#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৬.
‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আমি শাহিন বলছি। এবিইউ হসপিটাল থেকে সিলেটে একটি ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। আপনার উপস্থিতি জোরালোভাবে কাম্য। আপনার জন্য ইনভাইটেশন কার্ড পাঠানো হয়েছে। তবুও হসপিটাল অথোরিটি থেকে আপনাকে বিশেষ ভাবে ফোন করে ইনভাইট করা হলো।’
আদর ল্যাপটপে চোখ রেখে কী-বোর্ডে অভিজ্ঞ হাত চালিয়ে কান দিয়ে ফোন কাধে চেপে ধরে বলল,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কত তারিখে?’
‘২৭ তারিখ স্যার।’
২৭ তারিখ! আদরের মেডিকেল ক্যাম্প ২৫ তারিখ। এটেন্ড করা যাবে। সমস্যা হবে না। আদর কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘আমি আসার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।’
ফোন’টা কেটে আদর আর্দ্রকে ফোন লাগালো। ফোন ধরেই আর্দ্রর নাটকীয়তা শুরু,
‘রং নাম্বার।’
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। আদর দাঁতে দাঁত চেপে আবার ফোন দেয়। সাথে সাথে আর্দ্র বলে,
‘অন্য কোথাও ফোন দিতে গিয়ে এই নাম্বারে ভুল করে ফোন দিয়েছো, ভাইয়া?’
‘মারবো টেনে এক চর। বেয়াদব। ভুল করে মানুষ বারবার ফোন দেয়?’
‘ওওও… সরি সরি। বলো।’
‘সিলেট যাবি ঘুরতে?’
আর্দ্র দুষ্টু গলায় বলল, ‘ইউ মিন… হানিমুন?’
‘ঠাটিয়ে কানের নিচে দেবো একটা। অসভ্য জাতের ছেলে।’
আর্দ্র থমথমে মুখে বলে, ‘নাহ। তাহলে যাবো না।’
‘মানে?’
‘না। আমি বউ ছাড়া কোথাও যাবো না।’
‘তোকে বউ ছাড়া কে যেতে বলেছে বাপ? সবসময় এক লাইন বেশি বুঝিস।’
আর্দ্র বুঝমানের সুরে বলল, ‘ওওও… আমি ভেবেছি তুমি আবার আমাকে বগলদাবা করে এবার সিলেট পালানোর ধান্দা করছো। কিন্তু তুমি ভুলে গেছো এখন আমাকে একা নিলে চলবে না। আমি বিবাহিত। আমার একটা মিষ্টি, দুষ্টু, ঝগড়ুটে বউ আছে। নাম টায়রা।’
আদরের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যেতে লাগলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কপালে দুই আঙ্গুল ঘষে বলল,
‘আমার ভুল হয়েছে তোর মতো অসভ্যকে ফোন দিয়ে। মাফ কর।’
‘এই ভাইয়া না না না। আরেকটু কথা বলো। কত্তদিন ধরে ফোন দেও না।’
আর্দ্রর ভাবখানা এই যে আদরের সাথে তার বহুজনম পর কথা হচ্ছে। আদর অতিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘তুই আমার হাতে লাত্থি খাবি।’
‘হাতে মানুষ লাত্থি কীভাবে খায়?’
‘আজ রাতে দেখাচ্ছি।’
‘ছিহ! পঁচা কথা বলো না তো ভাইয়া।’
‘অসহ্য, বেয়ারা ছেলে একটা! বড় ভাইয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও শিখিস নি?’
বলে আদর ফোন কেটে বুক ফুলিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আদরকে সিলেট যেতে হবে ক্যাম্পের দুইদিন আগে। আর্দ্র-টায়রার জন্য দুটো ঢাকা টু সিলেট এয়ার টিকিট কেটে রাখবে ২৬ তারিখ সকালের। মাঝখানের দুইদিন আর ঢাকায় ব্যাক না করে সিলেটেই থাকার প্ল্যান আদরের। কাজেই ওদের দুটোকে নিয়ে যাওয়া। বিয়ের পর আর্দ্র-টায়রার কোথাও ঘুরতে যাওয়াও হয়নি। সিলেটে কিছুদিন ঘুরেটুরে সব কাজ শেষ করে ফেরা যাবে।
________________________
টিকলির পরীক্ষা শেষ হলো আজ। পরীক্ষা দিয়ে এসেই সে হাত-মুখ ধুয়ে, জানালা দরজায় টান টান করে পর্দা টেনে রুমটা অন্ধকার করে, চার হাত-পা চারদিকে দিয়ে আরামে একটা ঘুম দিলো। সে বহুদিন ঘুমায় না। সে ঠিক করেছে এই যে এখন ঘুমালো আবার একদম কাল এই সময়ে উঠবে। কিন্তু টিকলির আরাম কি আর কারোর সহ্য হয়? দুই ঘণ্টা পরেই সাইলেন্ট ফোনের ভাইব্রেশনের ভু ভু শব্দে পাতলা কাঁচা ঘুমটা গেলো ভেঙে। টিকলি মাথা ধরে উঠে বসলো। নাক ফুলিয়ে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। ইভেন্ট ম্যানেজার কবির স্যার ফোন দিয়েছে। টিকলি ফোন হাতে নিয়ে বলল,
‘এই লোকটার সমস্যা কি? আমার সুখ তার কেনো সহ্য হয় না?’
ফোনটা রিসিভ করে খুব অবহেলায় টিকলি বললো,
‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার। জি বলুন।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। শোনো, তোমাকে সিলেট যেতে হবে।’
টিকলির চোখের ঘুম ছুটে পালালো। ঘর কাঁপিয়ে বলল,
‘হুয়াট? সিলেট…..? পারবো না, স্যার।’
‘বস কে? তুমি না আমি?’
‘আনফরচুনেটলি আপনি, স্যার।’
‘তাহলে তোমার মতামতে সব চলবে?’
‘এবসোলুটলি নো, স্যার।’
‘প্রিপারেশন নাও। ২৭ তারিখ ইভেন্ট। বাকিটুকু স্টেজ ম্যানেজার নিরবের থেকে শুনে নাও। আমি ব্যস্ত এবং কাল থেকে অফিসে আসবে। পরীক্ষা তো শেষ। আর কাল মিটিং আছে।’
‘নিরবও যাবে?’
‘হ্যাঁ। কোনো সমস্যা?’
টিকলি একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলো পরিচিত কেউ যাচ্ছে বলে।
‘নো স্যার।’
‘রাখছি তাহলে।’
‘স্যার।’ টিকলি কাঁদো কাঁদো স্বরে ডাকে। কবির সাহেব ঝাড়ি দিয়ে বলেন,
‘আবার কি?’
‘একটা দিন ছুটি দেন, স্যার।’
‘কাল সবার আগে অফিসে আসবে তুমি।’
এরপর টিকলির মুখের উপর ফোন কাটলো। টিকলি মুখটাকে বিকৃত করে কতগুলো গালিগালাজ করে নিরবকে ফোন লাগালো,
‘এই, কিসের ইভেন্ট? আমি এই কোম্পানির চাকরি আজই ছাড়বো। রিজাইন লেটার লিখ।’
নিরব ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে, ‘তুই চাকরি ছাড়বি আমি রিজাইন লেটার লিখবো কেনো?’
‘কথা কম বল, পাঠা। কাহিনী কি সেটা বল।’
‘একটু ঘুমাতে দে। এই ম্যানেজার আমার মাথাটা খেলো। এখন আবার তুই। পরীক্ষা দিয়ে এসে একটা ঘন্টা রেস্ট পেলাম না।’
‘আমি পেয়েছি? আমাকে ম্যানেজার বলেছে তোকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত শুনতে এখন আমি স্যারকে ফোন দিয়ে বলছি তুই আমাকে বলতে চাইছিস না। তোর কাছে ঘুম ইম্পোর্টেন্ড।’
নিরব যেনো এবার কেঁদেই ফেলবে, ‘আমাকে ছাইড়ে দে। মাফ কর। আমি শুধু একটা ঘণ্টা শান্তিতে ঘুমাতে চাই। ৫৪ ঘণ্টা ধরে আমি ঘুমাই না।’
‘আর ১০ মিনিট না ঘুমালে তুই মরে যাবি না। কীসের ইভেন্ট?’
নিরব বুঝলো কোনো লাভ নেই। তার ঘুমের সময় নষ্ট হচ্ছে। চোখ থেকে ঘুম টাও চলে যাচ্ছে। মরণ!
‘ডাক্তারদের।’
টিকলি বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল, ‘উফফ… আবার ডাক্তার? আমি আর কোনো ডাক্তার ফাক্তারদের ইভেন্ট ক্রিয়েট করতে পারবো না। সিলেটে কি এমপ্লয়ির অভাব পরেছে? ঢাকা থেকে আমাকে যেতে হবে? এতো মানুষ রেখে আমার পেছনেই কেনো মরে এই ম্যানেজার?’
‘এবারের দোষ ম্যানেজার স্যারের নয়।’
টিকলি ভ্রু কুচকায়, ‘তাহলে কার দোষ? তোর?’
‘ফালতু কথা বলিস না। শোন, আমাদের কোম্পানি ‘Moments And More’ এর সিলেট ব্রাঞ্চ একটা বড় ইভেন্টের কাজ পেয়েছে। এটা আবার ঢাকার এবিইউ হসপিটাল থেকে সিলেটে আয়োজন করা হচ্ছে। আয়োজকদের মধ্যে ডাঃ আরাফ হোসেন নামের একজন আমাদের ইভেন্ট কোম্পানির নাম শুনে নাকি তোর নাম উল্লেখ করেছে। তোর কাজ নাকি খুবই চমৎকার। হুহ ছাই চমৎকার! তাই বলেছে তোকে যেনো এই ইভেন্টের দায়িত্বে রাখা হয়।’
টিকলি ভাবুক হয়ে চেয়ে রইলো। ডাঃ আরাফ হোসেন? হঠাৎ এই ডাক্তার কেনো তার প্রতি এতো প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো? টিকলি ভাবলো কিছুক্ষণ। এরমাঝে নিরব বললো,
‘ইউনিক থিমে স্টেজ সাজানোর আইডিয়া দিতে বলেছে আমাকে। তুই একটু চিন্তা করে বের কর তো।’
‘একটা লাত্থি খাবি। এর আগের বারেও পেট খারাপের দোহাই দিয়ে বেঁচে গেছিস। প্ল্যান করতে করতে আমার জীবন উষ্ঠাগত! নিজের কাজ নিজে কর। এবার তোর পেট খারাপ হলে আমার ডায়রিয়া হবে মনে রাখিস।’
বলে টিকলি ফোন কেটে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুতে শুতে বলল,
‘লোকটা আমাকে যে একটা বাঁশ উপহার দিলো কনফার্ম। কি দরকার ছিলো ভাই আমার হয়ে এতো প্রশংসা করার? আমার কাজ না বাড়ালেই তোর চলছিলো না? আমার অভিশাপ লাগবে তোর কপালে।’
চোখ জোড়া বন্ধ করতেই পরক্ষণে টিকলি টপাস করে চোখ খুললো। নিজেই নিজের সাথে বলতে লাগলো,
‘ওয়েট আ মিনিট! এখানেও কি উনার থাকার সম্ভাবনা আছে? নো ওয়ে।’
ভেবে ভেবে টিকলির মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। মাথার চুল দু হাত দিয়ে এলোমেলো করলো। কাঁথার নিচে পা নাচিয়ে বলল,
‘উফফ.. উফফ.. অসহ্য একটা জীবন।’
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৭.
পরীক্ষা শেষ। এখন আর টায়রা, নিভাকে আটকে রাখে কে? কাজেই পরেরদিনই দুজন এসে হাজির হলো টিকলির এপার্টমেন্টে। টিকলি তখন মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে ক্লান্ত, শ্রান্ত, নিস্তেজ শরীরে। এসে দেখে দুটোয় মিলে চা-বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, কোল্ড ডিংকস সব একসাথে নিয়ে বসে গেছে। নিভা ড্রইংরুমের মেঝেতে আর টায়রা পা উপরে তুলে মাথা নিচের দিকে হেলে দিয়ে উল্টো হয়ে সোফায় শুয়ে আছে। খুবই মনোযোগের সাথে তারা টিভিতে কিছু একটা দেখছে। পাশে আবার পপকর্ণও আছে। নিভা কিছুক্ষণ পরপর পপকর্ণ টায়রার মুখে গুঁজে দিচ্ছে।
টিকলি বড় করে শ্বাস ফেলে ব্যাগটা কাউচের উপর রেখে নিভার পাশে মেঝেতে বাবু হয়ে বসে টিভিতে চোখ রেখে পপকর্ণে হাত দিলো। সিরিজ দেখতে দেখতেই ছোট করে বললো,
‘কখন এসেছিস?’
নিভা, টায়রার টিভির দিকে তখন অগাধ মনোযোগ। টায়রা চোখের পলক না ফেলে বলে,
‘অনেকক্ষণ।’
টিকলি আর কোনো কথা বলে না। সারা সন্ধ্যা তারা সিরিজ দেখে কাটালো। রাত নয়টা বাজতেই টিকলি পা দিয়ে নিভাকে ধাক্কা দিলো। সিরিজ দেখতে দেখতে নিভা মেঝেতেই একটা কুশন নিয়ে শুয়ে পরেছে। সিনে এই মূহুর্তে টান টান উত্তেজনা চলছে। ভিলেন নায়িকাকে আটকে রেখে নায়ক’কে ইচ্ছেমতো নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। সব গোপন তথ্য ফাঁস হচ্ছে। টিকলি আবার পা দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার ন্যায় লাত্থি দেয়। নিভা বিরক্তে চু সূচক শব্দ করে বলে,
‘কি হইছে বা*ল?’
‘যাবি না। এখানে থাকবি?’
‘হ্যাঁ, থাকবো।’
এরপর আবার তারা সামনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। আধ ঘণ্টা যেতেই টিকলির পেট গুম গুম করে ডেকে উঠে। টায়রা হা করে সামনে চেয়ে আছে। টিকলি ওর মুখটা বন্ধ করে দিলো। টায়রা থতমত খেয়ে মুখটা বন্ধ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে টিকলির দিকে তাকায়। টিকলি আদেশের সুরে বলে,
‘যা। কিছু বানিয়ে নিয়ে আয়। খিদা লেগেছে।’
টায়রা অবহেলার গলায় বলে,
‘কি খাবি?’
‘রামেন বানিয়ে নিয়ে আয়।’
‘যা। আমার জন্যও বানাস।’
নিভাও সুর মিলায়, ‘আমার জন্যেও।’
টিকলি কপাল কুঁচকে বলে, ‘ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দুটোকে বের করে দিবো।’
তৎক্ষণাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। নিভা, টায়রা, টিকলি কেউ উঠলো না। কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে তিন মিনিট ধরে। টায়রা বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
‘খোল না, টিকলি!’
‘তুই খোল। আমার খিদা লাগছে। খিদায় উঠতে পারছি না।’
টায়রা বিরক্ত চোখে তাকালো। তিনজন তিনজন’কে ধাক্কাধাক্কি করলো দরজা খোলার জন্য। এরমাঝে নিভার ফোনে রাহুল কল করলো। ফোন ধরতেই বলল,
‘ঘুমাচ্ছেন? দরজা খুলছেন না কেনো?’
‘খুলছি। খুলছি।’ নিভা হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। মেঝে থেকে কুশন তুলে ঠিকমতো রাখে। স্ক্রিনে তখন কিসিং সিন চলছিলো। নিভা চেঁচিয়ে বলে,
‘টিভি অফ কর, টিকলির বাচ্চা। এসব পরিষ্কার কর। রাহুল অগোছালো ঘর একদম অপছন্দ করে।’
টিভি অফ করে ওরা তিনজন ছোটাছুটি করে চিপস, চানাচুর, বিস্কিটের প্যাকেট, ক্যান এসব ফেলে দিয়ে আসলো। চায়ের কাপ গুলো রান্নাঘরে রেখে আসলো। যত্রতত্র স্থানে পরে থাকা পানি, জুস, চা টিস্যু দিয়ে মুছলো। টায়রা ওই অংশটুকু তাড়াতাড়ি ঝাড়ু দিয়ে চিপস, পপকর্ণের এর পরে থাকা দানাগুলো ঝেড়ে ফেললো। নিভা নিজের চুল হাত দিয়ে ঠিক করে, মুখটায় বার কয়েক হাত দিয়ে ঢলা দিয়ে, জামা টান টান করে গায়ে উড়না সুন্দর করে জড়িয়ে সাত মিনিটের মাথায় দরজা খুলে দিলো।
রাহুল বিরক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। তবুও নিভাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। অফিস থেকে ফেরার পথে নিভাকে নিতে এসেছে। রাহুল আসে কালেভদ্রে। ইদানীং তবু একটু সহজ হয়েছে। এখন টিকলির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। সবাই মিলে একসাথে বসে ডিনার করতে পারে। হাসি-তামাশায় মত্ত হতে পারে। নিভা সেসব কিছু মনে করেনি কোনোকালেই। প্রথম প্রথম তার কষ্ট হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে যেমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে তেমনি রাহুলও নিভাকে প্রায়োরিটি দিতে শিখেছে সবার আগে। দরজা খুলেই নিভা আলতো করে রাহুল’কে জড়িয়ে ধরলো। রাহুল মুচকি হেসে নিভাকে এক হাত দিয়ে মোলায়েম ভঙ্গিতে ধরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘আজ সারাদিন কাকে কাকে জ্বালালেন?’
নিভা প্রসন্ন চিত্তে প্রাণখুলে হেসে উত্তর দেয়, ‘কাউকে না। এখনো চিন্তা করছি। কীভাবে আদর ভাইয়াকে একটুখানি জ্বালানো যায়।’
নিভা দুই আঙ্গুল দিয়ে দেখালো ‘একটুখানি’। রাহুল ভেতরে ঢুকে চিকেন ফ্রাই আর বার্গার টেবিলের উপর রেখে টিকলির দিকে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘কি খবর, ভেবলি?’
টিকলির মুখ গোমড়া উত্তর, ‘ভালো না।’
‘কেনো?’
‘ওরা আমাকে রেস্ট নিতে দিচ্ছে না। ডিস্টার্ব করছে। নিজের বউকে বেঁধে রাখতে পারো না?’
রাহুল হাসে। টায়রার মাথায় টোকা দিয়ে বলে, ‘কিরে? এখানে কি তোদের?’
বেয়ারা টায়রা মাথায় হাত ঘষে বলে, ‘নিজের বউকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে টোকা?’
রাহুল সলজ্জে হাসে। নিভা রাহুলের থেকে সরে দাড়াতে চায়। রাহুল ছাড়ে না। এরমাঝে বার্তাহীন এসে দাঁড়ালো আর্দ্র। রাহুলের সাথেই এসেছে। নিচে গাড়ি পার্ক করছিলো বলে একটু দেরি হলো। আর্দ্রকে দেখে টায়রা বলে,
‘নাও। ষোলোকলা পূর্ণ হলো।’
কথার ধরণ শুনে বোঝা গেলো এই দম্পতির মাঝে আবারও কোলাহল চলছে। টিকলি এসব পাত্তা দেয় না। এ জায়া ও পতির মাঝে প্রেমের বিষয়টাও ঝগড়া সুতরাং সেসবে কর্ণপাত করে টিকলির পেটে দুটো খাবার জুটবে না। কিন্তু আর্দ্র এসেই একটা কান গরম করা কথা বলে ফেললো,
‘টিকলি, তোমার বোন আমার সাথে ঘুমায় না। তুমি এর বিচার করো।’
ড্রইংরুম ভর্তি মানুষ। বউ, বউয়ের বড় বোন, নিজের ছোট বোন, ছোট বোনের জামাই। যতই সমবয়সী এবং বন্ধুসুলভ হোক না কেনো রাহুলের তো বউয়ের বড় ভাই লাগে আর্দ্র। কাজেই সে নিভার কান দুটো দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে নিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলো। নির্লজ্জ টায়রা উত্তর করলো,
‘ও কি বিচার করবে? আমি কোনো পিঞ্চ করা অসভ্য পাবলিকের সাথে ঘুমাবো না এটা আমার মর্জি।’
টিকলি অতিষ্ঠ চোখে তাকায়। ওরা দুজন নির্লজ্জের মতো টিকলির কান ঝালাপালা করে দিয়ে ঝগড়া করে যায়। খানিকক্ষণ পরে টিকলি কান দুটো ধরে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে,
‘তোরা দুটো এই মূহুর্তে আমার বাসা থেকে বের হ।’
,
মাঝখানে বার্গার আর চিকেন ফ্রাই রেখে ওরা সবাই সবাই গোল হয়ে মেঝেতে বসেছে। হাসি-ঠাট্টার শোরগোলে মত্ত টিকলির ছোট্ট এপার্টমেন্ট’টা। হাসির মাঝে মাঝে দেয়ালে দেয়ালে ঝংকার তুলছে আর্দ্র-টায়রার তর্ক আবার এই আর্দ্র টায়রাকে ওর ভাগের থেকে খাইয়ে দিয়ে ভাব জমাচ্ছে। টায়রা আর্দ্রর বুকে একরকম মাথা রেখে মুরগির রানে বড় করে কামড় দিয়ে ছিড়ে নিয়ে বললো,
‘ইশশ… সবাই আছে শুধু ভাইয়া মিসিং। ভাইয়া একটু মজা করতে পারছে না। সারাক্ষণ কাজ আরে কাজ সাথে রাগ, ধমকা-ধমকি।’
নিভা টিকলির দিকে আড়চোখে চেয়ে বলে, ‘তাই নাকি? রাগবেই তো! বেচারার জীবনে কি আর সুখ আছে বল? কত পরিশ্রম করে আমার ভাই’টা!’
আর্দ্র কিছু মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে টায়রাকে বলল, ‘ওওও…. একটা কথা বলতে মনেই ছিলো না। ভাইয়া আমাদের জন্য ২৬ তারিখের টিকিট কেটেছে সিলেটের।’
টায়রা উৎসাহিত হলো কিন্তু বলল, ‘সত্যি? কিন্তু আমি একা একা ঘুরতে যাবো না।’
‘আরেহ! রাহুল, ভাইয়া তোমাদের জন্যেও টিকিট কেটেছে। বিয়ের গিফট।’
বলেই আর্দ্র বাম চোখ টিপ মারে। রাহুল নিভার দিকে তাকায়। নিভার চোখে মুখে খুশি দেখে আর বললো না ‘আমার ছুটি হবে না।’ বরং বললো,
‘তাহলে তো ভালোই হলো। সবাই একসাথে যাওয়া যাবে। টিকলি তুইও চল।’
টিকলি খেতে খেতে উদাসীন গলায় বলে, ‘আমার ইভেন্ট আছে ২৭ তারিখ।’
‘তাহলে আমরা ডেট পিছাই।’
টিকলি চোরা চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, ‘আমার ইভেন্ট সিলেটেই।’
টায়রা নিভার চোয়াল ঝুলে পরলো। সমস্বরে বললো, ‘কি? বলস নাই তো?’
টিকলি পাত্তাহীন গলায় বলে, ‘বললে যদি তোরা যেতে চাস তাই বলিনি।’
টায়রা নিভা নাক কুচকে বিরবির করে। আর্দ্র বলে, ‘তাহলে তো ভালোই হলো সবাই মিলে যাওয়া যাবে।’
টিকলির খাওয়া শেষ। টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে বলে,
‘আমাকে যেতে হবে আমার টিম মেম্বারের সাথে। সেখানে গিয়ে ইভেন্টের কাজ শেষ হতে হতে অনেক রাত হবে। তোমরা ঘুরাঘুরি করবে, আমি কাজ করবো। দেখা তো হবেই। কিন্তু ২৮ তারিখ আমার টিম মেম্বারদের সাথেই আমি ব্যাক করবো। আমার ঘুরাঘুরি ভালো লাগে না।’
টিকলি উঠে চলে গেলো। সবাই ওর যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। হতাশ শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে ভেবে গেলো অতীতের সেই স্বর্ণাভ দিনগুলো। টায়রা-নিভা মনে মনে ফন্দি আঁটলো। তারা বুঝতে পারছে সামনে কিছু একটা হতে চলেছে। টিকলিকে ওরা তখনো জানায়নি আদরও যাচ্ছে সিলেটে।
চলবে❤️