#অন্তরালের_গল্প (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
লতার বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে নির্বাকের মতো বসে আছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছেন। অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ এভাবে বসে থেকে উঠে দাঁড়ান লতার বাবা। ধীরে ধীরে বিছানার উপর একটি চেয়ার তুলেন। আলমারি থেকে লতার মায়ের একটি শাড়ী বের করেন। বেশ কিছুক্ষণ সেই শাড়ী বুকে জড়িয়ে নিরবে কান্না করেন লতার বাবা। এরপর চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ীটি পাখার সঙ্গে বাধেন। তারপর গলায় পেঁচিয়ে পা দিয়ে লাথি দিয়ে চেয়ারটি সরিয়ে দেয়। মূহুর্তের মাঝে তার গলায় টান লাগে, সে ছটফট করতে শুরু করে।লতার বাবা মৃ ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে এবং মনেমনে লতার কাছে মাফ চাচ্ছেন। লতার বাবা মনেমনে বলছে,“লতা মা তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকে এতিম বানিয়ে দিলাম। আমার জন্য তোর বিয়ে ভেঙে গেল। মা রে এতবড় অপ রাধের বোঝা মাথায় নিয়ে আমি এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারবো না। আমার অপরাধবোধ আমাকে দিয়ে আত্ম হত্যার মতো পাপ করাচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
মনেমনে এসব কথা বলে লতার বাবা মৃ ত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
____
অতীত,
লতার মায়ের সঙ্গে রাতুলের মেলামেশা এলাকার মানুষের মুখে শুনে লতার বাবার তার উপর সন্দেহ হয়। এরমাঝে একদিন সন্ধ্যাবেলা লতার বাবা বাড়ি ফিরে দেখে, রাতুল তাদের বেডরুমে শুয়ে আছে। আর লতার মায়ের হাত তার হাতে ধরা। লতার মা তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে। এটা দেখে লতার বাবার মাথায় র ক্ত উঠে যায়। তাকে দেখেই রাতুল চলে যায়। রাতুল চলে যেতে লতার বাবা লতার মাকে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে,“মাস্টার আমাদের বেডরুমে কি করে? তোমার হাতই বা ধরে ছিলো কেন?”
“তুমি ভুল ভাবছো। তেমন কিছু না। ওর শরীর খারাপ ছিলো তাই আমি এখানে বিশ্রাম নিতে বলেছি। আর আমার হাতে কিছু একটা লেগেছিলো সেটাই মুছে দিচ্ছিলো মাস্টার।”
লতার মা কথাগুলো ভয়ে ভয়ে বলে। যেসবে লতার বাবার সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। ধীরে ধীরে এই সন্দেহ বাড়তেই থাকে। সন্দেহের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে সেদিন যেদিন লতার বাবা লতার মায়ের গলায় তার দেওয়া চেইনটি দেখে না। বাসর ঘরে ঐ সোনার চেইন লতার বাবা বড় ভালোবেসে নিজের স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলো। এটা না দেখতে পেয়ে যখন লতার বাবা জিজ্ঞেস করে,“তোমার সোনার চেইন কোথায়?”
“ওটা একটু ছিঁড়ে গেছে সেজন্য খুলে রেখেছি।”
এই কথার জবাবে লতার বাবা যখন সেই চেইন চায়, সেটা সারিয়ে নিয়ে আসবে তখন লতার মা নানারকম তালবাহানা করে। তখনই লতার বাবা বুঝতে পারে লতার মা মিথ্যা বলছে। একটু জেরা করতে জানায়, রাতুলকে উপহার দিয়েছে। লতাকে এতদিন ধরে, এত ভালো পড়াচ্ছে তাই। এসব শুনে লতার বাবা সরাসরি জিজ্ঞেস করে,“ঐ ছেলের সাথে তোমার কী চলছে? তোমাদের মাঝে কিছু চলছে?”
“কিছু না। দেখো তুমি ভুল ভাবছো। আসলে….।”
লতার মা ভয়ে রাতুলের হুমকির কথা বলতে পারে না। সেই ভিডিওর কথা জানলে যদি লতার বাবা আরও ভুল বুঝে, সেজন্যও সে চুপ থাকে। অতঃপর যা হওয়ার তাই হলো। লতার বাবা সন্দেহ করলো লতার মায়ের এবং রাতুলের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। লতার বাবা সেদিন খুব ভেঙে পড়েছিলো। নিজেই নিজের সাথে কথা বলছিলো,“কেন লতার মা? কেন? তুমি আমার ভালোবাসার সাথে এতবড় বেঈমানী কেন করলে? কিভাবে পারলে এটা করতে?” তারপর থেকে লতার বাবা, মায়ের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তাদের মাঝে প্রায়ই ঝগড়া হয়।
তারপর লতার বাবা একজন কন্টাক্ট কিলারের সন্ধান করলো। তার কাছে রাতুল এবং লতার মায়ের খু নের সুপারি দিলো। তবে এখনই কাজ করতে বারণ করেছে। সে যখন বলবে তখন। সেই কিলার তার কাছে বলে, অগ্রিম টাকা না পেলে সে এমনিতেও এখন করবে না।
এরমাঝে লতার বাবা লতার বিয়ে ঠিক করলো। সেই বিয়ের জন্য ব্যাংক লোন নেওয়ার পাশাপাশি সেখানে কন্টাক্ট কিলারকে দেওয়ার জন্য যে টাকা লাগবে সেটাও লোন নেয় লতার বাবা। তবে সে এখনই কাজটা করাতে চায়নি। লতার বিয়ের পর করাতে চেয়েছিলো।
তবে লতার বাবার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় তখন যখন জানতে পারে লতার জন্য কেনা গয়না বদলে সেখানে নকল গয়না রেখে লতার মা সেগুলো রাতুলকে দিয়েছে। এসব শুনে সে লতার মায়ের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে,“এই বয়সে ভিমরতিতে পেয়েছে তোকে? তোর মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এখন তুই রঙঢঙ করছিস। শুধু কি তাই? নিজের মেয়েকে ঠকিয়ে তার গয়না চুরি করে তাকে দিচ্ছিস। তোর বেশ সাহস হয়েছে তাই না?”
“না। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।”
লতার মায়ের কথা শুনে লতার বাবা আরও রেগে যায়। কঠিন গলায় বলে,“আমি তোকে ভুল বুঝছিস। তুই তাহলে গয়নাগুলো তোর ভা তারকে কিসের জন্য দিয়েছিস?”
“ছিহ। এমন কথা বলো না। এগুলো শোনাও পাপ। বিশ্বাস করো তুমি ভুল ভাবছো। আমি তোমাকে সেদিনও বলেছি, আজও বলছি তুমি ভুল ভাবছো।”
“তাই? আমি ভুল ভাবছি তাহলে সত্যিটা কি?”
এই কথার জবাবে লতার মা চুপ হয়ে যায়। তা দেখে লতার বাবা তাকে দুটো গালি দিয়ে দেয়। লতার মা নরম গলায় বলে,“লতার বিয়েটা হয়ে যাক। ততটা অব্দি আমাকে সময় দাও। তারপর আমি তোমাকে সত্যিটা বলে দিবো।”
“লতার বিয়ের পর কেন? এখন বলতে সমস্যা কি? কথা ঘুরাচ্ছিস তাই না? সত্যি তো আমার চোখের সামনেই। যদি এটা মিথ্যা হতো তাহলে তুই এখনই বলতে পারতি।”
“সত্যি এটা নয়। তুমি খুব রগচটে মানুষ। তোমাকে সত্যিটা বললে তুমি সহ্য করতে পারবে না। বিয়ের আগে আমি কোন ঝামেলা চাই না।
এতদিন তো ধৈর্য ধরলে। আর কয়েকটা দিন ধরো। আমি তোমাকে সব বলবো।”
লতার মায়ের এসব কথা শুনে লতার বাবা বিরক্ত হয়ে চলে যায়। সেদিন যদি লতার বাবা তার মাকে জেরা করে অন্তরালে থাকা গল্পটা জেনে নিতো তাহলে হয়তো আজ এমন হতো না।
অতঃপর বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। লতার বিয়ের আগের দিন রাতুলের সঙ্গে পিছন দিক দিয়ে লতার মাকে চলে যেতে দেখে লতার বাবার সব ধৈর্য শেষ হয়ে যায়। লতার মায়ের সেদিনের কথায় সে আশায় ছিলো, বিয়ের পর অন্তত কিছু হলেও লতার মা বলবে। বা এই বিয়েতে সে কোন ঝামেলা করবে না। কিন্তু তার আগেই যে সে পালাবে এটা লতার বাবা বুঝতে পারেনি। এটা মেনেও নিতে পারেনি। কোনভাবেই মানতে পারিনি। সেদিনই টাকা দিয়ে কিলারকে ডেকে তাদের শেষ করে দিতে বলে লতার বাবা।
লতার মা সেদিন ফোনটা ঘরেই রেখে গিয়েছিলো। সেই ফোন দিয়ে ম্যাসেজ লতার বাবাই দিয়েছিলো। এরপর ফোনটা বাথরুমে ফেলে দেয়। লতার মা এবং রাতুলকে খু ন করার জন্য নিজে লোক ঠিক করেছে বিধায় লতার বাবা এটা নিয়ে পুলিশ অব্দি যায়নি।
সে ভেবেছিলো এদিকের সব আত্মীয়দের কোনরকম বুঝ দিয়ে লতার বিয়েটা শেষ করবে। কিন্তু তা আর হলো না। উল্টো লতার বিয়ে ভেঙে গেছে। লতার বাবা বুঝতে পারেনি এমনকিছু হবে। সেজন্য সে মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় প্রচন্ড রকম ভেঙে পড়ে।
বর্তমান,
__
এখন যখন লতার বাবা জানতে পারে লতার মা বাধ্য হয়ে রাতুলকে এত সঙ্গ দিচ্ছিলো। টাকা পয়সা দিচ্ছিলো তখন সে নিজের অপরাধবোধে শেষ হয়ে যায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে আরও একটি ভুল পথ বেছে নেয়।
বাবার ঝুলন্ত মৃত দেহ যখন লতা দেখে তখন তার পুরো পৃথিবী থমকে যায়। এই দুনিয়ায় তার আপন বলতে কেউ রইলো না। ইশ বাবা, মা এই মেয়েটার কথাও ভাবলো না। লতা সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে।
এজন্যই বলে সন্দেহ খুব খারাপ জিনিস। সেই সাথে সংসার জীবনে সুখ দুঃখ সবটা স্বামী এবং স্ত্রীর একে-অপরের সাথে শেয়ার করা উচিত। লতার মা যদি বিষয়টি গোপন না রাখতো তাহলে হয়তো এতকিছু হতো না। সেই সাথে লতার বাবাও যদি ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতো তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। তারা তো চলে গেল দুনিয়া থেকে কিন্তু নিষ্ঠুর এই দুনিয়ার চরম বাস্তবতার মাঝে অসহয় লতাকে রেখে গেল।ইশ সামান্য এক ভুলে একটা পরিবার কিভাবে শেষ হয়ে গেল।
(সমাপ্ত)
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন৷ কাল্পনিক গল্প কাল্পনিকভাবে দেখবেন প্লীজ। পড়ার জন্য ধন্যবাদ)