গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৫
#নাজমুন_নাহার
পরপর আরও চার-পাঁচদিন ধরে কোনোপ্রকার সন্ধান নেই নাবিলের। ষষ্ঠ দিনে অমাবস্যার চাঁদের মতো করে দেখা পাওয়া গেলো তার। আজ কেমন অন্যরকম লাগছে ওকে। আগের মতো প্রাণচঞ্চল ভাবটা নেই। সম্পূর্ণ অগোছালো, ক্লান্ত, দায়সারা একটা মানুষ। চেনাই যেনো যায় না। চোখ-মুখও হয়েছে কেমন থমথমে।
অনেকদিন পর ভিসি চত্বরে আসা হলো ওদের। নাবিলই আসতে চেয়েছে। আসার সময় শাওনের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ছেলেটা। শাওনও ছাড়ার পাত্র নয়, ইনিয়েবিনিয়ে বহু কায়দা করে ভেতরের রহস্য উদঘাটন করেছে। গত পনেরো দিনের সব ঘটনাই এবার স্পষ্ট।
“বর্ষা যে তোকে ভুলে যাবে, কিংবা জেদের বসে নিজের ক্ষতি করে বসবে না সেটার গেরান্টি কী?”
নাবিল দুই হাত ভাজ করে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে। মাথা নামায় পূনরায়। ” পারবে ভুলতে। কঠিন হবে না ভোলা। সহজ হবে কারণ ও আমাকে ভালোবাসেনি।”
“কী করে বুঝলি?”
“ভালোবাসায় যেমন উন্মাদ হতে হয়, ও আমার জন্য তেমন কখনোই ছিল না। নিরার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারটা আগে থেকেই ও জানতো, চাইলেই সেদিন মনের কথা বলতে পারতো। বলেনি, কারণ সে বিভ্রান্ত। ওর মনের পুরোটা জুড়েই আমার জন্য কেবল ভালো লাগা, আবেগ আর মোহ। কিন্তু বেচারী ভালোবাসা আর ভালোলার মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না। বর্ষা আমাকে ভালোবাসে না। যেটুকু আছে, সবটাই ওর ফেন্টাসি। আই এম রেসপেক্টিং হার ফিলিং। ওকে ওর আমিত্বকে জানানোর জন্যই একটু সফ্ট হতে হয়েছে আমাকে। মুখের উপর চাইলেই না করে দিতে পারতাম। তবে এতে ওর ইগো হার্ট হতো, জেদ বাড়তো। সমাধানের বদলে সবটা ঘোলাটে হয়ে যেতো।”
গত একঘন্টা ধরে সবটাই শুনলো শাওন। অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে ভেতরে। আপাতত আস্তে আস্তে জানবে সব।
“বুঝলাম। কিন্তু যার জন্য এতো তোলপাড়, তার দেখা পেলি কই?”
গুমোট মুখটায় এক চিলতে হাসির আভা দেখা গেলো। ফেলে রাখা হাতটা এবার রাখে শাওনের কাঁধে। প্রস্তুতিমূলক শ্বাস ফেলে বলে,
“প্রথম দেখা পেয়েছি তার জন্মের সময়। আমার বয়স তখন চার বছর।”
শাওন অবাক হয় বেশ। “জন্মের সময়? বলিস কী!”
” হ্যা। আম্মুর সাথে হসপিটালে গিয়েই প্রথম দেখা পাই তার। আমি তাকে কোলেও নিলাম। কিন্তু মেয়েটা বরাবরই জেদি স্বভাবের। আমার কোল তার পছন্দ হয়নি। কিছুতেই থাকবে না আমার কাছে। কোলে চড়েই ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা’গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেকেটে বিদিগিস্তা অবস্থা। সেদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেও পাঁচ সেকেন্ডের বেশি মেয়েটাকে কোলে রাখতে পারলাম না। অথচ আজ, এই মুহূর্তে এসে আজন্মের জন্য তাকে মাথায় চড়ে বসানোর সাধ জাগছে।”
শাওন মাথা উপরনিচ করে।
“সাংঘাতিক প্রেম ভাই! একটা দুধের শিশুর প্রেমে পড়ে গেলি?”
মাথা ঝাঁকিয়ে হাসে নাবিল।
“কে জানতো এই দুধের শিশুই যে জুয়ানকালে এসে কঠিন সর্বনাশ করে বসবে?”
“কতোদিন ধরে চলছে এসব?”
“কী সব?”
“লেদাবাচ্চার সাথে প্রেম।”
শব্দ করে হেসে ফেলল নাবিল।
“একতরফা প্রেম ব্রো। বলা হয়নি এখনও। বলবো, শীগ্রই বলবো। জানিস? প্রেমটা কিন্তু মাত্র ক’দিন হয় হলো। মানে তাকে আমি জন্মের পর থেকে অজস্রবার দেখেছি। কিন্তু সেদিনের মতো লাগেনি আগে কখনোই। মনে মনে যদিও কোথাও একটা সফ্ট কর্নার হয়তো আগে থেকেই রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এমন প্রেমের নজরে তাকে কখনোই খেয়াল করে দেখিনি। সেদিন মনে হয়েছিল, এইতো প্রথম দেখা। বড্ড নতুন, তবে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে তার রুপ,সুর,মন। নির্মল আলোর মতো গায়ে লাগলো একটা উষ্ণ উজ্জ্বল ছোঁয়া। এটাই বুঝি সে-ই চিরআকাঙ্ক্ষিত শুভক্ষণ। সে তুফানের মতো নতুনভাবে আমার জীবনে আসলো, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার প্রেমে ডুবে গেলাম। চেয়েও সেদিন তাকে এড়িয়ে যেতে পারিনি,বিশ্বাস কর। সর্বনাশিটা ধনুকের মতো বিঁধিয়ে দিলো ভালোবাসা নামক সুক্ষ ধারালো তীরটা। মনের ভায়োলেনটা সেদিনই বেজেছিল। মানুষ প্রেমে পড়ে জ্যোৎস্না রাতে, বর্ষণে, কিংবা বসন্তের নরম বাতাসে। আর আমি প্রেমে পড়লাম কাঠফাটা রোদ্দুরে! একটা শুঁকনো দুপুরে, রোদ পোহাবার ছুতোয়। তার সদ্য গোসল শেষ করে আসা মায়াবী মুখশ্রী। একজোড়া টানা টানা মায়াবী চোখ, আধভেজা দিঘল কালো কোমড় ছুঁই ছুঁই চুল, চুল বেয়ে আবার দু,এক ফোঁটা পানির বিচরণ মাটিতে। পৃথিবীর তামান সৌন্দর্য সঁপে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা যেখানে। একপলক চেয়ে রিতীমত প্রাণ যায় যায় হাল। অসার হয়ে গিয়েছিলাম,ভাই। হায়ে!বুকের ভেতরটায় কী হিংস্র ঝড়! পৃথিবীর তামান ঘূর্নিঝড় ফেইল সে-ই ঝড়ের সম্মুখে।যে ঝড়ে আমার মন লুকিয়ে যায়, মন খুঁজে পাই না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখি, তার আঁচলের তলায় কেমন গুটিশুটি মেরে সহজ-সরল মনটা লুকিয়ে আছে।”
থেমে লম্বা শ্বাস নিলো নাবিল। কথাগুলো বলার সময় চোখে-মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। প্রাণসতেজ ভাব কন্ঠে।
“আরও বল৷ আগ্রহ বাড়ছে তার ব্যাপারে জানতে।”
মাথা নুয়িয়ে হাসে নাবিল। বলে, “সে একেবারেই বাকি মেয়েদের মতো না, জানিস? একদম আলাদা। গম্ভীর, বদমেজাজি, কথা কম বলা বেরসিক একটা মেয়ে। আমাকে খুশি করার জন্য কখনও কিছু করেনি। তবুও মেয়েটা সামনে এলেই দুনিয়া ঘুরে যায়। আমার যে কী হয়, নিজেই বুঝি না। কেমন পাগল পাগল লাগে বিশ্বাস কর। ঘুম,খাওয়া সব তুঙ্গে। ইদানীং খুব যন্ত্রনা করে মেয়েটা। তার প্রেমের তীরটা বড্ড ভারী ঠেকছে এইখানটায়।”
শেষের কথাটা বলে বুকে আঙ্গুল ঠেকালো নাবিল। ওকে তখন দেখতে লাগছিল বড় বড় ট্রাজেডি সিনেমার প্রেমিক পুরুষদের মতো।
“ভাই ,তোর অবস্থা তো পুরাই এম্বুলেন্স ডাকার মতো ইমারজেন্সি। ওয়া ওয়া বাচ্চার প্রেমে মজনু হয়ে গিয়েছিস দেখছি।”
হাসল নাবিল। বেঞ্চের পেছনে দুই হাত রেখে আকাশের পানে চেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে আবার। আফসোসের স্বরে বলে, “সেদিন বিয়েটা না ভাঙ্গলে জীবনটা অন্যরকম হতো। বউয়ের কোলে মাথা রেখে আদর খেতে পারতাম। বছর না ঘুরতেই একটা লাড্ডুর বাপ হতে পারতাম। জীবনটা একশোতে একশো হতো, বন্ধু।”
শাওন তড়াক করে হতচকিত হয়ে চাইলো। বিস্ময়ে চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কপালে লম্বা ভাজ ফেলে শুধালো, “নিরুপমা?”
জবাবে সম্মতি জানানোর ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে হাসল নাবিল। সে-ই হাসিতে আছে এক আকাশ সমান নবপ্রেমের আনন্দ।
—
ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে বাস ধরলো ওরা। আজ ইমু জানালার পাশে বসেছে। প্রতিদিন জানালার পাশে বসা নিয়ে ছোটখাটো তর্ক-বিরোধ হয় ওদের মধ্যে। নিরা প্রতিবারই হার মানে ওর কাছে।
” নিরা দেখ,শাওন ভাই আর নাবিল ভাই না ওগুলো?”
কনুই দিয়ে হাত ঠেলে কথাটা ফিসফিস করে বললো ইমু। নিরা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইলো বাসের গেইটের দিকে। এদিকেই আসছে ওরা। নিরাকে দেখেও যেনো দেখলো না নাবিল৷ বিপরীত দিকে দুই সিট পেছনে বসলো। পরপর কয়েকবার ফিরে ফিরে চাইলো নিরা। একটু কথা বলার আকাঙ্ক্ষায়। ইচ্ছে করেই তাকালো না ছেলেটা। কানে এয়ারপোড লাগিয়ে চোখে কালো সানগ্লাস পরে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে রইলো নির্লিপ্ত, নির্বিকার ভঙ্গিতে। রাগে, দুঃখে অসহ্য লাগছে নিরার। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সামনে গিয়ে চুল ছিড়ে দিতে। শয়তান লোক! ইচ্ছে করে ভাব নিচ্ছে।
পরের স্টেশনে থামলো বাস। প্রায় বেশিরভাগ যাত্রীই নেমে যাবে সেখানে। একে অপরের গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে নামছে লোকগুলো। নিরা যথাসম্ভব চেপে বসলো। দৃষ্টি একটু এদিক-ওদিক হতেই কারো বিশ্রী হাত নোংরা ভাবে ছুঁয়ে দিলো নিরার পিঠ। বিদ্যুৎতের গতিতে নড়েচড়ে উঠল নিরা। ভীরের মধ্যে কে কাজটা করলো ব্যাপারটা নিরার বুঝতে যতক্ষণ না লেগেছে তার চেয়ে ন্যানো সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে পেছনে থেকে কারো তীব্র ক্রোধমিশ্রিত ভারী গর্জন ভেসে আসে।
“এই শুয়োরের বাচ্চা, দাঁড়া তুই! বাস্টার্ড এক পা-ও বাড়াবি না আর।”
বাসে থাকা সকল যাত্রী একসঙ্গে চাইলো। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে উঠা গেলো না। রাগে নাবিলের চোখ রক্তিম রুপ ধারণ করেছে। আগন্তুক দৌড়ে পালাতে চাইলে নাবিল ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে কলার চেপে ধরল লোকটার। কিছু বুঝে উঠার আগেই লোহার মতো হাতটার পাঁচ আঙ্গুল বিকট শব্দ তুলে বসে গেলো লোকটার গালে। শাওন তাৎক্ষণিক পেছন থেকে ওকে আটকাতে চাইলে ঝাড়ি মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো নাবিল। ক্ষোভে শরীর থরথর করে কাঁপছে। পৃথিবীর কোনো শক্তিই যেনো আজ ওকে ঠেকাতে পারবে না আর। আশেপাশে সকলেই ততক্ষণে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ ড্রাইভার তাৎক্ষণিক বাস থামিয়ে দিয়েছে। নাবিল সজোরে কতোগুলো লাত্থি কষল লোকটার পায়ে। লোকটা গায়ের জোরে না পেরে উঠলেও মুখে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই তার চোখে-মুখে। যা নাবিলের রাগে কেরোসিন ঢালার মতো কাজ করলো। শুধু থাপ্পড় আর লাত্থিতেই ক্ষান্ত হয়নি ছেলেটা। সজোরে পরপর কয়েকটা ঘুষি মারলো নাক বরাবর।
“কুত্তারবাচ্চা, নাম গাড়ি থেকে! তোকে গাড়ির নিচে পিষে মারবো আজকে আই স্যয়ার।”
লোকটা ঠোঁটের রক্তটুকু মুছে তেড়েমেড়ে আসতে আসতে চেয়ে পাল্টা কলার চেপে ধরলো। খ্যাকঁ খ্যাঁক করতে করতে বললো, “কার গায়ে হাত দিসোস? চিনোস বাইঞ্চোদ তুই আমারে?”
নাবিল কপালে হাত ঘষে শীতল কন্ঠে ধমকালো। দুরূহ ব্যাপার এবার তাকে থামানো।
“দশ সেকেন্ডের মধ্যে নাম। নয়ত…
“নয়তো কী? কী করবি না নামলে? ওই কী করবি ক! কাহিনী মারাও শালা? কিছু বুঝিনা মনে করসো? মাইয়া মানুষ দেখলেই হিরো হইতে মনচায়? বালের হিরোগিরি আমার বাল নড়াইতে পারবে না শাউয়ার ব্যাটা। আমি এইখানেই খারাই রইলাম। দেখি কোন চুদির ভাই আমারে উঠায়। দেখি তোর কতো ক্ষমতা।”
নাবিল শার্টের কলার ধরে টান মারলো। ঠান্ডা কন্ঠে জপলো, ” স্বসম্মানে নামবি না তাহলে?”
শেষ হুঁশিয়ারিটা দিয়ে চুপচাপ প্যান্ট থেকে ব্যাল্টটা বের করলো নাবিল। হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ভাজ করতে করতে অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলো। দৃষ্টি বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ আর অত্যধিক প্রখর। ওকে দেখতে এই মুহূর্তে লাগছে আসমান থেকে নেমে আসা কোনো ভয়ংকর যমদূতের মতো। বাসে এ পর্যায়ে পিনপতন নিরবতা। লোকটা ওর পা আগানোর ভঙ্গি দেখে অজানা আশঙ্কায় ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিললো। তবে বজায় রইলো মুখের সে-ই অবাধ্য স্বর।
“তুই চিনোস আমারে? তোর ধারণা আছে আমি কে? বিদ্রোহ করো শালা? একদম ভেতরে ভরে দেবো প্রতিবাদ। এমন দশটা মেয়ের ইজ্জত খাইয়া দিলেও আমি সুমইন্নার বাল ছিঁড়ার সাহস নাই কোনো বালের।”
নাবিল ভেতরের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াটাকে দাবিয়ে কেবল নিঃশব্দে হাসল। লোকটার দূর্ভাগ্য আছে বলা যায়। নিজের কলিজার পুরোটা জুড়ে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে এমন কুৎসিত মন্তব্য শুনে ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে নাবিলের। চোখদুটো ঘৃণা আর ক্রোধে সাংঘাতিক দেখালো। তীব্র ক্ষোভের সংমিশ্রণে এতো হিংস্র মনে হলো সে-ই দুর্বোধ্য হাসি। কে বাঁচাবে আজ ওর হাত থেকে লোকটাকে? কার এতো সাহস হবে?
“কী বলছিস ভাই? তোর বাল ছিঁড়তে যাবো কেন? এতো কুরুচি কি আর আছে বল? এসব করবো না। তবে আদর জমা হয়েছে অনেক, সে-সব না দিয়ে যেতে দেই কি করে?”
বলেই লোকটার শার্টের কলার ধরে টেনে দরজার সামনে এনে ঘাড় ধরে সজোরে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেললো। মুখ থুবড়ে পড়লো লোকটা। নাকের ফিনকি বেয়ে তড়তড় করে রক্ত পড়ছে। হাতের পিঠ দিয়ে রক্তটুকু মুছে উগ্র চোখে ঘাড় বাঁকিয়ে আবারও মুখ চালালো বিশ্রি গালিতে। ইতোমধ্যে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। নাবিল পূনরায় শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুষি মারল মুখে। মাটিতে ফেলে হাতের বেল্টটা দিয়ে অনবরত বেধড়কভাবে পেটালো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেও আর পাল্টা হামলা করার সুযোগটুকু হলো না। নাবিলের শক্তির সাথে কেউ পেরে উঠছে না এই মুহূর্তে। আশপাশ থেকে কেউ কেউ এক কদম এগিয়ে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে ভয়ে। ওরা কেবল নিরব দর্শক হয়ে দেখলো সবটা। বাস থেকে বাকি যাত্রীরা নেমে ইতোমধ্যে ঘটনা প্রচার করে দিয়েছে। ড্রাইভার ধরতে এসে ওর হাতের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেলো। কিসের দৈব বলে ছেলেটার এমন উদভ্রান্ত রুপ? প্রায় দশ মিনিট যাবত বিরতিহীন পিটিয়েও ক্ষান্ত হলো না সে। মাথায় রক্ত চড়ে বসেছে। উন্মাদের মতো নিজের চুল টেনে ধরলো। বেল্ট ফেলে দাঁতে দাঁত পিষে ফোঁসে শ্বাস ফেলতে ফেলতে কোথা থেকে রড তুলে আনলো। লোকটা এবার ভয়ে দুই হাত দিয়ে আকস্মিক ওর পা পেঁচিয়ে ধরলো। প্রাণবিক্ষা চাইলো। শরীর জখম হয়েছে অনেকখানি। হাত-পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। এবার রড দিয়ে পেটালে বাঁচার আর উপায় নেই।
“কুত্তার বাচ্চা! তোর শরীরের সব উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটাবো আজ। তুই আমার বুকের কোন জায়গায় ছুঁইলি তোর ধারণা নাই। আমার হাতে পড়েছিস, নসিব খারাপ তোর। আজ আর জীবিত ফিরতে পারবি না বাস্টার্ড! জিন্দা কবর দিবো তোকে আমি।”
নিরা এতোক্ষণ ধরে রোবটের মতো অনড় দাঁড়িয়ে দেখলো শুধু। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ইমু এসে পেছন থেকে ওকে ধরলো। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না আর। পৃথিবীর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেনো নিভৃতে বিধাতা আজই স্বচক্ষে দেখিয়ে দিলেন ওকে। আয়নার মতো স্বচ্ছ সবটা আজ। গলা ভেঙ্গে এলো ওর। নাক টেনে বিরবির করে বললো,
“ইমু, নাবিল ভাইকে থামা। উনার কষ্ট হচ্ছে। উনার হাতে রক্ত। উনাকে থামতে বল ইমু।”
“শাওন ভাইয়া, আপনি কিছু বলছেন না কেন? থামান আপনার বন্ধুকে।”
বলতে বলতে বসে পড়ল নিরা। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। ততক্ষণে স্থানীয় থানা থেকে বেশ কিছু পুলিশ এসে জড়ো হয়েছে।লোকটাকে নাবিলের হাত থেকে ছাড়াতে বেশ বেগ পোহাতে হলো ওদের। তাৎক্ষণিক ভুক্তভোগীর সাক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে লোকটাকে এরেস্ট করা হলো। ঘটনার বেশ কিছুক্ষণ পর ভীর কমলো।
নাবিল ধীরপায়ে সম্মুখে দাঁড়ালো। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বললো,” বাড়িতে চল।”
নিরা তাৎক্ষণিক ওর ডানহাতটা চেপে ধরলো। চোখ বেয়ে তখনও আষাঢ়ের বৃষ্টি নামছে৷ নিষ্প্রাণ কন্ঠে শুধায়, “তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো কেন আমায়?”
অপ্রত্যাশিত স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন শুনে বিভ্রান্ত হয় নাবিল। তবে সে-ই বাক্যটা ঠেলে মনোযোগ কাড়ল একটা সুতীব্র অনুভুতি। বিদ্যুতের ঝটকা খাওয়ার মতো সাড়া শরীর নড়েচড়ে উঠল। এতোক্ষণের পুষে রাখা দাবানলের হিংস্রতা কোথায়, কোন দেশেতে হারালো,কে জানে। জলন্ত অগ্নিশিখায় হিমশীতল বরফের মতো কাজ করলো নিরার স্পর্শ। হাত বেয়ে তখনও ঝরনার মতো চুয়িয়ে চুয়িয়ে রক্ত ঝরছে নাবিলের। অথচ সেদিকে এক আনারও ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটার। সে কেবল নিরলস, নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো নিজের হাতের বাঁধনে আঁটকে থাকা রেশম তুলোর হাতটি। বিভ্রম আর বিস্ময়ভাব কাটছে না কিছুতেই। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার। নাবিলের উথাল-পাতাল পৃথিবীর সকল যন্ত্রণা নিভে গেলো এক নিমিষেই,এক ছোঁয়ায়। নিরা একপলক ওর মাদকীয় দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে রক্তে রক্তিম হওয়া হাতটা ছোঁয়াল নিজের গালে। ঠোঁট ভেঙ্গে আওড়াল, ‘তুমি খুব খারাপ, নাবিল ভাই! খুব খারাপ তুমি!’
আহত কন্ঠে কেবল একটা বাক্যই জপলো নাবিল, “আমার শ্বাসরোধ হচ্ছে, নিরা৷ তোর ছোঁয়া মারাত্মক পিড়া দিচ্ছে। হাতটা ছাড় লক্ষিটী!”
নিরা হাত ছেড়ে বাহুতে ধরলো। পুরুষালী বাহুটা টানতে টানতে চড়ে বসলো রিকশায়। পুরোটা সময় নাবিল কেবল মোহগ্রস্তের বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো ওর পানে। হাসপাতালে থেকে বেড়িয়ে আবারও বাস ধরলো। বাসে থাকাকালীন পুরোটা সময় নিরা ওর কাঁধে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদেছে। যে চোখের পানিতে মেয়েটার মন জানা যাচ্ছে। সে একটু পরপর ব্যান্ডেজ করা হাতটার উপর নরম করে হাত ছোঁয়াচ্ছিল। ওর অবস্থা দেখে নাবিল নিঃশব্দে হাসল কেবল। নিরা ঠোঁট উল্টে কেমন অধিকার রটিয়ে বলল, “ফুপ্পিকে বলবে আব্বুকে বলে আমাকে ক’দিনের জন্য তোমাদের বাসায় বেড়াতে দিতে।”
“কেন?”
নিরা চোখ রাখলো ওর চোখে। পূনরায় চোখ নামিয়ে বলে, “আমার আজকাল ঘুম হয় না রাতে। খুব ছটফট করি৷”
নাবিল কথার মর্মকথা বুঝলো কি-না, কে জানে। হাসল কেবল। বিপরীত দিকের বাতাসের ঝটকায় ওর সামনের চুলগুলো বারংবার আছড়ে পড়ছে মুখের উপর। নাবিল কানের কাছে চুলগুলো গুঁজে দিয়ে ঝুঁকে বলল,”আমার বাসায় গেলে হবে ঘুম?”
নিরা রাগলো না আজ। ব্যান্ডেজ করা হাতটায় হাত বুলালো পরম আবেশে। “ফুপ্পি একা আর কতো দিক সামলাবে?”
বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কথাটা বলে আবার আড়চোখে চাইলো নিরা। একজোড়া চোখ আগে থেকেই ওর দিকে চেয়েছিল বলে মুহূর্তেই দৃষ্টি ধাক্কা খায় দু’জনের। যে ধাক্কায় পৃথিবীর সকল দুর্যোগ উবে যায়। ঝমাঝম বৃষ্টি নামে মনের আনাচে-কানাচে। আলোর ঝলকানি লাগে বুকে। নির্মল হয় প্রাণ।
“এতোকাল তো একাই সামলালো।”
“এখন বয়স হয়েছে না?”
মাথা ঝাঁকায় নাবিল। “হুম…. ভারী চিন্তার বিষয়। তো এখন কি করা যায় বল তো?”
নিরা অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলো। নাবিল কানের কাছে মুখ নেয়। ফিসফিস করে শুধায়,
“আচ্ছা, তুই কোনোভাবে শুধুমাত্র আমার দিকটা সামলানোর জন্য যেতে চাচ্ছিস না তো? ভেতরে কী চলছে বল তো?”
নিরা দুম করে থাপ্পড় মারল হাতে। বেচারা ব্যান্ডেজে ব্যথা পেয়েও টু শব্দটি করলো না। হাসল কেবল। ইঙ্গিত পেলো নতুন কিছুর। ঘাড় ফিরিয়ে ঠোঁটের মধুর হাসিটুকু ঢাকল। শিষ বাজালো ফুরফুরে মনে। আরচোখে আরেকপলক চেয়ে গভীর শ্বাস ছেড়ে প্রেম প্রেম কন্ঠে গাইলো,
“তোমার মনের উঠান লেপে দেবো
সাজিয়ে দেবো ফুলে..
তুমি এসো,তবু এসো ভালোবেসে…”
চলবে