি হয়নি। আজ ঝলমলে আকাশ দেখে বোঝার উপায় ছিল না বেলা গড়াতেই যে এমন ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে। ছাতাটা রেখেই বেরিয়েছিল। আর আজই কি না এমন মুসিবতে পড়তে হয়েছে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ খুঁজেও একটা রিকশা বা সিএনজি জোগাড় করতে পারল না। বৃষ্টির দিনে এই আরেক জ্বালা, রিকশা কিংবা তেমন কোনো গাড়িই পাওয়া যায় না। অন্যান্য দিন না চাইলেও বিশজন এসে বলবে, “আপা কই যাইবেন?” অথচ আজ তাদের ডাকলেও শুনছে না। রাস্তায় মানুষ ও তেমন একটা নেই। ওই যে, বিপদের সময় সবসময় একাই থাকতে হয়‌। যাত্রী ছাউনী তে বসে কোনো রকম করে বৃষ্টি থেকে নাহয় বেঁচেছে কিন্তু এভাবে একা একা আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? একবার ভাবল বাড়িতে কল করবে পরক্ষণেই ভাবল, থাক। এইটুকু ঝামেলা ঠিক সামলে নিতে পারবে। তবে ওঁর প্রত্যাশা মতো আজ কিছুই হচ্ছে না। এই যে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ওঁ সেটা খুব ভ’য় পায়। হাত পা গুটিয়ে নিয়ে এবার বাড়িতে কল করল। অদ্ভুত ভাবে তখন নেটওয়ার্ক এর সমস্যা দিতে লাগল। কল ঢুকছে না কোনো ভাবেই। ওঁর এবার কান্না করে দেওয়ার মতো অবস্থা হলো। কপালে তিন আঙুল ঘসতে ঘসতে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। অনুর মতো ভীতু মেয়ে এতক্ষণ কান্না না করে কীভাবে ছিল সেটাই তো চিন্তার বিষয়। রিমা থাকলে হয়তো অনুকে দেখে হার্ট অ্যা’টাক করতো। নিশ্চিত ঠাট্টা করে বলত, এত সাহসী অনুকে সে কখনো দেখেনি।

হঠাৎ সশব্দে সেখানে একটা কালো রঙের গাড়ি ব্রেক কষে। কালো গাড়ি দেখে খা’রাপ কেউ ভেবে ভ’য়ে আঁ’তকে উঠল অনু। গাড়ি থেকে কালো ছাতা মাথায় দিয়ে একজনকে বের হতে দেখে ওঁ আরো ঘাবড়ে গেল। তবে লোকটা যখন সামনে এলো ও চমকে উঠল ঠিকই তবে স্বস্তিও ফিরে পায়‌। সরোদ আলতো হেসে বলল,

“কোনো গাড়ি পাচ্ছেন না?”

অনু উঠে দাঁড়ায়। কিছু বলতে পারে না। শুধু মাথা নাড়ে। যার অর্থ না, পাচ্ছে না। সরোদ বলল,

“আমি আপনাদের বাড়ির ওদিকেই যাচ্ছিলাম। কোনো সমস্যা না থাকলে আমার সাথে যেতে পারেন। আমি ড্রপ করে দেব।”

অনু সাথে সাথেই মাথা নেড়ে বলল, “না, আমি যেতে পারব।”

“পারবেন আমি জানি। তবে এখন রিকশা কিংবা কোনো গাড়ি পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। বৃষ্টির গতি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন একটু পরেই এখানটায় পানি জমে যাবে‌। তাছাড়া অন্ধকার হয়ে আসছে। আশেপাশেও তেমন কেউ নেই। আর আপনাকে এভাবে একা ফেলে আমিও যেতে পারব না।”

অনুর ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করতে, “কেন পারবেন না?” তবে সেটা করল না। ওঁর মনে এখন অনেকটা ভ’য় ঢুকে গেছে। লোকটা যা বলছে তার একটাও ভুল কথা নয়‌। এখন তো আর না করার উপায় নেই। ও কিছু বলল না আর। সরোদ নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিল। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো। অনু চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ল‌। হঠাৎ অনুভব করল ওঁর বুক ধড়ফড় করছে। হার্ট অ্যা’টাক করতে চলেছে না কি?

ড্রাইভ করতে করতে সরোদ আড়চোখে বারবার অনুর দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটা ওঁর এত কাছে আছে তবুও কত দূরে! একটু আগেই তার মেজাজ বিগড়ে ছিল। অফিস থেকে রাগারাগী করে বেরিয়েছে। ড্রাইভ করতে করতে কয়েকবার নিয়ন্ত্রণ ও হারিয়ে ফেলেছিল। দূর থেকে হঠাৎ মেয়েটাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য মনের ভ্রম মনে হয়েছিল। কাছে আসতেই সেই ভ্রম চরম সত্য হয়ে ধরা দিল।

অনু বুঝতে পারছে লোকটা বারবার ওঁর দিকে তাকাচ্ছে। খেয়াল করে দেখল এতে রা’গের থেকেও বেশি ল’জ্জা পাচ্ছে সে। এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হতো। অন্তত এমন দমবন্ধ করা অবস্থায় পড়তে হয়নি তখন। বেশ কিছুক্ষণ পর ও সোজা হয়ে বসল। না, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। সরোদের দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে উঠল,

“আপনার দৃষ্টি থাকবে সামনের দিকে। এদিক ওদিক কী দেখছেন? বাড়িতে ড্রপ করার নাম করে একেবারে উপরেই ড্রপ করে দেবেন মনে হচ্ছে।”

সরোদ হেসে ফেলল। অনু বিরক্ত হয়ে বাইরে তাকালো। জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। দেখতে ভালো লাগছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। সরোদ ততক্ষণে গান ছেড়েছে একটা,

বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি,
এ কোন অপরূপ সৃষ্টি
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি……
এ কোন অপরূপ সৃষ্টি
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি

এত মেঘের কোণে কোণে
এল বাতাস হুহু শনে
এত মেঘের কোণে কোণে
এল বাতাস হুহু শনে
রিমঝিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি
এ কি দুষ্ট অনাসৃষ্টি
বৃষ্টি ….বৃষ্টি …..বৃষ্টি…
ওগো বৃষ্টি তুমি মিষ্টি

বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
এ কোন অপরূপ সৃষ্টি
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি……

তোমার অঝোর ধারায় ভিজে
আমি নতুন হলাম নিজে
তোমার অঝোর ধারায় ভিজে
আমি নতুন হলাম নিজে
মা মা পা ধা নি ধা নি
আজ হারিয়ে গেছি আমি
বৃষ্টি… বৃষ্টি… বৃষ্টি….
কেন এত তুমি মিষ্টি

বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
এ কোন অপরূপ সৃষ্টি
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি……..

১৮.
সকাল সকাল মা ফোন করেছিলেন, নীরদ কাজে ব্যস্ত ছিল। রিসিভ করতে পারেনি। একটু সময় পার হলে সে যখন কল ব্যাক করল তখন তার মা বোধহয় খুব রে’গে ছিলেন। ভারী গলায় বললেন,

“আজকাল ভীষণ ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে। মা কে কল করার সময় পাও না, মা কল দিলেও রিসিভ করো না।”

“মা আমি সবসময় ব্যস্ত থাকি। এমনটা নতুন কিছু না। আর কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছ কেন?”

“তাসরিফের মায়ের সাথে আজকে কথা হলো।”

“তো?”

“উনি চাইছেন উনার ভাইয়ের মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করতে।”

“আচ্ছা।”

“আচ্ছা? এখন আচ্ছা? বিয়ে করতে রাজি তুমি?”

মা খুব বেশি রেগে আছেন নীরদ বুঝতে পারল। এত রেগে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে সেটা চট করেই ধরতে পারল না। বলল,

“তুমিই তো চাইতে আমি বিয়ে করি।”

“চাইতাম মানে? আমি এখনও চাই। তবে আমার পছন্দ করা পাত্রীর সাথে হোক সেটা চাই।”

নীরদ চোখ বন্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করল। মায়ের পছন্দ করা মেয়ে মানে ওই মেয়েটা! জেদি, আত্মকেন্দ্রিক একটা মেয়ে! নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবে, সততার মূর্ত প্রতীক একেবারে! আত্ম অহমিকায় ডুবে থাকা মেয়েটাকে সে ভীষণ অপছন্দ করে। মায়ের সাথে সন্ধি করতে ইচ্ছে করল না তার। ভালো করেই জানে, একবার হ্যাঁ বললে এই বিয়ে সম্পন্ন করে ছাড়বেন তিনি। যা সে কষ্মিনকালেও চায় না। এর থেকে অদেখা, অচেনা তাসরিফের কাজিনটাকেই বিয়ে করে নেওয়া উত্তম হবে। বরং অবিবাহিত পড়ে থাকলে ওই মেয়ের জন্য তাকে আরো ভোগান্তিতে পড়তে হবে। মায়ের সাথে বারবার তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হবে।

“তুমি হ্যাঁ বলে দাও। ওই মেয়েকেই বিয়ে করব।”

“কি বললি তুই? ওই মেয়েকেই বিয়ে করবি!”

মা আবার তুই তে ফিরে এসেছেন। যাক তাও ভালো। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সে মনে প্রাণে ওই মেয়েকে ভুলতে চায়। তার এতটুকু জীবনে আজ পর্যন্ত কেউ এমন ছোট করে তাকে কিছু বলতে পারেনি। অথচ ওইটুকু একটা মেয়ে! ওঁর সাহস কত? নীরদকে বলছে চোখের সামনে দেখতে চায় না, তাকে না কি ভালো লাগে না। আরে নীরদ নিজেই তো এমন মেয়েদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। দুর্ভাগ্যক্রমে এই মেয়েটাকে নিয়ে একটু ভাবতে হয়েছে এই যা!

“বিয়ে করলে এখন এখানেই করব। নয়তো আর কখনো করব না। তুমি ঠিক করো, তুমি কি চাও। ছেলের পছন্দ না কি নিজের পছন্দ। আমি বলে রাখছি আগে থেকেই। তুমি যার কথা বলছ তাকে কোনো দিনই আমি জীবন সঙ্গিনী হিসেবে মেনে নেব না।”

#চলবে।