রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-২৭

0
12

গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ২৭
#নাজমুন_নাহার

অলস বিকেল৷
জিম থেকে এসে কেবলই ডিভানে হেলান দিয়ে বসলো নিলয়। ফোন হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলো কিছুক্ষণ। একঘেয়ে আর পানসেটে লাগছে দেশের দিনগুলো ইদানীং। ভালো লাগছে না এখানে আর। প্রবল শূন্যতা ক্রমে ক্রমেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে তাকে।

নিলয় ফেইসবুক নিউজফিডে ঢুকতেই একটা পোস্ট নজরে পড়ে। অল্প কিছুক্ষণ আগের শেয়ার করা পোস্ট। কোনো একটা লেকের পাড়ের হলদেটে বিকেলবেলার ছবি। পোস্টটা বর্ষার করা। ক্যাপশনে আবার সে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে ইংরেজি গুটিগুটি অক্ষরে লিখেছে,

“This place reminds me of ‘All the bright places’ movie and a special one.”

ক্যাপশনটা পরপর মন দিয়ে কয়েকবার পড়ল নিলয়। রহস্য উদঘাটন করতে চাইলো এই ‘স্পেশাল ওয়ানের’ ঘটনাটাকে। পরক্ষণেই নেটফ্লিক্স ঘেঁটে উল্লিখিত মুভিটা দেখতে বসে পড়ল সে। রহস্যের খোলাসা এখানেই।

মুভিটার সারমর্ম কিছুটা এমন: ভায়োলেট মার্কি এবং থিওডোর ফিন্চ। দুজন ভিন্ন ধরনের মানুষ, যারা মানসিকভাবে নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভায়োলেট তার বোনের মৃত্যু কাটিয়ে উঠতে পারছে না, আর ফিন্চ নিজের ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়ছে।

একদিন এক অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে তাদের দেখা হয়।ফিন্চ ভায়োলেটকে একটি সেতুর ধারে আত্মহত্যা করতে যাওয়া অবস্থায় দেখতে পায় এবং তাকে বাঁচায়। এখান থেকেই শুরু হয় তাদের বন্ধুত্ব এবং পরে প্রেমের সম্পর্ক। তারা উপলব্ধি করে, তাদের মানসিকতা ভিন্ন হলে-ও নিয়তি বোধহয় একই। একসাথে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক গাঢ় হয়। সেসব স্থান ওদের সম্পর্কের সেতু। যাদেরকে ওরা নিজেদের জীবনের ‘ব্রাইট প্লেসেস’ বলে জানে। পরবর্তীতে নায়কের অনুপস্থিতিতে নায়িকার যতবার নায়ককে মনে পড়েছে, সে সেসব জায়গায় তাৎক্ষণিক ছুটে গিয়েছে ততবারই। নায়কের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছে সেসব উজ্জ্বল স্থানগুলোতে। যদিও এই মুভির আরও গভীর বিশ্লেষণ আছে। তবে নিজের জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার জন্য এতোটুকু মিলই যথেষ্ট নিলয়ের জন্য।

টানা আড়াই ঘন্টা পর মুভিটা দেখা শেষ করে আবার ফিরে যায় বর্ষার টাইমলাইনে। ভালো করে মনোযোগের সহিত দেখে ছবিটা। ধর্মসাঘরপাড়ের লেকের পাশের জায়গাটা। এটা বোধহয় সেই জায়গাটাই, যেখানে নিলয় আর বর্ষা প্রথমবার নিজেদের আগ্রহে দেখা করেছিল। কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছিল এখানে। হ্যা, এখানেই তো।

ছবিটা দেখতে দেখতে এক ফালি আনন্দের হাওয়া কোথা থেকে এসে ফু দিলো নিলয়ের চোখে। মনের ভেতর অদ্ভুত এক স্বস্তি ঘীরে ধরে তাকে। কেমন একটা হাল্কাভাব হৃদয়ে। অন্যরকম অল্পস্বল্প প্রাপ্তির আনন্দে ভারমুক্ত লাগছে কিছুটা।

সেদিন ওদের বাসা থেকে হুট করেই চলে আসায় বর্ষার সঙ্গে কথা হয়ে ওঠেনি নিলয়ের। এরপর অবশ্য বর্ষাই স্বেচ্ছায় কয়েকবার যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে নিলয় নিজের গরজে যোগাযোগ করার আগ্রহ দেখায়নি একদিনও। সেদিন রাতে ছাঁদে এতোগুলা ইঙ্গিতের বিপরীতে মেয়েটার নির্লিপ্ততা নিলয়কে কিছুটা পিছু হটিয়ে দিয়েছে৷ সে বরাবরই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নির্বিবাদী একজন মানুষ। এভাবে একটা মেয়ের সম্মুখে নিজের এহেম ব্যক্তিত্বহীন অনুভুতি প্রকাশের ধরনের জন্য নিজেও কিছুটা লজ্জিত হয়েছিল। সেসব অবশ্য বর্ষাকে বুঝতে দেয়নি। তবে ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির হয়েছে। চেয়েছেও ওর সাথে যোগাযোগ করার জন্য। বর্ষা স্বেচ্ছায় গত দু’দিন ধরে ফোন করাতে কিছুটা স্বস্তি লাগছে। অস্থিরতাটুকুও কমেছে অনেকখানি। কেন যেনো মনে হচ্ছে, এই ক্যাপশন, এই ছবি নিলয়কে উদ্দেশ্য করেই শেয়ার করা। কিছুটা বিবেকের অমতে গিয়েই টেক্সট করে বসলো মেয়েটাকে,

“আই থিংক উই শুড বি ক্লিয়ার। একটা প্রোপার সমাধানে আসা উচিত আমাদের। উই আর নট ইম্যাচিউর। এই মন আর মস্তিষ্কের খেলা আর কতদিন, বলো? আমি কেবল আর একমাস আছি দেশে। মনে রেখো, শুধু একমাস। নিজের ভেতরকার প্রশ্নগুলোকে ডিল করো৷ আমি তোমার ডেস্টিনি হতে চাই ,বর্ষা!”

——

কমলা রঙা বিকেল ছাপিয়ে কেবলই অন্ধকার নেমেছে ধরায়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এমনিতেও একটু বেলা করে রাতের আধার নামে। রাহেলা কেবলই মাগরিবের নামাযে বসলেন। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজেও বেশ কিছুক্ষণ বিভ্রম হয়ে বসে রইলেন। এটা তার প্রতিদিনকার অভ্যাস। অন্যরকম এক শান্তি খুঁজে পান এতে। একধ্যানে কোথায় একটা চেয়ে মোহাচ্ছন্নের মতো তাজবি পড়ছেন। চোখ বেয়ে ঢলঢলে দীঘির মতো পানি গড়িয়ে পড়ছে। থেকে থেকেই সন্ধাটা ভারী হয়ে আসছে অদ্ভুত এক বিষন্নতায়। কোথায় একটা শূন্যতা টের পান৷ উঠে জায়নামাজ ভাজ করে আহত চিত্তে ছেলের ঘরে উঁকি মারলেন। দু’দিন ধরে নাবিলের জ্বর। ছেলেটা বিছানা ছেড়ে উঠছে না, খাচ্ছে না ঠিকটাক, না দেখাচ্ছে ডাক্তারকে। অদ্ভুত এক জেদ নিয়ে দু’দিন ধরে বিছানা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছে। চোখ-মুখ থমথমে। চেহারায় হাসির লেশমাত্র নেই। সারাক্ষণ হৈহৈ করে বেড়ানো প্রাণচঞ্চল ছেলেটার এহেম নীরবতা তার সরলা মা’কে ব্যথিত করছে। ছেলেটার নিষ্পাপ দুঃখী দুঃখী মুখটার দিকে তাকালে হু হু করে ডুকরে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার৷ তিনি ধীরপায়ে ছেলের শিউরে বসলেন। মা’কে দেখামাত্রই ভাবনা থেকে বেরিয়ে সহজ দৃষ্টিতে চাইলো নাবিল। মা-ছেলের মুখে কোনো কথা নেই বেশ কিছুক্ষণ। দৃষ্টি বিনিময় হলো নীরবে কেবল। ছেলের তপ্ত কপালে হাত রেখে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন রাহেলা। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে জানতে চাইলেন, “কেমন লাগছে এখন?”

নাবিল জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ চেয়ে থাকে মা’য়ের কোমল মুখের পানে। মৃদু হাসার চেষ্টা করে। মায়ের হাত টেনে আবারও রাখে নিজের মাথায়। শান্ত স্বরে শুধায়, “মুখটা এমন শুকনা লাগছে কেন তোমার? কীসের শোকে শোকাহত আমার বউয়ের শাশুড়ীটা? এতো দুঃখ কেন?”

ছেলের ম্যাকি রসিকতা ধরতে পারে মা। তবে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। নিশ্চুপ চেয়ে থাকে কেবল। ছেলের দুঃখ ব্যতিত পৃথিবীর কোনো দুঃখই তার দুঃখ বলে মনে হয় না। বিবেক আর রক্তের সম্পর্কের কাছে এই আবেগটুকুও যে হার মানে মাঝে মাঝে। মানাতে হয়।

নাবিল মা’র হাত নিজের গালের কাছে নিয়ে ফের বলে, “সত্যি করে একটা কথা বলো তো, আম্মু? মামা কি তোমারই ভাই? আপন ভাই? নির্ভেজাল? ফর্মালিন নেই তো?”

ছেলের এহেম প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে চায় রাহেলা। মনে মনে বিস্মিত, রাগান্বিত হলেও মুখে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন কেবল। নাবিল চোখ বুঁজে স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে রসিয়ে রসিয়ে বলে, “তোমার এই ভাইকে নানাভাই কোনো এক ঘষেটি বেগম টাইপ মহিলার কাছ থেকে দত্তক এনেছে আমি ড্যাম সিউর। নয়তো আমার আম্মুর মতো এমন লক্ষী প্রতিমা রমণীর এমন বিটকেল ভাই হতেই পারে না। আই হ্যাভ ডাউট।”

বলে নিজেই হু হা করে হাসল। হেলদোল দেখা গেলো না রাহেলার মুখে। অপলক চেয়ে রইলেন ছেলের পানে। মা’কে হাসানোর, মন ভালো করানোর কী মিথ্যা প্রচেষ্টা ছেলেটার। মাতৃবক্ষ মুচড়ে উঠে নিজের ছেলের ভেতরের অস্থিরতার কথা ভাবলে। এই ছেলে এমনি এমনি অসুস্থ হয় না। অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তায় এমন হয়েছে ওর। জ্বরে চোখদুটো কেমন রক্তিম হয়ে আছে। এলোমেলো খাপছাড়া চুলগুলো লেপটে আছে কপাল অব্ধি। মা খেয়াল করে, এমন মলিন অসুখেও কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। কী বিশদ মায়া! মনে মনে দোয়া পড়লেন তিনি। লোকের কুদৃষ্টি থেকে এই আদুরে মুখটাকে রক্ষা করার দোয়া। মানুষের ধ্বংসাত্মক চাহুনি থেকে ছেলেকে নিরাপদে রাখার দোয়া। নাবিল তোতাপাখির মতো জ্বরের ঘোরে কতো কথা বলে যাচ্ছে। হাসছে নিজে নিজেই। রাহেলা বিপরীতে হাসলেন না, রাগও করলেন না। মা’র মন ভোলানোর জন্য ছেলের কৃত্রিম অভিনয়টুকু বোধহয় ধরতে পারলেন তিনি।

ফোন বাজে নাবিলের। পরপর কয়েকবার রিং হলেও সে উঠে রিসিভ করে না। বাবা-র ফোন। ভিডিও কল। নাবিল বালিশের নিচ হাতরে ফোনটা মা’কে ধরিয়ে দিলো।

“কী খবর? তোমার ছোট্ট বাচ্চাটার শরীর কেমন এখন? বউয়ের শোকে দেবদাস হয়ে যাচ্ছে নাকি ছেলেটা আমার?”

তিনি ম্লান হাসলেন স্বামীর মশকরা ধরতে পেরে। নাবিল উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সেভাবে থেকেই বলল, ” কাটা গায়ে লবন ছিটানো বন্ধ করো,আব্বু। রাগ হচ্ছে আমার।”

হু হা করে হেসে ফেলল জসিম এহসান।

“ডোন্ট ওয়ারি জেন্টলম্যান, আই উইল হ্যান্ডেল। আমার ছেলের বউকে কতদিন ওই হতচ্ছাড়া আঁটকে রাখে, আমিও দেখবো। অবশ্য বিয়েটা করে ফেলে একটা কাজের কাজ করেছিস। একদম বাপ কা বেটা ধরনের যোগ্য কাজ। উঁচু নাক ওয়ালা শশুড়ের জন্য উচিৎ হয়েছে।”

রাহেলা কঠিন চোখে তাকালেন স্বামীর পানে। কটমট করতে করতে বললেন, “আরও লায় দাও। দাও আস্কারা আরও। বাপ-বেটা শুধু নিজেদেরটাই বুঝো। আমার ভাইয়ের দুঃখটা একবারও নজরে পড়ছে কারো? ভাইজানের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কতটা কষ্ট পেয়েছেন! আমার ভাইটা আজীবন শুধু কষ্টই করে গেলো। সুখ দেওয়ার কেউ নেই।”

স্ত্রীর ছলছল আবেগ দেখে সতর্ক হয়ে যায় জসিম। ঠেলে ঠেলে হেসে বললেন, “আহা! কাঁদার কী হলো আবার বলো তো? অদ্ভুত মহিলা তুমি। তোমার ভাইকে কিছু বলেছি নাকি আমি? কীরে নাবিল, তোর মামাকে কিছু বলেছি?”

নাবিল মনের শয়তানি মুখে প্রকাশ না করলেও পেঁচ লাগানোর উদ্দেশ্যে বেশ গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়, “অবশ্যই বলেছো। আলবাত বলেছো। আমার মা এমনি এমনি এখোনও রাগ করে না। মামাকে তুমি মাত্রই হতচ্ছাড়া বলেছো। আমি একজোড়া কান দিয়ে স্পষ্ট শুনেছি তা। ছিহ্! এমন সহজ-সরল মানুষটাকে তুমি হতচ্ছাড়া বলতে পারলে? বিবেকহীন মানুষ তুমি। ভাইয়ের দুর্নাম শুনে আম্মুর কেমন লাগবে সেটাও চিন্তা করলে না! আফসোস! আব্বু শুনো, আম্মু দেখেই তোমার এতো অত্যাচারের পরেও মুখে কুলুপ এঁটে সব সহ্য করে নিচ্ছে। অন্য মহিলা হলে কত ধানে কত ভাত হয় বুঝতা।”

জসিম ছেলের বাঁদরামি ধরতে পেরে বেকায়দা দৃষ্টিতে চায় স্ত্রীর তেজি মুখে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,

“রাহেলা, তোমার ছেলে একটা মীরজাফর। বাবা-মা’র মধ্যে কীভাবে যুদ্ধ লাগিয়ে দিচ্ছে দেখলে? তোমাকে উস্কে দিচ্ছে রাহেলা। আমি কিন্তু তেমনভাবে বলিনি। বন্ধু মানুষ, তাই একটু ফ্রাঙ্ক হয়ে গিয়েছিলাম।”

হাসির দরুণ জসিমের ক্যামেরা নড়চড় হতেই হুট করেই রাহেলা খেয়াল করে, ঘরের তাবত জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে স্বামীর ফ্লাটের। পেছনের লাগেজ কয়েকটা নতুন। তিনি সন্দিহান হয়ে শুধান, “কী ব্যাপার? বাসার এই অবস্থা কেন তোমার? আর এতোগুলা লাগেজ দিয়ে করছো?”

জসিম তাৎক্ষণিক সতর্ক হয়ে ক্যামেরা নিজের দিক ফিরিয়ে নেয়। আমতাআমতা করে বলে, “লাগেজগুলো ফিরজ ভাইয়ের৷ আগামীকাল দেশে যাবেন উনি। উনার জিনিসপত্রই গোছাচ্ছিলাম দু’জন মিলে।”

রাহেলার কাটকাট প্রশ্ন, “ফিরজ ভাই লাগেজ গোছানোর জন্য তোমার ফ্লাটে এসেছে? তা-ও এতদূর থেকে?”

জসিম অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি টের পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “নাবিলের মা, আমার একটু কাজ আছে। রাখছি। ওর দিকে খেয়াল রেখো।”

বলেই দুম করে ফোনটা কেটে দিলো। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে ফোনের দিকে চেয়ে রয় রাহেলা। বাবা-র অবস্থা বুঝে মনে মনে ঠোঁট টিপে হাসল নাবিল। মা’র পানে চেয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” এখোনও বুঝোনি? প্রিটেন্ড টু বি ফুল, সুইটহার্ট। তোমার স্বামী সম্ভবত দেশে আসবে খুব শীগ্রই। তোমাকে সারপ্রাইজ করার জন্য ঢং করছে। বাবা-র আচরণ লক্ষ্য করছো না? নিজে থেকে অনেক কিছু বুঝে নিতে হয় বোকা রমণী। তুমিও এক্টিং করো, এজ ইফ তুমি কিছু জানোই না। কেউ সারপ্রাইজ দিতে চাইলে সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করতে হয়।”

রাহেলা তীক্ষ্ণ চোখে চাইলেন ছেলের পানে।”তুই বুঝলি কীভাবে?”

“স্পেশাল সোর্স।”

ছেলের পানে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নাবিল কপাল চাপরায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমার বাপের বেরসিক বউ। বিশ্বাস হচ্ছে না, নাকি তুমি মানুষটাই এমন? আব্বুর এই বয়সেও কতো ডেডিকেশন তোমার জন্য, আর আমার আনরোমান্টিক জননীর কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। কই এই খুশিতে দারাজ থেকে দশ- বারোটা শাড়ী অর্ডার করে ফেলবে, পার্লারে গিয়ে একটু যুবতী সাজবে, তা না। ছেলের রোগ সেরে যাবে, তুমি এই মুহুর্তগুলো আর পাবে? গ্রো আপ বেইবি।”

রাহেলা ছেলের কপালে আবারও হাত রেখে বললেন, “সারপ্রাইজ আর রইলো কই? তুই তো বলেই দিলি। তাছাড়া, তোকে এমন অবস্থায় দেখে আমার কোনো সুখ উৎযাপন করতে ইচ্ছে করছে না। তুই সুস্থ হয়ে উঠ, বাবা।”

নাবিল জানে উপরে উপরে নির্লিপ্ত ভাব দেখালেও বাবা-র আসার সংবাদ শুনে মা এখনই চার রাকাত নফল নামায পড়ে ফেলবে। কেঁদেকেটে সৃষ্টিকর্তার নিকট অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করবে। ঘর-সংসার গোছানো শুরু করবে এখান থেকে বেড়িয়েই। আলমারির সবচেয়ে সুন্দর শাড়ীটা বের করে একদৃষ্টি চেয়ে থাকবে নববধূর ন্যায়। হাত বুলাবে সেটায়, হাসবে মুচকি মুচকি। বিয়েতে বেকার বাবা-র দেওয়া সেই লাল শাড়ীটা। যে শাড়ী মা কেবল বাবা থাকতেই পরেছিল। তারপর থেকে সেটার কেবল যত্নই করেছে, গায়ে জড়িয়ে মাড় নষ্ট করেনি। পাছে স্বামীর অস্তিত্ব না মুছে যায়।

—-

নিস্তব্ধ নিশিরে পৃথিবীটা যেনো হয়ে উঠে জনমানবহীন শূন্য খাঁখাঁ বিচ্ছিন্ন দীপ। কোথাও কোনো হাসির শব্দ নেই, নেই কোনো উৎসব, না আছে পাড়ার মোড়ের সেই বখাটে কুকুরের দলগুলোর ঘেউঘেউ বিচ্ছিরি আওয়াজ। সোডিয়ামের হলদেটে আলোটাকেও কেমন ম্লান আর নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছে। একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে মনে হয়, এক বিষন্ন দেহ চরাচরের সকল দুঃখ আগলে একলা দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ-কোটি বছর ধরে। দুঃখ জমতে জমতে সে পাহাড় হয়েছে। শেষ রাতে বোধহয় সবাই এমনই করে ক্লান্ত হয়। এমনই করে একলা হয়। জাদুর শহরের প্রতিটা ইট-পাথর ঘুমোচ্ছে অঘোরে। কেবল রাত জাগা পেঁচা হয়ে জেগে আছে ধরণীর সকল দুঃখী মুখেরা। ক্লান্ত আর অবসন্ন কিছু চোখ। গভীর করে নিঃশ্বাস ফেলার এই তো সময়। নিশির শেষ প্রহরটা এদের জন্য নয়ন ভেজানোর উপযুক্ত মুহূর্ত

উরুর উপর সকল বেদনা সপে ‘দ’ আকৃতিতে জানালার ধারে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে নিরা। দৃষ্টি মরা নদীর মতো শান্ত, মনটা কিশোরীদের মতো অশান্ত।

বাবা আজ ক’দিন ধরে নিরার সাথে কোনোরকম কথা বলছে না। সামনে পড়লেও এড়িয়ে যাচ্ছে। খাবার টেবিলে ওকে দেখতে পেলে অর্ধ খাওয়া অবস্থাতেই উঠে যাচ্ছে মুখ কালো করে। মা-ও আজ-কাল কেমন পর পর হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলে না। বাবা-মায়ের এহেম দূরের মানুষের মতো আচরণ নিরার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। বুকের মধ্যে ফাটল দৃষ্টি হয়। নিরার চোখ ভেসে আসে সদ্য জন্ম নেওয়া অবুঝ শিশুর ন্যায়। এই রিক্ত রিক্ত দিনগুলো বড্ড নিষ্ঠুর।

ভারী একটা শ্বাস ফেলে একধ্যানে চেয়ে রইলো পাড়ার মোড়ের ওই মলিন আলোটার দিকে। জানালার জীর্ণশীর্ণ অন্ধকার কার্নিশটার চেয়ে যথাযথ দুঃখবিলাসময় স্থান বোধহয় আর অন্যটি হয় না। দুঃখ ছাড়াও এমনি সময়ই সেখানে নীরবে একটু বসে থাকলেই অযথাই কত অবান্তর যুক্তিতে দুঃখী লাগে নিজেকে। কেমন অদ্ভুত ক্লান্তি ভর মনে। কী ভয়ংকর মন খারাপ হয়। এই মন খারাপের কোনো হেতু নেই। তবে আপন মানুষদের এহেম অবহেলা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে নিরার। হৃদয়টা কঠিন হয়ে দেহটা ভার ছেড়ে দিতে চায় শক্ত দেয়ালে। প্রতিমার মতো চেহাটায় আজ শুধুই মলিনতা। দৃষ্টিতে প্রগাঢ় নীল ব্যথাতুর অভিমান।

ক্ষণে ক্ষণে ফোনে ম্যাসেজ নোটিফিকেশনের শব্দ হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত বার্তা প্রেরকের কথা মাথায় আসতেই স্ক্রিন অন করে তাকায় নিরা। প্রতিদিনকার মতো নাবিলের ম্যাসেজ। ওর ফোনের কোনোপ্রকার রেসপন্স নিরা করছে না ক’দিন ধরেই। ইনবক্সে না ঢুকেই নোটিফিকেশনে দেখে নিলো ম্যাসেজগুলো।

“তুই ঠিক আছিস, জান? খাওয়াদাওয়া করছিস তো?”

“মামা, তোকে উল্টাপাল্টা আর কিছু বলেছে? তুই অশান্ত নিস না। ক’টাদিন দে, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“আমার ঘুম আসছে না, নিরা। ডেস্পারেটলি মিসিং ইউ!”

প্রসন্ন শ্বাস ফেলে নিরা আজ ফোন করলো ওকে। রিং হওয়া মাত্রই অপর পাশ থেকে রিসিভ হয়। সাড়াশব্দ না পেয়ে নিরা নিজেই বলে, “হ্যালো, শুনছো?”

ময়না পাখির মতো ওই ‘শুনছো’ শব্দটাই নাবিলকে দূর্বল করে ফেললো। ভেতরের ক্রোধ দমিয়ে শুধায়, “রেসপন্স কেন করিসনি এতোদিন? কী দোষ আমার?”

নিরা অপরাধীর মতো চুপ থাকে কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই কথার প্রতুত্তরে উদ্বিগ্ন হয়ে ভিন্ন প্রশ্ন করে, “তোমার কন্ঠটা এমন কেন শোনাচ্ছে? তুমি কি অসুস্থ? ”

নাবিলের কন্ঠ গম্ভীর শোনালো।”আমার প্রশ্নের উত্তর এটা না।”

নিরা ফের শুধায়,”তোমার জ্বর হয়েছে?”

“হলেই কী! মরে গেলেই কী! তুই তোর মতো থাক। আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার কী? আমি একাই সম্ভবত তোকে এতো ভালোবাসি, নিরা। ভালোবেসে দিবারাত্রি পুড়ছি। আমার যে কেমন অসহ্যকর দিনগুলো কাটছে, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো সাধ্য নেই বোঝার। তোর মতো ভালো না বাসা নিষ্ঠুররাই পৃথিবীর সমস্ত সুখ, ভালো থাকা লুফে নেওয়ার জন্য আসে। বেদনা সব নাবিলদের প্রাপ্য।”

নাবিলের কন্ঠে আবারও অভিমান। নিরা রাগলো না, না পেলো দুঃখ। এসব বলার অধিকার নাবিলের আছে। সে বলুক।

“আব্বু-আম্মু আমার সাথে কথা বলছে না, নাবিল ভাই। একই বাসায় থেকেও কেমন অদ্ভুত লাগছে। ওরা আমার সাথে কেমন পাষাণের মতো আচরণ করছে। দমবন্ধ লাগছে খুব। আমার একটুও ভালো লাগছে না এখানে।”

হুট করেই এসব বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নিরা। নাবিল হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ঘটনার আকস্মিকতায়। উদ্বিগ্নতা বাড়ে তার। উত্তেজিত কন্ঠে বলে, “মন খারাপ করে না। বারান্দায় এসে দাঁড়া। আমার পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে।”

বলেই ফট করে ফোনটা কেটে দিলো। নিরা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো ফোনের পানে। রাত প্রায় তিনটা বাজে। লোকটা এই সময়ে আসবে!

পাঁচ মিনিট পাড় না হতেই বাইকের হর্নের শব্দে বারান্দায় ছুটে আসে নিরা। রাস্তার কার্নিশে বাইকের সিটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চিরচেনা পুরুষ। উসকোখুসকো এলোমেলো চুলগুলোয় আজ কেমন অপরিপাট্যতা। পরনে সাদা টি-শার্টের সাথে কালো ট্রাউজার পেন্ট। চোখদুটো রক্তিম। ওকে দেখামাত্রই পৃথিবীর সমস্ত অসুখ উপেক্ষা করে মিষ্টি করে হাসল নাবিল। ঠোঁটের ইশারায় উড়ালো আদরময় একটা চুমু। নিরার ছলছল কোটর ডিঙিয়ে এবার অগত্যাই বেড়িয়ে এলো ভালোবাসার সুখ সুখ ব্যথাতুর অশ্রু। রেলিংয়ে কপাল ঠেকিয়ে ঠোঁট উল্টে চেয়ে রয় তার একান্ত নিজস্ব মানুষটার পানে। নাবিল হাসে ম্লান মুখেই। কতো রকম ইশারা করে বোঝায়, “তোকে দেখে বুকের মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলাম। তুই একটা ম্যাজিক, নিরু।”

নিরা হেসে ফেলল। এতোক্ষণের সকল দুঃখ কেমন অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেলো কোথাও। এই লোককে কেউ বোঝাও, সে নিরাকে নয়, নিরা নামক যুবতীটি তাকে দেখে প্রাণ ফিরে পায়। মানুষটার নেশাতুর চোখদুটো নিরার সকল ব্যথানাশক অসুখের ঔষধ। এই সরল মুখটাই যে নিরার একমাত্র সুখের জগৎ!

নাবিল হাত দিয়ে ওকে ইশারা করে না কাঁদতে। নিরা কাঁদতে কাঁদতেই হাসে। হৃদয়ে জমে থাকা অভিমান, অভিযোগের পাহাড় ভেঙে পরক্ষণেই সৃষ্টি হয় অনন্য এক নরম অনুভুতির। পেলব মুখ হয় আরও উজ্জ্বল। সে উপলব্ধি করে, এমন একটা নাবিল জীবনে আছে বলেই হয়তো দুঃখরা নিরাকে ছুঁয়েও ছুঁতে পারে না। এমন একটা পাগলাটে পুরুষ আছে বলেই মধ্যরাতের সকল মনের অসুখ এক মুহুর্তেই উধাও হয়ে যায়। এমন একটা মানুষ আছে বলেই জীবনের ভারটুকু বড্ড হালকা মনে হয়। সে সামলে নেয় বলেই তো ভালোবাসাটাকে একটা সাতরঙা প্রজাতি মনে হয় নিরার। যার ডানায় নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে নিরা তার জীবনের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছে!

চলবে।