নিঃসঙ্গতার পরের অধ্যায় পর্ব-০২

0
12

#নিঃসঙ্গতার_পরের_অধ্যায় (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

রিনির শ্বশুরবাড়ি থেকে শৈলী আজই চলে যেত সম্ভব হলে, কিন্তু রাত হয়ে যাবে বলে বাধ্য হয়ে থেকে গেল। সে একাই এসেছে। কাজিনদের বেশিরভাগের পরীক্ষা চলছে, আবার বড়রা কেউ বাড়িতেই নেই। বাবা বাসে তুলে দিয়েছেন।

রিনি বলেছিল কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকতে, সে-ও সম্মতি দিয়েছিল। রিনির সাথে বয়সের পার্থক্য থাকলেও বন্ধুর মতো সম্পর্ক শৈলীর। শাফিনের সাথে সম্পর্কে সে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় সেটা আরও পোক্ত হয়েছে।

এখানে এসে মিফতাকে দেখার পরে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামীকালই চলে যাবে। শৈলী যথাসম্ভব চেষ্টা করছে যেন ছেলেটার মুখোমুখি না হতে হয়। তবুও সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া মনটা খানিকটা অবাধ্য। মনে মনে ঠিকই চাইছিল, হুট করে মিফতা যেন ওর সামনে পড়ে যায়।

আচ্ছা, কেমন হবে, যদি মিফতা আঁড়চোখে ওর দিকে তাকায়! শৈলী কি লজ্জা পাবে! মনকে কষে ধমক দিয়ে নিজেকে এসব অদ্ভুত ভাবনা থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল। মনের লাগাম শক্ত করে টেনে ধরতে না পারলে সামনে ঘোরতর বিপদ। দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দিচ্ছে কেউ যেন!

বিকেলে রিনি বলল, “তুই ছাদে গিয়ে বোস। আমি বানিয়ে যাচ্ছি।”

“শাফিন ভাইয়া কখন আসবে?”

“ছয়টার দিকে।”

শৈলী ভীষণ ছটফটে, চটপটে ধরনের মেয়ে। সে দ্রুতপায়ে ছাদে চলে এলো। বুঝতে পারেনি এখানে মিফতা আছে৷ ওর পায়ের শব্দেই বোধহয় বেচারার ধ্যান ভেঙেছে। নেমে আসবে ভাবছিল, তখনই মিফতা ওর দিকে ঘুরল।

এখন ফিরে গেলে জিনিসটা খুব বাজে দেখায়। সেজন্য ঠোঁটে জোরপূর্বক একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,

“কী করছিলেন?” বুকে যেন ঢাকের শব্দ হচ্ছিল।

“কিছু না।” শুকনো, কাঠখোট্টা উত্তর মিফতার৷

“কিছু না কেউ কীভাবে করে? আমাকে শেখাবেন?” মিফতার উত্তর পছন্দ হয়নি বলে মৃদু ব্যঙ্গ ঝরল শৈলীর কথায়।

এবার আর উত্তর দিল না মিফতা, মুখে বিরক্তির ছায়া পড়ল স্পষ্ট। নিজেকে ভীষণ অযাচিত মানুষ বলে মনে হলো শৈলীর।

“আমি ছাদে আসায় আপনি বিরক্ত হয়েছেন বোধহয়। আপনি থাকুন, আমি নেমে যাচ্ছি।”

বলে নেমে যেতে উদ্যত হতেই মিফতা বলল, “তুমি এই বাড়ির অতিথি। তুমি থাকো, প্লিজ। আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে থাকলে স্যরি।”

শৈলী থাকার সিদ্ধান্ত নিল, তবে সেটা কেবলই পছন্দের মানুষের সান্নিধ্যের জন্য নয়, একজন বিষাদে ডুবে থাকা মানুষকে বিষাদী সমুদ্র থেকে টেনে পাড়ে তুলবার সাধ হলো ভীষণ।

“সত্যিই মন থেকে স্যরি বলছেন?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করবেন?”

“আমি গল্প জানি না।”

“আমি গল্প করব, আপনি শুনবেন, মাঝেমধ্যে যদি কোনো প্রশ্ন করি, তার উত্তর দেবেন। তাহলেই হবে।”

এটুকু বলে মিফতার অপ্রস্তুত অভিব্যক্তি দেখে সাথে যোগ করল,

“ভয় নেই৷ ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে অনধিকার চর্চা করব না।”

রিনির বিয়ের দিন মিফতার বলা কথার সামান্য প্রত্যুত্তর দিতে ভুলল না। অবশ্য বুঝল কি-না কে জানে! অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন এলো না কোনো। এই ছেলে তো দেখা যায় আস্ত একটা রান গড়ুড়ের ছানা। হাসতেই পারে না বোধহয়।

“ঠিক আছে।”

শৈলী খানিকটা এগিয়ে এসে কার্নিশে কনুই ঠেকিয়ে দাঁড়াল।

“আপনি কি ছোটবেলা থেকেই এমন?”

“কেমন?”

“অতিরিক্ত চুপচাপ।”

“আমি খুব সহজে মিশতে পারি না কারোর সাথে। তাই বন্ধুও খুব কম। তবে তারা আমাকে ভীষণ বোঝে।”

শৈলী মনে মনে বলল, “আমি আপনাকে বুঝতে চাই, মিফতা। আপনার সমস্তটা।”

কিন্তু মুখে বলল না। বরং হাতের আঙুল গুণে হিসেব করতে লাগল। কিছুটা বিস্মিত হলো মিফতা, জিজ্ঞেস করল,

“কী গুণছেন?”

“আপনি একসাথে মোট কয়টা শব্দ বললেন সেটা কাউন্ট করছিলাম। আপনি ভীষণ মেপে মেপে কথা বলেন তো। আপনার লিমিট ক্রস করে গেলে তো আর কথা বলবেন না। তখন আমাকে একাই বকবক করতে হবে। আচ্ছা, আপনার ডেইলি ওয়ার্ড লিমিট কত?”

মিফতা জানে শৈলী ওকে অপ্রস্তুত করতেই কথাটা বলেছে, তবে বলার ভঙ্গিতে ভীষণ সরলতা ছিল। তাই গায়ে লাগল না, উল্টো মিফতা মৃদু হাসল। মেকি কিংবা ট্রেডমার্ক বিষণ্ণ হাসি নয়, মন ভালো করা হাসি। কতদিন পরে এভাবে মন থেকে হাসল, ওর নিজেরই মনে নেই।

শৈলী চোরা দৃষ্টিতে মিফতার দিকে তাকাল, হাসিতে চোখ আটকে গেছে। ছেলেটার বিষণ্ণতার মতো এই চিলতে রোদের মতো ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠা মৃদু হাসিটাও কী যে সুন্দর! ম্লাণ চোখ দুটোতেও যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।

সরাসরি সেই হাসিতে চোখ রাখার সাহস হলো না শৈলীর, পাছে যদি ধরা পড়ে যায়! তবে হৃদয়ের ফ্রেমে ছবিটাকে বন্দী করে নিল। খুব গোপন প্রকোষ্ঠে ধরে রাখবে এই ছবিটা৷ ইচ্ছে হলেই বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবে সে।

“আপনি ভীষণ সুন্দর করে হাসেন। কেউ বলেনি আপনাকে?”

মিফতার হাসি মিলিয়ে গেল, আবারও বিষাদী খোলসে নিজেকে আবৃত করল। কেন যে কথাটা বলতে গেল! নইলে দুর্লভ অভিব্যক্তি আরও কিছুক্ষণ দেখতে পেত।

এরমধ্যে রিনিকে দেখা গেল দুটো ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ নিয়ে এসেছে।

“আরে মিফতা, তুমি ছাদে, আমি জানতাম না। বোসো ভাই। আমি আরেক কাপ আনছি।”

“না না, তোমরা গল্প করো। আমি যাচ্ছি।”

“আরে, চা মাত্রই বানিয়েছি। বেশি আছে। তুমি থাকো তো। এটা নাও।”

ট্রে থেকে দুটো কাপ দু’জনকে দিয়ে নেমে গেল রিনি। শৈলী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

“আহা! রিনি আপুর চা। দারুণ না?”

“হুম।”

“কী হুম হুম করছেন। শুধু কী চা! রিনি আপুর রান্নার হাত দারুণ। আপনার কাজিনের বউ ভাগ্য ঈর্ষণীয়।”

“হ্যাঁ। রিনি ভালো রাঁধে।”

“আপনি বিয়ে করবেন না?”

“সেভাবে ভাবিনি এখনো।”

“কেন ভাবেননি?”

“তুমি কিন্তু বলেছিলে অনধিকার চর্চা করবে না।”

“তাহলে আপনি একটু অধিকার চর্চা করুন প্লিজ। আমি বোরড হচ্ছি।”

“আমি মানুষটাই বোরিং, শৈলী। আজকের আড্ডার জন্য তুমি ভুল মানুষকে সিলেক্ট করেছ।”

এই মানুষটার থৈ পাওয়া দুঃসাধ্য। কখনো মনে হয় এই বুঝি কিছুটা কাছাকাছি আসা গেল, পরক্ষণেই মনে হয় এখানো ওদের অবস্থান আলোকবর্ষ দূরত্বে।

“আড্ডা জমাতে আমি একাই যথেষ্ট। শুধু শোনার জন্য একজন মানুষ থাকলেই হলো, যে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কিছু মানুষ থাকে না, ভাব নেয় সব শুনছে, অথচ হুট করে জিজ্ঞেস করলে বোঝা যায়, কিছুই শোনেনি। তেমন মানুষ দেখলে খুব রাগ হয়।”

অকপট কথা বলার সহজাত একটা গুন আছে শৈলীর মধ্যে। কাজিন কিংবা বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমনি সে-ই হয়ে উঠে। যেখানেই যাক, খুব সহজে মানিয়ে যায় সে।

আবারও রিনি চলে এলো। কিছু কথাবার্তার পরে রিনি বলল,

“মিফতা, শৈলী প্রথমবার এখানে এলো। কাল তো শুক্রবার। আমি আর শাফিন, শৈলীকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাব। তুমিও কিন্তু আমাদের সাথে থাকবে।”

“তোমরা যা-ও। আসলে আমার একটা কাজ আছে।”

শৈলী এমন কথায় হতাশ হলো ভীষণ, “আপু, আমি তো কালই চলে যাব।”

“কিছুতেই না। মা তো কাল তোর জন্য কত আয়োজন করছেন। উনি আপ্যায়ন করতে ভালোবাসেন। তাছাড়া, তুই এক সপ্তাহের আগে নড়তে পারবি না, ব্যস।”

“রিনি আপু, আমি…”

“কোনো কথাই শুনছি না। তোমরা দুইজনই কাল আমাদের সাথে যাচ্ছ। কথা শেষ।”

দু’জনের কারোর আপত্তি গৃহীত হলো না।

***
বের হবার আগে এখানে আনা সবচাইতে সুন্দর পোশাকটা পরল শৈলী। যদিও রিনি আপু আর শাফিন ভাইয়া থাকছেন৷ তবুও এটাই তো মিফতার সাথে ওর প্রথমবার ঘুরতে যাওয়া।

ঘুরতে যাবার দিন সব ঠিকই ছিল, ফিরে আসার পরে যে এমন কিছু হবে সেটা শৈলীর ভাবনার সীমার বাইরে ছিল। পূর্ব প্রস্তুতিও ছিল না। সব ঠিকঠাকই চলছিল, এরপর অকস্মাৎ…

মনের কথা কেন যে মনে চেপে রাখতে পারে না!
………
(ক্রমশ)