#অন্তরালের_গল্প (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
লতার মায়ের মৃত দেহ ময়না তদন্ত শেষে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের মৃত দেহের সামনে লতা ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে। সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। লতা কান্নার মাঝেও শুনতে পায়, আশেপাশের মানুষ এখনো তার মাকে বাজে কথা বলছে। কেউ কেউ বলছে,“গিয়েছিলো ভা তার ধরে কিন্তু সে রাখেনি। হয়তো খেয়ে ছেড়ে দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিলো। সেজন্যই এমন করেছে।”
মানুষের এই বাজে কথা যে বন্ধ হওয়ার নয় সেটা বুঝতে পেরে লতা আরও ভেঙে পড়ে। দূরে এক কোনে লতার বাবা অসহয়ের মতো বসে আছে।
___
গ্রীষ্মের এক দুপুরে লতা কান্নারত অবস্থায় বলে,“মা আমি কোচিং এ আর পড়তে চাই না।”
লতার মা এই কথা শুনে বেশ অবাক হয়। বিষ্ময়ের গলায় বলে,“কেন?”
“রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বাজে ছেলেরা বিরক্ত করে। তাছাড়া কোচিং থেকে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমি একা বাড়ি ফিরতে ভীষন ভয় পাই।”
লতার মুখে এই কথা শুনে তার মা তাকে কোচিং যেতে বারণ করে। পরবর্তী দিনই খোঁজ নিয়ে দেখে রাতুল মাস্টার নামে একজন ভীষন ভালো পড়ায়। তার চারিত্রিক দিকও ভালোই শুনলো। তাই বিনা সন্দেহে লতার বাবাকে বলে তার মা রাতুল মাস্টারকে বাসায় এসে লতাকে প্রাইভেট পড়াতে বলে দেয়। রাতুলও রাজি হয়ে যায়।
রাতুল যখন প্রথম লতাকে এসে বাড়িতে পড়াতে আসে। তখন থেকে তার আচরণ, তার পড়ানো সবটাই ভালো ছিলো। যা অনায়েসে লতা এবং লতার মায়ের পছন্দের হয়ে যায়। রাতুল কিছুটা রসিক মানুষ ছিলো, সেজন্য পড়ার শেষে সুযোগ পেলেই লতার মায়ের সঙ্গে গল্প করতো। সবকিছুই ভালো যাচ্ছিলো।
একদিন পড়ানোর সময় রাতুল লতার মাকে বলে,“আপনাদের ওয়াশরুমটা ব্যবহার করা যাবে?”
লতার মা অনুমতি দিতে রাতুল ওয়াশরুমে চলে গেল। এর ঠিক কয়েকদিন পর রাতুল লতার মাকে ফোন দেয়। সেদিন প্রথম সে নিজের ধারা থেকে বের হয়ে বাজে কথা বলে লতার মাকে। লতার মায়ের শারীরিক গঠন নিয়ে, লতার শারীরিক গঠন নিয়ে বিভিন্ন বাজে কথা বলে। এসব শুনে লতার মা বলে,“স্যার আমি তো আপনাকে খুব ভালো মানুষ মনে করছিলাম। আর আপনি? ছিহ। আপনি আর কখনো আমাদের বাড়িতে আসবেন না।”
এসব কথা বলে লতার মা ফোন কেটে দেয়। এরপর রাতুল বারবার ফোন দেওয়ায় লতার মা ফোন নাম্বার ব্লক করে দেয়।
পরবর্তী দিন যথা সময়ে রাতুল চলে আসে। তাকে দেখে লতার মা ক্ষেপে যায়। সে বলে,“আপনাকে বলেছি না, আপনার আর আসার প্রয়োজন নেই। আমি আমার মেয়েকে আপনাকে দিয়ে পড়াবো না। আপনি আবার কেন এসেছেন?”
“আমার কথা তো আগে শুনুন। তারপর নাহয় বিদায় করুন…।”
রাতুলের কোন কথা শুনতে লতার মা আগ্রহী নয়। সেজন্য খুব শক্ত গলায় বলে,“আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না। আপনি চলে যান। আপনার এই মাসের বেতন আমি পাঠিয়ে দিবো।”
“শুধু বেতন দিবেন? আর আমার কাছে যেটা আছে সেটার দাম দিবেন না?”
রাতুলের এই কথার অর্থ লতার মা বুঝতে পারে না। তাই শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“মানে?”
“আমার কাছে আপনাদের মহামূল্যবান একটি জিনিস রয়েছে। সেটার চড়া মূল্য। সেটা পরিশোধ না করা অব্দি তো আপনারা আমাকে বিদায় করতে পারবেন না।”
রাতুলের এমন হেয়ালি করে কথা বলার কিছুই বুঝতে পারে না লতার মা। অতঃপর রাতুল তার ফোন দিয়ে কিছু ভিডিও দেখায়। যেটা দেখে লতার মায়ের পায়ের নিচ থেকে মাটি চলে যায়। ভিডিওটা তার এবং লতার গোসলের ভিডিও। লতার মা হতভম্ব হয়ে বলে,“ছিহ আপনি এত খারাপ মানুষ।”
“এই দুনিয়ায় ভালো মানুষ হয়ে টেকা যায় না ম্যাম। তাই তো আমি খারাপ মানুষ হয়ে থাকতে চাই।”
রাতুল খুব কঠিন গলায় কথাটি বলে। লতার মা এবার অনুনয়ের গলায় বলে,“প্লীজ এই ভিডিওগুলো ডিলিট করে দাও।”
“এত সহজে? এত কষ্ট করে ভিডিও সংগ্রহ করলাম। তার সঠিক মূল্য না পেয়েই ডিলিট করে দিবো?”
রাতুলের এই কথায় লতার মা ভীষন ভয় পেয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলে,“কী চাই?”
“দশ লাখ টাকা।”
রাতুল বেশ সাবলীল গলায় কথাটি বলে। লতার মা টাকার পরিমান শুনে অবাক হয়ে যায়। সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“আমরা খুব নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। এত টাকা আমরা কোথা থেকে দিবো? এত টাকা আমাদের কাছে নেই।”
“টাকা কোথা থেকে দিবেন, কিভাবে যোগাঢ় করবেন সেটা তো আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমার দশ লাখ টাকা চাই। নয়তো এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবো।”
“না। রাতুল প্লীজ এমন করো না। আমাদের মা মেয়ের সমাজে সম্মান বলতে কিছু থাকবে না। এই ভিডিও ভাইরাল হলে ম রা ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকবে না।”
লতার মা যথেষ্ট অনুনয় করে কথাগুলো বলে। রাতুল ততই কঠিন গলায় বলে,“ম রতে না চাইলে টাকা রেডি রাখুন।”
“আমার কাছে এত টাকা নেই।”
“না থাকলে চুরি করুন। আমি শুধু জানি আমার টাকা লাগবে। কোথা থেকে যোগাঢ় করবেন সেটা আমি জানি না।”
এই কথা শুনে লতার মা নিজের গলার চেইন খুলে দেয়। সে বলে,“আমার কাছে এটাই আছে। তুমি এটা নিয়ে নাও।”
“এটা আর কত আনা হবে? সর্বোচ্চ দুই আনা। এর দাম কত হবে? আমার এতে পোষাবে না। তাই আপনি যত দ্রুত সম্ভব টাকা রেডি করুন। নয়তো আমাকে উল্টো পথে হাঁটতে হবে।”
রাতুলের এই কথায় হতভম্ব হয়ে যায় লতার মা। এখানে উল্লেখ্য রাতুল এবং লতার মা আলাদা হয়ে কথা বলছে। লতা পাশের ঘরে বই পড়ছে। সেজন্য সে এসব বিষয়ে জানে না। রাতুল লতার মাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য বলে,“একবার ভাবুন তো এই ভিডিও যখন সবার ঘরে ঘরে থাকবে তখন কেমন হবে? সব পুরুষ যখন আপনাদের শরীরের অঙ্গ চোখ দিয়ে গিলবে, কেউ কেউ অনেক উত্তেজিত হয়ে এটা সেটা করবে। তখন কেমন লাগবে? আপনার মেয়ে কলেজে গেলে সেখানে সব ছেলেরা তাকে টিজ করবে, তাকে বাজে অফার করবে৷ এইসব আপনার মেয়ের জন্য কতটা লজ্জাজনক।”
”না।”
লতার মা চিৎকার করে উঠে। লতা এটা শুনে সামনে এসে বলে,“মা কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
লতার মা নিজেকে সামলে বলে। লতাকে ঘরে যেতে বলে। লতার মা ভয় পেয়ে রাতুলের থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নেয়।
★
এভাবেই শুরু হয় রাতুলের নোংরা অভিসন্ধি। সে টাকা চাওয়ার বাহানায় যখন খুশি লতাদের বাড়ি আসতে শুরু করে। লতা কলেজ থাকার সময়ও তার এই বাড়িতে আনাগোনা মানুষের চোখে পড়ে। সেজন্য আড়ালে আবডালে লতার মা, রাতুলকে নিয়ে অনেক কথা বলে যায়। এসব লতার মা শুনলেও বিশেষ পাত্তা দেয় না। তবে রাতুলকে বলে,“আমি টাকার ব্যবস্থা করছি। তুমি দয়া করে যখন খুশি তখন চলে এসো না। লোকে বাজে কথা বলে।”
“তো? লোকে বাজে কথা বলে তাই আমি আসবো না? আচ্ছা আসবো না। আমার টাকা দিয়ে দেন।”
রাতুলের এই কথায় আটকে যায় লতার মা। যাই হোক এভাবে কয়েক মাস চলে। এই কয় মাসে অনেক কষ্টে লতার মা রাতুলকে দেড় লাখের মতো টাকা দেয়। যেই টাকা লতার বাবার সঞ্চয়ের ছিলো। এই টাকা নিয়ে লতার মায়ের সাথে লতার বাবার প্রচুর তর্ক হয়। কিন্তু লজ্জা, ভয়, ঘৃণায় লতার মা লতার বাবাকে সত্যিটা বলতে পারে না।
এই সবকিছুর মাঝে লতার বিয়ে ঠিক হয়। তখন রাতুলের উৎপাত আরও বেড়ে যায়। সে আর সময় দিতে পারবে না। মাত্র ঐ কটা টাকায় তার কী হয়?তার টাকা চাই। টাকা না দিলে সে লতার শ্বশুড়বাড়িতে ঐ ভিডিও পাঠাবে। এসব হুমকির ভয়ে লতার মা লতার জন্য কেনা সোনার জিনিসের সঙ্গে সিটিগোল্ডের বদল ঘটিয়ে সেই সোনার জিনিসগুলো রাতুলকে দেয়। কিন্তু রাতুল এতেও সন্তুষ্ট হয় না। সেজন্য বিয়ের আগের দিন রাতে লতার মাকে ফোন করে বলে,“আমার সাথে এখনই দেখা করুন।”
“অসম্ভব। বাড়িতে এত লোকজন, আমি দেখা করতে পারবো না।”
এই কথার পরিবর্তে রাতুল বলে,“দেখা করবেন নাকি আমি চলে আসবো। সেই সাথে ভিডিও নিয়ে আসবো। সেটা আপনার হবু জামাইয়ের ফোনে পাঠাই। সেও দেখুক সে কি জিনিস পেতে চলেছে?”
রাতুল এরপর নোংরা ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে। যেটায় ভয় পেয়ে লতার মা দেখা করে। সে যখন বাড়ির পিছন দিক দিয়ে রাতুলের সাথে যাচ্ছিলো তখন একজন তাদের দেখে নেয়।
____
পুলিশ এতক্ষণ ধরে এসব কথা লতাদের উদ্দেশ্য বলছিলো। এটাই রাতুলের ব্যবসা। সে এভাবে অনেকের থেকে টাকা নিয়েছে। বিয়ের আগের দিন লতার মাকে ডেকে টাকা চায়। টাকা নিয়ে হয়তো তাদের মাঝে তর্ক হয়। যার ফলে রাতুল তাকে মে রে দেয়। তবে এই খু নটা রাতুলই করেছে এই বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়। পুলিশের থেকে এসব কথা শুনে লতার বাবা একদম ভেঙে পড়েন। সে ঘরের এক কোনে বিধ্বস্ত অবস্থা বসে থাকে।
★
অন্যদিকে পুলিশ যে রাতুলকে খু নের জন্য সন্দেহ করছে সেই রাতুলও খু ন হয়েছে। অর্থাৎ রাতুল লতার মাকে খু ন করেনি। অতঃপর পুলিশ বুঝলো এসবের অন্তরালে আরও কোন গল্প রয়েছে। যার জন্য দু’টো খু ন হয়ে গেল।
’
’
চলবে,