গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২১
#নাজমুন_নাহার
নিশির মধ্যম প্রহর।
চারিদিকে শুনশান নীরবতা। কয়েকটা নেড়ি কুকুরের ঘেউঘেউ ছাড়া আশপাশ থেকে তেমন আর কোনো সাড়াশব্দ আসছে না আপাতত। পুরো এহসান মঞ্জিলেই নিস্তব্ধতা বিরাজমান। নিরার জ্ঞান ফেরায় কেবল মাত্রই ঘুমাতে গেলো সকলে।
নিরা ক্লান্ত শ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে আকাশের পানে চাইলো। আজ পূর্ণিমা। সারাদিন আকাশটা মেঘলা থাকলেও রাতে চাঁদ তার আপন সৌন্দর্য প্রদর্শন করার অভিলাষে মেঘেদের বিদায় জানিয়ে আকাশ দখল করে নিয়েছে। শুভ্র-সূদুর আকাশের ঝলসানো চাঁদকন্যাটা আজ যেনো নিজের সমস্ত রূপ-যৌবন উন্মুক্ত করে বিস্তীর্ণ চরাচরে ভেসে উঠেছে। রূপবতী নববধূর ন্যায় জ্বলজ্বল করছে তার দুধসাদা মুখ। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার কারণে বাইরে কৃত্রিম আলো নেই তেমন। যার দরুণ চাঁদের অকৃত্রিম রশ্মিটা আলোকীত করে রেখেছে পুরোটা শহর। তবুও সে আলোয় নিরা আজ কোনো উজ্জ্বলতা দেখতে পায় না। না আকর্ষণ করছে তার সৌন্দর্য। এ যেনো চির বেদনার পূর্নিমা! তার ম্লান হৃদয়ের হাহাকার কমাতে পারছে না এই অম্লান চাঁদটা। তবে রুপসী আর উজ্জ্বল হয়ে কী ফায়দা তার? কিসের এতো অহংকার?
রক্তচাপ কমার দরুণ নিরার দূর্বল দেহটা হয়ে উঠেছে আরও দূর্বল। মানসিক দোটানায় ঘুম নেই মেয়েটার চোখে। চোখ দু’টোও হয়ে আছে সাদামাটা, মলিন। হাতে ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইন যাচ্ছে শরীরে। দূর্বল চিত্তে চোখ বুজে নাক টানলো সে। আড়াল করলো ফুরিয়ে আসা অশ্রুটুকু। নিলয় টিস্যু দিলো হাত বাড়িয়ে। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
“অনেক হলো, থাম। কান্না বন্ধ কর।”
নিরা ফের ঠোঁট উল্টায়। কন্ঠ ভেঙে বলে, “আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছে, ভাইয়া। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়তে হয়নি। ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে গর্তে লুকিয়ে যাই। নাবিল ভাই আমাকে নিয়ে কী কী ভাবলো, কে জানে। উনার বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। আমি উনার মন ভেঙ্গেছি। এসব দেখার প্রত্যাশায় উনি আসেননি আজ। আমি নিজে থেকে ডেকে এনে কী ভয়ংকর একটা দিন উনাকে দেখালাম। খুব খারাপ লাগছে। অনুশোচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি পুড়ে।”
বলেই মেয়েটা ফুঁপানো শুরু করলো ফের। নিলয়ের মায়া হলো ওর জন্য। মাথায় হাত রাখলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। স্নেহময় স্বরে বলল,
“শত্রুকে মিত্র বানিয়ে ফেলা পর্যন্ত ঠিক আছে। তার জন্য আবার কাঁদছিসও? বাহহ! শত্রুর ক্ষমতা খারাপ না।”
নিরা বোকার মতো চেয়ে রইলো বিভ্রান্ত হয়ে। ঠোঁট টিপে হাসে নিলয়। কথা ঘুরিয়ে বলে,
“চিন্তা করিস না। ওকে জানি আমি। ওর মন ভোলানো কঠিন কাজ না। একটু ধৈর্য্য নিয়ে বোঝাতে হবে আরকি।”
কান্না থামিয়ে নিরা আবারও বাইরে চাইলো ক্লান্ত ভঙ্গিতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সবকিছু উলোটপালোট লাগছে। উনি কোথায় এখন? চলে গেছে বাসায়?”
নিলয় হাসল আড়ালে। বলল, “যায়নি। আর বললাম তো, ভাবিস না এতো। ও এতোও অবুঝ না। হলে এখনও এই বাড়িতেই থেকে যেতো না। তুই জ্ঞান হারানোর পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছে। পাগল পাগল হয়ে দশ মিনিটের মধ্যে কোথা থেকে ডাক্তার ধরে আনলো, কে জানে। ছিল এখানেই এতোক্ষণ।”
নিরা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চায়। “এখন কোথায়?”
“ছাঁদে আছে বোধহয়। ডেকে দিবো একটু পর। থাকুক কিছুক্ষণ একা। এখন বল, তোদের এই সাপেনেউলের মতো ভয়ংকর ক্যামিস্ট্রিটা কীভাবে কীভাবে এতো মিষ্টি সম্পর্কে কনভার্ট হলো? ওর জন্য তোর চোখে পানি দেখে আমি ভালোই বিস্মিত হচ্ছি। মাত্র ক’দিন আগেই তো বিয়ে করবি না বলে দুটোতে পালালি? এরই মধ্যে আবার কোন দৈত্য উদয় হলো তোদের জন্য?”
মন আর দেহের ক্লান্তির মাঝে-ও ঠোঁটে একরত্তি হাসি ফুটলো নিরার। ঘাড় ফিরিয়ে দৃষ্টি রাখে আবারও চাঁদের মুখে। বিভ্রম হয়ে ধীরকন্ঠে বলে,
“জানি না, ভাইয়া। সত্যি জানি না। কিচ্ছু টের পাইনি। আমার মন, মস্তিষ্ক কোনোটাই সতর্ক হওয়ার সুযোগ পায়নি,বিশ্বাস করো। কখন, কীভাবে আর কেন যে হুট করেই এতো টান অনুভব হতে শুরু হলো, সত্যি টের পাইনি। শুধু জানি, উনাকে নিয়ে আমার ভাবতে ভালো লাগছে। যে ভালোলাগায় বুকের মধ্যে সমুদ্র আছড়ে পড়ে? তেমন ভালো লাগা। উনি আমায় অসম্ভব ভালোবাসেন। আমি বুঝতে পারি সেটা। লোকটা তাকালেই তার চোখের মধ্যে কেমন একটা নেশা খুঁজে পাই নিজের প্রতি। অকারণে অধিকার দেখাতে দেখাতে কখন যে সে আমাকে আমার থেকে শক্ত করে কেড়ে নিলো, বুঝতে পারলাম না। শুধু বুঝি, আমি সম্ভবত এখন আর আমার নেই। উনি দখল করেছে পুরোটা আমাকে।”
কথাটা বলেই ম্লান হেসে চোখের পানি মুছল নিরা। নিলয় ঘাড় নুয়িয়ে হাসল মুচকি। উঠতে উঠতে বলল, “মিরার ব্যবস্থা পরে করবো। আপাতত অনেক কাজ বাকি আজ রাতে। আমি নিয়ে আসছি নাবিলকে। বোস তুই।”
—
দু-হাত বুকের উপর ভাজ করে মাথা নুয়িয়ে ছাঁদের রেলিঙে হেলান দিয়ে রিক্ত, শূন্য চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল। সবকিছু কেমন প্রাণহীন হয়ে উঠেছে কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে। এই হাহাকার কোন দিক থেকে আসছে? কেন সবই নিস্তব্ধ, গুমোট আজ? কীসের এতো দুঃখ পৃথিবীর? ক্লান্ত লাগছে খুব। পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিলয়ের নাম্বারে ডায়েল করলো। রিং হওয়ার শব্দ ভেসে আসছে আশপাশ থেকেই। নিলয়কে ছাঁদের দরজায় দেখামাত্র ধাতস্থ হয়ে দাঁড়াল নাবিল। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “ঘুমাওনি?”
“এটা জিজ্ঞেস করতেই ফোন করেছিস?”
নাবিল প্রতুত্তর না করে হাসল গভীর বিষাদ ঢেলে। নিলয় পাশাপাশি দাঁড়ায় ওর। কোনো কথা নেই দু’জনের মাঝে। বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। নিলয় পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো সেটা। সুখটান মেরে বলল,”জ্ঞান ফিরেছে ওর।”
নাবিল তীক্ষ্ণ চোখে একবার চেয়ে আবার ঘাড় ফিরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
“এটা জানতেও ফোন করিনি।”
হাসল বিদ্রুপ করে নিলয়। সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে শুধায়,”লাগবে?”
বিনাবাক্যে আধখাওয়া সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে মুখে দিলো নাবিল। ফুক দিয়ে ধোঁয়া উড়ালো আকাশে। ধোঁয়াগুলো উড়ছে খুচরো বিষাদ হয়ে।
“তুই সিগারেট খাস?”
হেসে মাথা ঝাঁকায় নাবিল। “উহু।”
“ধোঁয়া উড়ানোর স্টাইল দেখে তো এক্সপার্ট স্মোকার মনে হচ্ছে।”
হাসে সে। আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে বলে, “আমি যা করি,সেটাই স্টাইল। বন্ধুদের সাথে ট্রাই করেছিলাম কয়েকবার। আম্মুর হাতে ধরা খাওয়ার পর থেকে আর এ ভুল দ্বিতীয়বার করিনি। বোকা রমণী খুব কেঁদেছিল আমার হাতে সিগারেট দেখে। তার কান্না আবার আমার সহ্য হয় না।”
দু ভাই একত্রে হাসে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিলয় শুধায়, “মন খারাপ?”
নাবিল জবাব দেয় না। নিভৃতে শ্বাস ফেলে কেবল। কী জবাব দেওয়া যায় এ প্রশ্নের? কী নাম দেওয়া যায় এই অনুভুতির? সামান্য মন খারাপ? মোটেও না। এইযে বুকের ভেরত হচ্ছে তুমুল রক্তক্ষরণ, আর উথাল-পাথাল মহাপ্রলয়? তার নাম কেবল মন খারাপ হয় না। এর আসলে কোনো নামই হয় না। কোনো অভিধানে নেই একে জাহির করার মতো যথার্থ শব্দগুচ্ছ। না কোনো ডাক্তার-কবিরাজ বিশ্লেষণ করতে পারবে একে। আবার কাউকে অনুভব করানোও যায় না। কেবল নিজেই ছাই হওয়া যায় তীব্র দহনে পুড়ে।
“আমার উপর কোনো ব্যাপারে অভিযোগ আছে?”
নাবিল উজ্জ্বল আলোয় মুখ তুলে চায় ভাইয়ের পানে। আবার মাথা নামিয়ে হেসে বলে, “অকারণেই তোমার উপর অভিযোগ থাকতে যাবে কেন?”
“সিউর?নেই বলছিস?”
নাবিল সিগারেট মুখে নেয় আবার। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাসে মলিন করে। শান্ত স্বরে বলে, “তুমি দিন দিন গোয়েন্দা হয়ে যাচ্ছো, ভাই। অদক্ষ গোয়েন্দা। আসামী ছেড়ে ভুক্তভোগীকেই জেরা করছো।”
“তুই ভুক্তভোগী? আসামীটা কে তাহলে? নিরা?”
কোনোপ্রকার যদি, কিন্তু ছাড়াই নামটা বলে ফেলল নিলয়। নাবিল ছাঁদে পড়ে থাকা ইটের কণাটায় লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে হাসল আবার। নিলয় হাত ভাজ করে চায় ওর খামখেয়ালী, উদাস মুখে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
“বিয়েটা আমি বাসার লোকদের জোরাজোরিতে করতে রাজী হয়েছিলাম। আমার আবার অতো লোভ নেই অন্যের জিনিস দখল করার প্রতি।”
নাবিল অবাক নয়নে চাইলো কথাটা শুনে। নিলয় ঠোঁট কামড়ে হাসছে মনে মনে।
“ভুল বুঝছো তুমি। নিরা আর আমার মধ্যে কিছুই নেই তেমন। খামোখা আমাকে অপবাদ দিচ্ছো। কার দুঃখে জ্ঞান হারালো ওকেই জিজ্ঞেস করো৷”
ভ্রু কুঁচকায় নিলয়।
“আচ্ছা?”
“এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি যা বলি, সত্যিই বলি। আমার মতো একজন নিষ্ঠাবান মানুষকে সন্দেহ করা ঘোর অন্যায়।”
মাথায় ঝাঁকায় নিলয়। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,
“তোকে কেন আমি ছোটবেলা থেকে এতো স্নেহ করি জানিস?”
নাবিল প্রতুত্তর না করে চেয়ে রইলো নিজের পায়ের দিকে।
“কারণটাও কিন্তু শুধুই তুইই। আমার প্রতি তোর জন্মজন্মান্তরের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, টান.. এই ব্যাপারগুলো আমি ছোটবেলা থেকেই খেয়াল করতাম। তোর আচরণে সবসময় অনুভব করতাম, তুই আমারই রক্ত। পাখির মতো দাপিয়ে বেড়ানো নাবিলটা উপর থেকে ছটফটে হলেও ভেতরে ভেতরে সে যে তুলোর মতো নরম একটা হৃদয়, সেটাও কেবল আমি-ই জানতাম। তোকে যারা জানে, তারা কখনও এড়িয়ে যেতে পারবে না তোকে। তুই সে-ই সুযোগটাই দিতে রাজি না। কাছের মানুষদের মুগ্ধ করাই তোর প্রিয় কাজ। আমি নিজেও জানিনা, নেহাল ভাইয়ার চেয়েও বেশি ভালো আমি তোকে কেন বাসি। তুই বাধ্য করেছিস তোকে ভালোবাসতে। তোকে না ভালোবাসে কেউ থাকতেই পারে না! তুই জলজ্যান্ত একটা মায়া। যাকে ভালোবাসিস, তার জন্য সব করতে পারিস। নিজেকে উজাড় করে শূন্য হয়ে বসে থাকিস। আমার সবসময় মনে হতো, আমরা দু’জন দুই বৈশিষ্ট্যের মানুষ হলেও আমাদের আত্মাটা এক। তোর আমার হৃদয় একই জিনিস দিয়ে গড়া। তোর মনে আছে? তুই সবসময় সবাইকে বলে বেড়াতি, তুই তোর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান না। তোর আরেকটা ভাই আছে৷ আমার বড় ভাইয়ের নাম নিলয় বলে বলে খুব গর্ব করতি তুই আমাকে নিয়ে। আমি আজ-ও আমার প্রতি তোর এতো ভক্তি হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বেরাই। পাই না। শুধু বুঝি, তোর জন্য বুকের ভেতর কোথাও একটা খুব মায়া হয়। সে-ই মায়া থেকেই আজ ঠাটিয়ে দু’টো চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে।”
নাবিল আড়ালে আড়ালে একটু একটু চায় ভাইয়ের পানে।
“আমি কিন্তু আগেই বলেছি, ভুল বুঝছো তুমি আমাকে।”
নিলয় মন খারাপের দৃষ্টিতে চায় ওর পানে। অভিমান জমিয়ে বলে, “এখন আর তুই সেই নাবিলটা নেই। তুই বদলে গিয়েছিস। আমাকে তুই আর ভালোবাসিস না। বিশ্বাস করিস না। দুশমন ভাবিস তুই আমায়।”
“এমন মনে হচ্ছে কেন?”
“মনে হবে না? হওয়া উচিত না?”
নাবিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“দেখো ভাই, তোমার প্রতি আমার অভিমান নেই। তোমার কোনো দোষ নেই। খামোখা নিজেকে দোষী ভাবা বন্ধ করো। ওর ব্যাপারে জানি আমি সবটাই।”
ধমকে উঠে নিলয়।”কিছুই জানিস না তুই। তুই সত্যি কিছুই জানিস না,নাবিল। ভুল বুঝছিস ওকে। ও জানতো, ওর এনগেজমেন্ট তোর সাথে। তুই ওকে বিয়ে করবি এটা জেনেই মেয়েটা এতো খুশি ছিল।”
নাবিল শান্ত চোখে চায়। উত্তর করে না কোনো।
“দেখ, আমি জানি তুই কষ্ট পাচ্ছিস। বেচারিটাও কম দুঃখ পাচ্ছে না রে ভাই। আমি নিরার সাথেই ছিলাম এতোক্ষণ। ওর চোখে তোর জন্য যে অস্থিরতা দেখে এলাম, ওটা মিথ্যে না। মিথ্যে হতেই পারে না।”
নাবিল চায় তীক্ষ্ণ চোখে৷ আমতাআমতা করে শুধায়, “কী বলেছে ও?”
নিলয় বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আগুন চোখে চাইলো ওর পানে। থমথমে গলায় বলল,
“বলছি। তার আগে ফুটবল স্টাইলের একটা লাত্থি খেতে হবে তোকে।”
নাবিল তাৎক্ষণিক দূরত্ব মেপে দাঁড়াল। মতিগতি ঠিক নেই ভাইয়ের। দিলেও দিতে পারে।
——
চোখ বুজে ক্লান্ত ভঙ্গিতে খাটে হেলান দিয়ে বসে বলেছিল নিরা। অকস্মাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ লাগতেই মুখ তুলে চায় সে। নিরা তাকাতেই নাবিল হাসে বিমোহিত। ঘাড় নুয়িয়ে শুধায়, “ভালো লাগছে এখন একটু?”
নিরা নিঃশব্দে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রয় ওর মুখের পানে। আকস্মিক ঠোঁট ভেঙ্গে মাথা ঝাঁকায়। নাবিল উদ্বিগ্ন হয়ে গালে হাত রাখে ওর। পরম আদরে জানতে চায়, “কী হয়েছে?”
এক ফোঁটা চোখের পানি এসে পড়ল নাবিলের হাতে। উদ্বিগ্ন হয় হয় নাবিলের মন। আলতো করে দুই বাহু ধরে বুকের মধ্যে টেনে ধরে ওকে। নিরা ফোপাঁতে ফোঁপাতে শার্ট খামচে ধরে ওর। কান্নামিশ্রিত স্বরে বলে, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, নাবিল ভাই। তোমাকে কাঁদিয়ে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কী করবো এখন? কী করলে তোমার ব্যথা কমবে?”
নাবিল হেসে মাথায় হাত বুলায়। পরম শান্তি নিয়ে বলে, “ব্যথা নেই আমার। তুই মাথা এলিয়েছিস না বুকে? এখন আর কোনো ব্যথা নেই। ”
নিরা নাক টেনে বলে, “সবকিছু কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। আমরা কী করবো এখন? সকাল হলেই বাবা জোর করে হলেও বিয়ে পরিয়ে দেবেন। কিছু একটা তো করবেন আমাকে আটকানোর জন্য। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। মরে যাবে নাবিল ভাই আমি।”
নাবিল ওর চোখের পানি মুছিয়ে দেয় আলতো হাতে। স্যালাইন কমে এসেছে প্রায়। সেদিকে একপলক চেয়ে বলল, “খুলে দেই এটা?”
কিছুক্ষণ পিটপিট করে চেয়ে থেকে শান্ত বাচ্চাটির মতো মাথা উপরনিচ করে নিরা। নাবিল যত্ন সহকারে সুচটা খুললো। হাতটা চেপে ধরলো রক্ত পড়া বন্ধ করতে। ড্রয়ার থেকে ফাস্টেড বক্স বের করে সেখানে সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিলো স্বযত্নে। পরনে ওর তখনও বিকেলের সেই খয়েরী জামদানী শাড়ি। নাবিল গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে এলোমেলো হয়ে থাকা শাড়ীর কুঁচিগুলো ঠিক করলো। আঁচলটা ঠিকঠাক গায়ে জড়িয়ে চুলটা আঁচড়ে দিলো। যত্ন করে খোঁপা করলো চুলে৷ ড্রেসিং টেবিল হাতরে খুঁজে বের করলো লাল রঙের লিপস্টিক, আর ছোট্ট টিপের পাতাটা। পুতুলের মতো সামনে বসিয়ে সাজালো যত্ন করে। কাজল এঁকে দিলো চোখে। পুরোটা সময় নিরা বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ ওকে প্রশ্রয় দিয়েছে। নাবিল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সামনে বসিয়ে রেখে। মেয়েটার চোখের জ্যোতিতে নক্ষত্রের আলো হারায়। থমকে দাঁড়ায় বসন্ত। গুনী শিল্পীর আঁকা পুরো নিরাটাই একটা রুপকথার চিত্রলেখা। নাবিলের চোখ হাসে ওকে দেখলেই। কমেনা মুগ্ধতা, ফেরেনা দৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে ঘরের আলো নিভায় নাবিল। বৈদ্যুতিক আলো না থাকলেও পুরোপুরি অন্ধকার লাগছে না। আবছা আলোয় দু’টি চোখ কেবল দেখে দুটি চোখকেই। অস্বস্তি হলো না নিরার। ভয়ও পেলো না সে। নাবিল হাত বাড়ায় ওর সম্মুখে। নিরা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় নিজের হাত রাখল একটা উত্তপ্ত শক্তপোক্ত হাতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর পায়ে পা চালালো। বারান্দায় এসে দাঁড়াল দু’জন। নিরা মন ভোলানো আকাশের পানে চায় মুগ্ধ হয়ে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে চারপাশটা। অন্তর শীতল করা রাত। নাবিল এবারও ওর মুখে চেয়ে থাকে মোহগ্রস্তের মতো। নিরা ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসে মুচকি। চোখ নাড়িয়ে শুধায়, “কী দেখছো?”
নাবিল অবহেলায় পড়ে থাকা আঁচলটা তুলে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেয়। চায় তৃষ্ণা নিয়ে, হাসে তৃপ্তি ঠোঁটে। বুকে হাত নিয়ে বলে,
“দেখছি না। দেখাচ্ছি। অহংকারী চাঁদকে আমার আপন চাঁদের উজ্জ্বলতা দেখাচ্ছি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড মুগ্ধ হয় নীলিমার তাকে দেখে… আর আমি মুগ্ধ হই তোকে দেখে। তাকে ইর্ষা করালাম একটু। সে দেখুক, বসুমতী মাতোয়ারা করা সৌন্দর্য গায়ে মাখিয়েও নাবিলকে আকর্ষণ করাতে পারছে না তার হিরন্ময় রুপ। অথচ, সামান্য একজোড়া কাজলমাখানো টানা টানা চোখ ঠিকি বিভ্রম করে তুলছে আমার উন্মাদ প্রাণ! সে দেখুক,জ্বলুক, হিংসে করুক।”
শব্দ করে হাসল নিরা। মুক্তার মতো ছোট ছোট দাঁতগুলো চকচক করে উঠলো হাসির সাথে পাল্লা দিয়ে। নাবিল আবারও হাত রাখে বুকে। দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, “ইশ! ইশ! ইশশশশ! আর কতোবার মারবি অবলাকে?”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছেলেটার নাটক দেখে নিরা। আবারও হাসে দু’জন একসাথে।
“আমি অতো সুন্দর না। চাঁদ হিংসে করলে তোমাকে করবে৷”
নাবিল মাছি তাড়ানোর মতো কথা ফেলে দিয়ে হাত নাড়ায়৷ নিরা সামনে দাঁড়ায় ওর। জোর গলায় বলে, “একদমই গুল খাওয়াচ্ছি না। সত্যি বলছি, তুমি অনেক সুন্দর।”
“সুন্দর?”
“সুপুরুষ।”
“আমি সুপুরুষ?”
“অবশ্যই তুমি সুপুরুষ। তোমার মতো এমন সুন্দর করে হাসতে আমি কাউকে দেখিনি। ছেলেরা নরমালি এতো সুন্দর হাসে না। কেউ হাসতেই পারবে না তোমার মতো এতো মুগ্ধতা নিয়ে। তোমার চুল, চোখ, ঠোঁট, নাক সব সুন্দর। তুমি ছেলে ভালো, অন্তর ভালো, দেখতেও সলিড। তাহলে সুপুরুষ নয় তো কী?”
নাবিল ভাব নিয়ে চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে শুধায়, “আসলেই আমি সুন্দর?”
“কেন? আগে কেউ বলেনি?”
“বলেছে৷ সবাই বলেছে। তবে তোর মুখ থেকে শুনে বিশ্বাস করলাম, আমি আসলেই সুন্দর। মেনে নিলাম, আমার হাসি বসুমতীর সকল সৌন্দর্যকে হার মানায়। মেনে নিলাম কারণ, প্রিয় মানুষেরা কোনোকিছুর প্রশংসা করলে সেটা বিশ্বাসযোগ্যই হয়। আরও খুশি হলাম এটা জেনে যে, কেউ আজকাল আমার সৌন্দর্য খেয়াল করা শুরু করেছে।”
নিরা হাসে রেলিঙে মাথা ঠেকিয়ে। নাবিল এক হাত দিয়ে ওর হাত ধরে একই ভঙ্গিতে মাথা ঠেকায় রেলিঙে। চারটা ঝিলের মতো চোখ অনেকক্ষণ ধরে দেখে নিজেদের। নাবিল ডাকে মধুর স্বরে, “শোন!”
নিরা চোখ বুজে হাসল। “শুনছি তো।”
“চল আরেকবার ধ্বংস করি সব। আরেকবার ঝাঁপিয়ে পড়ি মহাসমুদ্রে। ডরভয় আমার ভেতরে কোনোকালেই ছিল না। তবুও কোনো দুরূহ বেগ পোহাতে, কোনো শৃঙ্খলা মানতে ইচ্ছে করছে না আজ আর। চল…সেদিনের মতো আরেকবার স্বাধীন আর নির্ভীক হই! অবিকল একই চন্দ্রিমার রাতে, একই গলির পথ ধরে আবারও উদ্দেশ্যহীন ছুট লাগাই দু’জন। এবার ফিরলে পাখি হয়ে ফিরবো। মুক্তি মিলবে বন্দীদশায় কাটানো অবরুদ্ধ দু’টি মনের। যাবি?”
মেয়েটা উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায় না। তখনই পকেটে ফোন বেজে উঠে নাবিলের। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নিলয়ের নাম দেখে কপালে হাত ঘষে হাসল।
“ব্যাটা সুখে থাকতে দিবে না।”
ঘরে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকেই নিলয় চোখ ছোট ছোট করে নাবিলের পানে সন্দিহান হয়ে চাইলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। পুরো ঘরে নজর বুলিয়ে বলে, “ধৈর্য্য-সহ্য দেখছি খুবি কম। বৈধতার আগে দরজা লাগিয়ে ঘর অন্ধকার করে ফেলাটা কিন্তু ভালো কাজ না। ঘোর পাপ।”
ভাইয়ের ইশারা বুঝে মুচকি হাসল নাবিল। ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে বলল, “বারান্দায় বসেছিলাম একটু। এমনিতেই তো চাঁদের আলো খুব। ঘরের আলোটা তাই মনে ধরছিল না।”
“রোগী কোথায়?”
নাবিল চোখ দিয়ে বারান্দায় ইশারা করলো। মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে বলল, “রোগী লজ্জা পাচ্ছে সামনে আসতে। শত হলেও ভাসুর তো তুমি।”
নিলয় গরম চোখে চাইলো। পিঠে চাপড় মেরে বলল, “ওর লজ্জা আছে, নেই শুধু তোরই। এখন কাজের কথা শোন, হাতে সময় কম৷ আমার এক বন্ধুকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করিয়ে রেখেছি। গেইটের চাবি আছে না নিরার কাছে?”
নাবিল হাঁক ছাড়ল ঢঙ করে,” কিগোওওও! আছে চাবি?”
নিরা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে একপলক বিরক্তি মুখ করে চাইলো নাবিলের পানে। এই অপদার্থ লোক বদলাবার নয়৷ অসভ্য একটা!
ড্রয়ার থেকে চাবি বের করে হাতে দিলো ওর। শুধালো, “চাবি দিয়ে কী হবে?”
নাবিল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শিষ বাজাতে বাজাতে বলল,
“তোদের বাড়িতে ডাকাত দল ঢুকাবো। নানাজানের আটপৌরে বাড়িটায় নাকি বহুত খাজানার সোর্স পাওয়া গেছে? তোর বাপ তো এমনি এমনি নিতে দিবে না সেসব কিছুই। তাই এই বিকল্প। তথ্য কিন্তু সিক্রেট। বাপের কানে লাগাস না যেনো।”
নিরা ফুঁসে তাকাল৷ নাবিল ওর কপালে টোকা মেরে শুধায়, “বোরখা আছে?”
“কেন?”
“হজ্জে যাবো। বোরখা পরে আয়। আর এনআইডি কার্ডও লাগবে। ওটা না থাকলে বার্থ সার্টিফিকেট হলেও চলবে। সময় দশ মিনিট৷ এর মধ্যে রেডি হ।”
নিরার অবস্থা দেখে নিলয় হাসল মিটিমিটি। নিরা বিরক্তি বিরক্তি মুখ করে শুধায়, “এনআইডি কার্ড কেন?”
“কতো প্রশ্ন করে দেখেছো, ভাই? এই মেয়ে আমাকে সবসময় এমন বউ বউ অধিকার দেখায় কেন? অথচ লোকে তো ঠিকি ভাবে, আমি তৈলমর্দন করে একে পটিয়েছি। আশ্চর্য ব্যাপার! তুই বউ হবি কেন? আমার কি বয়স হয়েছে বিয়ে করার?”
নিরা চোখ-মুখ খিঁচে দাঁতে দাঁত পিষে আবারও শুধায়,
“এনআইডি কার্ড দিয়ে কী হবে, নাবিল ভাই?”
“নৌকা মার্কায় একটা ভোট দিয়ে আসবো। যা রেডি হ।”
শব্দ করে হেসে ফেলল নিলয় এবার। নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে কোমড়ে হাত দিয়ে ঝাঁঝালো চোখে চাইলো নাবিলের পানে। নাবিলের ভাব গা-ছাড়া। গা জ্বালানো হাসি ঠোঁটে।নিরা আর আবোলতাবোল বলার সুযোগ না দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ওয়ারড্রব থেকে বোরখা বের করে বাথরুমে ঢুকল। দুই মিনিটের মধ্যে বের হলো বোরখা পরে। নাবিল ওর পা থেকে মাথা অব্ধি পর্যবেক্ষণ করে হাত বাড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলে, “চল।”
“কোথায়?”
“এতো প্রশ্ন কেন? ভয় হচ্ছে? ভরসা নেই?”
নিরা নিঃশব্দে মাথা উপরনিচ করে। স্মিত হাসে নাবিল।
“হাত বাড়া তাহলে। আজন্মের জন্য। আমার বন্ধনহীন মনটাকে মুক্তি দে তোর অন্তরে।”
নিরা বিনাবাক্যে হাত রাখে ওর হাতে। নাবিলও শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় বেঁধে নেয় ওকে। নিঃশ্বাস ফেলে গভীর আত্মতৃপ্তি নিয়ে। চোখাচোখি হয় দু’জনের। দু’টো নিবিড় চোখ হেসে সম্মতি জানায় একে-অপরকে। ওরা নিভৃতে ঘর ছাড়ে পূর্ণচন্দ্রকে সাথে নিয়ে। পেছনে ফেরার সময় নেই। না আছে ভবিষ্যতের শঙ্কা। কেবল দু’টো কোমল প্রাণ নির্জনে ভরসা দিলো একে-অপরকে। হৃদয়ের সুখের উত্তেজনা লুকিয়ে ছুটলো আড়ালে-আবডালে। এই চাঁদ, এই রাত আর নিভু নিভু সুখতাঁরারা সাক্ষী থাকলো আগামীর একটা আকাঙ্ক্ষিত নবসূচনার।
[রিচেক করা হয়নি।]