রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৫৫+৫৬

0
2

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৫৫
ইংল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হলো লন্ডন।
যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ও পযর্টক কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে অন্যতম লন্ডন শহর। এখানের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সাথে চিকিৎসা ব্যবস্থাও বেশ চর্চিত। জন্ম সূত্রে এই লন্ডন শহরের বাসিন্দা সুফিয়া খান। বাবা-মা, ভাই বোনকে নিয়েই ছিল উনার পারিবারিক বসবাস এই শহরের তলিতে। একটা সময় পড়াশোনার সুবাদে পরিচিত হয়েছিল নিহাল খানের সঙ্গে এই শহরের মাটিতে। প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর দুজনের প্রেম। পড়াশোনা শেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছিল তাদের। তারপর নিহাল খানের হাত ধরে সুফিয়া খান বাংলাদেশে সেটেল্ড হয়ে যান। তারপর আর কখনোই এই লন্ডন শহরকে আপন করতে পারেন নি তিনি। যদিও দুজন একটা সময় পর আলাদা হয়ে গেছেন তবে বিচ্ছেদ হয়নি দুজনের। আজও দুজন স্বামী স্ত্রী। তারপরও কেন জানি সুফিয়া খান কখনো বাংলাদেশের মাটি ত্যাগ করে লন্ডন শহরকে আপন করতে পারে নি। তবে উনার যোগাযোগ রয়েছে এই শহরের সঙ্গে একেবারে পর করে দেননি এই শহরকে। জম্ম সূত্রে ইংল্যান্ডের সিটিজেনশিপ নাগরিক হওয়ায় প্রায় প্রতি বছরই উনার বাংলাদেশ টু লন্ডন আসা-যাওয়া লেগেই থাকেন ভিন্ন কাজে। তাছাড়া সুফিয়া খানের বাবা-মা আজ জীবিত না থাকলেও উনার বড়ো ভাই আজও পরিবার নিয়ে এই লন্ডন শহরের বসবাসরত আছেন। যেমন আছেন শশীর মা সালমা সৈয়দ ও উনার স্বামী। সুফিয়া খানের ছোট বোন সালমা সৈয়দ পরিবার এই শহরের নাগরিক। বাংলাদেশে তিনি শুধু খান বাড়ির উদ্দেশ্যে আসা-যাওয়া করেন। বলতে গেলে শশীর সঙ্গে রিদের বিয়ের ব্যাপারটা তাজা রাখতে এতো কাঠখড় পুড়িয়ে দু-টানার সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন তিনি। দু-টানা সম্পর্কে সালমা সৈয়দ খাতির জমালেও স্বভাবে ঠিক বিপরীত হলো সুফিয়া খান। রাগ জেদ্দে এক স্পষ্টভাসী মহিলা তিনি। মিথ্যা, ছলনা পছন্দ নয়। মুখের উপর সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলায় উনার কঠিন ব্যক্তিত্ব । বলতে গেলে রিদ অনেকটা তার মার মতোই হয়েছে। রাগী আর বদমেজাজি টাইপ। নিহাল খান এমন শক্তপোক্ত কঠিন চরিত্রে প্রেমে পরেছিল যৌবনকালে। পরেছিল বলতে ভুল হবে, আজও তিনি বউয়ের প্রেমে পড়ে আছেন। কিন্তু দীর্ঘ দিনের দূরত্বের কারণে দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বউয়ের জন্য মায়া আছে কিন্তু প্রকাশ করার জন্য ভাষা নেই নিহাল খানের। তাই যেটা যে ভাবে চলছে সেটা সেভাবেই যেতে দিচ্ছেন তিনি। যৌবনকালটা তিনি একাই কাটিয়েছেন এখন তো মধ্যবয়সটাও শেষে দিকে। এখন আর উনার একাকিত্ব পোড়াই না। সয়ে গেছে। একা থাকতে শিখে গেছেন। এই দুনিয়াতে বাঁচবে বা আর কয়দিন? বাকি দিন গুলো না-হয় একাকিত্বে কাটিয়ে দিবে। তারপরও এই বয়সে এসে কাউকে ডিস্টার্ব করতে মন চাইনা উনার। সবাই তো ভালো আছে, উনি দুঃখে থাকলে কেউ বা দেখবে? কারও দেখার তো আর নেই। কেউ দেখতে আসেও না। সবাই শুধু উনার উপরটায় দেখে, যেটা উনি দেখায়। কিন্তু মনের খবরই বা কয়জন নেয়? আজকাল উনার এই দুনিয়াটা কেমন তেতু তেতু লাগছে। নিজের নিশ্বাসটাও বেশ ভারি ভারি বজা মনে হয়। নিজের ছেলের মৃত্যুমুখী হওয়ার কারণটা আজ তিনি। উনার করা রাজনৈতিক দন্ডের জন্য আজ উনার বড় ছেলে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে। বাবা হিসাবে তিনি অপরাধীর। না হতে পারলেন ভালো স্বামী আর না হতে পারলেন আদর্শ বাবা। ব্যর্থ উনার জীবন। আর এই ব্যর্থতা উনাকে ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে।
নত মস্তিষ্কের নিহাল খান দু’হাতে মাথা চেপে হাহাকার বুকে দীর্ঘ শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে দু’ফোটো চোখের জলও ফেললো পায়ের কাছে ফ্লোরে। সামনেই রিদের কেবিন। তিনি হসপিটালের বিশাল করিডোরের সারিবদ্ধ চেয়ারে মাথা ঝুঁকে বসে মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনায় বিভোর। আশেপাশে পরিচিত কেউ নেই। সকল অপরিচিত ভিন্ন দেশিদের মাঝে তিনি একা বসে জীবনের কিছু হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। উনার জীবনের অনেক সময় তিনি এই শহরে কাটিয়েছেন। আবার রিদ-রাদিফ আয়ন, তিনজনের পড়াশোনা, বেড়ে উঠা এই লন্ডন শহর থেকেই হয়েছে। তাই এই শহরটা উনার কাছে এতোটাও অপরিচিত নন। পরিচিত বটে। পরিচিত শহরে নিজের সন্তানকে নিয়ে আজ পনেরোদিন যাবত হসপিটালের চক্কর কাটছেন উনারা। অজ্ঞানরত রিদের হুশ নেই। বিগত পনেরোদিন পেরুয়ে ষোলো দিনে পড়তে চলল। অথচ রিদের কন্ডিশন এখনো আগে নেয়। মাথার অপারেশনও সাকসেসফুলি হয়েছে তারপরও রিদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে রিদকে। টুয়েন্টি ফর আওয়াস হসপিটালের চত্বরে কেউ না কেউ উপস্থিত থাকছে রিদের সঙ্গে। বেশিভাগ সময় সুফিয়া খান আর নিহাল খানকে দেখা যায় হসপিটালের। খাওয়া-দাওয়ার আর গোসল বাদে দুজন হসপিটালের থাকছেন চব্বিশ ঘণ্টা। অথচ কেউ কারও সাথে কথা বলছে না আর না চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। দুজন দুজনার আশেপাশে থাকছে অথচ একজনের উপস্থিতে অন্যজন নিরব দর্শক। যেন নিরব যুদ্ধ চলছে দুজনার মধ্যে। এমন কি দুজন রাত্রী যাপন করছে দু’টো আলাদা আলাদা বাড়িতে। সুফিয়া খানের নিজ বাড়ি, নিজ আত্মীয় রেখেও তিনি হোটেলে উঠেছেন। কারও সাহায্য নেওয়ার মানুষ তিনি নন। সবসময় নিজের কাজ নিজে করেন। নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করতে পছন্দ করেন। সেজন্য রিদের আশেপাশে নিহাল খান থেকে উনাকে দেখা যায় বেশি। নিহাল খান
সুফিয়া খানের জন্য হসপিটালের রাত্রি যাপন করতে পারেন না নিহাল খান। একাধিক মানুষ হসপিটালের রোগীর সঙ্গে এলাউ নয় বলে তিনি রাদিফের ফ্লাইটে থাকছেন। আরাফ খান, হেনা খান আয়নের সঙ্গে আছেন ওদের পরিবারের। সকলেই রোজকার আসা
যাওয়া লেগে থাকে হসপিটালের চত্বরে। আয়ন প্রফেশনাল ডাক্তার হওয়ার সে রিদের রেগুলার চেক-আপ রুটিন মেইনটেইন করে। এখন রাত দশ-টা পাঁচটা। আপাতত হসপিটালের কেউ নেই। সুফিয়া খান হোটেলে গেছেন রিদের কিছু রিপোর্ট আনতে। সঙ্গে রাদিফও আছে। আয়ন হয়তো নিচে গেছে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে। সেই মূহুর্তে তিনি একা বসে আছেন এখানটায়। আশেপাশে সাদা চামড়ার ওয়েস্টার্ন পড়া মেয়েদের ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। যে যার মতোন রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত। আপাতত কারও মনোযোগ নেই নিহাল খানের উপর। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় নিহাল খান যখন বিভোর তখনই উনার সম্মুখে অর্ধ পোষাকে দাঁড়াল কেউ। খুবই মিষ্টি স্বরে নিহাল খানকে ইংরেজি ভাষায় বলল…

‘ মিস্টার খান আর ইউ ওকে?

অশ্রু ভেজা চোখ দ্রুত মুছলো নিহাল খান। পরিচিত নার্সের কন্ঠে পেয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিনিও ইংলিশে উত্তর করে বলল…

‘ আই এম ওকে মিস লিটা। থ্যাংকস ফর আকসিং মি।

বিদেশিনী নার্সটি বয়স প্রায় ত্রিশের উধ্বে অথচ দেখে মনে হবে মাত্র বিশের কোটায় পা রেখেছে সে। আসলে বিদেশিদের চেহারা দেখে বয়স ধারণা করার উপায় নেয়। যেমন মিস লিটা ক্ষেত্রে হয়েছে নিহাল খানের। রিদের পার্সোনাল নার্স হলো মিস লিটা। রিদের দেখা শোনা মিস লিটা নামক নার্সটি করে থাকেন সেজন্য বেশ পরিচিত এই নার্সের সঙ্গে সবাই। রিদের কন্ডিশনের বাইরেও মিস লিটা নিজ থেকে নিহাল খানের খবরা-খবর নিয়ে থাকেন সবসময়। তাই আজ নিহাল খানকে একা বসে থাকতে দেখে মিস লিটায় আগ বাড়িয়ে উনার সাথে কথা চলাল। সুন্দরী নার্সটি উজ্জ্বল হেঁসে লাজুক ভঙ্গিতে ঝলমলে ইংরেজিতে বলল….

‘ মাই প্লেজার মিস্টার খান। আপনার খবর নেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যেই পরে। যায় হোক, আপনি কি একা হসপিটালের আছেন? আর কেউ নেই?

নিহাল খান স্বাভাবিক নেয় উত্তর দিয়ে বলল….
‘ আপাতত কেউ নেই মিস লিটা। তবে একটু পর সবাই চলে আসবে।

নিহাল খান রাতে হসপিটালের থাকেন না। সুফিয়া খান রিদের সঙ্গে থাকছেন। সেজন্য উনাকে রাতে চলে যেতে হয় আবার সকালে আসতে হয়। নার্সটি বলল…

‘ ওহ! তাহলে আপনি এখন চলে যাবেন?
‘ না! একটু পর যাবো।

সুন্দরী নার্সটি চট করে নিহাল খানকে কফির অফার করে বলল…

‘ তাহলে কফি খাবেন আমারা সাথে? প্লিজ না করবেন না।

মিস লিটা কাজের প্রতি বেশ দায়িত্ববার। নিহাল খানের প্রচন্ড মন খারাপ হলে মিস লিটা বন্ধুর মতোন উনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন প্রায়। উনার বিষয়টা খারাপ লাগে এমন না। বিপদে একজন অন্য জনকে সান্ত্বনা দিতেই পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু না। উনিও বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ে উত্তর করতে যাবে তার আগেই শুনা গেল সুফিয়া খানের গলা। নিহাল খানের আগে বিদেশি নার্সটির উদ্দেশ্যে উত্তর দিতে দিতে একই ইংরেজি ভাষায় বললো…

‘ আপনার সাথে কফি খাওয়ার মতোন দাঁত নেই মিস্টার নিহালের মিস লিটা। বুড়ো মানুষ দাঁত সব বয়সের ভারে পরে গেছে। মুখের ভিতর এখন সব প্লাস্টিকের দাঁত। আপনার সাথে গরম কফি খেতে গেলে তার প্লাস্টিকের দাঁত সব গলে যাবে। আপনি বরং আমাকে কফির দাওয়াত দিতে পারেন। আই লাভ কফি।

সুফিয়া খানের কথায় চমকে উঠার মতোন বিদেশি নার্সটি ঘুরে তাকাল। সেই সাথে নিহাল খানও তাকাল তক্ষুনি। থ্রি পিসের উপর মোটা ভারি ওভারকোট পরে হাতে রিদের বেশ কিছু রিপোর্টের ফাইল চেপে দাঁড়িয়ে সুফিয়া খান। পিছনে রাদিফ সরল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। মা-ছেলে লম্বা প্রায় সমান সমান দেখালো। যদিও রাদিফের হাইট ৫’১০। সুফিয়া খানের ৫’৮। জুতো পড়ায় মা-ছেলে দুজনকে লম্বাই একই দেখাল। রাদিফ চোখ ছোট ছোট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে। বাবার যে প্লাস্টিকের দাঁত সব সেটা সে আজই জানতে পারলো। নয়তো এতোদিন তো সে তার বাবাকে ইয়ং আর বত্রিশ দাঁতে অধিকারী মনে করতো। কিন্তু আজ জানতে পারলো তার বাবা আসলে ইয়ং ম্যান নয় ওল্ড ম্যান। বুড়া মানুষ। সেজন্য রাদিফ ছোট ছোট চোখ করে বাবাকে আওড়াতে লাগল আসলেই নিহাল খানের দাঁত প্লাস্টিকের কিনা সেটা দেখতে। এর মাঝেই সুফিয়া খান পিছন থাকা রাদিফকে দিকে হাতের রিপোর্ট গুলো বাড়িয়ে দিতে দিতে সৃষ্টি তাক করলো সুন্দরী নার্সটির উপর। রাদিফকে বলল সুফিয়া খান…

‘ আয়নকে সেকেন্ড ফ্লোরে পাবে। গো।

রাদিফ ভদ্র ছেলের মতোন রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে তৎক্ষনাৎ জায়গা ছাড়লো। সুফিয়া খান মিস লিটার মুখোমুখি হয়ে তাকাল সুন্দরী নার্সটির গলার নিচে। টাইট ফিটিং ইউনিফর্মের বুকের কাছটায় দুটো বোতাম খোলা। পাশেই নিহাল খান দাঁড়িয়ে সুফিয়া খানকে দেখছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। উনার যে প্লাস্টিকের দাঁত মুখে সেটা তিনি নিজেরও আজ প্রথম শুনলো। হঠাৎ উনার বউ এসব কথা কেন বলল সেটাই তিনি বুঝতে চাইলো। সুফিয়া খান নিহাল খানের সকল কৌতুহল ভস্ম করে রয়েসয়ে দু’হাত চালাল সুন্দরী নার্সটির ইউনিফর্মের বোতামের উপর। টাইট ফিটিংস ইউনিফর্মটির দুপাশ টেনে বোতাম দু’টো লাগাতে লাগাতে আবারও সচ্ছ ইংরেজি ভাষায় বলল…

‘ হি ইজ নট ইন্টারেস্টেড ইন ইউ। কারণ তার বউয়ের প্রয়োজন হয়না তাহলে তোমার এসব দেখে কি ফিল করবে বলো। আসলে সমস্যা তোমার না তার মেশিনের। যন্ত্রে ঝংকার ধরে আছে তোমার সাথে চলবে না। ইউ ডিজার্ভ বেটার।

সুফিয়া খানের কথায় তৎক্ষনাৎ নার্সটি নিহাল খানের দিকে কেমন বাঁকা চোখে তাকাল। বিরবির করে বলল নার্সটি….

‘ ওয়েস্ট অফ টাইম।

নার্সটির কথায় তৎক্ষনাৎ উত্তর করলো সুফিয়া খান।

‘ ইয়াহ!

কথাটা বলেই সুফিয়া খান জায়গা ত্যাগ করেন। কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে পড়েন। পিছন থেকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিহাল খান। কেমন বোকার মতোন তাকিয়ে রইল সুফিয়া খানের যাওয়ার দিকে। এই দিকে খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে সুন্দরী নার্সটিকেও চলে যেতে দেখল। অথচ উনি এতোদিন সরল মনে কথা বলতো নার্সটির সঙ্গে। উনি বুঝতে পারেননি আসলে নার্সের মনে কি ছিল। এই বয়সে তিনি পরকীয়া করবেন ছিঃ।
~~
আজ সতেরো দিন হতে চললো রিদের এক্সিডেন্টের পর। মায়ার অবস্থার পরিবর্তন নেই। গায়ে সবসময় জ্বর থাকে। অতিরিক্ত মানসিকতা চাপে কারণে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে নয়তো চুপচাপ বসে থাকে। পারিবারিক আত্মীয়দের নানান কথা কানে আসে মায়ার। মায়ার ফুপিরা তো মায়ার সামনে এসে যাতা বলে যান। মায়ার জন্য জুইয়ের পড়াশোনাও বন্ধ পথে। বাড়ির মেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে ছেলেদের পিছনে ঘুরে পাগল হয়ে যাচ্ছে বলে আর পড়াশোনা করানো ঠিক হবে না বলে এমনটা মায়ার তিন ফুপির ধারণা। এতো পড়াশোনার করিয়ে বা কি লাভ হবে যদি পরিবারের সম্মান নষ্ট করে বেড়ায় এরা? পরিবারের সম্মান বাঁচাতে চাইলে মায়া বা জুই কারও পড়াশোনার আর দরকার নেই আর। ভালোই ভালোই সম্মান থাকতে মেয়ে দু’টোকে বিয়ে দিলে জান বাঁচবে নয়তো সমাজে মুখ দেখাবার নয়। এমনই মায়ার জন্য আত্মীয় স্বজনরা থুঃথুঃ করছেন উনাদের উপর। বড়ো লোক ঘরের ছেলেকে ফাঁসাতে না পেরে মায়া নাকি নিজেই পাগল হয়ে ঘরে বসেছে। এসব কথা আরিফের কানেও গিয়েছে অনেকবার। সে প্রতিবারই প্রতিবাদ করেছে কিন্তু সবসময় আরিফ সামনে থাকে না মায়াকে বাঁচানো জন্য। মায়ার ছোট ফুপি শান্তা মজুদার তিনি একটু শক্তমনের মানুষ। ভাইয়ের সংসারের ভালো-মন্দ চিন্তা করার উনার সবসময়ের স্বভাব। মায়ার অসুস্থতার বা প্রেম জনিত কথাটি শুনে বড়ো ভাইয়ের বউদের যা-তা শুনিয়েছেন তিনি। দুই ভাইকে বুঝাচ্ছেন মায়াকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে নয়তো সমাজে মায়ার পাগল হওয়ার বিষয়টি রটে গেলে সম্মান নষ্ট হবে সবার। মায়ার বাবা শফিকুল ইসলাম বোনের কথায় সহমত পোষণ করেন। সেই সাথে জুইয়ের বাবাও তাই প্রকাশ করলেন। সকলেই চাই মায়াকে সুস্থ করে চেয়ারম্যান পরিবারের বিয়েটা সেড়ে ফেলতে। সেই সাথে উনারা মতে মতে জুইয়ের জন্যও ভালো ছেলের সন্ধান করছেন। তবে বোনদের বিয়ের ব্যাপারে কেউ আরিফের সামনে আলোচনা করে না। আরিফ বরাবরই মায়ার অন্য জায়গায় বিয়ে নিয়ে প্রতিবাদ করে। সেজন্য পরিবারের সবাই ঠিক করলো মায়ার সুস্থতা নিশ্চিত করতে মায়াকে পরিবার থেকে দূরে পাঠানো হবে। আরিফ বলা হবে মায়ার চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে সেখান থেকে চুপিসারে মায়ার বিয়েটা উনারা সেরে ফেলবেন। নাহিদ ভালো ছেলে ।মায়া স্বামী সঙ্গ পেলে প্রেমের ভুত মাথা থেকে সরে যাবে। দ্রুত সুস্থ হয়েও উঠবে।

চলবে।

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৫৬
দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল। আদ্র শীত ধরনী জুড়ে। মায়া বেলকনিতে বসে পড়ন্ত বিকালের ঐ হেলে পড়া আমগাছটার দিকে তাকিয়ে। অল্প বাতাসে গাছের পাতা গুলো নড়ছে মৃদু মৃদু। শরীর কাটা দিচ্ছে শীতে। তারপরও গায়ের একপাশের ওড়নাটা অবহেলায় পড়ে আছে ফ্লোরে বাকি অর্ধেকটা মায়ার অপর কাঁধে জড়িয়ে। শূন্যহাত দু’টো কোলে রেখে দৃষ্টি অদূরে বারান্দার সঙ্গে নড়ে পড়া আমগাছের ডালে। তক্ষুনি শব্দ বিহীন পায়ের এসে বারান্দার দরজায় দাঁড়াল জুই। অগোছালো মায়ার দিকে তাকাতেই নির্জীব মায়া জুইয়ের উপস্থিতি বুঝে নমনীয় গলায় বলল…

‘ ওরা আবার ঝগড়া লেগেছে?

মায়ার দৃষ্টি তখনো ঐ অদূরে আমগাছটায় আটকে। জুই অগোছালো মায়ার দিকে তাকিয়ে খুবই ধীর গলায় সম্মতি দিল…
‘ হুম।
‘ আরিফ ভাই কই?
‘ ভাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে রাগারাগি করে।
‘ওহ!
মায়া ‘ওহ’ বলা ছোট শব্দটাতে যেন ক্লান্তিতার প্রকাশ পেল। মায়া দীর্ঘ দিনের মানসিক পিরায় ভুগছে। কারও সাথে কথা বলে না আর না পরিবারের কারও কথার কোনো উত্তর দেয়। সবসময় চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মধ্যে আরিফ বা জুইয়ের সঙ্গে দুই একটা কথার উত্তর দেয়। বাকিদের সঙ্গে মায়া যথাসাধ্য চুপ করেই বসে থাকে। মায়াকে চুপ থাকতে দেখে জুই এগিয়ে এসে মায়ার ফ্লোরে পরে থাকা ওড়নাটা উঠিয়ে গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ আব্বা- চাচা, ফুপিরা সবাই আরিফ ভাইকে দোষ দিচ্ছে। বলছে ভাইয়ের জন্য নাকি তুই নষ্ট হয়েছিস। তোকে সামলাতে পারেনি। রিদ ভাইয়ের সাথে তোর প্রেম আছে সেটা জেনেও নাকি আরিফ ভাই তোকে সাপোর্ট করেছে। বাঁধা দেয়নি। ভাইয়ের জন্য নাকি তুই পাগল হয়েছিস। তোকে বিয়ে দিলে নাকি তুই আবার ভালো হয়ে যাবি স্বামীর সঙ্গ পেলে।

এসব রোজকার কথা। রোজই এসব শুনতে হয় মায়াকে। তাই জুইয়ের কথায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল মায়া। শুধু ঠান্ডা স্বরে জানতে চাইল আরিফের কথা…

‘ আরিফ ভাই কি বলেছে জুই?

জুই আগের নেয় মায়াকে প্রতিটা কথা জানিয়ে বলতে লাগল…

‘ আরিফ ভাই তোর বিয়ের ব্যাপারের কথা বলতে সবাইকে নিষেধ করেছে। বলেছে তুই বিবাহিত। তোর বিয়ে রিদ ভাইয়ের সঙ্গে হয়ে আছে। কিন্তু ঘরের কেউ বিশ্বাস করে নাই আরিফ ভাইয়ের কথা। তুই তো জানি সবাই তোর বিয়ের কাবিননামা চাই। কিন্তু আরিফ ভাই বা তুই, তোদের কারও কাছেই তো তোর বিয়ের কোনো প্রমাণপত্র নেই। এজন্য ফুপিরা বলছে তুই আর আরিফ ভাই মিলে নাকি যুক্তি করে সবাইকে মিথ্যা বলছিস যাতে তোকে কেউ অন্য কোথাও বিয়ে দিতে না পারে।

জুইয়ের পইপই সবগুলো কথা শুনেও মায়া প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু চোখ ভরা অশ্রু জড়াল। গাল ভিজে গেল নোনা জলে। হঠাৎ করেই মায়ার পরিবারের মানুষ গুলোকে কেমন পর মনে হচ্ছে। আর নিজের বোঝা। মায়া এই মূহুর্তে সবার কাঁধে বোঝা হয়ে আছে। নিজের পরিবার নাকি খুব আপন হয়। সকল বিপদে পাশে থাকে সবসময়। আজ মায়ার পরিবারও মায়ার পাশে আছে, তবে সমাজের কাছে সম্মান বাঁচানোর ভয়ে পাশে আছে। সবার ধারণা মায়া প্রেম করে পাগল হয়ে গেছে সেজন্য মায়াকে বিয়ে দিলে ওহ ভালো হয়ে যাবে। ওর স্বামী সবসময় পাশে থাকলে মায়া দ্রুত রিদ খানকে ভুলে গিয়ে প্রেম থেকে বেড়িয়ে আসবে। অথচ কেউ এটা বিশ্বাস করতে চাইছে না মায়া রিদের বিয়ে কথা বউ সেটা। মায়ার বিয়ে কাবিননামা নেই, সাক্ষী নেই, কাজি মৃত্য, তো কি হয়েছে? মায়া যে রিদ খানের বউ সেটাতো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না তাই না। মায়া মনে প্রাণে স্বামী হিসাবে মানে রিদ খানকে এবার কে কি বললো তাতে মায়া কি যায় আসে? মায়া তো বিশ্বাস করে রিদ খান মায়ার স্বামী হয়। আর এতেই চলবে মায়ার। সবাই মায়াকে উপর থেকে চাপ প্রয়োগ করছে অথচ কেউ মায়ার মনে অবস্থা জানতে চাইছে না। সবাই সবার দিকটা চিন্তা করছে অথচ কেউ মায়াকে জিগ্যেসা করছে মায়ার ভিতরটা কেমন করছে? রোজই একবার করে মায়াকে নিয়ে পরিবারের ঝামেলা হয়, এতে মায়া চেয়েও সুস্থ থাকতে পারে না। অসুস্থ হয়ে পরে বারবার। মায়ার ফুপিরা নানান ভাবে মায়াকে বুঝায়, রিদ খান বড়লোক ঘরের ছেলে সে মায়াকে ভালোবাসে না। শুধু মায়াকে ব্যবহার করবে। ছেলেদের ভালোবাসা ছলনা হয়। রিদ খান এখন এক্সিডেন্ট করেছে বলে মায়া বুঝতে পারছে না। যখন সুস্থ হয়ে দেশে আসবে তখন বুঝবে। সে আর মায়ার সাথে যোগাযোগ করবে না। কখনো মায়ার দিকে ঘুরে তাকাবে না এই ছেলে। বড়লোক ছেলেরা ধোঁকাবাজি হয়। মায়াকে সহজ সরল মেয়ে পেয়ে রিদ খানও এতোদিন ধরে ভালোবাসার নাটক করে গেছে মায়ার সাথে। আরও নানান কথা বলে রোজই মায়া বেইন ওয়াশ করতে চাই মায়ার ফুপিরা। তাঁরা চান মায়া দ্রুত সুস্থ হয়ে যাক। রিদ নামক ছেলেটার পিছন ছেড়ে দিক। বড়লোক ঘরের ছেলেরা আসলে মায়ার মতোন সহজ সরল ছোট ঘরের মেয়েকে বিয়ে করবে না সেজন্য উনারা চেষ্টা করছেন মায়াকে দ্রুত সুস্থ করে চেয়ারম্যান পরিবারের বিয়েটা দিয়ে দিতে। কতো ভালো পরিবার চেয়ারম্যানের। সঙ্গে নাদিম ছেলেটাও অনেক ভালো মায়াকে ভালো রাখবে। অথচ তাঁরা কেউ বুঝতেই পারছে না মায়া তাদের কথায় সুস্থ নয় বরং দিন দিন মানসিক সমস্যা ভুগছেন। মায়ার বুক ভরা হাহাকার কেউ শুনতে চাই না। সবাই শুধু নিজেদের কথা গুলোই মায়াকে শুনিয়ে যায়। মায়া অদূরে গাছের ডালে তাকিয়ে অশ্রু সিক্ত চোখে ভাঙ্গা গলায় বলল…

‘ আমি মনে করেছিলা গোটা দুনিয়া আমার পাশে আছে জুই। অথচ আমার এটা বুঝতে দেরি হলো যে আমার স্বামী ছাড়া আমার আমি বলতে আর কেউ ছিল না। কেউ না। আজ উনি নেই বলে আমার পাশটাও শূন্য। যদি উনি ফিরতে ফিরতে আমি মরে যায় তাহলে কেউ আমার খোঁজ করবে জুই? আমার স্বামীকে বলবে উনার বউ মৃত্য?

মায়া কথায় জুইয়ের চোখেও অশ্রু গড়াল। সত্যি আজ মায়ার পাশে আরিফ ছাড়া অন্য কেউ নেই। অথচ রিদ ভাই সুস্থ থাকাকালীন সবাই ছিল মায়াকে ভাবি ভাবি বলে ডেকে কতো খেয়াল রাখতো। আজ রিদ খান অসুস্থ বলে তার বউয়ের কদর নেই। নয়তো এতোদিনে রিদের পরিবার থেকেও মায়ার কেউ খোঁজ নিলো না। এতোদিনে আয়নের সাথেও জুইয়ের যোগাযোগ হয়নি। যোগাযোগ করবে বা কিভাবে জুইদের হাতের ফোনটা তো সেই কবেই নিয়ে গেছে ওদের পরিবার। সঙ্গে মায়া জুই দুজনের পড়াশোনাও বন্ধ করে রেখেছে। মায়াকে তো বিয়ে দেওয়ার জন্য বাসায় তোড়জোড় চালিয়ে দিচ্ছে রীতিমতো ফুপিরা। সম্মান নষ্ট হওয়ার আগে আগে মায়ার বিয়েটা নাদিমের সঙ্গে দিয়ে দিলে সম্মান বাঁচবে নয়তো মায়া প্রেমের কথা শুনলে এতো ভালো পরিবারের বিয়েটাও হারাবে সবাই। এতোকিছুর মাঝে জুইয়ের হাত পা বাঁধা। চেয়েও সে কোনো উপকার করতে পারছে না। জুই এই নিয়ে দুইদিন মায়ের হাতের থাপ্পড় খেয়েছে মায়ার পক্ষ ধরে কথা বলায়। সবার ধারণা মায়া জুই দু’টো নষ্ট হয়ে গেছে চট্টগ্রামে একা একা থেকে। জুই ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে চেয়ে মায়ার কাধে হাত রেখে বলল….

‘ এমনটা বলিস না মায়া। আমি আর ভাই দুজনই আছি তোর পাশে। তোর কিচ্ছু হবে না ইনশাআল্লাহ।

জুইয়ের কথায় মায়া বিষন্নতায় বলল…

‘ বিয়েটা আটকাতে পারবি তো জুই? আমি কিন্তু রিদ খানের বউ। বুঝেছিস?

‘ আরিফ ভাই থাকতে তোর বিয়ে কোথাও হতে দিবে না ভরসা রাখ।

জুইয়ের কথায় মায়া চুপ থাকলো। চুপ থাকলো বলতে মায়ার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করলো না মানসিক চাপাতলে। যতবার এসব নিয়ে আলোচনা হয় ততবারই মায়ার মাথা ভিষণ ব্যথা করে। যেমনটা এই মূহুর্তে হচ্ছে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ মায়া নিতে পারে না। অজ্ঞান হয়ে যায় নয়তো মাথা পেইন দেয় ভিষণ। আজ দুপুরের খাবার নিচে খেতে যায়নি মায়া। কারণ আজ বাসায় তিন ফুপি এসেছিল। উনারা যেদিন বাসায় আসে সেদিন বড়সড় রকমের একটা তর্ক চলবে আরিফের সঙ্গে। আরিফের জন্য উনারা মায়ার বিয়ের কথাটা আগাতে পারছে না নয়তো এতোদিনে কিছু একটা হয়ে যেত। মায়া উনাদের আসার আভাস পেয়েই সকাল থেকে রুমেই বসে ছিল। বারান্দায় বসে নিচ থেকে ভেসে আসা সকলের চেঁচামেচি শব্দ শুনেছিল। আরিফ কে গেইট ধরে রাগ বেড়িয়ে যেতে ওহ এখানে বসে দেখেছিল তারপর জুই আসলো। দুবোন কথা চলল কয়েক মুহূর্ত তারপর সবাই আবারও চুপ।
~~
আজকাল মায়াকে নিয়ে পরিবারের প্রায়ই তর্ক বির্তকের যুদ্ধ হয়। মায়া পক্ষ হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায় একা আরিফ আর মায়ার বিপক্ষে থাকে সকলেই। বিশেষ করে মায়ার চাচা, আর তিন ফুপি। পরিবারের কমবেশি সকলে মায়ার অবস্থার জন্য আরিফকে দোষী করে অথচ আরিফ সে-সব কখনো পাত্তা দেয় না। কারণ সে দেখেছে রিদের চোখে বোনের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা। আজ রিদ পাশে নেই বলে বড়ভাই হিসাব আরিফ যে তাদের ভালোবাসার পাশে থাকবে না সেটা তো নয় তাই না। মায়ার পরিবার নানান যুক্তি দেখায় খান বাড়ির বিরুদ্ধে। সবগুলো যুক্তি যে অহেতুক সেটা নয়। যুক্তিযুক্ত কারণই দেখায়। মায়ার পরিবারের ধারণা খান বাড়ির কেউ মায়াকে তাদের ছেলের যোগ্য পাত্রী বলে মনে করে না। আর না কখনো যোগ্য মনে করবে। বড়লোক ঘরের ছেলে রিদ খান তার জন্য বংশগত বড়োলোক ঘরের মেয়ে বউ করে আনবে খান বাড়ির লোক। অযথা মায়ার পিছনে সময় নষ্ট করবে না তাঁরা। তাছাড়া রিদ খান যদি সত্যি মায়াকে এতো ভালোবাসতো তাহলে ছেলে ভালোবাসার মান রাখতে এক্সিডেন্টের এতোদিন পর কেন ঐবাড়ির কেউ মায়ার খবর নিল না এখনো। কেন ছেলের এক্সিডেন্টের ত্রিশদিন পরও কেউ মায়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলো না। একমাস পযন্ত কি খান পরিবারের ছোট-বড় সবাই ব্যস্ত হয়ে আছে যে দুই মিনিট সময় নিয়ে ছেলের বউয়ের খোঁজ নিতে পারছে না। আসলে মায়া কারও বউ টই নই। বউ হলে অবশ্যই মায়ার খোঁজ নিতো ঐ বাড়ির মানুষজন। যে বিয়ের কাবিন নেই, স্বাক্ষী নেই, কোনো কিছু নেই সেখানে আবার কিসের বিয়ে? কাবিন, স্বাক্ষী ছাড়া কি বিয়ে হয় নাকি? আবার শুনেছে এই বিয়ের কাজীও নাকি জীবিত নেই, যত্তসব মিথ্যা কথা, মিথ্যা বাহানা। একটা বিয়ের কি সবকিছুই ঘায়েব হয়ে যায় নাকি? সামান্য একটা ছবিতো থাকবে দুজনের এই বিয়ের তাই না? সবসময় আরিফ বা মায়ার মুখে শুনে এসেছে যে মায়া বিয়ে হয়েছে রিদ খানের সঙ্গে কিন্তু কখনো প্রমাণ পাইনি। এই যুগে এসে কি কেউ মুখের কথা বিশ্বাস করে প্রমাণ ছাড়া? মুখে মুখে তো মানুষ মিথ্যাও বলে বেড়ায় যেমন মায়া নিজের প্রেমিকের জন্য পাগল হয়ে সবাইকে মিথ্যা বলে বেড়াচ্ছে বিয়ে নিয়ে। আর আরিফ বোনের কষ্টে অন্ধ হয়ে সেও মায়াকে সাপোর্ট করছে মিথ্যা রটানোতে। নয়তো আরিফ নিজেও তো প্রমাণ করতে পারছে না মায়ার কখনো রিদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সেটা নিয়ে। বসার ঘরে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল মায়ার তিন ফুপিদের মধ্যে। শুক্রবার হওয়ায় বাড়ির সকল ছেলেরায় আজ বাড়িতে। তবে এই সময় জুম্মার নামাজে গেছে বাড়ির পাশে মসজিদে। রেহানা বেগমের সঙ্গে জুইয়ের মা সাবিনা বেগম দাঁড়িয়ে হাতে হাতে রান্না ঘরের কাজ সারছেন স্বামী ভাসুরদের ফিরার আগে আগে। বাসায় এমনিই কলহের শেষ নেই। রান্নায় দেরি হলে যদিও আবার কেউ রেগে যায় তো? উনার স্বামী এমনই বারতের মতোন জ্বলে উঠে সবসময়। আজ আবার তিন বোনের আগমন হয়েছে এই বেলায়, এবার নিশ্চয়ই আবারও ঝামেলা হবে বাসায়। মায়াকে নিয়ে এটা-সেটা বলে ভাইদের কান ভরবে এখন। মায়ার ফুপিরা আবার একটু বেশি তেজি। ছুন থেকে পান খসতেই রেগে যান তাঁরা। জুইয়ের মা সাবিনা বেগম হাতে হাতে রান্না ঘরের কাজ শেষ করছেন আর বারবার অপরাধীর দৃষ্টিতে রেহেনা বেগমের দিকে তাকাচ্ছেন। নিজের ছেলে- মেয়েদের নিয়ে কেউ এতো সমালোচনা করলে কোনো মা-ই সহ্য করবে না কখনো। উনার একটা মেয়েই জুই। জুইকে নিয়ে বাসায় এতোকিছু হলে তিনি সেই কখন বাসায় কান্নাকাটি -চিৎকার করে মাথায় তুলে রাখতেন। অথচ রেহেনা ভাবি বড়ো ধৈর্যশীল মানুষ। আদুরের ছোট মেয়েকে নিয়ে সবার এতোকিছু বলার পরও আজ পযন্ত উনাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সাবিনা বেগম। বসার ঘর থেকে তিন বোনের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে রান্নাঘর পযন্ত। সাবিনা বেগমের কানে যখন কথা গুলো আসছে তখন নিশ্চয়ই বড়ভাবির কানেও যাচ্ছেন। আগে মায়াকে নিয়ে কেউ কিছু বললে চেতে উঠতেন তিনি কিন্তু আজকাল তিনি প্রতিক্রিয়া দেখান না চুপ থাকেন। সাবিনা বেগম ধারণা তিনি হয়তো মায়ার উপর ভিষণ রেগে আছেন তার জন্য চুপ থাকেন সবকিছুতে। সাবিনা বেগমের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝে হাতে ক্ষুন্তিটা তেলে ভাজার উপর চালাতে চালাতে হঠাৎই ঠাস করে ছেড়ে দেন রেহেনা বেগম। ভেজা হাতটা শাড়ির আঁচলের মুছতে মুছতে এগোল বসার ঘরের দিকে। রেহেনা বেগমকে বসার ঘরের দিকে যেতে দেখে আঁতকে উঠল সাবিনা বেগম। তৎক্ষনাৎ গ্রেসের চুলাটি বন্ধ করে তিনিও পিছন পিছন ছুটলো রেহেনা বেগমের। বড়ভাবি চেতেছেন মানে এখন নিশ্চয়ই ছোটোখাটো একটা যুদ্ধ চলবে। সাবিনা বেগম আজ বড় ভাবির পক্ষেই থাকবেন। এই তিনটা বোন সবসময় বাপের বাড়ি এসে বেশি জ্বালায়। উনারা কেউ কিছু বলতে পারে না স্বামীদের ভয়ে। আজ আর থেমে থাকবে না বড় ভাবির সঙ্গে তিনি এই বোনদের একটা বিহীত করবে।

‘ আমার মেয়ে খারাপ! আমি মেয়ে মানুষ করতে পারি নাই তারপরও আপনারা কেন আমার মেয়েটাকে রেহাই দিচ্ছিন না। মেয়েটার এতো অসুস্থতার মাঝেও কেন মেয়েটার উপর আপনারা এতো জুলুম করছেন? রোজ রোজ কেন আমার মেয়েটাকে নিয়ে আপনারা এই বাড়িতে ঝামেলা করেন? আপনাদের মানসিক টর্চারের জন্য আমার মেয়েটা সুস্থ হচ্ছে না। আল্লাহর ওয়াস্তে এবার আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন। ওহ ছোট মানুষ। বয়সের দোষী না-হয় একটা ভুল করে ফেলেছে তাই বলে আপনারা সবাই মিলে আমার বাচ্চা মেয়েটাকে সৌলে ছড়াবেন? আপনাদের তো মেয়ে আছে। তাহলে আমার মেয়ে সাথে কেন এতো জুলুম করছেন?

রেহেনা বেগমের কথায় চটে যায় তিন বোন। মায়ার তিন ফুপির মধ্যে ছোট ফুপি সালেহা বেশ তীক্ষ্ণ। তিনি সবকিছুতে কারণ বের করে যুক্তি দেখান। উনার কথা বাকি দুই বোন, দুই ভাই শুনেও বেশি। সালেহার দুই বোন ফাহেমা আর মাজিদা কিছু বলার আগে চেতে উঠেন সাহেলা বেগম। তিনি রেহেনা বেগমের কথায় চটে গিয়ে রেগে বললেন…

‘ আমাদের বাসায় মেয়ে আছে ভাবি তবে তোমার মেয়ে মতো মেয়ে আমরা পেটে ধরেনি। যে মেয়ে বাপ-দাদার নাম ডুবাবে! তোমার সম্মান তো আর যাচ্ছে না ভাবি তুমি হলে পরের মেয়ে। সম্মান নষ্ট তো হচ্ছে আমাদের বাপ-ভাইয়ের। বাইরে বের হয়ে ঘুরে দেখো, মানুষ কি বলে তোমার মেয়েকে নিয়ে? এক কান, দুইকান হতে হতে এখন সবাই বলাবলি করছে তোমার মেয়ে প্রেমে ছেঁকা খেয়ে বাড়িতে পাগল হয়ে বসে আছে। মেয়ে মানুষের একটু বদনাম হলে সমাজে চোখে পঁচে যায়। এই সমাজে মেয়ে মানুষের চরিত্র হতে হবে নিষ্পাপ কলঙ্কহীন। নয়তো ভালোঘরে বিয়ে দেওয়া যায় না। এই সমাজে পুরুষ মানুষ কলঙ্ক হয়না ভাবি। মেয়েরা হয়। তোমার মেয়ে আমাদের রক্ত তাই রক্তকে কেউ কিছু বললে শরীরে এমন-ই আগুন লাগে। সেজন্য চাচ্ছি মেয়েটার ভালো হোক। সময় থাকতে ভালোই ভালোই কারও সাথে মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলে মেয়েটা সুস্থ হয়ে যেতো, সঙ্গে এসব বদনামও দামাচাপা হয়ে যাবে। কিন্তু তোমাদের মা-ছেলের মতিগতি তো অন্য রকম। যতদিন মেয়েটা না পঁচে যায় ততদিন তোমাদের শান্তি নাই।

মায়ার ছোট ফুপি সালেহার কথার যুক্তি একেবারে ফেলার নয় বলে দাবি করলো বাকি দুই বোন। আমাদের সমাজে যথারীতি এমনটায় হয়ে যাচ্ছে আজও। মেয়েদের বদনাম হওয়া থেকে বাঁচাতে চাইলে জলদি জলদি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও নয়তো সমাজের মানুষ ছিঃ ছিঃ করবে। যেমনটা মায়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। মায়ার বদনাম সবখানে ছড়িয়ে পড়ায় সেজন্যই মায়ার ফুপি আর চাচারা মিলে চাচ্ছেন মায়াকে বিয়ে দিয়ে বদনামগুলো দামাচাপা দিতে। যদিও মায়া অসুস্থ তবে নতুন পরিবেশ আর স্বামী সঙ্গ পেলে মায়াও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে এমনটা সকলের ধারণা। সেজন্য এতোদিন ধরে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও রেহেনা বেগম চুপ ছিলেন তাদের সামনে। কিন্তু আজ আর চুপ থাকতে পারলো না। এই ভাই-বোনদের মানসিক চাপে কারণে উনার মেয়েটা দিন বা দিন আরও অসুস্থ হয়ে পরছে। উনার সুন্দর সুস্বাস্থ্য মেয়েটা একমাসে কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। মেয়েটা যদি একটা প্রেম করেই থাকে তাহলে ওকে অন্তত কয়েকটা দিন সময় দিতো এসব থেকে আস্তে আস্তে ফিরে আসার জন্য। তা-না করে সবাই মেয়েটাকে ঘরবন্দী করে আরও চাপ প্রয়োগ করছে। মা হয়ে তিনি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। উনার হাসিখুশি মেয়েটা সবসময় চুপচাপ বসে থাকেন। কারও সাথে কথা বলে না। ঠিকঠাক খাই না। অঘুমে সারারাত চেয়ে থাকে। বারবার অজ্ঞান হয়ে যায়। অকারণে কাঁদে এসব কি এদের কারও চোখে পরে না? শুধু লোক দেখানো সমাজের কাছে বদনাম হওয়ার ভয়ে উনার জীবন্ত মেয়েটাকে তিলে তিলে মেরে ফেলবে এরা? আজ আরিফ মায়ার পাশে না থাকলে সবাই মিলে পি*ষে মে*রে ফেলতো এরা। উনার মেয়ে পঁচে গেলে যাক। উনার পঁচা-গলা মেয়েকে সারাজীবন বুকে আগলিয়ে রাখবেন তিনি, তারপরও মা হয়ে আজ তিনি আর চুপ থাকবে না। দরকার হলে মেয়েকে নিয়ে তিনি স্বামীঘর ত্যাগ করবেন তারপরও আজ এর একটা বিহীত করেই ছাড়বেন।

‘ আমরা বুঝি মেয়ের ভালো কোনটাতে হবে। সমাজে বদনাম হলে হোক, আমার অসুস্থ মেয়েটাকে এখন আমি বিয়ে দিব না আপনারা যত যাই কিছুই বলুন না কেন। আমার মেয়ে পঁচে গেলে যাক। আমার পঁচা মেয়েকে নিয়েই আমি ভালো আছি। দরকার হলে মেয়েকে নিয়ে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আপনাই আপনাদের বাড়িতে সম্মান বাঁচিয়ে থাকুন।

‘ তোমার যাওয়ার হলে তুমি একা যাও ভাবি। মেয়ে তোমার একার না। এই বাড়ির মেয়ে মায়া। সে আমাদের রক্ত হয়। আমরা আমাদের মেয়ের ভালোমন্দ বুঝব। এই সমাজের তুমি তো আর কেউ না। আর না তোমার বাপ-ভাইয়ের কোথাও সম্মান যাচ্ছে। মা হয়ে খেয়াল করছো মেয়েটা যে দিন দিন আরও পাগল হয়ে যাচ্ছে সেটা?

সালেহা বেগমের মুখে বারবার মায়া পাগল সেটা শুনতে রাগে চেতে উঠেন রেহেনা বেগম। উনার মেয়ে পাগল না। এই পরিস্থিতিতে একটু মানসিক চাপে আছে। তবে মায়া সবকিছু ঠিকই শুনতে, বুঝতে পারে। অথচ এই তিন বোন মিলে সবসময় উনার ভালো মেয়েটাকে পাগল বলে বেড়ায়। রেহেনা বেগম সালেহা বেগমের কথায় চেতে উঠে বললেন…

‘ আমার মেয়ে পাগল না। ওহ সুস্থ। আপনারা সবাই মিলে আমার ভালো মেয়েটাকে বার বার পাগল বলে বলে ওকে পাগল বানাচ্ছেন। আপনাদের জন্য আমার মেয়েটা সুস্থ হচ্ছে না। আপনারা এর জন্য দায়ি।

কাটা গায়ে নোনের ছিঁড়ার মতোন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো সালেহা বেগম। রেহেনা বেগমের কথায় কষ্ট পেয়ে চোখে পানি ছেড়ে বলল…

‘ আমরা তোমার মেয়েকে পাগল বানাচ্ছি ভাবি? আমরা? এটা তুমি বলতে পারলে? মায়া কি আমাদের মেয়ে না? আমাদের রক্ত না ওহ? আমরা কি ওর ক্ষতি চাইবো কখনো? আমরা চাইনা ওহ দ্রুত সুস্থ হয়ে যাক? তুমি কিভাবে বললে আমরা মায়াকে পাগল বানাচ্ছি? এতো ডাক্তার? এতো ঔষধাদি জন্য দৌড়াদৌড়ি কে করছে? আমি করছি না? তাহলে আজ তুমি কিভাবে বললে আমি মায়ার অসুস্থতার জন্য দায়ী? তোমার মেয়ে কি সারাদিন ঘরে শুয়ে-বসে থাকলে ভালো হয়ে যাবে ভাবি? ওকে নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ দিতে ডাক্তার বলেছে সেজন্য ওকে আমরা বিয়ে দিতে চাইছি অথচ তুমি আজ আমাদের দোষী করছো সবকিছুর জন্য?

সালেহা বেগমের কথা শেষ হতে না হতে বসার ঘরের উপস্থিত হলো আরিফ, শফিকুল ইসলাম আর জুইয়ের বাবা সাজিদুল ইসলাম। তিনজনে গায়ে পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি। বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনজনই শুনেছে সালেহা বেগমের আবেগময় কথা। শফিকুল ইসলাম গম্ভীর চোখে বউ আর বোনদের দিকে তাকালেও সাজিদুল ইসলাম তৎক্ষনাৎ রেগে যায় বোনের চোখে পানি দেখে। রেহেনা বেগম সম্পর্কে বড়ভাবি হই বলে বেয়াদবি করা ঠিক হবে না এজন্য তিনি বাসার সবার উদ্দেশ্য রেহেনা বেগমকে কটাক্ষ করে বললেন….

‘ এই ঘরে পুরুষরা এখনো জীবিত আছেন। মরেনি কেউ। তাই এই বাড়িতে মহিলা সরদারের প্রয়োজন নেই। আমরা পুরুষরা সব মরে গেলে তখন না-হয় মহিলা সরদারে ঘর চলবে।

মায়ার প্রতি হওয়া অন্যায় থেকে দীর্ঘসময়ের রাগ ভিতরে পুষে রেখেছিল রেহানা বেগম। আজ পযন্ত তিনি স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করেননি। কিন্তু আজ যেন উনার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। উনার ছোট মেয়েটার প্রতি যে অন্যায় হচ্ছে সেটা বাবা হয়ে কিভাবে শফিকুল ইসলাম চুপ থাকেন শুধু লোক দেখানো সমাজের ভয়ে? রেহেনা বেগম আজ থেমে থাকবে না। সাজিদুল ইসলামের কথায় তৎক্ষনাৎ উত্তর করে বললো…

‘ এই ঘরের বউরা সত্যি কথা বললে মহিলা সরদার হয়ে যায়। আর এই বাড়ির মেয়েরা সরদারি করলে তখন ঠিক আছে। তখন কেউ মহিলা সরদার হয় না। আমি এই বাড়ির পুরুষ-মহিলা কারও সরদারি মানবো না। কেউ আমার বাচ্চা মেয়েটার উপর জোর করলে আমি তখন স্বামী-সমাজ, দেবর কাউকে মানবো না।

সাজিদুল ইসলাম আগের নেয় রাগান্বিত গলায় বললেন…

‘ আপনার মেয়ে যখন আমাদের জন্য কাঁধে করে বদনাম বয়ে আনছিল তখন আপনি কই ছিলাম? তখন কেন বুঝালেন না মেয়েকে? আপনার মেয়ের জন্য বাহিরে মুখ দেখাতে পারছি না আমরা। আপনি আমাদের থেকে ভালো এই বাড়ির মেয়ের কথা চিন্তা করবেন না। আমরা বুঝবো আমাদের মেয়ের সঙ্গে কি করা লাগে। আপনি বরং আপনার সংসার সামলান। বাকিটা এই বাড়ির পুরুষরা সামলিয়ে নিবে।

সাজিদুল ইসলামের কথায় আরিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথার টুপিটা পকেটে গুঁজাল। রোজ রোজ একই বিষয়ে বাপ-চাচার সঙ্গে তর্ক করতে করতে আজ সে ক্লান্ত। তাই সে একটা ডিসিশন নিয়েছে। এই বাড়িতে থাকলে মায়া আর ভালো হয়ে উঠবে না। আর না কখনো এই বাড়ির পরিস্থিতি ঠিক হবে। মায়ার সুস্থতার কথা চিন্তা করে হলেও আরিফকে এই বাড়ি, এই পরিবেশ ত্যাগ করতে হবে। অন্তত যতদিন না রিদ খান সুস্থ হয়ে বাংলাদেশে ফিরছে ততদিন আরিফের সঙ্গে মায়াকে রাখবে। এই বাড়িতে আর ফিরবে না সে। এই বাড়ির পরিবেশ অসুস্থ হয়ে গেছে। আরিফ হাতে টুপিটা পকেটে গুঁজাতে গুঁজাতে রেহেনা বেগমকে ডেকে সকলের উদ্দেশ্যে বলল…

‘ আম্মু সামনের সাপ্তাহ মায়াকে নিয়ে আমি চট্টগ্রামে ফিরবো। মায়া এই পরিবেশে থেকে সুস্থ হবে না। এই বাড়ির পরিবেশ অসুস্থ আর নোংরা হয়ে গেছে। এখানে শ্বাস ফেলতেও দমবন্ধ হয়ে আসে। তুমি চাইলে আমার সাথে যেতে পারো। অন্তত তোমার স্বামী সংসার থেকে ছেলের ভাড়া ঘরে সম্মানে থাকবে আম্মু। যদি ছেলে-মেয়ের সাথে যেতে চাও তাহলে রেডি থেকো। এক কাপড়ে এঘরে থেকে নিয়ে যাব। আজই তোমাদের নিয়ে যেতাম কিন্তু আজ রাতে আমাকে ইন্ডিয়া যেতে হবে কয়েকদিনের জন্য। আমাকে ছাড়া অপরিচিত পরিবেশে তুমি মায়াকে নিয়ে হিমসিম খাবে বলে আর কয়েকটা দিন কষ্ট করে এই বাড়িতে থেকে যাও আম্মু। জরুরি না হলে তোমাদের ছেড়ে আজ কখনো যেতাম না। তুমি যাবে আমার সাথে আম্মু?

ছেলের কথায় টলমল করা চোখে পানি শাড়ি আঁচলে মুছতে মুছতে রেহেনা বেগম বললেন….

‘ আমি অবশ্যই আমার ছেলের সঙ্গে যাব বাবা। আমার ছেলে-মেয়ে যেখানে থাকবে আমি সেখানেই থাকব। এঘরে আমার কোনো প্রয়োজন নেই আর।

মা- ছেলের কথায় চেতে উঠলেন সবাই। শফিকুল ইসলাম, সাজিদুল ইসলাম দুই ভাই যখন আরিফের বিরুদ্ধতা করবে তার আগেই আরিফ ক্লান্তিতা টেনে শান্ত গলায় বাপ-চাচার উদ্দেশ্য বললো….

‘ আমি বড্ড ক্লান্ত আব্বা। আর ঝামেলা ভালো লাগছে না। এই বাড়ির পরিবেশে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পরছি। প্লিজ আজ আর না। মা-বোন দুজনকে আমার সাথে নিয়ে যাব আগামী সাপ্তাহে। যদি আপনাদের কিছু বলার বা করার থাকে তাহলে বলবো আগে এই বাড়ির পরিবেশ ঠিক করেন নয়তো আমাকে আটকাতে পারবেন না।

কথা গুলো বলেই আরিফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রেহেনা বেগমের দিকে। শান্ত স্বরে আবারও বললো….

‘ কাল মায়ার বান্ধবী রাফা নামের একটা মেয়ে চট্টগ্রাম থেকে আসবে আম্মু। মেয়েটা মায়ার খুব ভালো বান্ধবী। আমাকে ভাই ভাই বলে ডাকে। মেয়েটার খেয়াল রেখো। মায়ার সাথে রাফা থাকলে মায়ার মনটা ভালো থাকবে।

ছেলের কথায় রেহেনা বেগম সম্মতি জানাতেই আরিফ সবাইকে অপেক্ষা করে নিজের ঘরের দিকে চলল। আরিফ চলে যেতেই রেহেনা বেগমও রান্না ঘরের ঢুকে গেল। পিছন পিছন সাবিনা বেগমও গে সেইদিকে। উপস্থিত পাঁচ ভাইবোন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তাকাল। শফিকুল ইসলাম গম্ভীর মুখে বসার ঘর ত্যাগ করতে, সাজিদুল ইসলাম এগোল বোনদের দিকে। আরিফ নিজের ঘরে যেতে যেতে শুনল ফুপিদের কথাবার্তা চাচার সঙ্গে। ওরা আবারও মায়ার বিয়ের বিষয়টা টেনে আলোচনা করছে। আরিফ বুক ফুলিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এখানে সেও একটা মস্ত বড়ো ভুল করেছে। যেদিন রিদ মায়ার বিয়ের সম্পর্কে সে শুনেছিল সেদিন যদি সে রাগ করে না থেকে বরং রিদ-মায়ার বিয়ের সত্যায়িত যাচাই-বাছাই করতো তাহলে আজ এতো কথা শুনতে হতো না। প্রমাণ দেখিয়ে বাড়ির সবাইকেও চুপ করিয়ে দিতো। আরিফ রিদ মায়ার বিয়ের সম্পর্কে যতটুকু জানে সবটা সে মায়ার মুখেই শুনেছে। কারণ রিদ এক্সিডেন্ট হওয়ার আগে সেও দুজনের বিয়ের বিষয়টা ঐভাবে ঘেঁটে দেখেনি। আদৌও রিদ-মায়ার বিয়ে হয়েছে কিনা কিংবা তাদের কাবিননামা আছে কিনা? কোথায় দুজনের বিয়ে হয়েছিল সে কিছুই জানতো না। পারিবারিক ঝামেলায় এখন মায়ার মুখে সব শুনতে পারলো আসলে রিদ-মায়ার বিয়ের কোনো কাবিন,কাজি কোনো প্রমাণই নেই। আর প্রমাণ ছাড়া যে পরিবারকে কখনো বুঝাতে পারবে না সেটাও জানে আরিফ। মায়ার বিয়ের কাবিন নামার একটা কপি অন্তত রিদ থেকে নিয়ে আরিফের কাছে রাখা দরকার ছিল। আরিফ জানে রিদ কখনো মিথ্যা বলবে না। সে যখন বলেছে রিদ-মায়ার বিয়ে হয়েছে তারমানে বিয়েটা সত্যি সত্যি হয়েছিল। কিন্তু মুখের কথায় তো আর পরিবারকে বুঝানো যাবে না সেজন্য আরিফের খুব করে মনে হলো মায়ার বিয়ের কাবিন নামাটা অন্তত রাখা দরকার ছিল তার। এর মাঝে আরিফ আবার আসিফকেও কল দিয়েছিল জানতে তাঁর কাছে রিদ-মায়ার বিয়ের কাবিননামার বা অন্য কোনো ডকুমেন্টস আছে কিনা। ব্যস্ততার আসিফ জানায় রিদের পার্সোনাল ডকুমেন্টস রিদ নিজের কাছে রাখে এসব আসিফ বা বাড়ির অন্য কারও কাছে পাওয়া যাবে না। হতাশার আরিফ তারপর থেকে আসিফের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে আসলো। রিদের খবর জানতে চাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা হতো না তাদের মাঝে। রিদের জ্ঞান এখনো ফিরল না। আজ একমাস হতে চলল। তবে এর মাঝে দুই একদিন রিদের বডিপার্ট অল্পসল্প নড়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলে শুনা যায়। ডাক্তার আশা করছেন খুব দ্রুত রিদের হুশ ফিরে আসবেন। তবে মায়া রিদের কোনো খবর জানে। সেদিন রাতেই আরিফ ইন্ডিয়া চলে যায় ব্যবসায়ীক কাজে। পরদিন আর রাফা আসলো না। রাফা আসলো আরও দুইদিন পর। ঘটনাটি রাফা আসার একদিন আগে আর রিদের এক্সিডেন্ট হওয়ার বত্রিশদিনের মাথায় এক সন্ধ্যায় মায়া নিজের রুমে বসে ছিল। তক্ষুনি হাতে ভাতের প্লেট চেপে কক্ষে ঢুকলো মায়ার মা রেহেনা বেগম। মায়ার উপর উনার অসীম রাগ। যেটা চোখে মুখে ফুটে উঠেছে উনার। বাসায় আজ আবার মায়া তিন ফুপি এসেছিল। তবে তারা বাসায় তেমন কোনো ঝামেলা না করলেও রেহেনা বেগমকে যা নয় তা শুনিয়ে গেছেন মায়ার জন্য। তিনি সন্তান মানুষ করতে পারেন নি এজন্য স্বামী, দেবর, ননদীরা সকলেই উনাকে কথা শুনিয়ে চলে আজকাল। বিয়ের এতোবছর পর এসে মেয়ের জন্য এইভাবে সকলেই কাছে অপমানিত হতে হবে সেটা সত্যি লজ্জাজনক। উনার মেয়ে না-হয় ছোট বলে প্রেম করেই ফেলেছে সেজন্য মেয়েকে সৌলের আগায় রাখছে সকলে। উনার মেয়েটা যে অসুস্থ সেই খেয়াল রাখছে কেউ। ফাঁসির অপরাধী সাথেও এতো জুলুম করে না যতোটা চাপ উনার মেয়ের উপর করছে। তার উপর আবার উনার বড়মেয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে আজ বাপের বাড়িতে এসেছে উঠেছেন। মায়ার জন্য নাকি মুক্তার সংসার ভাঙতে চলেছে এজন্য আবার নতুন করে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে এই বাড়িতে।
উনার মেয়েদের উপর থেকে যেন বিপদ কাটছেই না। একটা পর একটা বিপদ এসে পরছে এই বাড়িতে। আজ আরিফও বাড়িতে নেই যে মায়ার হয়ে কথা বলবে? একা উনি কারও সাথে কথায় পেরে উঠে না। আল্লাহ তুমি উনার মেয়ের উপর সহায় হও। এসব বিপদ থেকে উনার মেয়েদের দ্রুত কাটিয়ে উঠার তৌফিক দান করুক আমি। মনে মনে আমিন বলেই রেহেনা বেগম চোখ ভরা পানি নিয়ে মায়ার কক্ষে ঢুকার আগে শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছে একহাতে ভাতের প্লেট আর অন্য হাতে পানির গ্লাস নিয়ে ঢুকলো ঘরে। মায়া জুই খাটের দুইকোণায় বসেছিল। রেহেনা বেগমের উপস্থিতে দুজন তাকাল উনার দিকে। উনি রাগী ভঙ্গিতে মায়ার দিকে এগোল। হাতের গ্লাসটা ঠাস করে কর্ণার টেবিলে উপর রেখে ভাতে প্লেটে হাত দিলো। মায়ার পছন্দের মাছ ভাত নিয়ে এসেছেন তিনি। মেয়েটা খাবার একেবারেই খায় না। নিচেও যায় না। রেহেনা বেগম ভাত মাখোঁ মাখো করে মায়ার মুখে দিতে দিতে তিক্ত গলায় বললেন তিনি….

‘ আমি একটা নষ্টা মেয়ে পেটে ধরেছি। ছোট বয়সে পড়ালেখা না করে নাগর ধরছে। সবাই ঠিকই বলে সবদোষ আমার পেটের। মেয়েকে শিক্ষা দিতে পারেনি সেজন্য পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা না করে বেডার জন্য পাগল হয়ে ঘরে বসে আছে। আমারে মানুষ থুথু করে যায়। আসলে আমি মানুষের থুথু ফেলারই যোগ্য। একটা পাপ পেটে ধরেছি আমি। মানুষ যেন এমন পাপ আর জম্ম না দেয় কেউ।

মুখে ভাত নিয়ে মায়া চোখ টলমল করে উঠলো মায়ের কথায়। রেহেনা বেগম ফের মায়ার মুখে ভাত ঠুসে দিতে দিতে রাগে দুঃখে কষ্টে কান্না করতে করতে বললেন….

‘ সবাই বলে তুই নাকি পাগল হইয়া ঘরে বসে আছিস বেড়ার জন্য। আর বড়টার সংসার ভাঙতে চলছে তোর জন্য। তুই যে বেড়ারে পছন্দ করিস ঐছেলে আরেকটা প্রেমিকা আছে নাকি শশী নামে। ঐ মেয়ের মা আইসা মুক্তার শশুর বাড়িতে হামলা করছে। মুক্তার গায়েও হাত তুলছে সেজন্য স্বামী ঘর ছাইড়া বাপের আইয়া উঠছে তোর বোন। তোর ছোট চাচা মুক্তারে নিইয়ে গেছে ওর শশুর বাড়ির নামে মামলা করতে। আজ তোর জন্য আমার সুন্দর সংসারটার আগুন লাগল। না তুই ঐ ছেলের পিছনে যেতি আর না মুক্তার সংসারটা ভাঙতো। তুই পাগল না হয়ে একেবারে মরে গেলেও তো পারতি। সবাই শান্তিতে থাকতো। তুই মরে যাহ নয়তো আমাকে মেরে ফেল।
রোজ রোজ এতো অশান্তি আর ভালো লাগছে না।

মায়ের কথায় মুখে ভাত নিয়েই মায়া ডুকরে কেঁদে উঠলো। অসুস্থ মায়ার সারা শরীর মূহুর্তে তরতর করে কেঁপে উঠতে মুখে ভাত নিয়ে মায়া শুধু কোনো রকমে ডাকলো রেহেনা বেগমকে….

‘ আম্মু! আম্মু! আম্মু!

জুই পাশে থেকে এসে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো মায়াকে। রেহানা বেগমকে বাঁধা দিয়ে বলল…

‘ এসব কি বলছেন বড়আম্মু? মায়া মরবে কেন এখানে মায়ার কি দোষ?

রেহেনা বেগম হাত ঝাড়া দিয়েই মায়ার থেকে জুইকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ তুই ওর থেকে দূরে থাকবি জুই। নয়তো তুইও ওর মতোন খারাপ হয়ে যাবি। যা তুই মুক্তার রুমে যাহ।

জুই জেদ্দি গলায় বলল…
‘ না আমি যাব না। এখানেই থাকব।

রেহেনা বেগম জুইয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে পরপর ভাতের লোকমা ঠুসে ঠাসে ঢুকালো মায়ার মুখে। মায়ার ডুকরে কান্নায় ভাত চিবুতে পারছিল না নাক-মুখে কাশি উঠে যাওয়াতে তিনি হাতের কাছে গ্লাসটা উঠিয়ে মায়ার মুখে ধরলো। মায়ার মুখ চেপে পানিটা খাওয়াতে খাওয়াতে মায়া মুখে ভাত নিয়েই জ্ঞান হারাল শরীর কাঁপতে কাঁপতে অতিরিক্ত মানসিক চাপে। রেহেনা বেগমের রাগ তক্ষুনি মাটি হয়ে গেল মায়াকে জ্ঞান হারাতে দেখে তিনি দ্রুততায় হাতের প্লেট আর গ্লাসটা টেবিলে রেখে মায়াকে ধরতে চাইলে তার আগেই জুই মায়ার কাছে এগিয়ে আসে। রেহেনা বেগম জুইয়ের কাছ থেকে মায়াকে ছিনিয়ে নিতেই হুহু করে ডুকরে কেঁদে উঠলো বুক ফাটা আর্তনাদে। উনার ছোট মেয়েটা সবচেয়ে আদুরের আর যত্নে ছিল। কখনো ফুলের টোকা দেয়নি। আজ কতো ঝড়ঝাপটা যাচ্ছে এই মেয়েটার উপর। মেয়েটা মানসিক ভাবে অসুস্থ অতিরিক্ত চাপ নিতে পারে তারপরও কেউ একটা দিন রেহাই দেয়না মেয়েটাকে। সারাক্ষণ মেয়েটাকে নিয়ে কতো কথায় হয় বাসায়। সবসময় উনার স্বামী আর দেবরের কান ভরে রাখে উনার তিন ননদ যার জন্য উনাকেও এটাসেটা শুনতে হয়। উনি তারপরও মেয়েকে কিছু বলে না নিরবে চুপ করে থাকেন কিন্তু আজ যখন বড় মেয়ে মুক্তা সংসার ভাঙতে চলল মায়ার জন্য তখন তিনি আর রাগটা চেপে রাখতে পারেননি। যা নয় তা বলে ফেলেছে অসুস্থ মেয়েটাকে। কিন্তু তিনিও বা কি করবেন? বড় মেয়ের সংসারটা তো শেষ। এবার ছোট মেয়ের জীবন যাবে এই ঝড়ঝাপটা। ঠিকঠাক ঔষধ পযন্ত খাচ্ছে না মেয়েটা। এতো অশান্তিতে এমনই মারা যাবে উনার মেয়ে।
~~
কুঞ্জিত কপালে ভাজ সোজা হলো তৃতীয় বারের মতোন ওপাশের কলটি অকারণে ডিসকানেক্ট হয়ে যাওয়ায়। কান থেকে ফোন নামিয়ে উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে তাকাতে আয়নের কুঞ্জিত কপালে ভাজে ভাজে টেনশনে বলিরেখা দেখা দিল। বিগত এক সাপ্তাহ ধরে আয়ন বাংলাদেশে জুইয়ের কাছে মিলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বরাবরই তার কলটি ডিসকানেক্ট হয়েছে যাচ্ছে অকারণে। লন্ডনে আসার পর থেকে রিদকে নিয়ে ব্যস্ততার জন্য মায়া বা জুই দুজনের কারও খোঁজ নিতে পারেনি আয়ন। টেনশনে টেনশনে মাথা থেকে ছুটে গিয়েছিল আয়নের কাছে বাংলাদেশের কারও খোঁজ তার কাছে নেই। যদি পরিবারের সকলেই এখন লন্ডনে আছে বাংলাদেশে তেমন কেউ নেই খোঁজ নেওয়ার মতো সেজন্য হয়তো আয়নের রিদের টেনশনে টেনশনে মনে ছিলনা জুইদেরও খোঁজ নেওয়া তার দরকার। আসিফের সঙ্গে তার প্রায় কথা হয়। আয়ন আসিফের থেকে বেশ কয়েকবার মায়া জুইয়ের খবর নিয়েছে সে। আসিফ বরাবরই বলেছে তারা নাকি ভালো আছে। মায়া নাকি একটু অসুস্থ বাকি সব ঠিক আছে। স্বামী এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুকলে পরে থাকলে বউ হিসাবে মায়া যে টেনশনে টেনশনে অসুস্থ হয়ে যাবে সেটার ধারণা আয়নের আছে। তবে মায়া কতটা অসুস্থ সেই খবর আয়ন জানে না। আয়নের তথ্য অনুযায়ী আসিফও মায়া বা জুইয়ের সঠিক খবর জানে না। আরিফের সঙ্গে আসিফের যোগাযোগ হয়। সেখান থেকেই সাপ্তাহে দুই একবার কল করে মায়ার খবর নেওয়া হয় হয়তো। অথবা আরিফ রিদের অবস্থা জানতে চাইলে তখন হয়তো আসিফও ফাঁকে ফাঁকে আরিফ থেকে মায়ার কেমন আছে সেটা জেনে নেই। সবাই ভালো আছে এইতোটুকু খবর আপাতত লন্ডনে এসে পৌঁছায়। আজ বিগত তেত্রিশ দিন হতে চলল লন্ডনে শহরে আছে ওরা। এই তেত্রিশ দিনে আয়নের সঙ্গে জুইয়ের যোগাযোগ হয়নি। আয়ন বিগত এক সাপ্তাহ ধরে চেষ্টা করছে জুইয়ের হাতের ফোনটায় কল মিলানোর কিন্তু দুঃখজনক ভাবে প্রতিবারই কল কাট হয়ে যাচ্ছে। আয়ন চিন্তিত মনে তৎক্ষনাৎ কল মিলাল আসিফকে। কয়েক সেকেন্ড রিং হতেই ফোন রিসিভ করলো আসিফ। আয়নকে সালাম দিয়ে বলল…

‘ আসসালামু আলাইকুম আয়ন ভাই।

‘ ওয়ালাইকুম সালাম। ঐদিকে কি অবস্থা আসিফ? সবকিছু ঠিকঠাক আছে? কোম্পানি কি অবস্থা?

‘ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছে ভাই। রিদ ভাই নেই সেজন্য কোম্পানি চালাতে হিমসিম খাচ্ছি। নতুন কোনো প্রজেক্টের কাজ নিচ্ছে না আগের যা ছিল ঐগুলা কাজ চলছে আপাতত। বাকিটা ভাই সুস্থ হয়ে আসলে দেখা যাবে। নিহাল স্যার কবে দেশে ফিরবেন কিছু জানেন ভাই?

আয়ন বলল..

‘ এই সাপ্তাহই হয়তো আসতে পারে উনার ব্যবসায়িক আর রাজনৈতিক কাজে। চট্টগ্রামে কিছুদিন থাকবে তারপরও ঝামেলা মিটে গেলে আবার রিটার্ন এখানে ফিরবে নাকি। শুনলাম রিটার্ন টিকেট করেছে নাকি।

আসিফ ক্লান্তিময় হতাশ গলায় বলল…

‘ এখন বাংলাদেশে নিহাল স্যারের খুব প্রয়োজন আয়ন ভাই। বাংলাদেশে খুব ঝামেলার মধ্যে যাচ্ছি ভাই। আমি একা দু’টো কোম্পানি আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একা সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছি। নির্বাচনের অবস্থাও খুব গরম। খান বাড়ির কাউকে বাংলাদেশের উপস্থিত না পেয়ে এই দন্ড আরও বাড়ছে আয়ন ভাই। অন্তত নিহাল স্যারকে আপনি বুঝিয়ে বলুন দ্রুত বাংলাদেশে আসতে। উনার খুব প্রয়োজন এখানে।

আয়ন আসিফের কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনে বলল…

‘ আচ্ছা আসিফ? রিদের এক্সিডেন্ট কারা করেছিল খবর পেয়েছিস কিছু?

আসিফের উত্তর আসলো তৎক্ষনাৎ। বলল…

‘ জ্বি ভাই পেয়েছি তো। সব তথ্য রিদ ভাইয়ের আম্মার কাছে জমা আছে। উনি বলেছেন আর কাউকে এসব তথ্য না দিতে। এমনকি নিহাল স্যারকেও না জানাতে বলেছে কারা জড়িত আছে রিদ ভাইয়ের এক্সিডেন্টেট পিছনে। যা করার ম্যাডার দেশে ফিরে নাকি করবেন। আপাতত এসব বিষয়ে চুপ থাকতে বলেছেন। নিহাল স্যার বাংলাদেশে আসলেই বুঝতে পারবেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতোটা গরম হয়ে আছে। এই মূহুর্তে রিদ ভাইকে খুব প্রয়োজন পরতো নিহাল স্যারের।

আয়ন আসিফকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল…
‘ আমরা আছি তো আসিফ! আল্লাহ ভরসা আমরা মামার পাশে থাকবো। রিদের অবস্থা একটু ভালো হলেই বাংলাদেশে ফিরার চেষ্টা করবো আমি।

‘ জ্বি ভাই।
আয়ন মৃদুস্বরে ডেকে বলল…
‘আসিফ

‘ জ্বি ভাই।

‘ মায়া কোনো খবর জানিস?
‘ না ভাই।
‘ আরিফের সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই?
‘ আছে ভাই। কিন্তু লাস্ট পাঁচ-ছয়দিন তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না ব্যস্ততায়। একটু বেশি ব্যস্ততা দিন যাচ্ছে ভাই। সেজন্য কারও খবর নিতে পারিনি। কেন ভাই কোনো সমস্যা?

‘ না সমস্যা না। এমনি আরকি। আমি ফোন দিচ্ছিলাম মায়াদের হাতের নাম্বারে কিন্তু কল যাচ্ছে না। হয়তো নাম্বার অফ করে রেখেছে। তুই একটু আরিফকে কল দিয়ে জিজ্ঞেসা করতো ঐ বাড়ি সবাই কেমন আছে।

‘জ্বি ভাই এক্ষুনি কল দিয়ে দেখছি আমি।

আয়নের কল কেটে যেতেই আসিফ আরিফকে কল মিলাল। কিন্তু ওপাশ থেকে প্রথমবারের মতোন আরিফের নাম্বারটি বন্ধ পেতেই চিন্তিত কপাল কুঁচকালো আসিফ। প্রথম বার কল কেটে যেতেই আসিফ দ্বিতীয় বার কল মিলাল একই নাম্বারে, কিন্তু পুনরায় একই কথা বলাতে কল কেটে আসিফ তৎক্ষনাৎ কল মিলাল আয়নকে। ওপাশের আয়ন ফোন হাতে নিয়েই বসেছিল। আসিফের কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো সেটি। আয়ন কিছু বলবে তার আগেই আসিফ বলল…

‘ আয়ন ভাই আরিফের নাম্বার তো বন্ধ বলছে। ফোন যাচ্ছে না।

আসিফের কথায় আয়নের মাঝে টেনশনের অস্থিরতা দেখা দিল। প্রথমে জুইদের ফোন আর এখন আরিফের ফোন বন্ধ বলছে। কোনো বিপদ হয়নি তো ঐ বাড়ির কারও। অথচ আয়ন আসিফ দুজনের কেউ তখনো জানতো না আরিফ ইন্ডিয়াতে গেছে দুইদিন হলো।
আয়ন অন্তত চিন্তিত সুরে বলল…

‘ কাউকে আশুগঞ্জ পাঠাও আসিফ। ঐ বাড়ির সবার খোঁজ নাও প্লিজ। কারও কোনো বিপদ হয়েছে কিনা একটু খোঁজ নিয়ে দেখো।

আসিফ সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়ে বলল….
‘ আপনি টেনশন করবেন না ভাই আমি ভাবির খবর নিয়ে আপনাকে জানাব।

‘ দ্রুত জানাও আসিফ।

আয়নের কথা কাটার আগেই আসিফ তাড়াহুড়ো বলল…

‘ আয়ন ভাই! ফাহাদ বউ তো মায়া ভাবির আপন বোন হয়। ফাহাদের কাছে কল দিলে তো মায়া ভাবির খবর নেওয়া যাবে হয়তো।

আসিফের কথায় আয়নও সম্মতি দিয়ে বলল…

‘ আচ্ছা ঠিক আছে তুমি খবর নিয়ে আমাকে জানিও। আমি অপেক্ষা করবো।

‘ জ্বি ভাই।

আসিফ আগে নেয় এবার কল মিলাল ফাহাদকে পরপর দুবার রিং হতেই তৃতীয়বারে কল রিসিভ করলো ফাহাদের। দুজনের মাঝে কুশল বিনিময়ে মধ্যে আসিফ মায়ার কথা ফাহাদের কাছে জানতে চাইলে ফাহাদ বলল…

‘ আসিফ ভাই আমিতো ঢাকা নেই। চট্টগ্রাম খান বাড়িতে আছি দুদিন ধরে। মুক্তা ঢাকায় আম্মুর সাথে আছে। আমার সাথে মুক্তার কথা হয়না দুইদিন হলো সেজন্য আমি বলতে পারবো না মায়ার কথা।

আসিফ রয়েসয়ে ফাহাদ বলল..

‘ তুমি একটু বাসায় ফোন করে মায়া ভাবির খবরটা নাও ফাহাদ। লন্ডন থেকে ফোন এসেছে সবাই মায়া ভাবির খবর চাচ্ছেন। তুমি তোমার বউর থেকে মায়া ভাবির খবরটা নিয়ে আমাকে জানাও প্লিজ।

কথা শেষে আসিফ ফোন কেটে দিল। সবার কথাটা আসিফ এমনই বলল। আসলে সবার কথা না বললে হয়তো ফাহাদ নিজের বউকে কল দিয়ে মায়া ভাবির খবর নিতো না। এখন সবার কথা শুনে নিশ্চয়ই নিজের বউয়ের থেকে ভাবির খবরটা অবশ্যই নিবে? হলোও তাই। আসিফের কথা মতোই কাজ হলো। ফাহাদ সত্যি সত্যি বাড়িতে ফোন দিল মুক্তার কাছে কিন্তু সেই ফোন রিসিভ করলো ফাহাদের মা। ফাহাদ নিজের বউয়ের কথা জানতে চাইলে ফাহাদের মা ভয়ে আমতা আমতা করলো সত্যিটা জানাতে। মুক্তা যে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সেই খবর ফাহাদ এখন পযন্ত জানেন না। জানলে নিশ্চয়ই এতো শান্ত ভাবে কথা বলতো না। মুক্তা যাওয়া সময় হাতের ফোনটা পযন্ত নিয়ে যায়নি। ফাহাদের মা সত্যিটা লুকিয়ে ভয়ে আমতা আমতা করে বলল…

‘ তোর বউতো আজ বাপের বাড়ি গেছে ফাহাদ। ফোনটা ভুলে বাসায় ফেলে গেছে।

ফাহাদ মায়ের কথায় হাল্কা কপাল কুঁচকে বলল…

‘ হঠাৎ আজ এই অসময়ে ওহ বাড়িতে গেল কেন আম্মা?

‘ আমি জানি না। গেছে হয়তো কোনো কারণে হবে। তুই তোর শাশুড়ীর ফোনে কল করে দেখ কি বলে।

‘ আচ্ছা।

ফাহাদ সত্যি সত্যি রেহেনা বেগমের ফোনে কল দিল। মায়ের ফোনটা মুক্তার হাতেই ছিল বলে ফাহাদের প্রথম কলেই মুক্তা রিসিভ করলো। ফাহাদ মুক্তার বাড়ির আসার কথা জানতে চাইলে মুক্তা প্রচন্ড রাগারাগি করলো ফাহাদের সঙ্গে। ফাহাদ মুক্তার সঙ্গে তর্কে না জড়িয়ে ফোন কাটার আগে সুন্দর করে জানতে চাইলো মায়া কেমন আছে সেটা। আর এতে আবারও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মুক্তা। ফাহাদের পরিবারের জন্য আজ এতো কিছু হলো। মুক্তার সুন্দর সংসার ভাঙতে চলেছে। মায়াও পাগল হয়ে বাসায় বসে আছে। পাগল মায়ার খোজ এতোদিন তো ফাহাদ করলো না। যেই মুক্তা আজ বাপের বাড়িতে চলে আসলো তক্ষুনি ফাহাদ কল করে জানতে চাইছে মায়া কেমন আছে সেটা। এর আগে কেন মায়ার খোঁজ করলো না সে? বড় দুলাভাই হিসাবে কি ফাহাদের কোনো দায়িত্ব নেই। মুক্তা ফাহাদের কল কাটার আগে রেগেমেগে শুধু এতটুকু বলেছিল যে মায়া ভালো আছে। খুব ভালো আছে। মায়ার খবর কারও নেওয়ার দরকার নেই। এমনকি ফাহাদের ও না। অথচ বুঝতে পারলো না রাগে পিছনে থাকা মুক্তার কষ্টটা। কারণ ফাহাদ তখনো জানতো না মুক্তা কেন বাপের বাড়ি চলে গেল। কি হয়েছিল মুক্তা সঙ্গে ফাহাদের বাড়িতে। অথচ ফাহাদ মুক্তার রাগান্বিত কথা গুলো বিশ্বাস করে ফোন দিল আসিফকে। এবং পইপই করে বললো মায়া ভালো আছে, সুস্থ আছে। আসিফও ফাহাদের সেই খবর পাঠাল লন্ডনে আয়নের কাছে। মায়া ভালো আছে সেই খবর শুনে আয়নও শান্ত হয়ে গেল। অথচ কেউ জানতে পারলো না মায়ার সঙ্গে কতোটা ষড়যন্ত্র চলছিল তারই বাড়িতে। রিদ নেই! আরিফ নেই পাশে! একা মায়া আরও একা হয়ে গেল পরিবারের চাপে।

#চলিত….