জগন্নাথ হোটেল পর্ব-০২

0
21

#জগন্নাথ_হোটেল
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
#দ্বিতীয়_পর্ব

আবার চোখ গেলো শ্রীকৃষ্ণের ছবির দিকে! সাংঘাতিক রাগ হচ্ছে সবুজের! আজকাল ওর সবেতেই রাগ হয়ে যায়! বাবা অবশ্য বলে রাগ হলে শুধু রাধা রাধা নাম করবি দেখবি আর রাগ হবে না!

বিড়বিড় করেই যাচ্ছে সবুজ! কিন্তু সেটা রাধা নাম নয়! নিজের অজান্তেই বারবার বলছে 998745……. বেসিনটা জল দিয়ে ধুতেই জানলা দিয়ে চোখ গেলো সামনের জগন্নাথ মন্দিরে! কেমন পোড়ো বাড়ির মতো দেখতে লাগে মন্দিরটাকে! সবুজের ছোটবেলায় কত আড়ম্বর ছিল মন্দিরে! এখন একজন পুরোহিত পুজো দেয় ব্যাস মন্দির বন্ধ! অথচ যখন এই মন্দির প্রথম খোলে তাকে ঘিরে ছিল এলাহি আয়োজন! কত মানুষের সেই সময়ের পেট চালানোর রসদ ছিল এই মন্দির!

তাড়াতাড়ি আশেপাশে খুলে গেলো জগন্নাথ সুইটস, জগন্নাথ বস্ত্রালয়, জগন্নাথ সেলুন, জগন্নাথ বাসনালয়, জগন্নাথ হোটেল! এরকম কত কী! জগন্নাথের নামে দিব্বি দাঁড়িয়ে গিয়ে সব জগন্নাথ কেই ভুলে গেছে তাই তো মন্দিরের এমন দশা! আর এদের দশা দেখো রমরম করে ব্যবসা করছে!

” মানদা দি এদিকে দু প্লেট সবজি ভাত দাও! আর একটা ডিম ভাত!” – পঞ্চুদার গলা পেয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো সবুজ! সাড়ে এগারোটা বাজে সবে এর মধ্যেই লোকজন আসতে শুরু করেছে! জগন্নাথের দয়ায় পঞ্চুদার ব্যবসা এখন তুঙ্গে! সবুজের কাজ শুরু হলো, এবার একটা করে ব্যাচ শেষ হবে এঁটো কুড়িয়ে আবার বাসন মাজা!

আর এঁটো কুড়ানোর সময় মনে পরে ইলেক্ট্রনিক স্প্রেডশীটস, ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট! কী কঠিন কঠিন টপিক অথচ কত কত নাম্বার পেয়েছিলো সবুজ! বন্ধুরা হিংসে করতো, স্কুল কলেজের স্যাররা ভালোবাসতো, কত স্বপ্ন দেখতো সবুজ! সব যেন আটকে গেলো এই এঁটো কুড়ানোতে!

মনে পড়লো সুশোভনের কথা! হোটেল ম্যানেজমেন্ট শেষ করে একটা বড় রেস্টুরেন্টে এই কাজ করে প্রায়! মাজতে না হলেও খাওয়া প্লেট তুলতে হয়! সুন্দর পোশাক পরে সুন্দর ভাষায় এই কাজই করে! কিন্তু ওটা ও গর্ব করে বলে আর বলবে নাই বা কেন ও যে তার জন্য প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা স্যালারি পায় কারণ ওর ঝুলিতে রয়েছে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি!

গালে হাত দিয়ে বসে এটাই ভাবছে সবুজ! কী করবে, কোথায় যাবে কিচ্ছু জানেনা! ফোনটা বের করলো পকেট থেকে! আগে মনোজ দাকে করলো!” দাদা তুমি বললে ট্যালি টা দেখিয়ে দেবে!” মনোজ একটু ব্যস্ত স্বরেই বললো “হুম সে তো বলেছি! ট্যালি কোর্সের দাম জানিস? বেসিক সাড়ে তিন হাজার! পারলে ভর্তি হয়ে যা! সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস করাবো!” কত কী বলছে মনোজ কান মাথা ঘুরছে সবুজের! এখানেও জালিয়াতি! সুযোগ খোঁজার চেষ্টা! সেদিন রাস্তায় এমন ভাবে ধরে বললো যেন ও এমনিই শিখিয়ে দেবে! বুক ফেটে কান্না আসছে যেন সবুজের!

একটা আশা মরলো আবার! ফোনটা কেটে আবার করলো সজল কাকুর দোকানে! রিং হতেই ধরলো ফোনটা। “কাকু একটু দেখে বলবে বাবা ঠিক আছে তো? ” – সবুজ জিজ্ঞেস করতেই সজল বললো “হুমম প্রভাত দা ভালোই আছে! আমার দোকানেই বসে আছে! দিচ্ছি দাঁড়া!”

সবুজদের ঘরের পাশেই এই সজলের ছোটখাটো একটা দোকান। আগে ওর দোকান থেকেই প্রভাত মাস কাবারি আনতো! চাল ডাল তেল মশলা ভরে থাকতো ঘরে! প্রভাত বছর খানেক আর বেরোতে পারেনি! ডাক্তার বলেই দিয়েছে বেশি ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো! হার্টে চাপ পড়বে! সেই থেকে আর বেরোতে দেয়নি সবুজ! মাস আটেক সবুজের পড়ানো আর প্রভাতের জমানো – টুকটুক করে গাড়ি চলছিল হঠাৎ যেন সব শেষ! প্রভাত বলে বসে খেলে রাজার ধনও যে ফুরায় বাবা! সত্যি বোধহয় তাই! আজকাল তো মাসের শেষের খাবার যোগান দিতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে সবুজের !

” বল বাবা!” – প্রভাতের গলা পেয়ে সবুজ বললো ” বাবা মুড়িটা খেয়েছিলে? ” সবুজের কথায় আশ্বাস দিয়ে বললো খেয়েছি! তারপর জ্বরের ওষুধ খেয়েছি! এখন কিছুটা সুস্থ! তাই তো সজলের দোকানে একটু বসতে এলাম! ” বাবার কথায় সবুজ একটু বিরক্ত হয়েই বললো ” সে ঠিক আছে! কিন্তু কারোর থেকে আবার বিড়ি নিয়ে খেয়ো না!”

এই এক চিন্তা সবুজের! ফ্রিতে ভাত দেওয়ার লোকের অভাব থাকলেও বিড়ি দেওয়ার লোকের অভাব হয় না! “না না সে খাবো না! তুই সাবধানে থাক! আর যেটুকু চাল ছিল ভাত করে নিয়েছি! সজলকে বললাম পঞ্চাশ সর্ষের তেল দিতে আর দুশো আলু! বললাম আগের যা পাওনা আছে সব শুদ্ধ দিয়ে দেবো!”

একটু নিশ্চিন্ত লাগছে সবুজের! ধারে হোক আর বাকিতে দুপুরে খাওয়াটা তো জোগাড় হলো! রাতে অবশ্য এখান থেকেই খাবার নিয়ে যায় ও আর মানদা! ” ও বাবু, সবুজ! ” বাবা ডাকছে শুনে ” বলো বাবা ” বলে সাড়া দিলো সবুজ! “দুটো ডিম নেবো? ” -চোরের মত জিজ্ঞেস করলো বাবা!

আগের মাসের বারোশো এখনকার বাকী! তারপর আজকে কিছু চাপলো! ভাবনাটা মাথায় আসতেই বলে দিলো “আলুসেদ্ধ আর সর্ষের তেল দিয়ে চালিয়ে নাও আর ধার বাড়াতে হবেনা!”

কথাটা বলেই ফোন কেটে দিলো সবুজ! দুটো ডিম বড় কথা না! লোকের কথা হজম করাটাই বড় কথা! সজল কাকু দেখা হলেই সবার সামনে বলে সবুজ বারোশো! অথচ এই কাকুর যখন সবে দোকান খুলেছে প্রভাত ইচ্ছে করে সব এখান থেকেই আনতো! প্রভাত বলতো – পাড়ার ছেলে দোকান খুলেছে এটুকু না করলে কী করে হবে! সব ভুলে গেছে!

কে জানে হয়তো ভুলে যায়নি বলেই আজ এইটুকু আবার ধারে দিলো! ভাবনাটা আসতেই মনটা অনেক শান্ত হলো সবুজের! গীতার কোনো এক শ্লোক বিশ্লেষণে পড়েছিল –

“যে ব্যক্তি পরের দোষে নয়, গুণে বিচার করতে শেখে, সে নিজের চিত্তকে শান্ত রাখতে পারে।” সত্যি বোধহয় তাই! হঠাৎ সজল কাকুর ওপর রাগটা পরে গেলো! কিন্তু মনটা সবুজের খচখচ করছে! বাবা একটা ডিম খেতে চেয়েছিলো সেটাও দিতে পারলো না! রাতে এখান থেকে ঠিক একটা ডিমের ব্যবস্থা করবে! রাতে পঞ্চুদা ওর মতো ডাল তরকারি ভাত দেয়! সেখানে সবুজ আরেকটু ভাত বেশি ভরে নেয় লুকিয়ে, আজ না হয় আরেকটা ডিম নিয়ে নেবে! শুধু বাবার জন্য! ওর দরকার নেই! এতে দোষ হবে না!

পঞ্চুদা কম দোষ করেছে! ক্যাশ সামলানোর জন্য ডেকে বাসন মাজাচ্ছে! দুদিন লোক দেখানোর জন্য সিঁথির হোটেল টায় গেলেও এখন এখানেই থাকে! না থেকেও উপায় নেই লোক তো রাখবে না! সব পয়সা একা খাবে! মাঝে মাঝে ভিড় থাকলে খাবার পরিবেশনের কাজেই হাত লাগায়! পালাবে সবুজ! একদিন ঠিক পালাবে! এভাবে নিজেকে অসম্মানিত করার কোনো অধিকার ওর নেই! বাবার অনেক কষ্টের টাকায় লেখাপড়া করেছে সবুজ! আর তার হিসেব গিয়ে দাঁড়িয়েছে এই জগন্নাথ হোটেল।

” জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসেব নিকেশ কিছুই রবে না!”

গান বাজছে রেডিওতে! এই সময় এরকম গান বাজতেই থাকে! পুরোনো দিনের গান! রেডিওতে মন যেতেই সেই বিজ্ঞাপনটার কথা মনে পড়লো! দুঃস্থ বয়স্কদের জগন্নাথ দর্শনের সুযোগ! একবার ফোন করবে কী! যদি বাবার এই শখটা অন্তত পূরণ হয়! এমনিতে তো সম্ভব না! মনে করার চেষ্টা করলো নাম্বারটা 99874567 আর মনে পড়ছে না! 85 কী! হ্যাঁ এটাই বোধহয় রিং করলো সবুজ! একজন মহিলা ধরতেই ও জগন্নাথ দেবের বিষয়টা বললো রং নাম্বার বলে কেটে দিলেন!

আবার ফোন করলো 58 দিয়ে একই বললো রং নাম্বার! কেন যে লিখে নিলো না! কী করে লিখতো সবুজ তো তখন বাসন মাজছিলো! কিছুতেই মনে পড়ছে না! কত নাম্বার ছিল যেন! খুব অস্বস্তি হচ্ছে সবুজের! কান্না পাচ্ছে! চোখ গেলো কৃষ্ণ রাধার সেই প্রেম মাখা ছবির দিকে!
আবার রাগ হচ্ছে! দুঃখ হচ্ছে! উনি নাকি সব বোঝেন, সব দেখেন! দেখতে পাচ্ছেন না সবুজের কষ্টটা! কেঁদেই ফেললো সবুজ।

“আপনি কী জানেন যে আপনার ভাগ্যেই এবার আছে পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করার সুযোগ! বুঝলেন না তো! এই বছর ‘জগন্নাথ সেবা সংঘ’ গরিব, অসুস্থ ও বৃদ্ধদের জন্য রথযাত্রা দর্শনে বিশেষ বাস চালাচ্ছে। নির্দিষ্ট আবেদন ফর্ম পূরণ করে বাছাই হলে পুরী দর্শনের সুযোগ পাবেন। যোগাযোগ করুন 998745……”

হঠাৎ খেয়াল হলো রেডিওতে আবার বলছে! আর দেরি করলো না তাড়াতাড়ি ডায়াল করলো সবুজ! রিং হচ্ছে! রিং শুনতে শুনতেই কৃষ্ণ ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো! কেন যে এমন করে সবুজ ওঁকে দেখলে! হাসে, কাঁদে, রাগ করে! যেন ওর আত্মীয়!

” হ্যালো! জগন্নাথ সেবা কেন্দ্র!” – ওপাশ থেকে বলতেই শান্তি লাগলো সবুজের! ” আপনাদের ওখানে ফর্ম ফিল আপ করতে চাই!” সবুজের কথায় ভদ্রলোক বললেন “এখানে আসুন! ফর্ম ফিলাপ করুন! বয়সের সার্টিফিকেট, আধার কার্ড আনবেন! ক্যান্সার পেসেন্ট হলে আসবেন না! লটারি হবে! সিলেক্ট হলে ডাকবো! আর হ্যাঁ ফর্ম ফিলাপের জন্য কুড়ি টাকা লাগবে!”

ভদ্রলোক বোধহয় সারাদিন এই কথা বলতে বলতে মেশিন হয়ে গেছে! ওঁর কথা শেষ হতেই সবুজ বললো ” এই যে বললেন টাকা লাগবে না!” কুড়ি টাকাই লাগবে আর কিছু না! শ্রীগুরু আশ্রমে রাখা হবে, খাওয়া ফ্রি! মন্দির দর্শন সমুদ্র দর্শন পরের পরের দিন ফিরিয়ে আনবো!” – ভদ্রলোক বলতেই সবুজ ঠিকানা জিজ্ঞেস করলো! উনি বললেন আর সবুজ পেন দিয়ে লিখে নিলো কী কী সবজি লাগবে সেটা লেখার খাতাটায়!

ভদ্রলোক ফোন কেটে দিতেই মনে মনে হিসেব করলো সবুজ! কুড়ি টাকা করে যদি দুশো জন লোকও ফিলাপ করে চার হাজার টাকা! যাবে মাত্র চল্লিশ জন! আশ্রমে থাকবে মানে খাওয়ার খরচ তেমন নেই! এটুকুতেই থেমে গেলো!
ধুর এই হিসেব করে কী হবে! একাউন্টস নিয়ে পড়ে এই এক বদ অভ্যেস তৈরী হয়েছে ওর! ফোন রেখে কৃষ্ণের ছবির দিকে তাকালো সবুজ ! মনে মনে বললো ” উমম রাধার সাথে থেকে মুখে হাসি যেন আর ধরে না! ”
কৃষ্ণ ঠাকুরের সাথে এভাবেই কথা বলে সবুজ! কে জানে হয়তো সবুজ জানে এই মানুষটাই একমাত্র যে ওর কথায় প্রতিবাদ করবে না!
” সবুজ এঁটো গুলো তোল!”

চলবে।