রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-০৫

0
1

গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৫
#নাজমুন_নাহার

সকাল দশ-টা।
এহসান মঞ্জিলে এখন পুরোপুরি রোদ্দুর জানালা ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করা খড়খড়ে সকাল। ভ্যাপসা গরমে প্রাণটাও একটু বৃষ্টি-ছায়ার কামনা করছে। সকলের সম্মিলিত কামনা, রুক্ষ-শুষ্ক ধরণীতলটা একটু ভিজে উঠুক ধূসর আকাশের কান্নায়।

নাবিলের বাপ-চাচারা তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে জসিম অর্থাৎ, নাবিলের বাবা সকলের ছোট। বড় ভাই ফয়সাল এহসান ব্যতিত বাকি দুই ভাইয়ের বসবাস ফ্রান্সেই। ফয়সাল এহসানের কোনো সন্তান নেই। তার চেয়ে ছোট শফিক এহসানের দুই এক ছেলে,এক মেয়ে। ওরা বাংলাদেশেই থাকে। ফয়সাল এহসানের কাছে এরাই সন্তান সমতুল্য। নাবিলের বাবা এহসান মঞ্জিল ত্যাগ করেছে নাবিলের জন্মের আগেই।

প্রিয় বন্ধু, জয়নালের আদরের ছোট বোন রাহেলাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল জসিম। মা-মরা রাহেলাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিল যুবক জসিমের। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলো বন্ধু জয়নালকে। জসিম তখন ভার্সিটিপড়ুয়া বেকার যুবক। বাপের টাকায় তখনও চলে পড়াশোনা। তবুও নাকচ করতে পারেনি জয়নাল। যোগ্য পাত্র হারাতে চাননি। তার সহজ-সরল বোনটার কদর করার জন্য জসিমের চেয়ে ভালো পাত্র অন্যটি হয়না। তাই রাজি হয়ে যান।
পরিবারকে না জানিয়ে ছাত্র বয়সেই জসিম বিয়ে করে রাহেলাকে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্যদিকে। বাপ-ভাইয়েরা তার এমন সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ছিলেন না, বিশেষ করে ফয়সাল এহসান। কিছুতেই এমন নগন্য পরিবারের মেয়েকে ভাইয়ের বউ হিসেবে তিনি মানতে নারাজ। মেনে নেয়নি রাহেলাকে। বরাবরই জেদি, প্রখর আত্মসম্মানী জসিমের গৃহত্যাগের দিনটি ছিল সেদিনই।

যদিও পরবর্তীতে তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। নাবিলের জন্মের পর ইশতিয়াক এহসান বড় ছেলেকে নিয়ে নাবিল আর তার মা’কে সাদরে ওদের পূনরায় গ্রহণ করতে চাইলেও ওদের এহসান মঞ্জিলে আর স্থায়ী বসবাস হয়ে উঠেনি। স্বামীর কড়া নির্দেশে রাহেলা বেগম সেদিন না চাইতেও ওদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর থেকে ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভাইয়ের কাছাকাছি থেকে ঢাকাতেই বসবাস শুরু করে। কয়েক বছরের মাথায় মোটা অঙ্কের লোন নিয়ে জীবিকার তাগিদে ফ্রান্সে পারি জমায় জসিম। বছর পাঁচেকের মাথায় ঋন পরিশোধের সাথে সাথে ঢাকায় স্থায়ী বাড়ি হলো ওদের। এর মধ্যে ছেলেকে নিয়ে প্রায়ই শশুর বাড়ি যেতেন রাহেলা। বাপ-ছেলের গোপন মান-অভিমান ভাঙানোর প্রবল চেষ্টাও করে এসেছে শুরু থেকেই। ছেলেটাকে তা-ই সবসময় ওদের কাছাকাছি রাখেন। সে স্বামীর আদেশে অক্ষুণ্ণ বলে ছেলেটাকেও তো বঞ্চিত করা যায় না।
নাবিলের যাতায়াত চলে দাদুর বাড়িতে প্রায়শই। জসিমের একমাত্র অবলম্বন এখন এহসান মঞ্জিলের সকলেরই চোখের মনি। দাদাজানের সবচেয়ে আদরের নাতি সে-ই। রাহেলার শশুরটা নাবিলকে ক’দিন না দেখলেই চোখে হারায়। ওদের বাপ-ছেলের মধ্যে টুকরো টুকরো যোগাযোগ থাকলেও দাদা-নাতির মধ্যে সম্পর্ক বেশ জমপেশ। দু’জন দু’জনের অতি প্রিয়। নাতির সঙ্গে সম্পর্কটা ইশতিয়াক এহসানের একরকম সমবয়সী বন্ধু টাইপ।

সকালে ডািনিংয়ে বসে।

“রাহেলার শরীর কেমন রে?”

নাবিল আপন মনে খেতে খেতে জবাবে চাঁচির পানে চাইলো,

“ভালোই তো।”

ফয়সাল এহসান গম্ভীর মুখে চাইলেন ভাতিজার পানে। এক নম্বরের হারে বজ্জাত হয়েছে ছেলেটা। বড়দের সামনে কীভাবে কথা বলতে এতোটুকু ভদ্রতা-সভ্যতা পর্যন্ত নেই। কেমন ভাব নিয়ে খাচ্ছে দেখো।এখনই বাড়ির কর্তা হয়ে বসেছে। তোর বাপ-চাচারা এখনও জীবিত আছে ব্যাটা। দাদার আস্কারায় চাঁদ পেয়ে বসো না। ফয়সাল এহসান আরচোখে আরেকপলক চাইলেন। রাহেলা তো এমন না। তবে এই ছেলে কার স্বভাব পেয়ে বসলো? একেবারে বাপের কার্বন-কপি হয়েছে। অপমান হজম করে ভুলে যেতে পারে না বাপ-ব্যাটা। শিরায় শিরায় এদের আত্মসম্মান।

“তোমার মা’কে বলবে, এই বাড়ির দরজা তার জন্য সবসময় খোলা। সে যখন ইচ্ছে আসতে পারে। তোমার মা যেনো নিজের সংসারে এসে, নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নেয়। মানুষের জন্ম-মৃত্যুর ঠিক নেই। আমরা আজ আছি কাল নেই। তবে তোমরা যেনো নিজ বাড়িতেই থেকে পরিবারের স্থিতিশীলতা, বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারো গার্জিয়ান হিসেবে আমাদের চাওয়া এতোটুকুই। তাকে জানাবে, বিয়ের পর শশুর বাড়িই মেয়েদের একমাত্র অবলম্বন।”

নাবিল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খাচ্ছে। মুখে দায়সারা জবাব তার,

“আচ্ছা, বলবো।”

ইশতিয়াক এহসান নাতির পাশাপাশি চেয়ারেই বসেছিলেন। বুঝলেন চাচা-ভাতিজার মতিগতি সুবিধার ঠেকছে না। কখন ঘরোয়া যুদ্ধ বেঁধে যায় ঠিক নেই। ছেলেটা খেপে গেলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। এতো বড় ছেলেকে কিছু বলার সাহস তার নেই। এমতাবস্থায় নাতিটাকেই দমানোর চেষ্টা করা সুবিধাজনক।

“দাদুভাই, আরও দুইটা পরোটা নাও। বড়বউ, আমার ভাইয়ের প্লেটে দুইটা পরোটা দিও। না খাইতে খাইতে ভাইটা আমার শুকাই গেসে।”

নাবিল বুঝলো, তার সহজ-সরল দাদু পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেটা প্রতিবারই করে থাকে। এই একটা মানুষের টানেই নাবিল বার-বার ছুটে আসে চান্দিনায়।

“তুমি নিজের দিকে তাকাও, দাদু। আমাকে বডিশেমিং করার আগে তোমার ফিগারের হাল দেখো। তোমার মতো পাঁচটা ইশতিয়াক এহসানের সমান আমি নাবিল এহসান।”

“বয়স নিয়া খোঁটা দিতাসো, দাদুভাই? তোমার বয়সে আমিও কিন্তু দেখতে তাগড়া বেটালোকই আছিলাম। তোমার দাদি ত….

ইশতিয়াক এহসান মুখে বলতে গেলেন, তার দাদি অল্পবয়সে উনাকে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের প্রস্তাবটাও তার পক্ষ থেকেই প্রথম আসে। সত্তর দশকের সাহসী প্রেমিকা ছিলেন কামরুন্নাহার বেগম।
কিন্তু ছেলে আর ছেলের বউকে সামনে রেখে মুখে সেসব বললেন না।

শাহিনা রান্নাঘর থেকে ঠোঁট টিপে হাসছেন। সাগর ওর বাহুতে ধরে বলল,

“ভাই, তুমি জিম করো?”

নাবিল প্রতুত্তর করার পূর্বেই ফয়সাল এহসান রসিয়ে রসিয়ে তীর্যক কন্ঠে বললেন,

“জিম দিয়েই সবসময় সব হয়না রে বাপ। কপাল করে কোন বংশে জন্ম নিয়েছে সেটা দেখ একবার। সৌভাগ্য নিয়ে এহসান বংশের উত্তরাধিকারী হতে হয়। অবশ্য অকৃতজ্ঞরা এসব স্বীকার করবে না। আমাদের পূর্ব বংশের ব্যাটারা এর চেয়েও তাগড়া৷ আমরা তিন ভাই-ই সেসময়ের সুপুরুষদের কাতারে ছিলাম। আর দুয়েক বছর যাক, তোরও হবে এমন। বয়স উনিশ-বিশ ছাড়ালেই আমাদের বংশের ছেলেদের দেখতে এর চেয়েও খাসা লাগে।”

নাবিল বুঝলো তাকেই ইনিয়েবিনিয়ে অপমান করা হচ্ছে।
বংশের গৌরব দেখাচ্ছে তাকে।

“তুই আমার মামাকে দেখেছিস, সাগর?”

ফয়সাল এহসান মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বললেন,

“নির্বোধরাই মা’য়ের বংশকে নিজের বংশ মনে করে। সন্তানরা জীনগতভাবে বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যই পায় বাপের বংশের।”

“বললেই তো আর ‘ক’ কলিকাতা হয়ে যায় না।জেনেটিকের কথা বলতে গেলে সন্তানরা বাবা-মা উভয়ের সমান জিন পায়। সেক্ষেত্রে কিছু সময় কোনো এক পক্ষের কম-বেশি হতে পারে। বাপের বংশেরই শতভাগের বেশিরভাগ পেতে হবে এমন মূর্খতার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অবশ্য এসব আর বলে কী লাভ? যারা নিজেদেরকেই সবার উপরে রাখতে চায়, মনে করতে চায়, তাদের মধ্যে এই ধরনের দাম্ভিকতা থাকাটাও অস্বাভাবিক না।”

ফয়সাল এহসান নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো।

নাবিলটা ওর বড় চাচাকে বরাবরই এড়িয়ে চলে। গম্ভীর, বদমেজাজী, নিষ্ঠুর দেখতে লোকটাকে তার সবসময়ই খারাপ লাগার কারণ নেই। সে জানে চাচ্চু তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। তবুও না চাইতেও মনের তেতো ক্রোধ ঝারবার খায়েস বেড়িয়ে আসে। এই লোকটার কারণেই মা কখনোই এই বাড়িতে আসতে পারেনি। বাবাও নিজ বাড়ি ত্যাগ করেছে তার কারণেই। সেদিন বড় চাচা দাদুর কান ভারী না করলে হয়তো নাবিলেরও নিজের রক্তের লোকদের নিয়ে একটা সুন্দর শৈশব হতে পারতো। বাকি কাজিনদের মতো ওরও এই এহসান মঞ্জিলে একটা সুখের জীবন হতে পারতো। দাদুর স্নেহ তারও হতে পারতো। মা’কে নিয়ে সেদিন ওমন কুৎসিত মন্তব্য না করলে মা-ও হয়তো একটা সুন্দর পরিবার পেতো। মা’য়েরও একটা সুখের সংসার হতো। একা একা ছোট্ট শিশু নাবিলকে নিয়ে মা’কে এতো কষ্ট করতে হতো না। কতো রাত মা শিউরে বসে কেঁদেছে নাবিল তা দেখেছে। মায়েরও শাশুড়ী নামক একটা মায়ের প্রয়োজন ছিল। নাবিল দেখেছে তার মা’র কষ্ট। বাবা বিদেশে পাড়ি জমানোর পর এই মহীয়সী নারীটি অলৌকিক গুনে সবকিছু একাই সামলেছে৷ এই নারীটি নাবিলের চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী। নারীত্বের সর্বোত্তম উদাহরণ তার মা। পৃথিবীতে নাবিল সবচাইতে বেশি ভালো তার মা’কেই বাসে। মা’য়ের কষ্ট সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। বাবা মানসিক আর আর্থিকভাবে মা’য়ের পাশে থাকলেও দৈহিকভাবে তার উপস্থিতি ছিল না। মা সেসব সংগ্রামী দিনগুলো একা একাই পার করেছে, কেউ ছিলোনা মা’কে একটু স্নেহ করার। তা-ই এখন এসে এসব ন্যাকা ন্যাকা ফর্মালিটি নাবিলের বিরক্ত লাগে।

নিরা চুপচাপ খাচ্ছিল। মেজাজ বিগড়ালেও এখানে সে নেহাতই তৃতীয় পক্ষ। কিন্তু তার প্রচুর রাগ হচ্ছে নাবিল ভাইয়ের আচরণ দেখে। মানছে অতীতে ফুপ্পির সাথে এই বাড়ির লোকদের একটা ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে। তা-ই বলে সারাজীবন সেটা মনে রেখে মানুষকে ঘৃণা করতে হবে? মুরুব্বিদের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় এতোটুকু ম্যানার্স পর্যন্ত শিখেনি নেই। অসভ্য একটা!

“তা নিরা, তোমার আম্মু-আব্বুর শরীর ভালো তো? জয়নাল ভাই কেমন আছেন? নাবিলের আব্বু-আম্মুর বিয়ের আগে তো জয়নাল ভাই কতো এসেছেন আমাদের বাড়িতে। এখন আসেন না। মনে হয় রাগ করে আছেন আমাদের উপর, তাই না? ”

নিরা মিষ্টি হেসে চাইলো নাবিলের বড় চাঁচির দিকে। কী সরল দেখতে মহিলাটা। কথাবার্তায় কেমন সারল্যভাব। নিরার বেশ লাগলো তাকে।

“তেমন কিছুই না, আন্টি। আব্বু সবসময় একটু ব্যস্ততার মধ্যেই থাকে। তবে আপনাদের গল্প অনেক শুনেছি বাবার মুখে। আপনারা বাবাকে কতো স্নেহ করতেন সেসবও শুনেছি। আমি ভুল না করে থাকলে, আপনার নাম শাহিনা, ঠিক না?”

শাহিনা অবাক হলেন। নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামীর পানে চেয়ে বেশ আহ্লাদী কন্ঠে বললেন,

“জয়নাল ভাইয়ের মেয়েটা কী বুদ্ধিমতী হয়েছে দেখেছো? কী লক্ষী মেয়ে।”

ফয়সাল এহসান টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে নিরার মাথায় হাত বুলালেন।

“শুনো নিরা, তুমি এখন থেকে প্রায়ই নাবিলের সঙ্গে চান্দিনায় আসবে। নাবিলটা না এলেও তুমি তোমার ফুপ্পিকে নিয়ে চলে আসবে, কেমন? তোমাকে এই দায়িত্বটা দিলাম। ফুপ্পিকে অবশ্যই নিয়ে এসো।”

শাহিনার কথায় নিরা সম্মতিসূচক হেসে মাথা দুলালো। নাবিল একপলক সেদিকে চেয়ে ভ্রু বাঁকাল। এ হচ্ছে আরেক নাটকবাজ। মনে হচ্ছে, টিকিট না কাটিয়ে ফ্রি-তে সার্কাস দেখছে। কী নিখুঁত এক্টিং! বিচ্ছুটা কী ভাবটাই না নিচ্ছে সবার সামনে। মনে হচ্ছে, এর চেয়ে ভদ্র-নম্র, সরল,নিষ্পাপ মেয়ে পৃথিবীতে আর একটা নেই। এ যে কতো বড় বেয়াদব আর হারামি তা কী এরা জানে?

বর্ষার ঘুম এই ভাঙলো৷ বেলা বারোটার আগে সে শেষ কবে ঘুম থেকে উঠেছে মনে নেই। আজ বেলা করে ঘুম ভাঙারও বিশেষ কারণ রয়েছে। মনটাও সে-ই কারণ সূত্রে ব্যাপক ফুরফুরে। গতকাল সারারাত ঘুম হয়নি ছোট কাকির ফোন পাওয়ার পর থেকেই৷ নাবিল ভাই বিয়ে করেনননি শুনে যতটা না খুশি তার চেয়ে খুশি হয়েছে তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে লোকটা বাড়িতে আসছে শুনে। কারণটা এখনও অজানা। সেসবে অবশ্য আগ্রহ নেই। বিয়েটা যে হচ্ছে-না এই ঢেড়। তার স্বপ্নের পুরুষ, নাবিল ভাই! কিশোরী বয়স থেকে যে মানুষটার প্রেমে উন্মাদ হয়ে বসে আছে বর্ষা। দাদি যেদিন মারা গেলো সেদিনই ছোট কাকিকে বর্ষা প্রথম দেখেছিল। ফর্সা,লম্বা দেখতে মহিলাটাকে প্রথম দেখাতেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল বর্ষা সেদিন। তার জসিম কাকার বউ এতো রূপবতী! নাবিল ভাইকেও সেদিনই প্রথম দেখা। বর্ষা লোকটাকে প্রথম দেখেই বৈদ্যুতিক ঝটকা খাওয়ার মতো আঁতকে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, চোখের সামনে কোনো সিনেমার নায়ককে দেখছে সে। বর্ষার এখনোও মনে আছে, সাদা ফকফকা রঙের পাঞ্জাবী ছিল পরনে লোকটার। বাড়ির এক কোনে হাত বুকে ভাজ করে চুপচাপ বসেছিল মন ভার করে। কেঁদেকেটে নাক ফুলানো বর্ষাকে এসে যখন বলেছিল, “তুমি শফিক চাচ্চুর মেয়ে না? আমাকে একটা মাথা ধরার মলমের ব্যবস্থা করে দিবে? মাথাটা খুব ধরেছে।”

সেদিন মাথাটা বোধহয় নাবিল ভাইয়ের ধরেনি, ধরেছিল বর্ষার হৃদপিন্ডটায় কেউ একজন। এই সেই লোক, যাকে নিয়ে বর্ষা রোজ একটু একটু করে স্বপ্ন বুনে এসেছে। মামাতো বোনের সঙ্গে নাবিল ভাইয়ের বিয়ের দুঃসংবাদটা শুনে গত এক সপ্তাহ ধরে বর্ষার চোখে ঘুম নেই। দিন-রাত এক করে কেঁদেছে মেয়েটা। আর আজ স্বেচ্ছায় লোকটা বর্ষার কাছে ধরা দিতে এলো। এটাই বোধহয় নিয়তি। স্বপ্নেরা বোধহয় এভাবেও ধরা দেয়। গল্পেরা এভাবেও নেয় ভিন্ন ভিন্ন মোর।

বর্ষার বাবা-মা উভয়ই বেশ কিছু বছর ধরে বিদেশে থাকেন। সেসব অবশ্য টের পায় না ওরা দুই ভাই-বোন। বাড়িতে বড় চাঁচিই তাদের কাছে মায়ের সমান। তা-ই বাবা-মা দূরে থাকলে-ও তাদের কমতি কখনোই উপলব্ধি করেনি মেয়েটা। নিঃসন্তান শাহিনা নিজের সন্তানদের মতোই স্নেহ করে ওদের।

নিচতলায় নেমে বড়ঘরে উঁকি মারলো বর্ষা৷ব্যাকুল চোখজোড়া কাকে যেনো খুঁজছে। সেদিনের কিশোরী বর্ষাটা আজ উনিশ বছর বয়সী নারী হয়ে উঠা রমণী। গায়েগতরে সুন্দরী ললনা।
বর্ষা টেবিল খালি দেখে মুখ গোমড়া করে টেবিলে বসতে বসতে বড়মাকে শুধালো,

“সকলের খাওয়াদাওয়া শেষ নাকি, বড়মা? কার যেনো আসার কথা ছিল রাতে। এসেছে?”

শাহিনা রহস্যময় হেসে চাইলেন।

“কার সন্ধান করছিস রে? কার আসার কথা?”

শাহিনা বেগমের মশকরা ধরতে পারলো মেয়েটা।

“উফ বড়মা! ভনিতা করো না তো। বলো না, এসেছে?”

শাহিনা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজেই শুধালেন,

“রাজকন্যার এতো সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো তবে এই কারণে?”

বর্ষা নিজের লজ্জা আড়াল করার চেষ্টা করলো। আমতাআমতা করে বললো,

“খেতে দাও তো, খিদে পেয়েছে খুব।”

শাহিনা ঠোঁটের হাসি স্থিতিশীল রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

“যার সন্ধান করছিস, সে নিজের রুমেই আছে। দেখা করে আয় গিয়ে।”

বহুদিন পর নিজের ঘরটা ভালোমতো দেখছে নাবিল। ঘরটা প্রতিবার সে এলোমেলো করে দিয়ে গেলেও ফিরে এসে একদম গোছানো পায়। দাদাজান খুব শখ করে এই ঘরের ডিজাইন করেছে নাবিলের জন্য। বিশাল বিলাসি কক্ষটিতে কেবল তিন-চারটা আসবাব। খাট, কাঠের আলমারি, মাঝারি সাইজের একটা ডিভান আর একটা বড় বুকসেল্ফ। আলমারি আর খাট ব্যতিত বাকিগুলো বিশেষ কাজে লাগে না। মাসে, বছরে দু-একদিনের জন্য এলেও এই ঘরের অধিকার কেবলই নাবিলের। কাউকে ঢুকতে দেন না শাহানা। বর্ষা মাঝেমধ্যেই আসে ঘর পরিস্কার করতে। এটা অবশ্য ছুতো। ঘর পরিস্কার করার ছুতোয় লোকটাকে অনুভব হয় তার। নাবিলের ঘরি, শার্ট, প্যান্ট, টুকরো টুকরো যা পায় সবকিছুই মেয়েটা খুব যত্ন করে বুকে জড়ায়। লোকটার শরীরের তীব্র পুরুষালী সুভাস ভেসে বেড়ায় সেগুলোতে। এসবেও স্বয়ং মানুষটার অস্তিত্ব অনুভব হয়।

খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে গান শুনছিল নাবিল। ফোন বেজে উঠলো তার। বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে চাইতেই সহসাই সটান হয়ে উঠে বসলো। নিলয় ফোন করেছে ওকে। নাবিলের বেইবিইই!

“কিরে বাদর, কী শুনছি এসব? কী অঘটন ঘটিয়েছিস বাড়িতে? তুই কি কোনোদিনও শুধরাবিনা?”

নাবিল আড়মোড়া ভেঙে বললো,

“আমি আবার কী ঘটালাম, বেইবি? শুধরাবো না কেন? তুমি এলেই শুধরে যাবো। ট্রাস্ট মি।”

নিলয় হাসলো।

“কাজটা কি উচিত হয়েছে তোদের? কে দেয় এসব বুদ্ধি? আমাকে জানালেই তো আমি মামার সঙ্গে কথা বলতাম। এতো পাকামো করতে কে বলেছে?”

“বিশ্বাস করো ভাই, আমি একেবারেই নিরপরাধ, অবলা, নিষ্পাপ। তোমার আদরের মামাতো বোন, দ্য বেয়াদব নিরাটা আমাকে দিয়ে এসব করিয়েছে। নয়তো আমার ঘটে কি এতো কুটিল বুদ্ধি আঁটে? সবসময় আমাকেই দোষাও। ওকে তোমরা আজও চিনলে না। এ যে কী বড় ভন্ড তা যদি জানতে।”

নিলয় শব্দ করেই হাসল।

“তা, তোর ভন্ডটা কই?”

নিলা মাত্রই নাবিলের রুমে প্রবেশ করল।

“নাবিল ভাই, শ্যাম্পু আছে তোমার বাথরুমে?”

নাবিল সেদিকে চেয়ে নিলয়কে বললো,

“এইযে আমার ভন্ড হাজির। নে বাপ, কথা বল।”

“কে?”

“আমার কানাডিয়ান বেইবি।”

নিরা বুঝলো বোধহয়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে ধরলো। লজ্জা,সংকোচে কেমন অস্বস্তি লাগছে তার।

“নিরা!”

নিরার বুকের ভেতরটায় মুহূর্তেই তুফান বইতে শুরু করল৷ শরীরের শিরা-উপশিরায় কাঁপুনি শুরু হলো। মানুষটার কন্ঠে বরাবরের মতোই এমন শিহরণ লাগে ওর।

“কেমন আছেন, নিলয় ভাই?”

নিলয় জবাবে কিছু বলবে তার আগেই নাবিল খপ করে হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে হাতে শ্যাম্পুর বোতল ধরিয়ে দিয়ে বললো,

“বহুত কইছিস, নো মোর। ভাগ এখন।”

নিরা রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে চেয়ে শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে দুম করে আঘাত করে বসলো পিঠে। নাবিল খপ করে চুলের বেনী টেনে ধরলো। চুলে টান পড়তেই ব্যথায় উঃ করে উঠল মেয়েটা।

“জোর দেখাচ্ছিস আমার সাথে? খুব জোর হয়েছে?”

“শয়তান! ছাড়ো বলছি।”

“আহহ, কী হচ্ছে নাবিল? ছাড় তো ওকে। ব্যথা পাবে।”

“ছাড়বো? এটাকে তো বস্তাতে ভরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো ভাই।”

নিরা হাতে খামচি বসিয়ে দৌড় লাগালো।

“দেখলে ভাই, দেখলে ওর সরলতা? তোমাদের চোখে দূর্বিন লাগিয়ে দিলে তোমরা নাবিলের অপরাধই দেখবে। আর রাক্ষসীটা যে আমার পিঠ আর হাতের ইন্না-লিল্লাহ করে দিলো তার বেলায় কিছু না। যত বৈষম্য নাবিলের বেলায়। ওকে তোমরা কখনোই কিছু বলো না।”

নিলয় শব্দ করে হাসলো,

“ওকে কী বলবো? ও ছোট মানুষ, কিন্তু তুই তো ওর বড়?”

নাবিল অবিশ্বাস্য স্বরে বললো,

“একে তোমরা ছোট বলছো! এ ছোট? বয়সেই কেবল উনিশ, কাজ কাম করে নাইনটি নাইন বয়সের। ও একাই পুরা গোষ্ঠীর নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতে পারবে। ওকে এতোটাও সরল ভেবো না।”

“হয়েছে, শোন এবার। মন দিয়ে শোন।”

“বলো।”

“তোকে আগামী পরশু এয়ারপোর্টে আসতে হবে আমাকে রিসিভ করতে। কাউকে জানানোর দরকার নেই আপাতত।”

নাবিল চোখ বড় বড় করে চাইলো। স্ক্রিনে তারিখটা দেখে নিয়ে বিস্ময়ভরা স্বরে বললো,

“তুমি না আরও এক সপ্তাহ পরে আসবা? পরশু কেন?”

“সত্যিটা সবাইকে বলে দিলে সারপ্রাইজ হতো নাকি? একাই আসতে পারতাম। কিন্তু দেশে পা রাখামাত্রই প্রিয় একটা মুখ না দেখলেই না। তোকে ছাড়া বাড়ি পর্যন্ত পথটা জমবে না। একেবারেই একঘেয়ে লাগবে।”

চলবে।