রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-০২

0
1

#রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২
#নাজমুন_নাহার

নিশির প্রথম প্রহর।
ল্যাম্পোস্টের হলদেটে আলোয় ধুলোর শহর কমলা রঙা রুপ ধারণ করেছে। সেই মলিন আলোর পথ ধরে সদ্য বিয়ের লগন থেকে পালিয়ে সতর্কতার সহিত হেঁটে চলেছে একজোড়া বিভ্রান্ত যুবক-যুবতী। জাদুর শহরের বুক চিরে, নাম না জানা উদ্দেশ্যে, অজানা গন্তব্যে। কে জানে, কী আছে তারপর!

নিরার কালো রঙের বোরখার ভেতরের বেনারসীটা একটু আধটু পায়ের দিকে উন্মুক্ত। আশপাশটা তখনও পুরোপুরি নিস্তব্ধ না। রাত কেবল দশ-টা বাজলো। এই অবেলাতেই বাড়ির গেইট ডিঙিয়ে এসে দিশেহারার মতো ছুটছে নাবিল-নিরা। শেষমেশ ইফরানটা ওর মায়ের বোরখা এনে দিয়ে হেল্প না করলে আজ আর রক্ষা ছিল না।

বোরখার পরার দরুণ নিরার কনে সাজ ঢাকা পড়লেও নাবিলের পরনে তখনও বিয়ের পাঞ্জাবী। হাতে নিরার কালো রঙের একটা লাগেজ আর তারই মায়ের কিনে দেওয়া গোল্ডেন রঙের জুতাগুলো। নাবিল এসব নিয়ে ব্যাপক বিরক্ত। হাতে করে ব্যাগপত্র বহন করতে হবে বলে কখনও মায়ের সাথে মার্কেটে পর্যন্ত যায়নি ছেলেটা। আর এখন, এই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা রাতে এসে কি-না তরতাজা একটা যুবতীর ময়লা জুতাও বহন করতে হচ্ছে? কী কপাল! এরচেয়ে পাবজি খেলে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়াও উত্তম। কোন ঘুনাক্ষরে যে এই ব্রিটিশ মরিচের সাথে আম্মাজান তাকে একঘরে করতে চেয়েছেন, কে জানে! এবার সামলাও ঠেলা!

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে পেছনে চাইলো। দৌড়াতে দৌড়াতে নিরাটার অবস্থা প্রায় কাহিল। জুতা খুলেও বেনারসীর ভার সামলাতে পারছেনা মেয়েটা। আশপাশ থেকে লোকজন ক্ষণে ক্ষণে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে ওদের। এই রাত-বিরেতে দু’টো প্রাপ্তবয়স্ক যুবক-যুবতী এমন অদ্ভুত সাজে কোথায় ছুটছে? কোনো অবৈধ ঘটনা নয়তো? ওদের বাঁকা দৃষ্টি কখন বিপদ বয়ে আনে, কে জানে। লোকগুলো একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কী সব বিরবির করছে। আরচোখে সেদিকে একপলক চাইলো নিরা। প্রবল ক্লান্তিভাব শরীরে, তার উপর মনের ভয়। সব মিলিয়ে বেশ আতঙ্কজনক ব্যাপার।

হাঁটতে হাঁটতে বেশ নির্জন একটা গলিতে ঢুকে পড়েছে । নিরার পা দু’টো আর চলতে চায় না৷ এমনিতেও সারাদিন পেটে খাবার পড়েনি। ক্লান্তিতে শেষমেশ হাঁপাতে হাঁপাতে রাস্তাতেই বসে পড়ল এক পর্যায়। নাবিলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপন ভঙ্গিতে হাঁটছে। নির্জনে হাঁটতে হাঁটতে একা একা অনেকটা পথ চলে এসেছে প্রায়। খেয়াল করলো না পাশের জন সাথে আছে, কী নেই। নিরা একপলক ওর যাওয়ার পানে চেয়ে বিরবির করে কয়েকটা অশ্রাব্য, বিচ্ছিরি গালি ছুড়ল। একটা মেয়েকে এমন দুর্দশায় রেখে একা একাই বৈঠা চালিয়ে দিয়েছে। হাঁটার ধরন দেখো। আছে কোনো ভয়ডর এর ভেতর? কেমন মনের সুখে হাঁটছে। বদের হাড্ডি!

শরীরটা একটু স্বস্তি পেতেই পূনরায় উঠে দাঁড়ালো। মুখের নেকাপটা ঠিক করে হাঁটা ধরতেই কিসের অদ্ভুত ধরনের ডাকে পেছন ফিরে চাইলো। ঘাড় ঘুরাতেই যা দেখলো, তাতে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে এলো নিরার। কয়েকটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে। এই আপদের দল কখন এসে নিরার কাছাকাছি দাঁড়ালো, মেয়েটা খেয়াল করলো না। নিরা তাকাতেই ওরা নাক ফুলিয়ে, দাঁত বের করে ভয়ংকর দৃষ্টিতে চাইলো নিরার দিকে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা এলাকার পাতি গ্যাংস্টারদের মতো। দৃষ্টি হিংস্র। সামনের দাঁতকপাটি বের করে মৃদুস্বরে কেমন অদ্ভুতভাবে আওয়াজ করছে। মনে হচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত শিকারী পেয়েছে ওদের চোখগুলো। নিরার দমবন্ধ হয়ে এলো ওদের ওমন ভয়ংকর ডাক শুনে। একটা কুকুর তো রীতিমতো ওর কাছে এসে বোরখায় নাক ঘষাঘষি শুরু করছে৷ কেমন ঘিনঘিনে ব্যাপার। ভয়ে হাঁটু কাঁপছে তাঁর। আতঙ্কে নিরার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে-না। উপায়ন্তর না পেয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপতে থাকলো। কী করবে! কোথায় যাবে! কে বাঁচাবে! ইতোমধ্যেই বরফের মতো শীতল হয়ে এসেছে সর্বাঙ্গ। শরীর কাঁপছে ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়া গাছের মতো। তবুও মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। নাক ঘষতে থাকা কুকুরটা হুট করেই বোরখায় কামড় বসালো আকস্মিক। কুঁকড়ে উঠল নিরা। বোরখায় টান পড়তেই চোখ বড় বড় করে চেয়ে গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠলো।

নাবিল পকেট থেকে একটা সেন্টারফ্রেশ বের করে সেটা চিবুতে চিবুতে মনের সুখে হাঁটছে। কখনও কখনও দু’একটা বাবল ফুলিয়ে নিজেই সেগুলো মুখ দিয়ে ফুটাচ্ছে। পকেটে আরেকটা আছে। সেটা নিরাকে দেওয়া উচিৎ কি-না ভাবলো। বোধহয় দেওয়াই যায়। পকেট থেকে সেটা বের করে নিরাকে দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে পাশে চাইলো। এ কী! ব্রিটিশ মরিচ পাশে নেই! গেলো কই ফাজিলটা? পেছনে তাকিয়েও ওকে না দেখতে পেয়ে নাবিল পুরোপুরি আবিষ্কার করলো, নিরা ওর সাথেই আর নেই। আশপাশটায় চোখ বুলালো। দূর দূর পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় দু’একটা কুকুর ব্যতিত কোথাও কেউ নেই। মেয়েটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে গলা শুকিয়ে এলো নাবিলের। এতোক্ষণ নিরা তাহলে ওর সাথে সাথে আসেনি? ও মাই গড! একটা চিৎকারের আওয়াজ কানে এলো তখনই। সাথে বেশ কিছু কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খারাপ কিছু ইঙ্গিত দিতেই নাবিল হাত থেকে লাগেজটা ফেলে মুখে, ” শিট!” উচ্চারণ করে উম্মাদের মতো দৌড় লাগালো। চেতনাহীন দৌড়াচ্ছে ছেলেটা। কোথাও নেই নিরা। অজানা বিপদ আশঙ্কায় মাথায় চিন্তার দলেরা হানা দিয়েছে। মস্তিষ্কে বহমান ঘূর্নিঝড়ের দরুণ পাঞ্জাবীটা ঘামে ভিজে একাকার। রাগে চুলগুলো টেনে ধরলো নিজের। উফ! এতোটা ইরেসপন্সিল কী করে হতে পারলাম আমি! এই নির্জন রাস্তায় কোথায় খুঁজবো ওকে? এই মুহূর্তে কোনো পুলিশ ফোন করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ না। এতে ঝামেলা কমবে বৈকি বাড়তে পারে।

শেষ আধাঘন্টা ধরে একই গলিতে দশ-টা চক্কর দিয়েও নিরার দেখা পেলো না। গেলো কোথায় মেয়েটা? কুকুরগুলো এখানেই, তাহলে নিরা কোথায়? অস্থিরতায় কপালে হাত ঠেকালো। পূনরায় খুঁজতে যাবে তখনই কানে একটা শব্দ কড়া নেড়ে ইঙ্গিত জানালো কিছু একটার। একটা নারীকন্ঠের ফোঁপানির আওয়াজ। শব্দটা বেশ জোরালো। খুব কাছ থেকেই ভেসে আসছে। নাবিল তড়াক গতিতে তা অনুসরণ করে হাতের বামদিকের অন্ধকার সরু গলিটায় চাইলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার হওয়ার দরুণ আপাতত ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেবল আবছায়া একটা অব্যয় ভেসে আসছে। নাবিল পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফ্লাশলাইটটা অন করে সেদিকে তাক করলো। আলো চোখে পড়তেই ভেতর থেকে কেউ গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো।

“বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও!”

নাবিল কান চেপে ধমকে উঠলো।

“এই ফাটাবাঁশ, গলা নামা। আমি এটা। বাংলা সিনেমার গুন্ডাধরা নাইকাদের মতো ওভারএক্টিং করা বন্ধ কর।”

তাৎক্ষণিক নিরা মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফিরে চাইলো। মানুষটা নাবিলই সেটা নিশ্চিত হতেই দৌড়ে এসে নাবিলের পাঞ্জাবীর হাতা খামচে ধরলো। চুপসে গিয়েছে মুখটা। এতোক্ষণের চাপা কান্নাগুলো পরিচিত মানুষের দেখা পেয়ে এবার কিছুতেই বাঁধ মানলো না। বেড়িয়ে এলো অগত্যাই। শরীর কাঁপছে নিরার। অসম্ভব ভয় পেয়েছে মেয়েটা। ঠোঁট উল্টে, হিচকি তুলে নাক টেনে টেনে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে সে। চোখের পানিতে বোরখার নেকাব ভিজে একাকার। নাবিল আপাতত চুপ থেকে কিছুক্ষণ ওকে দেখলো। মনে মনে হাসল মিটিমিটি। কী অসহায় লাগছে নিরাটাকে। মেজাজ বিগড়ালেও আজ আর গোষ্ঠী উদ্ধার করে বকাঝকা করলো না। কাঁদুক একটু।

পুরো রাস্তা কেউ কারো সাথে কথা বললো না। অনেকটা পথ নিঃশব্দে এসে নাবিলই একপলক ওর ফোলা ফোলা মুখের দিকে চেয়ে দুষ্টুমি করে শুধায়,,

“তুই আগে দৌড় দিয়েছিস, নাকি ওরা?”

নিরা শান্ত মুখে চাইলো। হাঁটছে গম্ভীর মুখে।

“আমি।”

নাবিল রাস্তার ইঁটের টুকরোটায় ফুটবলের মতো লাত্থি মারতে মারতে বলে, “জানতাম। ফাউল,কুকুর দেখলেই দৌড় লাগাতে হয়না জানিস না? দৌড় দিলে এরা তোকে এদের শিকারী মনে করবে। সন্দেহের দৃষ্টি পড়বে। অহেতুক বিপদ ডেকে আনা আরকি। সুবুদ্ধির বদলে ব্রেইনভর্তি হাওয়া থাকলে যা হয়।”

নিরা ফুঁসে উঠল। রাগে গজগজ করতে করতে বললো,

“কাপুরুষ! একে তো একলা ফেলে হাঁটা ধরেছো, আবার গলা ফাটিয়ে কথা শোনানো হচ্ছে? আমার বোরখায় কামড় বসিয়েছে। পায়ে কামড় দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো? আমি একা একটা মেয়ে কী করতাম? আশেপাশে কাউকে না দেখে ভয় পেয়েছি। আর তুমি, খারাপ লোক, একটুও ফিরে চেয়ে দেখলে না আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেলাম? একটা মেয়েকে নিরাপত্তা দিতে পারো না, কেমন পুরুষ তুমি? বাড়ি ফিরে ফুপ্পিকে যদি না বলেছি, তো আমিও নিরা সিকদার না।”

নাবিল বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলে,

“যত দোষ এখন নাবিল ঘোষ? আমাকে তোর নিরাপত্তার ঠিকাদার রেখেছিস? বেতন পাই? শুরু থেকেই বলছি আমার সামনে সামনে হাঁটতে। কিন্তু না, তুই তো নিজেই নারীবাদী বেগম রোকেয়া। লং ডিস্টেন্স মেইনটেইন করেছো। কথায় কথায় ভাব। মেয়ে মানুষের এতো ত্যাজ থাকতে নাই। তোরা হচ্ছিস পরনির্ভরশীল দল। কথা শুনবি ব্যাটালোকদের। আর তুই আপাতত শুনবি আমার। কানা হয়ে শার্টের কোন খামচে ধরে হাঁটবি। নেক্সট থেকে নাবিল এহসানের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করলে নয়তো এভাবেই পদে পদে বিপদে পড়তে হবে। এখন তো কুত্তা তাড়া করলো, আরেকবার ঢিলেমি করবি তো এলাকার ভুতপ্রেতদল দিয়ে দৌড়ানি খাওয়াবো।”

“ভুতপ্রেত মনে হয় উনার শশুর লাগে, বললেই মেয়ের জামাইর সেবা করতে দৌড় লাগাবে।”

মুখ বাঁকিয়ে কথাটা বলল নিরা। নাবিল পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঝুঁকে এসে বেশ ভাব নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“নিজের বাপ নিয়ে এমন কুৎসিত মন্তব্য করিস না, নিরা। তোর বাপের মাথায় একটু ডিসটার্ব আছে দ্যটস ট্রু। তাই বলে বাপকে কেই ভূত বলে?”

নিরা দুম করে পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাতে চিমটি কাটলো । নাবিল আস্কারা দিয়ে হাত পেতে দিলো।

“তোর মতো পিপড়ার নোখের আঁচড়ে আমার শরীরের একটা পশমও টলবে না, মগজছাড়া মহিলা৷ নিজের সাইজ দেখেছিস? একটা ফু দিলেই তো উড়তে উড়তে মঙ্গোলিয়া পৌঁছে যাবি। আসছে রক্ত খাইতে।”

নিরা ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিলো। নাবিল চোখ ছোট ছোট করে চাইলো।

“ওরে কী নাটক রে ভাইইই! কাঁদছিস কেন, ভেলকিবাজ?”

এই লোকের যন্ত্রনায় নিরার এবার সত্যিই ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এর চেয়ে কুকুরগুলোর কাছে ফিরে গেলেই ভালো হতো।

“আমি কতো ভয় পেলাম, আর তুমি এখনও আমাকে ধমকাচ্ছ!”

নাবিলের কিঞ্চিৎ অনুশোচনা হলো। বেচারি ভালোই ভয় পেয়েছে বোধহয়। দেখেই কেমন আহারে আহারে টাইপ ফিলিংস হচ্ছে। নয়তো এই মাল তো এমনি এমনি কেঁদে দেওয়ার মেয়ে না। কুকুরগুলো মানুষ হলে না-হয় হকিস্টিক দিয়ে কেলিয়ে আসতো। কিন্তু পশুদের সাথে আর কী-ই বা করবে?
নাবিলের মনটা নরম হলো। মায়া হলো ওর জন্য। পকেট থেকে বাকি থাকা সেন্টারফ্রশটা বের করে ওর সামনে ধরে বললো,

“আচ্ছা স্যরি। আর বকবো না। নে, এইটা চাবা। মনোযোগ অন্যদিকে কনভার্ট হলে আর ওসব মনে করে খারাপ লাগবে না। মুভ অন কর।”

নিরা কিছুক্ষণ হাতের দিকে চেয়ে থেকে চুইংগামটা নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো। প্রকট রাগ দেখিয়ে একা একাই হাঁটা ধরলো।নাবিল চোখ বড় বড় করে চাইলো। বিচ্ছুটার সাহস আর বেয়াদবি দেখে রিতীমত চোখ কপালে আর মেজাজ তুঙ্গে উঠার পথে।

“এই বেয়াদব, তুই আর আমার সাথে হাঁটবি না। নিজের রাস্তা নিজে মাপ। যদি একসঙ্গে, একই পথে আসতে দেখি তো মাথায় তুলে বাপের কাছে দিয়ে আসবো। ধরে বেঁধে নাবিল এহসানের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে, ত্যাজ বের হবে।”

নিরা দু আনার পাত্তা না দেখিয়ে মুখ ভেঙিয়ে নিজের মতো হাঁটছে। নাবিল লাগেজটা শব্দ করে আছাড় মেরে তুললো। নিরা একপলক পেছন ফিরে চেয়ে রসিয়ে রসিয়ে বললো,

“ভাঙো ভাঙো, ভেঙে গুড়ো করে ফেলো না, কে আটকালো? তারপর ভেতরের মালপত্র সব পকেটে আর মাথায় নিয়ে ঘুরবে। আমার কী!”

নাবিল অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলো। সামান্য কুত্তার দৌড়ানি খাওয়া মেয়ে কিনা ওকে হুমকি দিচ্ছে? নাবিলকে! এটাকে তো সময়-সুযোগ বুঝে হারে হারে দেখে নেবে সে।

মালিবাগের একটা টঙ্গের দোকানে বসলো ওরা। হাতে ধোঁয়াউঠা রঙ চা। মাথাটা ধরেছে খুব।

“আমরা কোথায় যাবো এতো রাতে? কিছু ঠিক করেছো?

মিনমিন করে প্রশ্নটা করলো নিরা। নাবিল স্বভাবসুলভ দায়সারা ভঙ্গিতে চাইলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

“তোর শশুর বাড়িতে।”

নিরা আর কথা বাড়ালো না। মনটা এমনিতেই ঠিক নেই, তার উপর এর সাথে কথা বাড়িয়ে মেজাজের চৌদ্দটা বাজানোর কোনো ইচ্ছে নেই তার।

পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে ফোন করলো নাবিল।

“শাওন, কোথায় আছিস বন্ধু?”

“বাসায়,কেন?”

“মালিবাগের দিকে ইমিডিয়েট আমার বাইকটা নিয়ে আয়। চাবি জসিম ভাইয়ের কাছে।”

শাওন কী বুঝে হাই বোল্ডেজের শক খাওয়ার মতো করে বললো,

“কোথায় তুই? ওয়েইট, তোর না আজকে নিরার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা? বাসর রাতে বাইক নিয়ে কই ছুটছিস? আর এমন হাঁপাচ্ছিস কেন? নিরা কোথায়?”

“হাঁপাচ্ছি মানে? ওয়েইট, তুই কী আমাকে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিস, শালা? আমি এখোনও সহীহ-শুদ্ধ পুরুষ। ভার্জিনিটি কাঁচের মতো স্বচ্ছ। কোনো নারী জাতির দাগ নেই সোনার যৌবনে। ওসব দুই নাম্বারি ইঙ্গিত দেখাবি না, খবরদার।

“বিবাহিত পুরুষদের বাশর রাতে দুই নাম্বারি ইঙ্গিত দিবো এটাইতো স্বাভাবিক। তা মধুচন্দ্রিমায় মামাতো বউ ফেলে বাইককে তলব করছো কেন? একটু বুঝিয়ে বলো তো, ভাই?”

“বউ ভাল্লাগে না। বাইকের সঙ্গে রোমান্স করবো।”

শাওন হাসলো ওপাশ থেকে।

“বুঝলাম, কিন্তু নিরা কই?”

“নিরা আমার সঙ্গে,আমিও ওর সঙ্গেই। আমরা দু’জন দু’জনের সঙ্গে। বলা যায়, সঙ্গ দিয়ে সঙ্গে পালিয়েছি।”

শাওন বোধহয় বুঝলো না কিছুই।

“রাইমিং ছাড়, ব্যাটা। পালিয়েছিস মানে! নিরা তোর সঙ্গে ক্যামনে পালালো? একটু বুঝিয়ে বল তো, দোস্ত। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ”

“বিয়ে ক্যান্সেল। এটাকে আমার সহ্য হয়না, আবার আমাকেও এর সহ্য হয়না। বিরোধী পক্ষ নিয়ে সংসার করা যায়না, ব্রো।”

“তো তোরা রাজি নস সেটা ফ্যামিলিকে জানালেই তো হতো। নাকি কাহিনী ভিন্ন? আসল ঘটনা বল। এনিথিং রং? হবু বউকে নিয়ে ভেগেছিস তো বিয়ে ক্যান্সেল করার মানে কী? ভাই আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছিনা।”

“ধুর ছাতা! এতো প্রশ্নের ঝুলি খুলিস না তো ভাই। ওতো বোঝাবুঝির দিয়ে কাজ নেই। ফিরে এসে তোকে এবিসিডির মতো করে বুঝাবো। আপাতত বাইকটা নিয়ে এসে তোর শশুরদের হাত থেকে বাঁচা। নয়তো যেকোনো সময় হাজতে ঢুকে যেতে পারি। সোনার যৌবনে জেলের পানি পড়তে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। বিয়েসাদী করিনি। রেপুটেশনের ব্যাপার আছে।”

“তা এখন যাচ্ছিসটা কোথায়?”

নিরা লাগেজটা ধরে গম্ভীর মুখে আশপাশটা দেখছে৷ সেদিকে একপলক চেয়ে নাবিল বললো,

“নেপালের টিকিট কাটিয়েছি। মুসিবতটাকে এভারেস্ট ছেড়ে আসবো। এটাকে নিয়ে আবার বাড়ি ফেরা মানে চোখ বন্ধ করে মামা আর আম্মাজানের হাতে ডেড। ফেলে দিয়ে আসবো পাহাড়ে। টপকে পড়ে থাকবে কোথাউ। কেউ খোঁজ পাবে না,মাঝখান থেকে আমি সেইফ।”

নিরা একপলক রাগি দৃষ্টিতে চাইলো, ফোন কানে ধরে চাইলো নাবিলও। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো ওদের। নাবিল তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

নাবিল একটা ফুডকার্ড দেখে কিছু খাবার কিনার জন্য রাস্তার অপরপাশে গিয়েছে। শাওন বিশ মিনিটের মধ্যে বাইক নিয়ে ফিরলো। ছেলেটা এখোনও বিভ্রান্ত।

“কী ব্যাপার নিরুনিধি, কেমন আছো?”

নিরা ভদ্রতাসূচক হাসলো।

“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া, আছি ভালোই।”

“আমার সুদর্শন বন্ধুটাকে এভাবে রিজেক্ট করে দিলে? তুমি জানো, ওর জন্য ভার্সিটিতে কতো মেয়েরা পাগল? ওর বিয়ের কথা গোপন সুত্রে কয়েকজন শুনতে পেয়ে কী দুঃখটাই না পেয়েছে, জানো তুমি? বুঝলে না, নিরুপমা, বুঝলে না।”

নিরা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো।

“নিপাকে চিনো?”

” জ্বি না।”

“আরেহ ওইযে তোমাদের এলাকার ক্যাট্রিনা। জাহাঙ্গীর মোল্লার মেয়ে।”

“কী করেছে নিপা?”

“এই মেয়ে তো নাবিলকে খুব পছন্দ করে। বিয়েও করতে চায়।”

শাওন ভাবলো এসব বলে নিরার জেলাসি বাড়ানো যায় কিনা। কিন্তু না, উল্টো ব্যাপক বিরক্ত হলো মেয়েটা। নাবিল ভাইয়ের বন্ধুগুলোও তার মতোই প্যানিক মার্কা।

“ভাইয়া, আমার নাম নিরা। নিরুনিধি, নিরুপমা কোনোটাই না। আর আপনার বন্ধুকে ক্যাট্রিনা, জরিনা, মর্জিনা, যে-ই বিয়ে করতে চাক, তাতে আমার কী? এখন রাস্তা ক্লিয়ার, করতে বলুন না তাদের বিয়ে। আর আমি একা আপনার বন্ধুকে রিজেক্ট করিনি, সে নিজেও আমার মতামতের সাথে সম্মতি দিয়েছে। উই বোথ ডোন্ট লাইক ইচ আদার। আমাদের সম্পর্ক কখনোই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হওয়ার মতো মধুর ছিল না। তাকে আমি কাজিন হিসেবেই তো সহ্য করতে পারি না, সেখানে স্বামী মানার তো প্রশ্নই আসে না।”

“সেটা তো দেখেই আসছি৷ তা বিয়ে না করার বিশেষ কারণ কী? ব্যক্তিগত পছন্দ আছে? এনি প্রনয়?”

নিরার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। থাকলেও কেন তোকে বলতে যাবো রে?

“বিয়ে করতে না চাইলেই ব্যক্তিগত চয়েজ থাকতে হবে বলে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম আছে? আমি পড়াশোনা করতে চাই, এটাই বিশেষ কারণ।”

শাওন মিনমিন করে বলল,

“সব মেয়েরাই বেকার বয়ফ্রেন্ডকে ক’টাদিন বেশি সময় দেওয়ার জন্য বাপকে এই এক্সকিউজ দেখায়। বুঝি সবই।”

নিরা ভ্রু বাঁকাল।

“কিছু বললেন?”

শাওন ঝেড়ে কাশলো। রাস্তার অপরে চেয়ে বলে,

“না না, কি বলবো। ওইযে, তোমার বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় চরিত্র চলে এসেছে।”

চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে রাস্তা পাড়াপাড় করছে নাবিল৷ হাতে দু’টো বার্গারের প্যাকেট। নিরা সেদিকে চেয়ে মুখ ভেঙালো। কয়েকটা কর্পোরেট জব করা মেয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওর দিকে। যেনো চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে ছেলেটাকে। বিরক্তিতে কপালে হাত রাখলো নিরা। সবসময় এতো ভাব নিয়ে হাঁটার কী আছে লোকটার? মেয়ে পটানোর ধান্দা সব।

——

চশমা টা পড়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ইচ্ছে না থাকার সত্ত্বেও চিঠিটা মেলে ধরলেন জয়নাল সিকদার।

“মামা,

আপনাকে আঘাত করার জন্য ক্ষমা করবেন। আপনার সম্মানহানি হোক এমনটা আমরা কখনোই চাইনি।
ভুলটা বোধহয় আপনাদেরই৷ আমাদের কোনোরকম মতামত ছাড়াই বিয়ের মতো এতো বড় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন। একটা বার আমাকে কিংবা নিরাকে জিজ্ঞেস করার পর্যন্ত প্রয়োজনবোধ করলেন না, আমরা দু’জন দু’জনকে বিয়ে করতে চাই কি-না? বিয়েটা বোধহয় মানিয়ে নেওয়া, চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় না। দু’জনের মধ্যে সমঝোতা থাকতে হয়। যেটা আমাদের মধ্যে আপাতত একেবারেই নেই।

নিরা পড়াশোনা করতে চায়, মামা। ওকে আপনি ওর মতো করে বাঁচতে দিন। মিরাকে নিয়ে আপনার অনেক আশা ছিল, আমি জানি। মিরা আপনার বিশ্বাস ভেঙেছে তা-ই বলে সেটার শাস্তি নিরাকে কেন দিতে হবে? ওর তো কোনো দোষ নেই। ওর প্রতি একটু সহনশীল হোন,মামা। মেয়েটা একটু স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। একটু সহোযোগিতা করুন ওকে।

বিয়েটা যেহেতু পারিবারিক গোপনীতা বজায় রেখে হতে যাচ্ছিল তা-ই তৃতীয় পক্ষ এই ঘটনার সারাংশও জানবে না, এমনটাই হওয়ার কথা। তাই লোক জানাজানির সম্ভাবনা দেখছি না। ক’টাদিন পরিচিত কারো বাসায় থাকবো। বাসার পরিস্থিতি নরম না হওয়া পর্যন্ত আসছি না। নিরাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। ওকে দেখে রাখবো।

ইতি
আপনার স্নেহের ভাগ্নে,
নাবিল”