রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-০৪

0
1

#রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৪
#নাজমুন_নাহার

কানাডার রাজধানী, অটোয়াতে এখন সময় সন্ধা সাতটা। কেবলই সূর্যমামা ডুব মেরেছে। বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে এগারো ঘন্টার ব্যবধান। দেশে রাত ফুরিয়ে গেলে কানাডায় সন্ধার পদার্পণ ঘটে।

নিলয় মাত্রই শপিংমল থেকে ফ্ল্যাটে ফিরলো। পুরো ঘর ভর্তি এলোমেলো জিনিসপত্র। বাড়ির সকলের জন্যই কেনাকাটা করা শেষ। এতোগুলা বছর পর দেশে ফিরছে সে৷ মনে আনন্দ আর উত্তেজনার সাথে আছে চাপা পিছুটান। যে পিছুটান নিলয়কে এক রত্তিও স্বস্তি দিচ্ছে না। অটোয়া শহরের অলিতে-গলিতে কিছু একটা তাড়া করে বেড়ায় নিলয়কে। সবখানে একজনের নিবিড় অস্তিত্ব অনুভব করে ছেলেটা। যার অস্তিত্ব প্রকৃত অর্থে না থাকার সত্ত্বেও এখনও তাকে বিচ্ছেদের দহনে পুড়িয়ে মারছে। ছেলেটা জানে সময়ের ক্ষতগুলো একদিন সময়-ই মুছে দিবে। মানুষ আজন্ম একই যন্ত্রণা একইরকমভাবে বয়ে বেড়ায় না। প্রকৃতি, সময় তা হতে দেয় না৷ তবুও যে মন মানে না। মন বিশ্বাস করতে চায় না এতসব। তবে মাঝে মধ্যে একটু হাল্কা হতে ইচ্ছে হয়। কেউ একটা বোধহয় চাই, যার কোলে মাথা রেখে তার পুরুষালী শরীরটা ভার ছাড়বে। ডুকরে কেঁদে উঠবে একদিন। কিন্তু নিলয় তো এমন না। নিজের যন্ত্রণাগুলো আজ অব্ধি কারোর সাথে ভাগ করেনি ছেলেটা। নিজের মধ্যে রেখে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এতোদিন সে ছিল, আজ থেকে সেই একটা মানুষও নেই। পৃথিবীর বুকে সে আবারও একা! ছেলেটার একাকিত্বের ভার কেউ সামলাচ্ছে না আজ!

সাদা রঙের ঘরটায় আরেকটাবার চোখ বুললো। এই ঘরটাই যে নিলয়ের নারকীয় দিনগুলোর একমাত্র সাক্ষী। আর ভাবতে পারছে না সেসব। মনটা ভীষণ ক্লান্ত! না চাইতেও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। কী ভেবে ফোনের স্ক্রিনটা অন করলো। ওয়ালপেপারে ভাসমান নারীমুখটায় বেশ কিছুক্ষণ শান্ত চোখে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। ওয়ালপেপারে তার আর মারিয়ার হাস্যজ্জ্বোল একটা ছবি। দেখে মনে হয়,দু’জন দু’জনের সাথে কতো শান্তিতে আছে ছবিটায়। কী সুখী দেখাচ্ছে ওদের। মারিয়ার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কী উল্লাস নিয়ে নিলয়ের হাতটা ধরে রেখেছিল সেদিন। কী মায়া তার স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে! ছলনাময়ীরা দেখতে বুঝি এমনই মায়াবতী হয়? চোখ ভিজে আসছে নিলয়ের। নিজের প্রতি একরাশ ঘৃণা জন্মাল আবারও। আর কতো? আর কতো তাকে ভেবে নিজেকে পোড়াবি, নিলয়? সে তোকে তোর মতো করে ভালোবাসেনি। কখনোই বাসেনি! বাসলে এতোটা পথ এসে এভাবে একলা করে চলে যেতে পারতো বল?

নিলয় চোখের পানিটুকু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ওয়ালপেপারের ছবিটা রিমুভ করে দিলো। আস্ত মানুষটাই যদি জীবন থেকে হুট থেকে উধাও হয়ে যায়, তখন তার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো বহন করা মশকরা ছাড়া কিছুই না। এসব কেবলই বুক ভার করায়। দহন বাড়ায়। একরত্তিও ভালো থাকতে দেয় না।

ফেইসবুকে ঢুকতেই একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চোখে পড়লো। “Nirjhora Nira send you request”
প্রোফাইলে কারো ছবি না পেলেও বুঝতে বাকি রইলো না এইটা নিরারই আইডি। এক্সেপ্ট করলো নিলয়। সঙ্গে সঙ্গে ওর আগে থেকেই পাঠিয়ে রাখা কিছু মেসেজ শো করলো মেসেঞ্জার নোটিফিকেশনে। নিলয় আগ্রহ দিয়ে ঢুকলো।

“নিলয় ভাই, আমার আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমি জানি, আমার আর নাবিল ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার বিষয়টা আপনি জানেন। আপনার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই এই ব্যাপারে,নিলয় ভাই? আপনি কি কিছুই বোঝেন না? আমি ভেবেছিলাম আপনি নিজে থেকেই সবটা বুঝবেন।”

“বিয়েটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না৷ সত্যি বলছি, এই বিয়েটা হলে আমি মরেই যাবো। প্লিজ আপনি কিছু একটা করুন!”

বারো ঘন্টা আগের পাঠানো ম্যাসেজ। নিলয় মাথায় হাত ঠেকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে কপালে ঘষল। মেজাজ খারাপ হলো তার। মারিয়ার শোকে ভুলেই গিয়েছিল আজ যে নাবিল-নিরার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। নিরা কি বিয়েতে রাজি না? ওর সঙ্গে সবাই জোরাজোরি করেছে নিশ্চয়ই। নিলয় হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো। সন্ধা সারে সাতটা বাজে। এতোক্ষণে বাড়িতে কী ঘটে গিয়েছে, কে জানে! ব্যস্ত ভঙ্গিতে মা’কে ফোন করলো৷ ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। পরপরই নেহালকে ফোন করলো। টানা তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো নেহাল। বড় ভাইয়ের মুখে সবটা শুনে রীতিমতো নিলয় বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু নিরাটা এভাবে কেন কথা বলছে? কী নিজে থেকে বুঝবে নিলয়?

ভোর রাত।
নিঃস্তব্ধ আকাশ। একরাশ নিরবতায় ছেয়ে গেছে অচেনা এই ছোট্ট শহরটায়। শুধুমাত্র একটা বার্গার খেয়ে খিদে মেটেনি নিরার। শারীরিক-মানসিক দোটানায় কাহিল লাগছে শরীরটা। ক্লান্ত ওরা খুব। দূরে টিমটিমে আলো জ্বলছে একটা টঙ্গের দোকানে। বেশ কিছু কনফেকশনারিও খোলা পাওয়া গেলো। সেখান থেকেই কিছু প্যাকেটফুডের সঙ্গে দু’টো কফি নিলো। নিরা আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক বসালো। অথচ আজ, এই মুহূর্তে তার থাকার কথা ছিল নিজের রুমে। নিয়তি আর পরিস্থিতি মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানে না। ভাবতেই পারেনি স্রোতের বিপরীত পরিস্থিতি তাকে তার ফুপুর শশুর বাড়িতে নিয়ে আসবে। মানে নাবিলদের দাদার বাড়ি।

নাবিলের পরিকল্পনা ছিল কুমিল্লা সদরে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠার। ফোনে সব ঠিকঠাকই ছিল। মাঝপথে এসে নাবিলের মনে হলো, নিরাটাকে নিয়ে বন্ধুর বাসায় উঠে পড়াটা দৃষ্টিকটু দেখায়। তাছাড়া ওদের বাসার কোনো সদস্যই ব্যক্তিগতভাবে ওদের চিনে না। এই অবেলায় অচেনা একজনের বাসায় উঠে গেলে পাছে উল্টাপাল্টা না ভেবে বসে। নিরা মেয়ে মানুষ, চিন্তাটা ওকে নিয়েই। তার চেয়ে চান্দিনাই থেমে যাওয়া সেইফ।

ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। হাতের ধোঁয়াউঠা কফির কাপটা বাইকের সিটে রেখে পকেট থেকে ঝিমিয়ে পড়া ফোনটা এতোক্ষণে বের করলো নাবিল। মা ফোন করেছে। স্ক্রিনে ছোট্ট করে ‘আম্মু’ লেখাটা ভেসে উঠলো। এইরে, জননী খেপেছে বোধহয়!

“হেই সুইটেস্ট মমি, তোমার এংগ্রি ব্রাদারের আপডেট কী? মামু কি মারাত্মক খেপে আছে এখনও? বাসায় ফিরলে ঝাড়ু-জুতা বাদে আর কী কী খাদ্যের সুব্যবস্থা আছে, বলো তো? আই শ্যুড বি কনসার্ন, রাইট?”

“মশকরা হচ্ছে? তোদের কোনো ধারণা আছে কতো টেনশনে ছিলাম সকলে? আমি কীভাবে ভাইজানকে সামলালাম? শুন বাপ, বড় হয়েছিস তো, এইবার একটু সিরিয়াস হ। তোর মামার বয়স হচ্ছে, এসব ব্যাপার দুঃশ্চিন্তা বাড়ায়। ফিরে এসে পায়ে ধরে পড়ে থাকবি। যতোক্ষণ না ক্ষমা করবে তোদের জায়গা নেই। এখন বল, কোথায় আছিস রে, বাদর?”

“তোমার বউমা’কে নিয়ে চান্দিনায় ভোজন সারছি। পাউরুটি উইথ হট কফি। কফির টেস্ট নট গুড।”

“তা কুরিয়ার করে আমার আব্বার জন্য পাঠিয়ে দেবো কফি বানিয়ে?”

নাবিল মায়ের রসিয়ে রসিয়ে বলা কথার অর্থ ধরতে পারলো। ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ভালোই খেপে আছে তার সহজ-সরল মা টা।

“দিতেই পারো। তোমার ছেলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কফি খাবে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু দেখায় না? মা হিসেবে তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত, আম্মু।”

“হ্যা রে বাপ, খুব লজ্জা পাচ্ছি। লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাই না। তা চান্দিনায় কী করছেন রাজপুত্র আমার?”

“তুমি জায়গা দিলে কী আর তোমার শশুর বাড়িতে হামলা চালাতাম? ভাবছি, খাওয়া শেষ করে দাদু বাড়িতে এন্ট্রি নিবো। ফোন করে দাদুকে পুরো কনটেক্সট আগেভাগে জানিয়ে দাও তো, আম্মু। নতুন বউ নিয়ে ও বাড়িতে ঢুকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না। আমাকে এই ঘটনা নিয়ে কোনোপ্রকার জেরা করলে কিন্তু আজন্ম তোমার শশুর বাড়িকে বয়কট করবো। বিশেষ সতর্কতা জারি করবে, বড় চাচ্চুকে নিয়ে।
দাদুকে জানিয়ে দেবে, তোমার সোনার ছেলেকে যেনো কেউ কথা না শুনায়। আমার আবার সেল্ফ রেসপেক্টটা একটু বেশিই।”

রাহেলা ছেলের কথায় বিদ্রোহ করলেন।

“দিবো এক চর৷ খবরদার বাড়িতে ঢুকে একদম বাঁদরামি করবি না। চাচ্চু কিছু বললেও তর্ক করবি না। আর শোন, তুই কি নিরার সামনেই বার-বার বউ বউ করছিস? আহা! রেগে যাবে তো মেয়েটা। ওকে আর জ্বালাস না তো, বাপ। এমনিতেই ভাইজান ওর উপর রেগে আছে। বাসায় এলে মেয়েটা কী দূর্গতিতে পড়ে কে জানে!”

“ওকে নিয়ে এতো আহ্লাদ করো না তো। তুমি জানো, ও কতো বড় বেয়াদব? কতো স্পর্ধা! এইটুকুনি পুটিমাছ কিনা কথায় কথায় তিমি মাছের মতো গর্জন করে উঠে। শুধু তোমার মুখ চেয়ে সহ্য করছি, আম্মু। নয়তো এটাকে এক্ষুনি বুড়িগঙ্গায় ছেড়ে আসতাম। কতোগুলো ঝাড়ি মারলো আজকে সারাদিনে, জানো? ও কি জানেনা নাবিল পৃথিবীতে কেবল লোকজনদের এটেনশন পেতে এসেছে? পাত্তাই দেয়না ও আমায়। আমি কি ওর চেয়ে বয়সে বড় না? ভাবখানা এমন করে মনে হয় সে গুরু, আমি তার শীর্ষ। আই হেইট দ্যিস গার্ল,আম্মু।”

রাহেলা বেগম একটা ভারী শ্বাস ফেললেন।

“শোন!”

“হু।”

“তুই বিয়ে কেন করলি না ওকে, আব্বা? কেন পালালি? আম্মু যখন তোর কাছ থেকে মতামত চেয়েছিলাম, তখন তো না করিসনি। নাকি নিরাই তোকে অপছন্দ করে, হে রে?”

নাবিল বিশ্ব জয় করে হাসলো। সে-ই হাসির শব্দ পৌঁছালো নিরার কান পর্যন্তও। মেয়েটা কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে চাইলো।

“ও আমাকে অপছন্দ করবে! ও? ওর আছে কী যার গৌরবে নাবিল এহসানকে রিজেক্ট করবে? এমন দশটা নিরা তোমার ছেলে প্রতিদিন বায় বায় করে, আম্মু। আর আমি সম্মতি কখন দিলাম? তুমি জিজ্ঞেস করেছো, নিরাকে আমার কেমন লাগে? তো আমি বললাম, ভালোই। তার মানে এই না যে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। কালকে তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, ” তোর কোন খাবারটা ভাল্লাগে,আব্বা?” আমি যদি বলি ‘চিকেন’ তার মানে কি আমি তোমাকে মুরগীর সঙ্গে রোমান্স করার ইঙ্গিত দিয়েছি? আমাকে একটা মুরগী ধরে এনে বিয়ে করিয়ে দেবে? আজব কথা!”

বলেই অট্টহাসিতে মেতে উঠলো ছেলেটা। রাহেলা বুঝলেন ছেলে এখনও ফাজলামো করছে।

“মুরগী আর নিরা কি এক হলো? ফোন রাখ বেয়াদব ছেলে।”

নাবিল গগন কাঁপিয়ে হাসলো।

“এইযে, দেখলে তো। যে-ই না আদরের ভাতিজীর বদনাম করলাম ওমনি পল্টি? ওমনি আমি বেয়াদব? এই তুমি তোমার ছেলেকে ভালোবাসো, আম্মু? এই তোমার আমার প্রতি টান? আর তোমার আদবী ভাতিজী আমার সাথে যে কী ব্যবহারটা করলো সেসব শোনার বেলায় তো ঠিকি বয়রা।”

প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের এমন বাচ্চাসুলভ অভিযোগ শুনে হুট করেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন রাহেলা।

“কী বলেছে পুচকিটা আমার আব্বাকে?”

“থাক, আর শুনতে হবে না। যত পাপ টুনির বাপ।”

রাহেলা হাসলেন।

“এই টুনির বাপটা আবার কে গো, আব্বা?”

“আমি। আর টুনি হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ কন্যা।”

“বউটা কে?”

“সেটাই তো জানি না। কই গিয়ে পড়ে আছে, কে জানে।”

নাবিলের কন্ঠে আক্ষেপ। কী ভেবে আবার বলল,

“এই আম্মু, একদম টপিক চেঞ্জ করবে না। তোমার ভাতিজীর একটা বিচার কিন্তু হওয়া চাই এবার।”

“ওরে আমার পাখি রে, এবার বাড়িতে আসুক, নিরাকে খুব বকে দিবো। আমার লক্ষী ছেলেটাকে ঝাড়ি মারা? এতো বড় দুঃসাহস হয়েছে পুচকিটার! ওকে কী শাস্তি দিবো বলো তো,আব্বা?”

মায়ের আহ্লাদে আটখানা হলো ছেলে।

“আলগা পিরিত দেখাবে না তো, আম্মু। ইউ ডোন্ট লাভ মি।”

“কাকে ভালোবাসি তাহলে? আমার আর কে-ই বা আছে তুই ছাড়া? তোর বাবার পর আমার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তুই-তো। আমার সাত রাজার ধন৷ আমার লক্ষী ছেলে! বিশ্বাস কর, মা তোকে খুব ভালোবাসে বাপ।”

“আর নিরুকে? ওকে আমার চেয়ে কম নাকি বেশি ভালোবাসো?”

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিরার দিকে একপলক চেয়ে প্রশ্নটা করলো নাবিল। কপাল চাপরালেন রাহেলা। এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা যায় না। এতো বড় দামড়া ছেলে কি-না এইটুকুনি মেয়েকে হিংসে করছে? খুব হিংসুটে হয়েছে। তার ভালোবাসায় কারো ভাগ হতে দিবে না। এতে নিজের সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ধ সে। যা তার, তা শুধুই তারই। নিজের লোকের আদরের ভাগ কাউকে দিতে নারাজ । নিরুটার সঙ্গে এই নিয়ে শৈশব থেকেই চরম বিরোধ ওর। ঘুমের ঘোরে, শূন্য ঘরে কতো মেরেছে মেয়েটাকে৷ একা বসে খেলতে দেখলেই খামচি মেরে দিবে দৌড়। মেয়েটা নাকের পানি চোখের পানি এক করে কাঁদতে থাকলে আবার নিজেই কোলে নিয়ে আদর করে শান্ত করবে।

“বাবু, মা’কে এতো কেন জ্বালাস? বাজে বকিস না বাপ। এমনিতেই তোদের দুঃশ্চিন্তায় ঘুম নেই চোখে। খুব মাথা ধরেছে। ফোনটা দে নিরুকে। আর আমি ফোন করে তোর দাদুকে বলছি, সাগরকে বাজারে পাঠিয়ে দিতে৷ এই মাঝ রাত্তিরে বাইরে বসে থেকে বিপদ বয়ে আনার দরকার নেই। তোকে নিয়ে চিন্তা নেই। নিরুটা মেয়ে মানুষ, ওকে নিয়ে এভাবে বাইরে থাকা ঠিক হচ্ছেনা।”

নাবিল ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ দিয়ে সেটা নিতে ইশারা করলো। নিরা শুধায়,

“কে?”

“তোর পালিত মা।”

নিরার বুঝতে বাকি রইলো না নাবিল ভাই কার কথা বলছে। ছো মেরে ফোনটা কানে ধরলো। নাবিল মুখ ভেঙিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। নিরা হ্যালো বলতেই চুপ রইলেন রাহেলা। নিরা বোধহয় বুঝলো সেটা।

“ফুপ্পি, আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও! আর হবে না এমন।”

নিরার কন্ঠে অনুশোচনা। রাহেলা অভিমানী স্বরে বললেন,

“কিসের ক্ষমা? তোর কোনো ক্ষমা নেই।”

নিরা সহসাই কেঁদে ফেললো। রাহেলা বেগম মনে মনে হাসলেও মুখে গম্ভীরভাব বজায় রেখে বললেন,

“ফুপ্পিকে একবার বলার প্রয়োজনবোধটুকু পর্যন্ত করলি না? আমাকে এতোই অবিশ্বাস করলি! এই চিনলি তোর ফুপ্পিকে? তুই পড়তে চাস, কিংবা বিয়ে করবিনা সেটা শুনলে কি কেউ তোকে জোর করতো? অন্তত অন্য কেউ করলেও আমি দেখে নিতাম সেটা। ভাইজানকে কি বুঝাতাম না?”

নিরা চুপ রইলো। তীব্র অপরাধবোধে তার অস্বস্তি হচ্ছে। অনুশোচনায় চোখ নেমে এলো মেয়েটার। সত্যিই তো। একমাত্র ছোট ফুপ্পিকেই বাবা এতো গুরুত্ব দেয়। বাসার যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাবাকে দেখেছে ছোট ফুপ্পির সঙ্গে আলোচনা করতে। বিপরীতে ফুপ্পি যা মতামত দিবে, সেটাই করতে দেখেছে বাবাকে। তাহলে কেন আজ এমন বোকামিটা করলো? ইশশ! খুব রাগ হচ্ছে নিরার নিজের উপর। নাবিল ভাইটা ওকে এমনি এমনি ব্রেইনলেস, গোবরমাথা বলে না। লোকটা বদমায়েশ হলেও কিছু কিছু কথা একদম খাটি বলে। এইযে, কী নির্বোধের মতো সহজ উপায় থাকতে জটিলটাকেই বেছে নিলো।

“আমি…. মানে ফুপ্পি”

“থাক, আর মানে, কিন্তু করতে হবে না। খেয়েছিস কিছু?”

“হু।”

“মাথা থেকে টেনশন ঝেড়ে ফেল আপাতত। পরে যা হওয়ার হোক৷ দেখি কতোটুকু সামলানো যায়। একটু পরেই সাগর আসবে তোদের নিতে। ও বাড়িতে গিয়ে এই বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি আগে থেকেই বুঝিয়ে বলে দিচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

“ফোনটা দে নাবিলকে।”

নিরার চোখ-মুখ ফুলে আছে কান্নার দরুন। সেদিকে একপলক চেয়ে নাবিল বলল,

“কী বলেছো ওকে তুমি? কাঁদছে কেন?”

“বকা দিয়েছি।”

“কেন?”

“ওমা, তুই তো বললি বিচার করতে। তাহলে এখন আবার এতো দরদ নিয়ে কেন জানতে চাচ্ছিস যে?”

“আমি বলেছি বলে বকেছো তুমি? বললেই সব করে ফেলবে? আমি কি সত্যি সত্যি বকতে বলেছি?”

রাহেলা বেগম শব্দ করে হেসে ফেললেন এবার।

“কী কাহিনী রে? এতো টান দেখাচ্ছিস কেন ওর জন্য? এমনিতে তো দুই চোখে সহ্য হয়না বোঝাস।”

“আম্মু, ও এমনিতেই মানসিক পেরায় আছে। মামা বাড়িতে ফিরলে আস্ত রাখবে কি-না কে জানে। তার উপর তুমিও শুরু করলে। তোমরা ভাই-বোন দু’টোই এক।”

“যাক বাবা, এখন সব দোষ আমার আর আমার ভাইয়ের? আর তোরা বুঝি খুব সাধু? সারা বাড়ির লোককে নাচিয়ে ফেললে আর একটু কথাও শোনাতে পারবো না?”

একপলক নিরার দিকে চাইলো। নিঃশব্দে চোখের পানি মুছছে মেয়েটা।

“ওকে ফোনটা দিচ্ছি। তুমি একটু আদর করে কথা বলে দাও।”

“থাম তো। কিছুই বলিনি ওকে।”

“তো কাঁদছে যে?”

“আমি ওর উপর অভিমান করেছি এটা জেনেই কাঁদছে।”

নাবিল চুপ রইলো। পাশে তাকিয়ে মুখ ভেঙালো। কী দরদ ফুপ্পির জন্য। পরক্ষণেই মায়া হলো। এইটুকু কথায় কেঁদে ফেলার কী হলো? বেকুব একটা!

“আচ্ছা রাখছি।”

নাবিল বাইকের সিট থেকে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাত দিয়ে কফিটা নিয়ে চুমুক বসালো। পরক্ষণেই অন্যদিকে দৃষ্টি ফেলে তীর্যক কন্ঠে বলল,

“প্রেশার কমবে এতো চিন্তা করলে। ভবিষ্যৎ নিয়ে অহেতুক শঙ্কিত হওয়া উচিত না। এতে বর্তমান নষ্ট হয়।”

নিরা জবাব দেয় না। শান্ত দৃষ্টিতে একপলক ওর দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হাসলো। আকাশে তখনও কয়েকটা তাঁরা ভাসমান৷ ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসছে আশপাশ থেকে। আজকের রাতটা অজানা কারণেই ভীষণ সুন্দর মনে হচ্ছে!

চলবে।