গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ১৯
#নাজমুন_নাহার
নাবিলের অলস বারান্দার চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলো অযত্নে প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। পরম অবহেলায় মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঝরে পড়ে আছে গোলাপি, বেগুনি রঙের পাপড়িগুলো।আজকের দিনটা গুমোট। রোদ নেই, নেই বাতাসের ফিসফাস। শহরের কোলাহলের মধ্যেও আছে কিছু একটার নিরবতা। আকাশে ধূসর মেঘ করেছে, তবে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই তেমন। কাব্যিক ঢঙ্গে যেনো মন খারাপের দিন আজ প্রকৃতি ও মানবমনে একত্রে বাসা বেঁধেছে।
ঘুমের ঘোরেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো, এক ফোঁটা তরল উষ্ণ, বিষন্ন পানীয় স্পর্শ করলো নাবিলের শুভ্র ললাট। ঘুম ভাঙ্গে তারই ছোঁয়ায়। শরীরে ঠান্ডা কিছুর ছোঁয়া অনুভব হতেই পিটপিট করে চোখ মেলে চায় সে। বরাবরের মতোই শিউরে মা বসে আছেন৷ পুরাতন দৃশ্য। প্রায়শই জেগে পাশে মা’কে বসে থাকতে দেখে ছেলে। নাবিল তাকাতেই তিনি যত্রতত্র ঘাড় ফিরিয়ে নির্জনে অশ্রু মুছে নিলেন শাড়ীর আঁচলে। আবার ছেলের পানে চেয়ে পৃথিবীর তামান কৃত্রিমতা লেপ্টালেন চেহারায়। হাসলেন ম্যাকি। ছেলের মাথায়, কপালে, গালে হাত বুলালেন পরম আবেশে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন, “উঠে পড়ো, আব্বাজান। বেলা পড়েছে তো। কী খাবে নাশতায় আজ?”
নাবিল হাসল মৃদু। মা প্রতিদিনই এমন আদর করে ডাকে ওকে। জলজ্যান্ত যুবক ছেলেটা তার কাছে যেনো এখনও শৈশবের ছোট্ট শিশুটি। কন্ঠে সবসময় স্নেহ থাকে এই চমৎকার রমণীটির। নাবিল প্রায়ই বেশ মন দিয়ে মা’কে পর্যবেক্ষণ করে। মা’র কাজের সময় আগেপিছে ঘুরে বিরক্ত করে। কিন্তু এই অমায়িক মানবী বিরক্ত হলে তো! ছেলের পাগলামি দেখে হাসে মা। বরং এসবই প্রাণ বাঁচায় তার। মায়ের এহেম প্রতিক্রিয়ায় নাবিল প্রতিদিনই মুগ্ধ হয়। ভাবে, তার মতো এমন ভবঘুরে স্বভাবের ছেলে কি করে এমন মহীয়সী একজন মহিলাকে মা হিসেবে পেলো,সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় মা দেওয়ার ক্ষেত্রে নাবিলের প্রতি একটু বেশিই সদয় হয়েছেন।
ভাবনা কাটিয়ে আড়মোড়া ভেঙে হামি দিতে দিতে আরেকটু চোখ বুজলো নাবিল। ঠোঁট মিলিয়ে হেসে মায়ের হাতটা টেনে চুমু খেলো একটা। উঠে কোমল করে চোখ রাখল মায়ের চোখে। ছেলের সম্মুখে নিজেকে লুকানোর আপ্রাণ ব্যর্থ প্রচেষ্টা রাহেলার। সফল হলেন না বোধহয়। নাবিল দৃষ্টি অনড় রেখে পর্যবেক্ষণ করে মা’কে।জননীর ভারাক্রান্ত ভেজা ভেজা চোখ দু’টোয় কীসের যেনো আক্ষেপ! কিছু একটার হাহাকার। মায়ের এহেম চাহুনি নাবিলের বুক কাঁপায়। প্রাণ দূর্বল হয়। সে মায়ের পানে চায় সন্দিহান হয়ে। শুধায়, “সত্যি করে বলো তো আম্মু, ঝগড়া হয়েছে আব্বুর সাথে? হুয়াই আর ইউ স্যাড, বাচ্চা? তোমার ছেলেকে বলো। এতো বড় স্পর্ধা ইশতিয়াক এহসানের ছেলের! আমার মা’কে কাঁদায়! নাবিল বকে দিবে তাকে।”
চুপ রইলেন তিনি। জবাব না পেয়ে নাবিল উঠে বসে মায়ের সম্মুখে। এলোমেলো চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে বলে, “আম্মুউউউউউ! এই নানুর লক্ষী মেয়ে! মাই সুইটহার্ট, কাঁদছো কেন বাবা? আমি তো সুস্থ আছি এখন। এইটা ছাড়া তো আর কোনো কারণে তুমি কাঁদো না। কী হয়েছে? আমার টেনশন হচ্ছে তো। বলো? শরীর খারাপ?”
বলেই কপালে হাত ছোঁয়াল মায়ের। রাহেলা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন চুপচাপ। কাঙ্ক্ষিত জবাব না পাওয়া অব্ধি নাছোড়বান্দা হয়ে মুখ চালাবে ইচ্ছে মতো, সে-ও জানা।
“টেম্পারেচার তো স্বাভাবিক-ই। তাহলে কোথায় কষ্ট হচ্ছে? মাথা ব্যথা? প্রেশার বেড়েছে? মুড সুইং হচ্ছে? বাবা-র মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে? নাকি আমাকে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে? মারো। এইযে গাল পেতে দিলাম। তা-ও চুপ থেকো না। তোমার চুপ থাকাকে আমায় ভয় হয়।”
এবার না চাইতেও হেসে দিলেন তিনি। রেলগাড়ীর মত কথার গতি থামে না ছেলের। নাবিল ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। রাহেলা আবার হাসলেন। পরক্ষণেই ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। নাবিল মায়ের মনের অস্থিরতা টের পায়। মা’র শরীর কাঁপছে। সে মা’য়ের মাথায় হাত রাখলো। চুলে হাত বুলায়।
“ডোন্ট বি স্যাড। আজ তো আবার প্রাণের ভাইয়ের বাড়িতে যাচ্ছ। খাদিজা আন্টিও আসবে। ভাই-বোনদের একসাথে পেলে দেখবে আর খারাপ লাগছে না।”
তিনি চমকে তাকান ছেলের পানে। অস্থির হয়ে শুধায়,” ভাইজানের বাড়িতে যাব, সেটা তোকে কে বলল?”
নাবিল মুচকি হাসল। চোখ টিপে বলল,” সিক্রেট সোর্স। বলা যাবে না।”
“কেন যাওয়ার কথা, সেটা জানিস?”
নাবিল দায়সারা ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। ছেলের উৎফুল্ল মুখে চেয়ে আন্দাজ করলেন কিছু একটা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পরক্ষণেই। মাথা নুয়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, “আমরা যাচ্ছি না আজ কোথাও।”
মুহুর্তেই উল্লাসিত মুখটা ফেঁকাসে হয়ে আসে নাবিলের। জিজ্ঞেস করে, “কেন যাব না? ধুর! এতো প্যানিক করো না তো৷ উঠো। একটু পরেই বের হচ্ছি আমরা৷”
ধমকে উঠলেন রাহেলা, “নাবিল জোরাজোরি করবে না একদম। আমরা যাচ্ছি না, মানে যাচ্ছি না। আর তুইও যাচ্ছিস না।”
নাবিল নাছোড়বান্দার মতো ঠোঁট উল্টে বায়না ধরে ফের, “প্লিজ আম্মু! আগামীকাল তোমাকে বাইকে একটা রাইড দিবো। যেখানে বলবে, ঘুরতে নিয়ে যাবো। উঠো। নো বন্ধুবান্ধব, নট নাবিল। কালকের সারাটাদিন শুধু তোমার নামে উৎসর্গ করবো, প্রমিস। উঠো, রেডি হও। আমরা একটু পরেই বের হবো।”
কিছুক্ষণ হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ছেলের শিশুসুলভ মুখের পানে। ছেলেটার দিকে তাকালে মনটা অচিরেই কেমন করে একটা ভেঙ্গে আসে। কান্নারা গলায় দলাপাকিয়ে জমাটবদ্ধ হয়। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় তার। ছেলের কৌতুহলের আস্কারায় অকস্মাৎ রাহেলা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় নাবিল ভড়কায়। সে সঙ্গে সঙ্গে মা’কে বুকে জড়িয়ে নেয়। জননীর চোখের পানিতে সফেদ টি-শার্ট ভিজে একাকার। নাবিলের পৃথিবী থমকে যায়। অজানা আশঙ্কায় ঝড় বয় বুকে। মাথায় হাত বুলায় মা’য়ের। চোখ দু’টো বুজে ভারী শ্বাস ফেলে কিছু বলবে তার আগেই রাহেলা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “আমাকে ক্ষমা কর, বাবা। মা’কে ক্ষমা করিস। জীবনে এই প্রথম তুই এতো আক্ষেপ করে আমার কাছে কিছু চেয়েছিস, অথচ আমার সেটা দেওয়ার সাধ্য নেই। তোর স্বপ্ন চোখের সামনে ভেঙ্গে যেতে আমি দেখতে পারছি না। আমার তুই ছাড়া কেউ না-ই। আমার ছেলেকে আমি এভাবে ভেঙ্গে যেতে দেখতে পারবো না। তোর চোখের পানি, মনের ভাঙ্গন সহ্য করা আমার জন্য পরম বেদনার! আমি কীভাবে শোনাবো তোকে এসব!”
নাবিল বুকের উন্মাদনায় ঠিকঠাক কথাই বলতে পারছে না। আশঙ্কাও করতে পারছে না ঘটনা। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মা’কে নির্জনে কাঁদতে দেয় বুকে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয় পরক্ষণেই। সে শূন্যে চেয়ে বিভ্রম হয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে শুধায়, “আম্মু, আমরা মামার বাসায় কেন যাবো না? তোমার চোখ ভেজানোর কারণ কি তবে এটাই?”
মায়ের চুপ থাকাকেই সম্মতি জেনে নিলো ছেলে৷ নাবিল উপন্যাসের সারসংক্ষেপ বুঝে হাসল মলিন করে। আনমনেই বিরবির করে জানতে চাইলো, “আমার স্বপ্ন? তুমি নিরাকে মিন করেছো, তাই না?”
“তুই বললে আমি এখোনও হাতে-পায়ে ধরবো ভাইজানের। আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হলে হবে। আমার কাছে আমার ছেলের চেয়ে দামী আর কিছু নেই।”
নাবিল মা’য়ের চোখ মুছিয়ে দেয় হেসে। লম্বা শ্বাস টেনে উদত্য হয় জীবনের পরম কঠিন, বিষাক্ত সত্যগুলো শুনতে।
—-
কপালের টিপটা পরে নিরা দর্পণে নিজের মায়াময়ী মুখটা চাইলো পরম লাজুক হাসি নিয়ে। পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়ায় হাল্কা করে গোলাপী লিপস্টিক লাগিয়েছে সে। হাসল স্মিত। আয়নায় চোখাচোখি হলো বোনের সাথে। মিরার চোখে-মুখে আনন্দ যেনো উপচে পড়ছে। চোখ টলমল করছে আবেগে। সে বরাবরই আবেগী মেয়ে। আজ আদরের ছোটবোনের স্বপ্ন পূরনের দিনে আবেগটুকু বেড়ে যেনো শতভাগে দাড়িয়েছে। নিজের কাজল পরা চোখ থেকে একটুখানি আঙ্গুলে মুছে তা নিরার কানের পেছনভাগে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে, ” আমার নিরাপাখি, ছোট্ট নিরাপাখি! তোকে মধু লাগছে বোনু। পৃথিবীর সমস্ত কুনজর থেকে আবার নিরুর রক্ষা হোক।”
নিরা বোনের পানে চেয়ে হাসে। পৃথিবীর যাবতীয় কুসংস্কার মেনে বাঙালী নির্দিধায় কতো কতো মায়াময় দোয়া করে যায়, সেসবের ইয়ত্তা নেই।
নিরা পরক্ষণেই ম্যাকি বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলে, “আমার সারপ্রাইজ কোথায়? তুই বলেছিস শাড়ী পরার পরেই সারপ্রাইজ দিচ্ছিস। কোথায়? কী সারপ্রাইজ? তাড়াতাড়ি দে, আপু। এক্সাইমেন্টে বুক ধুকপুক করছে।”
মিরা হেসে বোনের গালের সঙ্গে গাল ঘেঁষে। আয়নার মুখোমুখি চেয়ে মুচকি হেসে বলে, “দাঁড়া দাঁড়া। অপেক্ষা কর আর কিছুক্ষণ। সারপ্রাইজ জ্যামে আঁটকে পড়েছে বোধহয়। সারপ্রাইজের জন্য মেয়ের ধৈর্য্য ফুরিয়ে যাচ্ছে দেখি।”
“তো ফুরবে না?এই আপু, সত্যি করে বল তো? তুই প্রাঙ্ক করছিস না তো? আমার কিন্তু ভাই সন্দেহ হচ্ছে। আই ডোন্ট বিলিভ ইউ। তোকে বিশ্বাস করা পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম গর্ধভাত্ব।”
শব্দ করে হেসে ফেলল মিরা। পরক্ষণেই কপাল চাপড়ে শ্বাস ফেলল মাথা দুলিয়ে। নিরা চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। মিরা ওর তাকানোর ধরন বুঝে বলল, “সারপ্রাইজটা পাওয়ার পর খুশিতে ঠিক কী করবি, সেটাই ভাবছি। লাফ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে এসে আবার চ্যাপ্টা করে দিস না যেনো। সবে বিয়ে হয়েছে আমার। তোর খালা হওয়াও বাকি।”
নিরা লাফিয়ে উঠে চোখ বড় বড় করে মিরার দুই বাহু নাড়িয়ে শুধায়, “আপু, তুই প্রেগন্যান্ট? ও মাই গড! আমি এটাই ধারণা করেছিলাম, বিশ্বাস কর। কবে? মানে কখন কনফার্ম হলি? আপু! আপু! আপু! ইজ দ্যট ট্রু। ইয়ারররর! আমি বোঝাতে পারবো না আমি ঠিক কতখানি হ্যাপি তোকে নিয়ে৷ আমার লাফিয়ে লাফিয়ে সেলিব্রেশন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। চিৎকার করে উল্লাস করতে মন চাচ্ছে। জাস্ট ইমাজিন? তুই আম্মু হবি! আমি খালামনি হবো! আম্মু নানু হবে! ভাবলেই আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুশিতেএএএএ! আয়ায়ায়ায়ায়ায়া! আমি সত্যি সারপ্রাইজড!”
ঘরময় লাফাতে লাফাতে কথাগুলো বলল নিরা৷ খুশিতে কী করবে, কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। শাড়ী পরেই নানান অঙ্গভঙ্গি করে আবেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে সে।
মিরা হতভম্ব হয় ওর চিন্তাশক্তির দৌড় দেখে। বাকশক্তি হারিয়ে কেবল রোবটের মতো চেয়ে বোনের অবান্তর উত্তেজনা দেখলো৷ হতাশায় মুখ হা হয়ে এলো। এদের কি বাচ্চা ছাড়া আর কোনো আন্দাজশক্তি নেই?
“কিরে? স্টাচু হয়ে গেলি কেন?”
মিরা প্রতুত্তর না করে চুপচাপ খাটের এককোণে গিয়ে বসলো। নিরা ওর পিছুপিছু বসে কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে নিজের মতোই বকবক করে যাচ্ছে, “উহহু! নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড! তোর প্রেগন্যান্সির খবরটা ঘটা করে জানানোর জন্যই ফুপ্পিদেরকে দাওয়াত করেছে, আম্মু? এতোক্ষণে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেলো। দেখেছিস, আমি কত জিনিয়াস? তোর বলতেও হয়নি। ঠিকি এক মিনিটের মধ্যে তদন্ত চালিয়ে সব বের করে ফেলেছি।”
বেশ গর্বের সঙ্গে কথাটা বলল নিরা। মিরা অসহায় মুখ করে চাইলো বোনের পানে। মেয়েটা তখনও ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে মাথা দুলিয়ে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করেই যাচ্ছে। কোথাকার পানি কোন সীমানায় গড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। মিরা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল, “আমার ঘরের মধ্যেই আইন্সটাইনের দু, দুটো মস্তিষ্ক লুকায়িত ছিল, এমন বিস্ময়কর গুনের সন্ধান কেন আজই পেলাম? সেদিন আম্মুকেও একই ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখি, জননীও আমাকে প্রেগন্যান্ট ভেবে নানু হওয়ার উত্তেজনায় ফেটে পড়ছেন। আর আজকে তুইও,…..
নিরা তুই লাইফে আর যা-ই কর, ওকালতি, গবেষণা, আর গোয়েন্দারাগিরীর মতো প্রফেশনগুলো চুজ করিস না। তোর হিরন্ময় দক্ষতার জোরে আমাদের গরীব দেশটার অনেক বড় লস হয়ে যাবে, বোন আমার। দেশটাকে রেহাই দিস।”
নিরা অসন্তোষ কন্ঠে শুধায়,”ল্যাহ্! প্রেডিকশন ভুল?”
মিরা মাথা উপরনিচ করে ঠোঁট টিপে হাসল। নিরা মুখটা গোমড়া করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। চুপসে যায় মুখটা। ঠোঁট উল্টে বলে, “তার মানে আমি খালামনি হচ্ছি না? ধুর! তাহলে আর কিসের ছাতার মাথার সারপ্রাইজ দিবি তুই আমাকে? যা সর এখান থেকে।”
বলেই রাগ দেখিয়ে শাড়ী খোলার জন্য উদ্যত হতেই মিরা হাত টেনে ধরে ওর। সামনে বসিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আজকের দিনটা তোর জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন হতে যাচ্ছে। তোর স্বপ্ন পূরনের এক ধাপ হতে যাচ্ছে, বোনু। শাড়ীটা খুলিস না। সারপ্রাইজ ইজ লোডিং।”
নিরা বোনের পানে চায় ভ্রু কুঁচকে। সৃষ্টি প্রশ্নসূচক। মিরা আর কোনো ভনিতা করলো না। স্নেহময় হেসে বলল, “ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন থাকার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আজ তোদের আংটিবদল। ফুপাতো ভাইয়ের বউ হওয়ার জন্য রেডি তো, নির্ঝরা নিরা?”
“মানে!”
নিরার চোখে বিস্ময়। মিরা হাসল ঠোঁট টিপে। দুই হাত ধরে দাঁড় করিয়ে ওকে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, “আই এম সো হ্যাপি ফর ইউ, নিরু। তোকে সুখী দেখা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ভেবেছিলাম, কিছুটা বেগ পোহাতে হবে বাসার লোকদের রাজী করাতে। কিন্তু আম্মু আর ফুপ্পি মিলে ব্যাপারটাকে ইজি করে দিয়েছে। এন্ড ফাইনালি, তোর ভালোবাসাও পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। ইট’স হ্যাপেনিং ডার্লিং!”
নিরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বাকরুদ্ধ হয়ে। কী বলা উচিত, বুঝলো না। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে মিরা তক্ষুণি ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে, ” নিজের রক্তকে ধন্যবাদ দিতে হয় না। আজ যা করেছি, সেটা তোর পাওনা। তুই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোন,নিরু । বয়সে আমি বড় হলেও, তুই গুরুজনদের মতো সবসময় আমার খেয়াল রেখেছিস, বিপদে সঙ্গ দিয়েছিস, ছোট ছোট অপরাধগুলোতে আমার হয়ে বাবা-র কাছে সাফাই গেয়েছিস। তুই না থাকলে আমার শৈশবটা বোধহয় এতোটাও মধুর হতো না। তুই নিজেও জানিস না তুই আমার জন্য কী! মনে করিস, আজকের দিনটা তারই প্রতিদান। আফসোস, তোকে জানতে আমার অনেকটা সময় লেগেছে। তোর চুপচাপ চরিত্রের আড়ালে যে এতো গভীর অনুভুতি লুকিয়ে রেখেছিস, বুঝতে পারিনি। এতো বছর পর এসে জানলাম, আমার ইন্ট্রোভার্ট বোনটাও কাউকে চায়, কাউকে ভালোবাসে। তাকে নিয়ে কল্পনা করে, স্বপ্ন বুনে। এটা জানার পরেও তোকে হেল্প না করার ভুলটা কি করে করি, বল তো?”
নিরা মোহগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো শুধু। মিরা হাসে। এবারও কিছুই বলাকওয়ার সুযোগ দিলো না মেয়েটাকে। নাক টেনে দিয়ে বলে, “যাই এখন? আমার অনেক কাজ আছে, বাবু। আপ্যায়ন করতে হবে না বোনের হবু শশুড় বাড়ির লোকদের? তুই এখানেই চুপটি করে বসে থাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে ফুপ্পিরা। আপু এসে নিয়ে যাবো তোকে।”
নিরার মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগছে। কী বলে গেলো মিরাপু? ভালোবাসার মানুষ! নাবিল ভাইয়ের ব্যাপারে ও কীভাবে জানলো? আজ আংটিবদল মানে! পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি মেয়েটা? বাবা ঠেঙ্গানোর বদলে ধৈধৈ করে পারিবারিকভাবে আংটিবদলের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে ফেলেছে? বিস্ময়কর ব্যাপার! মেনে নিলেন কী করে এতো সহজে? তাছাড়া কবেই-বা হলো এসব? বৃত্তের মতো চক্কর খাচ্ছে মাথাটা। চিন্তায় পড়ে গেলো মেয়েটা। তখনই মস্তিষ্কের দুয়ার খুলে উন্মুক্ত হলো গতকালকের দু,একটা বাক্য। নাবিলের বলা।, “আরেকবার বরযাত্রী নিয়ে আসলে কেমন হয়? পরব শেরওয়ানি কালকে?”
শিটটটটটট! এতোক্ষণে পুরো ঘটনা পানির মতো পরিষ্কার নিরার কাছে। তার মানে! সবকিছু আগে থেকেই সকলের জানা! আর এসবের মাস্টারমাইন্ড স্বয়ং নাবিল ভাই?
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে এলো নিরার। নাবিল ভাই তবে এটারই কিছুটা হিন্টস দিয়েছে গতকাল? আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই সকলে মুখে কুলুপ এঁটে নাটক করছিল এতোদিন? মাই গড!
জড়বস্তুর মতো বিভ্রম হয়ে এসবই ভাবল আধাঘন্টা যাবত। এরা কতো নিখুঁতভাবে ঘোল খাওয়ালো নিরাকে।
নিরা আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে আনমনে হাসল কিছুক্ষণ নিজে নিজেই। কপালের টিপটা সোজা করলো। যন্ত করে চোখে কাজল পরলো আবার। শাড়ীর আঁচল মাথায় তুলে বউ বউ সেজে রসিয়ে রসিয়ে কাকে যেনো শাঁসালো, “তোমার খবর আছে, নাবিল ভাই। আসো আজকে? করাচ্ছি বিয়ে। পরাচ্ছি শেরওয়ানি!”
পরক্ষণেই আবার শব্দ করে হাসল সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুই হাত দিয়ে লাজুকলতা মুখটা ঢাকল কাজল চোখের মেয়েটি। পৃথিবীর সমস্ত লাজুকতা বিধাতা আজ নিজ হস্তে ঢেলে দিয়েছেন একটা সবুজ পাতার মতো কোমল শরীরের রমণীর মনে। নিরা দর্পণে নিজের দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়ে পরম আনন্দের সহিত গাইলো,
“আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন
খুঁজি তারে আমি আপনায়……..!”
চলবে।