রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৬৮

0
1

#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৬৮
রিদের কথায় মায়া হঠাৎ লজ্জায় পড়ে গেল। রিদের প্রখর দৃষ্টি এড়াতে পিঠ মুড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মিনমিন গলায় বলল…

‘এমনি এমনি হয়েছি আর কি!

রিদ মায়ার বাহু টেনে নিজের দিকে ফিরাতে ফিরাতে বলল…

‘এমনি এমনি কিভাবে হয় সেটা বুঝাও আমাকে। আমি তো আজ পর্যন্ত শুনলাম না কেউ এমনি এমনি বাবা হতে। আমার কঠোর পরিশ্রম করার আগেই ফল পেয়ে গেলাম। এমন চমৎকার কিভাবে হলো সেটার ব্যাখ্যা দাও।

রিদের কথায় মায়া হাঁসফাঁস করলো। কোনো কিছু উত্তর করতে না পেরে তটস্থ হয়ে আবার পিঠ মুড়ে দাঁড়াল। রিদ একই ভাবে মায়া’র বাহু টেনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাল। সরাসরি মায়াকে প্রশ্ন করে বলল…

‘কাহিনি কী? মিথ্যা ছড়াচ্ছ কেন?

নত মস্তিষ্কের মায়া আরও নত হয়ে দাঁড়াল। মিনমিন করে বলল…

‘শুনলে আপনি আমাকে বকবেন।

‘ বকবো না।

‘ তিন সত্যি বলুন।

‘তোমার এত কাহিনি শুনেও যখন হজম করতে পেরেছি তাহলে বাকিটা শুনেও হজম হবে। বকবো না। বলো।

‘ সত্যি তো?

মায়া আড়চোখে একবার রিদের দিকে তাকাল। রিদ মায়া’র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় মুহূর্তে চোখ মিলল দু’জনের। মায়া ফের দৃষ্টি নত করে মিনমিন করে বলল….

‘আম্মুকে আপনাদের বাড়িতে ফিরানোর জন্য মিথ্যা বলেছি আমি প্রেগন্যান্ট।

মায়ার কথায় রিদ তৎক্ষনাৎ বিরক্তি প্রকাশ করলো। সে চিনে তার মাকে। এসব ফালতু কথাকে কখনো তিনি বিশ্বাস করবে না। বরং চট করে বুঝে যাবেন কে উনাকে মিথ্যা বলছে আর কে উনাকে সত্যি বলছে। তাছাড়া মায়া প্রেগন্যান্ট হলে তিনি এই বাড়িতে কখনো আসবে না বরং মায়াকে নিজের কাছে নিয়ে রাখবেন তিনি। রিদের বোকা বউটার গিলুতে এই ছোট কথাটি ঢুকলো না। অথযা অকারণে রিদের নাম বদনাম করলো চারপাশে। হৈচৈ করে সবাইকে মিষ্টিমুখ পযন্ত করাল। রিদ বিরক্তি গলায় বলল…

‘ তুমি আর কাহিনি খুঁজে পেলে না? খুঁজে খুঁজে তোমাকে এই ফালতু মিথ্যাটাই রটাতে হলো? তোমার এসব কথায়, তোমার চতুর শাশুড়ি ফিরবে বলে মনে হয়? তুমি কতটুকু চিনো সুফিয়া খানকে? তোমার ধারণা আছে উনার সম্পর্কে? খবর নিয়ে দেখো, তুমি যাকে মিথ্যা শুনাচ্ছো সে তোমার নাড়িভুঁড়ি চেনা শেষ। তোমার এসব মিথ্যা কখনো কাজে দিবে না রিত। তাছাড়া তুমি কেন? কেউ আম্মুকে ফিরাতে পারবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আম্মু নিজ থেকে খান বাড়িতে ফিরতে চাই ততক্ষণ। তাই এসব কাহিনি করা বদ্ধ করো। অযথা এসবে আমার নাম খারাপ হচ্ছে।

রিদের কথায় মায়ার মন খারাপ হলো। তারপর আশা ছাড়ল না। বরং জেদি গলায় রিদকে বলল…

‘আম্মু ফিরবে। আমি ফিরাব উনাকে।

রিদ আগের ন্যায় বিরক্তি প্রকাশ করে বলল…

‘ওকে, যা খুশি তা করো গিয়ে, তবে আমাকে এসবে জড়াবে না। কোনো কিছু না করে বারবার বদনাম হতে ভালো লাগে না।

রিদের কথায় মায়া একই সুরে বলল…

‘ওকে আপনাকে টানব না তাহলে আপনি একটা বুদ্ধি দিন।

রিদ কাটকাট গলায় নাহুচ করে বলল…

‘আমি পারব না।

‘প্লিজ!

‘নো!

রিদের ‘না’ করাতে মায়া জেদি গলায় বলল…

‘ঠিক আছে আপনার বুদ্ধি দিতে হবে না। তবে আমিও বারবার টানব আপনাকে। আমার যখন যা মনে হবে তাই করব। দেখবেন!

মায়ার কথায় রিদ ধমকে বলল…

‘রিত!

রিদের ধমকে মায়াও তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে বলল…

‘কী?

‘ঝামেলা করবে না। ভালো লাগছে না এসব।

রিদের তপ্ত মেজাজে মায়া অনুনয় করে বলল…

‘ একটা বুদ্ধি দিন না প্লিজ। আমি সত্যি আম্মুকে এই বাড়িতে ফিরাতে চাই। প্লিজ হেল্প করুন।

রিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মায়ার আকুতি ভরা মুখটার দিকে তাকাল। গম্ভীর মুখে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল….

‘তাহলে আমাকে নয় তোমার শ্বশুরকে ধরে টান দাও, দেখবে তোমার শাশুড়ি এমনিই চলে আসবে।

রিদের কথায় মায়া চমকে ওঠার মতন করে তাড়াহুড়ো করে বলল….

‘আম্মু তো আব্বুর উপর রাগ করে আছেন। এখন আবার আব্বুর কথা বললে আম্মু আসবে?

রিদ মায়াকে কাছে টানতে টানতে বলল…

‘যেখানে রাগ বেশি সেখানে ভালোবাসাও বেশি হয় জাম। কান টানলে যেমন মাথা আসে? তেমনই শাশুড়িকে চাইলে শ্বশুরকে ধরে টান দাও , দেখবে কাজ হয়ে যাবে।

রিদের গভীর কথার মানে বুঝতে মায়ার বেশ সময় লাগলো। চিন্তিত মায়া যখন রিদের কথার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত তখন রিদ মায়াকে নিজের কোলে বসাতে বসাতে দু’হাতে মায়ার পেট জড়িয়ে খোলা কাঁধে শব্দ করে চুমু খেতে মায়া মৃদু কেঁপে উঠলো। কম্পিত হাতে রিদকে বাঁধা দিয়ে বলল…

‘আমি অসুস্থ।

রিদ পরপর মায়ার একই জায়গায় শব্দ করে চুমু খেতে খেতে মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল….

‘ওকে!

রিদ মায়াকে অস্বস্তিতে ডুবিয়ে দু’হাতে বাঁধন আরও শক্ত করলো। মায়ার কাঁধ হতে মুখ উঠিয়ে কানের লতিতে নাক চেপে রিদ ফিসফিস করে বলল…

‘তুমি অসুস্থ অথচ পুরো খান বাড়ি মিষ্টি খাচ্ছে আমি বাবা হচ্ছি বলে। বউ না ছুঁয়েও বাবা হওয়ার যে ব্যাপারটা সেটা কাকে বোঝাই বউ? আমার কষ্ট কেউ বুঝবে জান?

রিদের কথায় মায়ার মনে অপরাধ বোধ জাগ্রত হলো। শাশুড়িকে ফিরাতে গিয়ে মায়া নিজের স্বামীর মনে কষ্ট দিতে চায়নি। তাছাড়া ওদের বিয়ের অনেক দিন হলো। অনেক ঝড়-ঝাপটাও গেল। দুজনের মনোমালিন্যতাও দূর হলো। এবার হয়তো ওদের দুজনের সামনে চিন্তা ভাবনা করা উচিত। এতকিছু চিন্তা ভাবনা না করেই মায়া ভিতরকার অপরাধ বোধে মিনমিন করে বলল….

‘স্যরি! আমি আসলে আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি কোনো কিছুতে। আমি সুস্থ হলে আপনাকে জানাব।

রিদের মনে হলো সে মায়ার কথা ভুল শুনেছে। তার বউ তাঁকে সুস্থ হলে জানাবে মানে? মায়া কি চাচ্ছে রিদের কাছাকাছি আসতে? রিদ মায়ার কথাটা শিওর হওয়ার জন্য পুনরায় প্রশ্ন করে বলল…

‘ কি জানাবা তুমি?

‘ সুস্থ হলে জানাব।

মায়ার কথায় রিদ হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। মায়াকে ছেড়ে হাসতে হাসতে বলল…

‘আবার বলো, কী হলে জানাবা তুমি?

রিদের হাসিতে মায়া দ্বিধায় পড়ে গেল। মায়া কী এমন বলেছে রিদকে প্রথমে বিষয়টি বুঝতে না পেরে আবারও মিনমিন করে একই উত্তর দিয়ে বলল…

‘সুস্থ হলে জনাব আরকি।

রিদ যেন মায়ার কথায় মজা পেল। নিজের গম্ভীরতা ছেড়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দুষ্টু স্বরে বলল রিদ….

‘তুমি সুস্থ হলে আমাকে জানিয়ে কী করবা জান?

মায়া রিদের কথার তালে মিনমিন করে বলল…

‘ তখন আপনার কষ্ট করতে হবে না।

রিদ মায়ার কথার ইঙ্গিত বুঝেও না বুঝার মতন করে মজা নিল। কৌতুক করে দুষ্টু স্বরে বলল…

‘ তুমি আমার কি কষ্ট দূর করবা আগে সেটা শুনি?

‘ ঐ যে…

মিনমিন করে মায়া কথা গুলো বলতে বলতে অস্বস্তিতে থেমে যায়। রিদ একই ভাবে বলল…

‘ ঐ যে কি? কোন বিষয়ে কষ্ট করছি আমি বলো না?

‘ ঐ আর কি!

‘ঐ আর কি কী?

‘মানে আপনি বললেন না তখন ঐটা।

‘মানে কী বলেছি আমি? কী কষ্ট হচ্ছে আমার?

রিদের প্যাঁচানো কথায় মায়া আমতা আমতা করে বলল…

‘মানে।
‘মানে কি জান?

রিদের পরপর দুষ্টুমিতে মায়ার বোধগম্য হলো যে রিদ এতক্ষণ কোন বিষয়ে মায়াকে পেঁচাচ্ছিল। কথার মানপ বুঝতে পেরে মায়া লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। ছিঃ, এসব বিষয়েও কেউ কথা বলে? মায়া রিদের সম্মুখ থেকে চলে যেতে চেয়ে বলল….

‘কিছু না। সরুন।

মায়া রিদের সম্মুখ থেকে পালাতে চাইলে রিদ তৎক্ষণাৎ মায়ার বাহু টেনে পুনরায় একই ভাবে মায়াকে নিজের উরুতে বসাতে বসাতে রিদ আগের নেয় মায়াকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল…

‘তুমি আমার কী কষ্ট দূর করবে সেটার ব্যাখ্যা না দিলে আমি তোমাকে যেতে দেব না বউ। আগে ব্যাখ্যা দিবে তারপর যাবে। তাছাড়া আমি কিন্তু জানি আমার বউ পেকে গেছে। পাকা বউয়ের একটু অ্যাডভান্টেজ নেওয়ায় যায় তাই না।

রিদের কথায় মায়া লজ্জায় তৎক্ষণাৎ দু’হাতে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলল….

‘আমি কিছু জানি না।

রিদ দুষ্টু হেসে মায়ার দু’হাত টেনে মুখ থেকে সরাতে সরাতে বলল…..

‘আপনি সব জানেন ম্যাডাম, জেনে-বুঝে আমাকে পাগল বানাচ্ছেন।

মায়া একই ভাবে পুনরায় দু’হাতে নিজের মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলল….

‘উফ! লজ্জা লাগছে আমার।

রিদ মায়ার সঙ্গে দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে একই ভাবে আবারও মায়ার হাত টেনে দুষ্টু স্বরে মায়াকে কপি করে বলল….

‘উফ! কেন লজ্জা লাগছে আপনার?

মায়া লজ্জা থেকে বাঁচতে তৎক্ষনাৎ দু’হাতে রিদকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল…

‘ যান তো।
~~

রিদের কথায় সত্যি হলো। সত্যি সত্যি সুফিয়া খান মায়ার প্রেগন্যান্সির বিষয়টা বিশ্বাস করেননি। করার কথাও না উনার। মায়া সুফিয়া খানের কাছে ছিল বিগত দু’মাস। রিদের সঙ্গে চট্টগ্রামে এসেছে সবেমাত্র এক সপ্তাহ হলো। সুফিয়া খানের হিসাব মতে মায়া এক সপ্তাহে প্রেগন্যান্ট হতে পারে না। হওয়ার কথাও না। তাই রাদিফ যখন ফোন করে সুফিয়া খানকে মায়ার প্রেগন্যান্সির কথাটা জানায় তখন তিনি রাদিফের কথাটি কানেই তোলেননি। বরং মায়ার পেটে সমস্যা বা অন্য কোনো কারণ হতে পারে বলে রাদিফকে সাজেস্ট করলো মায়াকে ভালো ডাক্তার দেখাতে। এতে করে রাদিফ ও মায়া দু’জনই হতাশ। এত ছলাকলা কষে তাদের প্ল্যান সাকসেস না হওয়ায় আবার ভাবতে বসলো নতুন প্ল্যানের সন্ধানে। নিহাল খানের নির্বাচনের কাজে রাদিফ ব্যস্ত থাকায় তার নতুন করে প্ল্যান বানাতে আরও খানিকটা সময় প্রয়োজন, কিন্তু অধৈর্য্যের মায়ার যেন ধৈর্যে কুলাল না। বরং অস্থির ন্যায় ড্রয়িংরুমে বসে মাথা খাটালো কিভাবে কী করা যায়? কিভাবে সুফিয়া খানকে খান বাড়িতে ফেরানো যায় সেই চিন্তায় বিভোর মায়ার হঠাৎই ধ্যান ভাঙল নিহাল খানের উপস্থিতিতে। অসময়ে নিহাল খানের উপস্থিতিতে মায়া তৎক্ষনাৎ নিজের মাথার কাপড়টা টানল। দ্রুততায় উঠে দাঁড়াতে চাইলে নিহাল খান নরম গলায় মায়াকে বাঁধা দিয়ে বলল….

‘আপনাকে উঠতে হবে না আম্মু, আপনি বসুন। রেস্ট নিন। আপনার এই সময়ে রেস্ট প্রয়োজন।

মায়া বুঝল নিহাল খান মায়াকে ওর মিথ্যা প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা নিয়ে চলাফেরায় সতর্ক করছে। মায়ার মনে হঠাৎ তীব্র অপরাধ বোধ জাগ্রত হলো। কাল রাদিফের কথা শুনে মায়া ঐভাবে সবাইকে মিথ্যা প্রেগন্যান্সির কথাটা বলা ঠিক হয়নি। একটা বাচ্চা একটা পরিবারের ইমোশন হয়। মায়া ঐভাবে সবার ইমোশন নিয়ে মিথ্যা কথা বলাটা ঠিক হয়নি। মায়ার তীব্র অপরাধ বোধের মাঝেই নিহাল খান মায়ার পাশে বসতে বসতে মায়ার মাথায় স্নেহময় হাত বুলিয়ে বলল….

‘আজ অনেকটা বছর পর খান বাড়িতে সুসংবাদ পেলাম আম্মু, যেটা শুনে খুব মানসিক শান্তি পেলাম। আল্লাহ আপনার দীর্ঘায়ু করুক।

নিহাল খানের কথায় মায়া অপরাধ বোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। নিহাল খানকে মিথ্যা প্রেগন্যান্সির কথাটা জানাতে চেয়ে মায়া ভয় ভয় গলায় বলতে চাইল….

‘আপনাকে একটা কথা বলি আব্বু?

‘একটা না দশটা কথা বলুন আম্মু। আমার সমস্যা নেই। আমি ধৈর্য্য নিয়ে শুনব।

নিহাল খানের কথায় মায়া হাসফাস করলো। তীব্র অপরাধ বোধে জড়তায় আমতা আমতা করে বলল…

‘আসলে আমি আম্মুকে এই বাড়িতে ফিরাতে….

মায়া অল্প কথাতেই থামে। মায়া থামে নয়, থামতে হয় নিহাল খানের কথার মাঝে। তিনি মায়াকে শেষ করতে না দিয়ে নিজে বললেন….

‘আপনার জেদি শাশুড়ি যদি ফিরতে চাই তাহলে আমার এতে কোনো আপত্তি নেই।

নিহাল খানের কথায় মায়া চুপ করে যায়। মায়া আর আগ বাড়িয়ে সত্যিটা বলা হলো না। কারণ নিহাল খান ইতিমধ্যে মনে করছেন মায়া সুফিয়া খানকে খান বাড়িতে ফিরাতে চেয়ে উনার কাছে অনুমতি চাইছেন। অথচ এটা সত্যি নয়। মায়া নিহাল খানের থেকে অনুমতি নয় বরং মায়া ওর শ্বশুরকে সত্যি জানাতে চেয়েছিল যে মায়া সুফিয়া খানের জন্য নিজের প্রেগন্যান্সির কথাটা মিথ্যা বলেছিল সবাইকে, যাতে করে সুসংবাদ পেয়ে সুফিয়া খান, খান বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু তার কিছুই হলো না। তবে মায়ার এত কিছুর মাঝে একটা জিনিস ভালো হলো যে ওর শশুরের মনোভাব বুঝে ফেলল। নিহাল খান যে, নিজের স্ত্রীকে খান বাড়িতে ফিরাতে চেয়ে বেশ আগ্রহী সেটা বুঝা গেল। তাই মায়া নিজের মিথ্যাটা বহাল রেখে সাহস দেখিয়ে নিহাল খানের কাছ থেকে প্রশ্ন করার অনুমতি চেয়ে বলল…

‘একটা কথা বলি আব্বু? যদি বেয়াদবি না নেন।

মায়ার কথায় নিহাল খান স্বাভাবিক ন্যায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই মায়া বেশ সাহস দেখিয়ে নিহাল খানকে বলল….

‘আপনি আম্মুকে খান বাড়িতে কেন ফিরাচ্ছেন না আব্বু?

মায়ার কথায় খানিকটা সময় চুপ করে বসলেন নিহাল খান। হুট করে নিজের গাম্ভীর্যতা ছেড়ে মায়ার সাথে সহজ হতে পারলেন না। তবে মায়ার কথার উত্তর দিতে নিহাল খান স্বাভাবিক গলায় বলল…

‘আপনার আম্মু আমার কাছে ফিরতে চান না তাই।

‘মিথ্যা কথা। আম্মু ফিরতে চান। আপনি কখনো আম্মুকে নিজের কাছে রাখতে চাননি, সেজন্য আম্মু কখনো ফিরে আসেননি। আপনি ডাকলে অবশ্যই ফিরতেন আম্মু।

মায়ার মতো নিহাল খানও হুট করে অস্থির উত্তেজিত হয়ে উত্তর করতে পারল না। তিনি মায়ার বয়সী নন। থাকলে অবশ্যই মায়ার মতন ছটফটিয়ে উঠে নিজের ভিতরকার কথাগুলো প্রকাশ করতেন। তিনি একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি। তাই উনার কথা বলতে হবে ভেবেচিন্তে, জায়গা বুঝে। সব জায়গায় সব কথা যেমন বলা যায় না তেমনই সব আবেগও সবার সামনে প্রকাশ করা যায় না। তাই নিহাল খান চেয়েও মায়ার সম্মুখে কোনো কিছু প্রকাশ করতে পারলো না। বরং ভিতরকার কথা চেপে গিয়ে ভারি নিশ্বাস ফেলে মায়ার কথার উত্তরে বলল….

‘বাড়ির সবাই যেখানে আপনার শাশুড়ীকে ডেকেছে সেখানে আমার কি আলাদাভাবে ডাকতে হবে?

নিহাল খানের কথায় মায়া যেন ভুলে বসলো সে ওর সম্মানিত শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলছেন। মায়া অস্থির ভঙ্গিতে বলল…

‘বাড়ির সবাই আর আপনি কি এক আব্বু? আম্মুর রাগ অভিমান আপনার সাথে থাকলে বাড়ির সবাই কেন আম্মুর অভিমান ভাঙাতে যাবে? যেখানে আপনারা সামান্য কথায় আম্মু ফিরে আসতেন সেখানে আপনি বছরের পর বছর আম্মুকে দূরে রেখেছেন কেন? আপনি চাইলে বিষয়টা অল্পতে শেষ হতে পারত। আম্মু মানুষটা রাগ-জেদি হতে পারে কিন্তু আম্মু নিজের পরিবারের প্রতি খুবই সেনসিটিভ সেটা আমার থেকে আপনিই ভালো জানেন। দূরে থেকেও আম্মু আপনার আর এই পরিবারের প্রতিটা মানুষের খেয়াল রাখেন। আপনার উচিত ছিল আরও আগে আম্মুর রাগ ভাঙানো। আপনি আম্মুকে অনেকটা বছর কষ্ট দিয়েছেন আব্বু।

মায়ার অভিমানে ভরা কথায় নিহাল খান কেমন পাথর ন্যায় শক্ত হয়ে বসলেন। মনে অনেক কথা জমে আছে উনার। কিন্তু সব কথা সবার সাথে বলা যায় না। তাছাড়া মায়া উনার ছেলের বউ মানে উনার মেয়ের বয়সী। বাবা হয়ে মেয়ের সাথে সব কথা বলা যায়? না যায়। নিহাল খান মায়াকে নিজের মনের খবরটা জানাতে পারলেন না। তবে তিনিও চান উনার স্ত্রী দীর্ঘদিনের মনোমালিন্য ভুলে উনার কাছে ফিরে আসুক। তিনি মায়াকে এই কয়েকদিনে বেশ লক্ষ করেছেন। উনার স্ত্রী এই মেয়ের বেশ খেয়াল রাখেন। মায়াও শাশুড়ি হয়ে কথা বলে সবসময়। এই যে আজ শ্বশুরের দিকে পর্যন্ত আঙুল তুলছে শাশুড়ির পক্ষ হয়ে। মূলত এজন্য নিহাল খান বিগত দিন ধরে সুযোগের সন্ধানে ছিলেন কিভাবে মায়ার সঙ্গে সুফিয়ার ব্যাপারে কথা বলা যায় সেটা নিয়ে। মায়া উনার ছেলের বউ হওয়ায় তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে মায়ার সাথে সহজ হয়ে কথা বলতে পারছিলেন না -সংকোচে। তবে আজ সব জড়তা মায়া কাটিয়ে নিলো। তাই নিহাল খান মুক্ত মনে মায়াকে বলবেন উনাকে অন্তত একটা সুযোগ দেওয়া হোক উনার নিজের দিকটা সুফিয়ার সম্মুখে প্রকাশ করার। নিহাল খান অনেকটা সময় নীরব থেকে ধীর গলায় মায়ার কথার উত্তরে বললেন…

‘আমাকে একটা সুযোগ দিলে অবশ্যই আপনার শাশুড়ির মান-অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করব আম্মু।

নিহাল খানের সরাসরি কথায় মায়া যেন চমকে উঠলো। না চাইতেও আশার আলো দেখতে পেল দু’চোখে। খুশিতে মায়া উৎফুল্ল হয়ে বলল…

‘সত্যি?
মায়া’র খুশিতে নিহাল খান সম্মতি দিয়ে বলল…

‘জ্বি!

‘তাহলে আমি যা বলব করবেন আব্বু?

‘ইনশাআল্লাহ!

নিহাল খানের কথায় বেশ আশ্বস্ত হলো মায়া। সেদিনের মতো রাদিফের সঙ্গে আবারও যুক্তি করলো কিভাবে কী করবে বাকিটা। অনুসন্ধানে মায়ার হঠাৎ রিদের কথাটা মনে হলো। শ্বশুরকে ধরে টান দিলে শাশুড়ি অবশ্যই ফিরে আসবে চট্টগ্রামে মাটিতে। মায়া রিদের কথা অনুযায়ী কাজ করলো। যেহেতু রিদ আর সুফিয়া খান একই চরিত্রের মানুষ। তাহলে তাদের কর্মকাণ্ড গুলোও সেইম হবে। রিদ যেমন মায়ার বিপদে দিশেহারা হয়ে যায় একই ভাবে সুফিয়া খানও নিশ্চয়ই নিজের স্বামীর বিপদে দিশেহারা হবে? অন্তত এই বিষয়ে একটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার মায়ার। যদি বিষয়টা সত্যি হয় তাহলে নিশ্চয়ই সুফিয়া খান এবার নিজের রাগ ভুলে খান বাড়িতে পা রাখবে। মায়া রাদিফকে নিয়ে নিহাল খানের মিথ্যা হার্ট অ্যাটাকের লম্বা চওড়া একটা জটিল রিপোর্ট বানালো। এর মাঝে একদিন নিহাল খান দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা সভায় মাঝে হুট করে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতেই চারপাশে হৈচৈ পড়ে গেল মন্ত্রী নিহাল খান বেহুশ হয়ে যাওয়াতে। রিদ সেখানেই ছিল। তৎক্ষণাৎ বাবাকে গাড়ি করে হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতে দলে সকলের ভিড় জমলো হসপিটালে। রাদিফ নিহাল খানের সামান্য অসুস্থতাকে কাজে লাগিয়ে সুফিয়া খানের কাছে মিথ্যা রিপোর্ট পাঠালো হার্ট ব্লকের মতন জটিল বিষয়টা দেখিয়ে। দিশেহারা সুফিয়া খান রিদকে শত কল করেও পেল না। কারণ রিদের ফোনটা তখন রাদিফের হাতেই ছিল। মূলত রাদিফ ইচ্ছাকৃতভাবে রিদের ব্যস্ততায় ওর ফোনটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল যাতে সুফিয়া খান রিদকে কল করে না পায়। রিদের সর্বদা সত্যি কথা বলার ব্যামো আছে। কখনো কোনো কিছুতে মিথ্যা রিদকে দিয়ে বলানো যায় না বলেই রাদিফ ভিড়ের মাঝে রিদের ফোনটি নিজের কাছে রাখল। যেকোনো সময় সুফিয়া খান নিহাল খানের অসুস্থতা সম্পর্কে রিদ থেকে জানতে চেয়ে কল করবে, তখন যদি রিদ সত্যিটা সুফিয়া খানকে বলে দেয় তাহলে আবার মায়াদের প্ল্যান বিফলে যাবে। তাই রাদিফ নিজের করা প্ল্যানকে নিয়ে কোনো রকম রিস্ক নিলো না। বরং ক্রমাগত নিজের মায়ের কাছে নিহাল খানের জটিলতা বিষয়টি তুলে ধরলো। অথচ নিহাল খানের তেমন কোনো জটিলতার রোগ নেই। অঘুম, অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার থেকে দুর্বলতায় বেহুশ হয়ে গিয়েছিলেন নিহাল খান। ঘণ্টা দুয়েক হসপিটালে রেস্ট নিলে বাসায় ফিরে যেতে পারবেন তিনি। কিন্তু রাদিফ নিজের বাবার সামান্য অসুস্থতাকে একের সঙ্গে এক মিলিয়ে দুই করে সুফিয়া খানের সামনে প্রকাশ করলো। যাতে তিনি নিহাল খানের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে চলে আসেন চট্টগ্রামে। হলোও তাই। সুফিয়া খান রিদকে কলে না পেয়ে আয়নকে কল মিলালো। আয়ন নিহাল খানের জটিলতার খবর পেয়ে সেও তৎক্ষণাৎ জুঁইকে নিয়ে রওনা হলো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আয়নদের বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা খানিকের মাঝে সুফিয়া খানের হেলিকপ্টার উড়লো আকাশে। সেবার রিদের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে তিনি ছুটে গিয়েছিল হসপিটালে। আজ স্বামীর অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে যাচ্ছে খান বাড়িতে। সেই পনেরো বছর আগে তিনি এক কাপড়ে খান বাড়ি ছেড়েছিলেন, আজ পনেরো বছর পর আবারও এক কাপড়ে খান বাড়িতে গিয়ে উঠছেন। এর মাঝে কেটেছে দীর্ঘ পনেরো বছরের মনোমালিন্য। তারপরও কখনো সুফিয়া খান নিহাল খানের সঙ্গে যোগাযোগ বা কথা পর্যন্ত বলেননি। রিদকে নিয়ে পঁয়তাল্লিশ দিন লন্ডন শহরে থাকার পরও তিনি কখনো নিহাল খানের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলেননি আর না নিহাল খানকে সেই সুযোগ দিয়েছেন উনার সাথে কথা বলার। অথচ আজ মায়ার অতিরিক্ত কান্নাকাটি আর রাদিফের বাড়াবাড়ি রকমের রিপোর্টে এক মুহূর্তের জন্য শক্তপোক্ত সুফিয়া খানও ভয়ে থমকে যায়। দীর্ঘদিনের মনোমালিন্য ভুলে অবশেষে সেই অপ্রিয় মানুষের টানে ফিরতে হয় চট্টগ্রামের মাটিতে।

[ বানান ভুল ম্যানশন করবেন কমেন্টে]

#চলিত…

#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃরিক্তা ইসলাম মায়া

[খন্ড-বিশেষ]
অসময়ে নিহাল খানের আগমন ঘটলো খানবাড়িতে। ঘরে ঢুকে সুফিয়া খানের দেখা না পেয়ে পুনরায় বেরিয়ে গেল সুফিয়া খানের সন্ধানে। উনার বাহ্যিক মনোভাব এমন যেন তিনি কারও সন্ধানে নেই। অথচ চঞ্চল মন আর বুড়ো চোখ বিরতিহীনভাবে সুফিয়া খানের সন্ধান করেই যাচ্ছে। কাউকে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে পারছে না সুফিয়া খান কোথায়? পাছে যদি উনার বউয়ের কানে চলে যায় যে নিহাল খান সুফিয়া খানের খোঁজে অসময়ে বাড়িতে চলে এসেছে, তাহলে বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক হবে উনার জন্য। উনি আর তরুণ বয়সের সেই তাগড়া যুবক নেই যে বউয়ের জন্য উতলা হয়ে ঘুরবে। বরং উনি একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। ছেলে বিয়ে দিয়ে বউ বাড়িতে এনেছেন, তাই উনার এই বয়সে এসে বউয়ের জন্য উতলা হওয়া সাজে না। পাছে মানুষ বলবে বড়ো বয়সে মন্ত্রীমশায় বউ পাগল হয়ে গেছে সুন্দরী বউ পেয়ে। তখন উনার মান সম্মান কিছু থাকবে না। তাছাড়া উনিও মানুষকে বোঝাতে পারবে না যে পুরুষ মানুষের সব বয়সেই বউ প্রয়োজন হয়। দ্বিধায় পড়ে নিহাল খান নিজের ভিতরকার তীব্র ছটফটানি চেপে গেল। মুখটা গুরুগম্ভীর করে আশেপাশে দৃষ্টি বুলাতে লাগল। উনার ভাব এমন উনি কারও সন্ধানে নেই। হলোও তাই। বাড়ির কেউ উনার চুরি ধরতে না পারায় তিনি বেশ সন্তুষ্ট হলেন। একা একা হেঁটে পুরো খানবাড়ির ভেতর তল্লাশি করে যখন সুফিয়া খানের সন্ধান পেল না, তখন হঠাৎ মন কামড়ে উঠলো ভয়ে। এতো কাঠখড় পুড়িয়েছি সুফিয়াকে খানবাড়িতে আনার পর অবশেষে কিনা আবার চলেও গেল? অস্থির উত্তেজিত নিহাল খান বড় বড় পা ফেলে বাহিরে যেতেই দেখা মিলল সুফিয়া খানের গাড়ির। খানবাড়ির গেট ধরে গাড়িটি ভিতরে প্রবেশ করতে পার্কিং এরিয়াতে এসে থামল। একজন দেহরক্ষী দ্রুত গাড়ির পিছনের দরজা টেনে ধরতে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল সবুজ শাড়ি পরিহিত সুফিয়া খান। চোখে মোটা ফ্রেমের রোদচশমা পরে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছেন গম্ভীর মুখে। সুফিয়া খানের হাইট আর ওয়েট চোখে দেখার মতন, সুন্দরী দেখাল। নিহাল খান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুফিয়া খানের পদচারণের দিকে। মনস্তাত্ত্বিক সুফিয়া খান নিহাল খানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে মুহূর্তে নিহাল খান ডাকল…

‘ সুফিয়া?

সুফিয়া খানের পা থামে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে দেখা মিলল নিহাল খানের। তিনি এগিয়ে এসে নিহাল খানের মুখোমুখি দাঁড়াতে দাঁড়াতে কপাল কুঁচকে বললেন….

‘ তোমার না গায়ে জ্বর ছিল? কমেছে?

কথাগুলো বলতে বলতে সুফিয়া খান নিহাল খানের কপালে নিজের হাতের উল্টো পিঠ ছুঁয়ে তাপমাত্রা চেক করলো। এর মাঝে নিহাল খান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে বলল…

‘ তুমি অনেক সুন্দর সুফিয়া।

নিহাল খানের কথায় সুফিয়া খানের মনোভাব পরিবর্তন হলো না। বরং আগের ন্যায় কপাল কুঁচকে চোখের রোদচশমাটা হাতে নিতে নিতে বলল…

‘ সেটা বুড়ো বয়সে এসে চোখে পড়েছে তোমার?

সুফিয়া খানের খোঁচা মারার কথায় থতমত খেয়ে গেল নিহাল খান। মুখটা ছোট করে থমথমে গলায় বলল….

‘ আমি বুড়ো হয়ে গেছি সুফিয়া?

সুফিয়া খান এক কদম বাড়িয়ে নিহাল খানের ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। নিহাল খানের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে তিনি কটাক্ষ করে বলল…

‘ কোনো সন্দেহ আছে তোমার?

[ এটা কোনো পর্ব নয়- এটা বিশেষ মাঝের খন্ড-বিশেষ]