#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৫৯
‘ রিদ ফিরেছে?
‘ না ম্যাডাম।
ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক ড্রয়িংরুমের বড় ঘুড়িটায় সময় দেখে সুফিয়া খান। রাত প্রায় বারোটা ঘরে। মায়া খোঁজ এখনো পাইনি নাকি? উনার জানামতে রিদ তার বউকে আনতে গিয়েছিল আশুগঞ্জ। বিকাল থেকে এতোটা সময় লাগবে দুজনের ফিরতে? নাকি কোনো সমস্যা হলো?
‘ কফি দাও।
‘ জ্বি ম্যাডাম!
সার্ভেন্ট সম্মতি জানিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। চিন্তিত সুফিয়া খান গম্ভীর মুখে সোফার দিকে এগিয়ে গেল। হাতের মুঠোফোনটায় রিদকে কল লাগাল। ওপাশ থেকে রিদের ফোন অফ বলাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে আবারও দেয়াল ঘুড়িটাতে সময় দেখে নিলো। রিদের কল কেটে মূহুর্তে কল মিলাল আসিফকে। পরপর বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরও যখন আসিফের কলটা রিসিভ হলো না তাতে মূহুর্তে কপাল কুঁচকে আসে সুফিয়া খানের। উনার ছেলের শরীর ভালো না। অসুস্থ শরীর নিয়ে ত্যাড়ামী করে কাল রাতের ফ্লাইটে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিল রিদ। সকালে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেই নাকি বউয়ের খোঁজে সারাদিন পার করলো সে। অবশ্য উনিও সারাদিন রিদের খবর নিতে পারেন নি। কারণ উনার ফ্লাইট ছিল আজ তাই ছেলের খবর নিতে হয়েছিল বাংলাদেশে ফিরে। তিনি নিজের বাসায় না গিয়ে রিদের বাসায় উঠেছেন কিন্তু এখানে এসে জানতে পারে রিদ নাকি সকাল থেকে মায়ার খোজ করে সন্ধ্যার দিকে লোক নিয়ে বেড়িয়ে যায় মায়াকে আনতে। ছেলে ছেলের বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে সেটা ভালো কথা কিন্তু কেউ উনার ফোন ধরছে না কেন? সুফিয়া খান চিন্তিত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। হাতের ফোনটা টি-টেবিলের উপর রেখে বসতে কয়েক মিনিটের মধ্যে সার্ভেন্ট কফি দিয়ে গেলে তিনি তাতে চুমুক বসান। আপাতত কয়েকদিন তিনি রিদের সঙ্গে থাকবে এই বাড়িতে। যতদিন রিদের মেডিসিন চলবে ততদিন এখান থেকেই তিনি কোর্টে যাবেন। তাছাড়া উনার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের চট্টগ্রামের যাওয়া দরকার। কিছু হিসাব নিকাশ বাকি আছে কারও সাথে। সুফিয়া খানের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই তপ্ত আগুনের মতোন দাউদাউ করে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো রিদ। কোনো দিক না তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে অগ্নিশিয়ার নেয় চলে যেতে দেখে সুফিয়া খানের চোখে পরলো রিদকে। তিনি হাতের কফিটা রাখতে রাখতে তৎক্ষনাৎ রিদের পিছনে তাকাল মায়ার সন্ধানে। কিন্তু আশেপাশে মায়াকে কোথাও দেখতে না পেয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রিদের পিছন ডেকে মায়ার সন্ধান করে বলল….
‘ তুমি একা কেন? মায়া কোথায় রিদ?
মায়া নামটা কানে যেতেই রিদের কদম দুই সেকেন্ডের জন্য থামে। দুহাত মুষ্টি বদ্ধ করে আবারও চলে যেতে নিলে একই ভাবে রিদের পিছন ডাকল সুফিয়া খান…
‘ রিদ! তোমাকে কিছু বলছি আমি। একা কেন তুমি? মায়া কই?
মায়ের কথায় হিংস্রত্ব রক্তিম চোখে রিদ ঘুরে তাকাতেই আতংকে উঠল সুফিয়া খান। রিদের চোখে মুখে শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্তের ছিটা। কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। রিদের মাথায় পরপর দুটো সার্জারী হয়েছে সবেমাত্র। বেশকিছু অস্ত্র পাচার করা হয়েছে তাতে। এই অবস্থায় রিদের মাথায় পুনরায় আঘাত পাওয়া মানে রিদের কন্ডিশন খারাপের দিকে যাওয়া। আল্লাহ না করুক যদি দ্বিতীয় বার কোনো কারণে রিদের ব্রেইনে রক্ত ক্ষরণ হয় তাহলে রিদকে বাঁচানো মুসকিল হয়ে যাবে। তিনি রিদের সাদা পাঞ্জাবিটা রক্তের ছিটায় রক্তিম হয়ে যেতে দেখে আতংকিত গলায় বললেন….
‘ তোমার এই অবস্থা কেন রিদ? কি হয়েছে? মায়া কোথায়?
সুফিয়া খানের কথা শেষ হতে হতে রিদ মূহুর্তে সিঁড়ি গোঁড়ায় থাকা ফ্লাওয়ার প্যাশনটা দু’হাতে মাথার উপর তুলে আছাড় মারতে মারতে চিৎকার করে বলল….
‘ এই বেঈমান নারীর নাম আমার সামনে নিবা না কেউ। আই হেড হার! আই জাস্ট হেড হার।
বলতে বলতে রিদ জেদ্দে তোপে সিঁড়ি গোঁড়ার অপর পাশের টপটাও ছুড়ে মারলো। মূহুর্তের মাঝে ভেঙ্গে ছিটকে গেল ড্রয়িংরুমে জুড়ে। রিদের তোলপাড়ে আসিফসহ বেশ কয়েকজন দৌড়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলো। সুফিয়া খান কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। উত্তেজিত পরিস্থিতিতে তিনি রিদের কাছে যাচ্ছে না। কারণ এই মূহুর্তে রিদকে থামানোর চেষ্টা করা মানে রাগের বশে রিদকে আরও হাইপার করে দেওয়া, যেটা মোটেও রিদের জন্য ভালো হবে না। ছেলের রাগ সম্পর্কে উনার ধারণা আছে। তবে এই পরিস্থিতিতে রিদের রাগটা রিদকে ক্ষতি করছে। সুফিয়া খান জায়গায় পাথর মূর্তি নেয় দাঁড়িয়ে থাকতে আসিফ দৌড়ে রিদকে আটকাতে চাইলে মূহুর্তে হাতের ইশারায় নিষেধ করেন তিনি। আসিফ কাচুমাচু করল রিদের তোলপাড় ভাঙচুর দেখতে, সুফিয়া খান রিদের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় আসিফকে আদেশ করে বলল….
‘ আসিফ গাড়ি বের করো। কুইক!
আসিফ দৌড়ে বাহির দিকে যেতেই রিদ কয়েক মিনিটের মাঝে গোছানো পরিপাটি সুন্দর ড্রয়িংরুমটাতে ভাঙচুরের তোলপাড় বয়ে দিল। ফ্লোরের কাঁচ ভাঙ্গার টুকরো নেয় রিদের মন মস্তিষ্ক দুটোই বিখন্ডিত হয়ে গেল। সারারাতের ফ্লাইট, তারপর সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি, সন্ধ্যায় মায়ার বিয়ে নিয়ে হাঙ্গামা আর এখনকার ভাঙচুরের দখল রিদের শরীর আর নিতে পারলো না। নিস্তেজ শরীরের কেমন দূর্বল হয়ে পরলো। সারাদিন পেটে কিছু পরেনি সেই সাথে চিকিৎসারত মেডিসিনও নেওয়া হলো না। অস্থির উত্তেজিত রিদের নাক কান বেয়ে র’ক্ত ঝরলো। চোখের পাতা বুঝে আসলেও সে শক্তি খাটিয়ে ভাঙচুর করতে চাইলো। সুফিয়া খান দৌড়ে রিদকে ঝাপটে ধরেন। মায়ের বক্ষ পেয়ে রিদের হাতের লাঠিটা ফ্লোরে গড়িয়ে পরল। জ্ঞান হারানোর আগে মাথা ছেড়ে সুফিয়া খানের কাধে লুটিয়ে পরতে পরতে বিরবির করে বলল….
‘ রিত তো আমার ছিল আম্মু তাহলে অন্য কারও কেন হলো। আই হেড হার। আই হেড হার। আমার ওকে আর চাই না। চাই না।
রিদের গড়িয়ে পড়া নাকের র’ক্তে সুফিয়ার কাঁধ ভিজে উঠলো। রিদের শক্তপোক্ত শরীরের ভার সুফিয়া খানের উপর ছেড়ে দিতেই তিনি রিদকে সামলাতে হিমসিম খেলো। তাল সামলাতে না পেরে রিদকে নিয়ে ফ্লোরে কাঁচের উপর পরতে নিলেই বাসার সার্ভেন্টরা দৌড়ে আসে এলোমেলো ভাবে রিদসহ সুফিয়াকে ধরলো। দু’হাতে তখনো রিদকে ঝাপটে জড়িয়ে সুফিয়া খান। বুঝতে পারেন ছেলের মন ভালো নেই। কিছু একটা হয়েছে যার জন্য উনার শক্তপোক্ত ছেলেটাকে মানসিক ভাবে ভেঙে দিয়েছেন। উনার শক্ত চেহারায় আবারও অশ্রু জড়াল। রিদকে ধরাধরি করে রাতের আধারের তৎক্ষনাৎ নেওয়া হলো হসপিটালে। রিদকে আইসিওতে রেখে অক্সিজেন মাক্স পড়াল। ইউরোপীয়ান ডক্টরের সাথে কনফারেন্স কলে থেকে টিটমেন্ট দিল। টানা পয়তাল্লিশ দিন কোমায় থাকার পর রিদের জ্ঞান ফিরেছিল সবেমাত্র তিনদিন আগে। এই অবস্থায় রিদ মানসিক চাপ নেওয়া মানে নিজের জীবন ঝুঁকিতে রাখা। ডাক্তার রিদের বেইন শান্ত রাখার জন্য ঘুমের ইনজেকশন পুশ করলো। ডক্টরা সুফিয়া খানকে জানায় রিদকে কয়েকদিন ঘুমের মধ্যে রাখতে হবে তাতে রিদের মস্তিষ্ক শান্ত থাকবে নয়তো পেশেন্ট অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। সুফিয়া খান নিরব সম্মতিতে ডক্টরদের কথা মেনে নেন। উনি ছেলের ভালো চাই। উনার ছেলেটা সুস্থ হোক তাতেই হবে। রিদের আইসিওর বাহিরে চেয়ারে মাথা ঝুঁকে বসে ছিলেন সুফিয়া খান। রাত তখন দেড়টার ঘরে। আসিফ নিজের হাতের ফোনটা সুফিয়া খানের দিকে এগিয়ে দিতেই মাথা তুলে তাকান তিনি। ফোনের দিকে তাকাতেই আসিফ ছোট গলায় বলে…
‘ গুলশান থানার ওসি ফোন করেছে ম্যাডাম।
অসময়ে পুলিশের চক্রে বিরক্তির প্রকাশ করেন সুফিয়া খান। বিরক্তি গলায় বলল…
‘ কি চাই?
সুফিয়া খানের বিরক্তি কাচুমাচু করেন আসিফ। রিদের মা সঙ্গে তার কমই উঠা-বসা। কেমন রাগী আর জেদ্দি মানুষ এই মহিলা। দৃষ্টিও কেমন বাজপাখি নেয়। কথা বলেও কেমন তীক্ষ্ণ।
‘ আপনার সাথে কথা বলতে চাই। জুরুরি ছিল একটু।
বিরক্তি তৎক্ষনাৎ উত্তর আসলো সুফিয়া খানের….
‘ নট নাউ! পরে কথা বলবো! রেখে দাও।
আসিফ সুফিয়া খানকে পুনরায় ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল….
‘ একটা ঝামেলা হয়েছে ম্যাডাম। রিদ ভাইয়ের নামে কে*স ফাইল হয়েছে তিনটা। ওসি বলেছে, নারীর নির্যাতন মামলা, গাড়ি ভাঙচুরসহ দশলাখ টাকার গহনা-পাতি চু*রি নিয়ে মোট ষাটলাখ টাকার ম*মলা করেছে, সাথে মা*র্ডার কেসও আছে একটা। তিনটা মা*মলা নাকি আশুগঞ্জ থানা থেকে গুলশান থানায় ট্রান্সফার হয়েছে এই রাতে। সেজন্য ওসি সাহেব আমাদের কল করে বিষয়টা জানাচ্ছেন। রিদ ভাইতো অসুস্থ। আপনি যদি দেখতেন বিষয়টা।
আসিফের কথায় কেমন তেতে উঠলো সুফিয়া খান। একটা পর একটা ঝামেলা উনার ছেলের পিছনও ছাড়ছে না। উনার ছেলেটাকেও সুস্থ হতে দিচ্ছে না। এখন আবার উঠকো ঝামেলা।
‘ শালার বেড়ারা মরার আর জায়গা পেল না। ভাবছিলাম হাত নষ্ট করবো না। আমারে মাঠে না নামাইলে কারও শান্তি নাই। দে ফোন দে!
কথা গুলো বলতে বলতে আসিফের হাত থেকে ফোনটা এক প্রকার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করে কানে তুলল তিনি। থানার ওসিকে কিছু বলতে না দিতে সুফিয়া খান বললেন….
‘ শুনেন ওসি সাহেব আপনার কাছে রিদ খান নামে কোনো মা*মলায় আসে নাই এখনো পযন্ত। বাকিটা কি করতে হবে সেটা আপনি ভালো জানেন। বুদ্ধিমান লোককে কিছু বলতে হয়না আশা করছি।
ফোনের ওপাশ থেকে ওসি সাহেবের গমগমে উত্তরের বলল…
‘ জ্বি মিসেস খান বুঝতে পেরেছি কিছু বলতে হবে না। আসলে আপনি না বললেও আমরা এই মা*মলা গুলো হাতে নিতাম না। দোয়া করবেন তাতেই হবে। রিদ খানকে সালাম দিবেন আমার। রাখছি।
কল কেটে যাওয়ার আগেই সুফিয়া খান ওসির উদ্দেশ্য বলল…
‘ শুনেন ওসি সাহেব। ফোন রাখলে হবে না আপনার কাজ শেষ হয়নি। আসলে আমার ছেলেটা একটু অসুস্থ। আর অসুস্থ ছেলেটা আমার ইমোশন। এখন কেউ যদি আমার ইমোশন নিইয়া টানাটানি করে তাহলে সেটা আমার মোটেও ভালো লাগবে না। আপনি এক কাজ করেন আশুগঞ্জ থানার নাম্বারটা আমাকে সেন্ট করেন। সেই সাথে থানায় ফোন করে জানাবেন মা*মলাদায় করা বাধি জনাব জামাল শওকত চেয়ারম্যান একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। তাঁকে যেন থানায় আটকে রাখা হয়। আসলে আমি উনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। বুঝেছেন?
সুফিয়া খানের কথায় তৎক্ষনাৎ সম্মতি জানান ফোনের ওপাশের থাকা ওসি সাহেব….
‘ জ্বি ম্যাডাম হয়ে যাবে।
‘ ধন্যবাদ ওসি। তবে আপনার খেয়ালও রাখা হবে চিন্তা করবেন না। আমার লোক যাবে আপনাকে খেদমতে।
ওপাশের ওসি সাহেব খুশিতে উৎফুল্লতা দেখিয়ে বললেন….
‘ আপনার দোয়াই আছি ম্যাডাম।
কল কেটে যেতেই আসিফের হাতে ফোনটা তুলে দিতে দিতে সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকান আসিফের দিকে। কিছু একটা ভেবে বললেন…
‘ তুই আমার সাথে যাবি নাকি হসপিটালের থাকবি রিদের সঙ্গে? কোনটা?
আসিফ সুফিয়া খানের কথায় দ্বি মনা করে বলল…
‘ আমি আপনার সাথে যায় ম্যাডাম? রাদিফ ভাইতো বলেছেন তিনি আসছে রিদ ভাইয়ের সঙ্গে রাত্রে থাকবে এখানে। আপনার হয়তো আমাকে প্রয়োজন পরতে পারে।
সুফিয়া খান হাতে ফোনটা আসিফের দিয়ে বলল….
‘ তোর আরও বড় হতে হবে আসিফ। অল্প বেইনে রিদকে কিভাবে হ্যান্ডেল করিস? যায়হোক তোর প্রয়োজন আপাতত আমার ছেলে অবধি থাক। সকালে দেখা হবে। খেয়াল রাখিস। আসছি।
সুফিয়া খানকে হসপিটালের করিডোর ধরে চলে যেতে দেখেই আসিফ সেদিকে কেমন হতভম্ব হয়ে তাকায়। রিদ ভাইয়ের মা তার কাছে সাধারণ কোনো নারী মনে হয় না। উনার চালচলন, কথাবার্তা, শান্ত মস্তিষ্কের ডিসিশনে যেকোনো মানুষকে মে*রে ফেলার ক্ষমতাও রাখেন তিনি। ছেলের নামে মা*মলা গুলো কেমন মূহুর্তে দামাচাপা দিয়ে দিল তিনি, উল্টো মা*মলাদায়ি করা বাধি চেয়ারম্যানকেও ফাঁসিয়ে দিল মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল বলে। এরা মা-ছেলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। এদের পিছনে থেকে মাঝেমধ্যে আসিফের রুহ কেঁপে উঠে এদের কর্মকাণ্ডে। আল্লাহ জানে এবার চেয়ারম্যান পরিবারের কি হয়। সুফিয়া খান আশুগঞ্জ যাওয়ার মানে চেয়ারম্যান পরিবারের কপালে শনি লটকানো।
~~
রাত সাড়ে তিনটার ঘরে। অন্ধকার রাতে সাদা গাড়িটি এসে থামলো আশুগঞ্জ থানার সামনে। তাড়াহুড়ো ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা টেনে ধরতেই গাড়ি থেকে বের হন পরিপাটি সুন্দর সুফিয়া খান। বয়স্ক ডাইভারের হাইটে সুফিয়া খানকেই লম্বা দেখাল। তিনি আশেপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোজা হাঁটল থানার ভিতরের দিকে। ডাইভার শব্দ করে গাড়ির দরজা আটকাতেই সুফিয়া খানের পিছন পিছন আরও দুজন লোক হাঁটল সেদিকে। একজন সুফিয়া খানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট তারেক। বয়স রিদের পাশাপাশিই হবে। তবে হাল্কা-পাতলা ছেলেটি খুবই মেধাবী। প্রফেশনাল উকিল হলেও গোপনে সে একজন দক্ষ হ্যাকার। হাতের চালানে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তারেক নামক ছেলেটিকে আপাতত সবাই সুফিয়া খানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসাবেই চিনে সবাই। এই মূহুর্তে চোখে মোটা চশমা পড়ে হাতে মোটা ফাইল গুলো নিয়ে সেও সুফিয়া খানের পিছন পিছন যাচ্ছে পুলিশ স্টেশনের ভিতর। অপর পাশে আর্মির মেজর নওয়াজ হাসান। মধ্য রাতে তিনজন পুলিশ স্টেশন প্রবেশ করতেই থানার পুলিশ এগিয়ে আসেন সেদিকে। সুফিয়া খানের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের করার মাঝে সুফিয়া খানের চোখে পড়েন চেয়ারের বসা চেয়ারম্যান সাহেবকে। সুফিয়া খান সবাইকে এরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যান। পাশের চেয়ারটা টেনে জামাল চেয়ারম্যানের মুখোমুখি বসতে বসতে হেয়ালি করে বলেন….
‘ আরে চেয়ারম্যান সাহেব যে? কেমন আছেন আপনি? আপনার টানে আশুগঞ্জ অবধি চলে আসলাম। তা ভালো আছেন আপনি? সব ঠিকঠাক?
সুফিয়া খানের হেয়ালি কথায় কেমন তেতে উঠলো জামাল সাহেব। তিনি এসেছিল উনার ছেলে আর ছেলের বউকে মারার দায়ে মামলা করতে কিন্তু এখানে আসার পর উল্টো উনাকে আটকে রেখেছে ক্রিমিনাল বলে। উনি বুঝতে পারছে এই মহিলার কথায় উনাকে আর উনার লোকদের এতো রাত অবধি থানায় আটকে রাখা হয়েছে। ঐদিকে উনার অসুস্থ ছেলেটা জীবন মৃত্যু মুখে পরে লড়াই করছে উনি সেখানেও যেতে পারছে না এই মহিলার জন্য। আর এখানে এসে এই মহিলা উনার সাথে হেয়ালি করছে? জামাল সাহেব তেতে উঠে বললেন…
‘ আমাকে আটকে রাখলে ভেবেছেন আমি ভয় পাবো? আপনার গুন্ডা ছেলেকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো আমি।
জামাল সাহেব কথায় সুফিয়া গা ছেড়ে চেয়ারে বসতে বসতে পায়ের উপর পা তুলল। হেয়ালি করে বলল…
‘ কি চেয়ারম্যান সাহেব? এটা কেমন কথা? আমি আপনার সাথে কথা বলছি আর আপনি আমার ছেলেকে টানছেন। দিস ইজ নট ডান। মা এসেছে তার সাথে কথা বলুন না, শুধু শুধু এসবে ছেলেকে কেন টানছেন?
সুফিয়া খানের হেয়ালি কথা গুলো যেন জামাল সাহেবকে উত্তেজিত করছেন বারবার। তিনি রেগে চিল্লিয়ে বললেন….
‘ কারণ আপনার ছেলে একটা গুন্ডা সন্ত্রাসী তাই।
সুফিয়া খান আগের নেয় হেয়ালি করে বলল…
‘ আপনি আমার ছেলের বউকে নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন আর আমার ছেলে গুন্ডামী করলেই দোষ? ধরেন আপনার বউকে যদি আমার স্বামী বিয়ে করতে চাই তাহলে আপনি কি করবেন? আপনা..
সুফিয়া খানের কথা শেষ হওয়ার আগেই জামাল সাহেব চেতে উঠে চিৎকার করে বলল…
‘ আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।
জামাল সাহেবকে উত্তেজিত হয়ে যেতে দেখে দারুণ হাসলো সুফিয়া খান। হেয়ালি করে বলল…
‘ আপনার বুড়ো রক্ত এতো গরম হলে আমার ছেলের জোয়ান রক্ত কতটা গরম হওয়ার দরকার চেয়ারম্যান সাহেব? আপনি বুইড়া বয়সে বউয়ের ভাগ বসাতে চান না তাহলে আমার জোয়ান ছেলে কেমনে পারবে? আচ্ছা ধরেন, আপনার ভালো ছেলেটা যদি হঠাৎ করে হসপিটাল থেকে ঘায়েব হয়ে যায় তাহলে এতো ভালো মানুষি দিয়ে কি করবেন? শুনেন চেয়ারম্যান সাহেব জীবনে কিছু সময় গুন্ডা হওয়া খারাপ কিছু না। আপনাকে একটা কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। বারবার রিপিট করবো না কিন্তু। একবারই মনোযোগ দিবেন কেম…
সুফিয়া খানকে শেষ করতে না দিয়ে থানার মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুরু করলো জামাল চেয়ারম্যান। তিনি টাকার দাপট দেখাতে লাগল সুফিয়া খানের সামনে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে থাকিয়ে শান্ত থাকলেন সুফিয়া খান। চেয়ারম্যান সাহেব বলতে লাগলেন….
‘ আপনাদের মতোন মানুষদের আমার চেনা আছে। বারো বছর ধরে চেয়ারম্যানি করছি আমি, আপনাদের মতো দুই চারটে টাকা ওয়ালা মানুষকে উড়াই দিবার মতোন ক্ষমতা আমিও রাখি। মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মতোন থাকেন অথযা একটা পুরুষের সাথে কুলাতে পারবেন না। আপনাকে ছেলেকে তো আমি ছেলের ভাত খাইয়েই ছাড়ব।
চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় তিনি কেমন সুন্দর হাসলো যেন মজার কিছু শুনতে পেয়েছেন তিনি। পা নামিয়ে তিনি কনস্টেবল এগিয়ে দেয়া চা কাপটি হাতে তুলতে তুলতে বলল…
‘ আপনি আমার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াবেন ভালো কথা। কিন্তু তার জন্য তো আপনাকে আগে একটা কেস ফাইল করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আপনি কোনো কে*স না করে কাউকে জেলে ভাত খাওয়াতে পারবেন না এটা আইনে নেই। তাছাড়া আপনাকে তো থানায় আটকে রাখা হয়েছে ড্রাগস মা*মলার দায়ে। আপনি নাকি নারী পাচার করেন? দেশের নাবালক স্টুডেন্টের হাতে ড্রাগ সাপ্লাই করেন? আপনার আর আপনার ছেলের নামে নাকি ১৫৬টি এটেম টু মা*র্ডার কে*স ফাইল পাওয়া গেছে? শুনলাম আপনি নাকি এলাকায় দূর্নীতি করে চেয়ারম্যান হইছেন? সত্যি? আপনাকে এতো ভালো মানুষ মনে করেছিলাম আমি অথচ শেষ পযন্ত আপনি আর আপনার ছেলেরা সন্ত্রাসীর গডফাদার বের হয়েছেন। এই করে বেড়ান বুঝি এলাকায়? ছোটবড় ১৫৬টা মা*মলা ফাইল খোঁজে পাওয়া গেছে আপনাদের নামে। সব ফ্লেভারের মামলাই আছে দেখি। ছিঃ ছিঃ এসব করে বেড়ান আপনারা?
সুফিয়া খানের কথায় কেমন হতভম্ব আর হতবাক হয়ে যায় জামাল সাহেব। উনার জীবনে কোনো মামলা নেই। উনার পরিবার যথেষ্ট ভালো আর রক্ষণশীল পরিবার। সেখানে এতোগুলো মামলা আসবে কোথায় থেকে? জামাল সাহেবের বুঝতে দেরি নেই এসব যে সুফিয়া খানের কারসাজি। তিনি রেগেমেগে চেয়ারে বসা অবস্থায় টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে চেতে উঠে বলল….
‘ আপনি মিথ্যা মামলা কাহিনি সাজাচ্ছেন আমার পরিবারের নামে। মনে করছেন আমি ভয় পাবো আপনার কথায়? আপনার যা খুশি করেন আমিও এর শেষ দেখে ছাড়ব।
চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় হাতের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবারও আগের নেয় সুফিয়া খান বলল….
‘ আপনার এই মনে হলো আমি আপনাকে মিথ্যা বলবো? আমাকে আপনার এতো ছোট মস্তিষ্কের মনে হয়? তারেক! চেয়ারম্যান সাহেবকে উনার বিরুদ্ধে মামলা অভিযোগ গুলোর কাগজ দেখাত।
কথা গুলো বলতে বলতে তৎক্ষনাৎ তারেক নামক ছেলেটি হাতের ফাইল থেকে কিছু কাগজ বের করে সামনে রাখতে সেগুলো হাতে নেয় চেয়ারম্যান সাহেব। সাজানো গুছানো প্রত্যেকটা মা*মলাই উনার আর উনার ছেলেরদের বিরুদ্ধে করা। দপদপ করা জ্বলতে থাকা চেয়ারম্যান সাহেব হঠাৎ কেমন ভয়ে চুপ করে যায়। সুফিয়া খান সেদিকে তাকিয়ে হাতের চা-টা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে চেয়ারম্যান সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল…
‘ শুনেন চেয়ারম্যান সাহেব। এলাকায় চেয়ারম্যানি করছেন তো মানুষের সেবা পযন্ত সীমাবদ্ধ থাকুন। শুধু শুধু আমার ছেলে পযন্ত কি টানছেন। আমার ছেলে আপনার বাজেটের বাইরে। ছেলেটা অসুস্থ বলে মা এসেছি। ভাবুন মা যদি এতটুকু পযন্ত আসে তাহলে ছেলের বাবাও তো আসবে তাই না? আপনি আমাকে সামাল দিতে পারবেন না, বাবা-ছেলে অবধি যাবেন তো দূর। আমি যাওয়ার পর আমার স্বামী আসবে আপনি এতো চাপ নিতে পারবেন না। সেজন্য বলছি আমাদের থেকে দূরে থাকুন। শুনেন চেয়ারম্যান সাহেব ছোট মানুষের উপর ক্ষমতা প্রভাব দেখানোটা আমার পছন্দ না। ক্ষমতা খেলা জমে সমানে সমানে। তারপরও আপনার ভালোর জন্য একটা ড্যামো দেয়। আপনি আমার ছেলের নামে মা*মলা দিলে আমি আপনাকে রোজ একটা করে নতুন নতুন মা*মলায় ঠুকবো। আপনার হিসাবে খাতা ভুল হয়ে যাবে, টাকা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমার মা*মলা করা শেষ হবে না। আপনি যদি মনে করেন পালিয়ে বাঁচবেন তাহলে বলে রাখি আপনি আর আপনার ছেলে দুটোকে মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী বানিয়ে পেপার চাপিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা থানায় অভিযোগ দেওয়া হবে। এরপর যদি মনে করেন আপনারা দেশ ছেড়ে পালাবেন তাহলেও বলে রাখি এয়ারপোর্ট আমার বাপের রাজ্যত্ব চলে আপনাদের পালানোর পথ বন্ধ। ছেলের আমেরিকার ভিসা দিয়ে কি করবেন? যদি ছেলেটাই না বাঁচে? আমার ছেলেটা অনেক দিন অসুস্থতা পর বাংলাদেশে ফিরেছি বউয়ের টানে। সেই বউকে নাকি আপনার ছেলে বিয়ে করে নিলো। স্বামীর জীবিত অবস্থায় বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ে করা জায়েজ না। আইনগত দিক থেকেও অপরাধ। আপনি কয়টা মা*মলা সামলাবেন? কার কার কাছে যাবেন? আপনি যার কাছেই যান না কেন সে আমারই লোক হবে। তারপরও আপনার সান্ত্বনা জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারে। তারপরও একটু চোখ ঘুরিয়ে দেখেন, আপনার এলাকায়, আপনার থানায়, আপনার পুলিশের সামনে বসে যদি আমাকে পিষে ফেলার ক্ষমতা রাখি তাহলে ভাবুন এরপরও যদি আপনি আমার ছেলের পিছনে লাগেন তাহলে কি করবো?
দীর্ঘ কথা বলে সুফিয়া খান থামেন। চেয়ারম্যান সাহেবের কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে এই শীতের রাতেও। সুফিয়া খান টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা জামাল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে শান্ত কন্ঠে বললেন….
‘ দেখেন চেয়ারম্যান সাহেব আমি এই পলিটিক্স পলিটিক্স খেলতে চাইনি। আমার সন্তানের জন্য নামতে হয়েছে এই মাঠে। আসলে আমার মুখ থেকে ব্রেইন চলে বেশি সেজন্য এসব নোংরামিতে হাত নষ্ট করতে চাইনি বলে অনেক বছর আগেই নিজের ব্রেইন খরচ করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আসলে আমি বিশ্বাস করি যেখানে মন ইনভেস্ট হয় সেখানে ব্রেইন ইউস করা চলে না। সেজন্য আপনাকেও বলছি
এরপরও যদি আপনার মনে হয় আপনি আমার ছেলেকে টানবেন? তাহলে আমি আপনার বংশ ধরে টানবো। আশা করছি আপনি এবার বুঝতে পারছেন। এবার বাসায় যান নিজের ছেলের যত্ন নেন। ভালো থাকুন। যান।
কথা গুলো বলতে বলতে সুফিয়া খান উঠে দাঁড়ান। উনার আশুগঞ্জে আরও একটা কাজ বাকি সেটাই করতে হবে। তারপর সকাল হতে হতে আবার ছেলের কাছে ফিরতে হবে। কাল আবার একটু চট্টগ্রামেও যাবে। এই মাঠ পুরাতন। কিন্তু খেলার মানুষ গুলো নতুন। কেন যেন তিনি এসব মানুষের উপর ক্ষমতা দেখিয়ে মজা পাচ্ছে না। হয়তো সমানে সমান কাউকে পাচ্ছেন না বলে।
#চলিত….
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৬০
মধ্যরাতের প্রহর। রাত তিনটে তেরোর ঘরে। অন্ধকার রাতে পরপর দুটো গাড়ি থামলো মায়াদের গেইটে সামনে। মায়াদের বাড়ির গেইট তখনো খোলাই ছিল হয়তো বাড়ির মানুষই জাগ্রত বলে তাই। পরপর দুটো গাড়ির একটা পুলিশের জীপ হলেও অন্যটি সুফিয়া খানের কার। মধ্যরাতে পুলিশের ওসি মায়াদের বাড়ির গেইট টেনে ভিতরে প্রবেশ করতেই গাড়ি থেকে নামলো সুফিয়া খান। সূক্ষ্ম নজরে আশপাশটায় এক পলক দৃষ্টি বুলাল। গাড়ির অপর পাশ হতে তারেক নামক ছেলেটি নামতেই সেও সুফিয়া খানের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। অন্ধকার রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট আলো ছাড়া ঐ দুই চারটে কুকুর দেখা যাচ্ছে দূরে। রাস্তায় বুক ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে দুই একটা আবার তাদের গাড়ি দেখে দূর থেকেই ঘেউঘেউ করছে কয়েকটা। এরমাঝেই একজন পুলিশ এগিয়ে গেল মায়াদের বাড়ির গেইটে। লোহার দরজাটি টেনে খোলে ধরল সুফিয়া খানকে ভিতরে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে। সুফিয়া খান আশপাশটা পরখ করেই হাতের ফোনটা তারেক নামক ছেলেটির হাতে দিয়ে সামনে হাঁটল। পিছনে থাকা তারেক নামক ছেলেটি সুফিয়া খানকে অনুসরণ করেই দৌড়াল তৎক্ষনাৎ। একজন ভদ্র মহিলার কতটা ক্ষমতা আর দাপট থাকলে রাতের আধারের তাকে পাহারা দিতে চলে আসে আর্মি মেজর থেকে শুরু করে থানার পুলিশ ফোর্স? ভাবা যায়? সকলেই ভদ্র মহিলার পিছনে। আর্মির মেজর উনার পাশাপাশি হাঁটছে পা মিলিয়ে। উঁচু জুতোয় সুফিয়া খান হাইটে আর্মির মেজরকেও টক্কর দিবে যেন। মায়াদের বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে মেজর সাহেব কলিং বেল বাজাতেই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খোলে দাঁড়াল মায়ার ফুফি জাহানারা বেগম। উনার বিষ্ময়কর চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে বাড়ির বাকি সদস্যরাও হয়তো এখনো জাগ্রত। জাহানারা বেগম দরজা ধরে মূহুর্তে থমথমে খেয়ে বসল যখন দেখল একজন ভদ্র মহিলা পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে। মধ্যরাতে পুলিশের আগমনে তিনি ভয় পান। হতভম্ব হয়ে বাড়ির ভিতরের দৌড়ে যেতে যেতে আহাজারি করে চিৎকার করলো দুই ভাইদের উদ্দেশ্যে…
‘ শফিক, সাজিদ দেখ বাড়িতে পুলিশ আইছে। চেয়ারম্যান মামলা করছে আমাদের নামে। আই-হাইরে সর্বনাশ হইছে।
জাহানারা বেগম মনে করলেন চেয়ারম্যান পরিবার থেকে পুলিশ এসেছে উনাদের জন্য। উনার আহাজারির চিৎকারের সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকান সেদিকে। দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো বাড়ির সদস্যরা প্রায় সকলেই এখনো জাগ্রত বসার ঘরে ভিড় জমিয়ে হয়তো কোনো আলোচনা সভা হচ্ছিল তাদের মাঝে। হওয়াটাও স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু না। বাড়ির মেয়ের বিয়ে ভাঙলে, বরযাত্রী ফেরত গেলে সব পরিবারেরই এমন হৈচৈ থাকে। তাই মায়ার পরিবারের সবাই মাঝে হৈচৈ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। সুফিয়া খান আপাতত সেসব মনোযোগ হলো না। আর না উপস্থিত সদস্যের কাউকে চিনল। উনার চিনার কথাও না। কখনো মায়ার পরিবারের সঙ্গে উনার সাক্ষাৎকার হয়নি আর না ফাহাদের বউ মুক্তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবে তিনি ছবিতে দেখেছিল ফাহাদের বউকে। সেই সুবাদে উনার মুক্তাকে চেনা কথা। হয়তো মুক্তার ক্ষেত্রেও তাই। সুফিয়া খানকে সরাসরি না দেখলেও সেও ছবিতে দেখেছিল রিদ খানের মা সুফিয়া খানকে। সুফিয়া খানের হঠাৎ আগমনে থমথমে মুখে সকলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল দরজার দিকে তাকিয়ে। সুফিয়া খান মুখের মাক্স খোলতে খোলতে খুব স্বাভাবিক নেয় বাসায় প্রবেশ করলে চমকে উঠার মতোন দ্রুততায় এগিয়ে আসল মুক্তা। সন্ধ্যায় মায়ার বিয়েতে পড়া শাড়িটা এখনো ওর গায়ে জড়িয়ে। সেটির আঁচল মাথায় টানতে টানতে এগিয়ে আসল সুফিয়া খানের দিকে। রিদের মাকে চিনতে ভুল হয়নি ওর। দ্রুততায় এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই মুক্তার মাথায় হাত রাখল সুফিয়া খান। তীক্ষ্ণ গলায় মুক্তাকে উদ্দেশ্য করে বলল…
‘ ফাহাদের বউ রাইট?
গম্ভীর মুখোর সুফিয়া খানের প্রশ্নে খানিকটা ভয় পেল মুক্তা। এই মহিলা সাংঘাতিক ধারালো আর তেজি মানুষ। সে শুনেছিল ফাহাদের মুখে। যদিও বিয়ে পর কখনো মুখোমুখি হয়নি দুজন তারপরও প্রথম সাক্ষাৎতে কেমন যেন ভয় পাচ্ছে মুক্তা। তাছাড়া এতোগুলো পুলিশ নিয়ে হঠাৎ ওদের বাড়িতে আগমন করলে মুক্তার ভয় পাওয়াটাও তো স্বাভাবিক। মুক্তা ফের শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে মিনমিন করে সম্মতি দিয়ে বলল…
‘ জ্বি আন্টি।
মুক্তার কথা শেষ হতে হতে সুফিয়া খানের আর্দেশ আসল তৎক্ষনাৎ…
‘ তোমার মা-বাবাকে ডাকো।
মুক্তা থমথমে মুখে মিনমিন করে বলল…
‘ জ্বি উনারা এখানেই আছেন। আপনি ভিতরে আসুন আন্টি।
মুক্তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পুনরায় পিছনে তাকাল সুফিয়া খান। দেখল বসার ঘরের সকলেই উনাদের দিকে তাকিয়ে। মুক্তা হাত দেখিয়ে আঙ্গুল তাক করলো শফিকুল ইসলামের দিকে। শফিকুল ইসলাম প্রথম সোফাটায় বসেছিলেন। সুফিয়া খান মুক্তার উঁচিয়ে রাখা আঙ্গুল অনুসরণ করে মায়ার বাবার দিকে এগোতে এগোতে নিরেট গলায় বলল….
‘ আমি মায়ার সঙ্গে কথা বলতে চাই। এখন আপনারা কথা বলতে দিবেন নাকি ঝামেলা করবেন কোনটা? যেটা করতে চান আমি সেটাতেই রাজি। বলুন কি করলে খুশি হবেন?
হতবাক, হতবুদ্ধি, থমথমে মুখে সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো সুফিয়া খানের কথায়। মধ্যে রাতে এই মহিলা উনাদের বাসায় এসে সবাইকে কেমন হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। বলছে উনারা নাকি ঝামেলা করতে চাই।
বসার ঘরে মায়া, জুই, রাফা, আর রেহেনা বেগম বাদে সকলেই উপস্থিত ছিল। সুফিয়া খান শফিকুল ইসলামের মুখোমুখি দাঁড়াল উত্তরের আশায়। সাজিদুল ইসলাম হাতে, পায়ে, মাথায় জায়গায় জায়গায় ব্যান্ডেজ করে ভাই শফিকুল ইসলামের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সুফিয়া খানের কথায় চেতে উঠলো তক্ষুনি। কটাক্ষ গলায় বলল…
‘ কে আপনি? এখানে পুলিশ নিয়ে কেন এসেছেন?
সুফিয়া খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সাজিদুল ইসলামের দিকে। চটাং চটাং মেজাজের মানুষ উনার পছন্দ না। এ রকম মানুষের ব্রেইন খুব কম হয়। সেজন্য তাদের মুখ চলে বেশি। সুফিয়া খানকে উত্তর করতে না দেখে মুক্তা পাশ থেকে তাড়াহুড়োয় সাজিদুল ইসলামকে থামাতে চেয়ে বলল….
‘ কাকা উনি আমার মামীশাশুড়ী। রিদ ভাইয়ার আম্মু।
রিদ নামটা শুনতেই কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো সাজিদুল ইসলাম। এই ছেলের জন্য বরযাত্রী র’ক্তা*ক্ত অবস্থায় হসপিটালের পরে। উনাকে পিটিয়েছেন। উনি আহত অবস্থায় হাত-পা ভেঙে আজ বাসায় বসে। উনার বাড়ির মেয়েও সম্মান নষ্ট হলো। সবাই ছিঃ ছিঃ করছে উনাদের মুখের উপর। এখন আবার মা এসেছে নতুন কাহিনি করতে। উনাদের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না ঐ বাড়ির ছেলেদের। আজ এখানেই সবশেষ। সাজিদুল ইসলাম আবারও কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে রাগে কটমট করে বলল…
‘ দেখেন আপনি যেই হোন না কেন, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি আপনাদের মতোন অভদ্র মানুষের এখানে জায়গা নেই। আপনি বরং এখন আসুন। আমাদের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আপনাদের বাড়ির কারও কোনো সম্পর্ক থাকবে না আর না আপনার সাথে কেউ কথা বলবে। আপনি চলে যান।
জুইয়ের বাবা সাজিদুল ইসলামের কথায় তৎক্ষনাৎ ওসি সাহেব ধমকে উঠলো রাগে। কোথায়, কখন কার সামনে দাঁড়িয়ে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা বুঝাতে চেয়ে তিনি সাজিদুল ইসলামের দিকে তেড়ে যেতে চাইলে সুফিয়া খান হাতের ইশারায় ওসি সাহেবকে থামিয়ে দিতে দিতে সাজিদুল ইসলামের উদ্দেশ্যে শান্ত গলায় বলল….
‘ দেখুন সাজিদুল সাহেব, আমার সবখানে ক্ষমতা প্রয়োগ করাটা কিন্তু পছন্দ না। যে যতটুকুর যোগ্য আমি তাকে ততটুকুতেই রাখি। আপনার সাথে আমি ভদ্র আছি তারমানে বুঝতে হবে আপনি আমার চাপ নেওয়া যোগ্য নয়। বাকি রইল সম্পর্কের কথা? সেটা না-হয় আপনাদের বাড়ির মেয়েদের ঠিক করতে দেন তাঁরা কি চাই। আপনাদের বাড়ির মেয়েদের সম্মান না থাকলেও আমার বাড়ির বউদের কিন্তু যথেষ্ট সম্মান আছে সাজিদুল সাহেব। তাই গলা নামিয়ে, নয়তো আমি গলা উঁচালে কিন্তু আপনি ঠাই পাবেন না।
কথা গুলো বলেই সুফিয়া খান শফিকুল ইসলামের চোখে চোখ রেখে বলল…
‘ মেরুদণ্ডহীন প্রাণী পশুর সমান হয় শফিকুল সাহেব। ছেলেমেয়েদের বাবা হতে শিখুন নয়তো ছেলে-মেয়েরা আপনাকে বাবা ডাকা ছেড়ে দিবে।
কথা গুলো শেষ করেই সুফিয়া খান ফের ঘাড় ঘুরাল মুক্তার দিকে শক্ত গলায় বলল…
‘ মায়া কোথায়?
মুক্তা ভয়ে তাড়াহুড়ো বলল….
‘ উপরে আছে।
সুফিয়া খান আর্দেশ স্বরুপ বলল…
‘ আমাকে মায়ার রুমে নিয়ে যাও কুইক।
~~
কৃত্রিম লাইটের আলোয় সুফিয়া খানের মুখোমুখি বসে মায়া। মায়াকে জড়িয়ে ওর মা রেহেনা বেগম বসে বিছানায়। পাশেই রাফা, জুই দুজনই দাঁড়িয়ে। সকলে মুখ থমথমে বিস্ময়কর সুফিয়া খানকে এই মূহুর্তে দেখে। বাকিদের সুফিয়া খানকে চেনা না থাকলেই মায়া ঠিকই চিনল সুফিয়া খানকে। কিন্তু মাত্রাতিক জ্বরের ঘোরে মাথা ফেলে শুয়ে রইল মায়ের বুকে। এতক্ষণ মায়াকে জলপট্টি দিচ্ছিল রেহেনা বেগম। সুফিয়া খানের আগমনে বিব্রতবোধ করে মায়াকে নিয়ে অগোছালো অবস্থায় বসল রেহেনা বেগম। চোখ মুখ কেঁদে কুটে লাল হয়ে আছে সবার। সুফিয়া খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলকেই পরখ করে নিলো। মায়ার দিকে তাকাতে উনার কুঁচকানো কপাল আরও কুঁচকে আসলো মায়ার নাজেহাল অবস্থা দেখে। মায়ার সুন্দর মুখটা জ্বরে ঘোরে ফ্যাকাসে হয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা মায়ার শরীর এক কেজি মাংস হবে কিনা সন্দেহ আছে সুফিয়া খানের। এতোটা শুকিয়েছে মেয়েটা। লাস্টবার যখন তিনি মায়াকে দেখেছিল রিদের সঙ্গে তখন বেশ নাদুসনুদুস আর হেলদি ছিল মায়া কিন্তু এখন শরীরে অবস্থা খুবই সূচনীয়। তিনি এসেছিল মায়ার সঙ্গে কথা বলতে, কেন বিবাহিত হয়েও দ্বিতীয় বিয়ে করলো সেটা জানতে অথচ মায়ার পরিস্থিতি দেখে উনার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আগে সুস্থ করানো উচিত। তারপর বাকি কিছু। সুফিয়া খান মায়াকে পরখ করে রেহেনা বেগমকে প্রশ্ন করলেন মায়ার খবর জানতে চেয়ে বলল…
‘ কি হয়েছে মায়া?
সুফিয়া খানের প্রশ্নে মায়াকে দু’হাতে ঝাপটে ধরেই রেহেনা বেগম অসহায় গলায় বলল…
‘ আমার মেয়েটা অনেক দিন ধরে অসুস্থ।
রেহেনা বেগমের কথায় খানিকটা অসন্তুষ্ট হলো সুফিয়া খান। তীক্ষ্ণ গলায় বলল…
‘ এতো অসুস্থতার মাঝে মেয়েকে বিয়ে দিতেন গেলেন কেন? আপনারা জানতে না মায়া বিবাহিত ছিল সেটা?
সুফিয়া খানের কথায় ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো রেহেনা বেগম। অসহায় গলায় একে একে বলতে লাগল….
‘ আমার মেয়েটা বলেছিল আপনার ছেলের কথা। কিন্তু ওর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি প্রমাণ ছিল না বলে। ওর বাপ-চাচা আর ফুফিরা সবাই মিলে আমার অসুস্থ মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেয়।
রেহেনার বেগমের কথায় কেমন যেন মেজাজ খিঁচে গেল সুফিয়া খানের রাগে। এতো কিসের প্রমাণ প্রয়োজন হয় একটা অসুস্থ মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিবার জন্য? অসুস্থ মানুষকে এমনিতে বিয়ে দিতে নেই। এটা মূর্খ মানুষ গুলো কি জানতো না। তাছাড়া যদি কেউ দাবি করে সে বিবাহিত অন্তত সেটার সত্য মিথ্যা যাচাই-বাছাই করে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে হয়। নয়তো পাপের দারে দাঁড়াতে হয়। মায়া যখন বলেছিল সে বিবাহিত তখন অন্তত সত্য মিথ্যা যাচাই-বাছাই করার জন্য হলেও উনাদের অপেক্ষা করতে পারতো এরা। তা না করে উল্টো একটা বিবাহিত মেয়েকে জোর করে না জায়েজ সম্পর্কে বেঁধে দিলো এরা। উনার ছেলেটাও বউয়ের জন্য পাগল প্রায়। এই মেয়েকে না পেলে যে ঠিক হবে না তিনিও জানেন। কিন্তু মায়ার বিয়েটা নিয়ে কেমন যেন বারবার মেজাজ খিঁচে যাচ্ছে উনার। সুফিয়া খান শক্ত গলায় বলল…
‘ বিবাহিত মেয়ের স্বামী জীবিত অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে জায়েজ নয় সেটা জানার পরও কিভাবে আপনারা জোর করলেন মায়াকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য?
রেহেনা বেগম মুখ গুমরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। খানিকটা সময় নিয়ে রয়েসয়ে শুরু থেকে সবটাই জানাল মায়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে সুফিয়া খানকে। সবটা শুনে মূহুর্তে কেমন নমনীয়তা হয়ে গেল সুফিয়া খানের মন। তীব্র অপরাধ বোধের জাগ্রত হলো মনে। রিদকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে যাওয়ায় মায়ার খোঁজ করতে পারেন নি তিনি। বলতে গেলে উনার মাথায় ছিল না মায়ার ব্যাপারটা। আজ উনার বেখেয়ালিপনায় এতোগুলা সম্পর্কে ফাটল ধরলো। মায়া মানসিক রোগী। উনার ছেলেটা সুস্থ হয়েও হচ্ছে না বউয়ের জন্য ছটফট করছে। সুফিয়া খানের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই রেহেনা বেগম ফের বলতে লাগলো…
‘ আপনার ছেলের সঙ্গে বিয়ের কোনো প্রমাণ দিতে পারছিল না বলে আজ আমার মেয়েটাকে সবাই জোর করে পাপে বাঁধে, দ্বিতীয় বিয়ে দেয়। আপনারা দয়া করে আমার ছোট মেয়েটাকে এবার রেহাই দেন। ওহ আর আঘাত নেওয়ার ক্ষমতাতে নেই। এমনই আমার মেয়েটা মরে যাচ্ছে। মা হয়ে ভিক্ষা চাইছি আপনাদের কাছে আর মানসিক চাপে ফেলবেন না। সবাই আমার মেয়েকে পাগল বলে। আপনি আপনার ছেলেকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেন। আমার মেয়ে কিছু বলবে না। ওহ এমনই কাউকে চিনতে পারছে না। আপনার ছেলেকেও ভুলে যাবে। আমি আমার পাগল মেয়েকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারব আমাদের কারও দরকার নেই, তারপরও দয়া করে আমার মেয়েটাকে রেহাই দেন। দয়া করুন।
একজন অসহায়ত্ব মায়ের চিৎকার যেন সুফিয়া খানের বুকে গিয়ে লাগল। তিনিও তো একজন মা। ছেলের বিপদে উনার দুনিয়া ঘুরে গিয়েছিল। আজ এই মূহুর্তে এখানে বসে আছে উনার ছেলের কথা চিন্তা করেই এসেছেন। তিনি একজন শক্ত ধাঁচের মানুষ হয়েও যদি সন্তানের জন্য এতোটা দূর্বল হতে পারে তাহলে মা হয়ে রেহেনা বেগমের কতোটা দূর্বল হওয়ার কথা। সন্তান সবার জন্যই সমান হয়। সুফিয়া খান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রেহেনা বেগমের উদ্দেশ্য বলল….
‘ শেষ বিশ্বাসটুকু আমাকে করতে পারেন মিসেস রেহেনা। আমি কখনো বিশ্বাস ভাঙ্গার মতো কাজ করিনি এই অবধি। আজ এখানে ছেলের বিশ্বাসের জোড়া লাগাতে এসেছিলাম তবে এখন আপনার বিশ্বাসের ভার কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছি, আপনার মেয়ে আমার কাছে ভালো থাকবে এই পরিবেশ থেকে, আমি খেয়াল রাখব আপনার মেয়ের। আমাকে ভরসা করতে পারেন।
রেহেনা বেগম মূহুর্তে কোনো কথা খোঁজে পেল না বলার জন্য। শুধু দুচোখের জল ফেলে সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়াদের বাড়ির বর্তমান পরিস্থিতি মায়াকে সুস্থ হতে দিবে না। চারপাশে রটে গেছে মায়া দুই বিয়ের খবর। প্রথম স্বামী রেখে মায়া দ্বিতীয় বিয়ে করতে গিয়ে প্রথম স্বামীর হাতে মার খেয়েছে মায়া ও তার নতুন বর। এসব মানুষের মুখে মুখে রটে গেছে। সকাল হতে হয়তো মানুষজন আসবে তাদের বাড়িতে তামাশা দেখতে। মায়ার ফুফিরাও রেগে আছেন তাদের ভাইকে রিদ খান মারায়। মায়াকে যা-তা কথা শুনালো। অথচ রাত থেকে যে মেয়েটা বেহুশ ওকে হসপিটালের নিতে হবে সেই খবর কারও নেই। ভয়ে তিনিও কাউকে কিছু বলতে পারছেন না মেয়েটাকে ডাক্তার দেখাতে চেয়ে। অসহায় অবস্থায় সেই থেকে মাথায় জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে মায়ার। এরমাঝে যতবার মায়ার হুশ ফিরেছে ততবারই রেহেনা বেগমকে চিনতে অস্বীকার করেছে মায়া। উনি প্রচন্ড ভয়ে আছেন মায়ার মানসিক চাপ নিয়ে। উনার ভয় উনার মেয়েটা পুরোপুরি পাগল না হয়ে যায় এতসব সইতে না পেরে। রেহেনা বেগম সুফিয়া খানের চোখের দিকে তাকিয়ে নিরবে কাঁদল। হয়তো এই বাড়ির পরিবেশ থেকে মায়া ঐ বাড়িতে ভালো থাকবে। অন্তত মায়াকে তারা ডাক্তার দেখাবে অবহেলা না করে এতটুকুতেই তিনি সন্তুষ্ট। উনার ছেলে আরিফ ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসলেই না-হয় মায়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন রেহেনা বেগম। উনার মন কেমন কেমন করে যেন সুফিয়া খানের কথায় সম্মতি জানাল। দু’হাতে ঝাপটে ধরা মায়াকে সুফিয়া খানের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে দুচোখের পানি ছেড়ে বলল…
‘ আমার মেয়েটার খেয়াল রাখবেন আপা। এই মূহুর্তে একজন অসহায় মা হয়ে বলছি এই পরিবারের থাকলে আমার মেয়েটা এমনই মারা যাবে। ওকে অন্তত একটা ডাক্তার দেখাবেন। আমার ছেলেটা ইন্ডিয়া থেকে ফিরলেই নাহয় আমি নিয়ে আসব।
রেহেনা বেগমের বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে মায়াকে নিজের বুকে জড়াল সুফিয়া খান। মায়ার নেতিয়ে যাওয়া তপ্ত শরীরটা জড়িয়ে ধরতে ঠাহর করতে পারলো সত্যি মায়া কতোটা অসুস্থ। চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। সুফিয়া খান মায়াকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়াতে গেলেই অপর পাশ হতে দৌড়ে এসে মায়াকে আঁকড়ে ধরলো রাফা। সুফিয়া খানের উদ্দেশ্য বলল…
‘ আমিও যাব আপনাদের সাথে।
সুফিয়া খান চোখ আওড়িয়ে এক পলক তাকাল রাফার দিকে। যদিও মেয়েটিকে তিনি চিনেন না তবে মায়ার সঙ্গে মেয়েটিকে নিতে উনার কোনো অসুবিধা নেয়। চোখে ইশারায় সম্মতি দিয়ে তিনি রেহেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল…
‘ নিজের খেয়াল রাখবেন মিসেস রেহেনা।
মায়া আর রাফাকে নিয়ে বসার ঘরে সকলের সামনে দিয়েই বেড়িয়ে আসল সুফিয়া খান। সুফিয়া খানকে কিছু বলার মতোন সাহস মায়ার পরিবারের কেউ দেখাতে পারলো না। কথায় কথায় রেগে যাওয়া সাজিদুল ইসলামও কেমন মুখ চুপসে দাঁড়িয়ে। মায়ার ফুফিরাও তাই। মায়ার বাবার চোখে মুখে কেমন নমনীয়তা ছিল। তিনি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল সুফিয়া খানকে কিন্তু কোনো একটা অদৃশ্য বাঁধায় তিনি যেন চুপ করে যান। নিরব দাঁড়িয়ে দেখল মেয়ের চলে যাওয়া নিয়ে। জুই, জুইয়ের মা,আর রেহেনা বেগম মায়াকে এগিয়ে দিতে অন্ধকার রাতে গেইট অবধি দাঁড়িয়ে থাকেন। সুফিয়া খানের গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া অবধি সেই অদূরে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে রইল। আল্লাহ জানে উনার অসুস্থ মেয়েটা টানাপোড়ার সম্পর্ক গুলো কিভাবে ঠিক করবেন। আল্লাহ উনার মেয়েটাকে সুস্থ দান করুক। আমিন।
~~
রাতের প্রহর কাটিয়ে ভোরের দিকে মায়াকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছায় সুফিয়া খান। অসুস্থ মায়াকে দেখে হতভম্ব রাদিফ আসিফ দুজনই। রাফা সুফিয়া খানের সঙ্গে সঙ্গেই থাকছে। মায়াকে দেওয়া হলো রিদের কেবিনে পাশাপাশি বেডে। অসুস্থ মায়ার চিকিৎসা চললো তৎক্ষনাৎ। মায়ার বা’হাতে ক্যানুলা লাগানো হলো পরপর ইনজেকশনের পুশ করতে। মায়ার অবস্থায় সূচনী তা ডাক্তারের চোখ মুখ দেখেই বুঝা গেল। মায়াকে চিকিৎসা দিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরল মূহুর্তে।
‘ পেশেন্টের ব্যাপারে আপাতত আমরা কিছু বলতে পারছি না মিসেস খান। তবে পেশেন্ট অবস্থা খুবই সূচনীয়। আমরা বেশ কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার করে রিপোর্ট দেখে বলতে পারবো পেশেন্টের বর্তমান অবস্থা।
কথা গুলো বলে ডক্টর চলে যেতেই রাদিফ উত্তেজিত গলায় নিজের মাকে প্রশ্ন করে জানতে চাইল….
‘ ভাবির কি হয়েছে আম্মু? এই অবস্থা কেন উনার?
রাদিফের কথায় সুফিয়া খানের গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল…
‘ রিপোর্ট আসুক তারপর জানবে। আপাতত বলতে পারছি না।
মায়ের কথায় চিন্তিত ভাজ আরও গম্ভীর হলো রাদিফের কপালে। অথচ পাশ থেকে আসিফ সেই কখন থেকে রাফা দিকে তাকিয়ে মূলত সে রাফার সাথে কথা বলতে চাইছে। সে-তো জানতোই না রাফা যে মায়া ভাবিদের বাসায় ছিল। আর না এটা জানতো এখন রিদ ভাইয়ের মায়ের সঙ্গে ঢাকা চলে আসবে। মূলত আসিফ সন্ধ্যার দিকে রাফাকে মায়ার সঙ্গে দেখেছিল বরযাত্রী গাড়িতে তখন আসিফ রিদকে সামলাতে গিয়ে রাফার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু এখন তার রাফার সঙ্গে কথা বলা জরুরি মনে হলো তার কেন জানি মনে হচ্ছে রাফা আসিফকে এড়িয়ে যেতেই সুফিয়া খানের সঙ্গে সঙ্গে থাকছে। আসলেই কি তাই? যদি তাই হয় তাহলে তাকে এরিয়ে যাওয়ার বা কারণ কি রাফার?
সকাল এগারোটা দিকে হাল্কা হাল্কা জ্ঞান ফিরল রিদের। তীব্র মাথা ব্যথায় বিরক্তিতে বামহাত রাখল কপাল। অল্প মাথা নাড়িয়ে ডানে-বামে মাথা ঘুরাল। চোখ মিলে পাশে তাকাতেই ঝাপসা চোখে দেখলো বেডে অচেতন অবস্থায় পরে থাকা মায়াকে। প্রথমে রিদ মনে করতে পারলো না কিছুই। ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট গলায় আওড়াল একটু করে…
‘ রিত!
রিদ ডানহাত বাড়িয়ে মায়াকে ছুঁতে চাইলো। কিন্তু হাতের নলে চাপ পড়ায় নল বেয়ে রক্ত উঠলো তৎক্ষনাৎ। সুফিয়া খান দ্রুততায় এগিয়ে এসে রিদকে বাধা দিয়ে শান্ত করতে বলল…
‘ কি করছো রিদ? নলে রক্ত উঠছে।
সুফিয়া খানের কথায় রাদিফ এগিয়ে আসল। সে মূলত বাহির থেকে মায়ের জন্য কফি নিয়ে সবে কেবিনে প্রবেশ করেছিল। মায়ের কথায় তৎক্ষনাৎ দৌড়ে আসে এদিকটায়। রিদ তখনো হঠাৎ করে কিছু মনে করতে পারলো না। মায়ের হাত নিজের শরীর থেকে সরিয়ে দিতে দিতে রিদ বিরক্ত গলায় বলল…
‘ উফ বিরক্ত করছো কেন তোমরা? সরো। রিতকে বলে এদিকে আসতে। রিত কাম হেয়ার।
সুফিয়া খানের হাত সরিয়ে দিতেই রিদ ফের বেহুশ মায়াকে ডাকল নিজের কাছে। মায়ার নড়চড় দেখতে না পেয়ে রিদ রেগে কিছু বলবে তার আগে রাদিফ তাড়াহুড়ো রিদকে শান্ত করতে বলল…
‘ ভাই ভাবি তো অসুস্থ। উনি হুশে নেই। তুমি শান্ত হও।
মায়া অসুস্থতার কথা কানে যেতেই রিদ কপাল কুঁচকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানে হঠাৎই স্মৃতিচারণ হলো বিষাক্ত অতীত গুলো। মায়ার বিয়ে অন্য কোথাও হয়েছে সেটি মনে আসতেই রিদের শান্ত মস্তিষ্ক তড়াক করে জ্বলে উঠলো। দাউদাউ অগ্নি শেখার নেয় হুংকার ছেড়ে হাতের ক্যানুলা, স্যালাইন সবকিছু টেনে ফেলতে ফেলতে বলল….
‘ এই নারী এখানে আসলো কেমনে? কার এতো বড়ো কলিজা হয়েছে আমাকে ঠেঙ্গিয়ে এই নারীকে নিয়ে আসে? কার?
রিদের হুংকারে বাহির থেকে আসিফ আয়ন দুজনই দৌড়ে আসে ভিতরে। আজ সকালেই আয়ন বাংলাদেশে ফিরেছিল লন্ডন থেকে। মায়ার ব্যাপারে সবটা আসিফের কাছে শুনে সেও স্তব্ধ হতবাক। কিছু বলার মতোন ভাষা আয়নের কাছেও ছিল না। মায়ার বিপদে সেও তো পাশে ছিল না। জুইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও সে এই মূহুর্তে ভয় পাচ্ছে। কেমন যেন সৎ সাহসে কুলাচ্ছে না তার। তারপরও সে চিন্তা করলো কালই একবার আশুগঞ্জ যাবে জুইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। সুফিয়া খান রিদের তোলপাড়ে খুব স্বাভাবিক নেয় রিদকে উত্তর করলো…
‘ আমি নিয়ে এসেছি।
মায়ের কথায় রিদের তোলপাড় আরও বাড়ল। গর্জে উঠে বলল…
‘ কেন নিয়ে এসছ? দরদ দেখাতে? যখন খেয়াল রাখার কথা ছিল তখন তো খেয়াল রাখনি। অবহেলা করেছো। আজ এই নারী আমার জন্য হারাম তারপরও কেন এই নারীকে আমার সামনে হাজির করলে কেন?
পরপর রিদের হুংকারে ডাক্তারা দৌড়ে কেবিনে এগিয়ে আসল। মিনি ফ্রিজ হতে রিদের ইনজেকশন নিতে নার্সকে আর্দেশ করতে নার্স সেদিকে দৌড়াল। অস্থির উত্তেজিত পরিস্থিতিতে সকলেই আতংকিত মুখে রিদকে বুঝাতে চাইছে শান্ত হতে অথচ সুফিয়া খান স্বাভাবিক। বরং রিদের কথায় কটাক্ষ করে বলল…
‘ আমার মন চাইছে তাই এনেছি তোমার সমস্যা কোথায়? তোমার কাছে যাচ্ছে ওহ? তাহলে তুমি কেন এতো হাইপার হচ্ছো? হসপিটাল কি তোমার বাপের কেনা? যে তুমি ছাড়া অন্য কেউ চিকিৎসা নিতে পারবে না।
যেমন মা তেমন ছেলে গোলাভারতের মতোন মেজাজ। সুফিয়া খান ইচ্ছা করেই রিদকে রাগাল। কারণ রিদের রাগে প্রস্রয় দিলে এতে মায়ার ক্ষতি হবে ভেবেই তিনি এমনটা বললেন। মায়ের কথায় রিদের মস্তিষ্ক ধপধপ করলো। আগুন লাগার মন শিরা-উপশিরায় জ্বলল। এরমাঝে আয়ন,রাদিফ, আসিফ ডাক্তারসহ সকলেই রিদের হাতে পায়ে ঝাপটে ধরলো ঘুমের ইনজেকশন পুশ করতে। রিদ রাগের তোপে হিংস্রতা স্যালাইন, ক্যানুলা টেনে ছিঁড়ল ধস্তাধস্তি করে। সকলেই রিদকে ঝাপটে ধরে শুয়াতে চাইছে বলে রিদ ধস্তাধস্তি করে ডক্টরের হাতে ইনজেকশন ছিনিয়ে নিয়ে মুচড়ে ফেলতে ফেলতে চিৎকার করে বলল…
‘ আমি সেই জায়গায় এক মূহুর্তে দাঁড়াব না যেখানে এই নারী বিষাক্ত নিশ্বাস আছে। আমাকে যাইতে দে তোরা নয়তো কাউকে ছাড়ব না আঘাত করা থেকে।
সুফিয়া খান ইশারায় রিদকে ছেড়ে দিতে বললে রিদ তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করলো কেবিন হতে। রিদের পিছন পিছন ছুটলো আসিফ, রাদিফ দুজনই। সুফিয়া খান রিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তিনিও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। এর শেষ দেখেই ছাড়বেন তিনি। মায়াকে টানা তিনদিন হসপিটালের রাখা পর চতুর্থ দিন মায়াকে নিয়ে রিদের বাসায় উঠলো সুফিয়া খান। মায়াকে রাখল নিজের ঘরেই। যেহেতু রিদ মায়াকে মেনে নিচ্ছে না তাই।
#চলিত….