গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১১
#নাজমুন_নাহার
আশ্চর্যজনকভাবে নিরা-নাবিলের বিয়ে বাড়ি থেকে উধাউ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা খুব সহজেই ধামাচাপা পড়ে যায়। তেমন জোয়ার-ভাটার সম্মুখীন হতে হয়নি ওদের। সিদ্ধান্তটুকু স্রোতের উপকূলে গিয়ে ঠেকলেও ফলাফল তেমন একটা জটিল হয়নি। এতোকিছুর মধ্যে নাবিল ভুলে যায় বর্ষার বিশেষ পত্রের কথা। অবহেলায় পড়ে রইলো আলমারির ড্রয়ারে সেটা। ঢাকায় ফিরে নিরার পুরোপুরি বন্দীদশায় কাটে। মিনিট, ঘন্টা, দিন করতে করতে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়। দেখা হয় না নাবিলের তার দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করা রমণীটির সঙ্গে। চাতক পাখির মতো ছটফট করতে থাকে ছেলেটা। ছুতো পেলো না একটাও। এই ক’দিন ভার্সিটিতেও যায়নি নিরা। ব্যাপারগুলো আগের মতো হলে হয়তো ফট করেই মামার বাড়িতে ঢুকে পড়ার উপায় থাকতো। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি জটিল। চাইলেই স্বাভাবিকভাবে মামার সামনে দাঁড়ানো যাবে না। কিন্তু মন যে মানে না। ব্যাকুল হয়ে আছে তৃষ্ণার্ত চোখজোড়াও! শুধু একটা ঝলক তাকে দেখার কামনা! সাথে বুকে জমেছে এক আকাশ সমান অভিমান। যার জন্য হৃদপিঞ্জরে এতো রক্তক্ষরণ সেই নিষ্ঠুর মেয়েটির কি-না সেসব ফিরে দেখার এতোটুকুও তাড়া নেই? নেই কাউকে বোঝার একরত্তি প্রয়াস!
ঢাকায় ফেরার এক সপ্তাহ হলো ওদের। জয়নাল সিকদার এখনও নিজের মান-অভিমানে অটুট আছেন। অবশ্য অটুট যে আছেন সেটা বোঝাও মুশকিল। ভুল নিজ থেকে স্বীকার না করলেও নিরার পড়াশোনা নিয়ে এখন তিনি বেশ কঠোর। পড়াশোনার জন্য বাপের নাক কাটানোর শায়েস্তা, নাকি সত্যিই নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা সেটাও বোঝার উপায় নেই। স্নাতক শেষ করতে চাইলে প্রত্যেক সেমিস্টারে ভালো গ্রেড পাওয়া চাই। নয়তো সত্যি সত্যি বয়রা-কানা একটাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দেবেন বলে মেয়েকে হুশিয়ারি দেন জয়নাল সিকদার। নিরা অবশ্য এই হুশিয়ারকে নিজের জন্য সবুজ বাতি হিসেবে ধরে নিয়েছে। খুশি সে। আজ থেকে নো হাংপাংকি, শুধু পড়াশোনায় পূর্ন মনোনিবেশ। বাবাকে দেখাতে হবে নিরা গর্বিত মেয়ে। তবে আজ খানিক ব্যস্ততা বাড়িতে। আগামীকাল মিরার শশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও সকলেই থাকছে। ঘরোয়াভাবে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা না করলেই না জয়নাল সিকদারের। মন থেকে না মেনে নিলেও হাজার হলেও কুটুম ওরা। মেয়েটা ভালো থাকলেই ভালো। তাছাড়া সামাজিকতা বলেও একটা কথা আছে।
বসন্ত হানা দিয়েছে নিরার মনের দুয়ারে। চারিদিকে বহুল আকাঙ্ক্ষিত কারো আগমনের মধুর সুর বাজছে। একটা দীর্ঘ সময়ের পালন করা অবুঝ উষ্ণ প্রেম! পাগল পাগল লাগছে আজ ক’দিন যাবত। কখন তার মনের দরজায় সে অধিকার নিয়ে নাড়বে কড়া, কখন আসবে গোপন প্রেমিক!
নিরা একগাদা জামাকাপড় আলমারি থেকে নামিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। জামাকাপড়ের সাথো তার অবস্থাও অগোছালো। এলোমেলো লম্বা চুলগুলোও ঠাই পেয়েছে শুভ্র মেঝেতে। পা ছড়িয়ে বসেছে মেয়েটা। এক হাত কপালে। চোখেমুখে একরাশ চিন্তা আর দুঃখী দুঃখী ছাপ। আগামীকাল এতো গেস্ট আসবে বাসায়। মিরাপুর শশুর বাড়ির লোকজন, আত্নীয়রা, বাবা-র বন্ধুরা, প্রতিবেশী আর….নিলয় ভাই! এতোগুলা বছর পর মানুষটাকে আগামীকাল প্রথম দেখবে নিরা। এতো অপেক্ষা, এতো আকাঙ্ক্ষার পর তার সম্মুখীন হবে!,… কতো অস্থিরতা কাজ করছে মনে। উত্তেজনার দরুন দু’দিন ধরে নাওয়াখাওয়ার নিয়ম বেগতিক। কাল কি একটু বিশেষ লাগানো উচিত না নিজেকে?যা-তা একটা পরলেই হলো? কিন্তু পুরো আলমারি তল্লাশি চালিয়ে একটাও মনের মতো ড্রেস পেলো না। আমিনা বেগম ঘরে ঢুকে মেয়ের এহেম অবস্থা দেখে চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ কী অবস্থা করে রেখেছিস ঘরের? পাগলের মতো হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছিস কেন? মাথাটা ঠিক আছে?”
নিরা বিরক্তি নিয়ে চাইলো। “যাও তো আম্মু, ভাল্লাগছে না। আমার একটাও ভালো ড্রেস নেই, কালকে কী পরবো?”
আমিনা বেগম একবার মেঝেতে বিছিয়ে পিরামিড করে রাখা কাপড়গুলোর দিকে চাইলেন, তো আরেকবার উদাসমুখী মেয়ের দিকে। বলে কী মেয়ে! এতো এতো নতুন জামাকাপড়ের মধ্যে কি-না একটাও জামা চোখে পড়ছে না? মাথার সাথে সাথে চোখ দু’টোও গেছে মেয়েটার। তিনি প্রকট রাগ নিয়ে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“এসব কি ছালা মনে হচ্ছে? চোখে ছানি পড়েছে তোর?”
নিরা অবাক হয়ার ভান ধরে। “এগুলো পরবো আমি! এগুলো? সবগুলো কেউ না কেউ পরতে দেখেছে।”
তিনি শব্দ করে হাতের গ্লাসটা পড়ার টেবিলে রাখলেন।
“জমিদারের বেটি! একেকদিন একেকটা জামা লাগবে তার।”
নিরা ঠোঁট উল্টায়। “কালকের ব্যাপারটা ভিন্ন আম্মু। মিরাপুর শশুর বাড়ির লোকেরা আসবে। তোমার নতুন আর বেয়াই বাড়ি। তাদের সামনে আমি পুরোনো জামা পরে যাবো? তোমাদের একটা মানইজ্জত আছে না?”
“একদম রাগ উঠাবি না নিরা। পুরোনো জামা পরলে মানইজ্জত যায় না। এমন ফুটানি স্বভাব ছাড়।”
জড়িয়ে ধরলো মা’কে নিরা। “ফুটানি স্বভাব বলতে পারলে আম্মু! মিরাপুর শশুর বাড়ির লোকেরা না এলে কি এভাবে বলতাম বলো? প্লিজ প্লিজ আম্মু। সত্যি বলছি, এই মাসে আর এক টাকাও চাইবো না, প্রমিস।”
ওর বলার ধরনে ফিক করে হেসে ফেললেন তিনি। স্নেহ নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। চুমু খেলেন ওর কপালে তিনি। কৃত্রিম গম্ভীর হয়ে চাইলেন, “কখন যাবি?”
নিরা হৈহৈ করে উঠলো। “আই লাভ ইউ আম্মুউউউউউ! তুমি এতো ভালো কেনোওওওওওও! রাতে যা-ই?”
“আম্মু তো ব্যস্ত আছি রাতেও বাবু। কাকে নিয়ে যাবি?”
“নেহাল ভাইয়ার বউ তো আজকেই আসবে, তো ইফরানকে নিয়ে যাই?”
আমিনা মনে করার ভঙ্গিতে বললেন, “ওদের কথা তো খেয়ালেই ছিল না। কিন্তু এইটুকু পুঁচকেটা তোর সঙ্গে গিয়ে কী করবে? তার চেয়ে বরং নাবিলকেই ফোন কর।”
নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে। “আমি লন্ডন যাচ্ছিনা আম্মু। সব জায়গায় উঠকো বডিগার্ড লাগবে না। ইফরানকে যেতে দিলে দাও, নয়তো আই এম এনাফ ফর মাইসেল্ফ।”
মেয়ের জেদের নিকট হার মানলেন তিনি।
বাসা থেকে মার্কেট খুব দূরে না। দশ মিনিটের রাস্তা। হেঁটেই চলে এলো ওরা। বেশ কয়েকটা জামা দেখলো এরই মধ্যে নিরা। পছন্দ করতে পারছে না একটাও। নজরে লেগেছে তিনটা, এর মধ্যে থেকেই একটা নিবে। কিন্তু কোন রংটা মানাবে? দোকানদার তখন থেকে তেল মারা কন্ঠে বলেই যাচ্ছে, “আপনি সুন্দর মানুষ আপা, আপনারে সবগুলাই মানাবে। নিয়া নেন দুইটা।”
কী মনে করে ফোন করলো একজনকে। সরাসরি ভিডিও কল। ধরফরিয়ে রিসিভ করে ফোন ক্যামেরা অফ করে অপর প্রান্তের পুরুষালি কন্ঠটা ধমকে বলে উঠে, “কমনসেন্স কি কেজি দরে বেঁচে দিয়েছিস? বৈশাখ মাসে একটা নওজোয়ান ছেলেকে ভিডিও কল করার আগে একটু ম্যাসেজ করে যে টোকা মারতে হয়, এইটুকু সুবুদ্ধি হয়নাই?”
নিরা গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে। দাঁতে দাঁত পিষে রসিয়ে রসিয়ে বলে, “বৈশাখ মাসের সাথে ভিডিও কল না করার সম্পৃক্ততা কী?”
“গরম হচ্ছে ফ্যাক্ট। খালি গায়ে আছি মদন।”
নিরা মুখ বাঁকায়। “ঢং না করে সামনে আসো। হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়ে নির্লজ্জের মতো সারা ঘর ঘুরে বেড়িয়েছো, সে-ই সময় এতো শরম-বরম কই ছিল? শার্টলেস মনে হয় নতুন আসছো আমার সামনে?”
“এখন শরম লাগার সলিড কারণ আছে। তুলনামূলকভাবে এখন সময়টা একটু লজ্জার। নাহ, একটু বেশিই লজ্জার।”
“উফফঃ তোমার নাটক শেষ হলে সামনে আসো। আজাইরা আলাপ করতে ফোন করিনাই।”
“দাঁড়া, গেঞ্জিটা পরতে দে।”
নিরা ক্যামেরা তাক করে উল্টেপাল্টে জামা তিনটা দেখায়। “কোন রঙটা ভালো লাগবে?”
“কার জন্য?”
“আমার জন্যই। এতো খুশি হইয়ো না। তোমার কালার সেন্স ভালো বলেই তলব করা।”
বেশ কিছুক্ষণ খেয়াল করে দেখলো ড্রেসগুলো নাবিল। অকস্মাৎ চোখ বন্ধ করলো। কী একটা ভাবছে। নিরা ভ্রু কুঁচকায়। চোখ মেলে প্রসন্ন কন্ঠে নাবিল বলে, “একটাই নিচ্ছিস?”
“হু।”
“আরও কয়েকটা দেখ।”
নিরা চুপ থাকে বেশ কিছুক্ষণ। নাবিল কী বুঝে শুধায়, “শফিক্কার দোকান না এটা?”
নিরা কথার অর্থ বুঝতেই তীক্ষ্ণ চোখে চায়। “তোমাকে আসতে হবে না। শুধু বলো কোনটা নিবো?”
অপর প্রান্ত থেকে ফোন টুট টুট ফোন কাঁটার আওয়াজ। বাইক নিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসে নাবিল। নিরা চোখ কপালে তুলে চেয়ে রইলো। বলতে না বলতেই ভূতের মতো বাইক নিয়ে হাজির। ভাবসাবই অন্যরকম ইদানীং লোকটার। আজ-কাল একটু বেশিই পরিপাটি থাকে মনে হচ্ছে। চেহারা ছুরুতে নতুন বর বর টাইপ জড়তা। নিরা ওকে পা থেকে মাথা অব্ধি আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, ” নাবিল ভাই, চুপ থেকে জাস্ট একটা চয়েজ করে দিবা। নো হাংকিপাংকি।”
নাবিল জবাব না দিয়ে আঙ্গুলের তর্জনী দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে ইশারা করে দোকানদারকে বলে, “ভাই, বেস্ট কয়েকটা কালেকশন দেখাবেন। বেস্ট মানে বেস্টটাই।”
পুরোটা সময় মুখ আধার করে বসেছিল নিরা। অসহ্য লাগে এসব বাড়াবাড়ি। টাকার গরম দেখাচ্ছে? একটা মানুষ এতোটা নাছোড়বান্দা কী করে হতে পারে! ঘাড়ত্যাড়ার হাড্ডি!
নাবিল ওকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজনবোধ করলো না। নিজের পছন্দ মতো তিনটা তিন রঙের ড্রেস নিয়ে নিলো। নিরা খেয়াল করেনি সেসব। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসেছিল। ইফরান এতোক্ষণ চুপ থেকে সবই খেয়াল দেখে গেলো। মুখ গোমড়া তার। নাবিল মাথায় হাল্কা টোকা মেরে শুধায়, “তোর কাহিনী কী?”
“তুমি ফুপ্পিকে তিনটা ড্রেস কিনে দিলে আর আমাকে শুধু বিশ টাকার আইসক্রিম? বাড়িতে গিয়ে বলে দিবো সব।”
ঠোঁট উল্টে কথাটা বললো ইফরান। চোখদুটো টলমল করছে অভিমানে। নাবিল ওর মুখ চেপে ধরে। পকেটটা ফাঁকা আপাতত। “শালাররর! তোর বাপ তোরে কী খেয়ে পয়দা করসে রে? সবখানে ষোলোআনা নিজের হিসেব। কার সাথে নিজের কম্পেয়ার করছিস জানিস? চাঁচি ডাক, চাঁচি।”
“চাঁচি ডাকবো কেন? তোমাদের তো বিয়েই হয়নি।”
গগন কাঁপিয়ে হেসে ফেলল নিরা। নাবিল সেদিকে একপলক চেয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। ঠাটিয়ে দু’টো থাপ্পড় লাগাতে পারলে মন্দ হতো না। ফাজিল একটা!
চাপর মারে ইফরানের পিঠে হাল্কা। “চল, তোর আগুনে ঘি ঢালা রেডিও মেশিনটা বন্ধ রাখার জন্য হলে-ও একটা ঝিংকু মার্কা রিমোট কন্ট্রোল প্লেন কিনে দেই।”
সুযোগের সৎ ব্যবহার করা যাকে বলে। এক বলে ছক্কা হাঁকানোর মতো গুনে গুনে তিনটা খেলনা হাতিয়ে নিলো ইফরান। তাও যেনতেন না, শপের সবচেয়ে দামি দেখে তিনটা। হাতছাড়া করবে কেন? অন্য সময় হলে কী আর কিনে দিতো?
নিরা দোকান থেকে বের হওয়ার পর থেকেই হেসে চলেছে। ইফরানের অবস্থাও একই। নাবিল ওর কলারে হাল্কা টান মেরে হুমকির স্বরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “এবার বল, বাড়িতে গিয়ে বলবি কিছু?”
ইফরান মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতে খেতে জবাব দেয়, “উহু। আরেকটা আইসক্রিম কিনে দাও।”
চির অশুদ্ধ নাবিলের উন্মোচন ঘটে রাগে। “মির জাফরের বাচ্চা! আমারে দেখলে কী বিলগেটসের নাতি মনে হয়?”
ইফরান মাথা দু’দিকে দুলিয়ে বোঝায়, না, মোটেও মনে হয় না। নিরা ভদ্রতার খাতিরে হাসিটুকু বিকট আওয়াজে বের করার সুযোগ পাচ্ছে না। নাবিল তীক্ষ্ণ চোখে চায় ওর দিকে। বিরবির করে বলে, “হবু স্বামীর খয়রাতি দশায় এতো মজা তোর? তোকে সত্যি সত্যি কুঁড়েঘরে রাখবো ফাজিল!”
প্রায় দশটার মতো আইসক্রিম কিনে দেয় নাবিল। মুখস্থ পড়ার মতো গিলায় কিছু বাক্য। কেউ জিজ্ঞেস করলে কী কী বলতে হবে তাও শিখিয়ে দিলো। বাধ্য ছেলের মতো মাথা উপরনিচ করে ইফরান। বাইকে করে ওদের পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে যায় সে। বাসায় ফিরে তিনটার বদলে চারটা শপিং ব্যাগ দেখে থমকায় নিরা। চতুর্থ ব্যাগটা খুলে দেখলো কৌতুহলবসত। প্যাকেট খুলে চোখ বড় বড় হয়ে এলো। এটা এলো কোথা থেকে?
একটা জলপাই রঙের জামদানী শাড়ী।
——
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা। এই মাঝ রাত্তিরে রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ছেন রাহেলা৷ ছেলের ফ্রাইড রাইস আর চিকেন ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করেছে। শুয়েই পড়েছিলেন তিনি প্রায়। তখনই বাচ্চাদের মতো মা’র কাছে গিয়ে আবদার জুরে বসলো নাবিল, “আজ তুমি কিছুতেই ঘুমাবে না আম্মু। আমার সাথে অনেকক্ষণ জেগে থাকতে হবে। আজ সারারাত আমার সাথে আড্ডা দিবে। উঠো, আমার ঘুম আসছে না। ভালো লাগছে না কিছুই। ফ্রাইব্রেড রাইস আর চিকেন ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করছে।”
হাসেন তিনি। কী নিষ্পাপ আবদার ছেলেটার। পৃথিবীর সকল ক্লান্তি না-ই হয়ে যায় ছেলের একটা বায়নাতে। এসব ক্ষেত্রে সে চির নিরলস, অক্লান্ত মা। বরং সারাক্ষণ এসবেরই অপেক্ষায় থাকেন। কখন ছেলেটা ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো মা’কে জড়িয়ে ধরে এটা সেটা খাওয়ার বায়না ধরবে, অভিযোগ করবে অবান্তর বিষয়গুলো নিয়েও। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই যেনো সকল অসুখ ভুলে যান তিনি। ভীষণ আদুরে একটা মুখ।
খাওয়া শেষ হলে মা’র কোলে মাথা রেখে শোয় নাবিল। রাহেলা বেগম বোধহয় কিছু একটা আচ করলেন ছেলের আচরণে। আজকাল বড্ড অন্যরকম আচরণ করে ছেলেটা। পাগলামীগুলো একটু কমেছে। মা’কে জ্বালানোর বদলে সারাদিন ধ্যানমগ্ন হয়ে কী যেনো ভাবে। গুনগুন করে গান গায়। বার-বার আয়নায় চুল ঠিক করে। একের পর এক শার্ট-প্যান্ট পরিবর্তন করে। কী সব এলোমেলো ভাবনা মাথায় ঘুরে কে জানে!
ছেলের চুলে বিলি কাটেন। মনোযোগ দিয়ে দেখলেন ছেলেটাকে। খেয়াল করলেন, তার ছেলেটা দেখতে অসম্ভব সুদর্শন। এমন একটা আহ্লাদী চেহারার ছেলের মা হিসেবে সৃষ্টিকর্তা কি-না তার মতো নগন্য নারীকেই নির্বাচন করলেন? গর্বিত হাসলেন তিনি। কপালে চুমু খেলেন ছেলের। চুলে হাত বুলিয়ে মাতৃস্নেহের কন্ঠে শুধান, “বাবাকে ফোন করা হয়েছে আজ?”
নাবিল চোখ মেলে অসহায় মুখ করে চায়, “শিট! খেয়ালই ছিল না আম্মু।”
“তা তো দেখছিই। আজ-কাল কোথায় কোথায় থাকে খেয়ালগুলো?”
নাবিল স্মিত হাসে। ছেলের হাসিতে কিছু একটা খুঁজে বেড়ায় মা।
“তোর বাবা রেগে আছে তোর উপর। বলছে, দাদা বাড়ি থেকে এসে তুই বদলে গিয়েছিস। আগের মতো বাবা-র খোঁজ করিস না। ওরা বোধহয় তোকে বাবা-র বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে।”
নাবিল চোখ বুঝে মা’র কোমড় জড়িয়ে ধরে, “তো তুমি কী বললে?”
“কী আর বলবো? আমিও আরেকটু উস্কে দিলাম। বলেছি আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটছে। ছেলে তার মাকেও পাত্তা দেয় না আজকাল।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা শ্বাস টেনে কেবল ব্যথাতুর কন্ঠে ডেকে উঠে নাবিল, “আম্মু!”
“শুনছি তো আব্বা।”
“আমি যদি তোমার সমপরিমাণ কিংবা তার চেয়ে একটু বেশি কাউকে ভালোবাসি, তুমি কি তাকে হিংসে করবে?”
বিস্মিত হন তিনি। চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান চোখে চাইলেন ছেলের পানে। নাবিল লাফিয়ে উঠে মা’র সামনাসামনি হয়ে বসে।
“আচ্ছা বাদ দাও। এখন বলো,আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছো? আই মিন, চেহারায়?”
ছেলের একের পর এক এহেম অদ্ভুত কথায় রাহেলার দুঃশ্চিতার পরিমান একটু একটু করে বাড়ছে। তিনি জবাব না দিয়ে চেয়ে রইলেন কপাল সপ্তম আসমানে তুলে।
“না মানে, শুনলাম প্রেমে-ট্টেমে পড়লে মানুষ একটু কেমন কেমন হয়ে যায়? মানে একটু পাগল টাইপ। অতি সুখে নাকি চেহারা-ছুরুতই পাল্টে যায়। ব্যাপারটা কতোটুকু সত্য সেটা নিশ্চিত হতেই জিজ্ঞেস করা।”
“আব্বা, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? এমন আবোলতাবোল বকছো কেন এতো রাতে? মা ভয় পাচ্ছি বাপ। কী হয়েছে বল? মাথায় কী চলে?”
শব্দ করে হেসে উঠল নাবিল। ঘেমে উঠলেন রাহেলা। আঁচল টেনে মুখে ধরলেন।
“তুমি তোমার জলজ্যান্ত সুস্থ ছেলেকে মানসিক রোগী বানিয়ে দিচ্ছো? প্রেমে পড়ার অপরাধে এখন আমাকে পাবনাও যেতে হবে?”
“কে প্রেমে পড়েছে?”
“তোমার সোনার টুকরো ছেলে।” চোখ মেরে নাটকীয় স্বরে কথাটা বলে নাবিল।
মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না রাহেলার। মা’কে চুপ থাকতে দেখে নিজেই শুধায়, “আচ্ছা আম্মু, এক দেখায় কি কারো প্রেমে পড়া যায়? মানে এক মিনিটের সাক্ষাতে ভালোবাসা ব্যাপারগুলো হওয়া সম্ভব?”
এতোক্ষণে ঘটনার সারাংশ বোধগম্য হয়। স্বাভাবিক হলেন তিনি। “কেন বল তো?”
“এমনি। বলো না!”
“মমমম…হয়তো হয়। তোর আব্বুর ক্ষেত্রে তো তেমনটাই হয়েছে। তোর আব্বু কিন্তু আমাকে এক দেখাতেই পছন্দ ফেলেছিল। তার পরই সোজা বিয়ের প্রস্তাব।”
“ধুর! পছন্দ আর ভালোবাসা কি এক হলো?”
“পছন্দ না করলে ভালোবাসার অনুভূতি আসবে কী করে, আব্বা? একটা তো বাহানা লাগবেই ভালোবাসতে।”
“মানে বলছো ব্যাপারটা দৈহিক, আই মিন রূপগত আকর্ষণ হতে পারে? এতে দোষ নেই,তাই তো? তবে সেটা ভালোবাসা হয় কী করে? যদি কেউ শুধুমাত্র কারো সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে? এটাঅন্যায় না?” ছেলের সহজ স্বীকারোক্তি।
“অন্যায় কেন হবে? ভালোবাসার মতো সম্পর্কে পুরোপুরি আবদ্ধ হওয়ার জন্য একটা বাহানা তো চাই, একটা ছুতো তো লাগেই তার প্রতি আকর্ষিত হওয়ার জন্য, তাই না? কেউ চোখ দেখে আকর্ষণ অনুভব করে, কেউ কন্ঠ শুনে, কেই বা চুল-হাসি ইত্যাদি। বলতে পারিস রুপের টান ব্যাপারটা হচ্ছে বাহানা।”
নাবিল চোখে রহস্যের ছটা এঁকে শুধায়,”আচ্ছা তো, কারো রাগের উপরও প্রেমে পড়া যায়? ইজ দ্যট নরমাল? আই মিন, কারো ঝাঁঝালো কথার তরেও প্রেমে পড়া সম্ভব?”
শব্দ করে হেসে উঠলেন এবার তিনি।
“আপনি কি প্রেমে ট্রেমে পড়েছেন আব্বা? এতো অস্থির হয়ে তো আমার ছেলেটা কখনোই কথা বলে না। ছলাকলা না করে নামটা বলুন।”
নাবিল মা’য়ের কোলে মাথা রেখে পেট জড়িয়ে নিজের লজ্জার মুখ ঢাকলো।
“আই এম ইন লাভ উইথ আ ক্রিমিনাল, আম্মু।”
রাহেলা আঁতকে উঠলেন ছেলের কথায়।
“সে কী কথা! কোন ক্রিমিনালের প্রেমে পড়েছিস? এসব কী কথা, নাবিল?”
নাবিলের কন্ঠের আওয়াজ তীব্র হয়। “সে চোর, সে ডাকাত, সে খুনি। সে….সে কতো বড় আসামী জানো, আম্মু?
রাহেলা চিন্তিত ভঙ্গিতে ছেলের কপালে-কলায় হাত রাখলেন। নাহ, কপাল,গলা তো ঠান্ডাই। জ্বর-টর হয়নি। তবে দিনে-দুপুরে এমন ভুলভাল বকছে কেন সুস্থ ছেলেটা?
“ফাজিল! টেনশন দিচ্ছিস তুই আমায়।”
মা’য়ের চিন্তিত মুখে চেয়ে বিশ্ব জয় করা হাসল নাবিল। উঠে বসে মা’র দুই গাল টেনে মজনু স্টাইলে বলে,”তোমার ছেলের হতদরিদ্র মনটাকে পর্যন্ত একরত্তিও ছাড় দিলো না পাষাণ রমণীটা। নিষ্ঠুর উপায়ে আমার মনটা চুরি করেছে। ডাকাতি করেছে একঘেয়ে সুখের দিনগুলোকে। আমায় তার অপ্রতিরোধ্য চোখের ধারালো চাহুনিতে এক মুহূর্তেই খুন করেছে, আম্মু,। তোমার ছেলে বেঁচে নেই। সে এক সর্বনাশিনীর প্রেমে মৃতপ্রায়! শি ইজ আ ক্রিমিনাল। বুকের মধ্যে ঢুকে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে গত এক সপ্তাহ ধরে। আমি না ঠিকঠাক খেতে পারছি, না ঘুমাতে। সবখানে আমি ওকেই দেখি আম্মু। তুমি বুঝতে পারছো আমার অবস্থাটা? তার এসব প্রাণনাশক অপরাধ নিয়ে তোমাদের তথাকথিত সংবিধানের আইনে কোনো ধারা নেই? নেই কোনো কঠিন নীতি? এমন গুরুতর অপরাধের জন্য তার কি কোনো সাজা হবে না, আম্মু? তোমার ছেলেকে খুন করার অপরাধে তাকে কি ফাঁসিতে চরানো উচিত না,বলো?”
রাহেলা বেগম ছেলের বিভ্রম কথার মানে বুঝতে পারছেন না। কন্ঠে কৌতুহল মেখে শুধালেন,
“নাম কী?”
নাবিল মায়ের দিকে একপলক চেয়ে বাম হাতটা নিজের বুকে মাঝ বরাবর রাখে। ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি অথচ কী গভীর দীর্ঘশ্বাস। মিটিমিটি হাসলেন মা। কোমল হয়ে এলো হৃদয়টা। “কে করলো আমার ছেলের এমন দুর্দশা? নাম বল। কার এতো বড় সাহস? আমার নিষ্পাপ ছেলেটার সাথে এতো অবিচার!”
নাবিল ভাবে। চোখদুটো বুঝে একপলক নিরার বসন্তের শুভ্র ফুলের মতো স্নিগ্ধ জ্বালাময় হাসিটা মনে করে নেয়। যেই হাসি নাবিলকে অস্থির করে তোলে৷ ঘুমাতে দেয়না, খেতে দেয়না। যেখানে যায়, যা করে সব খানে মেয়েটার বিচরণ থাকা চাই। দিন-রাত খিলখিল করে হেসে নাবিলের দশাকে ব্যাঙ্গ করে চলেছে। কুটিল রমণী! সর্বনাশিনী! পাষান! নিষ্ঠুর! হৃদয়হীন!
নাবিলের কন্ঠ ভেঙে আসে বিষন্ন নিশির মধ্যম প্রহর হয়ে। ব্যথাতুর নয়নে মা’র দিকে একপলক চেয়ে মাথা ঝুঁকায় ছেলেটা। কন্ঠে আবেগ মিশিয়ে বলে, “আমার ওকেই লাগবে, আম্মু। তোমার আদরের নিরাটাকে আমার লাগবেই! কথা দাও, ওকে আমার করে দিবে?”
চলবে।