গল্প #রোদ_পোহাবার_ছুতোয়
#সমাপ্ত
#নাজমুন_নাহার
দুই বছর পর।
অটোয়াতে এখন মধ্যরাত। কানাডায় গ্রীষ্মকাল চলে এই সময়ে। মাঝেমধ্যে মৃদুমন্দ বৃষ্টিপাতেরও দেখা মিলে। আজও হচ্ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বারান্দায় কিশোরীসুলভ অভিমান নিয়ে একমনে বসে সেই বৃষ্টি দেখছে বর্ষা। নিভৃতে উপভোগ করছে একাকিত্বতা। মুখে একরাশ নিস্তব্ধতা আর বুকের ভেতরে প্রগাঢ় শূন্যতা অনুভুত হচ্ছে। ক’দিন ধরে এমনিতেও মনটা ভীষণ খারাপ তার। সময়ে-অসময় মুড সুইং, শরীর খারাপের ব্যাপারটাও ঘনঘন ঘটছে। এই অচেনা শহরে চারমাস হলো মেয়েটার পদার্পণের। এর মধ্যে কেবল তিনবার নিলয় ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে। বাকি দিনগুলোতে বোবা প্রাণীর মত সারাদিন বাসায় একা একা বসে থাকা। পরিবার ছেড়ে, মাতৃভূমি ছেড়ে একটা ভিন্ন দেশে এসে শূন্য ঘরে একলা একা সারাদিন পড়ে থাকতে কার ভালো লাগে? তা-ও নিলয় বাসায় থাকলে মনটা কিছুটা হালকা থাকে। সে ওর মন ভালো রাখার সুযোগ পেলে একরত্তি প্রচেষ্টাও ছাড়ে না। ছেলেটার ব্যস্ততা আর দূরে দূরে থাকাটা ইদানীং বর্ষার আর ভালো লাগে না। কেন এত ব্যস্ত থাকতে হবে উনাকে? কেন সব কাজটাজ বাদ দিয়ে সারাবেলা বর্ষার সঙ্গে গল্প করা যায় না? নিলয় কি বুঝে না মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে? প্রিয় মানুষরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে পৃথিবীটা এত অসহ্য হয়ে উঠে কেন! রাগে-দুঃখে ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে ঘরে ফিরে এলো বর্ষা। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসলো। নিলয় ঘুমিয়ে আছে পাশে। বর্ষার খুব ইচ্ছে করছে ওকে জাগিয়ে সারারাত গল্প করতে। কিছুক্ষণ ঘুমন্ত মুখটায় চেয়ে আবার মায়াও হলো ভীষণ। সারাদিন কাজ করে খুব ক্লান্ত হয়ে আছে নিশ্চয়ই। হৃদয় কোমল করে কপালে হাত বুলাতেই চোখ তুলে চায় নিলয়। ওকে জেগে থাকতে দেখে চমকানো ভঙ্গিতে উঠে বসে সহসাই। উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে থেকে গালে হাত রেখে শুধায়, “কী হয়েছে তোমার? চোখ ফুলে এ কী অবস্থা! কেঁদেছ?”
নারীসুলভ অভিমান ভেঙে মুহূর্তেই চোখ ভিজে এলো মেয়েটার। ঝরঝর করে কেঁদে অকস্মাৎ বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নিয়লের। তুমুল মন খারাপের স্বরে বললো, “আমার বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। বড় মা’কে, সাগরকে খুব মিস করছি। এখানে একটুও ভালো লাগছে না। আমাকে দেশে নিয়ে চলুন।”
নিলয় নিঃশব্দে মাথায় হাত বুলিয়ে অভিমান, অভিযোগ ঝাড়তে দিলো ওকে। অসম্ভব অনুশোচনায় বুকটা ভার লাগছে কেমন। আসার পর থেকে অফিসে কাজের চাপটাও আগের চেয়ে বেড়েছে। চেয়েও মেয়েটাকে সময় দিতে পারছে না সে। দু’বার বসের সঙ্গে কথা বলেছে এই নিয়ে। বহু কাহিনীর পর গতকালই ছুটির জন্য রাজী হলো। আগামীকাল কাজটা করতে পারলেই একমাসের জন্য ছুটি। ভেবেছিলো আগামীকাল কাজ থেকে ফিরেই সারপ্রাইজ করবে ওকে। কিন্তু এই মেয়ে তার আগেই নিঃস্বের মতো দুঃখবিলাস শুরু করেছে।
নিলয় হেসে চোখ মুছিয়ে দেয় অভিমানিনীর। বলে, “তুমি আমার সঙ্গেই তো আছো, বর্ষা। দেশে যাওয়ার কী প্রয়োজন? আমি যেখানে থাকবো, সেখানেই তোমার ঘর। মানছি, এই মাসে কাজের চাপটা একটু বেশিই থাকবে। তবে সারাবছর কোম্পানিতে একইরকম প্রেশার থাকে না। তাকাও লক্ষীটি, ক’টাদিন গেলেই সব নরমাল লাগবে। মন খারাপ করে না।”
বর্ষা কান্না থামিয়ে টি-শার্ট খামচে ধরলো ওর। হিচকি তুলে বললো,
“আপনি খুব খারাপ। আপনি….আপনি আগের মতো একটুও ভালোবাসেন না আমায়। মুখে মুখে দরদ ঢেলে বিয়ে করে এখন শুধু কষ্ট দিচ্ছেন। আমার সারাদিন মন খারাপ থাকে। কেন এত ব্যস্ত থাকতে হবে আপনাকে? ক’টাদিনের জন্য ছুটি নিতে পারছেন না?”
নিলয় হাসে মেয়েটার বাচ্চাসুলভ অভিযোগ শুনে। ঠোঁট উল্টানো বর্ষার চোখে চেয়ে বলে, “নিলাম তো।”
মাথা তুলে অবাক দৃষ্টিতে চায় বর্ষা। “মানে!”
নিলয় চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,”মানে আগামীকাল কাজটা করতে পারলেই একমাসের জন্য ছুটি। এর জন্য এভাবে নিঃস্ব রমণীর মতো কেঁদেকেটে চোখ ফুলাতে হয়? প্রবাসীর বউ না তুমি। বি স্ট্রং। ছুটি নিয়েছি। আমি তো জানি আমার বউয়ের এখন আমাকে দরকার। খুব দরকার।”
বর্ষা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে চোখে চোখ রাখে ওর। নিলয়ের ঠোঁটে আনন্দের হাসি। তৃপ্তির একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বললো, “আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে, তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো আমার কাছ থেকে। খুব বিশেষ কিছু। আমি উপলব্ধি করতে পারছি সেটা। সত্যি করে একটা কথা স্বীকার করো তো, আর ইউ প্রেগন্যান্ট?”
মেয়েটা আবারও চমকায়। চোখ ছোট ছোট বেশ কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থেকে শুধায়, “আপনি জানেন?কীভাবে বুঝলেন?”
তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বিজ্ঞের মতো হেসে নিলয় বলে, “তুমি তো আর বাচ্চাকে বিয়ে করোনি, জানেমান। গুনে গুনে আট বছরের বড়ো তোমার থেকে আমি। তোমার শরীরটা আমার পরিচিত। এই শরীরের পরিবর্তনগুলোও তা-ই সবার আগে আমারই নজরে আসার কথা। তাছাড়া লাস্ট দুইমাস ধরে তুমি আমাকে সেনিটারি প্যাড কেনার কথা বলছো না। এটাও এনাদার ক্লু।”
“তাহলে জিজ্ঞেস করলেন না কেন এতদিন?”
“জিজ্ঞেস করলে আমি এটা জানার পরও কেন ছুটি নিচ্ছি না ভেবে তুমি নিজে নিজে কষ্ট পেতে। এই নিয়ে মানসিক চাপ পড়ে যেতো আমার উপর। তবে তোমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা কনফার্ম হওয়ার পর থেকেই ছুটির জন্য এপ্লাই করেছি, বিশ্বাস করো। বস বেটা কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না। আমি এতদিনে এসে বুঝলাম, কেন বাঙালী প্রবাসী প্রেমিকরা ওদের প্রেমিকাদের এত লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করায়।এই ভীনদেশীরা আসলে বাঙালির মতো সেন্টিমেন্টাল না। এরা ইমোশনটা কম বুঝে। যান্ত্রিক মস্তিষ্ক। তাই আবেগটা বোঝাতে এতদিন লেগেছে।”
বর্ষার অনুশোচনা হলো বেশ। মানুষটা ওকে সময় দেওয়ার জন্য এতো চেষ্টা করে যাচ্ছে আর সে কি-না তাকে ভুল বুঝে নিজে নিজে কষ্ট পাচ্ছিলো।
“সরি!”
নিলয় হাসে। “সরি কেন?”
বর্ষা প্রতুত্তর না করে আবদার করে, “আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। একেবারে শক্ত করে ধরবেন।”
নিলয় ওর মাথাটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “উঁহু, শক্ত করে তো আর ধরা যাবে না এখন থেকে। আমাদের বাবুটা ব্যথা পাবে। ওকে ব্যথা দেওয়া কিছুতেই যাবে না।”
বর্ষা ওর পুরুষালী প্রসস্থ বুকে নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাসে প্রাণ ভরে। বলে, “আমার এখন নিজেকে খুব সুখী সুখী মনে হচ্ছে। এতদিন অভিমান থেকে চেপে গিয়েছিলাম কথাটা। এখন মনে হচ্ছে, কেন আগে জানালাম না আপনাকে। আপনি যেভাবে আমাকে বুঝেন, আমি আপনাকে ওভাবে বুঝতে পারি না নিলয়। শুধু ভুল বুঝি।”
নিলয় চুপচাপ শুনে হাসে। বলে, “তোমার অভিমান করার অধিকার আছ, বর্ষা। তুমি অনেক কিছুই প্রাপ্য আমার কাছ থেকে। আশানুরূপ কিছুই করতে পারছি না তোমার জন্য। তবে চিন্তা করো না। এই জবটা আমি এমনিতেও আর বেশিদিন কন্টিনিউ করবো না। তোমাকে সময় দিতে না পারলে আমার এত কাজ দিয়ে কী হবে? অনেক আশা নিয়ে আমার হয়েছো। তোমাকে ভালো রাখাটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। মোটা অঙ্কের সেলারির চাকরি নিয়ে চিন্তা নেই। আরেকটা জব পেয়েছি, সেলারি খারাপ না৷ আমাদের তিনজনের সংসার বেশ আয়েশ করেই কেটে যাবে।”
বর্ষার বুক ভার হয়ে আসে অদ্ভুত এক সুখ সুখ প্রশান্তিতে। সে প্রতুত্তর করে না। নিশ্চুপ মাথা গুঁজে রাখে তার প্রিয় পুরুষের বক্ষপিঞ্জরে। অনুভব করে, এই ছেলেটা তার জীবনে না এলে পৃথিবীটাকে আজীবনই ভীষণ রঙচটা লাগতো। সে মাথায় হাত না বুলালে বহু অভিমান, অভিযোগ এমনিতেও কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো তার সরল নারী সত্তাকে। এই মানুষটার সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে দেখা হওয়াটা বর্ষার জীবনে সবচেয়ে সুন্দরতম ব্যাপার। বর্ষা ভাবে, নিলয়ের সঙ্গে তার কখনোই তো দেখা হওয়ার কথা ছিলো না এভাবে। বিধাতা বুঝি এমনই কাকতালীয়তায় মনুষ্য প্রাণের মিলন ঘটিয়ে থাকে। যার সঙ্গে যার গন্তব্য, পৃথিবীর অপরিচিত কোণ থেকে হলেও তাকে উঠিয়ে এনে দেখা করান। জোড়া মিলিয়ে থাকেন এভাবেই। আকস্মিক ঘটনায়, দমকা হাওয়ার মতো!
—-
থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে ভোর থেকে। আষাঢ়ের পুরোটায় নীরব বর্ষণ চললেও শ্রাবণে তা রুপ নিয়েছে ‘ক্যাটস এন্ড ডগ’ হয়ে। গত তিনদিন ধরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরে কাশি বাঁধিয়েছে শাওন। ছেলেটা ইদানীং যা হারকিপ্টে হয়েছে। অসুখ-বিসুখ হলে থম মেরে শুয়ে কাজে চলে যাবে। ডাক্তার ফাক্তার দেখাতে তার যত কিপ্টেমি। ইমু রাত থেকে কানের সামনে ঘেনঘেন করে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। তবে এই ছেলের হেলদোল দেখা গেলো না বিশেষ। সাধারণ জ্বর, সেরে যাবে। এইটুকুনির জন্য ডাক্তার ফাক্তার দেখিয়ে কাজ নেই। কিন্তু ইমু তো ইমুই। সে তো আর ছাড়ার পাত্রী নয়। আজ যে ডাক্তার না দেখিয়ে বাসায় ফিরলে তার রক্ষা নেই, সেও বোধকরি শাওন বেচারা হারে হারেই জানে।
গ্যাসের চুলায় গরম পানি দবদব করে ফুটছে। দুই চামচ চা ঢেলে ইমু হাঁক ছাড়ল, “আপনার ছেলে গোসল করে বেরিয়েছে, আম্মা? মেঘার নাশতাটাও একসাথে দিয়ে দেই।”
রেহনুমা ব্লাউজে সুই চালাতে চালাতে বললেন, “মেঘার তো আজকে কলেজ বন্ধ , মা। এই মেয়ে আজ বারোটার আগে উঠবে না। আমি আর তোমার শশুর নাশতা করেছি। শাওনকে দিয়ে তুমিও বসে পরো ওর সাথে।”
খাবার টেবিলে বসেও একনাগাড়ে কেশে যাচ্ছে শাওন। ইমু কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো। বিরক্ত বিরক্ত মুখ করে ঘর থেকে ফিরে আবারও বসলো সামনে। হাতে মুঠো করে রাখা এক হাজার টাকার তিনটি নোট বের করে ওর বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে ধমকানোর স্বরে বললো, “এই তুমি এতটা হারকিপ্টে কী করে হলে? তোমার রোজগার কম? নাবিল ভাইয়ের শপে ম্যানেজিং পোস্টে চাকরি হওয়ার পর থেকে তো আমাদের আর কোনো অভাব নেই। তোমার মাসিক যা বেতন তার থেকে পুরো মাস সংসার আরামসে চালিয়েও আরও অর্ধেক থেকে যায়। আমার কোনো কথাই কানে যায় না তোমার, তাই না? তুমি কোন ধাঁচের পুরুষ গো? নিজের জন্য ভালো একটা শার্টও কিনতে ইচ্ছে হয় না? ডাক্তার না দেখিয়ে কাশিটার দশাও করেছে নাস্তানাবুদ। আজকে যদি ডাক্তার না দেখিয়ে ফিরেছো, খবর আছে তোমার।”
চলন্ত রেলগাড়ীর মতো এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললো ইমু৷ শাওন সভ্য স্বামীর মতো স্ত্রীর সকল শাসনই চুপচাপ শুনলো। একদৃষ্টে ইমুর রাগী রাগী মুখে চেয়ে থেকে শেষে একটু হেসে জানতে চাইলো, “টাকা পেলে কোথায়?”
“জাহান্নাম থেকে।” ইমুর কাটকাট জবাব
ঠোঁট টিপে হাসল শাওন। সে জানে ইমুকে ও যে টাকা দেয়, সেটা সে কখোনও আজেবাজে ব্যাপারে খরচ করে নষ্ট করে না। মেয়েটা নিজেও বেশ সাংসারিক আর সঞ্চয়ী। শাওন দুষ্টুমি করে টিপ্পনী কেটে বললো, “জাহান্নামে আমার বউয়ের জন্য টাকা-পয়সা কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি রেখে দিয়েছে বলো তো? মানবতার এমন বিরল দৃষ্টান্ত দেখে ভারী অবাক হচ্ছি। তাছাড়া তুমি নিজেকে এতো পাপী কেন মনে করছো,সোনা? খামোখা জাহান্নামে কেন যাবে তুমি! তোমার স্বামী তোমার উপর পূর্ণ সন্তুষ্ট। স্বামীকে যে ভালো রাখে? আল্লাহ তাকে খুব পছন্দ করে। চিন্তা করো না, স্বামীর দোয়ায় জান্নাতেই যাবে তুমি।”
ইমু অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আবারও। জবাবে প্রসঙ্গে পাল্টে বললো, “লাঞ্চে কী দিবো আজকে?”
“তোমার তাতানো ঝাল ঝাল ঝাড়ি আর রুপের আগুন। উইদ্ এক্সট্রা সস।”
রেগে যেতে নিয়েও অকস্মাৎ হেসে দিলো ইমু। অল্পতে সুখী হওয়া নরম হৃদয়ের পুরুষের নিষ্পাপ মুখে চেয়ে বললো, “আজ বিরিয়ানি রান্না করবো, রাতে তাড়াতাড়ি এসো।”
“আজ তো কাজের প্রেশারটা বেশি, বিবিজান। তোমার বান্ধবীর তো আজকে জন্মদিন। বান্ধবীর জামাই সম্ভবত তার জন্য কিছু একটা প্ল্যান করেছে। প্রাণের বন্ধুর চিন্তা কমাতে আমাকে আজকে একটু দেরি করে আসতে হবে। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো।”
ইমু ক্যালেন্ডারে খেয়াল করে চোখ বুলিয়ে দেখলো, আজ জুলাইয়ের ৬ তারিখ। সাংসারিক ব্যস্ততায় নিরার জন্মদিনের কথাটা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। উইশ করা হয়নি ওকে।
“কখন ফিরবে?”
“বারোটা তো বাজবেই।”
“ঠিক আছে। তুমি কাজ সেরেই এসো, আমি অপেক্ষা করবো।”
শাওন হতাশ শ্বাস ফেলে ব্যস্ত হয়ে টেবিল গোছানো ইমুর দিকে চায় শান্ত নয়নে। মেয়েটাকে হাজার বলেও ফায়দা হবে না, সে জানে। বিয়ের পর থেকে এই মেয়ে কখনও শাওনকে ছাড়া রাতের খাবার খায় না। মাঝ রাত হলে সে সেই পর্যন্তই না খেয়ে বসে থাকবে। মেয়েটার পেলব মুখখানায় তাকালে শাওনের মাঝেমধ্যে খুব মায়া হয়। বিনা অভিযোগে, বিনা চাহিদায় কতো সহজভাবে সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়েছে ইমুটা। মুহুর্তেই মনে পড়ে গেলো ওকে প্রথম দেখার দিনটার কথা। সেদিন প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ইমুদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম ছিলো ক্যাম্পাসে। সবুজ রঙের একটা জামদানী শাড়ী পরে বান্ধবীদের সঙ্গে সে কী আড্ডা, হাসি তার। পৃথিবীর সকল নীরবতা ভেঙে খিলখিল করে হাসছিলো মেয়েটা। চঞ্চলার ওই হাসির শব্দটুকুও ভ্রমের মতো টানছিলো তাকে। দূর থেকে গোপনে পুরোটা সময় এই মেয়ের আশেপাশে ঘুরেছে শাওন। কখনও মুচকি হেসেছে তার হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তবে কোনোদিন কি ভেবেছিলো এই দস্যি মেয়ে ইমু তার ঘরণী হবে? ভেবেছিলো কি, নাকের ডগায় তেজের প্রলেপ ছাপানো মেয়েটাও শান্ত নদীর মতো সামলাবে শাওনের ছোট্ট সংসার, ছোট্ট জীবন? ভাবেনি। প্রকৃতি অনেকসময় আমাদের ভাবনার গন্ডি পাড় করেই বহু কিছু ঘটিয়ে ফেলে। অপ্রত্যাশিত স্বপ্নগুলোও কেমন নিঃশব্দে পূরণ করে দেয়। কোনো চড়াই-উতরাই ছাড়াই কেউ কেউ পায় ভালোবাসার মতো ভালোবাসা! যেমনটা পেলো শাওন। তার অগোছালো ঝাপসা জীবনে পেলো একটা মায়া মায়া চোখের পাখিকে। শাওনের ইমুপাখিকে!
——–
তাড়াহুড়ো করে কোনোমতে শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে নিরা ছুটলো মেয়ের জন্য সেরেলাক বানাতে। আজ একমাস হয় বুকের দুধ ছেড়ে মেয়েকে সেরেলাক খাওয়ানো ধরেছে সে।
শাশুড়ীর ঘরের সামনে এসে বাহির থেকে উঁকি মেরে দাদীর-নাতনীর খুনসুটি দেখে নিলো এক ঝলক। নিভৃতা দাদীর ঘরেই কাটায় সারাদিন ইদানীং। নিরাকে বাটি সমিত সেরেলাক নিয়ে সেখানেই খাওয়াতে হয় বসে। মেয়েটা তার শাশুড়ীর নেওটা হচ্ছে দিন দিন। রাহেলাও যেনো নাতনিকে চোখে হারান একেবারে। নিরা হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো দু’জনের। নিরাকে দেখে রাহেলা খুশি হলেও হাতে খাবারের বাটি দেখে নিভৃতার মুখে কঠিন অমাবস্যা। মেয়েটা হারে হারে বুঝে যায় সব। রাহেলা ছেলের বউয়ের দিকে চেয়ে তাগাদা দিয়ে বললেন, “কী রে, কখন বের হবি তোরা? আকাশের অবস্থা দেখেছিস? আমার ছেলেটার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। দেখি, ফোন দে ওকে।”
নিরা হাসল। বাটিতে চামচ ঘাটতে ঘাতটে বললো, “ব্যস্ত হইয়ো না, ফুপ্পি। শপে কাজের চাপটা ইদানীং একটু বেশিই। শাওন ভাইকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েই বের হবে। এমনিতেও আমরা তো আজ আর ফিরছি না, অতো তাড়াহুড়োর কাজ নেই।”
মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য চামচ নিয়ে মুখের সামনে ধরতেই নিভৃতা সজোরে মাথা নেড়েই চলেছে। সে আজ কিছুতেই এসব সাদামাটা বিচ্ছিরি খাবার খাবে না। খাবে না খাবেই না। বাবা থাকলে অবশ্য ভালো হতো। বাবা নিভৃতাকে না খেলে কখোনই বকে না। মা টা বকে। মা খুব পঁচা।
নাতনির আচরণ দেখে হাসলেন রাহেলা। আদুরে, আহ্লাদী গলায় বললেন, “খেয়ে নাও, বোনু। খাওয়া শেষ হলে আমরা সারাদিন খেলবো, কেমন? আম্মু আজকে সারাদিন তোমাকে বিরক্ত করবে না। ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছি আজকের জন্য।”
নিভৃতার মন দাদীর সান্ত্বনা বানীতেও গললো না। হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাটিটা ফেলে দিলো মেঝেতে। নিরা হতাশ শ্বাস ফেলে চাইলো জেদি মেয়ের পানে। প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে গিয়েছে এই মেয়ের। খাওয়া নিয়ে তার যত অসন্তোষ। রাহেলা ছেলের বউয়ের মেজাজ বুঝে বাটিটা তুলতে তুলতে বললেন, “দে,আমি নিয়ে আসছি।”
দাদী যেতেই নিভৃতা অতি নিষ্পাপ, ভোলাভালা মুখ করে মা’য়ের পানে চায়। নিরাও মেঝে পরিস্কার করতে করতে আড়ালে মেয়ের পানে কঠিন দৃষ্টিতে চাইলো। বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে থেকে অকস্মাৎ হেসে দিলো মেয়েটার কৌশলী মুখে চেয়ে। দাদী যেতেই কী ভোলাভালা নাটক করছে দেখো। হুবহু বাপের কার্বন কপি। বাপের চেয়ে কম নাটক জানে না।
রাহেলা বাটি নিয়ে খাটে বসতে বসতে বললেন, “সেরেলাক তো শেষ হয়ে গেলো। এক সপ্তাহ আগেই তো আনলি, এরই মধ্যে শেষ হওয়ার তো কথা না। এই বৃষ্টিতে এখন কাকে পাঠাবো?”
নিরা সরলা শাশুড়ীর পানে চেয়ে বললো, “যে গিলেছে তাকেই আনতে বলো।”
রাহেলা বিভ্রান্ত হয়ে চাইলো। “যে গিলেছে মানে! তুই আমার নাতনিকে খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছিস?”
“তোমার নাতনিকে কেন খোঁটা দিতে যাবো? ঘরে তো আর বাচ্চা একটা না, ফুপ্পি। দুই দুইটা বাচ্চা। একটা সাত মাসের, আর আরেকটা সাতাশ বছরের। তোমার বড়ো পাঁজি বাচ্চাটা আমার মেয়ের অর্ধেক পাউডার দুধ, সেরেলাক গেমস খেলতে খেলতেই সাবার করে ফেলে।”
রাহেলা অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে না হেসে পারলেন না। হাসতে হাসতে চোখের কোটরে পানি জমার উপক্রম। ছেলের এসব বাচ্চাসুলভ স্বভাবের কথা শুনে পুরোনো নাবিল সত্তাকে খুঁজে পেলেন। এই ছেলে বাপ হয়েও ছেলেমানুষী ছাড়ছে না।
রীতিমতো কাকভেজা হয়ে এগারোটা নাগাদ বাসায় এসে পৌঁছালো নাবিল। দরজায় বেল পড়তেই নিভৃতা উৎসুক হয়ে চায়। সে জানে, দরজায় বেল পড়লে তার বাবা-ই আসে। মেয়েটা দাদীর কোলে বসে থেকেও দরজার পানে চেয়ে অপেক্ষা করছে বাবা-র আগমনের। ঘরে ঢুকেই এসপারওসপার না দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করতে করতে নাবিল বললো, “গোছগাছ শেষ? আমার মেয়েকেও রেডি করা।”
নিরা দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে বলে, “ওকে না বাসায় রেখে যাওয়ার কথা? এই বৃষ্টিবাদলের দিন মেয়েটাকে বাইরে নিয়ে যাবো?”
“কিচ্ছু হবে না। তুই রেডি করা। ওকে এখানে রেখে গিয়ে আমার মন টিকবে না।”
৪০ কিমি গতিতে নাবিলের লাল রঙের **** গাড়িটা চলছে অজানা গন্তব্যের দিকে। নিভৃতা গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতটা খুব কাইকুই করে মা’কে জ্বালিয়েছে সে। নাবিল স্টিয়ারিং থেকে চোখ ঘুরিয়ে মা-মেয়ের পানে চাইলো তীক্ষ্ণ চোখে। নিরা নিজেও সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। ক্লান্ত লাগছে ওকেও। নাবিলের পাঁজি মেয়েটা তার লক্ষী বউটাকে ভীষণ রাত জাগাচ্ছে আজকাল। মেয়ের আদুরে মুখখানায় চেয়ে হাসল মৃদু। মেয়েটার চেহারা একবারে নাবিলের। এই নিষ্পাপ, শান্ত ঘুমন্ত মুখটাই না-কি তার স্ত্রীকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায়। নিজের মেয়ে না হলে তার বউকে জ্বালানোর অপরাধে নাবিল ঠিকি এটাকে মা’য়ের রুমে সিফ্ট করিয়ে দিতো। এই মেয়ে বাপের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। বাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালায়। বাপ-মেয়ের মধ্যে প্রতিনিয়ত গোপন যুদ্ধ চলে এই নিয়ে। তাদের দু’জনেরই এক দাবী, নিরার সকল মনোনিবেশ হওয়া চাই কেবল তাদের মধ্যে যেকোনো একজনের তরেই।
টানা দু’ঘন্টা জার্নির পর ওরা এসে পৌঁছায় কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় অবস্থিত একটা প্রত্যন্ত ‘সাতগাঁও’ নামের গ্রামে। গাড়ি থেকে নামার আগ পর্যন্তও নিরা জানতো না ওরা কোথায় যাচ্ছে। নাবিল বলেনি সেসব। গ্রামটা অদ্ভুত সুন্দর। এত সবুজের সমারোহ, পাখির কলরব দেখে নিরা বেশ বিভ্রান্ত হয়। কোথায় এলো বোঝার উপায় নেই। নাবিল লাগেজ নামিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরলো আপন মনই। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাবিল হাসল মৃদু। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো, “দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? আরও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি।”
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একজন অল্পবয়সী তরুনসহ দু’জন লোককে আসতে দেখা গেলো। একজন মহিলাও এলো। সম্ভবত সকলে একই পরিবারের। ওরা এসেই নিভৃতাকে কোলে নিয়ে নিলো। নাবিলের হাত থেকে লাগেজ টেনে নিতে নিতে মধ্যবয়ষ্ক লোকটা নিরার পানে চেয়ে হেসে বললো, ” ভালো আছো, আম্মা?”
নিরা অপ্রস্তুত হেসে উত্তর করলো। তখনও সবকিছু কেমন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে তাদের বাসায় খাওয়াদাওয়া সেরে ওদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বের হয়। একটা ডিঙি নৌকায় চড়ে, এলোমেলো হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে বৈঠা চলছে বিশাল জলরাশি এগিয়ে। সন্ধা হয়ে এসেছে প্রায়। দূরে কোথাও বিলের মাঝখানে সবুজঘেরা একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। ঘর কম, সবুজটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। বর্ষার অথৈজলে চারপাশ ফুলেফেঁপে টইটম্বুর, অথচ মাঝখানে কেবল একখানাই উঁচু ভিটে। সেই ভিটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বাড়িখানা যেনো জলের রাজ্যে কোনো বিচ্ছিন্ন স্বাধীন দ্বীপ। নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা। নিরা তখনও চুপচাপ বসে সবকিছু অনুভব করছে। প্রকৃতির এহেম শীতলতা তাকে আর প্রশ্ন করার ফুরসত দিচ্ছে না। নৌকাটা একটু একটু করে যত বাড়িটার নিকটে আসতে শুরু করেছে, তত বাড়ির উঠোনের আয়তনটা বড়ো মনে হচ্ছে। পাড়ে এসে খুব সাবধানে নেমে দাঁড়ায় ওরা। নৌকায় যে দু’জন ওদের সাথে এসেছিল তারা সবকিছু ওদের বুঝিয়ে দিয়ে নৌকা সমিত আবার ফিরে গেলো ওপারে।
বাইরের কমলা রঙা বাল্বের আলোয় নিরা ঘুরে ঘুরে পুরোটা জায়গা দেখলো। প্রায় তিরিশ শতাংশ জায়গার উপর ছোট্ট কুঁড়েঘরটার অবস্থান। ঘরের সামনে বিশাল বড়ো উঠোন। তার সামনে একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের সিঁড়িগুলোতেও খুব সুক্ষ নব্বই দশকীয় ব্যাপার উপলব্ধি করা যাচ্ছে। নাবিল মেয়েকে ঘরে নিয়ে শোয়াতে শোয়াতে নিরা আরেকবার ঘুরে ঘুরে দেখলো সব। বাড়ির সামনের দিকের বাগান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজতে গুঁজতে প্রশান্তির শ্বাস টেনে ঘরে ঢুকলো। খুব একটা নান্দনিকতার ঝঞ্জাট নেই সেখানে। ঘরের বিছানা, পালঙ্ক, জানালা, দুয়ার সবকিছুতেই অদ্ভুত এক সারল্যভাব। নিরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো ঘরের মাটি, বাঁশ, খড়-কুটার দেয়ালগুলো। আশ্চর্যজনক মাটি মাটি সরল প্রশান্তির সুভাস এতে। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের কলমের শিল্পে এসব বাড়িকেই তো দারিদ্র্যতার বদলে শান্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। চিহ্নিত করেন সহজ জীবন, ভালোবাসার আশ্রয় হিসেবেও। এসব দেখতে দেখতে অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে নিরার চোখ ভিজে এলো। অতিরিক্ত আনন্দের দরুন বুক চিরে অচিরেই কান্না বেরিয়ে আসতে নিতেই একটা শক্তপোক্ত হাত পেছন থেকে খুব দায়িত্ব নিয়ে আলিঙ্গন করে না রুখে দিলো। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে গভীর স্বরে শুভেচ্ছা জানানোর স্বরে বললো,
“শুভ জন্মদিন!”
নিরা ঘাড় ঘুরিয়ে চায় নাবিলের সৌম্য, সুদর্শন চেহারায়। নাবিল হেসে পকেট থেকে একটা সোনার চিকন বিছা বের করে শাড়ীর ভাজে হাত ঢুকিয়ে নিরার কোমরের পরিয়ে দিলো সেটা। প্রবল উত্তেজনায় মেয়েটার নয়নের সুখের জোয়ার বাঁধ মানছে না কিছুতেই। নিরা আকস্মিক ওর বুকের উপর হামলে পড়ল। অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে নাক টেনে বললো, “আমার জন্মদিন ছিলো আজ?”
নাবিল ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বলে,
“জন্মদিনের উপহার পছন্দ হয়েছে? তোর স্বপ্ন ছিলো এসব। একটা নির্জন দ্বীপের মতো আটপৌরে বাড়ি, ছোট্ট নিজস্ব পুকুর, মাটির মেঝে, অথৈজল, কাঠ- কঞ্চির জানালা, সোঁদা মাটির ঘ্রাণ, ফুল, সবুজ….বৃষ্টি! টানা দেড় বছর লেগেছে আমার বাড়িটাকে মনের মতো করে গোছাতে। আমাদের বিয়ের পরপরই অনেক বেছে বেছে আমি এই জায়গাটা কিনেছিলাম। এখানে প্রথমদিন এসেই মন আঁটকে গিয়েছিলো। তোর যে জায়গাটা পছন্দ হবে, সেটাও নিশ্চিত ছিলাম। বাকি কাজ সব আম্মুই করেছে। আমি শুধু প্ল্যান দিয়েছি, আর আম্মু এখানে সশরীরে এসে সেটা এক্সিকিউট করেছে। কেমন সলিড শাশুড়ী পেয়েছিস দেখ। আর কেউ করবে ছেলের বউয়ের জন্য এতকিছু?”
নিরা ফিক করে হেসে দিলো হঠাৎ। আবারও কাঁদতে কাঁদতে ঠোঁট উল্টালো। হিচকি তুলে বললো, “আমার ফুপ্পিকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে খুব। তুমি কেন ফুপ্পিকে একলা রেখে এলে?”
নাবিল হাসে। “তোর ফুপ্পি ছেলে আর ছেলের বউয়ের ব্যক্তিগত মুহূর্তে তদারকি করতে চায় না। মহিলাকে অনেক বলেও রাজী করাতে পারিনি। আমার শশুরটার মতো তার বোনটাও বড্ড একঘেয়ে।”
ততক্ষণে নিভৃতার ঘুম উবে গিয়েছে পুরোপুরি। বাসার সাদা সাদা দেয়ালের বদলে চোখ মেলে নিজেকে সে আবিষ্কার করলো অদ্ভুত এক জায়গায়। কৌতুহলে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে আকস্মিক চিৎকার করে উঠলো। নিরা দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিলো। নাবিল কোথা হতে একটা কেক বের করে তার উপর একটা ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে বিছানার উপর রাখতে রাখতে মেয়েকে কোলে নিয়ে বললো, “ক্যান্ডেলে ফু দাও তো, বাবা। আজ তোমার আম্মুর জন্মদিন। সে তোমাকে নয়মাস খুব কষ্ট করে তার নাজুক পেটে সামলেছে। আমার ছোট্ট বউটা তোমার জন্য কত কষ্ট করেছে। তোমার বাবাকে, তোমাকে,তোমার দাদীকে যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, আজ সে-ই মহীয়সী রমণীর জন্মদিন। তোমার বাবা-র মতো একটা আধপাগল ছেলেকে যে সহ্য করতে পছন্দ করে, আজ সেই চমৎকার রমণীর জন্মদিন। চলো আমরা তোমার মাম্মামকে উইশ করি। ফু দাও।”
নিভৃতা বাবা-র ইশারা বুঝে অপরিপক্ক ঠোঁটে ফু দেয় ক্যান্ডেলে। মেয়ের এই পাখির ঠোঁটের হাওয়ায় এই মোম যে এযাবৎকালেও নিভবে না, তা নিরা ভালোই বুঝলো। স্বামীর হাতের উপর হাত রেখে নিজেই ফু দিয়ে নেভালো তা। ক্যান্ডেলটা নিভে যেতেই বাবা-মেয়ে একত্রে মহা আনন্দ নিয়ে হাত তালি দিতে লাগলো। নিভৃতা দেখলো, বাবা কী চমৎকারভাবে মাম্মামকে নিয়ে কেক কাটছে। কী যেনো বুঝে এক গাল হাসল মেয়েটা। বাবা-মা’কে এত খুশী দেখে তার ভীষণ ভালো লাগছে।
কাঁচা বাজারের সবকিছুই আগে থেকে রাখা আছে এখানে। নিরা গ্রাম্য গিন্নীর মতো কোমরে আঁচল গুঁজে রাতে মাটির চুলোয় ভাত, ডাল, ডিম ভাজা রান্না করলো। রান্না শেষে আয়েশ করে খেলো দু’জনে। নিভৃতাকে ঘুম পাড়িয়ে মধ্যরাতে দু’জনে বসলো পুকুরঘাটের পাকা সিঁড়িতে। দক্ষিণা হাওয়ায় উড়ছে নিরার সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ীর আচল। চারিদিকে শুনশান নীরবতা আর অদ্ভুত কালো অন্ধকার। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে পেলব গায়ে। তবুও যেনো পৃথিবীর কোনো অশরীরিদের ভয়ই নিরাকে ছুঁতে পারলো না। ঘিরে ধরলো না কোনো আতঙ্ক, চিন্তা। পৃথিবীটাকে আজ বড়োই মধুর লাগছে। কেননা তাকে শক্ত হাতে সামলে রেখেছে একটা নিরাপদ জাদুর পুরুষ। তার সামলানোর হাত নিরার সকল চিন্তা মুছে দেয়। মানুষটা নিজের কাঁধে ওকে মাথা রাখার জায়গা করে দিয়ে বলে, “তোর কল্পনার জগতটা অসম্ভব সুন্দর। আগে যখন এসব ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতি, উদ্ভট মনে হতো। তবে এখন মনে হচ্ছে, তোর স্বপ্নগুলো সাধারণ হলেও এতে স্বর্গীয় আনন্দ লুকিয়ে আছে। এই সাধারণ একটা বাড়িতে আমার যে কখোনও মন টিকবে, আমি জানতাম না।”
নিরা হাসে। চোখ বুঁজে বলে, “আমার স্বপ্নগুলোর বাস্তবতাও এত স্বর্গীয় হতো না, যদি না তুমি পাশে থাকতে। তুমি আছো বলেই আজ সব রঙীন। এই ইচ্ছেগুলো অন্য কারো সঙ্গে আমি কখনও পূরণ করার ইচ্ছে পোষণ করতাম না। চেপে রাখতাম। তবে তোমার সঙ্গে করতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, আমার সাধারণ ইচ্ছেগুলোও তোমার উপস্থিতিতে অসাধারণ হয়ে রুপ নেয়। এই ছোট্ট জীবনে তোমায় নিয়ে আমি সমস্ত কল্পনা জগতের বাস্তবতা ঘটাতে চাই। সমস্ত মানে সমস্ত। কোনো আক্ষেপ রেখে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
নাবিল ওর আঙুলের ভাজে ভাজে নিজের আঙুলের বিচরণ ঘটাতে ঘটাতে মুচকি হাসে। কোনো অনুমতি ছাড়াই প্রলম্বিত চুমু খায় ঠোঁটে। নিরা বাঁধা দেয় না। খোলা আকাশের নিচে ওষ্ঠদ্বয়ের মিলন ঘটিয়ে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে নিজের। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির গতি বাড়ছে। তবুও আজ ঘরে ফেরার তাড়া নেই। না আছে জ্বর নিয়ে ভয়। আছে শুধু চমৎকার নীরব প্রেম, আর মনের আরাম। নাবিল চোখ বুঁজে শ্বাস নেয়। প্রেয়সীকে বুকে জড়িয়ে স্বরণ করে সে-ই চমৎকার দিনটিকে। যেদিন ছোট্ট কিশোরী নিরাকে পরিপূর্ণ রমণী রুপেই দেখেছিল। তার নারীসুলভ দেহে শাড়ীর আঁচলের ভাজে ভাজে ফুটে উঠা গভীর ঢলঢলে দীঘি। প্রতিমার মতো গরন। সুকেশিনীর ঝরনার মতো লম্বাটে চুল, আর সে-ই দৃষ্টিতে প্রেম ঝড় নিয়ে তার ঘুরে তাকানো! পুরোনো মুখের নতুনত্ব! পুরোনো মানুষের নতুন প্রেমের সুতোর টান। তার টানা টানা চোখের সর্বনাশ, আর ঠোঁটের আরাম আরাম হাসি। সেদিনের হৃদয় ঘায়েল করা প্রেমই তো আজ এনে দিয়েছে রুপকথার জীবন। একটা রুক্ষ, শুকনো দিন। তীব্র তেজি সূর্যের উপস্থিতিতে তার রোদ পোহাবার ছুতোয় মহা প্রলয়ের মতো মেয়েটার সেদিনের আকস্মিক আগমনই সব বদলে দিয়েছিল নাবিলের জীবনের। সব মানে সব! নাবিল হাসে, আবারও হাসে। তৃপ্তি ভরে শ্বাস টানে বার-বার। অর্ধাঙ্গিনীর হাতে হাত রেখে গলা ছেড়ে গায়,
তুমি রোদ পোহাবার ছুতোয়
ছাঁদে আসতে নিয়ে গভীর বাসনা
আরও বাদেই জমলো মেলা
আমার বয়স পঁচিশে প্রেম প্রেম খেলা…
সসমাপ্ত।