#নিঃসঙ্গতার_পরের_অধ্যায় (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা
দুপুরে খাবার পরপর চারজন বেরিয়ে পড়ল। এখানে শৈলী আগে কোনোদিন আসেনি। জায়গাটা ওর জন্য নতুন। কোথাও গেলে সবার আগে ওই নির্দিষ্ট জায়গার মানুষের কথাবার্তা, আচার অনুষ্ঠান, এসবই ওর মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করে। দর্শনীয় স্থানের পেছনের গল্পও। সেসবে শাফিনের সাথে মিফতাও যোগ দিল। বোঝা গেল ইতিহাস বিষয়ে বেশ আগ্রহী। সেসব শুনতে শৈলীর বেশ ভালো লাগছিল।
হঠাৎ শাফিনের কল এলো, কথা শেষ হতেই রিনি জিজ্ঞেস করল,
“কোনো সমস্যা?”
“আমার কলিগ রেদোয়ান, আজ বিবাহবার্ষিকীর দাওয়াত দিল। সস্ত্রীক।”
“তো, সেটা আগে বলেনি কেন? শেষ মুহূর্তে?”
এবার শাফিন হেসে ফেলল, “আর বোলো না। বেচারা দিনটা ভুলে গিয়েছিল। ওদিকে ভাবি ভেবেছিল তাকে কোনো সারপ্রাইজ দেবে। পরে আকারে ইঙ্গিতে জানতে পারে যে ভুলে বসে আছে। সেই থেকে নাকি রেগে আছে। প্রথম বিবাহবার্ষিকী তো। বউয়ের রাগ ভাঙাতে সত্যি সত্যি এবার একটা সারপ্রাইজ পার্টি দিচ্ছে সে।”
“বেচারা। বিয়ে করেছে, অথচ তারিখ নাকি মনে নেই। তোমরা এমনই সব। ঠিকই আছে, রাগ করা যৌক্তিক।”
“ও ভুলে গেছে, এরজন্য সবাই একরকম নাকি!”
“দেখব তুমি কেমন মনে রাখতে পারো।”
শৈলী এবার হেসে ফেলল, এরপর জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কখন যাবে?”
“বলল তো, এরেঞ্জমেন্টেও নাকি হেল্প করতে হবে। কিছুক্ষণ ভাবি বাইরে থাকবে। এরমধ্যে অনেকটা গুছিয়ে ফেলতে চাইছে। যত দ্রুত সম্ভব যেতে বলল।”
রিনি বলল, “কিন্তু.. আচ্ছা, তুমি যাও তাহলে, শৈলীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি। ওকে ফেলে এভাবে…”
“রিনি আপু, কী যে বলো না তুমি। তুমি আর ভাইয়া যাও তো। আমি উনার সাথে চলে যাব।”
মিফতাকে ইঙ্গিতে করে বলল শৈলী।
“কিন্তু…
“আপু, এটা ওদের জন্য কত্ত স্পেশাল। এমন সুন্দর আয়োজনে সাক্ষী থাকার জন্যও তোমাদের যাওয়া উচিত। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না তো। আমি ছোট বাচ্চা নই আর৷ তাছাড়া আমার জন্য তুমি না গেলে আমারই খারাপ লাগবে।”
“মিফতা, শৈলীকে সাবধানে বাসায় নিয়ে যাস। পারবি?”
“হ্যাঁ, পারব। তুই চিন্তা করিস না শাফিন।”
রিনি তবুও কিন্তু কিন্তু করছিল, শৈলী রাজি করিয়ে পাঠিয়ে দিল।
রিনি রিকশায় যেতে যেতে শাফিনকে জিজ্ঞেস করল, “শৈলী বেড়াতে এলো। ওকে ফেলে দাওয়াতে যাচ্ছি। বিষয়টা কেমন হয়ে গেল না? তাছাড়া ও এখানে নতুন।”
শাফিন অভয় দিয়ে বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না। শৈলী বুদ্ধিমতী মেয়ে। এসব নিয়ে মন খারাপ করবে না। তাছাড়া মিফতা হয়তো কথা কম বলে, কিন্তু ও রেসপনসেবলিটি নিতে জানে। আমরা জীবনে অনেক ফাঁকিবাজি করেছি, কিন্তু ও সেটা করেনি। কোনো দায়িত্ব নিলে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়ে না সেটা পালন করতে।”
***
মিফতা আর শৈলী ফুটপাত ধরে হাঁটছে। শৈলী অনেক আলাপ করছে, যার বেশিরভাগই হয়তো অপ্রাসঙ্গিক। মিফতা প্রায় নির্বাক শ্রোতা। পাশেই স্থানীয় পার্ক৷ তার প্রবেশপথে ঝালমুড়ি দেখে শৈলী বলল,
“চলুন, ঝালমুড়ি খাই।”
“ঝালমুড়ি খাবে?”
“হ্যাঁ। এমনভাবে বললেন, যেন আপনি খান না!”
মিফতা মনে করার চেষ্টা করল শেষ কবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি ফুচকা খেয়েছে। একসময় স্কুলের বাইরে ভীড় ঠেলে ঝালমুড়ি কিনত।
“ওকে, না খেলেও আজ খাবেন। আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য ট্রিট এটা।”
“উপলক্ষ্য?”
“অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে সহ্য করার জন্য।”
“ঝালমুড়ি ট্রিট কখনো দেখিনি।”
“আমি দিই। এখন তো আমার একমাত্র আর্নিং সোর্স বলতে বাপের হোটেল। যখন ইনকাম করব, তখন ট্রিটও বড় হবে। আরও বেশি ইনকাম থাকলে পার্টিও দেব।”
এত উচ্ছ্বসিত গলায় কথাটা বলল শৈলী, মিফতার মনে হলো, মেয়েটা বুঝি এখনই বিশাল বড় একটা পার্টি দিয়েছে। ওর সব কাছের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজনে ওর চারপাশ গিজগিজ করছে।
“তুমি হৈ হুল্লোড় খুব ভালোবাসো, তাই না?”
এই প্রথম মিফতা নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করল শৈলীকে।
“হ্যাঁ। কয়দিন বাঁচব বলুন তো! এই যে হাঁটছি, হাঁটতে গিয়েও হুট করে মরে যেতে পারি। তাই না? জীবন নিয়ে ভেবে ভেবে ডিপ্রেসড হলেও মরতে হবে, আনন্দে থাকলেও একই পরিণতি৷ তাহলে যে কয়দিন বাঁচব, শুধু শুধু গুমরে গুমরে কেন বাঁচব? আমি সবাইকে নিয়ে আনন্দে বাঁচতে চাই। যে কয়দিন বাঁচি, মন থেকে ষোলোই থাকতে চাই। আপনার মতো অল্প বয়সে বুড়িয়ে যেতে চাই না।”
“সবার পরিস্থিতি একরকম হয় না।”
“সেটা হয় না৷ কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয়। অবশ্যম্ভাবী কিছু তো আপনি এড়াতে পারবেন না। আল্লাহ যা ঠিক করে রেখেছেন, তাই হবে। তিনি মানুষকে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিও দিয়েছেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করব আর সবাইকে নিয়ে ভালো থাকব, আনন্দে থাকব।”
বলতে বলতে থেমে হুট করে জিজ্ঞেস করল, “আপনার বয়স কত?”
“কেন?”
“বলতে আপত্তি আছে? নায়িকাদের মতো?”
“ছাব্বিশ।”
“দুঃখ-কষ্ট তো সবারই আছে। কিন্তু সেসব আঁকড়ে ধরে রাখার তো দরকার নেই। হৃদয়ে দুঃখ জমিয়ে ভরাট করে তারপর তার দরজা বন্ধ করে দিলে সুখ কোথা দিয়ে ঢুকবে? হৃদয়ের দরজা সবসময় খোলা রাখতে হয়। তাতে করে কী হয় জানেন? দুঃখ-বিষাদ ঘাঁটি গাড়তে পারে না। আনন্দ যখন আলতো পায়ে সেখানে প্রবেশ করতে থাকে, জমে থাকা বিষাদও তখন জায়গা একটু একটু করে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।”
বয়স জিজ্ঞেস করার সাথে এই কথার কোনো তাল-মিল না থাকলেও শুনতে কেন যেন ভালো লাগছে মিফতার। ওর হৃদয়েও তো বিষাদ ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, স্থায়ী বিষাদ। ওদিকে শৈলী বলে চলছে, এবার সে ঠিক মিফতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেজন্য আমার হৃদয়ের দরজা সবসময় খোলা, আপনিও খুলে দেখুন। বাইরে থেকে হয়তো এক টুকরো সুখ কড়া নাড়ছে আপনার মনের দরজায়। মন দিয়ে সেই শব্দ উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন, হে ছাব্বিশ বছরের বিষণ্ণ যুবক।”
শেষ বাক্যটা বলল নাটকীয় ভঙ্গিতে, এরপর হেসে ফেলল সশব্দে। প্রাণবন্ত উচ্ছল হাসি। মিফতার মুখেও হাসি ফুটল ওর অবচেতনেই।
ঝালমুড়ির ঠোঙা হাতে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। বহুদিন পরে ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ঝালমুড়ি খাওয়া, নস্টালজিক করে দিচ্ছে ওকে।
পাশের মেয়েটাকে যেদিন প্রথম দেখেছিল, তখন শাড়ি পরা ছিল, খুব ভালো করে খেয়াল করা হয়নি। তবে মনে আছে, বয়স যে এত অল্প সেটা বোঝা যায়নি। এখন সালোয়ার-কামিজে অন্যরকম মনে হচ্ছে। রিনি প্রায়ই শৈলীর গল্প বলে, তখনই আলাপে আলাপে জেনেছে। এখব বলে ফেলল কথাটা৷
“প্রথমদিন যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম, সেদিন তোমার বয়স এত অল্প বোঝা যায়নি।”
শৈলী খুব স্বাভাবিক সহজভাবেই বলল, “সেদিন তো শাড়ি পরেছিলাম৷ শাড়ি পরলে একটু বড় বড় লাগে। আবার আমি কিন্তু এতও অল্পবয়স্ক নই। বিশ হতে বেশি বাকি নেই।”
“হুম।”
“আচ্ছা, আমাকে সেদিন শাড়িতে বেশি সুন্দর লেগেছে নাকি আজকে?”
মিফতা আবারও অপ্রতিভ হচ্ছে দেখে শৈলী উপলব্ধি করল, প্রশ্নটা একটু কঠিনই হয়ে গেছে। তাই ব্যখ্যা দেবার প্রয়োজন বোধ করল। অবশ্য তাতে কিছু এখনকার পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক কথাও উঠে এলো,
“এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। এত গুটিয়ে যাবার মতো কিছু নয়। কমপ্লিমেন্ট দিতেই পারেন কেউ জানতে চাইলে। ভালোকে ভালো বলতে দোষ কী! দেখেন না, চারদিকে নেগেটিভিটির চর্চা এত বেড়ে গেছে। কেন বলুন তো! আমরা খারাপ জিনিস নিয়ে চর্চা করতে পছন্দ করি। কিছু পছন্দ হলো না, সেটা নিয়ে এর-ওর কমেন্টবক্সে গালাগালি করছি নয়তো পোস্ট করছি। এতে যারা নেগেটিভিটিকে পুঁজি করে ভাইরাল হতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছি। কিন্তু কোনোকিছু পছন্দ হলে বা কেউ ভালো কোনো কাজ করলে কয়জন সেটা নিয়ে চর্চা করি? এতে কী হয়? অনেকের কাছে মনে হয় আমাদের চারপাশে সমস্ত কিছু ট ক্সি ক। অথচ দেখুন, মন খুলে ভালো কিছুর প্রশংসা করতে শুরু করলে, সেসব নিয়ে বেশি বেশি চর্চা করলে, আরও কিছু স্বপ্নবাজ মানুষ তৈরি হতো। বাকিরা উৎসাহ পেত। আর নেগেটিভিটি ছাড়ানো লোকগুলো পাত্তা না পেয়ে পথে ফিরত নয়ত হারিয়ে যেত। মন খুলে প্রশংসা করতে পারাও একটা গুণ। সবাই সেটা পারে না।”
কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হলেও খুবই যৌক্তিক মনে হলো মিফতার কাছে। চপলমতি হলেও হালকা ভাবনার মেয়ে যে শৈলী নয়, সেটা বেশ বোঝা যায়। জীবন নিয়ে, সমাজ নিয়ে ভাবে মেয়েটা। নিজস্ব জীবনবোধও আছে। খুব সহজে সাবলীলভাবে আর অকপটে সেটা দ্বিধা ছাড়াই প্রকাশও করতে পারে। প্রকাশভঙ্গিও ভীষণ সহজ। হাসতে-খেলত গভীর কথা বলে ফেলে।
আগের কথাগুলো মনে পড়ল ওর। কী সহজভাবেই না বলল, মৃত্যুর কথা। আনন্দে বাঁচার স্বপ্ন দেখানো। এমন না যে কথাগুলো মিফতা জানে না বা ওকে কেউ বলেনি! অসংখ্যবার অনেকেই বলেছে। সে-ও উপলব্ধি করে। তবে মন থেকে বিশ্বাস করে সত্যিকার আনন্দ নিয়ে বাঁচা একজন মানুষ যখন কথাগুলো বলে, তখন অন্যরকম মনে হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে শৈলী হঠাৎ করে বলল, “আমার সাথে কাল আরেকবার বের হবেন?”
“আমি?”
“আপনার এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছে আপনার সামনে আমি নই, একজন শাকচুন্নি বসে আছে। যে এখনই ক্যাঁচ করে আপনার ঘাড় মটকে দেবে।”
“আমি এসব ভাবিনি।”
“ভয় নেই, আসলে বাবা কিছু টাকা পাঠিয়েছিল৷ সবার জন্য কিছু কিনতে। আমি ওদের না জানিয়ে উপহারগুলো কিনতে চাই। সময় হবে আপনার?”
সত্যি কথাই বলল শৈলী। তবে মিফতাকে আরেকটু জানবার লোভও হচ্ছে। তাছাড়া আগের চাইতে একটুখানি সহজ মনে হচ্ছে তাকে। জীবন নিয়ে আনন্দ নিয়ে আরও কিছু স্বপ্ন যদি লোকটার মস্তিষ্কে ঢুকানো যায়!
“ওকে। কখন?”
“বিকেলে?”
“ঠিক আছে।”
“থ্যাংক ইউ।”
“কেন?”
“এই যে আমাকে সহ্য করলেন।”
“সেটার জন্য তো ঝালমুড়ি ট্রিট দিলেন।”
“ধন্যবাদ দিলাম, আবারও সহ্য করতে রাজি হবার জন্য।” বলে আবারও হাসল শৈলী।
মিফতা দ্রুতপায়ে এগুচ্ছে, হাসিটা এখনো কানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। এমন করে সে হাসতে পারে না কেন! কিঞ্চিৎ আফসোস হলো মিফতার।
***
রাতে দশটার দিকে বাসায় ফিরল রিনিরা৷ শৈলী পানি খেতে এসে দেখল ড্রইংরুমে তার বসে আছে। সাথে শাফিনের মা। তিনি বলছেন,
“দেখ, মুনিরা চলে গেল। মিফতার দায়িত্ব এখন আমার। ওর বিয়ের ব্যবস্থা কর। এইভাবে কষ্ট পাচ্ছে, আমার চোখের সামনে। আমার সহ্য হচ্ছে না।”
“ও এসব কথা কানে তোলে না মা। আগেও বলেছি কয়েকবার।”
“তাও বল আবার। দরকার হয় আমি বলি। কিন্তু এভাবে তো হয় না।”
চুপিসারে শৈলী আবার ভেতরে চলে গেল। সিদ্ধান্ত নিল, কাল যখন বাইরে যাবে, তখনই এই বিষয়ে মিফতার সাথে কথা বলবে সে।
সে ভেতরে গুমরে গুমরে কষ্ট পেতে পারবে না। অন্তত মানুষটাকে তো জানাতে হবে! নিজের অনুভূতির কথা। ‘বুক ফাঁটে তো মুখ ফোটে না’ এই ক্যাটাগরিতে ওর বিশ্বাস নেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল শৈলী।
আচ্ছা, উত্তরে কী বলবে মিফতা! ওকে গ্রহণ করবে নাকি ফিরিয়ে দেবে! কেন যেন ভেতরে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। এতটা নার্ভাস আগে কোনোদিন লাগেনি।
…………….
(ক্রমশ)