বসন্তপবনে প্রেমছন্দ পর্ব-১১+১২+১৩

0
1

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১১.
টিকলি চোখ বড় বড় করে সাথে সাথে নাকোচ করে উঠলো, ‘কক্ষনো না। এই নিরব, সামনে আয়।’

ওমনি আর্দ্র নিরব’কে খামচে ধরলো, ‘না। ও সামনে যাবে না।’

নিভা বিরবির করে বলল, ‘এরজন্যই ওর বাসর হয় না।’

ও বললো ঠিক বিরবির করে আদতে সবার কানেই লাগলো। আর্দ্র পেছন থেকে নিভার দিকে নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে নিভার চুল ধরে হালকা হাতে টান মারলো। নিভা চেঁচিয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ রাহুলের হাত এগিয়ে নিয়ে আর্দ্রর গালে চর মারে। রাহুল বেকুব বনে আর্দ্রর দিকে তাকিয়ে থাকলো মিনিট খানেক। এরপর নিভার হাত থেকে হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এটা কীভাবে হলো?’

আর্দ্র ঠোঁট ফুলিয়ে গালে হাত রেখেছে তখন। রাহুল আর্দ্রর গালে হাত ঢলে বলে, ‘কেঁদে দিয়ো না প্লিজ, আর্দ্র। তাহলে তোমার ইজ্জতের বাকিটুকু দফারফা হয়ে যাবে।’

আর্দ্র রাগী দৃষ্টিতে তাকায় রাহুলের দিকে এরপর তাকায় নিভার দিকে। টায়রা ওলে লে লে করে আর্দ্রর গাল টেনে ধরে বলে,

‘আহারে আমার বাবু’টার গাল দেখি লাল হয়ে গেছে। সোনা কান্না করে না নিভাকে আমি মাইর দিয়ে দিবো।’

টিকলি সবসময়কার মতোই তার তথাকথিত অতিষ্ঠ চোখে এসব ড্রামা দেখে গেলো। এই ড্রামাবাজের দলের সাথে একটা কথা বলা যায় না। একটা কথা না! চোখ মুখ কুচকে বিকৃত করে ওদের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে টিকলির চোখ গিয়ে ভিড়লো আদরের দিকে। টিকলি আসলে না করতে চায়নি। অনেকদিনের একটা দূরত্বের অস্বস্থির অভ্যাস তাকে বেয়াদব মুখ’টা ফসকে গিয়ে ‘না’ বলালো তাকে দিয়ে। ওদিকে আদরের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। রাগে মুখ’টা লাল হয়ে গেছে। টিকলি বেকায়দায় পড়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো।

আদর স্টেয়ারিং শক্ত হাতে চেপে ধরেছে। তাকে উপেক্ষা? আদর খানের পাশে বসতে চাইতে নাকোচ করে অপমান? তার পাশে বসলেও বুঝি গায়ে ফোস্কা পরে যাবে? আদর বুঝি মরে যাচ্ছে এই মেয়ের পাশের সিটে একটু ঠায় পাওয়ার জন্য? আদর স্টেয়ারিং এ বাড়ি মেরে গাড়ি থেকে বের হয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো,

‘আনবেয়ারেবল।’

সেই মূহুর্তে গাড়িতে হৈচৈ পরে গেছে। এক তো টিকলি সামনে বসবে না আর নিরব সামনে আসতে চাইছে কিন্তু আর্দ্র আসতে দিবে না। একইসাথে আর্দ্র, নিভার দারুণ এক চুলোচুলি লেগেছে। টায়রা পপকর্ণ চিবিয়ে মুভি দেখার ন্যায় ওদের ঝগড়া দেখছে কিন্তু রাহুল পরেছে মুসিবতে। সে অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কানে হাত গুঁজলো। নাহ! ঝগড়া গাড়িতে জমছে না বলে এই গেঞ্জামের দলেরা সবাই গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। টিকলি শুধু এটুকুই বলতে পারলো,

‘এরা সবাই ইম্পসিবল! এদের মতো বস্তির সাথে মানুষ ঘুরতে যায়?’

টায়রা কেনো আর্দ্রর হয়ে কিছু বলছে না বরং সিনেমার অ্যাকশন শো দেখার মতো এঞ্জয় করছে এ নিয়ে আর্দ্র-টায়রার মধ্যে আবার একচোট তর্ক-বিতর্ক হলো।

‘আপনি বসে বসে মুড়ি খাচ্ছেন কেনো?’
‘তো কি করবো? আপনার মাথায় পানি ঢালবো?’
‘দেখতে পারছেন না রাহুল মাঝখানে ঢুকে ওর বউকে আমার হাত থেকে বাঁচাচ্ছে? আপনি এসে আমাকে বাঁচান।’
‘বাঁচাতে গিয়ে যদি আমি দুটো চর থাপ্পড় খাই?’
‘খেলে খাবেন। আমি খেয়েছি না? স্বামীর জন্য একটা চর খেলে কি আপনার জাত চলে যাবে?’
‘এই এই এই… জাত নিয়ে কোনো কথা হবে না, মুরুব্বি।’
‘জাত নিয়ে কথা হবে না মানে? আলবাৎ হবে। একশোবার হবে। আপনার স্বামী চর খেলো ওর জামাইয়ের হাতে। আপনি আমার বউ হয়ে ওর গালে একটা চর দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করবেন না?’

টায়রা নিভার দিকে মায়া নিয়ে তাকিয়ে করুণ গলার ভঙ্গি করে বলল,

‘আহারে! আমার সোনা’টার ওতো সুন্দর গালে আমি চর মেরে দায়িত্ব পালন করবো? সুন্দরী মেয়েদের গায়ে আমার হাত উঠে না, ভাই। ওমন দায়িত্ব পালনের আমার কোনো দরকার নেই।’

‘এই এই, ভাই ডাকছেন? স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না তা বুকে পাথর চাপা দিয়ে মেনে নিচ্ছি তাই বলে ভাই বানাবেন?’

টায়রা কোমরে দুই হাত রেখে বলে, ‘আপনাকে আমি কখন স্বীকৃতি দিলাম না? আমি কার সংসার করছি?’

‘স্বীকৃতি দিলেন কই? বাসরের স্বীকৃতিই তো দেননি।’
‘এই বাসর ছাড়া আপনার মুখে কোনো কথা নেই?’
‘না নেই।’
‘না থাকলে মুখ বন্ধ করে বসে থাকুন।’
‘আপনার মুখ দিয়ে কথা বলি আমি?’
‘আপনার মুখ সেলাই করে দেবো।’
‘দেন না! আমার হাত কি আমি খান বাড়িতে কাছে রেখে এসেছি?’
‘কি নির্দয়!’
‘কি পাষাণ! বর চর খায় সে মুড়ি খেতে খেতে তা চেয়ে চেয়ে দেখে।’

ওদের বাকবিতণ্ডা চলতে থাকলো। আদর দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। টিকলি একবার হতাশ চোখে আদরের দিকে চেয়ে ক্ষীণ আওয়াজে ওদের বললো,

‘তোরা প্লিজ চুপ কর। আমার কান আর সহ্য করতে পারছে না।’

ওরা তো ওরাই। টিকলির আওয়াজ ওই উচ্চ শব্দে ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছালে তো! টিকলি গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। ক্লান্ত লাগছে! নিরব এসব দেখে আহাম্মক বনে গিয়ে টিকলির পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বলে,

‘টিকলি চল আমরা ঢাকায় ব্যাক করি।’

টিকলির বন্ধ ঠোঁট একটু বাঁকে, ‘কেনো? ঘুর!

আদরের কথা বলা শেষ। কোনোদিকে তার চোখ নেই, কর্ণপাত নেই। দৃষ্টি গিয়ে ভিড়েছে টিকলির দিকে। বলি টিকলির পাশে কোনো ছেলে থাকলেই শুধু আদরের চোখে পরে? এরমাঝে এই ঝগড়া পার্টির গেঞ্জাম দেখে সেই মূহুর্তে আরাফ এলো। সে বেরিয়েছে সবার শেষে। আদরের দিকে সৌজন্যে হেসে অনুষ্ঠান কেমন হয়েছে, কি কি প্রবলেম হয়েছে আনুষঙ্গিক আরো নানান কথা বলে আরাফ একটু ইতস্তত হয়ে বলল,

‘ওরা কারা? কি হয়েছে ওদের? টিকলি এখানে? তুমি চেনো?’

ওরা সবাই থামলো। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে চিনতে পারলো লোকটাকে। আর্দ্র তখনো চিনতে পারেনি। টায়রাকে জিজ্ঞাসাসূচক গুতা দিলো। টায়রা ওর কানে কানে বলল,

‘চিনতে পারেননি? আরে ওইযে ওই টিকলির কোমর ধরা ডাক্তার’টা।’

আর্দ্র চিনতে পারলো। টায়রা শয়তানি হাসি দিলো। এরপর আরাফের সাথে পরিচিত হয়ে ঘটনাটা সংক্ষেপে যতটুকু বলা যায় বলল। আরাফ উচ্চশব্দে হেসে বলে,

‘ভারী মজার তো তোমরা সবাই। টিকলি যে তোমার ফ্যামিলি পার্সন আগে বলবে না আদর?’

আদরের ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। বলতে ইচ্ছে করলো ‘কেনো? আগে বললে কি হতো?’ কিন্তু বলল না। আরাফ বলে,

‘আদর, আমি তোমাদের সবাইকে আমার বাসায় ইনভাইট করতে চাই। যেহেতু এবার আমারও দুইদিন বাসায় থাকার ইচ্ছে। তোমরা আমার বাসায় চলো। আমি তোমাদের ঘুরে ঘুরে সব জায়গা দেখাবো।’

আদর তৎক্ষণাৎ না করতে পারলো না ঠিক কিন্তু আরাফের হঠাৎ এতো আগ্রহে তার ভ্রু দুটো ধনুকের ন্যায় বেঁকে গেছে তখন। গেঞ্জাম পার্টি তখন উৎফুল্লতায় লাফিয়ে উঠলো। বেশি খুশি হলো টায়রা-নিভা। আদরের চোখ মুখ দেখেই তারা বলতে পারছে আদর ভেতরে ভেতরে রাগে টম হয়ে যাচ্ছে।

আদর ওদের দিকে তাকিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করলো। আরাফ গেঞ্জাম পার্টির সাথে দু’এক বাক্য হাসি-তামাশা করে বলল,

‘আচ্ছা, টিকলিকে নিয়ে যেহেতু সমস্যা সেহেতু টিকলি আপনি আমার গাড়িতে আসুন।’

তৎক্ষণাৎ একটা বিকট দৈত্য গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলো,

‘না…।’

আদর বলে নিজেই তব্দা খেয়ে গেলো উল্টো ঘুরে নিজের মুখ’টা চেপে ধরলো। গালে আলতো করে দুই একটা চর থাপ্পড় দিতে দিতে নিজেকে নিজেই বলল,

‘পাগল হয়ে গেছিস?’

পরমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে অবিন্যস্ত স্বরে বলল, ‘না বলতে… মানে ভাইয়া, অপরিচিত কারোর সাথে যেতে আপনার অস্বস্থি হবে।’

বলে আদরের ইচ্ছে করলো আবার নিজের গালে কয়েকটা চর থাপ্পড় লাগাতে। আরাফ সৌজন্যতার হাসি দিয়ে বলে,

‘না আমার অস্বস্থি হবে না। টিকলি ইজ আ নাইস পারসন। ওর সাথে যেতে আমার ভালো লাগবে।’

আদরের মুখে যেনো ৫০ কেজি চাল ভিজিয়েছে এমন তারায় ফুলে গেলো। রাগে সাপের মতো ফসফস করে চোখ খিচে তাকিয়ে রইলো। কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল,

‘আমিও যাবো।’

‘হু?’

‘না মানে, এমনিতেই এই জংলিদের চিৎকার চেঁচামেঁচিতে মাথা ধরে গেছে। বাকিটা পথ আমার পক্ষে যাওয়া আর সম্ভব না।’

আরাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাধ ঝাঁকিয়ে বললো, ‘ওকে।’

আদর দু পা এগুতেই বলে, ‘ওহ ভাইয়া, সমস্যা তো আরেকটা আছে?’

‘কি?’

‘ওরা তো কেউ ড্রাইভ করতে জানে না।’

আর্দ্র-রাহুলের চোয়াল ঝুলে পরলো। খসেই পরবে যেনো! আরাফ জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালে আদর বলে,

‘ভাইয়া, আপনি ওদের নিয়ে আগে যান আমি আপনার পেছন পেছন ফলো করছি।’

আরাফ বেকায়দায় পরে গেলো। ‘না’ করতে পারলো না। ইতস্তত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বড় করে শ্বাস ফেলে বলল,

‘ওকে। আই লাইক দেম। হোপ, দিজ জার্নি উইল বি এঞ্জয়েবল।’

আদর বন্ধ ঠোঁটে ওর সুন্দর হাসিটা দিয়ে আরাফের থেকে চাবি নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। টিকলিকে নিচু গলায় বলে গেলো,

‘এদিকে আসুন।’

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১২.
আরাফের গাড়ি’টা পথ চিনিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। আদর নিশ্চুপে তা অনুসরণ করছে। শীতল বাতাসের শা শা শব্দ, গাড়ির হর্ণ, রাস্তার সাথে চাকার ঘর্ষণ ব্যতিত গাড়ির ভেতরে তখন সুনশান নিরবতা। তারা কি দিয়ে কথা শুরু করবে তা খুঁজে পেলো না। টিকলি সংকোচ নিয়ে কতক্ষণ হাত কচলে গাড়ির জানালায় মাথা ঠেস দিলো। হীম পবনে শরীরে কাঁপন ধরছে। আদর একবার গলা খাঁকারি দিলো। এরপর মিনিট দুয়েক চুপ থাকলো। আরেকবার কেশে রাস্তার দিকে চোখ রেখে অবজ্ঞা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,

‘ভাববেন না আপনার সাথে যাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছিলাম। তখন আমাকে ইগনোর করেছেন তাই আপনাকে আমার সাথেই নিয়ে যাচ্ছি।’

আদর বললো ঠিক কিন্তু টিকলির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আদরের কপালে কুঞ্চন দেখা গেলো। গাড়ি ডানে বাঁক নিয়ে আদর টিকলির দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা ঘুমিয়ে পরেছে। সেই রাতের সিলেটের বসন্তের পবনে তার কাটা চুলগুলো উড়ে উড়ে বারবার চোখের সামনে নৃত্য করছে। কোমর ছাড়ানো চুল…চোখের চশমা হাতে গুটানো… টিকলো নাক… টিকলিমার্গযুক্ত ললাট… ভরাট লালাভ কপোলের কান্তিমান ঝকঝকে আননের দিকে চেয়ে আদরের সবকিছু বৃথা মনে হলো। শ্বাস আটকে গেলো বুকে। সেই অনিচ্ছিত কিছু তুচ্ছ খুচরো রাগ, অভিমান, দম্ভের শিকল ভেঙে গুড়িয়ে দিতে গিয়ে…. নিজ প্রেমিক চিত্তকে রুষ্ট করে আদর চোখ সরিয়ে নিলো।

ঘুমের মাঝেই অসভ্য চুলের যাতনায় টিকলির কপালে ক্ষীণ বিরক্তের ভাঁজ পরলো। সেই ভাঁজ অবলোকন করে আদর অতর্কিতে খুব যত্নে টিকলির চুল কানে গুঁজে দেয়। গুঁজে দিতে গিয়ে দেখে টিকলির শরীর মৃদু গরম। আদর গাড়ি থামিয়ে ওর ব্লেজার টিকলির গায়ের উপর দিয়ে দেয় খুব আদরে। এদিকে নিজের সাথে নিজেই ছলচাতুরী করে বিরক্তের কণ্ঠে বিরবির করে বলে,

‘বোকা মেয়ে, একটা শাল অবধি আনেনি।’

আদর নিজ সত্তাকে দেখালো ঠিক আদতে এ কাজ সে সৌজন্যতার খাতিরে করছে! এককালে মেয়েটা তার নিজের হৃদপিণ্ড ছিলো কি না! কিন্তু সেই সৌজন্যতা যখন পৌছালো প্রেমের শীর্ষ পর্যায়ে.. আদরের অনিচ্ছায়, অবচেতনে দুটো আঙ্গুল গিয়ে তখন টিকলির চেরির মতো নরম গালে সুখদ ভঙ্গিতে স্লাইড করতে লাগলো…. চোখদুটো মুগ্ধতার জোয়ারে ভেসে গেলো। সেই মুহূর্তে মনে হলো বস্তুত এই মেয়েটি এখনো তার হৃদপিণ্ড’টিই আছে।

,

টিকলি যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন ওর সামনে অবাকতার মেলা। গাড়ির চারপাশ দিয়ে ওরা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। টিকলি পিটপিট করে ঘুমুঘুমু চোখ খুলতে গিয়ে কিছু বুঝতে পারলো না। কিন্তু বুঝতে পারলো তখন যখন আদর ওর মাথাটা তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো। টিকলির চোখ দুটো টপাস করে খুলে গেলো। একবার নিজের দিকে আরেকবার আদরের দিকে তাকিয়ে তড়িৎ বেগে নিজের সিটে ঠিকভাবে বসলো। গায়ের উড়না ঠিক করলো। অবাকতার চরম শীর্ষে আরেকবার চলে গেলো যখন নিজের গায়ের উপর আদরের ব্লেজার দেখলো। ও আদরের দিকে হাতের ব্লেজার’টা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ মুখ খিচে বলল,

‘সরি। কাধ ব্যথা করছে?’

‘না।’ আদর থমথমে মুখে ওর হাত থেকে ব্লেজার’টা নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। আর এদিকে গেঞ্জাম পার্টির মুখে হাত। কত দরদ? একটু কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে বলে আবার নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ‘কাধে ব্যথা পেয়েছেন?’ বাপরে! আর্দ্র নিচু কণ্ঠে টায়রাকে জানায়,

‘এতোটুকু তো আশা করিনি। ডিরেক্ট কাধে ঘুম পাড়ায়লো আমার ভাই?’

টায়রাও চাপাস্বরে জানায়, ‘উহু… এতো তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে গেলো? আবার ব্লেজারও পড়ায়ছে দেখছেন? আপনি জীবনে নিজের গায়ের কাপড় খুলে আমাকে দিছেন?’

আর্দ্র কাধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘দিবো কীভাবে? আপনার গায়ে তো সবসময় কাপড় থাকে।’

টায়রা ফুসে উঠে আর্দ্রর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আর্দ্রর পায়ে পারা দিয়ে আরাফের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। বাড়ির গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আরাফের মা, বাবা। ওদের সাদরে গ্রহন করে নিলো। টায়রাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার নাম কি, মা?’

ওমনি আর্দ্র উত্তর দেয়, ‘টায়ার। ফুটা টায়ার। ফুল নেইম মিসেস ফুটা টায়ার।’

টায়রা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে, ‘আরেকটা পারা খাবেন?’

আরাফের মা নিভাকে নাম জিজ্ঞেস করলো। আর্দ্র তখনো আগ বাড়িয়ে দাঁত কেলাতে কেলাতে বলল, ‘ওর নাম তো আন্টি গরু। আফ্রিকান কাউ। দেখেন না চেহারাটা? একদম গরুর মতোন।’

আর্দ্র নিভার গাল দুটো চেপে ধরে বলল। নিভা ‘উ উ’ করতে করতে আর্দ্রকে দুই চারটা থাপ্পড় দিলো। রাহুলের আবার বউয়ের কষ্ট সহ্য হয় না। আর্দ্রর থেকে বউকে ছাড়িয়ে নিয়ে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আরাফের মা সুলতানা বেগম হেসে দিলেন। আরাফ বললো,

‘ওরা সবাই খুব কুল মাইন্ডের না মা?’

সুলতানা বেগম সায় দিয়ে টিকলির থুতনি ধরে বলেন,

‘বাহ! কি সুন্দর দেখতে তুমি! কি নাম তোমার মা?’

আর্দ্র হেসে কুটিকুটি হয়ে বলে, ‘মিস টিকটিকি।’

আদর ওমনি আর্দ্রর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। টিকলিকে এই নাম দিয়েছিলো আদর। আর্দ্রর এসব ফাইযলামি আদরের যারপরনাই বিরক্ত লাগলো। ওদিকে সুলতানা বেগম মিস শুনে বুঝে গিয়েছেন, টিকলি সিঙ্গেল। শাবানার মতো তার বলতে ইচ্ছে করলো এরকম একটা মেয়ে যদি আমার বেটার বউ হতো। এবং তিনি বলেও ফেললেন তা,

‘এইরকম মিষ্টি একটা মেয়ে আরাফের জন্য খুঁজছি। কি করো তুমি, মা?’

টিকলি ইতস্তত ভাবে হাসলো। প্রথম দেখায় এমন কথা সে আশা করেনি। গেঞ্জাম পার্টির চোখ তখন রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো। আদরের চাপা শক্ত হলো। এতো সিরিয়াস মোমেন্ট দেখে আরাফ জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,

‘চলো আমরা ভেতরে যাই।’

ওরা সবাই একে একে ভেতরে ঢুকছে। নিভা বলল,

‘কেস’টা কি হলো?’

টায়রা ভাবুক ভঙ্গিতে বলে, ‘বুঝতে পারছি না। ভেবে এলাম একটা, হচ্ছে আরেকটা। টিকলিকে এখানেই আবার বিয়ে দিয়ে যেতে হয় কিনা! মহিলার চোখ মুখ দেখেছিস? টিকলিকে দেখে চকচক করছিলো।’

‘ঠিক বলেছিস। এই ডাক্তার আরাফের গন্ধও কিন্তু ভালো না। ওর শরীর থেকেও টিকলি টিকলি গন্ধ আসতাছে।’

নিভার কথায় টায়রা চিন্তার মাঝেও হেসে দেয়। কাধ দিয়ে ধাক্কিয়ে বলে, ‘চল, শালী।’

পাশ থেকে নিরব হঠাৎ বলে, ‘আর ডাক্তার আদরের মন থেকে টিকলি পুড়া পুড়া গন্ধ আসতাছে।’

টায়রা-নিভা একটু চমকে উঠেছিলো নিরবের আওয়াজে। ওরা কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে নিরবের দিকে চেয়ে হেসে উঠে তিনজন হাত মেলায়।

আদর ওদের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো। টিকলিকে ক্রস করে গিয়েও দু’পা পিছিয়ে এলো। নীরবে পকেট থেকে চশমা বের করে টিকলির হাতে দিলো। ঘুমের মাঝে টিকলির হাত থেকে গাড়িতে পরে গিয়েছিল। টিকলি রাহুলের সাথে কি নিয়ে যেনো কথা বলছিলো। আদরের এহেন আচরণ দেখে সে অবাক হয়ে তাকালো। ইতস্তত ভঙ্গিতে চশমা হাতে নিয়ে চোখে পরলো। কী আশ্চর্য! আজ বুঝি তার ইতস্তত হবার দিন?

সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই আদর ঘোষণা করলো,

‘কাল আমরা চলে যাবো।’

আরাফ বলে, ‘কেনো? কোনো সমস্যা হচ্ছে?’

‘না ভাইয়া। খুবই ভালো লাগছে।’

‘তাহলে?’

‘আসলে ভাইয়া, এই দুই কাপল মূলত হানিমুনে এসেছে।’

বাকিরা লজ্জাহীন নির্বিকার থাকলেও রাহুলের কাশি উঠে গেলো। আর্দ্র কনুই দিয়ে টায়রাকে ঠেলা দিয়ে ইশারায় কিছু বুঝালো। আরাফ বুঝতে পেরে বলল,

‘ওহ আচ্ছা।’

এরপর কথোপকথন, হাসি-ঠাট্টা চললো। ছাদের আড্ডায় মশগুল সবাই। আদর অগোচরে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি তা দেখলোও। আদর চোখ সরালো না। কেমন যেনো হুমকির চোখে তাকিয়ে আছে। যেই চোখ বলছে,

‘ডাক্তার আরাফের থেকে একশ হাত দূরে থাকবেন আপনি, মিস টিকটিকি।’

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৩.
চৈত্র মাস! সে চৈত্রের প্রভঞ্জনে শুকনো পাতা উড়িয়ে দুটো গাড়ি পর পর ছুটে যাচ্ছিলো জাফলং এর দিকে। আগেরবারের ন্যায় আদর-টিকলি এবার একা একসাথে যাচ্ছে না। ওদের সাথে যাচ্ছে আর্দ্র। সামনে সিটে বসেছে। তার মুখটা ভার। আদর আরাফের গাড়ি ফলো করতে করতে লুকিং মিররে টিকলির দিকে একবার নজর ফেলে আর্দ্রকে শুধালো,

‘মুখটা পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেনো?’

আর্দ্র দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, ‘বউ’টা ফেলে এসেছি যে!’

আদর চোখ উল্টালো। টিকলি আর্দ্রকে জোর করে এই গাড়িতে উঠিয়েছে আবার সামনেও বসিয়েছে। তাতে আদরের কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। টিকলি তো অন্তত চোখের সামনে থাকছে।

‘এ্যাহ! সারাদিন বউয়ের সাথে মারামারি করে আবার এখন দরদ উতলে পরছে?’

‘তুমি কি বুঝবা? তোমার তো আর বউ নেই। বউ থাকলে বুঝতা। বউ না হতেই যে ভাব’টা করেছো সে কি আমরা দেখিনি মনে….

আর্দ্রর কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে আদর হাত বাড়িয়ে থাবা দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। আর্দ্র আদরের হাতে কামড় দিলো। আদর ঝটকানা দিয়ে হাত সরিয়ে ফেলে ওর মাথায় চাপর মেরে তেজীয়ান কণ্ঠে শুধায়,

‘কুকুর নাকি তুই? ভাত খাস না? মানুষ কামড়াস।’

আদরের বৃথা চেষ্টা অস্বস্থিটুকু এড়িয়ে যাওয়ার। টিকলি গাল দুটো লাল করে তখন জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। মিনিট পনেরো না গড়াতেই আর্দ্র বাচ্চাদের ন্যায় মায়ের কাছে চকলেট চাওয়ার মতো আবদার করে বসলো,

‘ভাইয়া, আমি আমার বউয়ের কাছে যাবো।’

টিকলি বড় করে শ্বাস ফেলে কপালে হাত ঠেস দিয়ে সিটে হেলান দিলো। আদর বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে ক্ষুব্ধ স্বরে অসহ্য হয়ে বলল,

‘বউ পাগলার বাচ্চা…..!’

আর্দ্র হেহে করে হেসে বলে, ‘ভাইয়া, তুমি ঠিক বলেছো।’

‘মারবো টেনে এক চর, বেত্তমিজ। তোকে বউ ছাড়া যেতে বলেছে কে?’

‘টিকলিই তো জোর করে টেনে আনলো।’

‘কেউ জোর করলেই তুই আসবি? তুই জানিস না তুই কি জিনিস? বউ ছাড়া যে চলতে পারিস না?’

আর্দ্র বাঁকা মুখে বলে, ‘তোমরা জানো না?’

টিকলি ক্লান্ত হয়ে চোখ কপাল হাত দিয়ে ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলহীন নিচু গলায় বলল,

‘ওদের গাড়ি থামাতে বলে টায়রাকে এখানে আসতে বলেন।’

আদর তাই করলো। টায়রা এক ছুটে কাজলের ন্যায় তার শাহরুখ খানের কাছে এলো ফিল্মি স্টাইলে। সে এতোক্ষণ নিভা, নিরবের মাথা খেয়ে ফেলছিলো, ‘আহারে! আমার নাদান বর টা যে আমাকে ছাড়া একা একা কীভাবে যাচ্ছে! দুই গোমড়ামুখোর যাতাকলে আমার জামাই’টা কথা আটকে রেখে পেটে ফেটে বোধহয় মরেই যাবে রে আজকে।’

‘এই এক ওর জামাই টা আজ মরেই যাবে করে করে’ ওদের সবার কান ঝালাপালা করে দিয়েছে টায়রা। নিরবের অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ টাইপ। সে শুধু বারবার বিরবির করে বলেছে, ‘এই চিজগুলো যাদুঘরে না থেকে এখানে কি করছে?’

টায়রা টিকলির সাথে গিয়ে বসতেই আর্দ্র পেছনে এলো। আদর নাক ফুলিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘আমি তোদের ড্রাইভার?’

কথা বলা শেষ করা মাত্র টায়রা, আর্দ্র ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘বুঝতে পেরেছি, ভাই। তোদের আর আলাদা করবো না।’

টিকলি বিনাবাক্যে সামনে এলো। উইন্ডোতে মাথা ঠেস দিয়ে শূন্যে চেয়ে রইলো নিরবে। সেই মৌন, নির্মল, শান্তির পরিবেশ কি আর সহ্য হলো? পেছন থেকে হাতে হাত রেখে, বুকে মাথা রেখে একটু পর পর নায়িকার গলা ভেসে আসছে,

‘আপনাকে ছেড়ে যে এতোটুকু পথ কীভাবে এলাম! এদের মাঝে দম’টা বন্ধ হয়ে যায়নি এই যা!’

অপরপক্ষও গলে গলে বলে উঠলো, ‘আহারে! আমার আলাভোলা বউটা! অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝি?’

এরকম নানান কথা চলতে থাকলো নির্লজ্জ দুটোর। সামনে যে তাদের বড় ভাই-বোন বসে আছে সেদিকে সম্মান তো দূরে থাক কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। আদর শুধু দাঁতে দাঁত পিষছে। একবার গাড়ি থেকে নামুক শুধু! মজা দেখাবে আর্দ্রকে। টিকলি কানে হাত গুজলো। তবুও ফুসুরফাসুর কানে লাগছেই। বিবাহিতদের মাঝে অবিবাহিত’দের থাকা যে কী জ্বালার! কী অস্বস্থির! এক পর্যায়ে টিকলি টিকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলো তার স্বরে,

‘এই দুটোকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন না কেনো?’

এতো জোরে চিৎকারে আদর সহ হতভম্ব হয়ে তাকিয়েছে। টিকলি আদরের দিকে তাকিয়ে তখনো সাপের মতো ফসফস করছে। মিনিট খানেক চেয়ে থেকে আদর উত্তর দিলো,

‘আচ্ছা, সামনের মোড়ে ওদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।’

টায়রা আর্দ্র এক মূহুর্ত চুপ থেকে সমস্বরে বলে উঠলো,

‘আর ইউ গাইজ জেলাস?’

আদর মিরর গলিয়ে ওদের দিকে দাঁত খিচিয়ে তাকালো। টিকলি ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘আর একটা টু শব্দ করলে হানিমুন ক্যান্সেল। ঘুরাঘুরি ক্যান্সেল। আজ রাতেই ব্যাক করবো। একদম চুপ। ওকে?’

আর্দ্র-টায়রা জবাব দেয় না। টিকলি গলার জোর বাড়িয়ে বলে, ‘ওকে?’

ওরা কেঁপে উঠান ভান করে মাথা নাড়িয়ে সমস্বরে মিনমিন করে বলে, ‘ওকে।’

আদর ঠোঁটে হাত দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে সবার অগোচরে হেসে দিলো।

,
জাফলং যাওয়ার রোড থেকেই শুরু হয় অপরপ্রান্তের আকাশ ছোঁয়া মেঘালয়ের পাহাড়ের সৌন্দর্য। চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা রঙিন দৃশ্যপটের ন্যায় তারা মুগ্ধ চোখে দেখে যায় সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টির সৌন্দর্য। টায়রা ভিডিও করে। গাড়িতে ওদের সবার ছবি তুলে। জানালায় হাত ঠেকিয়ে, চোখ উঁচিয়ে বিশাল অরণ্যশৈলের মনোহরতা দেখে টিকলির বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই বিশদ গিরির কাছে সে বড় নগন্য। টিকলি সপ্নাতুর গলায় বলল,

‘সিলেট’কে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি পাহাড় রাজ্য। ইশশ.. আমার যদি সিলেটে একটা বাড়ি থাকতো।’

টিকলি বলেছিলো নিচু গলায় অথচ ওদের প্রত্যেকের কানে লাগলো। আর্দ্র দুষ্টুমির স্বরে বলে,

‘চলো তোমাকে সিলেটে বিয়ে দিয়ে দেই।’

তৎক্ষণাৎ আদরের মনে পরে গেলো আরাফের কথা। কপালে কুঞ্চন ফেলে লুকিং গ্লাসেই আর্দ্রর দিকে এমন ভাবে তাকালো যেনো ভস্ম করে দিবে এই অমানুষকে।

,
জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে দেখা যাচ্ছে ওপারের ডাউকি গ্রামের সৌন্দর্য। পাহাড় কেটে কেটে বানানো যেনো পুতুলের ঘরবাড়ি। এদিকে সারি সারি দোকান বসেছে। খুব পপুলার হলো পাথরে খোদাই করে মানুষের নাম লেখা। আরাফ একটা দোকানে দাঁড়িয়ে পাথরে খোদাই করা ‘টিকলি’ নাম উপহার দিলো টিকলিকে। একে একে সবাইকে দিলো। কিন্তু টিকলিকে দিলো সবার প্রথমে, যত্নে। আদর এক ভ্রু উঁচু করে তা দেখলো।

প্রায় এক-দেড়শো সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে। কিছু সিড়ি সরাসরি কিছু বাঁকানো আবার ঢালু পথও রয়েছে কোথাও কোথাও। ত্যাড়াব্যাকা ভাবে যত্রতত্র স্থানে আবার দোকানও বসেছে। প্রধান সিড়ি বেশ বিস্তৃত। আদর যাচ্ছিলো সবার আগে আগে সিড়ির ধাপ পেছনে ফেলে। টিকলি নিভার সাথে গাড়িতে টায়রা, আর্দ্রর ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে পা ফসকে পিছলে যাচ্ছিলো। অস্ফুটে তার মুখ থেকে স্বর বেরিয়ে এলো। আরাফ ছিলো টিকলির পেছনে। সে তৎক্ষণাৎ টিকলির হাত ধরে ফেলে। আদরও তখন পেছন ঘুরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলো তিন সিড়ি মাড়িয়ে।

‘ঠিক আছিস?’

টিকলি মাথা নাড়ায়। আদর ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। নিভা ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘আরাফ ভাইয়া তোকে বারবার বাঁচায়। একটা থ্যাঙ্কিউ দে।’

টিকলি আদরের দিকে চোখ রেখে আরাফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে জোরপূর্বক হেসে জানায়, ‘ধন্যবাদ।’

আদর এগিয়ে এসে টিকলির ব্যাগ’টা হাতে নিয়ে চেইন খুলে পানি বের করলো। বোতলের মুখ খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘পানি খান।’

টিকলি বিস্মিত হলেও বিনাবাক্যে বাধ্য মেয়ের ন্যায় বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে আদরের দিকে এগিয়ে দিলো। বাকি পানিটুকু খেয়ে আদর হাত বাড়িয়ে বলল পৃথিবীর সবচেয়ে দায়িত্ববান, সুদর্শন, প্রেমিক পুরুষের ন্যায়, ‘আমার হাত ধরুন।’

টিকলি ‘যথা আজ্ঞা’ র আদরের হাত ধরলো মোলায়েম ভাবে। আদর আগে পা ফেলে গেলো। টিকলি তার পরের ধাপে। ওরা সিড়ির কয়েকটা স্টেপ পার করার পর পেছন থেকে ভেসে এলো গেঞ্জাম পার্টির হৈ-হল্লা, ‘ওওওওউউ…।’

তাতে টিকলির বন্ধ ঠোঁটে কি প্রফুল্লতার কুসুমাস্তীর্ণ রেখা ফুটে উঠলো? লোকে কি বুঝলো এই মূহুর্তে জগতের সেরা সুখী মানুষ’টি টিকলি? চশমার নিচে যে তার চোখ জোড়া হেসে উঠলো!
সে বসন্তে ওই চোখ ধাঁধানো যত্নবান সুশ্রী পুরুষের দিকে চেয়ে মনমাতানো পবনে টিকলি প্রেমের ছন্দ কেটেছিলো গোপনে.. নিভৃতে… মনেমনে,

‘প্রিয়,
আপনার প্রতি আমার প্রেম বারবার ফিরে আসুক,
যেমন শৈত্যে ফিরে আসে ঝরা পাতার দিন।’

চলবে❤️