#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
১৮
ভিষণ অস্তিত্বে মায়া। রিদ হঠাৎ করে সামনে চলে আসাতে অনেকটা হতভম্ব। মায়া ঘুনাক্ষরেও ধারণাতে ছিল না রিদ আজ দেশে ফিরবে দেশে সেটা নিয়ে। মায়া যদি জানতো রিদ আজ হঠাৎ করেই দেশে চলে আসবে তাহলে ইহজন্মেও মায়া মুক্তা শশুর বাড়িতে আসত না। ফ্যাসাদে পরে মায়া স্তব্ধ নেয় হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইল জায়গায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিকে সেদিক ঘুরাতেই রিদের কপালের ভাজ শিথিল হলো হঠাৎ। নিজ বাড়িতে মায়ার উপস্থিতিটা রিদের ধারণাতেও ছিল না। অনাকাঙ্ক্ষিত মায়ার উপস্থিতিতে রিদ নিজেও খানিকটা চমকিত হলেও গম্ভীর মুখ অতলে তা প্রকাশ করলো। বরং মায়াকে কয়েক পলক দেখে খুব স্বাভাবিক নেয় এগিয়ে গেল সিঁড়ি দিকে। গম্ভীর মুখোর রিদ ধুপধাপ পা ফেলে চলল নিজে ঘরে। তখনই রিদকে দেখে জুইয়ের পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ফাহাদের বোন সেজুতি। তাড়াহুড়ো রিদকে পিছন ডেকে বলল…
‘ আরে রিদ ভাই! তুমি কখন এসেছ দেশে? তুমি কি আজকে এই বাড়িতেই থাকবে আমাদের সাথে?
সেঁজতি কথায় রিদ পিছন ঘুরলো না আর না উত্তর করলো কোনো কিছু। যেমন হাঁটছিল ঠিক তেমনই হাঁটা গতি বহাল রাখতেই ফের রিদের কানে আসল সেঁজুতি উৎফুল্লতা ডাক। সে তাড়াহুড়োয় হেনা খান ডাকছে রিদের ফিরে আসার খবর দিয়ে। রিদকে নিঃশব্দে চলে যেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মায়া। এতক্ষণ জানটা গলায় আটকে ছিল যেন। মায়া স্বস্তির হলেও সেঁজুতি কথায় রিদকে উত্তর করতে না দেখে ফের মুখ বেঁকে আসল মায়ার। লোকটা আসলেই বজ্জাত! দেমাগি আর অহংকারী টাইপ। কতো সুন্দর করে সেঁজুতি ডাকলো অথচ লোকটা ঘুরেও তাকাল না? এমনিতে মায়াকে অপমান করতে সবসময় মুখ চালিয়ে এগিয়ে আসে অথচ আজকে চুপ। মায়াকে নিজের বাড়িতে দেখে প্রতিক্রিয়াও করলো না? এতো ভালো মানুষ তো এই রিদ খান নয়। নিশ্চয়ই মায়াকে অপমান করতে খিচুরি পাকাচ্ছে মনে মনে। সুযোগ পেলেই যে খোঁটা মারবে নিজের বাড়িতে আসা নিয়ে সেটাও মায়া বেশ বুঝতে পারছে। মায়াকে এবার সাবধানে থাকতে হবে। ভুলেও এই লোকের সামনে পরা যাবে না। নয়তো মায়াকে অপমান করতে কতক্ষন লাগবে এই বজ্জাত লোকের? দেখা গেল বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে মায়াকে ‘আউট ‘ বলে অপমান করে বসল। তখন মায়া এতো রাতে কোথায় আউট হয়ে যাবে এই বাড়ি থেকে? জায়গায় আছে কোথাও যাওয়ার? এতো রাতে একা একা মায়ার তো আশুগঞ্জ যাওয়া সম্ভব নয়। তবে যেটা সম্ভব সেটা হলো আপাতত এই লোকের চোখের সামনে না পরা। মায়া বিগত দুইদিন লুকিয়ে চুকিয়েই বেড়াতে হবে এই বাড়িতে রিদ খানের সামনে পরতে না চেয়ে। একবার নিজের বাড়ি অবধি পৌছাতে পারলে ভুলেও বোনের শশুর বাড়িতে পা রাখবে না আর মায়া। ভাবুন মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিদের চলে যাওয়ার দিকে। চলন্ত রিদ চলে যেতে যেতে কি মনে করে সেও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মায়ার দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। অনাকাঙ্ক্ষিত চোখ মিলনের আতংকে উঠল মায়া। আতঙ্কের নেয় ধড়ফড়িয়ে সামনে ঘুরে যেতেই রিদও ঘাড় ঘুরাল সামনে। রিদের মুখ ভঙ্গিমা তখনো গম্ভীর। বুঝার রা নেই তার মনে আসলে কি চলছে মায়ার উপস্থিতে। সেঁজুতি ডাকে প্রায় সাথে সাথে হেনা খানকেও রান্না ঘর থেকে বেরুতে দেখলো মায়া। রিদের চলে যাওয়ার দিকে উৎফুল্লর মুখ করে তিনিও সেদিকে ছুটলো রিদের পিছন পিছন। হেনা খান খান বেশ সচ্ছ আর নরম মনে মানুষ। এই বয়সে এসেও নিজের পরিবারের তদারকি তিনি নিজের হাতেই করছেন সবটা। ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনীদের বিয়ে মেহমানদারি সবকিছু উনার হাতে। অথচ এতোবড় বাড়িতে মায়া রিদের বাবা-মাকে কোথাও দেখলো না। আর না কেউ তাদের কথা কিছু বলছে। মায়া রিদের বাবাকে বেশ কয়েকবার দেখেছিল চট্টগ্রামে কিন্তু রিদের মাকে আজ পযন্ত দেখেনি। মায়া বুঝতেও পারছে না আসলে রিদের মা জীবিত আছেন নাকি মৃত? যদি জীবিত থাকে তাহলে কোথায়?? উনি উপস্থিত নেই কেন পারিবারিক অনুষ্ঠানে? তাছাড়া রিদের বাবাও বা কেন আসলো না নিজের পারিবারিক বিয়েতে? ভাবুক মায়া ভাবনার মাঝেই হেনা খানকে দেখলো রিদের রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে তাও প্রায় বিশ মিনিট পর। হেনা খানের উজ্জ্বল চেহেরায় হাসিটা যেন চোখে পরার মতোন। হয়তো রিদের উপস্থিতিতে এতোটা খুশি তিনি তার প্রমাণ উনার হাস্যজ্বল মুখে। মায়া বুঝতে পারে না এমন গুমরো মুখের রিদ খানের উপস্থিতিতে কেউ এতোটা খুশিও হতে পারে। নয়তো রিদের মতোন মানুষকে তো সোজা ভাষায় কারও সাথে কথা বলতেও দেখা যায় না। মায়ার ভাবনার মাঝে ফের সেঁজুতি ডাকলো পরলো কিচেনে। হেনা খান ডেকেছে। সেঁজুতি হাতে ফোনটা নিয়েই দৌড়াল সেদিকে। মায়া সেঁজুতি চলে যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল জুইয়ের দিকে। সেই কখন থেকে জুই ফোনে মন্ত। মিটমিট হাসছে আর চ্যাট করছে। মায়া যে কিছু জিগ্যেসা করবে সেই সুযোগটাই পাচ্ছিল এতক্ষণ যাবত সেঁজুতির উপস্থিতিতে। সেজুতি চলে যাওয়ায় এবার সুযোগ বুঝেই মায়া উঠে দাঁড়াল। জুইয়ের বরাবর দাঁড়িয়ে কিছু বলবে তখনই সেঁজুতিকে দেখলো কিচেন থেকে কফির মগ হাতে নিয়ে বেরুতে তাড়াহুড়োয়। সেঁজুতিকে দেখেই মায়া চুপ করে গেল। মুখে আসা কথা গুলো ঢুক গিলে নিয়ে জুইয়ের দিকে তাকাল। দেখলো বেখেয়ালি জুই তখনো মিটমিট হেঁসে চ্যাট করছে ফোনে। মায়া যে সেই কখন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই খেয়াল পযন্ত নেই। রাগান্বিত মায়া জুইকে মুখে কিছু বলতে না পারলেও সেঁজুতির অগোচরে ধুপ কিল বসাল জুইয়ের বাহুতে। মায়ার হঠাৎ কিলে জুই খৈই হারিয়ে হাত ফসকে ফোন পরলো ফ্লোরে। চমকিত জুই নিজের ফোনটা ধরতে চেয়ে তাকাল মায়ার দিকে। রাগান্বিত মায়া তখনো রাগে কটমট করে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে। জুই ঝুঁকে ফোনটা ফ্লোর থেকে উঠিয়ে বিরক্তি গলায় ঝাড়লো মায়ার উপর। বলল…
‘ কি সমস্যা তোর? মারলি কেন হ্যাঁ? ভালো লাগে না? পছন্দের বিয়াইর বাড়িতে আছিস, কই আনন্দ প্রকাশ করবি, তা না করে মারামারি করছিস বোনের সাথে। গায়ে বেশি জোর থাকলে গিয়ে রিদ বিয়াইকে দেখা যাহ! ব্যাটা তোর জন্য বিদেশ থেকে চলে এসেছে। কতো দরদ দেখেছিস? নিশ্চিত তোর জন্য চানাচুর আর আমার জন্য রসমালাই এনেছে। যাহ সেগুলো গিয়ে নিয়ে আয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে। যাহ সর!
রাগান্বিত মায়া আরও চেতে উঠল জুইয়ের খোঁচা মারা কথায়। এমনই জুইয়ের জন্য মায়াকে এই বাড়িতে আসতে হয়েছে এখন আবার জুই-ই মায়াকে খোঁচা মারছে রিদ খানকে জড়িয়ে। রাগান্বিত মায়া জুইকে কিছু বলবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো সেঁজুতি। দুজনের উদ্দেশ্য বলল…
‘ তোমরা কেউ উপরে যেতে চাও আমার সাথে? যেতে চাইলে আসো!!
‘ যাব আপু!
মায়া তৎক্ষনাৎ উত্তর করলো সম্মতি দিয়ে। পরক্ষণেই জুই জানালো সে যাবে না, বলে আবারও ফোনে মন্ত হলো। মায়া হাতে ফোন না থাকায় ঘুরাঘুরি জন্য সেঁজুতি সঙ্গ নিতে চাইল। বিগত কয়েক ঘন্টা ধরে
একজায়গায় বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি লাগছিল মায়া। সেজন্য সেজুতির পিছন পিছন যেতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে উপরে। কয়েক সিঁড়ি যেতেই আচানক ফোন বেজে উঠল সেঁজুতি। কল রিসিভ করে ফোনটা কানে তুলে কথা মগ্ন হয়ে হাঁটতে লাগলে মায়া সহানুভূতি দেখাতে চাইল সেঁজুতি উপর। যেহেতু সেঁজুতি ফোনে কথায় ব্যস্ত সেজন্য কফির মগটা নিজের হাতে নিতে চাইল মায়া। হলো তাই। মায়া হাত বাড়িয়ে সেঁজুতি থেকে কফির মগটা নিতে চাইলে সেঁজুতি প্রথমে দিতে না চাইলেও পরে দিতে বাধ্য হয়, কফির মগ হাতে নিয়ে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছিল বিদায়। মায়াকে ছোট করে ধন্যবাদ জানালো সেঁজুতি। উত্তরে ভদ্রতা দেখিয়ে হাসলো মায়া। কফির মগ হাতে মায়াও সেঁজুতি পিছন পিছন এসে থামল এক বন্ধ দরজার সম্মুখে। কিন্তু তখনো সেজুতির ফোন আলাপ শেষ না হওয়ায় সে কান থেকে অল্প ফোন উঠিয়ে বিনয়ের সহিত মায়াকে বলল…
‘ একটু কষ্ট করে কফির মগটা ভাইয়াকে দিয়ে আসতে পারবে তুমি? আসলে আমার কলটা খুবই আর্জেন্ট। ভাইয়া রুমেই আছেন হয়তো। তুমি কফির মগটা দিয়ে চলে আসবে। পারবে?
সরল মায়া ভদ্রতা দেখিয়ে তৎক্ষনাৎ মাথা কাত করে সম্মতি দিল সেঁজুতি কথায়…
‘ আচ্ছা আপু।
মায়া সুন্দর সাবলীল সম্মতি দিয়েই চাপানো দরজাটায় নক করল। ভিতর থেকে কোনো উত্তর না আসায় মায়া আবারও নক করলো। পরপর কয়েকবার নক করতেই সাইডে দাড়িয়ে থাকা সেঁজুতি অল্প কান থেকে ফোন উঠিয়ে মায়াকে বলল…
‘ ভাইয়া মনে হয় ওয়াশরুম আছে মায়া। তুমি কফির মগটা রুমে রেখে চলে আসো!
মায়া তাই করলো। দ্বিতীয়বার আর নক না করেই চাপানোর দরজার আস্তে করে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো। খুব পরিচয় একটা ঘ্রান নাকে ভাজলো তখনই। আবছায়া আলোয় মায়া রুমটাকে দেখলো। বেশ সুন্দর আর বড়। ভিতরকার পরিপাটি গুছালো আয়োজন দেখে মায়া বুঝলো এই রুমের মালিক বেশ রুচিশীল। মায়া ভাবলো রুমটা হয়তো ফাহাদের হবে। যেহেতু সেঁজুতির মুখে মায়া ভাইয়া শব্দটাই শুনেছে বেশ কয়েক বার সেহেতু এই রুমের মালিক ফাহাদেরই হওয়ার কথা। কারণ সেঁজুতি ভাই তো ফাহাদ তাই না। সেই হিসাবে এই রুমটাও মুক্তার ভবিষ্যত রুম। মায়া গোল গোল চোখে রুমেটা দেখতে দেখতে একটু সামনে এগোল। কোমর বেঁকে টি-টেবিলে উপর কফির মগটা রাখতে গিয়ে চোখ গেল আবছায়া আলোয় সামনের বিছানার উপর। মূহুর্তে আকাশ ভেঙে পরার নেয় চমকে উঠে পুনরায় কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল হতবুদ্ধি রুপে। হতবাক মায়া থমকে জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল বিছানায় রিদকে বসে থাকতে দেখে। রুমের লাইট অফ থাকায় মায়া প্রথমে রিদের উপস্থিতি ঠাহর করতে না পারলে রিদ মায়াকে রুমে প্রবেশ করতে দেখেছিল। তখন থেকেই রিদ শান্ত দৃষ্টিতে মায়া দিকে চেয়ে। মায়ার হাবভাব সবকিছুই খেয়াল করছিল সে। মূলত রিদ বাহির থেকে রুমে এসেছে ত্রিশ মিনিটেরও উপরে তারপরও ফ্রেশ হতে পারেনি প্রথমে হেনা খানের জন্য পরে তার ফোন কলের জন্য। হেনা খানের কাছে সেই কফি চেয়েছিল তখন। হেনা খান চলে যেতেই ভেবেছিল ফ্রেশ হবে কিন্তু জুরুরি ফোন কল আসায় কথা বলতে বলতে বিছানা পাশে এসে বসেছিল সেজন্য তখন মায়ার দরজা নক করাটা হেয়াল করেনি রিদ। কিন্তু মায়াকে তার রুমে প্রবেশ করতে দেখেই ফোন কানে থাকা অবস্থায় খানিকটা কপাল কুঁচকে আসল রিদের। নিঃশব্দে মায়াকে লক্ষ করে কল কেটে ফোনটা রাখল বেড সাইডের টেবিলের উপর। তারপর আস্তে ধীরে হাতে ঘুড়িটা খুলেও সেখানে রাখার সময় মায়া দৃষ্টিতে পরলো রিদকে। এতে রিদ বিন্দুমাত্র আবাক হলো না মায়া উপস্থিতিতে। আর না চমকালো। বরং স্বাভাবিক নেয় মায়ার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোমর বেঁকে সুইচ বোর্ডের সুইচ চেপে রুমের আলো জ্বালিয়ে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল থমথমে খেয়ে থাকা মায়া দিকে। কোমরে গুঁজে রাখা শার্টটা টেনে প্যান্টের উপর ফেলতে ফেলতে শান্ত দৃষ্টি ঘুরাল মায়া পা থেকে মাথা অবধি। দু’হাতে পকেটে গুঁজাতে গুজাতে মায়া উদ্দেশ্য তীক্ষ্ণ গলায় বলল…
‘ কি চাই?
থমথমে মায়া ধ্যান ভাঙ্গল রিদের গম্ভীর কথায়। জড়তায় আষ্টশ হয়ে মিইয়ে গেল তখনই। মায়া ফাহাদের রুম মনে করে ভুল ক্রমে রিদের রুমে ঢুকে পরেছে। এমনি এই লোকের সাথে মায়ার সখ্যতার সম্পর্ক নেই। তার উপর আবারও ভুল করে এই লোকের রুমেই এসেছে মায়া। আগের বার মায়ার রিদের দাদা বাড়িতে যাওয়াটায় পছন্দ করেনি রিদ সেজন্য অপমান করে করেছিল ছায়াকে ‘আউট’ বলে। এবার নিশ্চয়ই আরও বেশি অপমানজনক কথা শুনাবে মায়াকে নিজের রুমে দেখে? দুঃখী মায়ার দুঃখে কেদেকুটে বুক ভাসাতে ইচ্ছা করলো। ঘুরে ফিরে কেন রিদের মুখোমুখি হয় মায়াকে সেটাই বুঝে না সে। দুঃখী মায়া দুঃখ কষ্টে নিজের ভাগ্যে দোষী বানাল। আজকাল মায়ার ভাগ্যে রিদ দোষ পরে গেছে। সেজন্য মায়া প্রতিবার ঘুরেফিরে শুধু রিদ খানের চক্রেই ফেসে যায় এজন্য? দুঃখে কষ্টে জর্জরিত মায়া ছোট গলায় মিইয়ে গিয়ে বলল রিদকে…
‘ কিছু চায় না।
রিদের তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে চাইল…
‘ তাহলে…
রিদের কথার মাঝে ফোড়ন কাটলো মায়া। রিদকে শেষ করতে না দিয়ে বেশ সাহসী গলায় রিদকে শাসিয়ে বলল…
‘ তাহলে কি হ্যাঁ? কি করবেন আপনি হুম? আমাকে ভয় দেখান? আমি আপনাকে ভয় পায় মনে করছেন? ভুলেও না। আপনি হবেন কোথাকার নেতা-সেতা। আমি আপনাকে মোটেও ভয় পায়না বুঝেছেন। উল্টো আপনি আমাকে ভয় পাবেন যদি আমার আসল পরিচয় জানন তো। আপনি জানেন আমি কে? চিনেন আমাকে? আমি হলাম জাতির ভাবি। আমার পিছনে কার হাতে আছে জানেন? এই জাতির ভাইয়ের লম্বা হাত আছে আমার পিছনে। তাই আমার সাথে বেশি তেরিং বিরিং করলে সোজা সেই হাত দিয়েই টুস করে আপনাকে গায়েব করে দিব হুহ। শুধু ফাহাদ জিজুর ভাই বলে ছেড়ে দিলাম আপনাকে, নয়তো আমি কিন্তু অনেক ক্ষমতাসীন ভাবি হয় মনে রাখবেন। নিন আপনার কফি নিন।
মায়া লম্বা চওড়া হুমকিতে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল রিদ। মায়া রিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তক্ষুনি হাতের কফির মগটা পুনরায় টি-টেবিলে উপর রেখে এক প্রকার দৌড়ে পালাল রুম থেকে। মায়া চলে যেতেই রিদ এগিয়ে এসে কফির মগটা হাতে নিল। সেটাতে চুমুক দিতে দিতে মৃদুস্বরে আওড়াল…
‘ জাতির ভাবি! ইন্টারেস্টিং!
~
খান বাড়ির মেহমানদারিতে অতিষ্ঠ মায়া। একের পর এক রাস্তার পরিবেষণ করেই যাচ্ছে মায়াকে তাও কিছুক্ষণ পর পর। এমনিতে মায়া বেশি খায়। সারাদিন ঘুরঘুর করে খাওয়ার বদ অসভ্য আছে। কিন্তু এই মূহুর্তে খেতে পারছে না জড়তায়। বোনের শশুর বাড়িতে আছে মায়া। প্রথম দিনই যদি এতো বেশি খায় তাহলে মায়ার ভদ্রতা চলে যাবে না? তখন মানুষ কি বলবে মায়াকে? মায়া পেটুক রাক্ষসের মতোন খায় এটা বললে তখন মায়ার আর ভদ্রতা থাকবে চলে যাবে না? মূলত এজন্যই তো মায়া লোক দেখানো ভদ্রতার খাতিরে কিছুক্ষণ পর পর আসা সকল রাস্তা গুলো ফেরত পাঠাচ্ছে অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু খান বাড়ির মানুষজনও জানি কেমন, দেখছে মায়া খেতে পারছে না, ভদ্রতা রক্ষা করছে, তারপরও কিছুক্ষণ পরপর গাদা গাদা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে মায়াকে। আর এজন্যই মায়ার ভালো লাগছে না। অতিষ্ঠ লাগছে খান বাড়ির অতিরিক্ত মেহমানদারিতে। আর লাগবেই বা না কেন? চোখের সামনে প্রিয় খাবার গুলো বারবার ফিরত পাঠাতে কার ভালো লাগে? মায়ার কষ্ট হয় না বুঝি? দুঃখী মায়া নিজের সামনে রাখা ট্রে ভরতি খাবার দিকে তাকাল। হতাশা দৃষ্টিতে বিরক্তি ঠেলে চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল জুইকে খোঁজতে। এই জুইটাকেও আশেপাশে কোথায় দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ফাহাদের বোন সেঁজুতি সাথে কোথাও গিয়েছে। মায়াও যেতে চেয়েছিল ওদের সাথে কিন্তু জুই বলল ওহ নাকি ওয়াশরুমে যাবে। আবার এক্ষুনি চলে আসবে বলে মায়াকে অপেক্ষা করতে বলেছে। মায়াও সেই সন্ধ্যা থেকে এই খান বাড়ির ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে থাকতে থাকতে মায়ার কোমর লেগে আসছে ব্যথায়৷ অতিষ্ঠ মায়া বিরক্তিতে উঠতেও পারছে না ভদ্রতা দেখিয়ে। কোথায়, কোন দিকে যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না। যাও একটু ওঠেছিল সেঁজুতি পিছন পিছন কিন্তু রিদের ভয়ে ফের এখানে এসে বসেছে পুনরায়। তাছাড়া মায়া এখানকার কোনো কিছুই চিনে না। তারপর আবার মায়ার বোন মুক্তাকে উপরের কোন রুমে নিয়ে গিয়েছে তখন সেটাও মায়া দেখেনি। শুছেনে মুক্তাকে ফাহাদের বাবার রুমে নিয়ে গেছে। ছেলেরা সব বাহিরে! মায়াকে সারাক্ষণ ভাবি ভাবি ডাকা ছেলেগুলো খান বাড়ির বাগানের দিকটায় দেখেছিল মায়া। হেনা খানের সাথে ফাহাদের মাকে দেখেছিল কিচেনে সার্ভেন্ডদেরকে রান্নায় সাহায্য করতে। বাকি রইল মায়া সে একাই আপাতত খান বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে। আশেপাশে মানুষের উপস্থিতির শব্দ মায়া পাচ্ছে কিন্তু মায়ার পাশে কেউ নেই। নিঃসঙ্গ মায়া অতিষ্ঠ হয়েই একটা সময় সোফায় বসে মুচড়া মুচড়ি শুরু করলো বিরক্তিতে। কি করবে ভেবে না পেয়ে খাবার দিকে তাকাল। খাবে কি খাবে না তা নিয়েও দ্বিধায় ভোগলো। মায়া নিজের বাসায় থাকলে এতক্ষণে সবগুলো নাস্তাই মায়ার পেটে চালান হয়ে যেত কিন্তু বোনের শশুর বাড়িতে ভদ্রতা দেখাবে নাকি খাবে তাই নিয়েও ভাবলো। খুব জোর করে মনকে বুঝালো না থাক, মায়া এই মূহুর্তে ভদ্রতা দেখাবে না খেয়ে। মায়ার চিন্তা ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ধুপ করে মায়ার গা ঘেঁষে বসল চেপে। হঠাৎ বসার দারুণ মায়ার বাহুর সঙ্গে বাহু আর উরুর সঙ্গে উরুর ঘষা লাগতেই চমকে উঠে মায়া পাশে তাকাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মায়ার নাক, মুখ ভারি খেল রিদের বাহুতে। সিগ্ধ মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে ভাজতেই শরীর শীতল হয়ে আসল মায়ার। রিদের হঠাৎ উপস্থিতে থমকে যাওয়ার মতোন কয়েক সেকেন্ড থ মেরে রইলো। একটা সময় হুশে ফিরতে ধড়ফড়িয়ে রিদের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইলে তৎক্ষনাৎ গায়ের কাপড়ে টান খেয়ে আবারও জায়গায় বসে পড়লো মায়া। অস্তিত্বের মায়া তৎক্ষনাৎ নিচে তাকিয়ে লক্ষ করতে বুঝতে পারল মায়ার ওড়নাসহ চুরিদার ফ্লকের কিছু অংশে রিদ বসে আছে গা এলিয়ে সোফায়।
আতঙ্কিত মায়া রিদের এতো কাছে বসে থাকতে অস্থির নেয় ছটফট করে টানাটানি শুরু করলো নিজের কাপড় রিদের নিচ হতে ছাড়াতে। রিদ মায়া দিকে তাকাল না। আর না মায়া কাপড় ছাড়ল বসা থেকে। বরং গা এলিয়ে সোফায় বসল। ভাবখানা এমন রিদের পাশে আপাতত কেউ নেই। আর না রিদ কাউকে দেখতে পারছে। তখনই রিদ গলা ছেড়ে হেনা খানকে ডেকে বলল ‘রিদকে পুনরায় কফি দিতে! রিদ হেনা খানকে ডাকায় অধৈর্য্যের নেয় অস্থির হলো মায়া। হেনা খান ওদের দুজনকে খোলামেলা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকতে দেখলে নিশ্চয়ই খারাপ ভাববে মায়াকে। অস্থির মায়া নিজের কাপড় দু’হাতে টেনে রিদের উদ্দেশ্যে ছোট গলা বলল….
‘ ছাড়ুন!!
মায়ার ছোট গলায় রিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মায়ার দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখাচোখি হলো অস্তিত্বে মিইয়ে যাওয়ার মায়ার দুচোখের সাথে। জড়তার মায়া প্রথমবারের মতোন রিদকে এতো কাছ থেকে লক্ষ করলো। রিদ খান আসলেই সুন্দর। শুধু সুন্দর নয়, বলতে গেলে বাড়াবাড়ি রকমের আর্কষণে সুন্দর লোক এই রিদ খান। সবচেয়ে সুন্দর এই লোকের চোখ। গুরুগম্ভীর আর মারাত্মক নেশালো। জবান নয় যেন চোখ কথা বলে তাঁর। এই যে সদ্য গোসল করে আধ ভেজা চুলে আর গায়ে, চলে এসেছে এতে রিদকে আরও সচ্ছ আর সিগ্ধ সুন্দর লাগলো মায়ার চোখে। এই যে রিদের ঘাড় বেয়ে নামা ফোঁটা পানিতেও মায়ার চোখ গেল। বুকের পাশের হাল্কা ভেজা কালো টি-শার্টেও তো প্রথম নজর পরেছিল মায়ার। লোকটা আসলেই সুন্দর শুধু একটু বদমেজাজির রাগটা আছে। সেটা ছেড়ে দিলেই একদম পারফেক্ট লাগতো। রিদ মায়াকে মনোমুগ্ধের নেয় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার কপালে ভাজ শিথিল হলো তখনই। মায়ার ধ্যান ভাঙ্গতে তীক্ষ্ণ গলায় বলল…
‘ নজর দিয়ে লাভ নেই। আমি অলরেডি বুকড বিয়াইন!
রিদের কথায় থতমত খেয়ে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি লুকাতে আশেপাশে তাকাল মায়া। চুরি ধরা পরার মতোন অস্তিত্বে মিইয়ে আবারও নিজের কাপড় টেনে রিদকে বলল…
‘ ছাড়ুন প্লিজ!!
রিদ ভ্রুর উঁচিয়ে তাকাল প্রশ্নোত্তর দৃষ্টিতে। মায়া রিদকে নড়তে না দেখে ফের নিজের কাপড় টেনে তাকাল রিদের দিকে। চোখাচোখি হয়ে যেতেই মায়া নিজের দৃষ্টি নিচে করে ফের কাপড় টেনে বলল…
‘ কি হলো ছাড়ুন প্লিজ!!
‘ এখনো তো ধরতেই পারেনি। ছাড়ব কখন? তাছাড়া আপনি আমার বাড়িতে কি করেন? শুনলাম আপনি নাকি আমার নতুন বিয়াইন হয়েছেন? কথাটা কি সত্য???
‘ হুমমম!
‘ তাহলে শুনেন সলিড একটা কথা বলি। আপনি দরদ দেখিয়ে দুলাভাইয়ের ভাই মনে করে আমাকে ছেড়ে দিলেও আমি ফাহাদের শালী মনে করে আপনাকে কখনোই ছাড়ব না। এর জন্য আপনার জাতির ভাইকেও আমি দেখে নিব সমস্যা নেই। আর রইল আপনার কথা! তাহলে প্রথমে বলি রাখি, বোনের শশুর বাড়ির মনে না করে নিজের শশুর বাড়ির মনে করেও চলতে পারেন এতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার অতিরিক্ত টইটই নিয়ে সমস্যা আছে। দুলাভাই বা আদাস পাবলিক যাদেরকে আপনি নতুন নতুন বিয়াই বলে চিনেন আপাতত তাদের সাথেও ঘুরাঘুরি নিষেধ। মানে হেলদি দূরত্ব বজায় রাখবেন তাদের সাথে। নয়তো ঐ যে বললাম সবাইকে দেখে নিব। সে-দলে আপনি থাকবেন কিন্তু। আরেকটা কথা নাইস কালার! কালো রংটা বেশ মানিয়েছে আপনার সাথে। আই লাইক ইট! তবে নেক্সট টাইম লালের সাথে লাল পরবেন। তাহলে আরও সুন্দর দেখাবে।
লাস্ট কথাটা দুষ্টুমির ছলে বলেই সামনে ঘুরে গেল রিদ। হতবাক মায়া হতবুদ্ধি হয়ে থ মেরে বসে রইল। প্রথম রিদের হুমকি ধামকি গুলা মাথায় আসল না। সে কেন নিজের দুলাভাই বা বিয়াইদের কাছ থেকে দূরে থাকবে তাও এই লোকের কথায়? বোনের শশুর বাড়িতে এসেছে বিয়াইদের সাথে আড্ডা দিবে এটাই স্বাভাবিক তাই না? সে কেন রিদ খানের কথা শুনতে যাবে আশ্চর্য? তাছাড়া এই লোকের চোখেও সমস্যা আছে। মায়া এই মূহুর্তে টকটকা লাল রঙ্গা ড্রেস পরে আছে অথচ এই লোক বলছে মায়াকে কালো রঙ্গে মানিয়ে বেশ? আজব পাবলিক ঠিকঠাক কালার চেনে না হুহ। হেনা খান এগিয়ে আসতে দেখে মায়া আস্তে করে সরে বসল। কারণ ততক্ষণে রিদ মায়া কাপড় ছেড়ে দিয়েছিল। হেনা খানের আসার প্রায় সাথে সাথে জুই আর সেঁজুতিও উপস্থিত হলো সেখানে। মায়ার পাশে জুইকে বসতে দেখে রাগে মুখ বাঁকাল মায়া। জুই মায়া মাথায় টুকা দিতেই চোখ গরম করে তাকাতেই জুই আবারও মায়ার মাথা গাট্টু মেরে বলল…
‘ বলদি তোর কালো ফিতা দেখা যাচ্ছে কাঁধে। সেটা ভিতরে ঢুকা নয়তো কারও চোখে পরবে।
জুইয়ের কথা আকাশসম চমকিয়ে তৎক্ষনাৎ তাকাল রিদের দিকে। তারমানে এই লোক তখন মায়াকে এই কালো ফিতার জন্য বলেছিল মায়াকে কালো রঙ্গে সুন্দর লাগছে? গাঢ় লজ্জায় তখনই মিইয়ে গেল মায়া। অথচ রিদ খান মায়াকে এতোবড় কথা বলেও দিব্যি সে তার কফির মগ চুমুক দিতে ব্যস্ত। পাশেই হেনা খান অনেক কিছু বলছে তাঁকে। সে হ্যাঁ না উত্তর করছে না। শুধু গম্ভীর চিত্তে শুনে যাচ্ছে।
#চলিত….
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
১৯
সকাল আটটা! দিনটা মুক্তার বিয়ের পরদিন। নতুন বউকে নিয়ে রান্না ঘরেই পারভীন শেখ। আশেপাশে সার্ভেন্ট আছে আরও দুজন। একজন তরকারি কুটছে তো অন্যজন রুটি বানাচ্ছে। মুক্তা ঘোমটা মাথায় শাশুড়ী পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির মানুষের জন্য চা বানাচ্ছে। পারভিন শেখ রুটি তেলে ভেজে সেটা আবার শেকে দিচ্ছে আগুনে পুরে। বিয়ে বাড়িতে মেহমান আছে সবাইকে নাস্তা দিবে বলেই তোড়জোড় করে সবাই ব্যস্ত হাত চালাচ্ছে কাজে। তবে মুক্তাকে কেউ বলেনি রান্না ঘরে আসতে বরং না আসতে নিষেধ করেছিল পারভিন শেখ। মুক্তা নিজ থেকেই সেধে এসেছে শাশুড়ীকে কাজে সাহায্য করতে। নতুন বউ হয়ে কিভাবে অসুস্থ শাশুড়ীকে কাজ করতে দেখেও বসে থাকবে সে? বড্ড বেমানান হয়ে যায় না? তাছাড়া বাড়ির মানুষজন বিশেষ করে মুক্তা মা পইপই করে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে শশুর বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠার আগেই যেন মুক্তা রান্না ঘরে উপস্থিত থাকে। অসুস্থ শাশুড়ীকেও যেন হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে। মুক্তা বরাবরই নরম ও বুঝদার মেয়ে। বড়রা যাহ বলবে তাই করে। এজন্য পারভিন শেখের বারবার নিষেধ করা শর্তেও রান্না ঘর থেকে যায়নি মুক্তা। শাশুড়ী প্রথমে বলেছিল উনার ছেলেকে সময় দিতে। ফাহাদ কাল বাদে পরশু সিঙ্গাপুর চলে যাবে বাবাকে নিয়ে, ফিরবে কখন? তার ঠিক নেই। তাই ছেলের আশেপাশে থাকতে বলছে। কিন্তু মুক্তা নরম গলায় পারভিন শেখ জানায়, ফাহাদ এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠতে আরও ঘন্টা দুয়েক সময় নিবে। ছেলের ঘুমের কথা শুনেই চুপ করে যান পারভিন শেখ। মুক্তাকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করেই থমথমে খেয়ে চুপচাপ ফের হাতের খুন্তিতে পুরোটা ভাজেন। মৃদু স্বরে আদেশ করেন তিনি ‘ তাহলে তুমিও গিয়ে ঘুমাও। আমি সার্ভেন্ড দিয়ে খাবার রুমে পাঠিয়ে দিব যাও।
শাশুড়ীর কথায় বেশ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা ঘুমটা টেনে জড়তা চোখে এদিকসেদিক তাকাল মুক্তা। তখনই চোখাচোখি হলো তরকারি কুটতে থাকা কাজের মহিলা ফুলমতি সঙ্গে। অর্ধবয়স্ক ফুলমতি ওকে দেখেই মিটমিট হাসছিল। সেজন্য ইতস্ততায় জড়িয়ে মুক্তা শাশুড়ী দিকে ঘুরে গিয়ে মিনমিন গলায় বলল ‘
‘ আমি আপনার পাশে থাকি আম্মু। আমার সকালে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।
আর কিছুই বলল না পারভিন শেখ। চুপচাপ নিজের কাজে হাত চালাল। শাশুড়ীর নিরব সম্মতি দেখে মুক্তা চায়ে কিটলিতে হাত বাড়াল। সত্তরে ঊর্ধ্বে বয়স্ক হেনা খানও বসে নেই। তিনি মূলত ডাইনিংয়ে খাবার রাখছে একে পর এক। পাশেই সার্ভেন্ট রুপি অল্প সময়ী মালা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে উনাকে সাহায্য করতে। তক্ষুনি দেখল রিদকে ফরমান ড্রেসআপে সিড়ি বেয়ে নামতে। হেনা খানের চোখ সেদিকে পরতেই রিদকে ডাকল নাস্তা করতে। রিদ হাত ঘড়িতে সময়টা এক পলক দেখে নিয়ে ড্রয়িংরুমে মেইন দরজা দিকে যেতে যেতে বলল…
‘ এখন না দাদী! একটু পর! আয়ন আসছে জরুরি কাজে। সেটা শেষ করেই করব।
হেনা থেমে যায়। শুধু বলল…
‘ তাহলে কফি করে দিব তোকে? খাবি? পাঠাবো?
রিদ চলে যেতে যেতে বলল..
‘ পাঠাও।
~~
সকাল সকাল খান বাড়ির বাগানে বিচরণ মায়ার। নতুন বাড়ি! নতুন পরিবেশ দেখে রাতেও তেমন ঘুম হয়নি। এজন্য সকল সকাল ঘুম থেকে উঠেই খান বাড়ির বাগানে হাটাহাটি করতে চলে এসেছে। খান বাড়ির বাগানটা বেশ মনে ধরেছে মায়ার। বেশ সুন্দর আর পরিপাটি। বাগানে মাঝে একটা ছোটখাটো বাংলোও দেখেছে মায়া। খোলা বাংলোতে আবার আধুনিকা সোফাও ফেলে বসার মতোন সুন্দর পরিবেশ করে রেখেছে খান বাড়ির মানুষ। মায়া আর সেদিকটায় যায়নি। বরং উল্টো পথে হাঁটল। বাগানের মালিদের বাগান চর্চার কাজ করতে দেখা গেল সেদিকটায় এগোতে চাইল মায়া। অল্প এগোতে দেখল আরাফ খানকে। তিনি সাদা ফতুয়া গায়ে জড়িয়ে হাতে লাঠিভর করে দাঁড়িয়ে বাড়ির মালিদের এটা সেটা আদেশ করছে বাগানে পরিচর্যায়। উনাকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ বিরক্ত মালিদের উপর তিনি। মায়া আরাফ খানকে এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছিল। কথাও হয়েছে দুজনের টুকটাক। তবে বেশিভাগ সময়ই মায়াকে মজার ছলে হেনস্ত করেছেন তিনি। এই যেমন কাল যখন জানতে পারলো মায়াই মুক্তার বোন হয়, তক্ষুনি বেশ রসিয়ে মজা করেছিল মায়া সঙ্গে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিখ্যাত ঝগড়ার খেতাব নিয়ে। মায়া অবশ্য হুম হ্যাঁ তেমন কিছুই বলেনি বিয়ে বাড়ির মানুষজন দেখে। কিন্তু আজ মায়া নিজ থেকেই আরাফ খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। আরাফ খানকে অনুসরণ করে সেদিকে পা বাড়াতেই ধপাস করে মুখ থুবড়ে পরলো পায়ের নিচে ইট বেজে। বাগানের ইটের সরু রাস্তায় পরে যাওয়ায়, দু’হাতের কুইন আর দু’পায়ের হাঁটু জ্বিমজ্বিম করে উঠল তক্ষুনি ব্যথা দিয়ে। কেউ দেখা আগে তাড়াহুড়ো উঠে বসল মায়া। লং হাতার চুরিদার জামার উপর দিয়ে একহাতে অন্যহাতের কুইন চাপলো ব্যথায়। মুখ কুঁচকে, ইস, ইস করে বুলি আওড়িয়ে হাতের তালুতে কুইন ঘষতেই, তক্ষুনি মুখের সামনে বাড়াল কারও পুরুবেষ্টি শক্তপোক্ত হাত। মায়া চমকে মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পরলো কুঁচকানো দুটো চোখে শীতল দৃষ্টি। অসময়ে হুটহাট অপরিচিত মানুষের সামনে মুখ থুবড়ে পরে যাওয়ায় মায়ার ইজ্জত লাগল বেশ। কিন্তু তারপরও তব্দা খেয়ে যাওয়ার মতোন করে থমথমে মুখে চেয়ে রইল শ্যামবর্ণের পুরুষটির দিকে। অপরিচিত লোকটিকে মায়ার বেশ পরিচিত মনে হলো। কিন্তু কোথায় দেখেছে লোকটাকে, সেটা মনে করতে চেয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে সে। তক্ষুনি গম্ভীর মুখ খুলল শ্যামবর্ণে লোকটা। নিজের হাত হাল্কা নাড়িয়ে মায়াকে বলল…
‘ কি হলো মিস? ওঠে আসুন। এইভাবে বসে থাকলে অবশ্যই আশেপাশের সবাই জেনে যাবে আপনি নিজের পায়ে সঙ্গে বেজে পরে গেছেন৷ তখন সেটা শুনতে ভালো দেখাবে না। বিষয়টা লজ্জা জনক হতে পারে আপনার জন্য। তাই কেউ দেখার আগেই আপনার আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ানো উচিত।
আমতাআমতা করে অপরিচিত লোকটার হাত চেপে উঠে দাঁড়াল সে। লজ্জায় জড়িয়ে আমতাআমতা করে ধন্যবাদ জানাল ছোট করে। লোকটা মায়া দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে হাতের ঘড়ির সময়টা দেখে নিল। তারপর পকেটে দুটো হাত গুজে দিতে দিতে বলল…
‘ আমি যদি ভুল না হয় তাহলে আপনি ফাহাদে শালী হবেন রাইট?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। তবে পর মূহুর্তে প্রশ্ন করে বলল…
‘ আপনি কিভাবে বুঝলেন?
‘ আন্দাজে ডিল মেরেছিল। তবে সঠিক হয়ে গেল। সম্পর্কে আপনি আমার বিয়াইন হোন৷ সেই সুবাদে আপনাকে একটা ভালো পরামর্শ দেয় ফ্রীতে। এইভাবে হুটহাট পাবলিক প্লেসের পরে যাবেন না কেমন। হাঁটতে না জানলে রোজ সকালে নিময় করে হাঁটাহাটি করবেন, দেখবেন একদিন ঠিকঠাক হাঁটতে শেখে গেছেন। তারপরও এইভাবে হুটহাট পাবলিক প্লেসের সুন্দরী মেয়েদের পরে যাওয়া নিষেধ মনে থাকবে??
মায়া কি হলো কি জানি। লোকটির কথায় সুন্দর করে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। সুন্দর মুখের লোকটার এদিকসেদিক তাকাল। তারপর আবার মায়ার দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো ফের সময় দেখে বলল…
‘ সম্পর্কে যেহেতু বিয়াইন হয়েছেন তাই আমাদের আবারও দেখা হবে। আবার বলতে বারবার দেখা হওয়ারও চান্স আছে। এখন আসি। তবে আমার কথা গুলো মনে রাখবেন কেমন?
মায়া সুন্দর করে সম্মতি স্বরুপ ঘাড় কাত করতেই লোকটা তাড়াহুড়ো মায়াকে পাশ কাটিয়ে সামনে দিকে পা বাড়াল। কি মনে করে লোকটা ফের পিছন ফিরে তাকাতেই মায়ার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মায়া লজ্জা মিইয়ে যেতেই লোকটা তাড়াহুড়ো মায়াকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল…
‘ আর হ্যাঁ! ঐ যে বললাম সুন্দরী মেয়েদের হুটহাট রাস্তায় পরে যেতে নেই সেটাও কিন্তু মনে রাখবেন বুঝেছেন?
মায়া এবারও লজ্জিত মুখে সম্মতি স্বরুপ ঘাড় কাত করল মৃদুস্বরে আওড়াল..
‘ জ্বি আচ্ছা!
তাড়াহুড়োই আয়ন কয়েক কদম এগোতেই হঠাৎ সম্মুখে পরলো জুই। অল্পের জন্যে দুজনের শরীর স্পর্শ লাগেনি এর আগেই সর্তক সহিত ছিটকে সরলো জুই। পথে বিঘ্ন ঘটায় বিরক্তি সহিত তাকাল আয়ন। চোখে বাজল জুইয়ের সহ্য ঘুম থেকে উঠা সিগ্ধ মুখটা। কপাল কুঁচকে জুইকে এক পলক দেখেই তৎক্ষনাৎ পিছনে তাকাল আয়ন মায়ার উদ্দেশ্য। ততক্ষণে মায়াকে দেখা গেল আরাফ দিকে হেঁটে যেতে। জুই অনুতপ্ত গলায় শুধালো…
‘ সরি ভাইয়া। আমি আসলে আপনাকে…
জুইয়ের কথার মাঝেই আয়ন ঘুরে তাকাল ওর দিকে। জুইকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল আয়ন…
‘ দুজন কি টুইনস?
আয়নের প্রশ্ন বুঝতে না পেরে অবুঝ গলায় শুধালো জুই…
‘ জ্বি??
আয়ন কি মনে করে আবারও পিছন ঘুরে তাকাল মায়ার দিকে। মায়াকে দেখা গেল আরাফ খানের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলতে। খুব স্বাভাবিক নেয় আয়ন সেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল জুইয়ের কৌতুহল ভরা মুখটার দিকে। আয়ন আবারও শিওর হওয়ার জন্য বলল…
‘ আমি যদি ভুল না হয় তাহলে আপনি ফাহাদের দ্বিতীয় শালী আর মায়ার বোন রাইট?
কৌতুহলী জুই হতবাক স্বরুপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। অপরিচিত একটা ছেলেকে নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে পেরে বিস্মিত হলো। আবাক স্বরে প্রশ্ন করল জুই..
‘ আপনি মায়াকেও চিনেন? কিভাবে?
দারুণ হাসল আয়ন। রিদকে দেখলো খান বাড়ির ভিতর থেকে বের হতে। সেদিকে পা বাড়াতে চেয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় আদেশ জাড়ি করলো জুইয়ের উদ্দেশ্য। বলল…
‘ যানতো বিয়াইন সাহেবা আমার জন্য এক গ্লাস পানি আর একটা হট কফি নিয়ে আসেন। আজ সকাল সকাল কাজের তাড়াহুড়ো বের হয়ে পরেছিলাম তাই কিছুই খাওয়া হয়নি আমার। তবে হ্যাঁ! পানিটা অবশ্যই কুসুম গরম পানি নিয়ে আসবেন কেমন। আমার গলায় সমস্যা হচ্ছে এজন্য গরম পানি পান করতে হচ্ছে। যানতো দ্রুত নিয়ে আসেন।
গমগমে আদেশ করেই আয়ন রিদের দিকে আগালো। হতভম্ব জুই হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইল আয়নের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। চিনা নেই, জানা নেই, একদম অপরিচিত একটা লোক এসে এমন ভাবে জুইকে কাজের আদেশ করল যেন শত যুগ ধরে জেনা মানুষটি জুইয়ের। অথচ জুই যে এই বাড়িতে নতুন মেহমান সেদিকেও খেয়াল করলো না লোকটা। এখন জুই গিয়ে কাকে বলবে গরম পানি আর হট কফি দিতে? যদি কেউ জিগ্যেসা করে, কার জন্য এসব, তাহলে কি নাম বলবে জুই? লোকটার নামটাও তো জানে না জুই। খান বাড়ির সাথে লোকটার কি সম্পর্ক সেটাও বুঝতে পারছে না। তবে লোকটা যে ফাহাদের ভাই টাইপের কিছু একটা হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছে কিছুক্ষণ আগের জুইকে বিয়াইন সাহেবা বলে সম্মোধন করা কথায়। জুইকে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ন ফের চলে যেতে যেতে তাড়া দিয়ে বলল…
‘ কি হলো জুই দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমাকে নিয়ে পরে ভাববেন এখন দ্রুত যান। আমার মাথা পেইন দিচ্ছে আপনার কফির জন্য।
হতবাক জুইয়ের বিস্মিতা আকাশ ছুলো আয়নের কথায়। লোকটা জুইয়ের নামও জানে? সর্বনাশ!
হতবুদ্ধি জুই তৎক্ষনাৎ ছুটল বাড়ির ভিতর দিকে। ফিরে এলো ট্রেতে করে কুসুম গরম পানি আর হট কফি নিয়ে। ততক্ষণে আয়ন রিদের সাথে কথায় ব্যস্ত। জুই ইতস্ততা বোধ করে সেদিকে আর আগালো না। বরং রিদের ছেলেদের একজনকে ডেকে ট্রে তুলে দিল তাদের হাতে আয়নকে দিতে। ছেলেটির কফির ট্রে হাতে নিতেই তৎক্ষনাৎ বাড়ির দিকে দৌড়াল জুই। আপাতত সেঁজুতি রুমটা জুইয়ের স্বস্থির মনো হলো।
~
মোটর পাইব হাতে চেপে দাঁড়িয়ে মায়া। উদ্দেশ্য বাগানের চারাগাছে পানি দিবে। কিন্তু হঠাৎ করে মোটর পুড়ে যাওয়ায় হতাশ মায়া। সেজন্য লাল ছোট বালতি হাতে বাগানের একপাশের মোটরকল থেকে পানি সংগ্রহ করতে সেদিকে গেল। দু’জন মালির দেখাদেখি সেও টিউবল চেপে বালতি ভরলো পানিতে। দু’হাতে বালতি আগলিয়ে টেনে কিছুপথ যেতেই কোথাও থেকে দৌড়ে এগিয়ে আসল সেই তপু নামক দামড়া ছেলেটি। ভাবি, ভাবি বলে মায়াকে সম্মান দেখিয়ে জোরপূর্বক বিনিত সহিত মায়ার হাত থেকে বালতিটা নিজের হাতে নিলো। থমথমে মুখের মায়া চুপ করে গেল তপুর মুখে ভাবি ডাকটা শুনে। সর্তক চোখে আশেপাশে তাকাল কেউ শুনে নিয়েছে কিনা দেখতে। মায়ার ভয়, পাছে যদি কেউ শুনে নেয় মায়াকে এতো বড় দামড়া ছেলে ভাবি ভাবি ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে তাহলে নিশ্চয়ই বিষয়টা দৃষ্টিকুটু দেখাবে নতুন আত্মীয়দের মাঝে। মুক্তার কানে যেতে পারে সেই ভয়ও করলো মায়া। তাছাড়া এখনকার সবাই জানে মায়ার এখনো বিয়ে হয়নি। এখন কোন জাতীর ভাইকে জড়িয়ে এই দামড়া ছেলেগুলো মায়াকে এতো এতো সম্মান দেখায় সেটাও তো মায়া জানে না। সেজন্য মায়া কথা না বাড়িয়ে সর্তক সহিত এদিকসেদিক তাকাতেই চোখে পড়লো কিছুদূর বসা রিদকে। মায়ার দিকেই কপাল কুঁচকে তাকিয়ে। নিশ্চিত শুনেছে তপু নামক ছেলেটিকে মায়াকে ভাবি ডাকতে। মায়া খানিকটা থমথমে খেয়ে যায় রিদের সাথে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যেতে। আবার কি মনে করে মায়া বেশ সাহসী হয়ে বুক ফুলিয়ে রিদের দিকে গর্বিত চোখে তাকাল। নাক ফুলিয়ে রিদকে ভাব দেখিয়ে বুঝাতে চাইল মায়া এখন জাতির ভাবি। ওর পিছনে জাতির ভাইয়ের লম্বা হাত আছে সেটা। মায়া রাতেই যে রিদকে ছোটখাটো হুমকি দিয়েছিল জাতির ভাইয়ের লম্বা হাত দিয়ে রিদকে ঘায়েব করে দিবে, সেটা সকালেই সত্যি হলো তপুর ছেলেটার এতো সম্মান দেখিয়ে ভাবি ডাকায়। এখন নিশ্চয়ই এই রিদ খান মায়ার পিছনে আর লাগবে না? ভয় পাবে ওকে? নয়তো এই লোকটা যে সবসময় মুখ বাঁকিয়ে থাকে মায়াকে অপমান করার সেটা আজ বুঝবে মায়ার কতো সম্মান আছে সকলের সমানে। আর যায় হোক জাতির ভাই অন্তত একটা উপকার করেছে মায়ার জীবন এসে। এই যে মায়া এখন রিদ খানকে নিভয়ে নাক দেখিয়ে চলবে সেটাতো একমাত্র এই জাতির ভাইয়ের জন্যই হলো তাই না? এজন্য তো অন্তত মায়ার উচিত এই জাতির ভাইকে একটা ধন্যবাদ দেওয়ার। ক্ষমতাসীন মায়া নিজের ভাবনা ছেড়ে রিদকে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল তপুকে অনুসরণ করে। মনে মনে শপথ করলো আজ থেকে সে এই রিদ খানকে ভুলেও ভয় পাবে না। কারণ রিদ খান থেকে মায়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। মায়া কতো সম্মান এই দামড়া দামড়া ছেলেগুলোর সামনে। সেটা বুঝাতে হবে না এই রিদ খানকে? এখন মায়াকে অকারণে ভয় পেলে চলবে? ভুলেও চলবে না। হু! মায়া কি মনে করে চলে যেতে যেতে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিদের দিকে তৎক্ষনাৎ চোখ মিলল দুজনের। রিদ তখনো আগের নেয় কপাল কুঁচকে তাকিয়ে মায়ার দিকে। রিদের সাথে ফের চোখ মিলতেই মায়া আবারও মুখ বাঁকাল রিদকে। তক্ষুনি শুনা গেল কারও ঝনঝনে মুক্ত হাসির শব্দ। মায়া চমকে উঠে পাশের তাকাতেই দেখল সকালের সেই শ্যামবর্ণের ছেলেটি রিদের পাশে বসে আছে মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লজ্জায় মায়া তৎক্ষনাৎ ছুটে পালাল আরাফ খানের কাছে। তক্ষুনি আয়ন বলল…
‘ বাহ! বিয়াইন সাহেবা তো ভালোই মুখ ভেঙ্গাতে পারে। তা তোর প্রতি এতো মেহেরবানির কারণ কি?
‘ আপাতত আমি তার শত্রু পক্ষের আছি তাই।
‘ আচ্ছা এই ব্যাপার? পরিচয়টা দিয়ে দে তাহলেই তো হয়।
রিদের মুখটা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে উঠল। অল্প কথায় বলল…
‘ নো নিড!
কথাটা শেষ করে ফের রিদ চোখ তুলে তাকাল মায়ার দিকে। দূর পথে দেখা গেল মায়াকে বালতি থেকে মগে করে বাগানের চারাগাছে পানি দিতে আরাফ খানের সঙ্গে। ইতিমধ্যে যে আরাফ খানের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে মায়ার সেটা বেশ চোখে পরলো রিদের। মেয়েটার সবার সাথেই সহজে মিশতে পারে অথচ রিদের বেলায় এলেই যতো মিথ্যা থাকে রিদকে বলে বেড়ায়। তাহলে সেখানে রিদ কেন যেচে নিজের পরিচয় দিতে যাবে? রিদকে কি দিয়েছিল এই মেয়ে নিজের পরিচয়? নাকি বিয়ের রাতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বলে পালিয়ে ছিল? হয়তো আজও দুজন দুজনের পরিচয় মিলতো না যদি না রিদের মন শ্রায় দিতো এই মেয়েকে নিয়ে। দেখা যেত আজীবন স্বামী স্ত্রী হয়েও কখনো নিজেদের পরিচয় মিলতো না। বরং সামনে থেকেও দূর হয়ে যেত একে অপরের। না ডিভোর্স হতো আর না সংসার। এই মেয়ে যখন ঝুলন্ত অবস্থায় নিজেকে রাখতে পছন্দ করে, তাহলে রিদ কেন আগ বাড়িয়ে যাবে নিজের পরিচয় দিতে? থাকুক আজীবন ঝুলন্ত অবস্থায়! রিদ কখনো বলবে না সে কে? কি তার পরিচয়? যদি এই মেয়ে তাঁকে খোঁজে বের করতে পারে তখন দেখা যাবে কি করার যায় এই সম্পর্কটা নিয়ে। ততদিন থাকুক যেমনটা চলছে তেমন।
রিদ নিজের চিন্তা ভাবনায় আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। মায়া আরাফ খানের সঙ্গে চারাগাছে পানি দিয়ে বসল বড় ছাতার নিচে। চেয়ারে পা বুঝিয়ে বসতেই সেখানে আগমন ঘটল মালার। হাতে মায়া আর আরাফ খানের জন্য নাস্তার ট্রে। টেবিলের উপর রেখে মালা আরাফ খানের উদ্দেশ্য জানায়, সকালের চা নতুন বউ মানে মুক্তা বানিয়েছে সবার জন্য। মালা চলে যেতে আরাফ খান গলা ছেড়ে রিদকে নিজের কাছে ডাকল। রিদ ততক্ষণে আয়নের সাথে বাড়ির ভিতরের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু আরাফ খানের ডাকে পিছন ঘুরে তাকাল। সেদিকে যেতে না চেয়েও রিদ কি মনে করে পা বাড়াল আরাফ খানের উদ্দেশ্য। আয়ন রিদের পিছনে না গিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে হাঁটল হেনা খানের সঙ্গে দেখা করতে। রিদকে আসতে দেখেই ভারি নিশ্বাস ফেলল আরাফ খান। নাস্তার ট্রের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় মায়াকে বলল…
‘ বুঝলে মায়া, দিন দিন আমার রিদটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে তারপরও বিয়ে করতে চাচ্ছে না। এজন্য না পেরে ছোট ভাই ফাহাদকে বিয়ে করালাম আমরা, তাও তোমার বোনের সঙ্গে। এই রিদটা যদি বুঝতো! তাহলে আজকে নাস্তার টেবিলে চা সাথে গরম গরম পিঠাও খেতে পারতাম ওর বউয়ের হাতের। কতো সুবিধা হতো আমাদের বলো।
আবারও হতাশার ভারি নিশ্বাস ফেলল আরাফ খান। যেন এই মূহুর্তে উনার মতো দুঃখী মানুষ দুটো আর এই ধরণীতে নেই। মায়ার ও বেশ মায়া হলো আরাফ খানের কথায়। বুড়ো মানুষের এতো দুঃখ থাকতে নেই। এতে মায়ার কষ্ট হয়। ততক্ষণে রিদও মায়ার পাশের চেয়ারটা টেনে আরাফ খানের মুখোমুখি হয়ে বসল। আরাফ খানের নাটকীয় কথা সবই তার কানে এসেছে। সেজন্য বসতে বসতে বলল…
‘ সব ফালতু কথা!
রিদের অল্প কথায় যেন আহাজারি করে উঠল আরাফ খান। মায়ার কাছে ফের ভারি দুঃখ প্রকাশ করে বলল…
‘ দেখেছ নাতনী? ওর বিয়ের কথা বললে সব ফালতু হয়ে যায়। আর ওহ যে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে বিয়ে না করায় সেটা ওর চোখ পরে না। আচ্ছা তুমিই বলো ওকে দেখতে শুকনো শুকনো লাগছে না তোমার কাছে?
আরাফ খানের কথায় তক্ষুনি মায়া কৌতুহল ভরা দৃষ্টিতে তাকাল রিদের দিকে। রিদ কিছু বলবে তার আগেই এক অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসল মায়া। হাত বাড়িয়ে রিদের থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরাল। এদিকসেদিক ঘুরিয়ে রিদের মুখে জহরী দৃষ্টিতে পরখ করে মায়া আরাফ খানকে বলল…
‘ হ্যা একটু একটু শুকনা লাগছে দেখতে নানাভাই।
মায়া রিদের থুতনি ছেড়ে দিতে থমথমে খেয়ে বসল রিদ। মায়া হঠাৎ এমনটা করবে তার ধারণাতেও ছিল না। তবে আরাফ খান দারুণ মজা পেল। তিনি একগাল হেঁসে উঠতেই রিদ চাপা স্বরে মায়া ধমকে শুধালো…
‘ স্টুপিড! ওটা রোদে শুকিয়েছে।
মায়া কিছু বলবে তার আগেই আরাফ খান মায়ার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে উৎসাহে বলল…
‘ আরেহ বাহ! তোমার সাথে দারুণ জমবে আমার। তবে তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি ভিতর থেকে আমার মেডিসিন গুলো খেয়ে আসছি। নয়তো গিন্নি আমার এক্ষুনি হাঙ্গামা শুরু করে দিবে।
মায়া ঘাড় কাত করে আরাফ খানকে সম্মতি দিতেই তিনি হাতের লাঠি ভর করে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে গেল। উনাকে যেতে দেখেই ভিতরে চেপে রাখা কথা গুলো রিদের উদ্দেশ্য বলল মায়া…
‘ আপনি আমাকে একদম ধমক দিবেন না। আমি কিভাবে বলবো কোনটা রোদে শুকিয়েছে আর কোনটা আপনার বিয়ে না করায় শুকিয়েছে? আমি কি আগে বিয়ে করেছি নাকি যে জানবো? আমার তো পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই বুঝলেন?
মায়া ত্যাড়া কথায় রাগে দাঁত পিষল রিদ। বলল…
‘ আর আমিতো শত অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ব্যক্তি। এর আগে চার পাঁচটা বিয়ে করে অভিজ্ঞ হয়ে বসেছি।
রিদের কথায় মায়া সহমত প্রকাশ করে খোঁচা মেরে বলল…
‘ চার পাঁচটা বিয়ে তো করবেনই। এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? আপনার যে রাগ বউ ঠিকবে এই জীবনে আপনার? সবগুলা বউ তো এমনই চলে যাবে আপনাকে ছেড়ে। আমি আগেই ভেবেছিলাম আপনি এমন কিছুই করবেন। এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যান, তা নাহলে শুধু চার পাঁচটা বিয়ে কেন? এর পরে দশ-বারোটা বিয়েও করতে হবে যদি না শুধরান। তারপরও একটা বউ থাকবে না দেখবেন।
মায়ার কথায় রিদ চুপ হয়ে গেল। এই মেয়ে তার কথা কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে গেল। এখন রিদ কিছু বললে আরও উল্টো তাঁকেই পাগল বানাবে এই মেয়ে। তাই রিদ মায়ার কথায় মায়াকেই ফাঁসিয়ে দিয়ে বলল…
‘ যাক অবশেষে কেউ আমার দুঃখ বুঝলো। বুঝলেন বিয়াইন সাহেবা আমি সত্যিই অনেক দুঃখে আছি। আমার বউ থাকছে না আমার কাছে। বিয়ে করেও রাতে বউ ছাড়া ঘুমাতে হচ্ছে। এদিকে ছোট ভাই বিয়ে করে নিল। অথচ আমার বউ আমাকে এখনো স্বীকারই করতে চাচ্ছে না। উল্টো আমাকে তার শত্রু ভাবে। এদিকে শীতও চলে এসেছে। রাতে যে বউকে জড়াজড়ি করে ঘুমাব তারও কোনো উপায় নাই। আমি ভিষণ দুঃখে আছি বুঝলেন বিয়াইন। আপনি আমার জন্য একটা সঠিক বউ খোঁজেন তো। যে বউ মেন্টালি আধপাগল হবে। গেলুও কম থাকবে। বোকা চেহারা আর সরল হাসি থাকবে তার। আমিতো লম্বা মানুষ তাই বউটা খোঁজবেন ঠিক আপনার মতোন নাটু মেয়ে। আসলে ছোট বউকে কোলে তুলে কিস করার ফিলিংস আলাদা। আহা! আর এজন্য আমার ছোট বউই লাগবে কনফার্ম। তারপর এই যে আমার গায়ের রংটা হলো ফর্সা, এজন্য বউয়ের গায়ের রঙ মিলিয়ে হতে হবে হলুদ, একদম আপনার মতোন। তারপর এই যে আপনি আমার দিকে তাকান।
মায়ার থুতনি ধরে রিদ নিজের দিকে ঘুরিয়ে মায়ার নাক মুখ দেখিয়ে আবার বলল রিদ….
‘ এই যে আপনার মতোন নাক, ঠোঁট, মুখ, গাল, চোখের ভিতরের কালো তিল, একদম সবকিছু এই রকমের হলেই চলবে। তারপর এই যে ধরেন আমি যা বুঝাতে চাইবো বউকে সে ঠিক তার উল্টো বুঝবে একদম আপনার মতোন করে। আমার এই রকম গুণের বউই পছন্দ। যদি আপনার অনুসন্ধানে এমন মেয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন কেমন? আমি অপেক্ষায় রইলাম। আসলে শীত চলে এসেছে তো তাই বউটা খুব জরুরি। শীতের রাতের উমের একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না? আচ্ছা আমি এখন আসি তাহলে বিয়াইন! আপনি একটু খোজাখুজি করে দেখেন কোথাও আছে কিনা এমন মেয়ে, ততদিন না-হয় আমি আর একটু অপেক্ষা করলাম।
কথা গুলো বলেই রিদ জায়গায় ছাড়ল। মায়া রিদের চলে যাওয়ার দিকে কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে রইল। আসলে রিদের জন্য বউ খোঁজা নিয়ে একটু কনফিউজড সে। রিদ খান কি মায়াকে বউ খোঁজতে বলে গেল নাকি মায়ার পিছনে সরাসরি লাইন মারল? কোনো ভাবে কি রিদ খান মায়াকে নিজের পাত্রী হিসাবে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে গেল? কনফিউজডের মায়া ঠোঁট উল্টালো।
.
#চলিত…