রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৬৫+৬৬

0
5

#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৬৫
রাত দশটা। মায়ার অবস্থান চট্টগ্রাম খান বাড়িতে। অন্ধকার ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে মায়া। এই ঘরটা রিদের। অসময়ে মায়ার শুয়ে থাকার কারণ দুটো—এক, লং-টার্ম জার্নিতে মায়ার শরীর বেশ ক্লান্ত। দ্বিতীয়ত, সে রিদের সাথে এই বাড়িতে আসতে চায়নি, কিন্তু রিদ জোর করে নিয়ে আসায় সে জেদ দেখিয়ে একা ঘরে শুয়ে আছে। খালি বাড়িতে সার্ভেন্ট আর দলের লোকজন ছাড়া পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই। রিদ মায়াকে খান বাড়িতে পৌঁছে তৎক্ষণাৎ চলে গিয়েছিল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আরাফ খান, হেনা খান ঢাকায় আছেন। তারা নিহাল খানের উপর হওয়া হামলার কথাটা শুনেছেন। ইতিমধ্যে রওনাও হয়েছেন হয়তো, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে তাদের। খালি বাড়িতে মায়ার খোঁজ করার মতো সার্ভেন্ট ছাড়া অন্য কেউ না থাকলেও রিদ আর সুফিয়া খান ঠিকই মায়ার খেয়াল রাখছে বারবার কল করে। দুপুরে মায়াকে নিয়ে রিদ খান বাড়িতে আসার পরপর ব্যস্ততায় সে বেরিয়ে গেলেও মায়ার জন্য সার্ভেন্ট ঠিক করে যায় যাতে অসুস্থ মায়ার খেয়াল রাখতে পারে কেউ। কিন্তু দুপুর থেকে মায়া না খেয়ে জেদ করে কক্ষে শুয়ে আছে—এই বিষয়টা সুফিয়া খানের কানেও পৌঁছাল। মায়ার অসময়ে শুয়ে থাকার মাঝেই দরজায় নক করলো কেউ। প্রথমে বিষয়টি মায়া কানে না নিলেও পর মুহূর্তে কানে এল বাড়ির সার্ভেন্ট তানির গলার স্বর শুনতে পেয়ে। সে অনবরত দরজা ধাক্কিয়ে মায়াকে ডাকতে লাগল…

‘ভাবিমনি, দরজাটা খোলেন। বড়ো ম্যাডাম কল দিয়েছেন, আপনার সাথে কথা বলতে চান। ভাবিমনি! ও ভাবিমনি! শুনছেন?’

কাজের মেয়ের গোছানো সুন্দর কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। সুফিয়া খান মায়াকে কল দিয়েছে বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মায়াকে দেখে কাজের মেয়েটি হাতের ফোনটা এগিয়ে দিতেই মায়া সেটি স্বাভাবিকভাবে হাতে নিল। দরজা বন্ধ করে ফোনটি কানে তুলতে তুলতে ফোনের ওপাশ থেকে শোনা গেল সুফিয়া খানের গম্ভীর গলার স্বর…

‘কী হয়েছে তোমার? খাচ্ছো না কেন?

সুফিয়া খানের কথায় মায়া মিনমিন গলায় বলল…

‘আমার এখানে ভালো লাগছে না, আম্মু। আমি আপনার কাছে যাব। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান প্লিজ।

মায়ার কথায় যেন সুফিয়া খানের মনে কোথাও শান্তি পেল। এই প্রথম হয়তো কেউ উনার কাছে থাকার জন্য আবদার করছে। নয়তো উনার সন্তান কিংবা স্বামী—কেউ উনার সাথে থাকতে চায় না। উনার একটা মেয়ে থাকলে নিশ্চয়ই মায়ার মতো করে আবদার করে বায়না করত উনার সাথে থাকার? সুফিয়া খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়াকে বোঝাতে চেয়ে বলল…

‘অবশ্যই নিয়ে যাব, আম্মু। আপাতত তুমি দু’দিন ঐ বাড়িতে থাকো, তারপর আম্মু রাদিফকে বলব তোমায় দিয়ে যেতে, কেমন?

‘এই বাড়িতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, আম্মু। সবকিছু অসহ্য লাগছে। আমি এখানে দু’দিন থাকতে পারব না। প্লিজ আমাকে এখন নিয়ে যেতে বলুন, আম্মু। আমার এখানে ভালো লাগছে না।

মায়ার ভিতরকার অস্থির ছটফট যেন ফোনের ওপাশে বসে থাকা সুফিয়া খান ঠাহর করতে পারলেন। তিনি মায়ার অস্থিরতার কারণ বুঝতে পেরে গম্ভীর গলায় বললেন…

‘আমার মনে হয় তোমার এবার রিদের মুখোমুখি হওয়া উচিত, মায়া।

সুফিয়া খানের কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ জেদি গলায় উত্তর করে বলল…

‘আমি আপনার ছেলের মুখোমুখি হতে চাই না, আম্মু। আমার উনাকে প্রয়োজন নেই। আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই সবসময়। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান প্লিজ।

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনের সমান অপরাধ—সেটা তুমি বিশ্বাস করো তো? সবকিছু চুপ করে সহার চেয়ে মুখ খুলে প্রতিবাদ করাটা উত্তম। তুমি চুপ করে থাকলে তোমার হয়ে কেউ এগিয়ে এসে কথা বলবে না, মায়া। ব্যক্তির নিজের লড়াই নিজেকেই করতে হয়। অন্যের আশা করাটা বোকামি। তোমার প্রতিবাদ তোমাকেই করতে হবে। তাছাড়া চুপ থেকে থাকলে কোনো কিছুর সমাধান করা যায় না, মায়া। তোমার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ করার জন্য হলেও তোমার রিদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। প্রয়োজনে চুপ নয়, প্রতিবাদ করতে শিখো।

সুফিয়া খানের কথার ইঙ্গিত মায়া বুঝতে পারল। রিদের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা মায়ার ফুরিয়ে গেছে। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে কিসের ভালোবাসা? রিদের অনুপস্থিতিতে মায়া কী কী পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল, সেটা রিদ একবারও শুনতে চেয়েছে ওর কাছে? নাকি মায়াকে বিশ্বাস করেছিল কোনো কিছুতে? রিদও সবার মতো করে মায়ার দিকে আঙুল তুলেছে, ভুল বুঝেছে, অপমান করেছে, আঘাত করেছে—কিনা করেছে রিদ মায়ার সঙ্গে? তাহলে মায়া কেন রিদকে সাফাই দিতে যাবে কী হয়েছে না হয়েছে তা নিয়ে? মায়াকে পাগল বানানোর পিছনে কি শুধু মায়ার পরিবার আর রিদের পরিবারই দায়ী ছিল? রিদ ছিল না? সে কতটুকু বিশ্বাস করেছিল মায়াকে? শুরু থেকে মায়া এই সম্পর্কটার জন্য পাগল ছিল। তাহলে রিদ ভাবল কীভাবে মায়া ওর স্বামীকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে? বিয়ে কি খেলাঘর? যে আজ একজনকে বিয়ে করলাম, কাল আবার আরেকজনকে বিয়ে করে খেলবে? মায়ার যদি এতই বিয়ে করার ইচ্ছা থাকত, তাহলে মায়া শুরু থেকেই হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজ করত না কখনো। বরং মায়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় না বলেই ও নিজের নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান এত খোঁজাখুঁজি করে বের করেছিল। মায়ার এত ভালোবাসার স্বামীকে রেখে সে অন্য কাউকে বিয়ে করবে—এটা কীভাবে রিদের মাথায় এল? কেন কখনো মায়ার ভালোবাসা রিদের চোখে পড়ে না? এখন মায়ার সুস্থ হওয়ার পরই কেন রিদকে সাফাই দিতে যাবে আসলে মায়া সেদিন বিয়েটা করেছিল কি না এই নিয়ে? কেন বলতে যাবে সে এত কিছু? যেখানে অলরেডি মায়াকে বেইমান, প্রতারক নারী হিসেবে রিদের মেনে নেওয়া হয়ে গেছে, সেখানে মায়া পুনরায় কিসের হয়ে সাফাই দেবে? মায়ার আত্মসম্মান নেই? মায়াকে বারবার মিথ্যা অপবাদ দেবে আর মায়া সেটা মেনে নেবে? কেন, কিসের জন্য? স্বামীকে ভালোবাসে বলে? হ্যাঁ, এটা সত্য মায়া ওর স্বামীকে ভালোবাসে, তার মানে এই না যে মায়া ভালোবাসায় অন্ধ, ওর কোনো আত্মসম্মান নেই। মায়াকে এতগুলো মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার আগে রিদ ভেবেছিল এর বিপরীতে মায়ার কী হতে পারে? কিছুই তো ভাবেনি, তাহলে আজ কেন মায়া রিদের হয়ে ভাবতে যাবে? মায়ার বিপদে কে ছিল? রিদ ছিল সেদিন? ছিল না। সেদিন যদি সুফিয়া খান মায়াকে ওর বাড়ি থেকে নিয়ে না আসতেন, তাহলে আজও মায়াকে ঐ বাড়িতে থাকতে হতো, রিদও কখনো মায়ার খোঁজ করত না—মরে গেলেও না। সুফিয়া খান মায়াকে দয়া করে নিয়ে এসেছেন, সুস্থ করেছেন বলেই আজ রিদের এত প্রশ্নের উত্তর চায় মায়ার থেকে। আর মায়াও নির্লজ্জের মতন উত্তর দিয়ে যাবে—এটা আশা করে তারা? মায়ার কি কোনো সেলফ-রেসপেক্ট থাকতে নেই? মায়ার পাগল হওয়ার পিছনে শুধু মায়ার পরিবার কিংবা রিদের পরিবার একা দায়ী নয়, বরং রিদ নিজেও শতভাগ দায়ী ছিল। সেদিন যদি রিদ সবার মতো করে মায়াকে ভুল না বুঝে অন্তত সত্য জানতে চাইত, তাহলে মায়া সত্যটা বলত। রিদকে কাছে পাওয়ার খুশিতে হয়তো মায়াও অসুস্থতা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু রিদ তা করেনি, বরং মায়াকে অসংখ্য অপমান, অপবাদ দিয়ে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল যাতে মায়া পাগল হয়ে যায়। হয়েছিলও তাই। মায়া এতসব যাতনা সহ্য করতে না পেরে অতিরিক্ত মানসিক চাপে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে যায়। এসব কিছুর জন্য মায়া কখনো রিদকে ক্ষমা করবে না আর এসব কিছু এত সহজে ভুলে যাবে না। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় মায়াকে চুপ থাকতে দেখে সুফিয়া খান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন…

‘মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দু’পিঠই তোমার দেখা উচিত, মায়া। আমার ছেলে মুখে ভেঙে ভিতরকার খবর প্রকাশ করতে পারে না বলে তার মানে এই না যে ওর নিজের একটা দিক নেই। অবশ্যই আছে। সেজন্য বলছি তোমার রিদের সঙ্গে অন্তত একবার কথা বলা উচিত। আপনজন সুযোগ চাইলে একবার নয়, বারবার সুযোগ দিতে হয়, মায়া।

‘তাহলে আপনি কেন বাবাকে একবারও সেই সুযোগটা দিলেন না, আম্মু?

মায়া সুফিয়া খানকে প্রশ্নটা করেই থমথমে মুখে হয়ে যায়। সে আসলে এই প্রশ্নটা করতে চায়নি। কিন্তু কীভাবে যেন কৌতূহলবশে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। তবে তক্ষুনি শোনা গেল সুফিয়া খানের শক্ত গলার উত্তর। তিনি বললেন…

‘সে আমার কাছে কখনো সুযোগ চায়নি। স্বাধীনতা চেয়েছিল। যা চেয়েছে, তাই দিয়েছি।

কথা বলতে বলতে সুফিয়া খান ঠাস করে কলটা কেটে ডিল মেরে ফেললেন সোফার উপর। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন। আজ অনেকটা বছর পর আবারও এই শূন্যতা উনাকে ঘিরে ধরল।
নিহালকে নিয়ে উনার এই মুহূর্তে অনুভূতি শূন্য। দীর্ঘ একটা পথ একা পাড়ি দিয়ে এসেছেন তিনি। বাকিটা পথও একা কাটাতে পারবেন। তবে আজ হঠাৎ করেই কেন যেন শূন্যতা অনুভব হচ্ছে উনার।
স্বামী, সন্তান, সংসার—সবকিছু থেকেও যেন ছন্নছাড়া একাকী জীবন পাড় করতে হচ্ছে উনাকে। এমনটা নয় যে তিনি এই একাকী জীবনের সাথে পরিচিত নন। অবশ্যই পরিচিত! আর সেটা এক-দু’দিনের নয়, বরং গোটা পনেরো বছরের এই একাকীত্বের জীবনের অভিজ্ঞতা উনার। কিন্তু হুট করে মায়াকে পেয়ে উনার একাকিত্ব জীবনটা ভুলে বসে ছিলেন প্রায়। কিন্তু আজ হঠাৎ করে রিদের মায়াকে নিয়ে ঐভাবে চলে যাওয়াতে উনার একাকিত্ব জীবনটা যেন পুনরায় মাথা নাড়া দিয়ে উঠল। মনে এল উনি আসলেই একা। উনার আবারও একা থাকতে হবে।
মায়া কান থেকে ফোনটা নামিয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সুফিয়া খানকে প্রশ্নটা করা ঠিক হয়েছে কি না দ্বিধায় ভুগল। তবে মায়া খুব করে চায় সুফিয়া খান সবার সাথে একত্রে থাকুক। আজও উনার কথায় খান বাড়ির ছোট থেকে বড় পর্যন্ত মেনে চলেন, সম্মান করেন, ভয় পান। সুফিয়া খান দূরে থেকেও যেন এই সংসারটা আজও উনার হয়েই আছেন। মায়া প্রায় শুনেছিল দাদা-দাদিকে সুফিয়া খানকে বলতে তিনি যেন উনার সংসারে ফিরে আসেন। উনাদের ছেলে নিহালের সঙ্গে একত্রে এক ঘরে থাকতে না চাইলে দুজন আলাদা ঘরে থাকবে, তারপরও যেন তিনি খান বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু দাদা-দাদির কথায় সুফিয়া খান কখনো উত্তর করতেন না, বরং বরাবরই নীরবতা পালন করতেন। মায়ার কেন মনে হয় সুফিয়া খান উনার স্বামী নিহাল খানের অপেক্ষা করছেন আজও।
~~
রাত বারোটা পেরিয়ে একটা। রিদ সবেমাত্র ঘরে ফিরল। অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করতে কপাল কুঁচকে এল তার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কাটিয়ে সে অল্প আলোর লাইট জ্বালালো। আবছা আলোয় মায়াকে বিছানায় কুঁজো হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রিদ সেদিকে এগোল। মায়ার কপালে হাত রেখে শরীরের তাপমাত্রা চেক করলো। গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে সে মায়ার গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে গায়ের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বেড সাইড টেবিলের উপর মায়ার ওষুধগুলোতে চোখ বোলাল। হাতে নিয়ে দু-একটা ওষুধের পাতা নিয়ে চেক করে দেখল মায়া ওষুধ খেয়েছে কি না। খোলা ওষুধের প্যাকেট দেখে রিদ বুঝতে পারল মায়া মেডিসিন নিয়েই শুয়েছে। রিদ শরীরের ক্লান্তি দূর করতে লম্বা একটা শাওয়ার নিল। গায়ে কালো টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার প্যান্ট জড়িয়ে বের হলো। সময় নিয়ে কফি মেকারে ব্ল্যাক কফি বানাতে বানাতে পুনরায় দৃষ্টি ঘোরাল বিছানায় শুয়ে থাকা মায়ার উপর। আজ নিয়ে দ্বিতীয় রাত হবে দুজনের একত্রে একই বিছানাতে থাকা। বিয়ে, ভালোবাসা, বৈধতা থাকার পরও দুজনের একত্রে থাকা হয়নি কখনো। রিদ এবার ঠিক করে রেখেছে যত কিছুই হোক না কেন, সে তার বউকে নিজের সাথে রাখবে সব কিছুতে। রিদ মরে গেলেও মায়াকে যাতে কেউ অবহেলা করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও সে ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। জীবনে মানুষ বাঁচে আর কত দিন? রিদ চায় বাকিটা জীবনে এই নারী তার পাশে থাকুক। হাতের ধোঁয়া ওঠা গরম গরম কফিতে রিদ চুমুক বসাতে বসাতে সে বারান্দার দিকে হাঁটল। বাবার নির্বাচনের বাকি আর এক মাস। এই একটা মাস রিদ ঢাকা টু চট্টগ্রাম যাওয়া-আসা করবে। কারণ তার নিজেরও কোম্পানি আছে ঢাকায়। তার নিজের কোম্পানিতে সময় দিতে হয়। বাকি রইল ওর বাবার ওপর হামলা করার বিষয়টা তো, রিদ যতটুকু জানে জসিমের চ্যাপ্টারটা ওর মা সুফিয়া খান আরও দু’মাস আগেই শেষ করে গিয়েছিলেন, তাহলে এখন কারা ওর বাবার উপর আক্রমণ করতে পারে সেই খবর কাল সকালের মধ্যে রিদের হাতে এসে যাবে। রিদের ধারণা মতে জসিমের পরিবার এসব করবে না। কারণ জসিমের তিন ছেলের ভিতর একটা ছেলে মাত্র সুস্থ-সবল জীবিত আছে, বাকি একটা পঙ্গু হয়ে বেডে শুয়ে, অন্যটা মৃত। জসিম নিজেও মৃত, তাহলে জসিমের পরিবারের কারও সাহস হবে না রিদের পরিবারের আর কারও সঙ্গে টক্কর নেওয়ার। রিদের ধারণা, সবকিছু আড়ালে থেকে খুবই সূক্ষ্মভাবে তৃতীয় পক্ষের কেউ রিদের বাবাকে টার্গেট করছে? রিদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই হঠাৎ পিছনে কারও উপস্থিতির টের পেল রিদ। কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে রিদ বুঝতে পারল বন্ধ দরজার ভিতরে তার পিছনে কে দাঁড়াতে পারে। রিদ খুব শান্ত ভঙ্গিতে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। দরজার সম্মুখে মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে মিহি স্বরে ডাকল…

‘ কাছে আসো!

রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার হাতটা ছুঁতে গেলেই মায়া পিছিয়ে গেল একদম। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল…

‘ আমাকে ছুঁবেন না আপনি।

মায়ার কথায় রিদকে তখনও শান্ত স্বাভাবিক দেখাল।
রিদ আবছা আলোয় মায়ার রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে আগের মতো বলল….

‘ তাহলে কাকে ছোঁব?

‘ যাকে খুশি তাকে গিয়ে ছোন!

‘ বউ ছাড়া যাকে খুশি তাঁকে ছোঁয়া হারাম। বউকে ছোঁব বলেই একই বউকে তিন তিনবার বিয়ে করলাম। এখন নিষেধ করলেও তো হবে না জান।

রিদের হেঁয়ালি কথায় মায়ার রাগ বাড়ল। সে মূলত সুফিয়া খানের কথা মানতে রিদের মুখোমুখি হচ্ছে, নয়তো মায়ার রিদের প্রতি রাগ বিন্দুমাত্র কমেনি। মায়া রাগে নাকের পাটা ফুলিয়ে জেদি গলায় বলল…

‘ আপনি আমার কেউ নন।

রিদের একই ভাবের উত্তর এল তক্ষুনি…

‘ আমি আপনার সব।

‘ আমি আপনাকে অপছন্দ করি।

‘ কিন্তু আমি আপনাকে পছন্দ করি।

রিদের পরপর কথার উত্তরে মায়া খানিকটা চুপ হয়ে গেল। মায়া যা-ই বলছে রিদ তার বিপরীতে উত্তর করছে বলে মায়া মুখে মুখে তর্ক করতে মন চাইল না। কিন্তু সে রিদের উপর সন্তুষ্টও না। বিগত দিনে যা কিছু হয়েছে সেসব মায়া কক্ষনো ভুলবার নয়। মায়া চাইলেও ভুলতে পারবে না, আর না রিদকে ক্ষমা করতে পারবে। কিন্তু মায়া সে-সব কোথা থেকে শুরু করবে সেটা বুঝল না। রিদ তো প্রশ্ন করছে না, তাহলে মায়ার কোথা থেকে শুরু করা উচিত? তাছাড়া যখন রিদ মায়ার থেকে সবকিছু শুনতে চাইত তখন মায়া কিছুই বলেনি। আর এখন রিদ হয়তো মায়ার থেকে সবকিছু শুনতে ইচ্ছুক নাও হতে পারে। তাই মায়া স্বেচ্ছায় কিছু বলাটা কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগছে। মায়া দ্বিধায় দ্বিমনা করে চলে যেতে চাইলে শান্ত থাকা রিদ যেন মায়ার অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারল। মায়াকে থামিয়ে বলল….

‘ যেটা বলতে এসেছ সেটা শেষ করে যাও। আমি শুনছি।

রিদের কথায় ক্ষেপে উঠল মায়া। সে কি বলতে এসেছে এই লোককে? পিছন ঘুরে শক্ত গলায় বলল মায়া….

‘ আমি আপনার মতন লোককে কোনো কিছুর সাফাই দিতে আসিনি। আর না কখনো দেব। আমি শুধু আম্মুর কথা রক্ষার্থে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। নয়তো আপনি যে অবিশ্বাসে এই সম্পর্কটা শেষ করেছিলেন, আমি সেই দৃঢ়তায় এই সম্পর্কে ফুলস্টপ লাগাতাম। সম্পর্কের नींव বিশ্বাসের চলে আপনি কখনো আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। সবসময় আমার দিকে, আমার ভালোবাসার দিকে আঙুল তুলেছেন। আমি বেঈমান, প্রতারক, আমি দুনিয়ার জঘন্যতম নারী। যে স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য পুরুষকে বিয়ে করে ফেলেছে। কথা শুনতে যতটা কঠিন লাগে তার থেকে কঠিন হচ্ছেন আপনি। আপনি আমার দিকে একটা আঙুল তুললে বাকি চারটা আঙুল কিন্তু আপনার দিকে উঠে আসে। আপনাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম, আপনার খোঁজেও আমি বেরিয়েছিলাম, আপনার জন্য পাগল আমিই ছিলাম। আপনাকে না দেখে স্বামী হিসাবে আমিই মানতাম। বলতে গেলে এই সম্পর্কে আমি শুরু থেকে শতভাগ দিয়েছিলাম। যে মেয়ে তার স্বামীকে জানে না, কখনো দেখেনি, অপরিচিত একটা মানুষকে শুধু অন্ধের মতো ভালোবেসে গেছে, সেই মেয়ে স্বামীর খোঁজ পাওয়ার পর, স্বামীকে ভালোবাসার পর, কিভাবে সে অন্য পুরুষ বিয়ে করবে এটা কেন আপনার মনে এল না? একদিকে আমার পরিবার বিয়ের জন্য চাপে ফেলে, অন্যদিকে আপনি বিয়ে করার জন্য আমাকে আঘাত করেছেন। দুদিক থেকে আমিই পাপী, আমিই দোষী। আর আপনারা হচ্ছেন মহাবিচারক। কিছু না করেও বারবার আমাকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। আর আমি আপনার বিরহে মরতে গিয়েছিলাম….

কথাটা বলতে বলতে মায়া নত মস্তিস্কে দু’হাতে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল বিষাক্ত অতীত মনে করে। মায়ার কান্না রিদ স্থির দাঁড়িয়ে। তার হেলদোল নেই আর না জায়গা ছেড়ে এগিয়ে এল মায়াকে সান্ত্বনা দিতে। বরং রিদ সেভাবে হাতের কফি মগটা চেপে দাঁড়িয়ে রইল। মায়া খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল। সে ঠিক করেছিল রিদের সামনে কক্ষনো কাঁদবে না এসব বিষয়ে। কিন্তু তারপরও কেন জানি মায়া নিজেকে আটকাতে পারছে না কান্না করা থেকে। নিস্তব্ধতা চাপিয়ে মায়া নিজের কান্না আটকাতে চেয়ে ভাঙা গলায় বলল…

‘ আপনার অ্যাক্সিডেন্টের পর আপনার পরিবারের কেউ আমার খোঁজ করেনি। এমনি অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে আপনার জ্ঞান হারানোর পরপর আমাকেও আপনার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, শেষবারের জন্য দেখতে পর্যন্ত দেয়নি কেউ আমাকে। আমার কান্না, আমার চিৎকার, আমার আর্তনাদ শোনার মতন সেদিন কেউ ছিল না আমার পাশে। আপনি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন, অথচ আমি বেঁচে থেকে হাজার বার মরেছিলাম ক্ষণে ক্ষণে। আমার আর্তনাদ কেউ শুনতে আসেনি, বরং মানুষ উপহাস করেছে আমাকে নিয়ে – আমি পাগল। আপনাকে হারিয়ে অসুস্থ ছিলাম, কিন্তু মানুষের উপহাসের পাগল উপাধি পেতে পেতে মানসিক চাপে পড়ে গেলাম! আপনার অনুপস্থিতিতে সেদিন প্রথমবারের মতন মনে হয়েছিল আমি যাদের আপন মনে করেছিলাম তাঁরা আসলে কেউ আমার ছিল না। আমার ‘আমি’ বলতে আমার স্বামী ছাড়া সকল সম্পর্কই ঠুনকো ছিল। সবাই আপনার উপস্থিতিতে আমার আপন ছিল। আপনাকে হারিয়ে পাগলপ্রায়, তারপরও কারও সাহায্য আমি পাইনি অবহেলা ছাড়া। আপনার অনুপস্থিতিতে গোটা একটা পাহাড় সমান চাপে পড়ে আমার পরিবার। আমাদের বিয়ের খবরটা জেনে আমার পরিবার তোলপাড় শুরু করে। ঘরে অশান্তি শুরু হয়। আরিফ ভাই সবাইকে আমার বিয়ের ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলে তাঁরা আমার আর আরিফ ভাইয়ের কাছে আমাদের বিয়ের প্রমাণপত্র চায়। যা আমার আর আরিফ ভাই কারও কাছে ছিল না বলে আরিফ ভাই আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু আসিফ ভাইও জানায় আপনার পার্সোনাল কাগজপত্র উনার কাছে নেই। আমাদের বিয়ের কাবিননামা, কাজী, এমনকি আমাদের দুজনের একত্রে কোনো ছবি পর্যন্ত আমার পরিবারকে দেখাতে পারিনি বলে তাঁরা মনে করেন আমি আর আরিফ ভাই মিলে সবাইকে মিথ্যা বলছি আমার আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে এটা বলে। তাঁরা কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করছিল না। এটা নিয়ে রোজ অশান্তি শুরু হয় আমাদের ঘরে। একদিকে আপনাকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা আমার, অন্যদিকে সপ্তাহ পর সপ্তাহ অসুস্থ হয়ে থাকতে হতো আমাকে হসপিটালের বেডে। তারপর আবার আমাদের এলাকায় রটে গেল আমি আমার আপুর বড়োলোক বাসরের প্রেমে পাগল হয়ে হসপিটালের পরে থাকি। চারপাশে আমার পাগল হওয়া বদনাম রটল। সেজন্য আমার পরিবার চাইত এই বদনামের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে তাঁরা দ্রুত আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। নতুন জায়গা কিংবা স্বামীর সঙ্গ পেলে আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠব এমনটা তাদের ধারণা ছিল। কিন্তু বিয়ের জন্য আমি বা আরিফ ভাই রাজি হচ্ছিলাম না বলে আমাকে নিয়ে ঘরে আরও অশান্তি বাড়ল। আরিফ ভাই বাসায় থাকলে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না, কিন্তু আরিফ ভাই বাসায় না থাকলে সবাই আমাকে যা-তা শোনাত। এই নিয়ে আমার ফুফিদের হাতে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছিলাম আমি, কেন আপনাকে ভুলতে পারছি না তা নিয়ে। আপনার বিরহে দিনদিন মানসিক চাপে পড়ছিলাম, অন্যদিকে আপনার পরিবারের কারও খোঁজ পাচ্ছিলাম না যে আমাকে এসব থেকে বের করবে। আমি নিঃসঙ্গ একা হয়ে গেলাম। এরমধ্যে আরিফ ভাইকেও হঠাৎ করে ব্যবসায়িক কাজে ইন্ডিয়া যেতে হল। ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে আমার উপর চাপ বাড়ল। আমার ফুফিরা আর কাকারা মিলে ঠিক করল আরিফ ভাই ইন্ডিয়া থেকে ফেরার আগে আগে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। হলও তাই। আমাকে এক রাতের মধ্যে ছোট ফুফির গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। চেয়ারম্যান পরিবারের শুধু আমার অসুস্থতা বিষয়টা ছাড়া সবকিছু লুকানো হল। এক রাতের মধ্যে বিয়ে ঠিক করা হল। বিয়ের বাজারও করা হল সেই রাতে। পরদিন বিয়ে। আমার অবস্থা এমন ছিল যে আমি আপনার বউ হয়ে বেঁচে থাকতে না পারলে মরে যাব। তারপরও আপনার বউ হয়েই থাকব। অন্য কাউকে বিয়ে করব না। তাই সেদিন রাতে সবার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর বাসায় যত ধরনের ওষুধ ছিল সবকিছু একত্রে করলাম। আমার ওষুধ থেকে ধরে বাবার, ফুফিদের সবার ওষুধ নিয়ে প্রায় তিনশো মতো ট্যাবলেট একত্রে খেতে গিয়ে আমার ছোট ফুফির হাতে ধরা পড়ে যাই। তিনি হৈচৈ চিৎকার করে বাসার সবাইকে একত্র করেন রাত দুটোয়। রাগে জেদে সেদিন রাতে আবারও ফুফিদের হাতে মার খেলাম। সবসময় আমার গায়ে জ্বর থাকত। সেদিন রাতে উনাদের হাতে মার খেয়ে রক্তবমি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আম্মু, জুঁই, রাফা, ছোট চাচী অনেক জোরাজুরি করে সেদিন ফুফিদের থামিয়ে আমাকে নিয়ে গ্রামের একটা হসপিটালে যায়। সাত ঘণ্টা হসপিটালে রাখার পর পরদিন সকাল এগারোটার দিকে আমাকে আবারও বাসায় আনা হয় বরযাত্রী আসার আগে। আমার আব্বু, কাকা, ফুফিরা মনে করছিল আমি বিয়ে করতে চাই না বলে বারবার নাটক করছিলাম জ্ঞান হারানোর, অথচ তাদের আঘাতে আমার ব্রেইনে চাপ পড়ে। গায়ের জ্বর বাড়ল। আমার শরীর অতিরিক্ত দুর্বল হওয়ায় বিয়ের দিন প্রায় অচেতন অবস্থায় ছিলাম। যে যা বলছিল আমি কাঠের পুতুলের মতো সেটাই করছিলাম। আর এই সবটাতে রাফা আমার পাশে ছিল বিশ্বস্ত বন্ধুর মতন। জুঁইকে ওর বাবা আর ফুফিরা আমার আশেপাশে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না, যাতে ও আমার বিয়েতে বিঘ্ন না ঘটাতে পারে সেজন্য। কিন্তু তীব্র অসুস্থতার মাঝেও আমি আশা ছাড়িনি। ভেবেছিলাম বিয়ের আসরে নাদিম ভাইকে বলব আমি এই বিয়েতে রাজি না। আমি বিবাহিত, এটা জেনেও আমার পরিবার জোর করে উনার সাথে আমাকে বিয়েটা দিচ্ছেন। উনি যেন চলে যান। আমার শেষ চেষ্টা এটাই হত। কিন্তু রাফা আমাকে তেমন কিছুই করতে দিল না। কারণ ও শুরু থেকে সবটা দেখেছিল। ও বুঝতে পেরেছিল আমি এমন কিছু করলে হয়তো আমার ফুফিরা আমাকে আরও আঘাত করবে সেজন্য রাফা তখন আমাকে আশ্বস্ত করে ও সবটা সামলে নেবে। আমি যেন চুপ থাকি। দুনিয়ার সবাই আমার হাত ছেড়ে দিলেও রাফা আমার সঙ্গ ছাড়বে না বলে ওয়াদা করল। সেই সময় পথহারা পথিকের মতন রাফার কথায় মেনে নিলাম আমি। আমাকে বিয়ের শাড়ি গয়না পড়ানো হলেও আমি বিয়ের কবুল বলিনি, কারণ সেই সময় আমি রাফাকে জড়িয়ে ছিলাম অসুস্থতায়। আশেপাশে অনেক মানুষ থাকলেও আমি রাফাকে ছাড়ছিলাম না আর না রাফা আমাকে ছাড়ছিল। মূলত বিয়ে পড়ানোর সময় আমার তেমন হুঁশ ছিল না, তবে আমার কানে এসেছিল কারও কবুল বলার শব্দটা। সেদিন রাফা কি করেছিল? আমার জায়গায় কে কবুল বলেছে আমি তাও জানি না। নাদিম ভাইয়ের সাথে কার বিয়ে হয়েছিল তাও বলতে পারি না। কারণ আমি হুঁশে ফিরি বিয়ে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর। আমাকে যখন নাদিম ভাইয়ের হাতে সঁপে দিচ্ছিল তখন আমার হুঁশ আসে। রাফা আমাকে আগেই সতর্ক করে রেখেছিল পরিবারের মানুষের সামনে ঝামেলা না করতে, কারণ এতগুলো মানুষের সাথে আমরা ঝামেলা করে পেরে উঠব না তাই। তাছাড়া যেহেতু সবাই জানে নাদিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছে সেজন্য আমিও চুপ ছিলাম। কারণ আমি আর রাফা জানতাম আসলে বিয়েটা হয়নি। এবার কার সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা রাফা জানে। আমি শুধু রাফার ভরসায় ছিলাম রাফা আমাকে এসব থেকে বাঁচাবে এই বলে। আমাদের ধারণা ছিল আমরা আমার পরিবারের থেকে দূরে গেলে সুযোগ করে নাদিম ভাইয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলব। উনি ভালো মানুষ, নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনবেন। কিন্তু পথিমধ্যে কোথা থেকে আপনি লোক নিয়ে আমাদের উপর রাস্তায় হামলা করলেন। গাড়ি ভাঙচুর করলেন। বরযাত্রী পেটালেন। নাদিম ভাইকেও মারলেন। আমাকে আঘাত করলেন। জুঁইয়ের বাবাকে আঘাত করলেন। সবচেয়ে বেশি যেটা আমাকে হিট করেছে সেটা হল আপনি আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিলেন। সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। একটাবার আমার দিকটা শুনতে চাইলেন না। আমাকে বিশ্বাস করলেন না। ঝড়ের বেগে এলেন সবকিছু তছনছ করে আবার চলে গেলেন আমাকে একা রেখে। আপনার অনুপস্থিতিতে আমি তাও লড়ছিলাম, কিন্তু আপনার অবিশ্বাসে, অপবাদে মনে হল আমি মিথ্যা একটা সম্পর্কের পিছনে ছুটছি। আমার এত লড়াই, এত যুদ্ধ করা সবকিছুই এক মুহূর্তের জন্য মিথ্যা হয়ে গেল যখন আপনি আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন তখন। আমি আর নিজের মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল আমি শেষ। আমার সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি ব্যর্থ। আমার সব সম্পর্ক ব্যর্থ আমার মতন। মানুষ বলে আমি পাগল। আসলেই আমি পাগল। আমি কারও যোগ্য না। তারপর থেকে সবটা আপনার চোখের সামনে। সবার অবহেলা মেনে নিয়েছিলাম আপনার ফেরার আশায় ছিলাম, কিন্তু আপনি ফিরেও যখন সবার মতন করে একই আচরণ করলেন সেটা আর সহ্য হয়নি আমার। আমাকে মানসিক রোগী থেকে পুরো পাগল আপনি বানিয়েছেন। সেদিন যদি আপনার মা আমাকে নিয়ে না যেত তাহলে হয়তো আজও আপনি আমাকে অবিশ্বাস করে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন। আপনার অবহেলায় আজ আমার মনেও আপনার জন্য তীব্র অনিহা জন্ম নিয়েছে। আমার আপনাকে ছাড়াও চলবে। পাগল থেকে যখন সুস্থ হতে পেরেছি তাহলে বাকিটা জীবনও আমার আপনাকে ছাড়া চলবে। আপনার ঠুনকো লোক দেখানো ভালোবাসার আমার আর প্রয়োজন নেই। আপনার মতন স্বার্থপর মানুষ আমার জীবনে না হলেও চলবে।

মায়ার দীর্ঘ কথায় রিদ টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। মায়া আবছা আলোয় অশ্রুসিক্ত চোখ তুলে তাকাল রিদের দিকে। আলোর বিপরীতমুখী হওয়ায় মায়া বুঝল না রিদের মনোভাব। মায়া লাস্ট কথাগুলো বেশ শক্ত আর ধারালো শোনাল। রিদের শক্ত হয়ে থাকা চোয়ালে ঠাহর করতে না পেরে মায়া পুনরায় একই ভাবে বলল….

‘ মানুষ বিশ্বাসে ভালোবাসার ঘর বানায়। আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস শব্দটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। খালি ঘরটার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। আপনার মাও তো অবিশ্বাসের ঘর না বেঁধে একা জীবন পার করছেন। আমি পারব উনার মতন করে একা থাকতে। আপনি আমাকে ছেড়ে দি….

মায়ার বাকি কথা শেষ করার আগেই রিদের দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভাঙল। মুহূর্তের মাঝে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল রিদের হাতের কফির মগটা ফ্লোরে পড়ে। মায়া ভয়ে দু-কদম পিছিয়ে যেতেই রিদ হুঙ্কার ছাড়ার মতন গর্জে উঠে বলল….

‘ সামনে থেকে যা রিত।

রিদের কথায় মায়াও তেজ দেখিয়ে বলল….

‘ যাবই তো। আপনার মতন লোকের সামনে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। আমি কালই আম্মুর কাছে ঢাকা চলে যাব।

মায়া তেজ দেখিয়ে হনহন করে রুমে চলে যেতেই তীব্র ভাঙচুরের শব্দ হল বারান্দায়। রিদের তোলপাড়ে মায়াও ভয় পেল। এগিয়ে গিয়ে রিদের কাছে না গিয়ে জেদ দেখিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। দীর্ঘ মনোমালিন্যে মায়া আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। একটা সময় রিদের ভাঙচুরের শব্দ থেমে গেল। পরিবেশ শীতল হল। অন্ধকার কক্ষে মায়ার নাক টানার শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ হল না। মায়া বুঝতে পারল রিদ মায়ার শেষ কথাগুলো শুনে হয়তো ক্ষেপে গেছে। রিদ আগেই মায়াকে সাবধান করেছিল ছাড়াছাড়ি শব্দটা যেন মায়া কখনো রিদের সামনে উচ্চারণ না করে, অথচ মায়া রাগে বশে রিদকে বারবার ছাড়াছাড়ির হুমকি পর্যন্ত দিয়ে এল। বেশ করেছে মায়া ছাড়াছাড়ির কথা বলেছে। এই লোক এটারই প্রাপ্য। মায়া এই লোকের সঙ্গে কখনো সংসার বাঁধবে না। কাল কেউ মায়াকে নিয়ে না গেলে মায়া একাই চলে যাবে ঢাকা, তারপরও এই লোকের সঙ্গে এক ঘরে থাকবে না। মায়া দীর্ঘ ফুঁপানিতে ঘুম ধরছে না। ভিতরকার কষ্ট যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে অভিমানে। এর মধ্যে হঠাৎ এসে রিদ ধুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়, এতে মায়ার শরীর ঝাঁকিয়ে উঠল বিছানার কম্পনে। মায়া রিদকে এড়াতে চেয়ে আরও চেপে গেল বিছানার পাশে। শরীর বটে কুঁজো হয়ে যেতেই হঠাৎ রিদ ঝটকা মেরে টানল মায়াকে। মায়ার পিঠ রিদের বুকের ঠেকে যেতেই তীব্র থেকে তীব্রতর ছটফট করল মায়া রিদকে ছাড়াতে চেয়ে। অস্পষ্ট স্বরে কাঁদতে কাঁদতে মায়া আওড়াল….

‘ অসভ্য লোক, ছাড়ুন আমাকে। ছুঁবেন না আপনি আমাকে। আমি থাকব না আপনার সাথে। ছাড়ুন।

রিদ পিছন থেকে মায়াকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে মায়ার দু’পা বাঁধল নিজের পায়ে। মায়ার মাথায় গা চেপে স্পষ্ট স্বরে আওড়াল….

‘ দীর্ঘ দিনের অঘুমা আমি বউ। আমাকে একটু ঘুমাতে দে। তোর বিরহে পাগল আমিও হয়েছি। তোর অসুখ আমাকেও ছুঁয়েছে। ভিতরটা পুড়ে ছারখার হয়েছে। এবার একটু শান্তি দে।

চলবে।

#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৬৬
একটা সুন্দর সকালের সূচনা। বিছানায় শুয়া মায়া ঘুম থেকে উঠে রিদকে কোথাও দেখতে পেল না। মাথা তুলে পাশের জায়গাটা খালি দেখে উঠে বসল মায়া। গায়ের ওড়নাটা পাশ থেকে নিয়ে জড়াতে জড়াতে খালি পায়ে নামল মেঝেতে। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে এক পলক সময়টাও দেখে নিল। সকাল ৮:২৩। কাল এসেছে পর থেকে মায়া এই ঘর হতে বের হয়নি। বাড়ির বউ এত বেলা করে শুয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু দেখায়। যদিও মায়াকে বলার মতো কেউ নেই। তারপরও মায়ার উচিত ছিল অসুস্থ শ্বশুরের একবার অন্তত খোঁজ নেওয়া। মায়া দ্বিধা নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে চোখে পড়ল ডাইনিংয়ে বসা রাদিফ, আরাফ খান; আর নিহাল খানকে। সবাই সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। সবাইকে একত্রে দেখে মায়া খানিকটা দ্বিধাবোধ করল নিচে নামতে। হেনা খান দাঁড়িয়ে সবাইকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। আবার কিচেন হতে এটা সেটা এগিয়েও আনছেন। তবে রিদকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। চঞ্চল রাদিফ খেতে খেতে দেখল মায়াকে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে। খাওয়া বন্ধ করে তক্ষুনি ডাকল মায়াকে…

“ভাবি, আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এদিকে আসুন! আমাদের সাথে বসে নাস্তা করুন।

রাদিফের ডাকে সকলেই তাকাল সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মায়ার দিকে। একত্রে এতগুলো মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতে মায়া জড়তায় সিঁটিয়ে মাথার কাপড় টানতেই মায়াকে দ্বিতীয়বারের মতো ডাকল হেনা খান…

“এদিকে আয় মায়া। নাস্তা করবি। তোর ওষুধ আছে। আয় তাড়াতাড়ি।

মায়া জড়তার পা ফেলে সেদিকে এগোল। মায়া অন্য একটা খালি চেয়ার দেখে সেটাতে বসতে চাইলে আরাফ খান বাঁধা দিয়ে নিজের পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে মায়াকে বসতে বলে তিনি বললেন…

‘ তুমি আমার পাশে বসো তো মায়া। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে বুঝলে? বসো বসো।

মায়া জড়তার পায়ে এগিয়ে এসে আরাফ খানের পাশে চেয়ারটায় বসতে গম্ভীর মুখ খুললেন নিহাল খান। তিনি মায়ার উদ্দেশ্যে বললেন…

‘কেমন আছেন আম্মু? আপনার শরীর ভালো আছে?

মায়া জড়তায় সিঁটিয়ে মিহি স্বরে বলল….

‘ জ্বি আব্বু, আলহামদুলিল্লাহ! আপনি ভালো আছেন?

“জ্বি, আল্লাহ রাখছেন ভালো। তবে রাতে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ ছিলেন? মাথা ব্যথা কমেছে আপনার?

মায়া রাতে রিদের সঙ্গে রাগ করে ঘর হতে বের হয়নি সেটা রিদ বাদে অন্য কেউ জানে না। স্বামীর উপর রাগ থেকে মায়া রাতে কারও সাথে দেখা বা কথা বলেনি। মায়া মনে মনে বেশ অনুতপ্ত হলো রাতের ব্যাপারটায়। তবে মায়া রাতে অসুস্থ ছিল না, বরং ভালোই ছিল। কিন্তু নিহাল খান যখন বলছেন মায়া অসুস্থ, ওর মাথা ব্যথা ছিল—তার মানে কেউ নিশ্চয়ই উনাকে মায়ার ব্যাপারে এটাই বলেছেন। মায়া জড়তা নিয়ে বলল…

“জ্বি।

নিহাল খানের খাওয়া শেষ। তিনি পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে রাখতে রাখতে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল….

” আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল আম্মু।

‘ জ্বি বলুন!

নিহাল খান সময় নিয়ে মায়ার উদ্দেশ্যে গুছিয়ে বলল…

‘ আসলে আমি এবং আমার পরিবার সকলেই অনেক অনুতপ্ত, আপনার প্রতি। আপনার সাথে যা হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা খুবই লজ্জিত। সত্যি বলতে, আমরা আমাদের ছেলের জন্য দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়, সেজন্য আপনার খেয়াল করতে পারিনি আমরা। ছেলের বুকভরা তাজা রক্ত দেখে আমাদের দুনিয়া ঘুরে গিয়েছিল—কী করব, কী করা উচিত তখন ঐ মুহূর্তে সব ভুলে শুধু ছেলের জন্য পাগল হয়ে ছিলাম। আমরা আসলে বুঝতে পারিনি আমাদের অনুপস্থিতিতে আপনি এতটা ভুক্তভোগী হবেন।

নিহাল খানের কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল না কী উত্তর দেবে। মায়া কি ওর শ্বশুরের কথায় ‘ঠিক আছে’ বলবে নাকি চুপ থাকবে? মায়াকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে হাঁসফাঁস করতে দেখে নিহাল খান মায়ার ভেতরের অবস্থা বুঝে নিয়ে তিনি বললেন…

“সমস্যা নেই আম্মু, আপনার কিছু বলতে হবে না। তবে কথা দিচ্ছি, আপনাকে আপনার যোগ্য সম্মান দিয়ে রাখব এই পরিবারে। দ্বিতীয়বার যেন একই ভুল না হয় সেই খেয়ালও রাখব আমরা। আপনি আমাদের উপর শেষবারের মতোন বিশ্বাস করতে পারেন।

কথাগুলো শেষ করে তিনি খাবার শেষ করে উঠে গেলেন বাইরে। বাহিরে লোকেদের ভিড় জমেছে। তাদের নিয়ে সমাবেশে বের হবেন তিনি। আজ একটা পার্টিদলের সমাবেশ আছে উনাদের। নিহাল খান চলে যেতে যেতে উনার কানে এল রাদিফের কথা। রাদিফ মায়ার উদ্দেশ্যে বলছে…

“ভাবি, সকাল থেকে আম্মু আপনার খোঁজে দশবারের বেশি ফোন দিয়েছে আমাকে। এতবার তো আম্মু আমাদের খোঁজেও ফোন দেয় না, যতটা আপনার খেয়ালে দেয়। ভাবছি আমার হাতের ফোনটা আপনাকে দিয়ে যাব। আমাদের থেকে আম্মুর আপনার চিন্তা বেশি। আপনি আমাদের বোন হলে আরও ভালো হতো ভাবি। অনেক আদুরে থাকতেন আপনি। রিদ ভাই আর আম্মু আপনাকে একটু শাসন করলেও আমি আর আব্বু কিন্তু আপনাকে অনেক আদর করতাম ভানি। রিদ ভাই আপনার বড় ভাই হতো আর আমি ছোট ভাই। বিষয়টা মজার না?

কথাগুলো বলেই রাদিফ জিভ কামড় দেওয়ার মতো করে নিজের কথাটা নিজেই সংশোধন করে বলল…

“সরি সরি ভাবি! ভুল বলেছি, ভুল বলেছি,, রিদ ভাইকে আপনি ভাই বলতে পারবেন না। রিদ ভাই আপনার জন্য যে পাগল মানুষ আল্লাহ! ভাই যদি শুনে আমি আপনাকে বোন বানানোর স্বপ্ন দেখছি তাহলে আমার রক্ষা নেই। আপ…

“আউট!

রিদের গম্ভীর গলার ধমকে তৎক্ষণাৎ মাথা ঘুরিয়ে তাকাল রাদিফ। রিদকে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝল রিদ রাদিফের কথাগুলো শুনেছে এতক্ষণ । রাদিফ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বোকার মতো হেসে বলল…

“আরে ভাই, আমার কোনো দোষ নেই এতে বুঝলে। এসবে ভাবিই আমাকে বলল উনার নাকি তোমাকে মামা বানানোর খুব ইচ্ছে ছিল। অথচ তুমি যে ভাবির বাচ্চার বাবা হতে ইন্টারেস্ট সেটা উনি বোঝে না।
তুমি একটু বুঝিয়ে বলো তো এমন দুষ্টু ইচ্ছা যেন ভাবি না রাখে। তুমি তাতে কষ্ট পাও।

রাদিফ দুষ্টু হেসে চলে যেতেই রিদ মায়ার দিকে তাকাল। মায়া হাঁ করে রাদিফের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কী সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যা বলে রাদিফ! রাদিফ চলে যেতে মায়া দৃষ্টি ঘোরাতে গিয়ে রিদের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মায়া তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নত মস্তকে বসে পড়ল চেয়ারে। রিদ মায়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে মায়ার পাশের খালি চেয়ারটায় বসতে চাইলে পুনরায় বাঁধা দিলেন আরাফ খান। তিনি রিদকে নিজের পাশের চেয়ারটায় বসতে বললে রিদ অগ্রাহ্য করে মায়ার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। আরাফ খান চেয়েছিলেন তিনি রিদ ও মায়ার মধ্যখানে বসতে, কিন্তু রিদ সেই সুযোগ না দিয়ে মায়াকে মধ্যস্থ রেখে বসতে বসতে বলল…

“তোমার খাওয়া শেষ হলে উঠে যাও দাদভাই। আমার প্রাইভেসি লাগবে।

আরাফ খানের খাওয়ার পর্বটা আরও আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি খালি কাপের চা নিয়ে বসেছিলেন মূলত মায়ার সাথে আড্ডা জমাবেন বলে। কিন্তু রিদ আরাফ খানকে চলে যেতে বললে তিনি খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন…

” তুই রুমে কি এমন করতে পারিস না যে তোর বউ নিয়ে ডাইনিংয়ে প্রাইভেসি লাগবে?

আরাফ খানের কথায় রিদ একই ভাবে উত্তর দিয়ে বলল…

“তুমি যা বুড়ো বয়সে রুমে করতে পারো না আমি তাই-ই করি।

রিদের হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় ক্ষেপে উঠলেন আরাফ খান। উনাকে কেউ বুড়ো বললে বেজায় চটে যান তিনি। রেগেমেগে রিদকে শুধালেন…

“বুড়ো হবে তোর বাপ। আমি এখনো জোয়ান আছি।

রিদ আরাফ খানের কথায় পাত্তা না দিয়ে মায়ার নাস্তার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল…

“আচ্ছা!

“এই আচ্ছা কি হ্যাঁ?

“ওকে!

পরপর রিদের হেয়ালি কথায় আরাফ খানের রাগ বাড়ল। তিনি রিদকে শুধিয়ে বললেন…..

“তুই তোর মাকে আমার নামে মিথ্যা বললি কেন? যে আমার বুক ব্যথা হয়েছিল কাল।

“আমার প্রাইভেসি দরকার ছিল তাই বলেছি।

রিদের কথায় আরাফ খান অবাক সুরে বললেন…

“তোর প্রাইভেসির জন্য আমাকে হার্টের রোগী বানিয়ে দিবি? তুই এত প্রাইভেসি দিয়ে কী করিস বল তো?

রিদ সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল…

“বউকে সময় দিই।

রিদের কথায় আরাফ খানও খোঁচা মারার মতো করে বলল….

“বউকে এত সময় দিয়ে করিস কী? বাপ তো আর হতে শুনলাম না। আবার চাস প্রাইভেসি। তোর বয়সে আমি তিন সন্তানের বাপ হয়ে গিয়েছিলাম এতদিনে। আর তুই এখনো একটারও হতে পারলি না।

রিদ মায়ার প্লেটে রুটি তুলে দিতে দিতে বলল…

“আমার বউ ছোট। তোমার মতো বুড়ো বউ বিয়ে করলে এতদিনে তিনটা কেন, সাতটা সন্তানের বাপ হয়ে যেতাম। তুমি নিশ্চয়ই পুষ্টিহীন রোগী ছিলে বলে কষ্ট করে তিনটার বাপ হতে পেরেছিলে। আমার মতো তাগড়া যুবক হলে নিশ্চয়ই এতদিনে খান বাড়িতে লাইন পড়ত তোমার সন্তানদের।

রিদের কথায় আরাফ খানের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তিনি পুষ্টিহীন রোগী ছিলেন? উনি এক ছেলে ও তিন কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। সেই সময়ে তিনি এক হৃষ্টপুষ্ট তাগড়া যুবক ছিলেন। উনাদের স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধানও খুব একটা ছিল না। তাই বলে রিদ উনার সুন্দরী বউকে বুড়ো আর উনাকে পুষ্টিহীন রোগী বলবে?
আরাফ খান রিদের কথায় রেগে চলে যেতে যেতে বললেন…

“তুই আর তো বাপ পুষ্টিহীন রোগী। আমি তো তাও টেনেটুনে চার সন্তানের বাপ হয়েছি। তোর বাপের তো তার মুরাদই নেই। দুটোতেই সে ক্লান্ত হয়ে ইতি টেনেছে, বউকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে। আর তুই এসেছিস আমার পুরুষত্বের দিকে আঙুল তুলতে। তোরা বাপ-ছেলে মিলেও তো আমার চার সন্তানের রেকর্ড ভাঙতে পারবি না। যদি পারিস তাহলে আমার নামও আরাফ খান না অন্য কিছু রাখব। যাহ!

পরপর কথাগুলো বলেই আরাফ খান লাঠি হাতে বেরিয়ে যান। এখানে থাকলে যে রিদের সঙ্গে কথায় পারবে না তা তিনি বেশ জানেন। সেজন্য রিদকে নিজের কথাগুলো শুনিয়ে বের হয়ে যেতে মায়াও রিদের পাশ থেকে উঠে যেতে চাইল। রিদ আর আরাফ খানের মাঝে এতক্ষণ মায়া নীরব দর্শক ছিল। লজ্জায় মুখ থমথমে হয়ে আছে মায়ার। ওহ রিদকে এড়িয়ে চলে যেতে চাইলে রিদ পিছন থেকে মায়ার চুলের বেণি টেনে ধরতে মায়া মৃদু স্বরে ‘আহ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল ব্যথায়। রিদ মায়ার বেণি হাতে পেচিয়ে মায়াকে পুনরায় জায়গায় বসাতে বসাতে বলল…

“রিত আমি একই কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না। রাতে বিষয়টা ছেড়ে দিলেও যে এখন তোমাকে ছেড়ে দেব বিষয়টা এমন নয়। আমার তোমার উপর রাগ ছিল কিন্তু বিশ্বাস হারাইনি কখনো। যদি বিশ্বাস হারাতাম তাহলে তোমাকে কখনো আমার বাড়িতে জায়গা দিতাম না। তুমি জানো আমি আমার কথা ছাড়া কারও কথা বিশ্বাস করে কাজ করি না। আমার আম্মু তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসার পিছনে আমারও সম্মতি ছিল। যদি আমার সম্মতি না থাকত তাহলে আমার মা কেন, দুনিয়ার কারও ক্ষমতা নেই রিদ খানের বাড়িতে তোমাকে রাখার। সবকিছু একতরফা দেখতে নেই। আমি রাগটা সবার সামনে প্রকাশ করতে পারি কিন্তু ভালোবাসাটা পারি না। আমা…

রিদের বাকি কথা শেষ হওয়ার আগে মায়া মাঝে ফোড়ন কেটে বলল…

“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই-তো?

মায়া রিদের কথা গুলোর মাঝে শুধু একটা কথাই বুঝলো—রিদ রাগ প্রকাশ করতে পারলেও রিদের ভালোবাসাটা আড়ালে থাকে। তার মানে রিদ মায়াকে ভালোবাসে? রিদ মায়াকে ভালোবাসে সেটা মায়া জানে, কিন্তু রিদ কখনো মায়াকে প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি দেয়নি এটা নিয়ে। তাই আজ মায়া কথায় কথায় রিদের থেকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করাতে চাইল। কিন্তু রিদ মায়ার কথায় বিরক্তি চোখে তাকাল মায়ার দিকে, মায়ার চুল ছেড়ে দিতে দিতে বলল…
“নাহ বাসি না।

“তাহলে আমিও আপনার সাথে থাকব না। যান।

মায়া জেদ করে আবারও উঠে যেতে চাইলে রিদ পুনরায় মায়াকে টেনে চেয়ারে বসাতে বসাতে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল…

“তুই থাকবি, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীও থাকবে বেয়াদব।

“ঠিক আছে যান, নিয়ে আসুন আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে। তারাই আপনার সাথে সংসার করবে নে। আমি পারব না।

রিদ ধমকে বলল…

“রিত!

রিদের ধমকে মায়া হাত গুটিয়ে চুপ করে বসল। রিদ নিজের রাগ চেপে মায়ার প্লেটে খাবার তুলে দিতে মায়া পিঠ বেঁকে বসল খাবে না বলে। রিদ মায়ার কাঁধে হাত রাখতে মায়া রিদের হাত সরিয়ে দিল। রিদ পুনরায় রেগে গেল। সে জীবনে কারও এসব রাগ সহ্য করেছে কিনা সন্দেহ, অথচ বিয়ে করে বউয়ের পাল্লায় পড়ে জীবনে যা না করেছে আজ তাই করতে হচ্ছে। রিদ পুনরায় মায়ার কাঁধে হাত রাখতে চাইলে মায়া একই ভাবে রিদের হাতটা সরিয়ে দিতে গেলে রিদ ক্ষেপে যায়। শক্ত হাতে মায়ার বাহু টেনে নিজের দিকে ফেরাতে ফেরাতে রাগান্বিত গলায় বলল…

“কী সমস্যা তোর? এমন করছিস কেন?
“খাব না আমি!
“কেন?
“আমাকে আম্মুর কাছে দিয়ে আসুন।
“পারব না।
“কেন?
“বিয়ে করেছি আমি। বউ আমার সাথে থাকবে তাই।

“তাহলে আম্মুকে এই বাড়িতে এনে দিন। আম্মু তো এই বাড়ির বউ। আপনারা কেন আম্মুকে এই বাড়িতে ফেরাচ্ছেন না?

রিদ মায়াকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলল….

“আমাকে এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে জড়াবে না রিত। আম্মু-আব্বুর বিষয়টা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারা তাদের জীবনের সঙ্গে কী করবে সেটা তাদের একান্ত বিষয়। এত বছরও যখন তাদের সিদ্ধান্ত বদলায়নি তাই আমি সন্তান হয়ে সেসবে জড়াতে চাচ্ছি না। আমার এমনিতেও কারও ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা পছন্দ না। আমার মনে হয় আম্মুরও পছন্দ হবে না উনার ব্যক্তিগত জীবনে কেউ হস্তক্ষেপ করুক সেটা নিয়ে। তুমি এসবের থেকে দূরে থাকো রিত। আমি নতুন ঝামেলা চাচ্ছি না।

রিদের কথায় মায়া তর্ক করল না। কারণ রিদ আর সুফিয়া খান দুজন একই ব্যক্তিত্বের মানুষ। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না তাঁরা। তবে মায়া এতদিনে বেশ করে সুফিয়া খানকে চিনেছে। উনার সংসার জীবন খুব পছন্দের। উনি যত্নসহকারে আগলে রাখেন সংসারের প্রতিটা মানুষকে। রিদ বা সুফিয়া খান হয়তো তাদের ব্যক্তিত্বের জন্য সহজে কাউকে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু একবার যদি কাউকে মেনে নেয় সারাজীবন আগলে রাখার মতো গুণ তাদের আছে। সেজন্য মায়ার ধারণা সুফিয়া খান নিহাল খানের সাথে মনোমালিন্যের জন্য দূরে দূরে থাকলেও আজও হয়তো দুজন দুজনকে ভালোবাসেন। নয়তো বিচ্ছেদের এত বছর পরও কেন কেউ কাউকে ডিভোর্স দিচ্ছেন না? ভালোবাসা আছে বলেই তো তারা বিচ্ছেদ চাচ্ছেন না। মায়ার ধারণা যদি কোনো রকমে ওর শ্বশুর-শাশুড়িকে একত্রে এক ছাদের নিচে আনা যায় তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা তাদের মনোমালিন্য পিছনে ফেলে কথা বলার একটা সুযোগ দেবেন দুজন দুজনকে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো সুফিয়া খান যে মানুষ জীবনেও কারও কথা শুনে এই খান বাড়িতে পা রাখবেন না। বাকি রইল ওর শ্বশুর নিহাল খান—উনি খুবই নমনীয় স্বভাবের মানুষ। উনাকে কোনোভাবে সুফিয়া খানের বাড়ি অবধি কয়েক দিনের জন্য পাঠাতে পারলে হয়তো কোনো একটা কাজ হতো। কিন্তু মায়া ওর শ্বশুরকে শাশুড়ির বাড়িতে পাঠানোর মতো, এই অসম্ভব কাজটা কীভাবে করবে ওহ? মায়ার মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝে রিদ মায়ার মুখের সামনে রুটি ছিঁড়ে এক টুকরো ধরতে মায়া সেটি মুখে নিতে নিতে বলল…

“আপনার ফোন কোথায়?

রিদ কিছু বলবে তার আগেই মায়া রিদের উপর চিরুনি তল্লাশি চালাল। রিদের বুকে, প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াল ফোনের খোঁজে। কিন্তু কোথাও রিদের ফোনের খোঁজ না পেয়ে মায়া অধৈর্য হয়ে পুনরায় রিদকে শুধালো…

“আপনার ফোন কোথায় বলুন।

রিদের বাম পাশে ডাইনিংয়ের উপর রাখা ছিল ফোনটি। ডান পাশে মায়া বসে। অধৈর্য মায়া রিদের ডানে-বামে না খুঁজে রিদের উপর তল্লাশি করল। রিদ পুনরায় মায়ার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বাম হাতে নিজের ফোনটি মায়ার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…

“তুমি আমার হয়ে থেকো রিত, গোটা দুনিয়া আমি তোমার করে দেব।
~~
রাতের আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। মস্ত বড় আকাশে থালার মতো চাঁদও উঠেছে। সেই চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল ধরণী। রাত দশটা সতেরো।
জুই গ্রিলের মাথা ঠেকিয়ে সেই আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে। মনের উতালপাতায় অসংখ্য কথা তীরের মতো বিঁধছে বুকে। আজ গত এক সপ্তাহ ধরে সে আয়নের ফ্ল্যাটে থাকছে পরিবার থেকে দূরে। এর মাঝে জুই বেশ কয়েকবার মুক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল ঐ বাড়ির খোঁজ নিতে। মুক্তাও বেশ জুইয়ের উপর রেগে আছে—এমন পরিস্থিতিতে জুই কেন আয়নের সঙ্গে পালিয়ে গেল তা নিয়ে। জুইয়ের বাবা নাকি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন জুইয়ের কাজে। আচ্ছা জুই কি আসলেই আয়নের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল? মন বেদনায় ডুকরে কেঁদে উঠল জুই। আয়ন ঘরে প্রবেশ করতে করতে জুইয়ের ফুঁপানো শব্দে দ্রুত ঘরের আলো জ্বালালো। অন্ধকার কাটিয়ে শূন্য ঘরে কাউকে দেখতে না পেয়ে হাতে ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে হাঁটলো বারান্দার দিকে। জুইকে গ্রিল ধরে কাঁদতে দেখে আয়ন জুইয়ের বাহু টেনে নিজের কাছে টানতে টানতে উত্তেজিত গলায় বলল…

“আপনি কাঁদছেন কেন জুই? কী হয়েছে?

আয়নের বুকে ঠাঁই পেয়ে জুইয়ের কান্না বাড়ল। দু’হাতে আয়নের পিঠ জড়িয়ে বুকে মুখ লুকাতে লুকাতে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল…

“আমাকে কেউ ভালোবাসে না ডাক্তার সাহেব। সবাই ঘৃণা করে। আব্বু আমাকে ঐ বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছেন, বলেছেন আমি নাকি তাদের জন্য মরে গেছি। সত্যি আমি মরে গেছি ডাক্তার সাহেব?

জুইয়ের কান্নার কারণটা বুঝতে পেরে আয়ন গুমোট নিশ্বাস ফেলল। এই আজ নতুন নয়। জুই যবে থেকে এই বাসায় এসেছে তখন থেকে জুই নিজের পরিবারের থেকে দূরত্বটা হুট করে মেনে নিতে পারছে না। তাছাড়া আয়নও ভাবেনি জুইকে ঐভাবে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে। সে জুইকে নিজের কাছে আনতে চেয়েছিল, তবে সেটা সসম্মানে। আয়ন জুইয়ের মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে আশ্বস্ত করে বলল…

“আমার উপর বিশ্বাস রাখুন জুই, আমি সবকিছু ঠিক করে দেব। আমার পরিবার এই মাসে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরবে, তখন আমার বাবা-মাকে আপনাদের বাসায় পাঠাব। আপনার বাবাকে বুঝিয়ে তারপর সসম্মানে আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে আমার ঘরে তুলব। আপনি কষ্ট পাবেন না জুই। আমাকে একটু সময় দিন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্বাস রাখুন।

“আমি কোনো আনুষ্ঠানিকতা বিয়ে চাই না ডাক্তার সাহেব। যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। আমি কোনো কিছুর পরিবর্তন চাই না। আমি জানি আমার বাবা কেমন, উনি এক জেদি পুরুষ—যতক্ষণ না তিনি নিজে থেকে সবকিছু বুঝবেন ততক্ষণ পযন্ত তিনি কারও কথা শুনবেন না। আমি চাই না আমার জন্য আপনি বা আপনার পরিবার ছোট হোক। যেটা হচ্ছে সেটা হতে দিন, আমি সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব দ্রুত।

কয়েক মূহুর্ত দুজনের এইভাবে কাটলো। হঠাৎ জুইয়ের হুশ ফিরতে সে আয়নকে ঠেলে নিজের থেকে দূরে সরাতে চাইলে আয়ন বাঁধা দিয়ে বলল..

“জুই, আজকে আমি আপনার সাথে থাকি?

জুই আয়ন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল..

“না।

“প্লিজ জুই, না করবেন না। আমি রাতে চোখে দেখতে পাই না।

আয়নের কথার মানে বুঝতে না পেরে জুই অবুঝ গলায় শুধালো আয়নকে বলল….

“মানে?

“হ্যাঁ জুই! আমি দূরের জিনিসটা একদম দেখতে পাই না। সেজন্য ডক্টর বলেছে আমাকে বউয়ের আশেপাশে থাকতে।

“আপনি ডাক্তার হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন?

“হ্যাঁ! আমিতো হার্ট সার্জন। চোখের ডাক্তারের কাছে না গেলে চোখের সমস্যা ভালো হবে কীভাবে বলুন?

আয়নের মনগড়া কথার মানে জুই বুঝতে পেরে জুই দুহাত বুকে বাঁধতে বাঁধতে বলল…

“তা ডাক্তার আর কী বলেছে আপনাকে?

“বলেছে আমার নাকি ভিটামিনের অভাব।

“তো কি করতে হবে?

“আপনার আশেপাশে থাকতে বলেছে। আপনাকে বেশি বেশি সময় দিতে। রাতে আপনার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতেও বলেছে।

আয়নের কথায় জুইয়ের হাসি পেল। নিজের হাসি চেপে রাখতে না পেরে জুই চলে যেতে নিয়ে বলল…

“যতসব ধান্দাবাজি আপনার! সরেন।

জুই আয়নকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আয়ন শক্ত হাতে জুইয়ের বাহু টেনে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল…

“আপনি দূরে গেলে তো চলবে না জুই। এমনি আমার চোখের সমস্যা, দূরের জিনিসটা দেখি না। আপনাকে হারিয়ে ফেললে তো আমার ভিটামিনের অভাব বাড়বে জুই। এর থেকে বরং আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা শক্ত করে চুমু খান, যেন আমার সকল অপুষ্টিহীতায় চলে যায়।

জুই লজ্জায় সিঁটিয়ে গেল আয়নের বুকে। খানিকটা মোচড়ামুচড়ি করে আয়ন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেয়ে বলল…

“আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।
“অসম্ভব।”
“আমি মায়ার কাছে যেতে চাই, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন।

আয়ন এক হাতে জুইকে জড়িয়ে অপর হাত জুইয়ের গাল স্পর্শ করে শব্দ করে চুমু খেতে খেতে মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল…

“মায়া ঢাকায় নেই। রিদের সঙ্গে চট্টগ্রামে আছে। আপনাকে কাল নিয়ে যাব চট্টগ্রামে, তারপরও আজ আমাকে বাঁধা দেবেন না জুই প্লিজ!
~~
রাত এগারোটা সাতাশ। মায়া অন্ধকার রুমে অল্প আলোয় পায়চারি করছে ঘর জুড়ে। হাতে রিদের ফোন। এটা সকালে নিয়েছিল, তখন থেকে এটা মায়ার কাছেই আছে। এই ফোনে মায়া দুটো কাজ করেছে—এক, রাফার সাথে যোগাযোগ করেছে; দ্বিতীয়ত, নিজের বাড়িতে কল দিয়েছিল মায়ের নাম্বারে, কিন্তু রেহেনা বেগমের নাম্বারটা বরাবরই বন্ধ বলেছে। মায়া খানিকটা চিন্তিত নিজের পরিবার নিয়ে। বহুদিন ধরে মায়া নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এমন না যে মায়া ওর পরিবারের সবাইকে মিস করবে। মায়া শুধু ওর মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে চায়। মায়াকে যখন ওর বাড়ি থেকে সুফিয়া খান নিয়ে আসে তখন ঐ বাড়ির পরিস্থিতি ভালো ছিল না। অনুকূল পরিস্থিতিতে মায়ার মা কেমন আছে সেটাই জানতে চায়। নিজের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে মায়া ভীষণ হতাশ হলো, তবে আজ বেশ কয়েকবার সুফিয়া খানের সঙ্গে মায়ার কথা হয়েছে। মায়া এখন একমাত্র লক্ষ্য কীভাবে সুফিয়া খানকে এই বাড়িতে নিয়ে আসা যায়। মায়া জানে কাজটা সহজ হবে না, তারপরও মায়া এই অসাধ্য কাজটা সাধন করতে চায়। মায়া রুম জুড়ে পায়চারি করার মধ্যে রিদ ঘরে ঢুকল। অল্প আলোয় মায়াকে কালো ছায়ার মতো দেখাতে রিদ ঘরে আলো জ্বালালো। মায়াকে সাদামাটা একটা সুতির থ্রি-পিস পরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিদ দেয়াল ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে কপাল কুঁচকে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল…

“ঘুমাওনি? এত রাত অবধি জেগে আছো কেন?

রিদের ক্লান্তি মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া মিনমিন করে বলল…

“আমার ঘুম আসছে না।

রিদ হাতের কোটটা ছুঁড়ে সোফার উপর ফেলতে ফেলতে মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে ডেকে বলল…

“কাছে এসো!

মায়া জড়তার পায়ে এগিয়ে গেল রিদের দিকে। রিদ মায়ার নাক টেনে কপালে টোকা দিতে দিতে খানিকটা ঝুঁকে গেল মায়ার উপর। ঠান্ডা গলায় বলল…

“শার্ট চেঞ্জ করো।

রিদের কথায় মায়া অবাক নেত্রে তাকাল রিদের দিকে। বলল…

“আমি?

“হুম!

রিদের সেই অপরিচিত মোহাচ্ছন্ন স্বর। মায়ার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল অদ্ভুত অনুভূতিতে। মায়া হাঁসফাঁস করে জড়তার হাত বাড়িয়ে রিদের শার্টের বোতাম খোলে গা থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নিতে মায়ার চোখে পড়ল রিদের শক্তপোক্ত শরীরটা। হাতা কাটা গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে রিদের আটসেটে মাংস পেশি শক্ত দেহটা। মায়া হতবাক হতবুদ্ধি চোখে রিদের শরীরের দিকে দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে হাত বাড়াল রিদের বাহুতে। রিদের শক্ত বাহু ছুঁয়ে মায়া হতবাক গলায় বলল…

“আল্লাহ, আপনি তো অনেক মোটা হয়ে গেছেন নেতা সাহেব। আপনার শরীর এত শক্ত কেন?

মায়ার কথায় রিদ পুনরায় মায়ার মাথায় টোকা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল…

“পাওয়ারফুল মেডিসিনে শরীর ফুলে গেছে একটু।

মায়া এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল রিদের অ্যাক্সিডেন্টের কথা। মায়া অবুঝ গলায় প্রশ্ন করে বলল…
“ওষুধ? কিসের ওষুধ খান আপনি?

“এত অল্পতে অ্যাক্সিডেন্টের কথা ভুলে গেলে হবে ম্যাডাম?

কথাটা বলে রিদ মায়াকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেতে চাইলে তৎক্ষণাৎ মায়া রিদের হাত টেনে ধরল। হাতে টান পড়ায় রিদ কপাল কুঁচকে ঘাড় বেঁকিয়ে পিছনে তাকাতে দেখল অশ্রুসিক্ত চোখে মায়াকে কাঁদতে। রিদ হুট করে বুঝল না মায়ার কাঁদার কারণটা। মায়া রিদের হাত টেনে তৎক্ষণাৎ দু’হাতে রিদকে জড়িয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল দীর্ঘ দিনের চাপা কষ্টে। অনেকটা দিন রিদের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে সুস্থতা কামনা করে কেঁদে কাটিয়েছে মায়া। অথচ মানুষটা সুস্থ হয়ে সামনে আসার পর দুজনের দূরত্ব কমছে না। মায়া এলোমেলো দু’হাতে রিদের গাল আঁকড়ে রিদের মাথা টেনে নিচু করলো মুখোমুখিতে। এলোমেলো ঠোঁট রিদের মুখে ছুঁতে দিতে রিদ খানিকটা শকট খেল। মায়া হাইটে ছোট হওয়ায় দু’পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে রিদকে চুমু খেতে গিয়ে দিকে এগিয়ে গেল। রিদ মায়ার শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে পিছু হাটল পরপর। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে রিদের পা বিছানায় ঠেকতে রিদ ধপ করে বিছানায় বসে পরলে মায়া রিদের মুখের উপর ঝুঁকে গেল। দু’হাতে রিদের দু’গাল আঁকড়ে এলোমেলো ঠোঁট রিদের মুখ ছুঁয়ে উঠল রিদের মাথায়। অ্যাক্সিডেন্টের জায়গাগুলোতে মায়া পরপর ঠোঁট বুলিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল দু’হাতে রিদের গলা জড়িয়ে। রিদের গলায় মুখ ডুবিয়ে কেঁদে উঠে বলল…

“আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না নেতা সাহেব। সত্যি বাঁচব না। আপনার সঙ্গে দুঃখের জীবন কাটাতে রাজি, কিন্তু আপনাকে হারিয়ে সুখী হতে রাজি নই।

#চলিত…