#জগন্নাথ_হোটেল
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
#তৃতীয়_পর্ব
“যদি কৃষ্ণ ঠাকুরের গলার মালাটা একবারে পরাতে পারি তবে বাবার পুরী যাওয়ার চান্স আছে নাহলে না ! ” ভাবতে ভাবতেই গলায় মালাটা পরিয়ে দিলো সবুজ ! একেবারে সুন্দর সেট হয়ে বসে গেছে ! একটু পা উঁচু করে দূর থেকেই মালাটা পরাতে হয় ! কোনোদিন ভালো হয় কোনদিন অনেক কষ্ট করে পরাতে হয়!
যবে থেকে হোটেলে কাজ করছে এটা আরেকটা দায়িত্ব সবুজের ! বৃহস্পতিবার করে এসে হাত ধুয়ে মালা পড়ানো ! জগন্নাথ দেব , শ্রী কৃষ্ণ , লোকনাথ বাবা , বজরংবলী কম ঠাকুর এখানে ! সবাইকে মালা পরায়! ঐদিন পুরোহিত সাজে সবুজ! সবুজের উচ্চতা অনুসারে এই দায়িত্ব ! দেওয়ালের অনেকটা ওপরে ছবিগুলো থাকায় পাঁচ ফুটের পঞ্চুদার হাত পৌঁছায় না !
ভালোই লাগে ওর পুরোহিত সাজতে! কৃষ্ণের গলায় মালা পরিয়েই উল্টোদিকের দেওয়ালের দিকে গেল ওখানেই আছে বাকি ঠাকুররা ! এবার সবুজ গেলো সোজা বজরংবলীর কাছে ! তাঁর আবার জবার মালা ! মনে মনে ভাবছে সবুজ যদি মালা পড়াতে গিয়ে একটা ফুল খুলে যায় তাহলে বাবার যাওয়া হবে !
সত্যি তাই ! বজরংবলীর গলায় মালা পরাতেই একটা ফুল খুলে গেলো ! এটাও জানা নিয়ম ! এক একটা ফুল এমন আলগা ভাবে গাঁথা থাকে যে মাঝে মাঝেই পরাতে গিয়ে খুলে যায় ! কিন্তু তাই বলে প্রতি বৃহস্পতিবার তো খোলে না মাঝে মাঝে খোলে আজ যখন একটা ফুল পড়ে গেছে তার মানে ভগবান ইঙ্গিত দিচ্ছে বাবার পুরী যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না !
এবার বজরংবলীর পাশে জগন্নাথ দেব ! তাকে মালা পরাচ্ছে সবুজ ! মালা পরাতে পরাতে যদি ওর মন হ্যাঁ বলে তাহলে জানবে ওটাই সত্যি ! কারণ পুরী যে জগন্নাথ দেবেরই ধাম ! মালাটা পরাতে গিয়ে কেউ যেন বলে দিলো শুধু বাবা নয় তুইও যাচ্ছিস পুরীতে !
এবার বেজায় চমকালো সবুজ ! এটা বোধহয় একেবারেই বিশ্বাসের উপযুক্ত নয় ! কারণ জগন্নাথ সেবা কেন্দ্র বাস ছাড়বে আঠাশে , এক তারিখ সকালে ফিরেও আসবে ! আর পঞ্চু দা এক তারিখের আগে কিছুতেই মাইনে দেবে না ! টিউশন বাড়ি গুলোতো ছেড়েই দিলো কোনো সময় জ্ঞান নেই!
আর পুরো বাড়ি খুঁজে দুশো টাকা খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ! পঞ্চুদা ছুটি দেবে কিনা সেটা তো ছেড়েই দিলো সবুজ ! কিন্তু এমন কথা কেন মনে আনালেন জগন্নাথ দেব ! ধুস মূর্তি ছবি এঁরা আদৌ কিছু করে নাকি!
আসলে এইসব মন গড়া কথা সবুজের ! ওরও তো যেতে ইচ্ছেই করছে ! শুধু জগন্নাথ দর্শন বলে নয় বাবাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না !শরীরটা তো ভালো নেই !
যদিও সেদিন ভদ্রলোক বললেন ওনারা খুব যত্ন করে নিয়ে যাবেন ! আর সাথে একজন ডাক্তার যাবেন ! এই উদ্যোগটা ওই ডাক্তারেরই নাকি ! ওনার বাবার শখ ছিল মৃত্যুর আগে একবার পুরী যাবে ! কিন্তু শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে সম্ভব হয়নি ! ভদ্রলোক মারা গেছেন ! তাই এরকম একটা ইচ্ছে – চল্লিশ জন বয়স্ক লোক যারা পুরী দর্শন করতে চান কিন্তু সামর্থে কুলায় না তাদের জগন্নাথ দর্শনে নিয়ে যাবেন !
সব খরচই ওনার ! তবে এই কুড়ি টাকাটা যেটা ফর্ম ফিলাপে নিচ্ছে সেটা সেবা কেন্দ্রেই দান করবে যেহেতু ওনারা দায়িত্ব নিয়ে এতো কিছু করছেন ! আগের শুক্রবারই তো পঞ্চুদার থেকে কুড়ি টাকা ধার নিয়ে সবুজ ফর্ম ফিলাপ করে এসেছে ! দুটো স্টেশন পরেই ওদের সেবা কেন্দ্র টা ! বেশ লেগেছে সবুজের ! অনেকক্ষণ রিসেপশনের ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেছে সবুজ ! সব বলেছে- ওদের অবস্থা, দিন আনা দিন খাওয়া সংসার, কখনো কোথাও যায়নি ওরা, শুধু বাবার ইচ্ছে পুরীতে একবার যাওয়ার সাথে এটাও বলেছে বাবার হার্টের অবস্থা ভালো না , ও একাউন্টেন্সি নিয়ে পড়েও চাকরি পায়নি একটা ভাতের হোটেলে কাজ করে ! যত দুঃখের কথা আছে ওর জীবনে সব বলেছে সবুজ ! উদ্দেশ্য একটাই -যদি ওদের দয়া হয় আর লটারিতে নাম না উঠলেও ওর বাবাকে যদি একটা চান্স দেয় ! নাহলে সত্যি সবুজ আজ অবধি নিজের দুঃখের কথা কৃষ্ণ ঠাকুরকে ছাড়া আর কারোকে বলেনি ! কি হবে বলে সবাই আহা উহু করে পিছন ফিরতেই লোকের কাছে গিয়ে গাল গপ্প করবে, হাসবে !
নিজের চোখে দেখেছে সবুজ ! নিজের পিসিকে ! পিসতুতো দাদাকে! দাদাভাই বড়ো একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। কতবার বলেছে সবুজ দাদাভাই একটা চাকরি দেখিস না আমার জন্য ! এক কথা গ্র্যাজুয়েশনের কোনো দাম নেই এখন ! সেই থেকে আর ফোন করলে ধরেও না ! খুব রাগ হয় সবুজের ! আর বিশ্বাস হয় না আত্মীয়দের !
কিন্তু আজ বারবার কেন মনে হচ্ছে ও পুরী যাবে ! কী ভরসা আছে ওই মূর্তিটার! বাবা বলে মনের ইচ্ছে মনে রাখলে হয়না তার জন্য চেষ্টা করতে হয় ! চেষ্টা করবে কী ভাবে! সেটা ভাবতেই মনে পড়লো শ্যামল কাকুর কথা ! কলেজে যাওয়ার সময় আলাপ ! ওদের স্টেশনেই টিকিট কাউন্টারে বসতো কাকু ! কনসেশন জোগাড় করে দিয়েছিলো ! এক টাকার মান্থলির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো ! আজ কি একবার ফোন করবে ! যদি পুরীর ট্রেনের একটা টিকিট জোগাড় করে দেয় ! ওখানে পৌঁছে না হয় শ্রীগুরু মন্দিরের মেঝেতে শুয়ে কাটিয়ে দেবে ! খাওয়া ঠিক জুটে যাবে!
কত কি আজগুবি ভাবনা ভেবে চলেছে সবুজ ! সাথে ফোনটা করে নিলো শ্যামল কাকুকে ! ভদ্রলোকের এটা বেশ ভাল কখনো আশাহত করেন না ! বললো দেখছি ! সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে পুরীতে যাওয়াটা ঠিক হবে- দুজনেরই হবে !
” বাসন গুলো মাজা হলো তোর ? এগারোটা বাজে !” পঞ্চুদার কর্কশ মার্কা মিষ্টি গলায় স্বপ্ন থেকে যেন বাস্তবে ফিরলো সবুজ ! আজ কিচ্ছু বিরক্ত লাগছে না ! বরং সব ভালো লাগছে ! বেসিন ভর্তি বাসন , মাছের লাল ঝোল , আঢাকা তেলতেলে আলু ভাজা তাতে মাছি গুলোর বিশ্রাম নেওয়া ! অন্যদিন এগুলো দেখলেই বিরক্ত লাগতো ! আজ মনে হচ্ছে যা হচ্ছে বা যা হবে সব ভালো হবে।
জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা , ইয়াহাঁ কল ক্যায়া হো কিসনে জানা…
রেডিওতে গাঁকগাঁক করে বাজছে ! খারাপ লাগছে না সবুজের ! গুনগুন করে ও গাইলো ! আজকে বারবার মনে হচ্ছে সবুজের সামনে খুব সুন্দর দিন আসতে চলেছে!
আজকেই তো খবর আসবে বাবা পুরী যাচ্ছে ! ব্যাস এটুকু হলেই হবে ! বাবা ঘুরে আসলেই ওর শান্তি ! আজ বারবার ফোনটা দেখছে সবুজ ! জগন্নাথ সেবা কেন্দ্র থেকে বলেছিলো বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফোন যাবে ! এতদিন যখন আসেনি আজ তো আসবেই ! ভদ্রলোক সেদিন সবুজের দুঃখ শুনে এতো বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন উনি কথা দিয়েছেন আপ্রাণ চেষ্টা করবেন যাতে বাবার যাওয়ার ব্যবস্থা হয় ! তাই সেদিন ফিরেই বাবাকে বলেছে সবুজ সবটা ! প্রথমে একা যেতে হবে বলে একটু গাইগুঁই করলেও পরে রাজি হয়েছে প্রভাত ! আর হতেই হবে স্বপ্ন পূরণ বলে কথা ! বাবারটাই হোক আপাতত ! সবুজের দিন তো পরেই আছে ! এতো তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বে না সবুজ ! ভালো একটা চাকরি জোগাড় করবেই ! পজিটিভ চিন্তা গুলো বোধহয় এরকমই! একটা আসলেই বাকিরাও কাঁধে হাত দিয়ে পরপর আসে!
সবুজ দেখলো মাছ গুলো ভাজা হয়ে এসেছে মানদা মাসির ! আধ ভাজা মাছই তুলে রাখলো ! এবার যারা চাইবে ঝোলে ডোবাবে আর দেবে ! কতবার বলেছে সবুজ মাসি মাছগুলো ভালো করে না ভাজলে আঁশটে গন্ধ লাগে ! কার কথা কে শোনে ! ধুর যা পারিস কর! আর লোকগুলোকেও দেখেছে সবুজ এই ঝোল মাখা ভাতই কেমন হাপুস হুপুস করে খাবে ! আবার মানদা মাসির কী প্রশংসা !
হাসি পেয়ে গেলো সবুজের ! সেদিন বাবার জন্য একটা ডিম নিয়ে গেছিলো লুকিয়ে ! একটাই ! ওরকম লোকানো চুরানো খাবার বাবা অসুস্থ তার জন্য ঠিক আছে ! ও খাবার সবুজের হজম হবে না ! কিন্তু বাবা শুনলে তবে তো ! অর্ধেক ডিম ভেঙে ঠিক সবুজের পাতে দিয়েছিলো ! খেতে গিয়ে সেই আঁশটে গন্ধ ! গা গুলিয়ে উঠেছিল সবুজের ! বাবা যদিও বোঝে নি ! আসলে মানদা মাসির রান্নার গন্ধটা যেন নাকে ঢুকে বসে আছে সবুজের ! মনে হয় সবেতেই ওই গন্ধ !
রান্না রেডি তো ? দুটো রুই ভাত !” – সবুজ দেখলো পঞ্চুদা এসে মুখ বাড়িয়ে বলছে ! মানদা মাসি তখন মুরগির ঝোলে বেশ করে লাল লঙ্কা মেশাচ্ছে !কারখানার লোকগুলো বড্ডো ঝাল খেতে পারে ! এই ঝোলে আবার ডলে ডলে লঙ্কা মাখে ! মানদা মাসি বলে ওরা পান্তা খায় তো তাই লঙ্কা মেখে খাওয়া ওদের অভ্যেস ! সবুজের অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা – ওমন বিস্বাদ ঝোলের হাত থেকে বাঁচার জন্য লঙ্কা মাখে ! যাতে ঝালের জন্য মুখে দিয়েই গিলে ফেলতে পারে ! -“মানদা দির রান্না চলছে ! সবুজ তাড়াতাড়ি দুটো ভাত বেড়ে নিয়ে আয় ! এদের একটু ঘি দিস প্রথম পাতে ! আর মাছের দুটো পেটি !” –
পঞ্চুদার কথায় বুঝতে অসুবিধা হলো না এঁরা যে সে লোক নয় ! বেশ উঁচু মাপের ! ফ্যাক্টরির দলের নেতা জাতীয় কিছু হবে ! তেলা মাথায় তেল দেওয়াটা স্বভাব পঞ্চুদার ! ভগবানদেরও ছাড়েনা ! নাহলে এইটুকু হোটেলে এতো ঠাকুরের ছবি ! সবুজ দুটো থালায় একে একে ভাত , ঘি , শাক ভাজা , আলু ভাজা , ডাল আর মাছ গুছিয়ে খেতে দিয়ে আসলো ! দুটো রুই ভাত মানে – আশি প্লাস আশি একশো ষাট ! যতটুকু নজরে পরে ঠিক হিসেবে রাখে সবুজ ! এটা হয়তো একাউন্টসের ছাত্র বলেই ! সবেতেই হিসেবটা খুব তাড়াতাড়ি করে নেয় !
থালা দুটো দিয়ে ভেতরে আসতে পারেনি আবার কাস্টমার ! সবজি ভাত আর মাংস ভাত ! আবার দুটো রুই ভাত। আজ আর সময় পাচ্ছে না সবুজ! মনে আশাগুলো আনন্দ তৈরী করেছে আর সেই আনন্দের জেরেই সবুজ একটার পর একটা এঁটো থালা তুলে বেসিনে রাখছে সাবান মাখাচ্ছে আর ধুচ্ছে!
হঠাৎ ঘড়িতে চোখ গেলো তিনটে পাঁচ! তাড়াতাড়ি এসে ফোনটা দেখলো সবুজ! কোনো ফোন নেই! লাস্ট ফোন সজল কাকা! বাবার খোঁজ নেওয়ার জন্য করেছিল! এতো বেলা হয়ে গেছে! ওদের লটারি কী এখনো হয়নি!
ফোন করবে কি! নাকি আরেকটু দেখবে! নাহ, আর দেখে লাভ নেই! এইটুকু শুধু বলে দিক যে লটারিটা এখনো হয়নি! ফোন করলো সবুজ! রিং হচ্ছে! বুকটা ঢিপঢিপ করছে সবুজের ! কৃষ্ণ ঠাকুরের মালাটা আজ দারুণ পরানো হয়েছে! বজরংবলীর নীচের তাকটায় জবা ফুলটা পড়ে আছে! জগন্নাথ দেবের মুখ দেখে কিছু বোঝা না গেলেও সবুজ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে উনি হাসছেন !তারমানে ভালো খবর নিশ্চয়ই পাবে যে রিং হয়েই যাচ্ছে! মাধ্যমিকের রেজাল্টের সময়ও এতো ভয় পায়নি সবুজ !
” জগন্নাথ সেবা কেন্দ্র!” – ওপাশ থেকে বলতেই সবুজ বললো ” আপনাদের লটারিটা হয়ে গেছে? ” ভদ্রলোক একটু থেমে বললো ” হুম, সে তো পরশুই হয়ে গেছে!” সবুজ যেন আকাশ থেকে পড়লো! রেগে বললো “ফোন করেননি তো আমাকে! আমার বাবা প্রভাত! ” এটুকু বলতেই ভদ্রলোক আরও রেগে বললেন ” চান্স পায়নি তাই ফোন করিনি!”
ফোন কেটে দিলো ভদ্রলোক! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গেছে সবুজ! কী হলো এটা! তাকালো আবার ছবি গুলোর দিকে! কৃষ্ণ ঠাকুরের মালাটা আজ দারুণ পরানো হয়েছে! বজরংবলীর নীচের তাকটায় জবা ফুলটা পড়ে আছে! জগন্নাথ দেবের মুখ দেখে কিছু বোঝা না গেলেও সবুজ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে উনি হাসছেন।
কী হলো তাহলে এটা!
সবুজ এঁটো গুলো নিয়ে যা!” – ডাক আসতেই ছুটলো সবুজ! এটাই বোধহয় ওর ভবিতব্য!
চলবে।