অর্ধাঙ্গ পর্ব-০৩

0
17

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-৩

“আরে মাস্টার মশাই! দিন কাল কেমন চলতাছে?”

মুখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রিয়ার মাস্টার মশাইয়ের দিকে তাকালো সজীব। কবির বিনিময়ে মুঁচকি হাসি দিলো,
“ভালোই চলতাছে, আমনের খবর কি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভাই, যাও রিয়ারে পড়াইতে যাও ভিতরে।”

কবির ভেতরে চলে গেলো, রিয়ার ঘরে। রিয়া কবিরকে দেখেই টেবিলে বইখাতা নিয়ে বসলো। উঠোনে তখন আগের মতনই দাঁড়ানো পারুল। সজীব এবার পারুলের কাছে গিয়ে বলে,

“যাও ভিতরে যাও। এমনে সঙের মতন খাড়াই থাইকো না।”
বলেই সজীব ভেতরে চলে যায়। পারুল নড়ে না, পূর্বের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে বলায় মনে মনে কষ্টের পাহাড় জমলো। তবে সেটা নিয়ে ভাবা বাদ দিয়ে একটু পরই রান্নাঘর থেকে সিঙারাগুলো একটা ছোট্ট বাটিতে নিলো। তারপর ঘোমটাখানা টেনে নিয়ে রিয়ার রুমে গিয়ে মাস্টার মশাইয়ের সামনে দিয়ে আসলো। রিয়া যে পারুলের হাতে সিঙারা দেখে বেশ অবাকই হয়েছে সেটা তার মুখ দেখেই স্পষ্ট! তারপর নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হতেই দেখে সজীব ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে আলনায় রাখছে৷ সেটা দেখে পারুলের মায়া হলো! মানুষটা নিশ্চয়ই কত খাটাখাটনি করে এসেছে! আর তখনই নিশ্চয়ই তার শ্বাশুড়ি ইনিয়ে বিনিয়ে ছেলেকে কিছু বলেছে সেজন্যই সজীব ওরকম ভাবে বলেছে। এগুলো ভালো করেই জানা পারুলের। সজীব বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। ঝগড়া ঝামেলায় যাবে তো দূর এসব সে পছন্দই করে না! আর শ্বাশুড়ি যেভাবে ছেলেকে তেল দিয়ে রাখছে সেখানে ছেলে তো বাধ্য মা’কে অন্ধের মতন ভালোবাসতে! পারুল দিন গুনছে কবে যে শ্বাশুড়ির অন্ধ ভালোবাসা থেকে বের হবে তার স্বামী!

“শরবত কইরা দিমু? ভালা লাগব, শইলডা।”
“আমি জানি ঘরে ট্যাং নাই, শরবত কি দিয়া হইব? খালি চিনির পানি আমি খামু না।”
“আমনে এহনি খাড়ান, আমি আইতাছি!”

বলেই পারুল রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ফিরলো মিনিট পাঁচেক পর। এসেই একটা স্টিলের গ্লাস এনে সজীবের সামনে ধরলো,
“নেন, খাইয়া লন।”
সজীব বিস্ময় নিয়ে পারুলের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলো! এতক্ষণ গরমে কাজ করার পর ঠান্ডা লেবুর শরবতটা যেন সর্বাঙ্গ শীতল করে দিয়েছে!

“বউ?”
পারুল গ্লাসটা নিয়ে চলে যাচ্ছিলো সজীবের ডাকে থমকে দাঁড়ায়। বউ সম্মোধনটাতে কি আছে সে নিজেও জাানে, বিয়ের এতগুলো বছরের পরও সজীবের মুখ থেকে বউ ডাক শুনে প্রথমদিনের মতনই শিহরণ জাগে তার শরীরে!

“হ, কন।”
“আমি চিনির পানি খামু না দেইখ্যা, লেবুর শরবত বানাইয়া দিলি! কিন্তু লেবু তো ঘরে নাই।”

“পাকঘরের পিছে দিয়ে কতডি গাছ উঠছে, হেইনে একটা লেবু গাছ উঠছিলো, হেই গাছে পানি দিয়া যত্ন টত্ন করছিলাম। গাছ থেকেই আনলাম। আরো দুইডা লেবু আছে এহনো, হেইডি দিয়া একদিন শরবত বানাই দিমুনে।”

“যত্ন করলে সবাই তার প্রতিদান দেয়, তাই না?”

পারুল মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিতেই, সজীব কেমন বিষন্ন কন্ঠে বলে,
“এই যে তুই আমারে এতো যত্ন করছ, আমি তোরে কি দিই? গালি তাই না রে বউ?”

পারুলের বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে ওঠে। সজীবের কন্ঠ কেমন জানি ঠেকলো! অন্যরকম, একটু আগের সজীবের সাথে এখনের সজীবের কোনো মিলই নেই যেন। হয়তো সংসারের দায়িত্ব, শ্বাশুড়ির অভিযোগ, সব কিছুর ভেতর হারিয়ে গেছে এক সময়ের তরুণ প্রেমিক পুরুষটা। কিন্তু পারুল জানে, সজীবের ভিতরে এখনো যে মানুষটা আছে, সে শুধু পারুলকেই ভালোবাসে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গ্লাসটা রেখে, সজীবের পাশে মাটিতে বসে পড়ে।

“আমি কি কিছু কই আমনেরে? আমি তো জানি, আমনের রাগ উইঠ্যা গেলে দুই চাইর কথা কইয়া ফালান!”

সজীব চুপ করে থাকে। তারপর আচমকাই বলে উঠে,

“তুই হইলি আমার জীবনের ছায়াগাছ রে পারুল, যে গরমে ছায়া দিছে, বৃষ্টিতে লুকায় রাখছে, অথচ আমি তেমন ভালা কইরা তোর গুঁড়িটার দিকে তাকাইয়াই দেখলাম না। তোর ভালোবাসা আছিল নীরব নদীর মতন, আমি শুধু পাড়ে দাঁড়াইয়া অনুভব করছি, ডুব দেই নাই কোনোসময়।”

“ডুব দিয়া দেহেন না! সময় তো অহনো ফুরায় নাই।”

পারুলের সমস্ত মুখমন্ডল যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেলো এটুকু কথাতেই! তারউপর সে-ও কেমন করে বলে দিলো! ইশ লজ্জা আর লজ্জা! স্বামীর মুখপানে তাকাতেই পারছে না! সজীব তখন একটু এগিয়ে গিয়ে পারুলের লজ্জারাঙা মুখটা আলতো করে দু হাত দিয়ে স্পর্শ করলো,
“অহনো, বিয়ার প্রথমের মতন সুন্দর লাগে তোরে লজ্জা পাইলে বউ।”

আরেক দফা লজ্জায় মুখ লুকোয় পারুল। সজীব আলতো করে পারুলের কপালে চুমু একে দিতেই পারুল মুঁচকি হাসে। সজীব যেন তার মনে অভিমান জমতেই দেই না! কি সুন্দর করে কথার জাদু দিয়ে তার অন্তরটারে শীতল কইরা দেয়!

সাল ১৯৯০।
ছোট্ট এক গ্রাম, নাম পলাশপুর। রাস্তার ধারে শীতলপাটির মতন বিছানো ধানখেত, মাঝখানে সচ্ছ পানির তৈরী পুকুর, আর তার পাড়েই কয়েকটা কাঁচা-পাকা বাড়ি। মানুষজন তখনো হারিকেনের আলোয় খাতা দেখে, আবার খালি চোখেই দেখে ভাগ্যরেখা। সেই গ্রামের এক চিলতে উঠানে জন্মেছিল পারুল। তিন বোনের মধ্যে সে ছিলো সবার বড়। মা কুলসুম বেগম ছিলেন শান্তশিষ্ট এক গৃহিণী। মুখে যতই হাসি থাক, চোখে ছিল সবসময় একরাশ দুশ্চিন্তা। কারণ, তাদের সংসারে কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না।
পারুলের বাবা রউফ মোল্লা, কৃষিকাজ করে জীবন চালাতেন, কিন্তু মনটা ছিল সমাজের কথায় উঠাবসা করা এক লোক। যে যা বলতো তাই বিশ্বাস করতো! মানুষের মুখে যখনি শুনেছেন, কুলসুমের আর ছেলে হবে না, উল্টে মেয়ে জন্ম দিয়েই যাচ্ছে! শেষমেষ একদিন তিনি ঘটা করে কুলসুম বেগমকে তালাক দিয়ে দিলেন। শেষ বক্তব্য ছিলো,
“তুই আমারে পোলা দিতে পারোস না, আর কিসের বউ?”

চোখেমুখে অপমান আর চোখে কান্না নিয়ে তিনটা মেয়ে আর এক বুক দুঃখ নিয়ে কুলসুম বেগম চলে গেলেন বাপের বাড়ি। পলাশপুরের পাশের গ্রামেই তার বাড়ি।

প্রথম প্রথম পারুলের মামা বাড়ির সবাই খুব আপন হয়ে গেলো। মায়া, মমতা সবই ছিলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মায়ার ওজন বাড়তে লাগলো, কারণ কুলসুমের তিন মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া যেন খুব কঠিন কিছু হয়ে গেছে! এর ভেতর মানুষের মুখে আবার নতুন কটু কথা

“তিন তিনটা মাইয়া নিয়া বইসা আছে! স্বামীর ঘর করতে পারে নাই!”

এই অসহ্য পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে একদিন কুলসুম বেগম যেন আর পারলেন না। সকালবেলা উঠোনে একটা কাঠালগাছের ডালে ওড়না পেঁচিয়ে নিঃশব্দে রেখে গেলেন তিনটা প্রাণের চোখ ভরা প্রশ্ন।

পারুল তখন তেরো কি চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী। চোখের সামনে মায়ের লাশ দেখে যেভাবে বুক ফেটে কেঁদেছিল, সেই কান্না আজও রাতের ঘুমে ফিরে আসে।
এরপর ভাগ্য যেন তিন বোনকে তিনদিকে ছড়িয়ে দিলো—
ছোট বোনের মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো। মেজোটা একদিন সকালে বাহিরে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। শোনা যায়, পাশের গ্রামে কারও সাথে পালিয়ে গেছে। বাকি রইলো পারুল। না মা, না বাবা তার জীবনে কেউ নেই।
তারপর বিয়ের পরে সে ধরে নিয়েছিলো,
“এ দুনিয়ায় নিজের বলতে যদি কেউ কিছু থাকে, তবে সেটা তার স্বামী।”

এই বিশ্বাস নিয়েই সে সংসার শুরু করেছিল সজীবের সাথে। পারুল জানতো, সে এই বাড়ির সবার পছন্দের নয়। কিন্তু তবুও সে চুপচাপ, ধৈর্য নিয়ে। ঘর সামলেছে, সংসার করছে।

আজও সে মনে করে,
”আমি উনারে যদি না ধরি, তবে আমারে কে ধরবে? আমি তো কারও মাইয়া না, কারও বোনও না! আমি তো অহন শুধু উনার বউ!”

রাত্রি তখন নয়টার কাঁটা ছুঁইছুঁই।
দিনভর রোদের তাপে যেন ঘরের দেয়ালগুলো এখনো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যার পরেও ঘরে থাকতে হাঁসফাস করছে দেহ! ঘরের ভেতরে হাতপাখা ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর।
পারুল হারিকেনটা জ্বালিয়ে ঘরের কোণায় টেবিলের ওপর রাখে।সে চুপচাপ রান্না করা ভাত, ডাল আর তরকারি সব গুছিয়ে রাখে। এই সময় সজীব হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে। গামছাটা গলায় ঝুলছে, মুখটা ঘামে ভেজা। হারিকেনের আলোয় তার মুখের ছায়া দেয়ালে দেখা যাচ্ছে ।

সজীবকে খেতে বসতে দেখে জমেলা বেগম পান চিবোতে চিবোতে ছায়ার মতো এসে হাজির হয়,

“বাজান! তুই কইছিলি রাইতে মা’র রান্ধা খাওন খাবি।”
সজীব বিনিময়ে কিছুটা হেঁসে উত্তর করে,
“হ, আম্মা।”
জমেলা বেগম খুশি হয়ে বসে পড়ে, ছেলের কাছে।
“আমি বাইরা দিতাছি।”

বলেই তিনি পাতিল থেকে প্লেটে ভাত বারতে লাগলেন। পাশেই পারুলকে দেখতে পেয়ে বলে,

“বউমা? আমি তো আছিই সজীবরে সব আগায় দেওনের লাইগ্যা! তোমার আর কষ্ট কইরা খাড়ায় থাহন লাগব না।”

জমেলা বেগমের কথায় পারুল কোনো পতিক্রিয়া না করলেও সজীবের মুখে দেখা দিলো এক চিলতে হাসি! যার অর্থ, তার মা, বউয়ের কথা ভাবছে। এদিকে পারুল ভ্রু কুঁচকে এক পলক জমেলা বেগমকে দেখে চলে গেলো ঠিকই তবে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো! সে ভালো মতনই জানে জমেলা বেগম এতো দরদী মহিলা না তার ক্ষেত্রে! পারুল সজীবের পছন্দ করা বউ হলেও জমেলা বেগমের অপছন্দের বউমা।

“বাজান, কইছিলাম দুপুরের কথাডা! কি চিন্তা করলি বাপ? দ্যাখ আমারও বয়স হইতাছে, কয়দিন বাঁচি হের কুনো ঠিক নাই।”

পারুল যেটা ভাবছিলো ঠিক সেটাই! তবে জমেলা বেগম এবার তাকে তাড়ানোর চেষ্টায় নেমেছে! মনে মনে বেশ রাগ জমলো পারুলের! কি যে ইচ্ছে করছে নিজেও বুঝতে পারছে না, ঠিক তখুনি পারুল দেখে উঠোনে টিউবওয়েলের আওয়াজ। উঁকি মেরে দেখে বাহিরে শরীফ এসেছে। সজীব তখন ভাত পাতে বসে আছে।

#চলবে?