টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-০২

0
1

#টক_ঝাল_মিষ্টি (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

সুফিয়ান স্নেহার সাথে নিজের পুরনো ছবি দেখছিলো আর অতীতের কথা ভাবছিলো। কত সুন্দর ছিলো তার জীবন। হঠাৎ একদিন তার মায়ের হৃদরোগ ধরা পড়ে। সুফিয়ানের বাবা খুব ছোটবেলায় মা রা গেলে তার মায়ের স্থান হয়েছিলো বাবার বাড়ি। সেখানে সবাই তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য জোর করা নিজের সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো সুফিয়ানের মা। সেই থেকে সুফিয়ান এবং তার মা এরা একে-অপরের দুনিয়ায়। কত কষ্ট করে সুফিয়ানকে তার মা বড় করেছে, সেটা সুফিয়ানের জানা। এই দুনিয়ায় তার মা এবং স্নেহা ছাড়া ভালোবাসার কেউ ছিলো না। কিন্তু যখন শুনলো সেই মা অসুস্থ তখন তার দুনিয়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গিয়েছিলো। প্রথমত মায়ের অসুস্থ দ্বিতীয়ত মায়ের স্বপ্ন। এই দুইয়ের মাঝে সুফিয়ান বন্দী হয়ে যায়। তার মা অসুস্থ, এতবড় একটি রোগ তার শরীরে বাসা বেধেছে এটি জানার পর থেকে তার মা প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। একরাতে সুফিয়ানকে কাছে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে বলে,“বাজান এইবার আমাকে আমার বৌমার হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ করে দে।”

মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুফিয়ানের বিয়ের কথা বলছে বুঝতে পেরে সুফিয়ান খুশি হয়। সেও তো বিয়ে করতে চায়। অতঃপর সুযোগ পেয়ে মাকে যখন স্নেহার কথা বলতে যাচ্ছিলো সেই মূহুর্তে তার মা বলে,“আমি আমার বৌমা অনেক আগেই পছন্দ করে রেখেছি। এবার শুধু তোর মতামতের অপেক্ষা।”

“মানে?”
সুফিয়ান অবাক হয়ে তার মাকে প্রশ্ন করে। তার মা জানায়,“আমার এক বান্ধবী ছিলো। ও বেঁচে নেই। তবে ও বেঁচে থাকা অবস্থায় আমি তোর বিয়ে ওর মেয়ের সাথে ঠিক করে রেখেছিলাম। সেদিন আমার অসুস্থতা দেখতে যে আসলো, তোর ঐ আংকেলের মেয়ে। আমি যদিও তোকে এই কথাটা অন্যসময় ভালোভাবে বলতাম। কিন্তু এখন যেহেতু আমার জীবনের কোন নিশ্চয়তা নাই তখন আমি দেরি করতে চাই না। তাই এখন তোকে জানালাম। তুই মত দিলে আমি ভাইজানের সাথে কথা বলে বিয়ের পাকা কথা সেড়ে নিবো।”
এসব শুনে সুফিয়ান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে তার মাকে কি জবাব দিবে ভেবে পায় না। তবুও অনেক নরম স্বরে মাকে বলে,“আম্মা তোমাকে একটি কথা বলতে চাই। আম্মা কষ্ট পেও না।”

“কী কথা? এই বিয়ে হবে না এমন কথা বলিস না বাজান। তাহলে কিন্তু আমি সহ্য করতে পারবো না। আমার বান্ধবীকে আমি কথা দিয়েছি, তার অনুপস্থিততে এখন আমি কথা ভাঙতে পারবো না। এটা আমার দ্বারা হবে না।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সুফিয়ান স্নেহার কথা বলতে পারে না। তার মা অসুস্থ। এই সময়ে যদি এমন কথা বলে তাহলে তার মা ভেঙে পড়বে। তাছাড়া এই বিয়ে নিয়ে মায়ের যে আকাঙ্খা সে দেখছে তাতে তার কথা শুনলেও হয়তো তার মা মানতে পারবে না। তাই সুফিয়ান কথা ঘুরিয়ে নেয়। এরপর কয়েকবার তার মাকে কথাটি বলতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। এভাবেই দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। বিয়ের দুইদিন আগে সুফিয়ানকে উদাসীন দেখে যখন তার মা জিজ্ঞেস করে,“তুই এই বিয়েতে খুশি না বাজান?”

“না।”
সুফিয়ান নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলো না। তাই মাকে সরাসরি তার কথা বলে দিলো। সে অনেক নমনীয় গলায় বলে,“আম্মা আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। এই বিয়ে হলে দুজনকে ঠকানো হবে। আমি পারবো না আম্মা। আমি এতদিন বুকে পাথর চাপা দিয়ে…..।”
সুফিয়ানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তার মা ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠে। সে উত্তেজিত গলায় বলে,“তুই এখন এই কথা বলতে পারিস না সুফি। আমি কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়ে রুমকে তোর বউ বানাতে চাচ্ছি। আমার বান্ধবী এবং আমার স্বপ্ন সত্যি করতে যাচ্ছি। এরমাঝে তুই এটা আমাকে কী শুনাইলি? এটা শোনার আগে আমার কান নষ্ট হয়ে গেল না কেন? এখন আমি সবাইকে কি বলবো? রুমকে কি বলবো? আর আমার….।”
এসব বলতে বলতে সুফিয়ানের মা অসুস্থ হয়ে যায়। সুফিয়ান তৎক্ষনাৎ তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। সুফিয়ান মায়ের এমন অবস্থা দেখে একদম থমকে যায়। মায়ের জ্ঞান ফিরলে সে তাকে জড়িয়ে উচ্চশব্দে কান্না করে দেয়। তখন সুফিয়ানের মা বলে,“এই বিয়েটা ভাঙিস না বাজান। এই বিয়েটা কর। দেখবি তুই অনেক সুখী হবি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে অনেক শক্তিশালী বন্ধন। যার কাছে সবকিছু মিথ্যে মনে হবে তোর। তুই এই বিয়েটা ভাঙিস না সুফি।”

মায়ের এই কথা ফেলতে পারে না সুফিয়ান। সে এই বিয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যায়। শুয়ে শুয়ে এসব কথা ভাবছিলো সুফিয়ান। তবে তার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটায় মশা। যেহেতু মেঝেতে শুয়েছে সেহেতু মশার উৎপাদ অনেকটা বেশিই ছিলো। সুফিয়ান হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করে। একটা সময় বিরক্ত হয়ে সে উঠে পড়ে। সে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা রুমঝুমকে ডাক দেয়। সে বলে,“এই, এই, এই….।”
সুফিয়ান নিজের এই ডাক শুনে নিজেই বিরক্ত হয়। সে ভাবে,“এমনভাবে ডাকলে এই মেয়ে বুঝবে কিভাবে যে তাকে ডাকছি?”
সুফিয়ান রুমঝুমের নাম মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রথমবার ব্যর্থ হয়। পরক্ষণে আবার চেষ্টা করতে ঝুম মনে পড়ে। তাই বলে,“ঝুম শুনছেন?”

রুমঝুমের ঘুম ভাঙছে না দেখে সুফিয়ান একটু জোরে ডেকে উঠে,“এই ঝুম।”

“কে কে?”
রুমঝুম কিছুটা হচচকিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। প্রথমে বুঝতে পারে না কী হলো। পরক্ষণে যখন বুঝতে পারে তখন বিরক্ত হয়ে বলে,“এই মাঝরাতে ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছেন কেন?”

“ভদ্রভাবে কথা বলুন। আমি মোটেও ষাঁড় নই। আমি যথেষ্ট ভালোভাবে ডাক দিয়েছি।”
সুফিয়ান রুমের মুখের সামনে আঙুল তুলে কথা বলছিলো। রুম কঠিন এক চোখে তার দিকে তাকাতে সুফিয়ান থেমে যায়। রুম চোখগুলো একটু বড় করে, অদ্ভুতভাবে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুফিয়ান শান্ত গলায় বলে,“এভাবে তাকালে যে আমি ভয় পাবো একদম সেটা ভাববেন না। নেহাৎ আমি একটি ভুল করেছি সেজন্য আপনার কথার প্রতিত্তোর করছি না। একটু নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করছি। তারমানে এটা নয় যে আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন।”

”মাঝরাতে আপনার এই ফালতু কথা শোনার জন্য নিশ্চয় আমি শখের ঘুম বিসর্জন দেইনি?”
রুমের এমন স্পষ্ট জবাব শুনে সুফিয়ান দমে যায়। সে আগের চেয়ে বেশি নরম গলায় বলে,“আমি নিচে শুতে পারছি না। প্রচন্ড মশা।”

“তো?”
রুমের এই কথায় সুফিয়ান বিরক্ত হয়। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে,“এটা আমার বাড়ি। আমার বিছানা। তাই নিয়ম অনুযায়ী আপনার নিচে শোয়া উচিত।”

“প্রথমত আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন কাজের লোক করে নয় যে নিচে ঘুমাবো। দ্বিতীয়ত আমি আপনাকে নিচে শুতে বলিনি। আপনার যেখানে খুশি শুয়ে পড়ুন।কিন্তু তাই বলে আমি মেঝেতে শুবো এটা ভেবে ভুল করবেন না। এটা নয় যে আমি মেঝেতে শুতে পারবো না। আমি পারবো। আমি সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু তাই বলে এখানে মানিয়ে নিবো সেটা আপনার ভুল ধারণা। অকারণে আমি নিচে কেন শোবো? যেখানে আমার কোন ভুলই নেই।”
রুম কঠিন গলায় কথাগুলো বলে। এটা শুনে সুফিয়ান বলে,“আচ্ছা তাহলে আপনি সাইডে সরুন। আমি এপাশে ঘুমিয়ে পড়ি।”

“আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে হলে আমাকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে হবে।”

“মানে?”
রুমের কথা বুঝতে না পেরে সুফিয়ান জিজ্ঞেস করে। রুম স্পষ্টভাষায় বলে,“আপনার ডিভোর্স চাই তো? দিয়ে দিবো। কিন্তু আমার সাথে এক বিছানায় থাকলে আপনাকে আমাকে স্ত্রী হিসাবে মেনে তারপর আসতে হবে। আর ডিভোর্সের নামও ভুলে যেতে হবে। এরকম অনেক কিছু আছে যেগুলো করলে আমি আপনাকে ছাড়বো না। আপনাকে সারাজীবন আমাকে নিয়েই কাটাতে হবে।”

“এই কথাটি একটু মিষ্টি করেও তো বলা যেতো। মিষ্টি এবং সহজ ভাষায় বললেই তো আমি বুঝতাম। এত তেজ নিয়ে বলার কি আছে?”
সুফিয়ানের এই কথা শুনে রুম ভাব নিয়ে বলে,“এটা বুঝতে হলে মস্তিষ্কের ব্যবহার জানতে হয়। যেটা বোধহয় আপনি জানেন না।”

সুফিয়ান বিরক্তি নিয়ে রুমের দিকে তাকায়। তারপর বলে,“আপনাকে কেউ কখনো বলেনি যে আপনার মধ্যে মিষ্টি ভাবের অভাব আছে।”

“হ্যাঁ বলেছিলো। সেই সাথে এটাও বলেছে আমার মধ্যে থাকা টক এবং ঝালকে পার্ফেক্ট করতে আমার জীবনসঙ্গীর দেওয়া এক চিমটি মিষ্টিই যথেষ্ট। দূর্ভাগ্যবসত আপনার মিষ্টি অন্যত্র বিলি করে দিয়েছেন তাই আমার কাজে লাগছে না। সেজন্য আমার টক, ঝাল ব্যবহার আরও বেশি ঝাঁজালো হচ্ছে।”
রুমের এই কথা শুনে সুফিয়ান আর কথা বাড়ায় না। সে চোরা চোখে একবার রুমকে দেখে নেয়। রুমের সব কথার মাঝে একটি কথা তার ভালো লাগে। তাহলো রুম তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। সেজন্য কষ্ট মেনে নিয়ে একটি মশার কয়েল জ্বালিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। সুফিয়ান মেঝেতে শুয়ে রুমকে উদ্দেশ্য করে বলে,“ঝুম প্লীজ আমাদের মাঝে এসব কথা মাকে বা অন্যকাউকে বলবেন না। আমার এই অনুরোধটা রাখবেন।”
রুমের থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে সুফিয়ান হতাশ হয়ে বলে,“ঝুম ঘুমিয়ে পড়েছেন?”

“আমি কী করবো এবং কী করবো না সেটা আমার সিদ্ধান্ত। আমি আমার সিদ্ধান্তে কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না।”
রুমের মুখে এমন কথা শুনে সুফিয়ানের ঘুম এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল। তার মাঝে প্রচন্ড টেনশন কাজ করতে শুরু করে। সে টেনশনে বারবার রুমকে অনুরোধ করছিলো, এসব কথা কাউকে না বলতে। এসব দেখে রুম বিরক্ত হয়ে বলে,“চুপচাপ শুয়ে পড়ুন এবং আমাকে ঘুমাতে দিন। একবার তো আমার ঘুম ভাঙালেন, দ্বিতীয়বার এমন কিছু হলে সোজা এখন গিয়ে সবাইকে সব বলবো।”
এটা শুনে সুফিয়ান চুপ হয়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মা যদি এসব জানে তাহলে খুব কষ্ট পাবে। সে চেয়েছিলো কয়েক মাস রুমের সাথে কাটিয়ে মাকে অন্য অজুহাত বা বলা যায় মা মারা গেলে রুমকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। সেই কয়েকটা মাস রুমকে মানিয়ে নিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু এখানে তো রুম সব বলে দেওয়ার কথা বলে তার রাতের ঘুম কেড়ে নিলো।


চলবে,