সংসারের খুঁটিনাটি পর্ব-০১

0
1

#সংসারের_খুঁটিনাটি (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমি আমার ছোট জাকে হিংসা করি। কথাটি আমার নয়, আমার শাশুড়ী মায়ের। কথাটি পুরোপুরি সত্যি নাহলেও আংশিক সত্য। আমি যখন দেখি যে কাজের জন্য আমার শাশুড়ী একদিন আমাকে বকতো সেই একই কাজ করায় জাকে কিছুই বলছে না। তখন হিংসা হয় নাকি কষ্ট জানি না। তবে বিষয়টা একদমই ভালো লাগে না আমার।

এই তো সেদিন, ছোট জা ডিম ভাজার পর কড়াইতে অনেকটা তেল পড়ে ছিলো। এটা দেখে আমার শাশুড়ী বিরক্তি মুখ নিয়ে তৎক্ষনাৎ তেলটি বোতলে ঢেলে নিলো। অথচ এই একই কাজ আমি করলে শাশুড়ী মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলতেন। না, আমার শাশুড়ী যে প্রচন্ড খারাপ মানুষ এমন একদমই নয়। আবার অনেক ভালো তাও নয়। আমার শাশুড়ী তার নিজের স্থানে ঠিক আছে। এতদিন অব্দি ঠিকই ছিলো। সেজন্য তার বকা আমি কখনো গায়ে মাখতাম না। ঐ যে বললাম তেলের কথা। এই তেল জিনিসটি বেশি খরচ করা আমার শাশুড়ীর পছন্দ নয়। কেন জানি না। শুধু যে দামের জন্য সেটা নয়, আমি দেখেছি অন্যসব জিনিস যতই দামি হোক তা রান্নায় বেশি ব্যবহার করলেও আমার শাশুড়ী কিছুই বলে না। কিন্তু এই তেল জিনিসটা বেশি দিলেই সে বকাবকি করেন।

আমার শাশুড়ী এরকম ছোট ছোট অনেক কারণেই আমাকে বকেন। এতদিন অব্দি আমি এটা সহ্য করে নিয়েছিলাম। আমার শাশুড়ী মা যে যুগের তাতে তার চিন্তা, ভাবনা আমার মতো হবে না এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি আমার মাকে দেখেছি। আমার মা এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো না। কিন্তু সেও কোথাও না কোথাও গিয়ে ভালো শাশুড়ী হতে পারেনি। আসলে তাদের যুগে বৌমাদের এত কষ্ট দেওয়া হতো যে এই যুগে এসে আমার ভাবী যদি সামান্য কারণে মুখ ভার করে ফেলে তাহলে তার মুখ দিয়ে অটোমেটিক বের হয়,“আমাদের সময়ে টু শব্দ করার জায়গা ছিলো না। কাজ করতে করতে ম রে গেলেও বিশ্রাম করার সময় পাইনি অথচ আজকালকার বৌরা একটু কিছু হলেই মুখ ভার। সংসারে জ্বা লা কিসের যে এত কষ্ট? আমাদের যা জ্বালাইছে। ভাতে, নুনে, পানিতে সবকিছুতে জ্বালাইছে। তাও আমরা কখনো কিছু বলিনি। আর এখন তাদের কিছু বলার আগেই মুখ কালো, মুখে খৈ ফুটে।”

উপরোক্ত কথাগুলো শুনে যেকোন বউয়ের কাছে তার শাশুড়ী খারাপ উপাধিতে ভূষিত হবে। কিন্তু আমি কেন জানি না পারি না। খুব ছোটবেলা থেকে মা মানুষটিকে দেখেছি তো। তার কষ্টগুলোর কথা শুনেছি। তাই বুঝি, সে তার অতীতের দুঃখ থেকে বের হতে পারছে না। তাই এমন বলছে। সেজন্য শাশুড়ী মায়ের বকা গুলো দিয়ে তার মধ্যে সত্তাটাকে ভালো বা খারাপ উপাধি কখনো আমি দেইনি। কিন্তু এখন পারছি না। একই বাড়িতে দুইজন বউ থাকলে, একজন যদি বেশি গুরুত্ব পায় তখন কষ্ট লাগে। সেই কষ্ট থেকে হয়তো হিংসা মনের মধ্যে জমা পড়েছে।

উপরে তো গেল একদিনের সামান্য তেলের ঘটনা। আজকের ঘটনাই দেখুন না। আমার ছয় মাসের একটি বাচ্চা রয়েছে। সে কান্না করছে তাই তাকে আমি ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলাম। সেই সময়ে আমার জা রান্নার জন্য চাল ডাল ধুয়ে এনে উনুনে রাখলো। শাশুড়ী মা অন্য এক কাজে ব্যস্ত ছিলো। সে এসে যখন দেখলো রান্নার সময় পার হয়ে গেছে। এখনো উনুন ধরানো হয়নি তখন সে বিরক্ত হলো। তাই বিরক্তি নিয়ে বললো,“একটু ভাতে আর ডালে জ্বাল দিলেও তো পারতা। এভাবে উনুনে এনে রেখে গেছো। কত সময় হয়ে গেছে? এই ভাত কখন হবে?”

এসব বলে শাশুড়ী মা রান্না করছিলো। সেই সময়ে আমার ছোট জা তার মুখের উপর বলে উঠলো,“আমি চাল ডাল ধুয়ে এনে রেখে গেছি। সে(আমি) পারতো না উনুনটা ধরাতে। তাহলে তো হয়ে যেতো। তার কাজের মধ্যে পড়ে না।”
আমার ছোট জায়ের মুখে এমন কথা শুনে শাশুড়ী কিছুই বললো না। কিন্তু আমি যদি এই পরিস্থিতি পড়তাম এবং মুখের উপর এমন কথা বলতাম তাহলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতো। এখানেই হিংসার জন্ম হয়। আমি বাচ্চাকে ঘুম পারিয়ে আসলে আমার শাশুড়ী বলে,“এখন আশা লাগবে না। বাচ্চা নিয়াই পড়ে থাকো।”

“বাবু কান্না করছে তাই গেছি। তো যে চাল ডাল ধুয়ে নিয়ে আসলো সে উনুন ধরাতে পারতো না।”
অন্যদিন হলে আমি চুপ থাকতাম। কিন্তু এখন জবাব অটোমেটিক চলে আসে। যখন ছোট জা এবং আমার মধ্যে শাশুড়ীর ভিন্নরকম আচরণ লক্ষ্য করি। আর আমার এই কথা শুনেই আমার শাশুড়ী বিরক্তি নিয়ে বলেন,“তুমি বড় বাইড়া গেছো। আজকাল কথা ছোয়ানো যায় না, মুখে মুখে জবাব দাও।”

আর এখানে কথা প্রসঙ্গে শাশুড়ী মা আমাকে সরাসরি বলেই দিলো, আমি আমার ছোট জাকে হিংসা করি। এই কথার জবাবে আমি বললাম,“আপনি তো শুধু আমাকেই বলেন।”

আমার এই কথাটিই ভুল হয়ে গেল। শাশুড়ী মা আমাকে অনেক বকতে শুরু করলেন। তার কথা,“ছোট বউ আসলো সবে আট মাস। নতুন বউ, তারে আমি কী বলবো? আর সে কি করে যে তাকে আমি বলবো। তুমি বেশিই বাড়ছো। দেখি তো। ছোট বউ আসার পর থেকে হাওয়ায় উড়ছো। তারে একটুও দেখতে পারো না। এটা কেমন কথা?”

আমার শাশুড়ী মা কথাগুলো অনবরত বলে যাচ্ছিলো। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকলাম। আমি ঝামেলা চাই না। সাংসারিক অশান্তি মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু তাও মুখটা মাঝে মাঝে খুলে যায়। আমি রান্নাঘর থেকে চলে আসলাম তখন ছোট জায়ের কথা শুনতে পাই। আমার শাশুড়ী আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলে,”দুই জা মিলেমিশে খাইতে পারবে না। কেউ কাউকে দেখতে পারে না।”

এই কথা আমার ছোট জায়ের গায়ে লাগে। সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“কেউ কাউকে দেখতে পারে না। এটা কেমন কথা বললেন মা? আমি কী করছি? আমি এই বাড়িতে এসে কারো সাথে কোন ঝামেলা করছি? আমার সাথে কারো কিছু আছে।”
আমার শাশুড়ী মা এরপর আর কথা বলতে পারলেন না। এই বিষয়টা লক্ষ্য করে আমার মন বললো,“এভাবে চটাং চটাং উত্তর প্রথম থেকে দেইনি বলেই কি শাশুড়ী মা আমার কথা সহ্য করতে পারে না? কিন্তু তার কথা ঠিকই হজম করে নেয়।”

এখান থেকে হিংসা এমনি চলে আসে। বলেন আসে না। এগুলো তো সামান্য ঘটনা বললাম। এরপর তো শুরু হলো তুলকালাম কান্ড। এখানে বলে রাখি, আমার স্বামী বাসায় থাকে। আমাদের দেশের বাড়ি ঝালকাঠি। আর আমার স্বামী এই শহরেই কাজ করে। কিন্তু দেবর বাসায় থাকে না। সে ঢাকাতে জব করে। যাই হোক ঘটনা হলো। সেদিন আমার স্বামী ঘরের সবার জন্য পুরি কিনে নিয়ে আসলো। সন্ধ্যাবেলা পুরি এনে আমার হাতে দিতে সেগুলো আমি সবাইকে ভাগ করে দিলাম। আমার জাকে যেটা দিলাম সেটা সে প্রথমে একটি পাত্রে রেখে দেয়। তারপর কয়েক ঘন্টা পর যখন পাশের ঘরের বাচ্চাটিকে নিয়ে ভাবী আসে সেই বাচ্চাকে দিয়ে দেয়। এই ঘটনাও মেনে নিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আরও একদিন দেখলাম, আমার স্বামী কলা নিয়ে আসলে সেই কলা তাকে দিলে সে চালের ড্রামে সেটা রেখে দেয়। চালের ড্রাম খাবার ঘরে যেতেই পরে। আসতে যেতে কয়েকবার সেটা দেখলাম। সেই কলা দুইদিন ধরে সেখানে ছিলো। পচে যাওয়ার পর আমার ছোট জা সেটা ফেলে দিলো। এখানে আমার মনের অনুভূতি বোঝাতে পারবো না। আমি এই নিয়ে কোন কথা বললাম না। শুধু দেখে গেলাম। আমার ছোট জা যে আমাদের দেওয়া কোন জিনিস খায় না সেটা বুঝতে পেরে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম তার দেওয়া জিনিসও খাবো না। আমি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ই বুঝছি, সে আমাদের জিনিস খায় না এটা নিয়ে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু ঠিকই আমার বেলা তুলকালাম হবে। সেটাই হলো। আমার ছোট জা তার বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলো। সেখান থেকে আচার নিয়ে এই বাড়িতে আসে। সেই আচার আমাকে দিলে আমি সেটা না খেয়ে তার মতোই রেখে দেই এক স্থানে। তারপর……


চলবে,