অর্ধাঙ্গ পর্ব-০১

0
13

#অর্ধাঙ্গ পর্ব-০১
#মীরাতুল_নিহা

“বাজান, তোর বউ বন্ধ্যা। বাচ্চা হইব না কোনোদিন! তুই তারে তালাক দিয়া দে বাপ।”

দুপুরের অসহনীয় গরমে হাতে হাতপাখা নিয়ে ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন জমেলা বেগম। হঠাৎ মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সজীবের গলায় ভাত আটকে গেলো। সে দম আটকে কাঁশতে লাগলো। জমেলা বেগম তৎক্ষণাৎ বাতাস বন্ধ করে ছেলের সামনে এক গ্লাস পানি ধরে দেন। সজীব এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাস খালি করে ফেলে। এরপর জমেলা বেগম আবার শুরু করলেন

“মায়ের কথাডা একটু চিন্তা কইরা দ্যাখ, বিয়া কইরা এত বছর হইয়া গেলো, তোর বউর এহনো কুনো বাচ্চা হইলো না। আর হইব বলিও মনে হয় না! এমন বেডিরে রাখবি ক্যান? তালাক দিয়া বিদায় কইরা দে!”

দরজার আড়াল থেকে জমেলা বেগমের প্রতিটি বাক্য নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিল পারুল। কোনো প্রতিবাদ করেনি। কেবল স্তব্ধ চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, সজীব কী বলে, সেই প্রত্যাশায়।

“পরের কথা পরে ভাবা যাইব আম্মা। এখন শান্তিতে খাইতে দেন তো।”

ছেলের কথায় জমেলা বেগমের কপালে একটুখানি ভাঁজ পড়ে, তবে পরমুহূর্তেই পান খাওয়া লাল ঠোঁট দুটোতে একধরনের সন্তুষ্টির রেখা ফুটে ওঠে।

“হ বাজান, আগে পেটটা ভইরা খা। হেরপর যা ভালো লাগবে, মা’রে কইস।”

সজীব কিছু বললো না। চারপাশের বাতাস থমকে আছে, রোদের ঝাঁজ যেন ঘরের দেওয়াল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। অসহনীয় গরম পড়েছ! সজীব ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে লাগলো। সাথে একটা আমের টুকরোও মেখে নিলো ভাতের সাথে। এক গ্রাস মুখে পুরে নিতেই মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো সজীব তখুনি সেখানে হাতে কাঁচা পেঁয়াজের টুকরো নিয়ে উপস্থিত হয় পারুল। পারুলকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন জমেলা বেগম!

“মা তার পোলারে শান্তিতে দুইডা ভাত, খাওয়াইতাছে। সেখানে তুমি আইয়া খাঁড়ায় রইছো খ্যান বউমা?”

মুখটা কালো করে কথাগুলো বললেন জমেলা বেগম। তাতে অবশ্য পারুলেন কিছু যায় আসে না। সে তো এসবে অভ্যস্তই! যখন জমেলা বেগমের ছেলের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার থাকে বা কোনো কথা বলার থাকে এভাবে দরদ নিয়ে ছেলেকে তার পছন্দের খাবার খাওয়ান। এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে পারুল, তবে তার স্বামী লক্ষ্য করেছে না-কি অন্ধ মাতৃ স্নেহেই ডুবে আছে কে জানে!

“কাঁচা পেয়াজের টুকরা’ডা লন। আমনে তো আবার ডাইলের লগে কাঁচা পেয়াজ কামড় দিয়া খাইতে পছন্দ করেন। হেইলাইগ্যাই আনছি।”

স্বামীর দিকে পেঁয়াজটা দিতেই সজীব হাল্কা হেঁসে স্ত্রী’র হাত থেকে পেঁয়াজটা নেয়। তারপর পারুলের কথামতনই ডাল দিয়ে ভাত মুখে নিয়ে শেষে তৃপ্তি সহকারে পেঁয়াজে কামড় বসায়। তা দেখে আরেকদফা তেতে উঠলেন জমেলা বেগম!

“বউমা! আমি যে আমার পোলার লাইগ্যা গোশত রানছি, হেইডা কি তুমি জানো না?”

“জানি আম্মা, পেঁয়াজের টুকরাডা নিয়াই আইছি, তাই ভাবলাম দিয়াই যাই।”

শ্বাশুড়ি আর পুত্রবধূর মাঝখানে কথা বললো সজীব,

“আম্মাগো, পাতলা ডাইল দিয়া ভাত মাখায়ে, লগে পেঁয়াজ কামড় দিয়া খাইতে সেই মজা।”

ছেলের মুখ থেকে এরকম কথা শুনে জমেলা বেগমের মুখটা কালো অন্ধকার হয়ে গেলো! সেটা সজীব লক্ষ্য করেই আবার বললো,

“আমনের গোশত দিয়া ভাত আমি রাইত খামুনে আম্মা। তহন খালি গোশত দিয়া খামু।”

খুশি না হলেও মুখে জোর করে হাসি ফুটালো জমেলা বেগম।

“ঠিকাছে বাজান, অহন খাইয়া লও।”

সজীব আবারো মনোযোগ হয় খাবার খেতে। পারুল আর সেখানে না দাঁড়িয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। সে মোটেও ছেলে আর মা’য়ের কথা শুনতে আসেনি, এসেছিলো পেঁয়াজ দিতে, তখনই জমেলা বেগমের কথাগুলো শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। খারাপ লাগলেও স্বামী যাতে তৃপ্তি সহ খায় সেজন্য হাতে রাখা পেঁয়াজটা দিয়েই গেলো! খারাপ লাগতে লাগতে যেন তার সয়ে গেছে সবকিছু। কম তো আর হয়নি! দুপুরের তীব্র গরমে, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ায় পারুল রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। জানালার পর্দাগুলো আড়াল করে রাখা হয়েছিলো, যেন তীব্র রোদ বাইরে থেকে ঘরের ভেতর ঢুকতে না পারে। সজীব খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে বসে ছিলো বাহিরে, একটু পর উঠে রুমে যায়, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো দেখলো, পারুল শোয়া অবস্থায়, উল্টোপিঠে শুয়ে আছে।

সজীব ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কপালের ভাঁজ এক সেকেন্ডের জন্য বাড়লো, তবে তা ঝেড়ে ফেললো তৎক্ষণাৎ। পারুলের মুখে কোনো অভিযোগ ছিলো না, চোখের গভীরে এক ধরনের বিষণ্নতা, অভিমান, চুপ থাকা, যা সজীব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলো। সে পারুলের কাছে একটু এগিয়ে গিয়ে, তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারুল একটুও সাড়া দিলো না। তার শরীর খানিকটা টানটান, যেন কোনো তীব্র অভিমান, রাগ জমে আছে। সজীব নিঃশব্দে এক মুহূর্তের জন্য ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে পারুলের কাছে গেলো। তাকে ভালোবাসার একটু ছোঁয়া দিতে চাইলো। সে পারুলের কাঁধে হাত রাখলো, তারপর একটু জোর দিয়ে বললো

“ এদিক পানে তাকা তো একটু।

পারুল চোখ বন্ধ করে, বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে সজীবের দিকে তাকায়। তার অভিমান আর চোখের নীরব কথাগুলো সজীব বুঝতে পারলো কি না কে জানে, কিন্তু পারুল কিছু বললো না। সে শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো, যেন সজীবের কাছে কোনো সান্ত্বনা বা কথা শুনতে চায় না।

“একটু জড়ায় ধরলে কি হইব রে বউ? একটু আদরই তো চাই!”

পারুল এবারও কিছু বললো না, শুধু উল্টোপিঠ দিয়ে শুয়ে রইলো, যেন সে আর কিছু শুনতে চায় না। সজীব গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর অবশেষে নিজের হাত দিয়ে পারুলকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। পারুল চাইলেই অভিমানে তার স্বামীকে দূরে ঠেলে দিতে কিন্তু স্বামীর স্পর্শ পেতে সে যেন একটু বেহায়া হয়ে গেলো! মানুষটাকে তো সে তেমন কাছেই পায় না এই সময়। শান্তির ঘুম দিতে চেষ্টা করছিলো, ঠিক তখনই, বাইরে থেকে এক তীব্র কর্কষ কণ্ঠে চিৎকার শোনা গেল,

“দুপুরবেলা আইডা বাসন গুলা মনে হয়, আমারই ধোওয়া লাগবো! কি কপাল বুড়া বয়সে এহন বাসন মাজতে যামু দুপুরবেলা।”

জমেলা বেগমের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সজীবের চোখ খুলে গেলো, পারুলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই দেখে পারুল পাখির ন্যায় ফুড়ুৎ!

উঠনো বালতিতে সব এঁটো বাসন গুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমেলা বেগম। বাসনের সাথে কিছু ময়লা কড়াইও জমেছে। প্রতিদিনই পারুল সবকিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখে। আজকে একটু মন খারাপ হতেই মনেই ছিলো না আর এঁটো বাসন ধোয়ার কথা! আর আজকেই তার শ্বাশুড়ি চেঁচিয়ে উঠলেন।

“আম্মা, সব যে বালতিতে রাখছেন?”
“আমার গতর তো আর তোমগো মতন জোয়ান নাই, আমি বুড়া মানুষ। বালতিতে লইয়া পুকুরপাড়ে যাইতাছি মাজতে।”

“পুকুড় পারে যাওন লাগে নাকি আম্মা? আমগো বাড়ির উঠোনে কি টিউবওয়েল নাই?”

বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মায়ের উদ্দেশ্য কথাগুলো বললো সজীবের ছোটো ভাই শরীফ। ছেলের এহেনো কথা শুনে জমেলা বেগমের রাগ যেন দ্বিগুণ হলো!

“তোরা কি মনে করোস রে আমারে? আমি ওই শক্ত টিউবওয়েল থাইকা পানি চিপতে পারমু? এত শক্তি!”

শরীফ উত্তর দেবার আগেই পারুল তার শ্বাশুড়িকে বলে,
“আম্মা, আমি ধুইয়া দিতাছি। আমনে রাখেন বাসনপত্র।”

জমেলা বেগম মুখটা কালো করে উত্তর দেয়,

“থাক আমিই পারুম, তুমি বরং গিয়া ঘুম যাও।”

“অযথা জিদ করতাছ ক্যান আম্মা? ভাবীই তো সব কাম করে! হয়ত দুপুরে একটু শুইছিলো, এর লাইগ্যা তুমি এমন করতাছো?”

দেবরের অনাকাঙ্খিত উত্তরে চমকে উঠলো পারুল! চোখ দু’টো বড়বড় করে শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, ঝড় আসার টেরর সে যেন ভালো করেই পাচ্ছে!

“আহা, শরীফ। তুমি ঘরে যাও তো।”
“না ভাবী, আমি কি মিছা কথা কইছি কন তো? আম্মা হুদাহুদি, এখন এমন করতাছে।”

এবার আর চুপ রইলেন না জমেলা বেগম! বালতিটা হাত থেকে শব্দ করে রেখে দিলেন! অগ্নিঝড়া দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ভাবীর হইয়া এতো কথা কস, কি হইছে তোর?”

ততক্ষণে সেখানে সজীব এসেও উপস্থিত হয়েছে। তবে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করছে! যেন নিরব দর্শক!
“আমার কি হইব আম্মা? আমি কি মাইনষের মতন চুপ কইরা থাহি নাকি! যা সত্যি হেইডাই তো কই!”

কথাটা যেন শরীফ সজীকে উদ্দেশ্য করে বললো সেটা আর কেউ না বুঝলেও পারুল ঠিকই বুঝলো। তবে সে চুপ হয়ে রইলো, কিন্তু চুপ হলেন না জমেলা বেগম! তিনি বিলাপ করত করতে বলে,

“এই দিন দেখোনের বাকি আছি তয়লে? ওই পোলা, তুই আমার পেট থেইকা হোস নাই? নাকি তোর ভাবীর লাইগ্যা দরদ বেশি কোনডা?”

শেষের কথাটা শুনে স্তব্ধ নয়নে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো পারুল! আঁড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালো একবার আর একবার শরীফের দিকে!

#চলবে?