বসন্তপবনে প্রেমছন্দ পর্ব-০২

0
1

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০২.
‘আদর…!’
শব্দটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কেবল শুনতে পেলো টিকলি। আদরের গায়ে সাদা শার্ট। হাতদুটো পকেটে। পেছনে রিফার হাতে ওর কালো কোর্ট। রিফা এখানে এসেছে আদরের এসিস্ট্যান্ট হয়ে। যেকোনো ইভেন্টে, মেডিকেল ক্যাম্পেইন, মিটিং এসবে রিফা আদরের পার্ট-টাইম এসিস্ট্যান্ট হিসেবে থাকে। আদর হাত মেলতেই রিফা ওসে ওর গায়ে কোর্ট’টা জড়িয়ে দিলো। টিকলি ভ্রু কুচকে দেখলো দৃশ্যটা। এরপর আদরের ওই ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে গটগট করে হেটে চলে যাওয়াটাও দেখলো।

ঘোর কাটলো কলে থাকা অপরপাশের জনের ডাকে। টিকলি মাটিতে পরে যাওয়া হার্ড-বোর্ড তুলে আবার মাথা ঘুরিয়ে আদরের নির্লিপ্ততা অবলোকন করে বলল,

‘আমি আসছি।’

টিকলি হলের ভেতরে ঢুকলো। হলের শুরুতে যারা আজ সংবর্ধনা পেতে চলেছে তাদের নাম সম্মানের সহিত টানানো হয়েছে ছবিসহ। টিকলি এর পুরো দায়িত্বে ছিলো ঠিকই কিন্তু এই লিস্ট টানানো হয়েছে মিনিট দশেক আগে। টিকলির উদ্যোগেই কিন্তু টিকলি দেখেনি। সে তখন দিকনির্দেশনা দিয়ে সবে হলের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পঞ্চমে যার ছবি টানানো সেই লোকটাই আদর। টিকলি আদরের ছবির সামনে মিনিট তিনেক দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে দেখে গেলো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে এলো।

এরমাঝে ইভেন্ট ম্যানেজার এলেন বেশ ভাবসাব নিয়ে। টিকলি জানে, নিশ্চয়ই নতুন আরেক বোঝা ওর ঘাড়ে চাপানো হবে। তাই সে উলটো ঘুরে চলে যাচ্ছিলো ওমনি ডাক এলো,

‘ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মিস টিকলি, প্লিজ কাম হেয়ার। কাম কাম।’

টিকলি চোখ উলটে মুখ ফুলিয়ে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে হাসিমুখে সেদিকে এগিয়ে বলল,

‘ইয়েস, স্যার।’

‘এদিকের কাজ কমপ্লিট?’

”অলমোস্ট, স্যার।’

‘তোমার তবে এখন কোনো কাজ নেই?’

টিকলি নাক ফুলিয়ে জবাব দেয়, ‘নো, স্যার। অনেক কাজ আছে আমার।’

‘আচ্ছা কাজ থাকলেও সেটা এক সাইডে রাখো। আর শুনো, একটা মেয়ে শর্ট।’

টিকলি ঠিক এই ভয়টায় পাচ্ছিলো। আবার নতুন কাজ! সে আর কিচ্ছু করবে না। জুতা মারে সে এই চাকরিতে।

টিকলি কাট কাট গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তো?’

ম্যানেজার একটু নরম হলেন এই পর্যায়ে,

‘তো মানে, তোমাকে ডিরেক্টর স্যার সেই মেয়ের জায়গায় যেতে বলেছেন। সংবর্ধনার জন্য যখন সবাই স্টেজে যাবে তখন তুমি পাশে ফুল, ক্রেস্ট এবং সনদ নিয়ে দাঁড়াবে। And you have been selected number 5.’

এটা তেমন কোনো বড় কাজ নয়। মিনিট দশেক স্টেজে দাঁড়াতে হবে এই তো! তা নাহয় দাঁড়ালো। টিকলি মাথা নাড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলে,

‘ওকে, স্যার।’

পরমুহূর্তেই যখন ভালোভাবে খেয়াল করলো সেই মূহুর্তে উচ্চস্বরে বললো,

‘নো, ওকে। নাম্বার ফাইভ???’

‘হ্যাঁ। কোনো সমস্যা?’

‘সবকিছুই সমস্যা। এই নাম্বারে আমি ফুল নিয়ে যেতে পারবো না। চেঞ্জ করুন।’

‘হুয়াট? তোমাকে আমরা সিলেক্ট করিনি। তোমাকে এই অনুষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট থেকে সিলেক্ট করেছে। আমাদের হাত নেই।’

‘ইম্পসিবল।’

‘প্লিজ টিকলি, সিনক্রিয়েট করো না। এরজন্য তুমি বোনাস পাবে।’

‘বোনাসের কপালে আগুন। আমার বোনাসের দরকার নেই, স্যার।’

‘আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি! ডু ইউ নো নাম্বার ফাইভে কে আছে? ডাঃ আদর খান। একমাত্র ইয়াং নিউরোসার্জন যে এই সংবর্ধনা পাচ্ছে। ‘গৌরবের সম্মাননার’ ৩৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ত্রিশ বছর বয়সী নিউরোসার্জন এই সংবর্ধনা পাচ্ছে।’

‘তাতে আমার কি, স্যার? আমি পারবো না।’

‘ইউ হেভ টু ডু ইট আদারওয়াইজ রিজাইন।’

বলেই ইভেন্ট ম্যানেজার চলে এলেন। পেছন থেকে টিকলি বারংবার ডেকে গেলো। ম্যানেজারের কানে যেনো লাগে এমন ধারায় বললো,

‘স্যার! আমি পারবো না করতে। আমার কাজ থিম আর ডিজাইন ভিত্তিক সবকিছু তদারকি করা। আই এম নট আ প্রেজেন্টেশন এসিস্ট্যান্ট। উফফ…।’

বলে টিকলি মাথার চুল খামচে হাটু ভেঙ্গে বসে পরলো। একটুপর একজন মেয়ে এসে বলল,

‘ম্যাডাম! আপনাকে মেকাপ রুমে যেতে হবে।’

টিকলি একবার মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত শ্বাস ফেলে আবার হাটুতে মুখ গুঁজলো।

০৪.
বিভিন্ন চ্যানেল থেকে সাংবাদিক এসেছে। স্টেজের সামনের অংশটুকু ক্যামেরাস্ট্যান্ড দিয়ে ভরপুর। ড্রোন শ্যুট চলছে। টিকলিরা ১৫ জন মেয়ে পরেছে কালো সাদা মিশেলে সফট জর্জেটের শাড়ি, ফুল হাতা ব্লাউজ, বুকে ব্যাজ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, মাথার চুল একপাশে সিথি করে একরকম ভাবে সবার খোপা করা। স্টেজে ডেকে নেওয়া হলো সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য সেই ১৫ জন ডাক্তার’কে। ওদের হাতে সম্মাননা তুলে দিবে আগেরবছর এই সম্মাননা পাওয়া ডাক্তারগণ।

ওরা সবাই স্টেজে উঠতেই এবার একে একে সারি ধরে ভেতর থেকে এলো গিফট বিয়ারার’রা। টিকলি মাথা নিচু করে পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আদর উদাস নয়নে একবার দেখেও দেখলো না। একসাথে সবার হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হলো। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের জ্বলকানিতে টিকলির চোখ তখন যায় যায়। এমনিতে চশমা খুলে রাখতে হয়েছে। পাঁচ ইঞ্চি দূরের বস্তুও ঝাপসা দেখছে তারমাঝে এই শাড়ি তাও আবার জর্জেটের। তন্মধ্যে টিকলিকে হেনস্তা করতে শাড়ি নাফরমানি করে পায়ে বেজে পরলো। টিকলি মুখ থুবরে যেই পরতে যাবে ওমনি একটি পুরুষালী হাত এসে টিকলির সূক্ষ্ম, ক্ষীণ কোমর ধরে বাঁচিয়ে নিলো। সাথে সাথে ক্যামেরার সাদা আলোয় টিকে থাকা গেলো না। চারিপাশে ছোটখাটো শোরগোল। নিশ্চয়ই হেড লাইনে আজ-ই উঠবে,

‘নিউ কাপল ইন দ্যা টাউন।’

টিকলি অপরিচিত আগুন্তকের হাত কোমর থেকে সরিয়ে শাড়ি ঠিক করে সৌজন্যে হাসি দিলো। লোকটির নাম আরাফ। গত বছর নিউরোসার্জন হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন। যিনি এই বছর আদরের হাতে সম্মাননা তুলে দিয়েছেন। বয়স ৩৩। রিফা এলো। আদর ওর হাতে ফ্লাওয়ার বুকে, ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে যেই চলে যেতে নিবে ওমনি রিফা নিচু গলায় বলল,

‘স্যার, এখন তো স্পিচ দেওয়ার জন্য বলবে।’

‘আমার আর্জেন্ট কাজ আছে। ম্যানেজ করে নাও।’

বলে আদর যেই চলে যাবে ওমনি উপস্থাপক বলে উঠলেন,

‘এখন আমাদের সামনে বক্তব্য রাখবে আমাদের গৌরব…বাংলাদেশের সম্মানিত ডাক্তারবৃন্দ।’

মেয়েরা নেমে গেছে। পরিস্থিতি অনুকূলে। সবাই একে একে বিশাল বক্তৃতা দিলো। যখন আদরের পালা এলো আদর কেবল সালাম দিয়ে জানালো,

‘ধন্যবাদ।’

বলে যেই আসতে নিবে ওমনি উপস্থাপিকা ইতস্তত করে বললেন,

‘ডাঃ আদর খান আপনার কেমন লাগছে এই সম্মাননা পেয়ে যদি একটু শেয়ার করতেন আমাদের তরুণ প্রজন্মের ডাক্তারদের জন্য!’

আদর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরো দুটো কথা বলে স্টেজ থেকে নেমে এলো। পার্কিংলটে এসে কোর্ট’টা ছুড়ে মারলো ব্যাকসিটে। পকেট থেকে টাকা বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলল,

‘তুমি যাও। আমি ড্রাইভ করবো।’

ড্রাইভিং সিটে বসে আদর গাড়ি স্টার্ট করলো। মেইন রোডে যেই উঠতে যাবে সেই মুহূর্তে দেখলো টিকলি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মাঝারি সাইজের ব্রাউন কালারের ব্যাগ, চুল হাত খোপা করা, গায়ে অফ-হোয়াইট লং টপস সাথে বেইজ কালার ফ্লেয়ার প্যান্ট, গলায় মাল্টিকালারের স্কাপ। আদর হর্ণ বাজালো। টিকলি ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে মাথা ঘুরাতেই ভ্রু জোড়া সোজা হলো। নির্বিঘ্নে গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। আদর তাকিয়ে দেখছে টিকলির ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত মুখের একপাশ… অবিন্যস্ত চুলের গলায় লেপ্টে থাকা…শুকনো ঠোঁট দুটো বারংবার মুখে পুরে সিক্ত করা।

আদর মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে যেই গাড়ি টানবে ওমনি রিফা এসে উইন্ডোতে বাড়ি দিতে লাগলো। আদর রাগটুকু গিলে নিয়ে উইন্ডো নামাতেই রিফা বলল,

‘স্যার, আপনার সম্মাননা গুলোই তো নিলেন না।’

‘ওহ। পেছনে রাখো।’

রিফা পেছনে রেখে আবার জানালার কাছে আসে। আদর ভ্রু কুচকে বলে, ‘আর কিছু বলবে?’

‘কিছু মনে না করলে স্যার আমাকে একটু ড্রপ করে দিবেন। এইতো সামনেই পাঁচ মিনিটের রাস্তা।’

‘পাঁচ মিনিটের রাস্তা হলে তুমি তো হেটেই যেতে পারো।’

আদরের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে রিফার মনঃক্ষুণ্ন হলো। সে মুখটা থমথমে করে বলল,

‘গাড়ি দিয়ে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে, স্যার। এদিকে একটা রিক্সাও পাচ্ছি না।’

আদর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডোর লক খুলে দিয়ে বলল,

‘উঠো।’

রিফা নাচতে নাচতে গাড়িতে উঠে। টিকলি কপালে তিনটে ভাঁজ ফেলে, ঠোঁট বাঁকিয়ে এই রিফা নামক প্রাণী’টির কার্যকলাপ অবলোকন করে। আদর গাড়ি স্টার্ট দেয়। এবার আর কোনো থামাথামি নেই একটানে রোডে উঠে এলো। লুকিং গ্লাসে দেখে গেলো ফেলে আসা নারীকে যতদূর দেখা যায়!

চলবে❤️