টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-১০

0
11

#টক_ঝাল_মিষ্টি (১০)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

রুমঝুমের শাশুড়ীকে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। তাকে সরাসরি সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। ডাক্তার, নার্স দ্রুতই চিকিৎসা শুরু করে দেন। একদিকে চিকিৎসা চলছে অন্যদিকে রুমঝুম এবং সুফিয়ান চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ানের অনেক অস্থির লাগছে। তার এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো তার মা বোধহয় তাকে ছেড়ে গেল। এই ভাবনা আসার পর থেকেই তার অস্থিরতা বেড়ে গেছে। রুমঝুম সুফিয়ানের এই অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে।

কয়েক ঘন্টা পর ডাক্তার জানায়, রুমঝুমের শাশুড়ী এখন কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত। তবে অবস্থা তেমন ভালো না। যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটতে পারে। অনেক রোগীর শরীরের ভেতর অনেক রোগ বাসা বাধে। যেটার লক্ষণ অনেক সময় তৎক্ষনাৎ দেখা দেয় না। এইক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। শেষ সময়ে এসে হার্ট অ্যাটাক হয় রুমঝুমের শাশুড়ীর। যেই সময়ে চিকিৎসা নাই বললেই চলে। যেখানে হার্টের প্রায় অধিকাংশ ড্যামেজ। এসব কথায় সুফিয়ান আরও ভেঙে পড়ে। সে মায়ের পাশে তার হাত ধরে চুপটি করে বসে থাকে। সে অনেক কথা বলতে চায়, কিন্তু পারছে না। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। এসব দেখে রুমঝুম সুফিয়ানের ঘাড়ে হাত রাখে। সুফিয়ান আনমনে বলে উঠে,“স্নেহা।”

রুমঝুম এই কথা শুনে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নেয়। সুফিয়ান তার দিকে তাকাতে রুমঝুম রাগী একটি লুক দিয়ে চলে নিজের বাবার কাছে। রুমঝুমের শাশুড়ীর অসুস্থতার কথা শুনে তার বাবা এসেছে। রুমঝুম তার বাবার কাছে আসতে তার বাবা বলে,“একটু ওদিকে চলো তোমার সাথে কথা আছে।”

রুমঝুম মাথা নাড়িয়ে তার সাথে চলে যায়। রুমঝুমের বাবা তাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে,“তুমি তো সবটা দেখছো। এখনো তোমার মনে হয় সুফিয়ানকে সত্যিটা বলা উচিত? সুফিয়ান এবং তার মায়ের প্রতি তোমার কি একটুও সহানুভূতি কাজ করছে না?”

“তুমি কি বলতে চাও? সারাজীবন আমি একটি মিথ্যের সাথে ঘর করবো?”
রুমঝুম শান্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে৷ তার বাবা তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলে,“না। সবটা সময়ের হাতে ছেড়ে দাও। সময় আসলে ঠিকই সব সত্যি সুফিয়ান জানতে পারবে, বুঝতে পারবে।”

”সত্যি যখন তার সামনে আসবে তখন সে স্নেহার বেদনায় শেষ হয়ে যাবে। এই বিয়ের কোন অস্তিত্ব হয়তো তার জীবনে থাকবে না। এই কথাটি এই বিয়ে দেওয়ার পূর্বে তুমি একবারও ভেবেছো?”
রুমঝুমের এই প্রশ্নের জবাব তার বাবা দিতে পারে না। সে হতবাক চোখে তার দিকে তাকায়। রুমঝুম বলে,“তোমরা আমাকে ঠকিয়েছো। বাবা হয়ে সন্তানকে ঠকিয়ে এক মানসিক রোগীর সাথে বিয়ে দিয়েছো। এসব তোমাদের কাছে সঠিক। আর আমি সত্যিটা প্রকাশ করতে চাইলে ভুল। সেটা শুনে একজন চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করে তো অন্যজন সেটা দেখে আমাকে বোঝাতে আসে। বাহ কি সুন্দর!”
একটু থেমে রুমঝুম আবারও বলে,“তোমরা ভাবছো একটা সময় সে আমাকে মেনে নিবে, আমাদের সুন্দর সংসার হবে। অথচ এটা ভাবছো না যে এখানে সত্যিটা সামনে আসলে সুফিয়ানের এই বিয়ের প্রতি কেমন মনোভাব জন্ম নিবে? এটা ভাববে কেন? তোমাদের কাছে তো মনে হয় সব খুব সহজ। এতটাই সহজ যে একজন পাগল ঠিক হয়ে যাবে, তার বউকে ভালোবাসবে। সবকিছু এত সহজ। তোমরা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হয়েও এই সামান্য কথাটা ভাবতে পারোনি। আবার এখন আমাকে জ্ঞান দিতে আসছো?”

রুমঝুমের এই কথার কাছে তার বাবা শব্দহীন হয়ে যায়। রুমঝুম কথাগুলো হয়তো খুব কঠিন করে বলে। কিন্তু কোন ভুল বলে না। এই মানসিক সমস্যা ভোগা ছেলেটির সাথে রুমঝুমের বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেকবার ভেবেছিলো অবশ্য, কিন্তু ঐ পুরনো ঋন বন্ধুত্বের অনুরোধের কাছে হেরে গেছে সে। অতীতে এই সুফিয়ানের বাবা, মায়ের অনেক সাহায্যই তারা পেয়েছে। সবচেয়ে বড় করা তারা দুঃসময়ে একে-অপরের বন্ধু হয়েছিলো। সেই সময়গুলোই তাদের বন্ধুত্ব অনেক গাঢ় করেছে। রুমঝুমের মা থাকলেও হয়তো সুফিয়ানের মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারতো না। এই বিয়েতে সেও না করতে পারতো না। এটা ভেবেই রুমের বাবা রাজি হয়। তবে এখন রুমঝুমের কথা শুনে তার মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে। তাই বলে,“যা করবে ভেবেচিন্তে করো রুম। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই৷ হয়তো আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো তার জন্য আমি স্যরি। তবে ভুল থেকেও কিন্তু ভালো কিছু হতে পারে। আমি চাইবো তুমি সেই ভালোটাকেই নিজের জীবনে নিয়ে আসো।”

রুমঝুম জবাব না দিয়ে সুফিয়ানের কাছে চলে আসে। সুফিয়ান রুমঝুমকে দেখে শান্ত গলায় বলে,“স্যরি।”
রুমঝুম বুঝতে পারে সুফিয়ান সেই সময়ে তাকে ‘স্নেহা’ বলায় স্যরি বলছে। তবে সে তেমন ভাবান্তর দেখায় না।

সেবার সাতদিন হাসপাতালে থাকতে হয় রুমঝুমের শাশুড়ীর। যার সাথে ওরা দুজনও ছিলো। এই কয়েকদিন রুমঝুম বেশ ভালোভাবে তার শাশুড়ীর যত্ন নিয়েছে। রুমঝুমের মতো কঠিন মানুষের এমম সেবা-যত্ন করা অবশ্য সুফিয়ানকে অবাক করে দিয়েছে। সে কখনো ভাবেনি এসব কাজ রুমঝুম করবে। এসব দেখে সুফিয়ান কিছুটা কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করে,“আপনি আমার মায়ের এত খেয়াল রাখছেন, এতে বিরক্ত হচ্ছেন না?”

“এটা আমার দায়িত্ব। আমি দায়িত্ব পালণে অবহেলা করি না।”
রুমঝুম স্বাভাবিকভাবে কথাটির জবাব দেয়। সুফিয়ান কিছুটা বিষ্মিত হয়েই বলে,“দায়িত্ব?”

“হ্যাঁ। মা তো আমাকে বৌমা হিসাবে অস্বীকৃতি জানাননি, তেমন আমিও তাকে শাশুড়ী মা হিসাবে স্বীকার করেছি। তো এখানে তার সেবা-যত্ন করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেই সাথে ভালোবাসাও।”
এই কথাটি বলে রুমঝুম নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সুফিয়ান অবাক চোখে রুমঝুমকে দেখে যায়।

বেশ কিছুদিন কেটে যায়। রুমঝুমের শাশুড়ীকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে পাঠানো হলেও ডাক্তার তাকে সম্পূর্ণভাবে বেড রেস্টে রাখতে বলেছে। রুমঝুম সেটাই করে। সে এখানেও তার দায়িত্বগুলো সুন্দরভাবে পালণ করে যাচ্ছে। রুমঝুম একা অবশ্য করছে না। তার সাথে সুফিয়ানও সঙ্গ দেয়। সুফিয়ানের মায়ের অসুস্থতা শুনে নিয়াজও দেখতে আসছিলো। তখন রুমঝুম তার সাথে পরিচিত হয়ে নেয়। সে তার ফোন নাম্বারটিও নিয়ে নেয়। সেই থেকে রুমঝুম নিয়াজকে সুফিয়ানকে এসব ঘোরের মধ্যে না রেখে সত্যিটা বলে দিতে বলে। তাকে সুস্থ হতে হলে এসব উদ্ভট চিন্তা তার মাথায় ঢোকানো বন্ধ করা উচিত নিয়াজের। নিয়াজ অবশ্য রাজি হয় না। কিন্তু রুমঝুম কঠিন গলায় বলায় সে সেই সময়ের জন্য রাজি হয়ে যায়। তবে আজও সুফিয়ানকে কিছু বলতে পারেনি। তাই রুমঝুম নিয়াজকে ফোন দিয়ে সরাসরি বলে,“আপনি তার বন্ধু। আপনি তাকে সত্যিটা বললে তার জন্য হয়তো সবটা সহজ হতো। তাই আমি আপনাকে বলেছি। তবে আপনি যখন মিথ্যের এই দুনিয়ায় তাকে রাখতে চান তখন আমাকেই সত্যিটা বলতে হবে। আর হ্যাঁ আমার বলার ভাষাটা আমার মতোই হবে। সেজন্য তখন কিছু হয়ে গেলে সেই দ্বায় আমি নিবো না।”

রুমঝুমের কঠিন গলায় বলা এই কথায় নিয়াজ কিছুটা ভয় পায়। সে ভয় যদি সুফিয়ান রুমঝুমের মুখ থেকে এসব শুনে অনেক শকড হয়ে কিছু করে ফেলে। তাই সে বলে,“প্লীজ না ভাবী। ভাবী আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আসলেই কোন স্ত্রী চাইবে না তার স্বামী মিথ্যা একটা সংসার তার সাথে গড়ুক। আমি সুফিয়ানকে সত্যিটা বলবোও। তাই আপনার বলার প্রয়োজন নেই।”

“আচ্ছা। যত দ্রুত পারেন বলুন। নয়তো আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
রুমঝুম এই কথা বলে ফোন রাখতে নেয় তখন নিয়াজ বলে,“ভাবী সুফিয়ানের বিষয়টাও একটু বুঝুন। ওর মা অসুস্থ, এই সময়ে ও যদি বুঝতে পারে ও নিজের যেই চিন্তা চেতনায় বন্দী আছে তাহলে ও আদো সুস্থ থাকবে?”
এই কথা শুনে রুমঝুম মুখের উপর ফোন কেটে দেয়। যদিও সে সবার কথা বুঝতে পারছে। কিন্তু যখন রাতের বেলা তারই সামনে সুফিয়ান স্নেহাকে মিথ্যা কল দিয়ে কথা বলে, তার রাগ ভাঙায়। এসব তার কাছে অনেক অসহ্যকর লাগে। যেহেতু এটা সুফিয়ানের কল্পনা তাই মেনে নিচ্ছে, যদি সত্যি স্নেহা থাকতো তাহলে রুমঝুমের হাতের থাপ্পড়ে থাপ্পড়ে সুফিয়ান শেষ হয়ে যেতো। কল্পনাকেও মেনে নিতো না রুমঝুম, তবে সেদিনের ঘটনায় সে কিছুটা হতভম্বই হয়। তার কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিলো সুফিয়ানের মা আজ মা রা গেলে সেটার কারণ হবে রুমঝুম। তার জন্যই সে এত চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। এই কারণেও মেনে নিচ্ছে রুমঝুম। তবে তার এসব মিথ্যা জিনিস একদম পছন্দ হচ্ছে না।

রুমঝুম এসব ভাবছিলো। তার ভাবনার মাঝেই সুফিয়ান বলে উঠে,“নিয়াজ আমাকে কী সত্যি জানাবে? আর ও তো আমার বন্ধু, তার সাথে আপনার এত ভাব হলো কিভাবে? যে আপনারা আলাদাভাবে কথাও বলছেন?”

“আপনি জানতে চান নিয়াজকে আমি আপনাকে কোন সত্যি জানাতে বলছি?”
রুমঝুম সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করে। রুমঝুমের মনে হয় এখনই হয়তো সঠিক সময় সুফিয়ানকে সত্যিটা বলার। সুফিয়ান যেই বলে,“হ্যাঁ।”

তৎক্ষনাৎ রুমঝুম বলে উঠে,“স্নেহা মা রা গিয়েছে। সে শুধুমাত্র আপনার কল্পনায় এখন বেঁচে আছে। যেটা আপনার জন্য হয়তো একটা বাস্তব কিন্তু বাকিদের জন্য আপনাকে পাগল….।”
রুমঝুম কথাটি শেষ করতে পারে না। তার মাঝে সুফিয়ান তার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। রুমঝুম কঠিন চোখে সুফিয়ানের দিকে তাকায়। সুফিয়ান রাগান্বিত গলায় বলে,“আপনার কথার জবাবে তেমনভাবে প্রতিত্তোর দেই না বলে আপনি যা খুশি তাই বলবেন? এই তো বলেন, এটা বাস্তব, এটা ন্যায়, এটা অন্যায়, এটা যৌক্তিক, এসব বিষয় মজার নয়। তাহলে আপনার নূন্যতম কমনসেন্স নেই যে একজন জীবিত মানুষকে মৃ ত বলে মজা করতে নেই।”
এই কথাটি বলে সুফিয়ান বলে উঠে,“আমার স্নেহা নেই। ও মা রা গেছে। ফাজলামি পেয়েছেন। এতবড় মজা করার সাহস আপনি কোথায় পেলেন? এসব অলক্ষুণে কথা কোথায় পান? এখন যদি সত্যি কিছু হয়ে যায় তার। আপনার এই অপয়া মুখে বলা কথাটি যদি লেগে যায়। না না। আমার স্নেহার কিছু হতে পারে না। কখনোই হতে পারে না।”
সুফিয়ান এসব বলে পাগলামি করতে শুরু করে। সে পাগলের মতো এসব বলেই যাচ্ছে। এটা দেখে রুমঝুম বলে,“সুফিয়ান….।”
এটা শুনে সুফিয়ান রুমঝুমের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। তাকে নিজের কাছে টেনে চোখে চোখ রেখে বলে,“একদম একটাও শব্দ করবেন না। আপনার ঐ অপয়া মুখে আমি মজা করেও আর কোন শব্দ শুনতে চাই না। আপনি জানেন আপনি কতবড় ফালতু কথা বলেছেন।তাও স্নেহাকে নিয়ে।”

“স্নেহা সত্যি বেঁচে নেই।”
এমন সময় অন্যকেউ হলে হয়তো সুফিয়ানকে তার মিথ্যার জগতেই আবার নিয়ে যেতো। কিন্তু রুমঝুম তো রুমঝুম। সে আবারও সুফিয়ানকে সত্যি বললো। তাও স্পষ্ট ভাষায়। এটা শুনে সুফিয়ান তৎক্ষনাৎ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সুফিয়ান পাগলের মতো বলতে থাকে,“মাথা খারাপ হয়েছে। আপনি বারবার একই মজা করে যাচ্ছেন। আমার স্নেহা নেই। আমার স্নেহা নেই। এসব বাজে কথা পান কোথায়? আমার স্নেহার আছে। তার সাথে তো আমি একটু আগেই কথা বললাম। তার রাগও ভাঙিয়েছি, আপনার কথামতো একজন বন্ধু হয়ে। প্রেমিক হয়ে নয়। আপনি এতবড় ফালতু কথা বললেন কিভাবে? আমার স্নেহা আছে। আমার স্নেহা আমার জীবনে সারাজীবন থাকবে। সে আছে।”
সুফিয়ান পাগলের মতো এসব বলে যাচ্ছে। সেই মূহুর্তে রুমঝুম সুফিয়ানের গালে দ্বিতীয়বারের মতো থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড়টি দেয় রুমঝুম। মূহুর্তের মাঝে সুফিয়ান নিরব হয়ে যায়। সে হতবাক হয়ে রুমঝুমের দিকে তাকায়।


চলবে,