রোদ পোহাবার ছুতোয় পর্ব-৩০

0
11

গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#পর্বঃ৩০
#নাজমুন_নাহার
সকাল থেকে ঝলসানো রোদ। আকাশ থেকে তীব্র গরমের লাভা যেনো গলে গলে পড়ছে ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে। ক’দিন ধরে যা বাজখাঁই গরম পড়েছে তাতে দেশে হিটস্ট্রোকের আশঙ্কাও গানিতিক হারে বাড়ার কথা। এই রুক্ষ দিনেই বনশ্রীর একটা ওয়েডিং ক্লাবে প্রায় আট কেজি ওজনের ভারী কারুকাজের শাড়ী পরে বসে আছে নিরা। শাড়ীটা ফুপ্পির পছন্দে কেনা। বেছে বেছে শপের সেরাটাই ছেলের বউয়ের জন্য কিনেছেন তিনি। গহনা, শাড়ীর ভারে ঠিকঠাক দাঁড়াতেও পারছে না মেয়েটা। তবে গরমটা বোধহয় খুব একটা গায়ে লাগছে না তার। আজ কোনো এক বিশেষ হেতুতে সবকিছুতেই কেমন আরাম খুঁজে পাচ্ছে সে। হালকা লাগছে অনেকটা। যেমন ভারহীন লাগে উঁচু পাহাড়ের সীমানায় দুই হাত ছড়িয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়ালে? যেমনটা লাগে শৈশবে মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকানোর মাঝে? যেমন উষ্ণ লাগে শীতের নরম রোদে। যেমনটা লাগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সকল গানের লাইনগুলো শুনলে? আজও তেমনই প্রাণের একটা শান্ত হওয়ার দিন। তেমনই আরামবোধ করার দিন। খুব সম্ভবত মনে সুখ থাকলে মহা দূর্যোগও মানুষের বাহ্যিক আনন্দের কোনো ক্ষয়ক্ষতি সাধারণ হয় না। এই মুহূর্তে চিরতার ন্যায় তেতো পানীয়জল পান করেও নিরা এক গাল হেসে দেওয়ার মতো আনন্দিত। সময়টা ভাদ্র মাস চললেও নিরার ব্যক্তিগত জীবনে চলছে শরৎ আর বর্ষাকাল। এই দিনটা যে বসন্তের দক্ষিণা হাওয়ার মতো কোমল। আবার শীতের কুয়াশার মতো উষ্ণ।

আয়নায় নিজেকে নিরা দেখতে দেখতে ফোন করলো কাউকে। রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে ব্যস্ত শহরের ট্রাফিকের যত ঝঞ্জাটের আওয়াজ ভেসে আসছে।

“কোথায় তুমি?”

“গাড়িতে।”

“কতক্ষণ লাগবে?”

“ঢাকা শহরের জ্যাম ওভারকাম করতে পারলে আর দশ মিনিট।”

“আমার খুব লজ্জা লাগছে,নাবিল ভাই।”

নাবিল শব্দ করে হাসে। “কেন?”

“জানি না।”

“ভিডিও কল দেই?”

“নাহ।”

“আমি এলে লজ্জা ভাঙবে?”

নিরার কন্ঠে কাঁপা লজ্জা। “এটাও জানি না।”

অপর পাশ থেকে শাওনের রসিকতা মিশ্রিত হাসির শব্দ ভেসে আসছে। নিরা কৌতুহলী হয়ে শুধায়, “কী ব্যাপার? তুমি স্পিকার লাউডে রেখেছো?”

“স্পিকার লাউডে নেই। গোয়েন্দা শাউইন্না কান পেতে বসেছে সাথে। শালা অসম্ভব কুটনা। আড়ি পেতে বন্ধুর প্রেম আলাপ শুনছে। রাখি। এই হারামি এখন কথা বলতে দিবে না। এটাও তোর আরেক সতিন।”

ঢাকার চির পরিচিত যানযট পেরিয়ে নাবিলের কালো রঙের টয়োটাটা বনশ্রী এসে পৌঁছালো। কাঙ্ক্ষিত একজনকে দেখার অভিলাষে সে ফুলসাজানো গাড়ি থেকে উঁকি দিলো বনশ্রীর সনামধন্য একটা ক্লাবের করিডরে। আজকাল সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ধরনের ভিডিও আবার খুব ভাইরাল। বর শেরওয়ানি পরে ওয়েডিং ক্লাবে এন্ট্রি নিচ্ছে, আর কনে সেখানকার কোনো জানালার গ্রিল থেকে উঁকি মেরে তাকে দেখছে। কী মিষ্টি দৃশ্য! কিন্তু নাবিল জানে সে প্রত্যাশিত তেমন কিছুই দেখবে না। অবশ্য নিরার কাছ থেকে এসব সস্তা ব্যাপার আশাও করা যায় না। মেয়েটা যে পৃথিবীর সমস্ত একঘেয়ে ট্রেন্ডের বাহিরে। এইযে ক্লাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারা হচ্ছে, এই নিয়েও তার বিরোধের শেষ নেই। নিরার মতে, এসব কৃত্রিমতার চাইতে বাড়িতে প্যান্ডেল করে শুধু নিজের মানুষদের সাথে ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলা ঢের ভালো। যেসমস্ত আনুষ্ঠানিকতায় বাইরের লোক অতিরিক্ত থাকে, সেসব বিয়েতে ব্যক্তিগত আনন্দের ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে যায়। নিজেদের আনন্দ অন্যদের মাঝে ভাগাভাগি হয়ে গেলে ব্যক্তিগত বলতে কিছুই রইলো না। ওর এসব চিন্তাভাবনার হেতু নাবিল অবশ্য ভালোই টের পাচ্ছে এখন। এই জ্যামের অসহ্য গরমই হৈ হৈ করে বউ তুলে নেওয়ার শখ মেটাচ্ছে। অবশ্য গরমটা খুব একটা মনোযোগ কাঁড়তে পারছে না। পূর্ণতার আনন্দের কাছে পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা যে ফিকে।

গেইটে নাম না জানা শালা-শালিদের ঢল নেমেছে। এতো এতো পাতানো শালা-শালী দেখে নাবিল বেশ অবাকই হয়। এতো বছর পর কোথা থেকে উদয় হলো এরা। নিরার কয়েকজন বান্ধবীকে অবশ্য নাবিল আগে থেকেই জানে। বাকিরা সম্ভবত নিরার নানার বংশের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বিচ্ছু সমাজ। এই বিচ্ছুদের সঙ্গে আজ আর কোনোপ্রকার বাঁদরামি করতে ইচ্ছে করলো না নাবিলের। তার ব্যস্ততা আর সকল মনোযোগ অন্যদিকে। আদর্শ দুলাভাইয়ের মতো এদের দাবিদাওয়া মিটিয়ে ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করলো। পেছনে পেছনে একদল ব্যান্ড পার্টি ঢাক-ঢোল পেটাতে পেটাতে বরযাত্রী নাচে উৎসাহ দিচ্ছে। নাবিলের বন্ধুরা ধুমসে নেচেছে। সবচেয়ে খুশি দেখাচ্ছে রাহেলাকে। ছেলের চেয়ে মা বেশি উৎসাহী।

স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই প্রেয়সীর দেখা পায় নাবিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে নববধূকে। শশুর বাড়ির আত্নীয়দের ভালোই খাতির করছে বউটা। নাবিলদের বাড়ির যে কাউকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিচ্ছে, হেসে হেসে কথা বলছে। কী মুগ্ধতা মেয়েটার হাসিতে। ছোট্ট কিশোরীটা আজ একেবারেই নারীসুলভ একটা ঘরে উপনীত হয়েছে। নিরা নামক মেয়েটা আজ নাবিলের নিজস্ব ঘর। সকল কোলাহল ছাপিয়ে এই মুহূর্তে নাবিলের দৃষ্টি আঁটকে রইলো কেবল সেই আপন ঘরের চেহারায়। নিরা! নাবিলের ছোটবেলার একমাত্র ঝগড়ার সাথী। নাকের ডগায় প্রবল জেদ লুকিয়ে রাখা অবুঝ বালিকাটা। আর তার এখনের ব্যক্তিগত নারী! নাবিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর চেহারায় আঁটকে গিয়ে ভাবে, যেদিন বিয়ে থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, আজ অবিকল তেমনই কি লাগছে নিরাকে? সে-ই খয়েরি রঙের ভারী শাড়ী, গাঢ় করে কাজল লেপ্টানো দু’টো চোখ, উদ্বিগ্ন একটা যুবতী, অবিকল এমন-ই কি লাগছে আজ মেয়েটাকে? সেদিনের মতোন বিভ্রান্ত, হতাশাগ্রস্ত? বোধহয় না। আজ ওই মুখে কেবলই আনন্দ আর পূর্ণতার তৃপ্তি। চেহারায় খানিক অপরিপক্কতা এসেছে মেয়েটার। হাসিটা আগের চেয়ে নরম। দৃষ্টি অতোটা তেজি না। হুটহাট রেগে যাওয়ার ব্যাপারটাও কমেছে। এখন সে নদীর মতো শান্ত, বর্ষার মতো স্নিগ্ধ। যুবতী থেকে পরিপূর্ণ রমণী। ঢলঢলে দীঘির মতো সাংসারিক দু’টো টানা টানা চোখ। নিরা বদলেছে। অনেকটা বদলেছে মেয়েটা। ভালোবাসলে মানুষ বুঝি এভাবেই বদলে যায়? যেমনটা সে বদলালো? মেয়েটার বদলে যাওয়াটা ভীষণ পেলব৷ এই বদলে যাওয়ার হেতুতে যখন-তখন ওর কোলে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। কাছে টানে তার কন্ঠ, কোল, হাত। সে মধুর করে গান গাইতে গাইতে হাত বুলাবে কোলে থাকা নাবিলের ক্লান্ত মাথায়। ওর আঙুল খেলা করবে গোছানো চুলের ফাঁকে ফাঁকে। কী দারুণ ব্যাপার!

—-

গাঢ় নীল পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে শাওন তীক্ষ্ণ চোখে আশপাশটা একবার পরখ করলো। আসার পর থেকেই ইমুর সন্ধান নেই। সারাক্ষণ লাফিয়ে,দাপিয়ে বেড়ানো চঞ্চলাটা নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েতে পরিবেশ ঠান্ডা রেখে কোথায় নিখোঁজ হয়ে বসে রইলো,কে জানে! মেয়েটাকে না জ্বালাতে পারলেও স্বস্তি লাগছে না। শাওনের ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে উড়ে এলো ইমু। সামনে দাঁড়িয়ে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে টানতে টানতে ক্লাবের রুফটপে নিয়ে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় বেচারা শাওন থতমত খেলেও তাৎক্ষণিক কিছুই বললো না। মেয়েটাকে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। আপাতত ঘটনা জানা দরকার।

শেষ দশ মিনিট ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে ইমু। শাওন কতভাবে কারণ জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু মেয়েটা কোনো যুৎসই প্রতুত্তর না করে চোখে গঙ্গা ভাসিয়ে কেঁদেই চলেছে। হতাশার শ্বাস ফেললো শাওন। অতিরিক্ত কান্নার দরুণ চোখ, গাল ফুলে একাকার ইমুর। টেনশন বাড়ছে এবার। এই অবস্থায় ছাঁদে কেউ দেখলে পরে ইমুরই সমস্যা হবে। শাওন কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো,

“দেখো, আমি বুঝতে পারছি সামথিংস গোয়িং রং। বাট তুমি না বললে বুঝবো কীভাবে? আমি এবার সিরিয়াসলি বিরক্ত হচ্ছি,ইমু। কিছু না বলে সামনে রোবটের মতো দাঁড় করিয়ে এভাবে কাঁদছো, ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? টিচ করেছে কেউ? কোনো ছেলে বখাটেপনা করেছে?”

ইমু চোখ মুছতে মুছতে মাথা নাড়ায়। ঠোঁট উল্টে বলে, “বখাটেপনা আর টিচ করা একই ব্যাপার, শাওন ভাই।”

শাওন বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। এ কী মেয়ে রে ভাই? কাঁদতে কাঁদতে ভুল ধরছে। কী চিজ এই মেয়ে!

শাওন তবুও নিজেকে সংযত রেখে আবারও শুধায়,”আমার সাথে রাগ? গতকালকের ঘটনা নিয়ে?”

শাওনের কৌতুহলী চোখে চেয়ে আবারও সজোরে মাথা নাড়ায় ইমু।

এবার আসলেই বিরক্ত হলো শাওন। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,”তাহলে?”

ফোলা ফোলা চোখ তুলে শান্ত দৃষ্টিতে শাওনের চোখের পানে চেয়ে ইমু অকস্মাৎ বলে বসল, “আমাকে বিয়ে করবেন, শাওন ভাই?”

বৈদ্যুতিক ঝটকা খাওয়ার মতো থম মেরে চোখ-মুখ হা করে চেয়ে রইলো শাওন। ব্যাপারটা বুঝতে এখনও বিভ্রমে আছে। বেশ কিছুক্ষণ মোহগ্রস্তের মতো ওভাবেই চেয়ে থেকে পরক্ষণেই ভ্রু বাঁকিয়ে আওড়ালো, “হুয়াট! বিয়ে? হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? কী হয়েছে তোমার?”

ইমু প্রশ্নের বিপরীতে মাথা নুয়িয়ে নিঃশব্দে আবারও ফুপালো।

“ওকে, লেটস টক। তুমি কোনো একটা বিষয় ফ্রাস্ট্রেটেড সম্ভবত। আমরা কথা বলি। খুলে বলো, আই উইল হেল্প ইউ।”

ইমুর চোখ বেয়ে প্রবল অভিমান ঝরে পড়ছে লোকটার প্রতি। গোপন প্রত্যাখ্যানে তড়তড় করে রাগ বাড়ছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ছে রক্তিম চোখজোড়াতেও। সেভাবে চেয়েই সে আক্রোশের সঙ্গে বলল, “আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কি-না?”

কপালের ঘাম মুছে শান্ত হয়ে তাকালো শাওন। নাহ, মেয়েটার চোখদুটো বলছে, ও নাটক করছে না। না শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু করছে। শাওন শান্ত মেজাজে সামনে দাঁড়ায় ওর। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থেকে শুধায়, “কী হয়েছে তোমার? কী সমস্যা চলে জীবনে? শান্ত হও। মাথা ঠান্ডা করে বলো।”

“বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”

শাওন অবাক না হয়ে বললো, “তুমি বিয়েতে রাজি না, তাই তো? সেটা বুঝিয়ে বলো উনাকে।”

“বুঝবে না। বাসায় আমার সিদ্ধান্তের কোনো ভ্যালু নেই, শাওন ভাই। এই ছেলেকে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা হতো না যদি না ও নিজের আসল রুপটা আমার সামনে আসতো।”

শাওন কপালে কৌতুহলের ভাজ ফেলে শুধায়, “আসল রুপ? বুঝিয়ে বলো।”

“ও একটা চরিত্রহীন। ও আমাকে বিয়ের আগেই কুপ্রস্তাব দিয়েছে। আলাদা কথা বলার নাম করে ও আমার শরীরে টাচ করার চেষ্টা করেছে। এসব আমি আব্বুকে কীভাবে বোজাবো?”

শাওন মাথা নুয়িয়ে নিজের অস্বস্তিভাব ঢাকলো। মুখের আগে হাত শক্ত হয়ে এলো প্রবল ক্রোধে। মুখ দিয়ে অশ্রাব্য কিছু গালি বেরিয়ে আসতে চাইছে অকপটে। নিজেকে সংযত করে শান্ত স্বরে বললো,

“তুমি আমাকে ওর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবে? নাউ ডোন্ট সে, শাওন ভাই আমি ঝামেলা চাই না। তোমাদের মতো ঝামেলা চাই না মার্কা মেয়েদের জন্যই এদের দাঁত গজায়। আমার কাছে বলার আগে ঠাটিয়ে দু’টো থাপ্পড় মেরে আসতে পারলে না স্টুপিড?”

ইমু ভীত চোখে চায় শাওনের রক্তিম চোখে। একপলক চেয়ে আর সাহস হলো না দৃষ্টি টিকিয়ে রাখার। শাওন ফের বলে,

“এসবের সাথে আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণটা কী?”

ইমু কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

“কারণ আপনি ফাজিল হলেও মানুষ ভালো। আপনি মুখে মুখেই আমাকে বিরক্ত করেছেন, ওর মতো লম্পট আপনি না। আপনার দৃষ্টি কখোনও আমাকে বিব্রত করেনি। পালাই পালাই করলেও আমি মনে মনে সবসময় চাইতাম, আপনি আমার আশপাশে থাকুন, বিরক্ত করুন। ক্যাম্পাসে এতো মেয়ে থাকতে আপনি কেবল আমাকেই জ্বালাতেন। কারণ, আপনি আমাকে পছন্দ করেন। আপনার সম্পর্কে খুব গভীরে না জানলেও আমি অনুভব করি, আপনি আমাকে খুব সম্মানে রাখবেন, যত্নে রাখবেন। বিয়ে করার জন্য আপনার চেয়ে ভালো পাত্র আমি আর পাবো না। আচ্ছা শুনুন, আপনার টাকাপয়সা আছে তো?”

শাওন ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ হিসেবি ইমুর মুখে চেয়ে অকস্মাৎ হেসে দিলো। ইমু ফের গম্ভীর হয়। বলে,

“আশ্চর্য! হাসছেন কেন? হাসার কী হলো! সংসার করতে টাকা লাগবে না? বাচ্চাকাচ্চাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে না? টাকাপয়সা ছাড়া কিন্তু আমি আপনাকে মোটোও বিয়ে করছি না।”

শাওন হাসি থামিয়ে নাক টেনে শ্বাস নিয়ে ফের হাসল।

“তোমার প্ল্যানিং শুনে ভালো লাগলো। বাচ্চাকাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করাটা একটা দায়িত্বশীল কাজ। তুমি ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে একজন দায়িত্বশীল মা হবে,ইমু। বেশ সাংসারিক মেয়ে তুমি। তবে সমস্যাটা অন্য জায়গায়।”

ইমু উদ্বিগ্ন হয়ে শুধায়, “কোথায় সমস্যা?”

“আমার বাবা-র অতো অঢেল টাকাপয়সা নেই যে বেকার থেকেও বউ পালতে পারবো,বউয়ের শখ মেটাতে পারবো। আপাতত টিউশনি করিয়ে যে ক’টা টাকা পাই, তাতে কোনোরকমে সংসার চলে। অনার্স শেষ করে চাকরির বাজারে আবার বিপুল সময় নষ্ট করতে হবে। কবে চাকরি হবে, তারও গেরান্টি দিতে পারছি না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা মধ্যবিত্ত সংসার চালানোর জন্য যুৎসই ইনকামের চাকরি পাওয়াও মুশকিল। ততদিন পর্যন্ত এই অভাগার জন্য নিশ্চয়ই তুমি অপেক্ষা করবে না?”

ইমু এসপারওসপার না ভেবেই বললো, “ভালোবাসতে পারবেন তো?”

শাওন ভ্যাবলার মতো চেয়ে বলে, “হাহ্?”

“বললাম, ভালোবাসতে পারবেন? নাকি ওটারও দৈন্যতা আছে?”

ওর কথার অর্থ বোধগম্য হতেই শাওন কপাল ঘষে হাসল।

“আপনার বাসায় কে কে আছে?”

“আম্মা, ছোটবোন মেঘা, আব্বা আর আমি।”

“আমার মতো আরেকজনের খরচ বহন করতে আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হওয়ার কথা না। আমি অতো খাই না। আমার অতো চাহিদা নেই, শাওন ভাই। বাসায় থাকতে আমার দমবন্ধ লাগছে। আব্বা আমাকে একটা জানোয়ারের হাতে তুলে দিবে। আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না। বিয়ে করে উদ্ধার করুন আপনি আমায়।”

কী নিষ্পাপ আবদার মেয়েটার। শাওন বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রলম্বিত এক শ্বাস ফেললো। আগেপিছে না ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে মা’কে কল করলো। রেহনুমা রিসিভ করেই ছেলেকে শুধালেন, “কিরে, বিয়ে শেষ? কোথায় আছিস এখন?”

শাওন বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “ক্লাবেই আছি, আম্মা। একটা কথা বলতাম আপনাকে।”

রেহনুমা উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন ছেলের কথার ধরন বুঝে।

“কী কথা, বাবা?”

“আমি বিয়ে করতে চাই,আম্মা। আর সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই। আপনাদের কোনো আপত্তি আছে?”

বেশ কিছুক্ষণ অপর পাশ থেকে সাড়া আসে না। মা’য়ের প্রতুত্তর না পেয়ে খানিকটা ভীত হয় শাওন। মনটা ছটফট করতে থাকে অকপটে। বেশ কিছুক্ষণ পর রেহনুমা চাপা গলায় শুধালেন, “মেয়েটার নাম কী? মেঘা যে মেয়েটার নাম বলেছে ওই মেয়েটাই?”

“মেঘা কার নাম বলেছে আপনাকে?”

মেঘা পাশেই বসেছিল। আড়ি পেতে সবটা শুনেছে এতোক্ষণ। তার প্রসঙ্গ আসতেই ফোনটা ছো মেরে কেঁড়ে নিয়ে হেসে ভাইকে রসিয়ে রসিয়ে বললো, “ইমু আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই না? আমি জানি। এর জন্যই এতো তাড়াহুড়ো তোর? ভাইয়া, আমি ইমুপুর কথা আম্মাকে কবেই বলে দিয়েছি। ছবিও দেখিয়েছি। আম্মার তো আগে থেকেই পছন্দ ওকে। তুই তাড়াতাড়ি বিয়ে কর, ভাইয়া। ইমুপু আমার ভাবী হবে, ভাবতেই কী যে ভালো লাগছে আমার। কবে বিয়ে করছিস তোরা? কালকেই করে ফেল। না না,আজই কর। এক্ষুনি নিয়ে আয় ওকে। আই এম সো এক্সাইটেড।”

রেহনুমা এই চঞ্চলা মেয়েকে নিয়ে আর পারেন না। সবখানে মেয়ের অতিরিক্ত কথা। ফোন টেনে নিয়ে ধমক মারলেন কিশোরী মেঘাকে। ছেলেকে বললেন, “তোর যেটা ঠিক মনে হয়, সেটাই কর বাপ। তোর সিদ্ধান্তের উপর ভরসা আছে আমার। তুই যেহেতু বিয়ে করার কথা ভেবেছিস, কিছু একটা চিন্তা করেই ভেবেছিস। রিজিকের মালিক আল্লাহ। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শুধু মেয়েটার পরিবার থেকে কোনো ঝামেলা না করলেই হয়।”

ইমু ফোন টেনে নিয়ে সালাম দিলো উনাকে। শান্ত স্বরে বললো, “আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ঝামেলা আসলে সেটা আমি সামলে নিবো,আম্মা। আমাকে একটু আপন করে নিন আপনারা। আমি খুব একা।”

সরলা রেহনুমার চোখ ভিজে উঠে মেয়েটার কথায়। এতবড় পৃথিবীতে এইটুকুনি মেয়ে কি-না নিজেকে একা ভাবছে! তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, “তুমি একা হবে কেন, মা? তুমি একা না। আমার ছেলে থাকতে তুমি একা না। এইযে দেখো, টানাপোড়েন সংসারেও আমাদের কত সুখ। শাওনটা আছে বলেই তো। আমার শাওনের মতো মানুষ যার জীবনে আছে, সে কোনোদিন একা হয় না।”

ইমু এই প্রথম আবিষ্কার করলো,শাওন নামের বিরক্তিকর ছেলেটাকে এই মুহূর্তে ওর চমৎকার লাগছে। সারাক্ষণ জ্বালিয়ে বেরানো মানুষটার আড়ালে আছে প্রবল বলিষ্ঠ দায়িত্বশীল একটা ব্যক্তিত্ব। ইমু আরও টের পায়, তার আসলেই এখন আর একা লাগছে না। নব বন্ধনের সুতোটা কী দারুণ মায়ায় বেঁধে ফেলেছে এই অল্প কয়েক মুহূর্তে তাকে। আড়ালে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো কপালে গভীর চিন্তার ছাপ ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার পানে। আজ প্রথমবার সে খেয়াল করলো, শাওন ভাই অসম্ভব রকম সুপুরুষ।


কমলা রঙা বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নেমেছে জাদুর শহরে। চারিদিকে চেনা-অচেনা মেহমানদের বিদায়ের পালা এবার। ক্লাবের ভীর কমছে ধীরে ধীরে। কাঠপুতুলের মতো বসিয়ে রেখে একের পর এক লোকজনদের ছবি তোলার পর্ব তবে শেষ হওয়ার পথে। অসহ্য গরমে নাবিলের মেজাজ বিগড়ে আছে। পাশে বসা রমণী অকপটে খেয়াল করলো তা। সামনের ছোট্ট টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে নিরা এগিয়ে দিলো ওকে। নাবিল কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ক্ষোভ ঝারে, “এত কাহিনী করার প্ল্যানটা কার রে? তোর বাপ ভেজাল মার্কা ঢেউটিনের নিশ্চয়ই? হবেই বা না কেন! আমাকে বাঁশ না দিলে তো মামু বেটার স্বস্তি নেই। চান্দিগলানো গরমে মানুষ এসব করে? বাসায় যাইতে দিবে কখন? এই বাল পরে আর কতক্ষণ বসে থাকবো?”

“শুধু আমার বাপের না, আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী মহোদয়ের বাপেরও।”

“এক্সপেক্টেড। এদের শৌখিনতার বালাই নেই।”

রাহেলার ডাক পড়ল পরমুহূর্তেই।

“কি রে, তোরা এখনও বসে আছিস?”

নাবিল প্রবল বিরক্তির সঙ্গে বললো, “তো কী করবো? এই গরমে আর কী করা উচিত? আম্মু আর কোনোদিন যদি তোমরা এসব রংতামাশা করার উদ্দেশ্যে বিয়ের নাম নিয়েছো, খবর আছে তোমাদের। আমি আর কোনোদিনই বিয়ে করবো না।”

রাহেলা হতবিহ্বল হয়ে ছেলের পানে চেয়ে ফিক করে হেসে দিলেন৷ পরক্ষণেই বললেন, “তুই আর বিয়ে করার সাহসও করিস না,বাপ। সবাই নেমে যাচ্ছে নিচে। ওকে নিয়ে গাড়িতে বোস।”

মা’য়ের শিরোধার্য ছেলে বউয়ের হাত টেনে ধরতেই নিরা প্রবল আক্রোশ নিয়ে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিলো নিজের থেকে। নাবিল ভ্রু কুঁচকে ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো। তেজি পাখির মুখে অভিমান দেখে শুধালো, “কী?”

“তোমার বাড়িতে তুমিই যাবে। আমি যাচ্ছি না তোমার সঙ্গে। এই ছেলে, আর কোনোদিনও বিয়ে করবে না মানে কী? কয়টা বিয়ে করার উদ্দেশ্য আছে তোমার ছিল?”

নাবিল কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর হুট করে হেঁচকা টান মেরে অকস্মাৎ পাঁজাকোলে তুলে নিলো নববধূকে। হাঁটা ধরলো খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। নিরা হতবিহ্বল অবস্থায় হা হয়ে চেয়ে রইলো কেবল। এতক্ষণ ধরে গরম লাগছে গরম লাগছে বলে পুরো ক্লাব মাথায় তুলে ফেলা লোকটা কী নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রেয়সীকে কোলে তুলে নিলো ভারী শাড়ীর সঙ্গেও। কানের কাছে মুখ ডুবিয়ে বললো, “তোর জেলাস জেলাস ব্যাপারটা আমি এনজয় করি। কিন্তু আফসোস! তোর স্বামীর চরিত্র খাঁটি। জেলাস হওয়ার সুযোগ তোর নেই। নারীঘটিত বিষয় নিয়ে তোর স্বামী কেবলই ফাজলামো জানে, অন্যকিছু তার নিষ্পাপ মনে এযাবৎকালেও হানা দিতে সক্ষম হয়নি।”

নিরার চোখ-মুখ তখনও গম্ভীর। সেদিকে চেয়ে নাবিল হাসল ইশৎ। মেয়েটা বড্ড হিংসুটে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। গোয়েন্দার মতো চেয়ে থাকে সবসময়।

নিরা গাল ফুলিয়ে থেকেই গলা জড়িয়ে ধরলো ওর। পাছে নাবিলের ওকে নিতে কষ্ট না হয়। মানুষটার শুভ্র গাল বেয়ে বেয়ে টুপটাপ ঘাম পড়ছে। হাতের টিস্যুটা গালে ছোঁয়ানোর আগেই ওকে নিয়ে নাবিল গাড়ির সামনে এসে পৌঁছালো। নিজের বাপকে এদিকেই চেয়ে থাকতে দেখে বেশ বিব্রত হয় নিরা। মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো নামার জন্য। নাবিল তা খেয়াল করে ইচ্ছে করেই নামালো না। শশুরের সামনে দিয়ে ভাব নিয়ে হেঁটে কোলে করেই গাড়িতে বসালো নিরাকে। রাহেলা আড়ালে সেসব খেয়াল করে হতাশ শ্বাস ফেললেন। পাঁজি ছেলেটা আজকের দিনের ভদ্র হবে না। শশুরের সঙ্গে মশকরা করছে!

কালো টয়োটা কারের ভেতরের সফেদ আলোয় সোনালী শেরওয়ানি পরিহিত পুরো মানুষটাই জ্বলজ্বল করছে মুক্তর দানার মতো। গাড়িতে ঢুকেই প্রবল বিরক্তির সঙ্গে শেরওয়ানি খুলে ফেলল নাবিল। এসি অন করে ব্যাকসিটে মা’য়ের রেখে যাওয়া একটা সাদা ঢিলেঢালা টি-শার্ট বের করলো। চার-পাঁচ না দেখে পরলো সেটা। পাজামার নিচে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ছিল বলে ওটাও খুলে ফেললো। নিরা হতভম্ব হয়ে শুধু তাকিয়েই দেখলো এই পাগলের কান্ড। পাশে জলজ্যান্ত বউ সাজের একটা মেয়েকে নিয়ে এই ছেলে কি-না হাঁটু দেখানো প্যান্ট আর বাসায় পরার মতো টি-শার্ট পরে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার প্ল্যান করে বসে আছে? এই মাথাপাগলের সাথে কী করে কাটাবে সারাটা জীবন? বাসায় যাওয়া অব্ধি সহ্য হলো না লোকটার। কী পরিমান ধৃষ্ট!

নিরা বিরক্তি নিয়ে বললো, “এই সামান্য শেরওয়ানি তোমার সইলো না? আমারটার ওজন জানো?”

নাবিল টিপ্পনী কেটে বললো, “ব্যাপার না, তোর এসব ওজন ফোজনের ব্যাপারগুলো অভ্যাস করা দরকার। আমার দরকার নাই।”

ওর কথার অর্থ বুঝতেই নিরা বিরক্তি নিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে অন্যদিকে ফিরে বসলো। এই অসভ্য লোকের সঙ্গে আর কথা বাড়ানো উচিত না। নিরাকে অন্যদিকে ফিরে থাকতে দেখে নাবিল মিটিমিটি হাসল। টিপ্পনী কেটে হাত-পা সিটে এলিয়ে বলল, “শান্তিইইই! চাইলে কিন্তু তুইও……”

আর কিছু বলার পূর্বেই নিরা প্রবল বিরক্তি নিয়ে মুখ চেপে ধরলো ওর। অসহ্য! অসভ্য! আধপাগল!

রাত দশটা। মহাখালীর বিদঘুটে জ্যামে আঁটকে এখানেই অর্ধেক রাত পেরিয়ে যাওয়ার পথে। নাবিল এসির পাওয়ার বাড়িয়ে মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করলো। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে আসছে নিরার শরীর। নাবিল তা বুঝতে পেরে একটু নিচু হয়ে বসে নিরার মাথাটা নিজের কাঁধে এলিয়ে শুতে দিলো। ওর কাঁধে উষ্ণতা পেতেই খানিকটা আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নিরা। সেই ঘুম ভাঙল এক ঘন্টা পর। অর্থাৎ এগারোটার দিকে। একঘন্টা পর ড্রাইভারের ডাকে চোখ মেলে চায় সে। গাড়ি বাড়ির সামনে এসেছে। একটু সতর্ক হয়ে চাইতেই নাবিলের কাঁধের বদলে নিজেকে আবিষ্কার করে গাড়ির সিটে হেলান দেওয়া অবস্থায়। পাশে নাবিলকে না দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে মৃদু নড়ে উঠতেই নিজের কোলের উপর অবুঝ শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়া নাবিলের মাথার ভারটা টের পায়। বাচ্চাদের মতো নড়েচড়ে কোমর পেঁচিয়ে আবার ঘুমের দেশে নিখোঁজ ছেলেটা। গুটিসুটি মেরে নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছে নিরার কোলে। নিরা হাসল। নিজের কাঁধে বউকে ঘুমানোর জায়গা করে দেওয়ার বদলে বাচ্চা সেজে সে নিজেই ঘুমিয়ে আছে তারই কোলে। নিরা কিছুক্ষণ মন দিয়ে চেয়ে রইলো ছেলেটার সৌম্য মুখের পানে। এই ছেলেটা হাসলে কী চমৎকারভাবে নিরার পৃথিবীতে মুক্ত ঝরে। বিরক্ত হলেও লাগে অভিমানী বালকের মতো অপরুপ নিষ্পাপ। নরম আর এলোমেলো হাওয়া বয়ে আনা কোনো প্রহরের মতো বিক্ষিপ্ত চুল তার। নিরা খেয়াল করে, নাবিলের চুলগুলো খুবই গোছানো। এলোমেলো অবস্থাতেও সেগুলো কোছানোই দেখায়। এমনকি যেভাবে রাখে, সেভাবেই মানায়। লোকটার শুভ্র গালের চাপ দাঁড়িগুলোও একেবারে যেনো শিল্পির সঠিক রেখায় আঁকানো ছবি। পুরুষের রুপ নিরা এর আগে কখনোই এমন গভীরভাবে খেয়াল করে দেখেনি। তবে এই লোককে ইদানীং খেয়াল না করে পারা যায় না। সে যেনো প্রকৃত পুরুষ সৌন্দর্যের জলজ্যান্ত উদাহরণ। এত নিখুঁত সুদর্শন তার! নিরা বার বার এই মুখে চেয়ে অবাক হয়। সহস্রবার এই ভেবে বিস্মিত হয় যে, নাবিল ভাইয়ের মতো এমন চমৎকার একটা মানুষ কি-না নিরার প্রেমে পাগলপ্রায়! কী অদ্ভুত! এই মানুষটাকেই কি-না নিরা এর আগে কখনোই প্রেমের নজরে চেয়ে দেখেনি? কী করে দেখলো না? কী করে করলো এতবড় বোকামি মেয়েটা! একটু খেয়াল করে লোকটার চোখের দিকে কি তাকানো যেতো না? যেতো তো। তাকালেই তো এক পলকে ঘায়েল হয়ে যাওয়ার কথা। আফসোস! আফসোস! আফসোস! এই আক্ষেপ সে কোথায় রাখবে? অবশ্য এই ভেবে ভালো লাগছে যে, নাবিল ভাইয়ের জীবনে নিরাই প্রথম রমণী। নাবিল ভাই কেবল নিরারই প্রেমে পড়েছে। আর এই অসহ্যকর, আধপাগল, ছিটখারাপ লোকটা কেবলই নিরার। মৌখিকভাবে, লিখিতভাবে, অলিখিতভাবে, সবভাবেই শুধু নিরার। এই অদম্য তৃপ্তির প্রাপ্তি নিয়ে ইশৎ হাসল মেয়েটা। নিরার মোহভঙ্গ হয় নাবিলের মৃদু নড়েচড়ে উঠায়। চোখ মেলে নিরাকে অমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকতে দেখে কী চমৎকার করে হাসল নাবিল। উঠে হাই তুলতে তুলতে গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে মোহগ্রস্ত স্বরে বলে, “ওয়েলকাম টু ইউর অউন হোম এন্ড অউন লাইফ ওয়াইফিইইইই! লেটস লিভ টুগেদার।”

চলবে।