অন্তর্ভেদী পর্ব-০১

0
1

#অন্তর্ভেদী
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১

একদিন প্রচন্ড মাইগ্রেনে ব্যাথা উঠলো। ব্যাথা এতোটাই তীব্র ছিলো যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে রাতে ডাক্তারের কাছে নিতে না পারলেও পরদিন আম্মু আমায় জোর জবদস্তি ডাক্তারের কাছে পাঠালেন। তখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। এই ডাক্তার আর ওষুধে আমার বেশ এলার্জি আছে। তীব্র জ্বরেও কেউ আমাকে ডাক্তারের কাছে আনতে পারতো না ছোট থেকেই। বান্ধবী শারমিনের সাথে ডাক্তারের কাছে এসেছি। সিরিয়াল দিয়ে আসিনি। লম্বা লাইন! তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে সেই লাইনের একদম শেষে আমার দাঁড়াতে হলো। মনে হচ্ছিলো এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আমি ইন্তেকাল করব। কিছুক্ষণ পর পর শারমিনকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি গিয়ে বসছিলাম। অতিরিক্ত গরম আমি সহ্য করতে পারি না। প্রচন্ড অসুবিধে হয় আমার। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু না। ঘন্টাখানেক দাঁড়ানোর পর আমি কিছুটা এগিয়েছি। আমার আগে আছে পাঁচ জন। এরপরই আমার সিরিয়াল। হঠাৎই রিসেপশনিস্ট বললেন ডাক্তার আধা ঘন্টা পর দেখা শুরু করবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ৩০ মিনিট বলেছে মানে এক ঘন্টা। একে তো মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিলো এখন আবার এই বুইড়া ডাক্তারটাও নাটক শুরু করেছে।

আমার পেছনে আরো তিন জন আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হওয়ার উপক্রম। মিনিট পঁচিশ পেরোতেই একজন ভদ্রলোক সিরিয়াল ভেঙে সামনে চলে যাচ্ছিলো। রাগ তো এমনিতেও নাকের ডগায় ছিলো এবার আরও বেরে গেলো। আমি চেচিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বললাম,
-“আরে কি ব্যাপার এখানে সিরিয়াল আছে দেখতে পাচ্ছেন না? হিরোর মতো সামনে চলে যাচ্ছেন! কানা নাকি?”

ভদ্রলোক পিছু ফিরে আমার দিকে তাকালেন। আমি বেশ চমকালাম। ভদ্রলোক অতি মাত্রায় সুদর্শন। তিনি মাত্রা অতিরিক্ত ভাব দেখিয়ে কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি থতমত খেলাম। পাশ থেকে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আপনি কাকে কি বললেন? উনিই তো ডাক্তার”

‘উনিই তো ডাক্তার’ এটুকু শুনে আমি শক খেলাম। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। শেষমেশ কি না ডাক্তারকেই কথা শুনিয়ে দিলাম? কি লজ্জা কি লজ্জা। লজ্জায় আমার অবস্থা শেষ। শারমিন এক নাগাড়ে হেসে যাচ্ছে। মন চাচ্ছে থাপ্পড় মারি। আমার ভাবনা অনুযায়ী ডাক্তারের বয়স হবে পঞ্চাশ +। অথচ ডাক্তার কি না এতোটা ইয়াং? আমারই বা কি দোষ? আমি যতগুলো ডাক্তার দেখিয়েছি সবাই বয়স্ক। আমার তুক্ষর মেজাজের কারণেই আজ এই পরিস্থিতি। আমার সিরিয়াল আসতেই শারমিনকে নিয়ে আমি ভিতরে গেলাম। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসলাম ডাক্তারের সামনে। টেবিলের উপর গোলাকার নেমপ্লেটে ইংরেজিতে বড় বড় করে নিলে “অনয় আহমেদ”। ড. অনয় আমার দিকে তাকিয়ে আমার সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলেন। চোখে চোখ পরলো দু’জনার। আমার লজ্জা আরো কয়েকশো গুন বেরে গেলো। আমি লজ্জিত হওয়া কন্ঠে তাকে বললাম আমার সমস্যা।

তিনি ঔষুধ লিখে বললেন,
-“মিস মিলি ইমারাহ্ আবার সামনের সপ্তাহে আসবেন। এরপর আসলে মেজাজটা একটু ঠান্ডা করে আসবেন”

আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। শারমিনকে নিয়ে তাড়াহুরোয় বেরিয়ে পরলাম। ড.অনয় বেশ সুনর্শণ পুরুষ। এক দেখায় যেকোনো নারীর পছন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু আমার তাকে মোটেও পছন্দ হয়নি। বদ, ফাজিল লোক! আমি না হয় ভুল করে বলেই ফেলেছি তাই বলে তিনি আমায় লজ্জা দিবেন? পেশেন্টের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে? শারমিনের সাথে তাকে নিয়ে কথা হলো। কথা বলতে আমিই উল্টোপাল্টা বকছিলাম ড.অনয়কে। বাড়ি ফিরে আরেক কান্ড আব্বা আমার জন্য পাত্র দেখেছে। পাত্র আর্মির ভালো পোস্টে চাকরি করছে। আর্মি শুনেই আমার নাক কুঁচকালো। নাক ছিটকে আব্বাকে সরাসরি না করলাম। আর্মি আমার মোটেও পছন্দ নয়। কোনো কারণ ছাড়াই পছন্দ না।

পাত্র রিজেক্ট করায় আব্বা আমার সাথে গুনে গুনে দুদিন কথা বললো না। আমিও জেদ ধরে কথা বলতে যায়নি। আম্মার অবশ্য শোকতাপ নেই। তিনি তার মতো ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। আব্বা দু’দিন কথা বলেনি। শুক্রবার, শনিবার আমার অফিস বন্ধ থাকে। আজ রবিবার সকাল সকালই ব্যস্ত জীবনে ফিরে এসেছি। রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে নাস্তা করতে বসেছি। আব্বু তখন শক্ত কন্ঠে বললেন,

-“তুমি কি আজীবন অবিবাহিত থাকতে চাও মিলি?”
আমি খেতে খেতেই জবাব দিলাম,
-“একদমই না। আজীবন কে অবিবাহিত থাকে আব্বু?”
-“তাহলে ছেলেটাকে রিজেক্ট করলে কেনো? কি সমস্যা ছিলো তার মধ্যে?”
-“আমার আর্মি পছন্দ না। তুমি অন্য পাত্র দেখো। পছন্দসই হলেই বিয়ে করে নিবো”

আব্বুর দিকে না তাকিয়েই তাড়াহুড়ায় বের হয়েছি বাড়ি থেকে। আব্বু ক’দিন যে এই এক বিষয় নিয়ে কাহীনি করবেন তা আর না বলি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই বৃষ্টি শুরু হলো। ওই বৃষ্টিতেই আধভেজা হয়ে অফিস করতে হলো আমার। অফিস থেকে যখন ফিরছি তখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। আমার ভাগ্যটাই বোধ হয় খারাপ। মাঝ রাস্তায় রিকশা খারাপ হলো। অর্ধেক ভাড়া দিয়ে নেমে পরতে হয়েছে। কি যন্ত্রণা! গতকাল ওই অভদ্র ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পর থেকেই আমার সাথে একের পর এক কিছু না কিছু হয়েই যাচ্ছে। রিকশা পেলাম না। এই সন্ধ্যায় আমার হেঁটে ফিরতে হবে। হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম। তখনই পেছন থেকে কেউ একজন প্রচন্ড জোরে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় কাঁদা পানি ছিটে এসে আমার সাদা জামাটায় লাগলো। রাগ তড়তড় করে বেড়ে গেলো। বাইকটা কিছুটা দূরেই থেমেছে। আমি হনহন করে বাইকের সামনে গিয়ে বললাম,

-“এই বদমাশ লোক মাথায় সমস্যা? রাস্তায় কীভাবে গাড়ি চালাতে হয় জানেন না? বেয়াদব অসভ্য লোক”

রাগে আমার গা জ্বলছে। ভদ্রলোক না না অভদ্র লোকটা হেলমেট খুলে আমার দিকে তাকাতেই আমি চমকালাম। এতো ড.অনয়। এবার আর লজ্জা লাগলো না। মেজাজ এতোটাই খারাপ হলো যে লাথি মেরে বসলাম ড. অনয়ের বাইকে। তিনি বোধ হয় কিছু বলতে চাইলেন আমি শুনলাম না সোজা হাঁটা ধরেছি। পেছন থেকে অবশ্য তিনি মিলি মিলি করে কয়েকবার চেঁচিয়েছেন। আমি শুনিনি। আমার ভাগ্য বোধ হয় অনেক ভালো ছিলো। তখনই রিকশা পেয়েছি।

২.

পরের সপ্তাহে হাসপাতালে যাওয়ার কথা থাকলেও আমি গেলাম না। না যাওয়ার কারণ ড.অনয়। তার সামনে আমি মোটেও পরতে চাই না আর। অভদ্র, অসভ্য লোক। আমার পছন্দের ড্রেসটা শেষ। আর পরার মতো অবস্থা নেই। আব্বু অবশ্য এর মাঝে পাত্র দেখছেন দু’জন। আমি খুঁত বার করে রিজেক্ট করেছি। আসলে এই মুহুর্তে আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই নেই। আমি ঘুরতে চাই। পাহাড় চড়া আমার নেশা। সাজেক ভ্যালি, নীলাচল,নীল গিড়ি সব খানেই আমার যাওয়া। সাজেক ভ্যালিতে আমি প্রায়শই ছুটে যাই। আমার আসলে চাকরি বাকরিতে মন টানে না। যখন তখন চাকরি ছেড়ে দেই। এই তো তিন মাস আগেই একটা ছেড়েছি। এই চাকরিটা হয়েছে মাস দেড়েক হলো। বোরিং ফিল হচ্ছে। এই আষাঢ়ে বৃষ্টি আমায় টানছে সাজেক ভ্যালিতে। পাহাড়ের চূড়ায় বসে বৃষ্টি দেখবো আর চা খাবো!

পরদিনই ছুটি নিলাম সাত দিনের জন্য। শায়নাকে ফোন করেছি ও ফ্রি কি না! ওকে যাওয়ার কথা বলতেই বিনা বাক্যে রাজি হলো। ঠিক হলো আগামীকালই রওনা হবো। আমি জানি আব্বু আমায় যেতে দিবে না। এ জন্যই মিথ্যে বলেছি অফিস থেকে ট্যুরে যাবে সাজেক। আব্বু অবশ্য প্রথমে যেতে দিতে চায়নি। আমি জোর করাতে রাজি হয়েছে। পরদিন প্যাকিং করে শায়নার সাথে বেরিয়ে পরলাম সাজেকের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ যাত্রা শেষে সাজেকে পৌছালাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়েছে। রুমে এসে ঘুম দিয়েছি দু’জন।
ভোরে ঘুম ভাঙলো ঝুম বৃষ্টির শব্দে। কাঠের কটেজের ছাদ বেয়ে টুপটাপ শব্দে গড়িয়ে পরছে বৃষ্টি। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আমিটা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। সাজেকের বৃষ্টি অদ্ভুত সুন্দর। শায়না উঠেই জোর করলো শাড়ি পরতে। তার নাকি খুব শখ সাজেক ভ্যালিতে শাড়ি পরে বৃষ্টি ভেজার। আমি না করিনি। ভীষণ আদুরে ভঙ্গিতে নীল রঙের শাড়িতে নিজেকে সাজালাম। খোলা চুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম সেই বৃষ্টি। শানয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“মিলি এখানে দাঁড়া তোর দুটো ছবি তুলি। তোকে কি আদুরে লাগছে রে”

আমি হাসলাম। শায়না পাগলামি করে তুলেই ছাড়লো ছবি। এগুলো স্মৃতি। দু’জন কটেজ থেকে বের হয়ে হাঁটলাম সাজেকের ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তায়। ভিজে ভিজেই উপভোগ করলাম প্রকৃতি। সাজেকের বৃষ্টিভেজা রূপ।
বৃষ্টি থামলো দুপুরের দিকে। আজ কংলাক পাহাড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা গেলাম না। বৃষ্টির সময়টাতে সেখানে যাওয়া বিপজ্জনক। বিকালের দিকে শায়না আর আমি গেলাম আদিবাসীদের বাজারে। দু’জন ঘুরে ঘুরে টুকটাক জিনিস কিনলাম। ফেরার পথে প্রচন্ড মাইগ্রেনে ব্যাথা উঠলো। এক প্রকার রাস্তাতেই বসে পরতে হলো। শায়না দিক বেদিক হারিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ওদিকে আমি মাথা চেপে বসে আছি। কেউ একজন হুট করে আমায় তার বুকে আগলে নিলো। আলতো হাতে ম্যাসাজ করে দিতে দিতে শায়নাকে বলল,

-“আপনি এক কাপ কফি বা ঠান্ডা কিছু নিয়ে আসুন দ্রুত”

কন্ঠস্বর পরিচিত মনে হলেও আমি তাকাতে পারলাম না। ঘাপটি মেরে তার বুকে পরে রইলাম। ভদ্রলোক আমায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন। কিছুটা সুস্থ অনুভব হতেই সরে আসতে চাইলাম তার থেকে। সে আমায় ছাড়লো না। ধীরে ধীরে উঠতে সাহায্য করলো। চোখ তুলে মুখের দিকে তাকাতেই থতমত খেলাম।

অস্পষ্ট ভাবে বললাম,
-“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?

#চলবে