বসন্তপবনে প্রেমছন্দ পর্ব-২৩+২৪

0
9

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৩.
গুমোট আবহাওয়ার প্রতিকূল শ্বাসে ঘেমে নেয়ে যাওয়ার ন্যায় অবস্থা। ওয়েদারের মুড ঠিকঠাক ঠাওর করা যাচ্ছে না আজকাল। ভ্যাপসা গরম বিলিয়ে দিতে দিতেই ঝড়ো হাওয়া বয়ে… মুখ কালো করে মেঘ গলিয়ে বৃষ্টি নেমে আসে। জ্যোৎস্না রাতের রুপোলী ঝিলিকে রাস্তার সাথে চাকার ঘর্ষণে গাড়ি এসে থেমে দাঁড়িয়েছে টিকলির এপার্টমেন্টের সামনে। টিকলি বাঁকা হয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো একবার।
আদরের মুখটা থমথমে! বুঝাই যাচ্ছে তাকে একদম ধরে বেধে নিয়ে আসা হয়েছে। টিকলি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। গাড়িতে উঠে বসে সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে পেছনে বসে থাকা নির্লিপ্ত, নির্লজ্জ কপোত-কপোতী’কে শুধালো,

‘এতো ইমার্জেন্সি মুডে ডেকে আনা কেনো? কোথায় যাচ্ছি?’

উত্তর দিলো আর্দ্র, ‘নিভার বাসায়।’

‘কেনো?’

‘কারণ নিভাকে এতো রাতে বাইরে বের হওয়ার পারমিশন দিচ্ছে না, রাহুল ভাইয়া। আমার সাথে একদফা ঝগড়াও করেছে জানিস? কী অসভ্য হয়েছে! সারাক্ষণ বউকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। সে বউ কোলে নিয়ে বসে থাকবে বলে আমরা তো আর বান্ধবীকে গলা থেকে নামাতে পারি না তাই না? তাই যাচ্ছি ওর বাসায় আজ রাত সেলিব্রেট করতে।’

টিকলি ভ্রু বাঁকায়, ‘কীসের সেলিব্রেট? আমি কাজ ফেলে এসব কুকাজ করতে এসেছি? আজ রাত মানে? রাত কত লম্বা জানিস? মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ।’

‘কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক। ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট দেন না কেনো?’

আদর অনিচ্ছায় গাড়ি স্টার্ট দিলো। টিকলি নিচু গলায় প্রশ্ন করলো,

‘কীসের সেলিব্রেশন? নিভার প্রেগন্যান্ট হওয়ার?’

আদর গম্ভীর গলায় খোঁচা মেরে উত্তর’টা দিলো, ‘অবিবাহিত অবস্থায় আপনার আজ লাস্ট রাত। তার সেলিব্রেশন।’

টিকলি বাম পাশের ভ্রু উপরে তুলে প্রশ্ন করলো, ‘শুধু আমার? মনে হয় কাল থেকে আমি একা বিবাহিত থাকবো?’

আদর উত্তর করে না। টিকলি খোঁচাটা পাল্টা ফেরত দেয়,

‘তা আপনার হাতে সময় আছে তো?’

‘আছে।’

‘কম না বেশি? আজ রাত পেরুবে?’

আদর টিকলির দিকে কোণঠাসা চোখে তাকায়। বলে, ‘বেশি কথা বলেন আপনি। ঝগড়া করার জন্য ইদানীং ওত পেতে থাকেন।’

টিকলি চোখ পিটপিট করে তাকালো। নিভার বাসার নিচে এসে থামতেই পেছনের কপোত-কপোতী নেমে চলে গেলো। টিকলি নেমে দাঁড়াবে বলে দরজা খুলেছে তখনি আরাফ কল দিলো। আদর ভ্রু কুচকে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নামটা দেখলো। টিকলি নেমে দাঁড়ায়। ফোনটা রিসিভ করে। আদর গাড়ি পার্ক করতে যায়।

‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো, টিকলি?’
‘জি ভালো। আপনি?’
‘এইতো ব্যস্ততায় দিন কাটছে। তোমার কাজ কেমন চলছে?’
‘ভালো। হঠাৎ ফোন দিলেন? কোনো দরকার, ভাইয়া?’

আদর এসে দাঁড়ালো। টিকলির মিষ্টি সুরে ভাইয়া ডাক শুনে কপাল কুচকে নিলো। আদরকে দেখে আরো মিনিট দুয়েক কথা বলে টিকলি ফোনকলের সমাপ্তি ঘটিয়ে আদরকে বলল,

‘চলুন।’

সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে আদর যেতে যেতে প্রশ্ন করলো, ‘ডাঃ আরাফ কেনো ফোন করেছিলো আপনাকে?’

‘কি জানি বুঝলাম না! এমনি হালচাল জিজ্ঞেস করে রেখে দিলো। কোনো দরকারও নেই।’

আদর সন্দেহজনক নজরে শূন্যে চেয়ে কিছুক্ষণ ভেবে গেলো। লিফটে উঠে টিকলি নয় তলার বাটন চেপে ফোনে চোখ ডুবালো। আদরের কি হলো কে জানে টিকলির হাতের দিকে সেকেন্ড কতক চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে ফেললো,

‘একটু মেহেদী হলেও তো লাগাতে পারতেন?’

টিকলির হাত’টা কি ক্ষণকালের জন্য থেমে গেলো? হৃদযন্ত্র খানা নিষ্ক্রিয় হলো? শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো বুঝি? এতোসব হলো অথচ তবুও টিকলি নিজের ঠাট বজায় রেখে ফোন স্ক্রল করার ভঙ্গিমায় পাত্তা বিহীন কণ্ঠে উত্তর দিলো,

‘গায়ে একটু হলুদই ছোঁয়ালাম না। আবার মেহেদী?’

‘ছোঁয়ালেন না কেনো?’

আদরের অন্যরকম কণ্ঠস্বর। এ কণ্ঠের সাথে টিকলি পরিচিত ছিলো বহু আগে। কিন্তু এখন আর নয়! কানে বড্ড নতুন লাগলো সে স্বর। শরীর’টা ঝনঝন করে উঠলো যেনো। আদরের চোখের দিকে চেয়ে বলতে চাইলো,

‘কারণ বিয়েটা কেনো করছি সেটাই বুঝতে পারছি না। কিন্তু বিয়েটা করতে চাইছি। তীব্রভাবে! কাউকে জানাতে চাই না… আপনার সাথে থাকতে চাই না…স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই না… আপনাকে ভালোবাসতে চাই না.. কিন্তু তবুও আমার দুশমন মন আপনার সাথে আমার সম্পর্কের একটা নাম চাইছে। কেনো? এই কেনোর উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’

,
নিভা জানতো ওরা সবাই আসবে। কিন্তু রাহুল যারপরনাই অবাক। তখন ঘড়িতে বাজে রাত ১১ টা। রাহুল সাফ সাফ জানিয়ে দিলো,

‘তোরা কি খাবি আমাকে বলবি। আমার বউ কিছু রান্না করতে পারবে না।’

টায়রা মুখ টানা মারলো। বললো,

‘একটু তো লজ্জা সরম করো। ভাইয়াকেও তো তোয়াক্কা করছো না। আগে কতো মান্য করে চলতে। যেনো বিয়ে করেছো এই লজ্জায় বড়দের সামনেই দাঁড়াতে পারতে না। আর এখন আমার বউ, আমার বউ করতে তোমার লজ্জা করছে না?’

আর্দ্র হাতের তালি দিয়ে বলে উঠলো, ‘সহমত। বউ নিয়ে লজ্জা পেতে অথচ এখন বাচ্চার বাপ হয়ে লজ্জা পাচ্ছো না? আশ্চর্য কারবার!’

রাহুল ওদের কথার থোরাই পাত্তা দিলো! বরং নিভা কিছু খাবে নাকি তা নিভাকে জিজ্ঞেস করে এলো। রাহুলের মা বেঁচে থাকা অবধি ছিলো রাহুলের জীবনের গোল্ডেন টাইম। তারপর সৎ মার অত্যাচারে বাড়ি ছাড়া হলো। বাবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। বাবা-মার ভালোবাসা না পাওয়া রাহুল চায় পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা তার সন্তানের জন্য ভাগ্যে জুটুক। এবং তার ভাগ্যের ভালোবাসা’টুকুও তার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য বরাদ্দ থাকুক। নিভা তার জীবনের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে নক্ষত্র সূর্যের আলো দিয়ে তার জীবনে ‘ডিভাইন টাইম’ বিলিয়ে দিচ্ছে। টিকলি বললো,

‘তুমি বসো, ভাইয়া। আমি বানাচ্ছি। কি খাবি তোরা?’

টিকলি প্রশ্ন করলো টায়রা, নিভার দিকে তাকিয়ে। নিভা টায়রার দিকে চেয়ে শুধায়,

‘মমো?’

‘রাইট। এটাই খেতে ইচ্ছে করছে আমার। বুঝলি কীভাবে রে তুই? এরজন্যই তো বলি তুই আমার বেটার হাফ।’

টায়রা নিভাকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দেয়। নিভা বমি করে দেওয়ার ভান করে। আর্দ্র টায়রার দিকে জহুরি নজরে তাকায়। বলে,

‘ও বেটার হাফ হলে আমি কি?’

‘আপনি আদার হাফ।’

‘আমার ফ্লাইং কিস কোথায়?’

টায়রা এমন ভান করলো যে তার বয়েই গেছে আর্দ্রকে ফ্লাইং কিস দিতে। একে তো রাহুলের মুখের বাবা হওয়ার জৌলুশ আর্দ্রর সহ্য হচ্ছে না তারউপর টায়রার এহেন ব্যবহার। ইচ্ছে করে একটা ঘুষি দিতে। আর্দ্র দুঃখে ভরা চোখ নিয়ে টিকলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘বলো তো, আমার কবে বাচ্চা হবে, টিকলি?’

টায়রা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

‘ওকে জিজ্ঞেস করলেন কেনো? আপনার কি মনে হয় ও মাজারের সামনে টিয়া পাখি নিয়ে বসে? ফরচুন টেলার?’

নিভা, টিকলি ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। আর্দ্র রেগে বলে,

‘আপনি চুপ করুন।’

‘কেনো? আমি কি আপনার মুখ দিয়ে কথা বলছি?’

‘তর্ক করবেন না একদম। এমনিতেই আমার মন ভালো নেই।’

আদর কফি খেতে খেতে টেনে টেনে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘কারণ আমি বাবা হতে চাই।’

আর্দ্র আদরের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে সম্মতি জানিয়ে আবার টায়রার দিকে তাকায়।

নিভা, টিকলি আরেক চোট শব্দ করে হাসে। টায়রা বিরক্তিকর শব্দে গলা খানিকটা উঁচুতে তুলে বলে,

‘আরে ভাই, দুই তিন মাস তো যেতে দিবেন। গেলো মাত্র এক মাস। এই মাসখানেকের মধ্যে আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবো? এটা তো টিকলির ওই ১৫ দিনের প্রেগন্যান্টের মতো কাহিনি হয়ে গেলো।’

নিভা তখনো হেসে যাচ্ছে। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে যাওয়ার উপক্রম। আর রাহুল নিভার কান চেপে ধরে আছে। নিভা হাসতে হাসতে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালে রাহুল ওর কানে ফিসফিস করে জানালো,

‘আমার বাচ্চা শুনছে সব। লজ্জা লাগে না আপনার?’

নিভা মুখ ভর্তি বায়ু শব্দ করে বের করে আরো জোরে জোরে হেসে উঠলো। টিকলি লজ্জা পেয়ে টায়রাকে ‘নির্লজ্জ’ বলে উঠে রান্নাঘরে গেলো। আদর লোক দেখানো কাশি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। বিরবির করে বললো,

‘কোন ভূত ঘাড়ে চাপার জন্য যে আমি এদের সাথে এসেছিলাম কে জানে!’

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৪.
আজ শুক্রবার। খান বাড়িতে বিয়ের উৎসবে আর্দ্র-টায়রা কোনো কমতি রাখলো না। সারা বাড়ি লাইট লাগানো হয়েছে। ডেকচি ভরে রান্নাবান্না হচ্ছে। বর বিয়ে করতে যাচ্ছে লাল গোলাপের সাজানো গাড়িতে। মোটামুটি আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভর্তি। তাদের বলা হলো এখন শুধু কাবিন হবে। বউ যখন উঠিয়ে আনা হবে তখন তারা বউ দেখতে পাবে আপাতত বউয়ের ছবি দেখো। বরযাত্রীও নাকি যাওয়া যাবে না। বউই যদি না দেখতে পারে তবে তাদের ডেকে আনা কেনো? ক’টা পোলাও মাংস খেতে বুঝি তারা এসেছে! এ নিয়ে কানাঘুঁষারও শেষ নেই। ছোট ছেলে পালিয়ে বিয়ে করলো। বড় ছেলে পালিয়েও বিয়ে করেনি এখন আবার বউ উঠিয়ে আনবে না। কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য! এ নিশ্চয়ই কনে বাড়ির কাছে আগের পালানোর কীর্তি ঢেকে রাখার ফন্দি। তবুও খান বাড়ির কারোর মুখের উপর কেউ কিছু বলতে পারে না।

,
সেদিনটা ভারী সুন্দর ছিলো। বসন্তের শেষ দিন! কুহেলির গানে রব রব সারাবেলা। বিকালের ঠান্ডা আঁচল উড়ানো পবন। কোথাও একটু রোদের ঝিলিক নেই। আকাশ মুখ কালো করে নেই। স্নিগ্ধ মাধুর্যপূর্ণ দিবান্ত। গাল ফুলিয়ে বিদায় জানাচ্ছে চৈত্রকে। অনিচ্ছায় স্বাগত জানাতে হচ্ছে ষড়ঋতুর বৈশাখকে। সাঁঝবেলার মন খারাপকে সম্মান জানিয়েছে টিকলি। সে ঘটা করে বিয়ের সাঁজ সাঁজেনি। ছিমছাম! আদরের পছন্দ করা টকটকে মেরুন রঙের শাড়ি’টাও গায়ে জড়ায়নি। জড়িয়েছে চোখে আরাম লাগা হালকা রঙের মক পিংক কালারের শাড়িটা। হাতে একটু মেহেদী নেই। গায়ে ভারী কোনো অলংকার নেই। কেবল গলায় একটা সরু চেইন আর কানে কলেজ রিং। মাথায় বিয়ের উড়না নেই। শাড়ি পরে ঠোঁটে হালকা রঙের একটা লিপস্টিক ঘঁষেছে শুধু সাথে চোখে বেবি পিংক কালারের চশমা খোলা চুল গুলোতে গেঁথেছে বিনুনি। তবুও তাকে লাগছে রুদ্রাণী…ইন্দ্রাণী…আদরীনি!

বর এসে গেছে! বর এসে গেছে!
টায়রার কলকলে ধ্বনি টিকলির শোবার ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে। বিয়েটা হচ্ছে টিকলির এপার্টমেন্ট থেকে। জামিলুর রেজা মেয়ের কাছে এসে বসলেন। মেয়ের হাত’টা শক্ত করে ধরতেই টিকলি বাবার হাতের উপর হাত রেখে দৃষ্টি নিচুতে রেখে মৃদু গলায় বলল,

‘বাবা, তোমাকে কখনো সরি বলা হয়নি। খুব অনুতপ্তে জর্জরিত হয়ে কীভাবে তোমাকে সরি বলবো, কীভাবে তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, একই অপরাধে দন্ডিত হয়েও কীভাবে টায়রাকে ছাড়া হেসে খেলে সেই বাড়িতে তোমাদের আদর নিবো সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। আমি অনেক সরি বাবা সেদিনের জন্য। আমার জন্য তোমার অসম্মান হয়েছে… তুমি মনে কষ্ট পেয়েছো… বাচ্চাদের মতো হু হু করে কেঁদেছো… আমি এই কষ্ট কাউকে দেখাতে পারিনি, বাবা। আমাকে মাফ করে দিবে?’

টিকলি চোখ তুলে তাকালো বাবার দিকে। জলে টইটম্বুর চোখ দুটো। জামিলুর রেজা মেয়ের মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে চোখ মুছিয়ে দিলেন। টিকলিও বাবার পানি জমতে শুরু হওয়া চোখ দুটো মুছিয়ে দেয়। জামিলুর রেজা মেয়ের হাতদুটো ধরে বলেন,

‘আমি অনেক সরি, বাবা। নিজের দম্ভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার উচিত হয়নি তোমার মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার অনুভূতিকে প্রশ্র‍য় না দিয়ে ওতো কঠিন হওয়া। তোমাকে ধন্যবাদ সেদিনের তোমার সেই পদক্ষেপের জন্য। তা নাহলে রাহুল-নিভা এতো সুখী হতো না। আর্দ্র টায়রাকে পেতো না। কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যেতো। তুমি আমার মেয়ে বলে আমি গর্বিত। যে মেয়ে বাবার কান্না শুনে পালিয়ে গিয়েও বিয়ে না করে ফিরে এসে, বাবার উপরেও অভিমান করে নিজের উদ্যমে নতুন পথ চলা শুরু করে। আমার শক্তিশালী মেয়ে!’

টিকলি ভাঙা আওয়াজে বলে, ‘সত্যি?’

জামিলুর রেজা হাসেন, ‘সত্যি।’

টায়রা দরজায় এসে দাঁড়ালো। চোখ ছোট ছোট করে বললো, ‘বাবা তুমি টিকলিকে বেশি ভালোবাসো, না? সত্যি করে বলো।’

জামিলুর রেজা পেছন ঘুরে তাকিয়ে হাসেন। টায়রা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, ‘দিজ ইজ নট ফেয়ার। বড় বলে ও বেশি আদর পাবে সবসময়?’

,
টিকলিকে ড্রইংরুমে নিয়ে আসা হলো। খুব অনাড়ম্বর ভাবে ওদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। টিকলিকে আদরের পাশে বসানো হলো। এরপরে টিকলি খেয়াল করলো আদতে শুধু নিজেদের পরিবারের লোক নয়… ড্রইংরুমের এক কোণায় আরাফ দাঁড়িয়ে। টিকলির দিকে যার করুণ দৃষ্টি। আরাফ’কে উপস্থিত দেখে টিকলি চকিতে চোখ পাকিয়ে গরম দৃষ্টিতে আদরের দিকে তাকালো। আদর উদাস নজরে তা দেখে। টিকলির বুঝতে বাকি নেই এ কার কাজ! দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘অন্য কাউকে দাওয়াত দিতে মানা করেছিলাম।’

আদরের ভাবলেশহীন কণ্ঠস্বর, ‘সে তো অন্যকেউ নয়। আপনার ভাইয়া…। সিলেটে একসাথে এতো ঘুরলাম… তার বাড়িতে দু’বেলা খেলাম একটা দাওয়াত তার পাওনা ছিলো না? বিয়ের দাওয়াতও খাওয়ালাম আবার ঋণও পরিশোধ করলাম। এক ঢিলে দু’পাখি।’

আদর গা জ্বালানো হাসি দেয়। টিকলি দাঁত কিড়িমিড়ি করে আদরকে ভস্ম করে দেওয়ার নজরে তাকিয়ে থাকলো মিনিট দুয়েক খানিক। রাগে চোখ সরাতেই আদর পরিপূর্ণ চোখে তাকালো টিকলির দিকে। আদরের খুব ইচ্ছে ছিলো টিকলিকে বিয়ের দিন ইয়া বড় টিকলি পরা অবস্থায় দেখবে। ওর ওই বড় কপাল… কপালে দু’পাশ থেকে শুরু হওয়া দুইগাছি চুলের সাথে বড় টিকলি কেমন মানিয়ে যেতো তা পরখ করে দেখতো! আদর জানে টিকলি ইচ্ছে করেই আদরের পছন্দমতো সাঁজেনি। তার এরকম সাদামাটা সাঁজ দেখলে যে কেউ নাক কুঁচকে বলবে, ‘বিয়ের কনের আবার এ কি ধরনের সাঁজ!’

ওইসময় আর্দ্র এলো। ক্যামেরা ধরে বললো, ‘দেখি দেখি বর-কনে একটু হাত ধরো তো। ভাইয়া টিকলির কাধে হাত রাখো। থুতনি’টা একটু ধরো। দুজন দুজনের দিকে প্রেম প্রেম নজরে তাকাও একটু। হাসো…! স্মাইল….!’

আর্দ্র বলে যাচ্ছে নিজের মতো অথচ ওরা নির্বিকার। ড্রইংরুমে গুরুজনেরা সবাই বসে আছে। টিকলি আর্দ্রর দিকে দাঁত খিচিয়ে তাকালো। টায়রাকে ইশারা দিয়ে বললো তোর বলদ জামাইটাকে এখান থেকে নিয়ে যা। টায়রা ফিরতি ইশারা পাঠিয়ে দেয় যার অর্থ ছিলো এই যে, ‘আমি ওকে পাঠিয়েছি। পোজ দে।’

অগ্যতা টিকলির আদরের হাত’টা ধরতে হলো তা নাহলে বড়রা কী ভাববেন! ইতিমধ্যে টিকলির মা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আদরের সাথে তোর ঝগড়া হয়েছে?’

আদর ডাকলো আরাফকে। টিকলি আদরের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘আবার উনাকে ডাকছেন কেনো?’

আদর টিকলির কথার উত্তর দেয় না। আরাফকে ডেকে বলে,

‘ভাইয়া, আসুন। আমাদের সাথে ছবি তুলবেন।’

আরাফ গড়িমসি করলো। সে জানতো না আদর, টিকলির বিয়ে। কাল রাতে আদর হঠাৎ ফোন দিয়ে বললো, আজ এখানে ওদের ছোটখাটো একটা এরেঞ্জমেন্ট আছে। আরাফের দাওয়াত রইলো। এটা যে এই এরেঞ্জমেন্ট তা তো আরাফ কল্পনাও করতে পারেনি। আসার সাথে সাথে বিস্ময়ভূত হলে আদর ওকে জোকার বানিয়ে দিয়ে বললো, ‘সারপ্রাইজ। আজ টিকলির সাথে আমার বিয়ে।’ আদরের বারংবার ডাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরাফকে গিয়ে ওদের সাথে ছবি তুলতে হলো। টিকলি জোরপূর্বক হাসলো তাতে। ইচ্ছে করছিলো আদরের মাথাটা ফাঁটিয়ে দিতে।

টিকলি ছোট্ট এপার্টমেন্ট’টাতে আরো এসেছিলেন রাহুল, নিভার বাবা-মা। রাহুল এটা জানতো না। বস্তুত টিকলিও জানতো না। তাতে অবশ্য টিকলি অবাক হয়নি। অবাকের বাউন্ডারির ওপারে সে চলে গিয়েছে। টায়রা একটু সময় পেয়ে এতোক্ষণে গিয়ে আকিদা হককে ধরলো,

‘আরে ভাল্লুক মামী থুরি মামী আপনি এসেছেন? আমাকে আপনার মনে আছে?’

টায়রা যে ইচ্ছে করে শুনিয়ে ভাল্লুক মামী ডেকেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আকিদা হক মুখ টানা মেরে বললেন,

‘তোমাকে কি আর ভুলা যায়?’

‘না ভাবলাম ভুলে টুলে গেছেন বোধহয়। তা মামী সুখবর টুখবর আছে নাকি?’

আকিদা হক প্রশ্নবোধক চোখে তাকালেন। তাতে টায়রা তার দিকে আরেকটু সরে এসে চাপা গলায় বললো,

‘আপনার পেট’টা সাইজে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে, মামী। টেস্ট মেস্ট করে চেক করে নিয়েন। আজকাল আবার প্রেগন্যান্ট হলেও লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় না। শুধু পেট বড় হতে থাকে। মানুষ ভাবে গ্যাসে বড় হচ্ছে। তারপর একদিন ফুট করে বাচ্চা বের হয়ে যায়। নতুন রোগ বুঝলেন!’

আকিদা হক বেকায়দায় পরলেন। সাইজে তিনি ডাবল হয়েছেন এ অতি সত্যি কথা। কিন্তু ইদানীং পেটটার মধ্যেও কেমন শক্ত শক্ত লাগে। মনে হয় কি যেনো নড়ে। আজকে গিয়েই টেস্ট করাবেন। তা নাহলে পেট ফুলতে ফুলতে ফুট করে বাচ্চা বের হয়ে গেলে তো সমস্যা!

আকিদা হকের মুখ দেখে টায়রা ঠোঁট চেপে হাসলো। নিভা এসে আকিদা হককে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছেন, আন্টি?’

আকিদা হক নিভাকে অকারণেই পছন্দ করেন না। কথায় কথায় নিভাকে অপদস্ত করেন। তিনি মুখটানা মেরে টেনে টেনে বললেন,

‘কেমন থাকি আর না থাকি তাতে কি আর তোমাদের যায় আসে? পালিয়ে বিয়ে করে পরিবারের মুখ পুড়িয়ে তোমরা তো খুব সুখে আছো না? সেই সুখ নিয়েই থাকো। শশুড় শাশুড়ির খেদমত করার কথা তো বাদই দিলাম বিয়ের করেই স্বামী নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছো।’

বলেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। পেটের বাচ্চার কথা তো দূর নিভাকে একবার জিজ্ঞেসও করলেন না তুমি কেমন আছো। টায়রা পেছন থেকে বলে গেলো উঁচু গলায়, ‘রাহুল ভাইয়া নতুন করে আলাদা হয়নি। আগে থেকেই আলাদা ছিলো। আপনি ওকে আলাদা করেছেন।’

রাহুল দূর থেকে তা দেখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। রুহুল হক’কে গিয়ে দাঁত চেপে বলল,

‘আপনার ওয়াইফ’কে ঠিকঠাক কথা শেখাতে পারেন না? শেখাতে না পারলে সব জায়গায় নিয়ে যান কেনো? উনাকে বারণ করে দিবেন আমার বউয়ের সাথে ওই সুরে কথা বলতে। আমি একদম টলারেট করবো না। জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলবো একদম।’

রাহুল বললো আকিদা হককে শুনিয়েই। নিভা মন খারাপ নিয়ে টিকলির ঘরে গিয়ে বসলো। টায়রা গিয়ে নিভার পাশে বসে ওর পেটে হাত রেখে বলে,

‘একবার কি হয়েছে জানিস?’
নিভা ভারী স্বরে উত্তর দেয়, ‘না।’
‘আমি ভাল্লুক মামীকে নিয়ে ছন্দ বানিয়েছিলাম। সেটা আবার তাকে শুনিয়েছিলামও।’
‘কি ছন্দ?’
টায়রা গলা ঠিক করে। এরপর ধমকে ধমকে বলে,

“এই আকিদা, ওইদিকে তাকা।
দা দিয়ে কেটে দিবো তোর পা আর কল্লা।
তাড়াতাড়ি তোর এই নাম পাল্টা।
এই আকিদা, গরু কেটে করে ফেল তোর আকিকা।”

শুনে নিভা অনেকক্ষণ হাসলো। হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পরলো। টায়রা সে হাসি চেয়ে চেয়ে দেখে নিজেও হাসে। নিভা শুধায়, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কি ফাটাবাঁশের মতোন আমাদের কানে তালা লাগিয়ে ‘টায়রা’ বলে গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো। আর আমি এক দৌড়ে পগারপার।’

‘তুই উনাকে ভাল্লুক মামী বলে ডাকিস কেনো?’

‘আরে উনার ব্যবহার’টা দেখিস না? শোন, ভাল্লুকের কাছে গেলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখতে হয় না হলে ফাঁদে ফেলে নিস্তেজ করে মারতে হয়। উনি হচ্ছেন ওরকম একজন মানুষ। ভয়ে কাঁপলেই থাবা দিয়ে ধরবে।’

চলবে❤️