#রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া
৬৯
খান বাড়িতে সুখের বসন্ত লেগেছে। দীর্ঘ পনেরো বছর পর সুফিয়া খান পা পড়েছে খান বাড়ির আঙিনায়। এই নিয়ে সকলে ভিড় জমিয়েছে সুফিয়া খানের চত্বরে। আরাফ খান, হেনা খান ছেলের অসুস্থতার দুঃখের চেয়ে বেশি আনন্দ প্রকাশ করছেন সুফিয়া খানের আগমনে। সেই খবর তিনি দেশ-বিদেশে সকল আত্মীয়ের মাঝে ইতিমধ্যে পাঠানো শেষ। হেনা খান নিজের তিন কন্যার সঙ্গে শশীর মাকেও আমন্ত্রণ জানালেন খান বাড়িতে আসার জন্য। আরাফ খান সেই ফাঁকে বাড়িতে আয়োজন করলেন মেজবাহনের দাওয়াতের। সুফিয়া খানকে ঘিরে শ্বশুর-শাশুড়ির এমন উৎফুল্লতার আনন্দটুকু নীরব চোখে দেখলেন সুফিয়া খান। বয়স্ক মানুষ বাচ্চাদের মতোন হয়, সেটা আবারও যেন প্রমাণ করলেন আরাফ খান আর হেনা খান। সুফিয়া খান বাড়িতে ফিরেছেন বিকাল তিনটার নাগাদ। এখন সন্ধ্যা ছয়টা। এর মাঝে পার হলো তিন ঘণ্টা। এই তিন ঘণ্টায় এই দুজন মানুষ উনার হাতে গোটা খান বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে বসে আছেন। সার্ভেন্ট থেকে শুরু করে গোটা খান বাড়ির মানুষ উনার থেকে প্রতিটা কাজে অনুমতি নিচ্ছেন। সুফিয়া খান বেশ বুঝতে পারছেন, এসব উনার শ্বশুর-শাশুড়ির কাজ। যে দায়িত্ব তিনি পনেরো বছর আগে ফেলে গিয়েছিলেন, সেই দায়িত্ব যত্ন করে উনার হাতে আবারও তুলে দিতে চাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। এই সংসার আর উনার নয়। এই সংসারের মায়া তিনি আরও অনেকটা বছর আগেই মাড়িয়ে গেছেন।
আজ হয়তো তিনি তাড়াহুড়ো করে চট্টগ্রামে ফিরেছেন, কিন্তু এই সংসারের তিনি আর স্থানীয় হবেন না।
আজ বাদে কালই ফিরে যাবেন নিজ গন্তব্যে। তাই তিনি চাচ্ছেন না ক্ষণিকের জন্য শ্বশুর-শাশুড়িকে কোনো কিছুতে বাধা দিতে। বরং যেটা যেভাবে চলছে সেভাবে চলুক। তাঁরা যদি অল্পতে খুশি হন তাহলে হোক, এতে অপরাধের কোনো কিছু নেই। বরং তাঁদের ভুল ধারণা একটা সময় এমনিই ভেঙে যাবে। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার গম্ভীর সুফিয়া খান হাতের গ্লাসটা ডাইনিংয়ে রাখতে রাখতে তাকালেন অদূরে সোফায় বসা হেনা খানের দিকে। হেনা খান সুফিয়া খানের বাড়ি ফেরার খুশিতে উৎফুল্লতা দেখিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছেন ফোনে। সুফিয়া খান এক পলক সেদিকে তাকিয়ে এগোতে চাইলেন সিঁড়ির দিকে। তক্ষুনি বাঁধা দিয়ে ডাকল কাজের মেয়ে মালা। বলল…
‘বড় ম্যাডাম রাতে কি রান্না করব?
বাঁধা পেয়ে পিছনে তাকালেন সুফিয়া খান। মালার কথায় তীক্ষ্ণ গলায় বললেন…
‘আমাকে কেন প্রশ্ন করছো? প্রতিদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করে রান্না করো তোমরা?
সুফিয়া খানের কথায় মালা থমথমে মুখে বলল…
‘দাদী বলছে আপনি যা আদেশ করবেন তাই বাড়িতে রান্না হবে, আর নয়তো সবাই না খেয়ে থাকবে। রান্না বন্ধ।
মালার কথায় সুফিয়া খান ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক হেনা খানকে দেখে মালাকে রান্নার তালিকা দিয়ে চলে যেতে চাইলে সেখানে হাজির হলো খান বাড়ির মালি ছেলে কাশেম। সে সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে লম্বা চওড়া বাজারের লিস্ট দিয়ে বলল…
‘বড় ম্যাডাম বাজারে এই লিস্টটা দাদাভাই পাঠিয়েছেন আপনাকে দিতে।
সুফিয়া খান মালাকে চলে যেতে বলে ঘুরে তাকালেন হালকা পাতলা গঠনের কাশেমের দিকে। কাশেমের থেকে কাগজের লিস্টটি হাতে নিয়ে সেদিকে তাকাতে দেখলেন বিশাল আয়োজনের একটি বাজারের লিস্ট সেটি। সুফিয়া খানের জানা মতে খান বাড়িতে আপাতত কোনো ফাংশন নেই। তাহলে এই লিস্ট কিসের হতে পারে সেটা জানতে চেয়ে কপাল কুঁচকে কাশেমকে বললেন…
‘বাড়িতে কি কোনো ফাংশন আছে কাশেম?
‘জ্বি ম্যাডাম! দাদাভাই আপনার বাড়িতে ফেরার খুশিতে এতিম বাচ্চাদের খাওয়াবেন বলছেন। এই লিস্টটা সেই আয়োজনের। আপনাকে বলছে এটা ঠিক আছে কিনা দেখতে।
হাতের কাগজটায় তিনি সেইভাবে আরও একবার নয় দু’বার নয়, বেশ কয়েকবার চোখ বুলালেন। মাত্র তিন ঘণ্টায় কেমন একটা টান অনুভব হচ্ছে এই ফেলে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি। উনার সংসার উনাকে যত্নসহকারে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন তাঁরা। অথচ যেই সংসারের মায়া তিনি অনেক আগেই ত্যাগ করে ফেলেছেন। সুফিয়া খান বাজারের লিস্টে বাচ্চাদের জন্য দুয়েক রকমের মিষ্টি জাতীয় খাবার এড করে দিতে বললেন। কাশেম সেই ফাঁকে আরও একটা কাগজ তুলে দেয় সুফিয়া খানের হাতে। গমগমে স্বরে বলল….
‘ম্যাডাম এটা হলো খান বাড়ির সকল কর্মচারীদের লিস্ট। মাসের দশ তারিখে আমাদের বেতন দেওয়া হয়। আজ নয় তারিখ। সেজন্য দাদাভাই এটা আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
সুফিয়া খান বেশ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন…
‘আমার কাছে কেন?
‘দাদাভাই বলছে আপনি আমাদের বেতন দিলে আমরা এই মাসে বেতন পাবো, আর নয়তো আমরা সকল কর্মচারী বেতন ছাড়া থাকব নাকি।
কাশেমের থমথমে মুখটার দিকে সুফিয়া খান তাকিয়ে সেভাবে বললেন…
‘ওকে, কাল দেওয়া হবে যাও।
কাশেম ছেলেটি চলে যেতে খান বাড়ির ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয় রাদিফ। যদিও সে দুপুরে দিকে এসে মায়ের সাথে দেখা করে গিয়েছিল, এখন আবারও আসা। সুফিয়া খানই কল করে ডেকেছেন রাদিফকে নিহাল খানের রিপোর্টের জন্য। ভয়ার্ত রাদিফ থমথমে মুখে সুফিয়া খানের হাতে নিহাল খানের ফেক রিপোর্ট তুলে দিতে গম্ভীর সুফিয়া খান সেগুলো নিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল..
‘আমার সাথে আসো রাদিফ।
ভয়ার্ত রাদিফ থমথমে মুখে সুফিয়া খানের পিছন পিছন হাঁটলো। এর মাঝে পথে দেখা পেল মায়ার সাথে। গায়ে একটা সবুজ জামদানি জড়িয়ে মায়া নিহাল খানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সুফিয়া খানের খোঁজে। সুফিয়া খান বাড়িতে ফেরার পরপরই মায়া এই শাড়িটা জড়িয়েছে গায়ে শাশুড়িকে খুশি করতে। অবশ্য বিগত সময় ধরে মায়া সুফিয়া খানের পিছন পিছন ঘুরঘুর করছিল। তবে এরমাঝে ফাকে সে রিদকে বাড়ির ফেরার কথা বলে এল ফোনে।
নিহাল খানের ঘরে প্রবেশ করতে মায়া ভয়ার্ত মুখে রাদিফের দিকে তাকাল। মায়ার মতো করে রাদিফের মুখটাও চুপসে আছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
বেহুশ নিহাল খানের হাতে তখনো ক্যানুলায় সেলাইন চলছে। সুফিয়া খান নিহাল খানের পরপরই রিপোর্টগুলো চেক করল মনোযোগ সহকারে। যতটা ক্রিটিকাল মনে করে সুফিয়া খান পাগল পাগল হয়ে চট্টগ্রাম ফিরেছিলেন, তার তেমন কিছু না দেখে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রাদিফের দিকে। ভয়ার্ত রাদিফ কাচুমাচু করে বিছানার অপর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মায়াও রাদিফের পাশাপাশি দাঁড়াল থমথমে মুখে। দুই অপরাধী একত্রে। মায়া ওর শাশুড়িকে উল্টাপাল্টা বলে চট্টগ্রামে তো নিয়ে এসেছে, এবার চতুর শাশুড়িকে সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে মায়াদের জন্য। খান বাড়িতে আসার পরপরই দুবার রাদিফের থেকে নিহাল খানের রিপোর্ট চেয়েছিলেন সুফিয়া খান। কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাতে রাদিফ এতক্ষণ রিপোর্টগুলো না দিলেও এখন দিতে বাধ্য হয় সে। সুফিয়া খান হাতের রিপোর্টগুলো দুবার খতিয়েও দেখল। রিপোর্টগুলো যে উনার বিশ্বাসের আসেনি, সেটা উনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারছে রাদিফ। তারপরও সুফিয়া খান রাদিফকে কিছু না বলে হাতের ফাইলগুলো বন্ধ করতে করতে রিদের খবর নিয়ে জানতে চাইল…
‘রিদ কই?
‘ভাই মিটিংয়ে।
‘বাড়িতে ফিরতে বলো ওকে।
‘জ্বি আম্মু।
~
রাত এগারোটা পেরিয়ে বারোটার ঘরে। রিদের ব্যস্ততা শেষ নেই। রিদ এই রাতেও বাসায় ফিরত না যদি না মায়া বারবার ফোন করে রিদকে বাড়িতে ফেরার তাগিদ দিত। নিহাল খানের অনুপস্থিতিতে সবটা রিদের সামলাতে হচ্ছে বলেই রিদের ব্যস্ততা দ্বিগুণের চেয়ে চারগুণ হলো। সেজন্য রিদ মায়ের সঙ্গে দেখা করে আবারও দ্রুত বেরিয়ে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। এক সপ্তাহ পর নির্বাচন। একদণ্ড বাড়িতে বসে থাকার সময় নেই কারও। রিদ দলের ছেলেদের সবাইকে নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত রেখেই সে এরাতে বাড়িতে ফিরেছে একা। রাদিফ অবশ্যই আসিফদের সঙ্গেই আছে। রিদ বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সুফিয়া খানের সঙ্গে হেনা খানের দেখা পেল বসার ঘরে। মায়াকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে রিদ ভাবল মায়া হয়তো ঘুমিয়ে। ক্লান্ত রিদ সুফিয়া খানের দিকে এগিয়ে গেল। মুখোমুখি হয়ে মায়ের সঙ্গে টুকটাক কথা চালাতে সেখানে লেবু পানি নিয়ে উপস্থিত হয় মায়া। রিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল…
‘আপনার পানি!
মায়ার গলা পেয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে রিদ ঘুরে তাকাল। মায়াকে সবুজ শাড়ি পরিহিত ট্রেতে করে লেবুর পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিদের দৃষ্টি থমকে দাঁড়াল। মায়া ফর্সা গায়ে সবুজ শাড়িটি যেন ঝলমল করলো রিদের চোখে। রিদ একবার নয় দু’বার নয়, বেশ কয়েকবার মায়ার দিকে তাকাল চোখ সরিয়ে। গোটা শরবতের গ্লাস এক চুমুকে শেষ করলো মায়ার দিকে তাকিয়ে। রিদের এমন দৃষ্টিতে মায়া হাসফাঁস করে আড়চোখে তাকাল সুফিয়া খান আর হেনা খানের দিকে। বড়দের সামনে রিদের স্থির দৃষ্টিতে খানিকটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ল মায়া। ততক্ষণে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সুফিয়া খান, হেনা খানও লক্ষ করলেন রিদের দৃষ্টি। মা হিসাবে চট করে বুঝে ফেললেন ছেলের ক্লান্তিময় মনোভাবটা। রিদ পানির গ্লাসটা ট্রে-তে রাখতেই সুফিয়া খান বললেন…
‘নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও রিদ। আমি তোমার খাবার রুমে পাঠাচ্ছি।
রিদ হ্যাঁ/না কিছুই বলল না। বরং চলে যেতে গিয়েও মায়ার দিকে তাকাল চোখ সরিয়ে। মায়া বিব্রতবোধ করে খালি গ্লাসটা নিয়ে কিচেনের দিকে যেতে চাইলে সুফিয়া খান বাঁধা দিয়ে বললেন…
‘তুমি রুমে যাও মায়া। দেখো আমার ছেলের কি প্রয়োজন হয়। আমি তোমাদের খাবার রুমে পাঠিয়ে দেব। যাও!
সুফিয়া খানের কথায় আপত্তি জানাতে চাইল মায়া। মায়া ইচ্ছে সবাইকে নিয়ে একত্রে ডাইনিংয়ে বসে খাবে। সে একা রুমে বসে খাবে না। তাছাড়া মায়া রিদকে ফোন করে এনেছে সুফিয়া খানের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সেখানে মায়া যদি রিদকে নিয়ে ঘরে আলাদা খায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখায় না। তাছাড়া মায়াও বুঝল না হঠাৎ করে সুফিয়া খানই বা কেন মায়াকে রুমে পাঠাতে চাচ্ছেন খাওয়ার জন্য। যেখানে মায়া সবার সাথে একত্রে খাওয়ার জন্য আয়োজন করেছে সেটা কি দেখেননি ওর শাশুড়ি? তাহলে?
‘আমি ঘরে খাব না আম্মু। আমি সবা…
‘রিত রুমে আসো!
রিদের উচ্চ স্বরে ডাকায় থমথমে খেয়ে গেল মায়া। সুফিয়া খান শক্ত গলায় বললেন….
‘রুমে যাও মায়া! দেখো রিদের কি প্রয়োজন।
মায়া আর দাঁড়াল না। হাতের ট্রে সোফার টেবিলে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে মায়া ঠোঁট উল্টাল। মায়াকে এতো তাড়া দিয়ে সবাই রুমে কিজন্য পাঠাচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না। শাশুড়ি ছেলে মাত্র বাসায় ফিরেছে। সে ফ্রেশ হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই মায়া গুছিয়ে রেখে এসেছে, তাহলে এতো তলব লাগিয়ে মায়াকে কি দরকার। শাশুড়ি ছেলে কি বাবু? যে মায়াকে ছাড়া সে একা ফ্রেশ হতে পারবে না। বিরক্ত নিয়ে মায়া রুমে ঢোকতে ঘরটা অন্ধকার পেল। মায়া ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘরটা উজ্জ্বল করতে রিদের দেখা পেল না কোথাও। ওয়াশরুমের দরজাটাও বাহির থেকে লক করা দেখে মায়া বুঝল রিদ ওয়াশরুমেও নেই। মায়া রিদকে ডেকে বলল…
‘শাশুড়ির ছেলে আপনি কোথায় আছেন?
মায়ার এক ডাকেই রিদ বারান্দা থেকে ঘরে এলো। রিদকে দেখে মায়া আবারও বলল…
‘সেকি আপনি এখনো ফ্রেশ হননি কেন?
‘তোমার সাথে হবো তাই।
রিদের সোজাসাপটা কথায় মায়া কারণটা বুঝল না। বরং রিদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল…
‘আমাকে দেখে আপনার ময়লা মনে হয় যে আপনার সাথে ফ্রেশ হবো? যান গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হন। আজ আমরা নিচে খেত…
মায়া থামিয়ে রিদ বলল…
‘আজ কয়দিন?
‘কিসের?
মায়া কুঞ্জিত কপালে পাল্টা প্রশ্ন করলো রিদকে। মায়ার কথায় উত্তর না দিয়ে রিদ মায়ার চোখের দিকে তাকাল শান্ত দৃষ্টিতে। রিদের বদলানো দৃষ্টিতে মায়া হাসফাঁস করে কিছু বলবে তার আগেই রিদ বলল…
‘আমার ফোনটা নাও।
মায়া বিছানার উপর থেকে রিদের ফোনটা দিতে রিদ আসিফের নাম্বারে কল লাগাল। রিদের কলটা রিসিভ হতে ওপাশের আসিফ কিছু বলবে তার আগেই রিদ মায়ার চেহারার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
‘সবাইকে বাসায় চলে যেতে বল আসিফ।
রিদের কথায় তক্ষুনি শোনা গেল আসিফের গলার সুর, বলল…
‘ভাই আজ তো আমাদের জরুরি মিটিং…
‘সব ক্যানসেল।
‘ কিন্তু ভাই আপনার..
ফের আসিফকে বলতে না দিয়ে রিদ বলল…
‘এই রাতে তোর কোনো ডিস্টার্বেন্স চাই না আসিফ।
আজ রাতে তোর কল দেওয়া নিষেধ।
কথাটা বলেই রিদ কল কেটে নিজের ফোনটা বন্ধ করে দেয়। একই ভাবে মায়ার ফোনটাও রিদ বন্ধ করে দিতে মায়া আপত্তি জানিয়ে বলল…
‘আপনি ফোন বন্ধ করছেন কেন?
‘ কারণ আজ রাতটা আমার তাই।
চলবে….
/
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা_ইসলাম_মায়া
৭০
‘এই রাতে তোর কোনো ডিস্টার্বেন্স চাই না আসিফ।
আজ রাতে তোর কল দেওয়া নিষেধ।
কথাটা বলেই রিদ কল কেটে নিজের ফোনটা বন্ধ করে দেয়। একই ভাবে মায়ার ফোনটাও রিদ বন্ধ করে দিতে মায়া আপত্তি জানিয়ে বললো…
‘আপনি ফোন বন্ধ করছেন কেনো?
‘কারণ আজ রাতটা আমার তাই।
রিদের কথাটা মায়া তৎক্ষণাৎ বুঝতে না পেরে বললো…
‘ আচ্ছা ঠিক আছে আজ রাতটা আপনার। তারপরও ফ্রেশ হয়ে আসুন, নিচে খেতে যাবেন। সবাই অপেক্ষা কর…
মায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় নক করলো কাজের মেয়ে মালা। খাবার ট্রে নিয়ে নরম সুরে বাহির থেকে ডেকে বললো…
‘ভাবি আপনাদের খাবার, বড় ম্যাডাম পাঠিয়েছেন।
মালার গলা পেয়ে মায়া সেদিকে এগোলো। রিদ তখনো জায়গায় দাঁড়িয়ে কোমরের ইন করা শার্টের ভাঁজ টেনে প্যান্টের উপর ফেলে কোমরে বেল্ট খুলতে খুলতে ততক্ষণে মায়া চাপানো দরজাটা খুলে মালাকে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো…
‘তুমি খাবার এনেছো কেনো মালা আপু? আমরা নিচে গিয়ে খাবো তু…
মায়ার কথা শেষ হওয়ার আগে রিদ বেল্ট খুলে বিছানা থেকে তোয়ালে তুলে মালাকে আদেশ করে বললো…
‘খাবারগুলো রেখে যা মালা।
‘জ্বি ভাই।
রিদের কথায় সম্মতি দিয়ে মালা জায়গা ছাড়লো খাবারগুলো দরজার সম্মুখে রেখে। মালাকে চলে যেতে দেখে মায়া খাবার ট্রলি দুহাতে ঠেলে ঘরে প্রবেশ করতে রিদ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে পুনরায় মায়াকে আদেশ করে বললো…
‘দরজা বন্ধ করো রিত।
মায়া দরজা বন্ধ করে খাবার ট্রলি ঠেলে সোফার সম্মুখে রাখলো। রিদ ততক্ষণে ওয়াশরুমে গোসলে গেছে। মায়া ট্রে থেকে খাবার গুলো নামিয়ে টেবিলে রাখতে পুনরায় দরজা নক করলো মালা। মায়াকে ডেকে বললো…
‘ভাবি নিচে মেহমান এসেছে আপনাকে নিচে যেতে বলছেন দাদী।
মালার কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ খাবারগুলো ট্রে-তে তুলে রেখে চলে গেলো নিচে। কোথায় থেকে কোন মেহমান এসেছে মায়ার জানা নেই। রিদ গোসল শেষ করার আগেই মায়া আগত মেহমানদের সঙ্গে দেখা করে চলে আসবে বলে রিদকে না জানিয়ে বেরিয়ে যায়। অথচ নিচে নামতে নামতে মায়া আয়নের সঙ্গে জুঁইকে দেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে। আজ কতটা দিন কতটা মাস দেখা হয় না দুবোনের। হেসে খেলে বেড়ানো দিনগুলো যেন হঠাৎ চাপা পড়ে যায় বাস্তবতায়। মায়ার নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বলতে গেলে মায়া নিজেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে না রিদ চায় না বলে। মাঝে রিদকে না জানিয়ে আরিফের বাসায় যেতে গিয়েও মায়ার যাওয়া হলো না রাফার জন্য। পরে আর মায়া চেষ্টা করেনি কারোও সাথে যোগাযোগ করার রিদের অগোচরে। আজ না হয় কাল রিদ নিজেই মায়াকে ওর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেবে বলে এটা মায়ার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু আজ হঠাৎ করে জুঁইয়ের দেখা পেয়ে যেন মায়ার চোখের পাতা ভিজে উঠলো সেই পুরাতন স্মৃতিগুলো মনে করে। মায়ার ফুঁপানোতে জুঁইও একই ভাবে ফুঁপিয়ে উঠে কান্নায়। আয়ন সবে মিনিট দশেক হলো জুঁইকে নিয়ে খান বাড়িতে প্রবেশ করেছিলো। এরমাঝে মায়ার আগমনে দুবোনকে জড়াজড়ি করে কাঁদতে দেখে সে হাতের গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললো…
‘আরে আমার ছোট শালী সাহেবা যে? তা ভালো আছো?
আয়নের কণ্ঠ পেয়ে মায়া জুঁইকে ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দু’হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো…
‘জ্বি ভাইয়া ভালো! আপনি ভালো আছেন?
‘এতক্ষণ ভালো ছিলাম না। তবে এখন তোমাদের দেখা পেয়েই ভালো হয়ে গেলাম। তোমার জামাই কই? রিদ?
রিদের কথা জিজ্ঞাসা করতে মায়া কান্না ভেজা নাক টেনে বললো…
‘উনি রুমে আছেন। আপনারা কখন এসেছেন ভাইয়া?
‘মাত্র আসলাম। তবে আমাদের মামীর সাথে দুপুরের ফ্লাইটে চট্টগ্রামে আসার কথা ছিলো। কিন্তু খালামণিদের জন্য ফ্লাইট মিস করলাম। সেজন্য রাত হয়ে গেলো। আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি নাহয় রিদের কাছে যাচ্ছি কেমন?
কথাটা বলেই আয়ন সোফা থেকে দাঁড়িয়ে যায় রিদের ঘরে যাবে বলে। আয়ন চলে যেতে গিয়েও কি মনে করে একটু পিছিয়ে জুঁইয়ের বরাবর হয়ে নিচু গলায় বলে যায়…
‘আপনার প্রয়োজনে আমাকে কল করবেন জুঁই। আমি রিদের ঘরে আছি।
জুঁই মাথা কাত করে সম্মতি দিতে আয়ন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। মায়া আয়নের কথায় চমকে তৎক্ষণাৎ পাশে তাকাতে বেশ অনেকগুলো দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হলো। রিদের ফুফুরা সকলেই উপস্থিত। ফাহাদের মাকে দেখা গেলো শশীর মায়ের সঙ্গে বসে। পাশাপাশি শশীও বসে মায়ার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মায়া একত্রে এতোগুলো মানুষের দৃষ্টিতে পড়ে অস্বস্তি বোধ করলো। জড়তা মিশ্রিত স্বরে সবাইকে সালাম দিতে সুফিয়া খান ডাইনিং থেকে মায়াকে ডাকলো। শাশুড়ীর ডাক শুনে মায়া পালিয়ে যাওয়ার মতোন সেদিকে হাঁটলো জুঁইয়ের হাত চেপে। মায়ার জীবনে ঘটে যাওয়া পুরনো স্মৃতির পাতা উল্টানো হলে সেখানে সমান দোষী শশীর মা-কেও করা হবে। সেদিন মায়াকে বিয়ের দেওয়ার পিছনে ওর পরিবারকে শশীর মা-ই উস্কে ছিলো। মুক্তাকে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে অপমান করে মিথ্যা অপবাদে বের করে দেওয়া হয়েছিল শুধু শশীর মার কথায়। আর সেই জেদে মায়ার পরিবার ক্ষেপে গিয়ে মায়াকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চেয়েছিল খান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না বলে। মায়ার এই বিষয়টা হয়তো রিদ বা সুফিয়া খানের জানা নেই। তাই মায়াও চায় না নতুন করে শশীর মায়ের জন্য ওর বৈবাহিক সম্পর্কে ঝামেলা হোক। তাছাড়া শশীর মা মায়ার খালা শাশুড়ী হয়। নিজের বোনের বিষয়টা শুনলে অবশ্যই সুফিয়া খান কষ্ট পাবেন। মায়া চায় না ওর জন্য আর কেউ কষ্ট পাক। বরং যেটা চলে গেছে সেটা মায়া সয়ে গেছে। পুরাতন স্মৃতি নতুন করে তাজা করার কোনো মানেই হয় না। মায়ার সুফিয়া খানের মুখোমুখি হতে মায়ার ভেজা চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুফিয়া খান বলল…
‘কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?
সুফিয়া খানের কথায় মায়া জুঁইয়ের হাত ছেড়ে দেয়। জুঁইকে সুফিয়া খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে ভাঙা গলায় বললো…
‘ওহ আমার বোন জুঁই, আম্মু।
মায়ার কথায় সুফিয়া খান এক পলক জুঁইকে দেখে বললো…
‘ওহ আয়নের বউ। আমি ওকে চিনি। বেশ কয়েকবার আমাদের দেখা হয়েছিলো ঢাকায়। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেনো? নিজের পরিবারকে মিস করছো বুঝি?
সুফিয়া খানের কথায় মায়া থমথমে মুখে জুঁইয়ের দিকে তাকালো। বেখেয়ালি মায়া জুঁইকে কাছে পাওয়ায় এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি জুঁইয়ের পরিবর্তনগুলো। নতুন বিবাহিত কাপলকে দেখতে যেমন লাগে জুঁইকে তেমনই লাগছে। জুঁইয়ের সাথে আয়নের সম্পর্কের কথাটা মায়া জানত কিন্তু জুঁই যে আয়নকে বিয়ে করেছে সেটা জানতো না। তাছাড়া যেখানে মায়ার বিয়েটা নিয়ে মায়ার পরিবারের আপত্তি ছিলো সেখানে এতো সহজে জুঁইয়ের বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিলো ওদের পরিবার? বিশেষ করে মায়ার চাচা জুঁইয়ের বাবা কতো বিরোধিতা করলো মায়াকে খান বাড়িতে বউ করে পাঠাবে না বলে, সেখানে উনার নিজের মেয়েকে শেষ পর্যন্ত খান বাড়ির ছেলের হাতে তুলে দেবে বিষয়টা অবিশ্বাস্য লাগলো। মায়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে সুফিয়া খান ডাইনিং হতে টিস্যু নিয়ে মায়ার ভেজা গাল যত্ন সহকারে মুছে দিতে দিতে বললো…
‘ছোটখাটো বিষয়ে নিজের মূল্যবান চোখের পানি জড়াতে নেই মায়া। তাহলে মানুষ তোমাকে দুর্বল ভাববে। আর খান বাড়ির বউরা দুর্বল নয়।
~~
রিদ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আয়নকে দেখতে পেলো বিছানায় বসে। মায়ার জায়গায় আয়নকে রুমে দেখে রিদ হাতের তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সূক্ষ্ম নজর ঘোরাল রুমে। মায়াকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে রিদের মেজাজ চটে গেলো তক্ষুনি। আয়ন রিদকে ওয়াশরুম হতে বের হতে দেখে বললো…
‘ কিরে ভাই কোনো কারণ ছাড়া এভাবে রেগে ফায়ার হয়ে যাচ্ছিস কেনো? কোনো সমস্যা?
মায়াকে রুমে না পেয়ে তার মেজাজ এমনই চটে আছে। সেখানে আবার আয়নের হেঁয়ালি কথায় রিদ বিরক্তিতে বললো…
‘তুই আমার রুমে কি করিস? কি চাই?
‘চাই তো অনেক কিছুই ভাই। কিন্তু আপাতত তোর মেয়েকে আমার ছেলের জন্য চাই বুঝলি?
‘না।
রিদ বিরক্তি কণ্ঠে উত্তরটা করে হাতের তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেললো সোফায়। যদিও রিদ অগোছালো কাজ পর্যন্ত করে না। তবে মায়ার অনুপস্থিতিতে যেন রিদের বিরক্তি বাড়লো। আয়ন রিদের কথায় রসিয়ে বললো…
‘না করলে তো হবে না ভাই। আমার ছেলের ভবিষ্যৎ বলে কথা। তোর ‘না’-তে আমরা বাপ-ছেলে কেউ রাজি নই। তাছাড়া তোর মেয়ে জন্ম দেওয়ার আগেই ব্যাপারটা ফিক্সড করে রাখলাম, নয়তো তুই যে ত্যাড়ালোক, মেয়ে জন্ম দিতে দিতে বেঁকে বসবি আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিবি না বলে। এজন্য তোর মেয়ের জন্ম হওয়ার আগের পাকা কথা সেরে ফেললাম।
রিদের বিরক্তি বাড়িয়ে ঘরে রাদিফ ঢুকতে ঢুকতে আয়নের কথায় আপত্তি জানিয়ে বললো…
‘আয়ন ভাই তোমার ছেলে রিজেক্ট। খান বাড়ির মেয়ে চৌধুরী বাড়িতে যাবে না। খান বাড়ির মেয়ে, খান বাড়িতেই থাকবে আমার ছেলের বউ হয়ে। তুমি বরং ছেলের জন্য অন্য সম্বন্ধ খোঁজো। আমার ছেলের সাথে রিদ ভাই নিজের মেয়ের বিয়ে দিবেন তাই না ভাই?
কথা বলেই রাদিফ আয়নের পাশাপাশি বিছানায় বসলো। রিদ বিরক্তি চোখে সেদিকে তাকাতে আয়ন রাদিফের কথার প্রতিবাদ করে বললো…
‘শোন রাদিফ ঝামেলা পাকাস না। প্রস্তাব আমি আগে নিয়ে এসেছি সেজন্য আমারটাই গ্রহণযোগ্য তোরটা নয়। তাছাড়া সিরিয়ালে আমি আর রিদ দুজনই বিবাহিত। তুই বিয়ে না করে ছেলের বউ ঠিক করিস কিভাবে? আগে একটা বিয়ে কর তারপর না হয় ভেবেচিন্তে দেখবো তোর ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যায় কিনা। কিন্তু তারপরও রিদের মেয়ে আমার ছেলের জন্যই ফিক্সড বুঝলি?
‘তুমি দুর্নীতি করছো আয়ন ভাই। আমার বউ নেই তাতে কি হয়েছে? আব্বুর নির্বাচনের পরেই আম্মুকে বলে আমিও একটা বিয়ে করে নিবো।
আয়ন ফের রাদিফকে থামিয়ে বললো…
‘তুই আগে বিয়েটা কর তারপর বুঝবো বাকিটা। এখন বল মামার রিপোর্টগুলো কই? মামি আমাকে জরুরি তলবে চট্টগ্রাম ডেকেছে মামার রিপোর্ট গুলো চেক করতে। তুই রিপোর্টগুলো নিয়ে আয় যাহ।
আয়নের কথায় রাদিফের উচ্ছ্বসিত মুখটা মুহূর্তে চুপসে যায়। এক পলক রিদের দিকে তাকাতে দেখলো ততক্ষণে রিদ কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এরমাঝে আয়ন রিদকে ডেকে থামাতে চাইলেও রিদ থামেনি। রাদিফ রিদকে চলে যেতে দেখে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোজাসাপ্টা কথায় বললো…
‘ আব্বুর রিপোর্টগুলো ফেইক আয়ন ভাই। আম্মুকে চট্টগ্রামে ফেরাতে আমি আর ভাবি মিলে এসব প্ল্যানিং করে ফেইক রিপোর্ট বানিয়েছিলাম। তুমি প্লিজ রিপোর্টগুলো দেখে আম্মুকে বলবে আব্বুর হার্টের সমস্যার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে। যেগুলো রিপোর্টে উল্লেখ আছে তুমি সেইগুলোই আম্মুকে বুঝিয়ে বলবে প্লিজ।
এতক্ষণ দুষ্টুমি করা রাদিফ হঠাৎ সিরিয়াস গলায় কথাগুলো বলতে আয়ন হতবাক গলায় বললো…
‘তুই এসব মিথ্যা প্ল্যানিং-ফ্লটিং করার জন্য আর মানুষ পেলি না রাদিফ? মামিকে এসব মিথ্যা বলে জীবনে পাড় পাবি তোরা? মামি যে মানুষ দু’দিনে ধরা পরে যাবি তোরা তখন কি করবি?
‘যখন ধরা পড়বো তখন বোঝা যাবে। আপাতত রিস্ক নিতে চাই না ভাই। আম্মু চট্টগ্রামে ফিরেছে বলে আজ আমাদের বাড়িতে এত আনন্দ। আমি চাই না আম্মু আবার ঢাকা ফিরে যাক। যেভাবেই হোক আম্মুকে সবার সাথে চট্টগ্রামে রেখে দিতে চাই। তুমি প্লিজ আমাকে এই ব্যাপারের সাহায্য করো আয়ন ভাই। বাকিটা আমরা সামলিয়ে নিবো।
রাদিফের কথায় আয়ন প্রশ্ন করে বললো…
‘রিদ জানে তোদের বিষয়টা?
‘জানে।
‘যদি মামি রেগে যায় তোদের উপর তখন?
‘ রিদ ভাই আছে, উনি আম্মুকে সামলে নিবে। আশা করছি ঝামেলা হবে না।
রাদিফের দৃঢ় মনোবল দেখে আয়ন নীরব সম্মতি দিলো। বিষয়টা আসলেই যুক্তিসঙ্গত। রাদিফের জায়গায় আয়ন হলে সেও এতদিনে বারবার চেষ্টা করতো নিজের মা-বাবাকে একত্র করার। আয়নের উচিত এই বিষয়ে রাদিফকে সাহায্য করা। আয়ন রাদিফকে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদিফকে নিয়ে রিদের পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে বসার ঘরে যেতে দেখলো উপস্থিত মেহমানদের ভিড়। শশীকে দেখা গেলো হেনা খানের সঙ্গে বসে। রিদ ডাইনিংয়ে সুফিয়া খানের দিকে এগোচ্ছে। সেখানে মায়া-জুঁই দুজন দাঁড়িয়ে প্লেট সাজাচ্ছে রাতের খাবারের জন্য। দীর্ঘ সময় নিয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সকলে বসার ঘরে আড্ডা জমাল আলোচনায়। রিদ তখন বাহিরে গেলো আয়নকে নিয়ে। রাদিফ তখন সবে খাবার চিবোচ্ছিলো মনোযোগ সহকারে। পাশাপাশি জুঁই, সুফিয়া খান আর শশীর মা বসে। বাকিরা ড্রয়িংরুমে যার যার মতো করে আড্ডা মেতে। আশেপাশে মায়া নেই। সে কিচেন থেকে টক দই ট্রে-তে করে নিয়ে সবাইকে দিচ্ছে। শশীর মা সেদিকে তাকিয়ে মায়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করে সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে কটাক্ষ করে বললো…
‘রিদের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলের জন্য তুমি একটা পাগল মেয়েকে বউ করে আনলে কেনো আপা?
শশীর মায়ের কথায় সুফিয়া খান বাদে সকলের খাওয়াই বন্ধ হয়ে যায় তক্ষুনি। জুই, রাদিফ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে থমথমে মুখে তাকালো সুফিয়া খানের দিকে। সুফিয়া খান তখনো গম্ভীর মুখে খাবার চিবোচ্ছে। হাতের চামচে ফের খাবার তুলতে তুলতে শশীর মায়ের কথার উত্তর দিয়ে বললো…
‘আমিতো জানি শশী মানসিক রোগী। মায়া তো ক্ষণিকের জন্য অসুস্থ ছিলো।
সুফিয়া খানের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো শশীর মা। বললো…
‘আমার মেয়ের সাথে তুমি ঐ পাগল মেয়েটার তুলনা দিচ্ছো আপা?
গম্ভীর সুফিয়া খান আগের নেয় বললো…
‘তুলনা দিলাম কোথায়? সত্যিটা বললাম। তুলনা দিতে গেলে তো শশী জন্মগত পাগল। তারপরও খান বাড়ির বউ করতে আপত্তি ছিলো না আমার। সেখানে মায়া তো জন্মগত সুস্থ্য মস্তিষ্কের একটা মেয়ে ওর জন্য কেনো আপত্তি করবো?
সুফিয়া খানের কথায় রাগ নিয়ে উঠে যায় শশীর মা। উনার চলে যাওয়ার দিকে জুঁই রাদিফ দুজন তাকায়। রাদিফ পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিলেও জুঁই বেশ কষ্ট পেলো শশীর মা মায়াকে পাগল বলাতে। যদিও সুফিয়া খান উপযুক্ত প্রতিবাদ করেছেন তারপরও জুঁইয়ের বেশ খারাপ লাগা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ার দিকে তাকাতে দেখলো শশীর মা চলে যাওয়ার সময় ইচ্ছা করে মায়ার সঙ্গে লেগে যায়, যাতে করে মায়ার গায়ে পানি পড়লো গ্লাস ফস্কে। হতভম্ব মায়া হতবুদ্ধি হয়ে যায় শশীর মায়ের কাণ্ডে। তারপরও মুখ ফুটে কিছু বলল না। বরং নিজের শাড়িটা ঝেড়ে পানি পরিষ্কার করতে চাইলে বেখেয়ালি চোখাচোখি হয় রিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সঙ্গে। চমকে উঠার মতোন মায়া হাতের শাড়ি ছেড়ে তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
অথচ রিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বলছে সে শশীর মায়ের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেছে। রিদের পাশাপাশি আয়নও দাঁড়িয়ে মায়ার বিষয়টা লক্ষ্য করে রিদকে কিছু বলবে তার আগেই রিদ শক্ত চোয়ালে স্থান ত্যাগ করতে করতে হাঁক ছেড়ে মায়াকে ডেকে বললো…
‘রিত রুমে আসো।
রিদ ডাকলো অথচ মায়া জড়তায় রিদের পিছনে যেতে দ্বিধাবোধ করলো উপস্থিত মেহমানের সামনে। মায়াকে নড়তে না দেখে রিদ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে ফের শক্ত গলায় হাঁক ছেড়ে বললো…
‘রিত! রুমে আসো।
মায়া আর কোনো দিকে তাকালো না। রিদের শক্ত গলায় তৎক্ষণাৎ দৌড়ালো সিঁড়ি বেয়ে রুমে। রুমে যেতে যেতে বেশ কয়েকবার শাড়ির আঁচল ঝেড়ে গায়ের পানি পরিষ্কার করতে চাইল। অন্ধকার রুমে পা রেখে মায়া খানিকটা থতমত খেয়ে বসলো। মায়ার যাওয়ার সময় রুমে আলো ছিলো এখন অসময়ে রিদের লাইট অফ করার কারণটা বুঝলো না। অন্ধকার রুমে মায়া সুইচ বোর্ডের খোঁজ করে রিদকে ডেকে বললো…
‘এই যে শুনছেন? আপনি কোথায়? রুম অন্ধকা…
মায়া কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ আতঙ্কে মৃদু চিৎকার করে উঠলো মায়া রিদের আকস্মিক ঝাঁপটে ধরায়। মায়া কিছু বলার আগেই ওহ গলার মিষ্টি ব্যথায় গোঙিয়ে উঠলো। রিদ মায়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বাড়াতে বললো…
‘ তোমার ইজ্জত আমার হক। আমার হক চাই রিত।
রিদের এলোমেলো হাতের স্পর্শে মায়ার শরীরের কম্পন ধরলো। মায়া কম্পিত স্বরে বলতে চাইল…
‘ আপনি আমাকে…
মায়াকে বলতে না দিয়ে রিদ মোহাচ্ছন্ন গলায় বললো….
‘সরি জান! তোমার বুঝতে টু-লেট।
কথাটা বলেই রিদ মায়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে একহাতে দরজা লক করলো। অপর হাতে মায়ার কাঁধের কাপড়টা টেনে বাহুতে নামাতে নামাতে মায়ার উন্মুক্ত কাঁধে দাঁত বসাতে মায়া ফের গোঙিয়ে উঠে, তীব্র কম্পনে রিদের বাহুতে শরীর ছেড়ে দিতে রিদ দু’হাতে মায়াকে জড়িয়ে নিতে নিতে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো…
‘ আই লাভ ইউ জান।
#চলিত….