#অন্তরালের_গল্প (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মেয়ের বিয়ের আগেরদিন মা পালিয়ে যায়। এই ঘটনার রেশ ধরে পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙে দেয়।
ব্যাংক লোন নিয়ে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছেন লতার অর্থাৎ পাত্রীর বাবা। শেষ মূহুর্তে এসে লতার মা এমন কান্ড করে বসবে সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি লতার বাবা। গতকাল রাতে লতার মায়ের নিখোঁজ হওয়ার খবরটা শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও নিজেকে সবার সামনে শক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। রাতটা শেষ হলে লতার বিয়ে। সেই বিয়ের কথা ভেবে, নিজের মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়।
তবে শেষ রক্ষা হলো না। আত্মীয়ের মাঝ দিয়ে কেউ একজন পাত্রপক্ষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে লতার মা পালিয়ে গেছে। এই কথা কানে যেতে পাত্রের বাবা কাজিকে বিয়ে পড়াতে বারণ করে দেয়। কাজি জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাতে পাত্রের বাবার দিকে তাকাতে সে বলে উঠে,“রাত পোহালে মেয়ের বিয়ে এই কথাটা না ভেবে যে মেয়ের মা পালিয়ে যেতে পারে সেই মায়ের মেয়ে কত ভালো হবে? এমন একটি পরিবারের সাথে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিবো না।”
মূহুর্তের মাঝে বিয়ে বাড়িতে শোরগোল বেধে গেল। লতার বাবা পাত্রের বাবার কাছে অনুরোধ করে বলে,“বেয়াই মশাই দয়া করে এই বিয়ে ভাঙবেন না। দেখুন লতার মা নিখোঁজ। সে কারো সাথে পালিয়ে যায়নি। আমরা তাকে খোঁজার চেষ্টা করছি।”
“শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন আপনি? আপনার স্ত্রী নিখোঁজ নাকি তার মেয়ের প্রাইভেট টিচারের সাথে পালিয়ে গেছে? শুনুন মশাই, আপনি এখন মিথ্যা বলে ঘটনা আড়াল করতে পারবেন না।”
পাত্রের বাবা অত্যন্ত কঠিন গলায় কথাটি বলেন। তার কথা শুনে লতার বাবা অনেকটা নরম এবং মিনমিনে গলায় বললো,“আমার মেয়ে খুব ভালো। তার মা নাহয় একটি ভুল করেছে। আপনি দয়া করে মায়ের ভুলের শাস্তি মেয়েকে দিবেন না।”
“হ্যাঁ আপনার মেয়ে কত ভালো হবে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। একটা কথা আছে জানেন, মায়ের গুনে মেয়ে। যার মায়ের নাই চরিত্র তার মেয়ের কতই বা থাকবে চরিত্র?”
পাত্রের বাবার কথার সাথে সম্মতি জানালেন কিছু মুরব্বিরা। মানুষজন লতার মা এবং পরিবার নিয়ে খুবই বাজে কথা বলতে শুরু করে। একজন তো বলে উঠলো,“জামাই সারাদিন অফিসে কাটায় আর সে বাড়িতে বসে মেয়ের শিক্ষকের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। আমরা এসব আগেই সন্দেহ করেছিলাম। নয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ ছেলে এই বাড়িতে কী করতো? শুধুমাত্র মেয়েকে পড়াতে আসতো?”
“যা বলেছো। মেয়েটাকেও তো দেখি পাড়ার ছেলেদের সাথে রঙঢঙ করে কথা বলতে। ছি কি নির্লজ্জ। নিশ্চিত মায়ের দেখাদেখি মেয়েটাও বিগড়ে গেছে।”
এই কথাটি কানে যেতে লতার বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। সুযোগ পেয়ে মানুষ এখন নানা কথা বানাচ্ছে। যা দেখেছে সেটা তো আছে। সেই সঙ্গে আরও অনেককিছু বানিয়ে ঘটনা সুন্দরভাবে সাজাচ্ছে। এসবের মাঝে পাত্র বসে বসে ভাবছিলো তার বসা থেকে ওঠা উচিত কি-না। তার ভাবনার মাঝে তার বাবা রাগী গলায় বললো,“শাওন তুমি এখনো উঠছো না কেন? আমি বললাম না, এই বিয়ে হবে না।”
বাবার মুখে এমন কথা শুনে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ালো শাওন। পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে বুঝতে পেরে নিজের সমস্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে লতার বাবা পাত্রের বাবার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। অনেকটা অনুরোধের গলায় বলে,“আমার মেয়ের কপালটা এভাবে পুড়ে যাবেন না আপনারা। আপনারা চলে গেলে, এই সমাজে আমার মেয়ের ঠাঁই হবে না। বিনাদোষে আমার মেয়েটাকে সবাই দোষারোপ করে যাবে।
বিয়ে ভাঙা মেয়েকে যে কেউ বিয়ে করতে চায় না। এভাবে আমার মেয়ের সঙ্গে অবিচার করবেন না। দয়া করুন।”
লতার বাবার সমস্ত অনুরোধকে এড়িয়ে গিয়ে পাত্রপক্ষ চলে যায়। লতার বাবা অসহয় চোখে এসব দেখে। লতা দূরে দাঁড়িয়ে বাবার অসহায়ত্ব, লোকজনের নোংরা কথা, পাত্রপক্ষের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। তার চোখে পানি। তবে সে বুঝতে পারছে না, এই পানি সে কার জন্য অপচয় করছে? নিজের অসহয় বাবা, নিজের পালিয়ে যাওয়া মা, নাকি বিয়ে ভেঙে চলে যাওয়া পাত্রের জন্য। হয়তো সবকিছু মিলিয়েই তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
ধীরে ধীরে বিয়ের বাড়ির শোরগোল কমে যায়। সমস্ত আত্মীয়-স্বজন চলে যায়। যাবার সময় অবশ্য সান্ত্বনার নামে দুই একটি কথা ইঙ্গিত দিয়ে শুনিয়ে যাচ্ছে। এই তো মাত্র এক ফুপু লতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার নামে বলে,“মা কষ্ট পেও না। যদিও তোমার মায়ের এই নষ্টামি, তোমার বিয়ে ভাঙার কথা শুনে কেউ তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। তবে চিন্তা করো না। একটা সময় পর পাত্র পেয়ে যাবে। হয়তো সে একটু বয়স্ক বা আগে দুই একটা বিয়ে আছে এমন হবে। তবুও তোমার মেয়ে হবে।”
অন্যদিকে আত্মীয়রা এমন সান্ত্বনা দিয়েই শুধু শান্ত হচ্ছে না। তারা যাবার আগে বিয়ের বাড়ির খাবার সবাই ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ খাবারের ভাগ নিয়ে তর্কও করছে। এরা এতটাই অমানবিক যে, ঋনগ্রস্ত অসহয় বাবার চোখের পানি কিংবা বিয়ে ভেঙে যাওয়া লতার নিরব আর্তনাদ দেখেও দেখছে না। অবশ্য সবাই অমানবিক নয়। যাদের মাঝে নূন্যতম মানবিকতা রয়েছে তারা লতা এবং তার বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ভরসাও দিচ্ছে। বলছে,“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এক পর্যায়ে লতা এবং বাবা মুখোমুখি হয়। এতক্ষণ দুজন দুই স্থানে বসে কান্না করছিলো। অতঃপর দুজন মুখোমুখি হয়। মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা নিজেকে সামলাতে পারলো না। সে লতাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। বাবার কান্নার শব্দ লতাকেও ভেতর থেকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেয়। এতক্ষণ অব্দি নিরবে কান্না করলেও এবার সে নিরব কান্না করে না। বাবার সঙ্গ পেয়ে সেও হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। লতা কান্নারত অবস্থায় বলে,“বাবা আমাদের সাথে এটাই কেন হলো? বলো না বাবা? আমাদের সাথেই এটা হওয়ার ছিলো? কেন হলো এমনটা?”
“সব আমার দোষ মা রে। আমিই তোর মাকে বোধহয় আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করাতে পারিনি। তাই তো আজ এত বছর পর তার অন্যকারো ভালোবাসার প্রয়োজন পড়লো। সব আমারই দোষ।”
বাবাও নিজেকে সামলাতে না পেরে বিলাপ বকতে শুরু করে। বাবা একটু থেমে আবারও বলে,“আমার জন্য তোর বিয়েটা ভেঙে গেল। আমি তোর বিয়েটা ভেঙে যাওয়া থেকে আটকাতে পারলাম না। আমি তাদের ভালোভাবে বোঝাতে পারিনি। তাই তো তারা বিয়ে ভেঙে চলে গেছে। সব আমার দোষে, আমার ভুলে হয়েছে।”
বাবা এবং মেয়ে একে-অপরকে জড়িয়ে এভাবেই বিলাপ বকতে থাকে। সেই সাথে অঝোরে কান্না তো আছেই। লতার মা এমনটা না করলেও পারতো। মেয়ের বিয়ে রেখে পালিয়ে গেছে, পালিয়ে গিয়েও শান্ত হয়নি। তাকে নিখোঁজ বলে পরিস্থিতি সামলানোর সুযোগও দেয়নি। পালিয়ে গিয়ে আবার লতার এবং তার বাবার মোবাইলে ম্যাসেজ করে সেই খবর জানিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয়কেও জানিয়েছে, যাদের মাধ্যমে এভাবে ঘটনাটি ছড়িয়ে গেছে।
____
লতার মায়ের পালিয়ে যাওয়ার দু’দিন হলো। লতার বাবা তাকে খোঁজার চেষ্টাও করেনি। যেই মানুষটি পরিবারের মান সম্মান ভুলে, মেয়ের কথা না ভেবে পালিয়ে যেতে পারে। সেই মানুষটির কথা ভেবে লতার বাবা সময় নষ্ট করতে চায় না। তিনি এখন নিজের মেয়েকে নিয়ে ভাবতে চান। তার মন থেকে এই পরিস্থিতির রেশ দূর করতে চান। বিষয়টি শুধু এটাই নয়, আসলে লতার বাবা অভিমানেও লতার মাকে খোঁজার চেষ্টা করছে না। যে মানুষটা তাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল। তার ভালোবাসাকে মিথ্যা প্রমাণ করে অন্য একজনের হাত ধরলো তার প্রতি অভিমান হবে না তো কি হবে? তবে ঘটনা বদলে যায় তখন যখন দুইদিন পর লতার মায়ের রক্তা ক্ত মৃত দেহ পুলিশ খুঁজে পায়। লতাদের বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি পুকুর পাড়ে তার মৃ তদেহ পাওয়া যায়। কেউ মাটি চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছিলো। তবে গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় মাটি নরম হয়ে যায়, সেখানেই বাচ্চারা খেলা করতে গিয়ে মৃত দেহের হাত দেখতে পায়। বাচ্চারা ভয়ে বাড়ি চলে গেলে, স্থানীয়রা পুলিশ খবর দেয়। পুলিশের কাছ থেকে এমন একটি খবর পেয়ে লতা এবং তার বাবা দুজনেই হতভম্ব হয়ে যায়। দুজনেই জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে একে-অপরের দিকে তাকায়। যার অর্থ,“তবে কী আমরা ভুল ভাবছিলাম?”
’
’
চলবে,