#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-৪
“আরে ভাবী যে! কলপাড়ে তুমি?”
পারুল মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“হ, তোমার অসুবিধা হইব দেইখ্যা, আইলাম কূপি নিয়া।”
“আমার তো হাত-মুখ ধোওয়া শ্যাষ, ভাবী।”
“ঘরে আইয়ো তাইলে। আম্মা ভাত বাইরা দিতাছে, তুমিও খাইতে বসো।”
“আইচ্ছা চলো।”
“আর আম্মা মনে হয় তোমার ভাইজানের লগে, তোমার বিয়ার কথা কইব।”
কথাটা শোনা মাত্রই সজীব অবাক নয়নে পারুলের দিকে তাকায়!
“কি কও!”
“তা জানি না, তবে বিয়ের বিষয়েই কথা হইতাছে, তুমি যাও তাড়াতাড়ি। গিয়া শুনো আম্মা কি কয়!”
শরীফ দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকতেই কানে আসলো সজীবের কথা, কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি মেশানো নিয়ে জমেলা বেগমের উদ্দেশ্য বলছে,
“এতো বিয়া বিয়া কইরেন না, আম্মা!”
শরীফ কথাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়,
“কার বিয়া লাগছে ভাইজান?”
“আম্মার!”
দরজার পাশ থেকে কথাটা বলে উঠলো পারুল। সেটা শুনেই শরীফ উচ্চশব্দে হেঁসে উঠে, জমেলা বেগমের চোখে মুখে তখন রাগের ভাঁজ স্পষ্ট! তার বাঁজখাই কন্ঠ ধেয়ে আসলো পারুলের দিকে!
“রসিকতা করো বউমা! আমার বিয়া!”
পারুল শাশুড়ীর এহনো অবস্থা দেখে পারছে না হাসতে, কাপড়ের আচলে মুখ টিপে বলে,
“আমি তো আম্মা কইয়া ডাক দিছিলাম আমনেরে, শরীফই মাঝখানে হেঁসে উঠলো!”
কাচুমাচু মুখ করে কথাটা বললো পারুল। জমেলা বেগম মুখটা কিছুটা কালো করেই রাখলেন চুপ করে!
“আয় শরীফ, খাইতে বইয়া পর।”
শরীফও বড় ভাইয়ের নির্দেশ মতন পাশে বসে পড়লো খাওয়ার জন্য। জমেলা বেগম পুনরায় বলে উঠলো,
“তুই আম্মার কথা হুনতি না বাপ?”
কন্ঠে মায়া মিশিয়ে, আশাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো বড় ছেলের দিকে।
“হুনার মতন কথা কন, আম্মা। ঠিকই হুনমু!”
জমেলা বেগম উত্তর দেবার আগেই শরীফ বলে,
“ছিহ্ আম্মা! আমনে বুড়া বয়সে বিয়া করতে চাইতাছেন! আবার হেই কথা ভাইজানরেও হুনতে কইতাছেন! আল্লাহ্ গো আল্লাহ্ কি দিনকাল আইছে গো! আমার আম্মাজান আব্বাজনরে থুইয়া বুইড়া বয়সে বিয়া করতে চায়। ও চাচীগো, ও কাকী গো, কে কই আছেন গো!”
এবার সজীব আর পারুল দু’জনেই হেঁসে উঠলো শরীফের কথা শুনে! পারুল জানে শরীফকেই তার কাজে লাগাবে! একপ্রকার সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না টাইপ। জমেলা বেগম রাগত কন্ঠে ছেলেকে ধমকাতে লাগলো,
“হারা°মজা°দা! মুখ সামলাইয়া কথা ক! মা’র লগে মশকরা করছ!”
জমেলা বেগম বুঝলেন আর কূল করতে পারবেন না, তারউপর ছোটো ছেলেও চলে এসেছে। সে তো সবসময় এক কাঠি উপরে! অগত্যা ব্যর্থ হয়ে, মুখ ভারী করে সেই ঘর থেকে দ্রুত প্রস্থান নিলেন তিনি। পারুল শাশুড়ীর দিকে তাকালেন, জমেলা বেগমের মুখ তখন দেখার মতন হয়েছে!
“ভাবী! গোশতডা কিন্তু মজা হইছে।”
“আম্মা রানছে শরীফ, মা’র হাতের রান্ধা তো সবসময়ই ভালো হয়।”
“এমন কইরা আম্মাও যদি সবসময় ভালা থাকতো।”
শরীফের কথা শুনে সজীব শরীফের পিঠে হাল্কা করে থাপ্পড় দিয়ে বলে,
“দূর ভাই! মা’র বয়স হইছে, আর তাছাড়া আম্মা তো আমগো ভালোই চায়।”
সজীবের কথা শুনে পারুল বড় করে শ্বাস ছাড়ে। এই শাশুড়ী আম্মা ভালো চাইতে চাইতে না জানি তার সর্বনাশ কইরা দেয়!
“তুই খাবি না, বউ?”
“আমনেরা খাইয়া লন, আমি আম্মা আর রিয়া হেগো লগেই খামু।”
“আইচ্ছা।”
দু ভাইয়ের খাওয়া শেষ হতেই পারুল জমেলা বেগমের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। চারিপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে ঘরের আশেপাশে কোথাও জমেলা বেগম নেই! পারুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনমনেই বলে উঠলো,
“রাইত কইরাও আম্মার মাইনষের বাড়িতে যাইয়া বইয়া থাহনের অভ্যাস গেলো না।”
পারুল এবার গেলো রিয়ার রুমের ভেতরে,
“রিয়া? ভাত খাবে না?”
“একটু পরে খাবো, ভাবী।”
“আম্মাও নাই! আম্মা আসলে তোমরা খাইয়া নিও, আমার শরীলডা ভাল্লাগতাছে না, আমি যাইয়া শুই।”
“আইচ্ছা। কিন্তু ভাবী হুনো?”
“কও?”
“ভাইজানরে একটু কইও তো, আমার খাতা শ্যাষ হইয়া গেছে।”
“আইচ্ছা কমুনে।”
কথা শেষ করে পারুল নিজের রুমে চলে যায়। গিয়ে দেখে সেখানে সজীব খালি গায়ে হাতপাখা দিয়ে বসে বসে বাতাস করছে। পারুল গিয়ে পাখাটা সজীবের হাত থেকে নিয়ে নিয়ে বাতাস করতে থাকে।
“আরে আমি বাতাস করতাছি তো।”
“থাক, আমনে আরাম করেন।”
সজীব মৃদু হেঁসে বলে,
“তোর গরম লাগতাছে না?”
“না।”
পারুলের চটজলদি জবাবে কিছু বললো না সজীব।
“একটা কথা কওনের আছিলো।”
“কইয়া ফালা, কি কইবি?”
“রিয়ার লেখনের খাতা শ্যাষ হইয়া গেছে।”
সজীব বড় করে শ্বাস নিয়ে বললো,
“শ্যাষ হইয়া গেছে, দেহি আইনা দিমুনে।”
“রিয়ায় পড়ালেহায় খুব ভালা।”
“হেই লাইগ্যা তো, গাঁয়ের মাইয়ারা যেনে পড়ালেহার নামও লইতে পারে না, হেই জায়গায় আমার বইনে পড়তাছে।”
“আইজকা তো খালি হাতে ফিরা আইছেন, বাজার করেন নাই। কালকের লাইগ্যা তো কিচ্ছু নাই!”
পারুলের কথা শুনে সজীব মলিন দৃষ্টিতে স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে বলে,
“দুপুরে তো হেই কারনেই বাইর হইছিলাম। আইজকা কয়ডা দিন ধইরা কোনো টেকার হদিস নাই! কাম যাও করছি হেরা কইছে টেকা কয়দিন পরে দিবো। কি যে করুম মাথা, পাগল পাগল লাগে!
স্বামীর চিন্তিত কন্ঠ শুনে পারুলেরও মুখ ভার হয়ে আসলো। তবুও আশ্বাস দিলো,
“চিন্তা কইরেন না, আল্লাহ্ আছে। ব্যবস্থা হইয়া যাইবো ঠিক।”
সজীব উত্তর করে না। পারুল চুপচাপ বসে, হাত-পাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে থাকে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। ঘরটা আধো অন্ধকার, হারিকেনের হলদে আলোয় দু’জনের ছায়া দেয়ালে দুলছে। একটু পর সজীবের দৃষ্টি আটকে যায় পারুলের মুখে। গরমে মেয়েটার কপালে ছোট ছোট বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, তবুও ক্লান্তির রেশ তার চেহারায় বিন্দু পরিমানও নেই। হারিকেনের আলোয় তার মুখটা ঝিম ধরা হলুদ-সোনালী রঙে ঝলমল করছে। হাত পাখার বাতাসে চুলগুলো হালকা উড়ছে। পারুল খেয়াল করে সজীব তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,
“ওমন কইরা কি দেহেন?”
“আমার বউরে দেহি!”
সজীবের কথায় পারুল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করো ফেলতেই সজীব পুনরায় বলে,
“তুই অন্যরকম বউ! একদম সহজ সরল, কোনো প্যাচঁগোছ নাই তোর ভিতরে!”
সজীবের কথায় পারুল নিশ্চুপ। হাতপাখাও ততক্ষণে থেমে গেছে। সজীব আকুতিভরা কন্ঠে পারুলকে বলে,
“সবসময় আমারই থাকিস!”
“ওমা? আমি কই যামু? আমি তো আপনার কাছেই আছি!”
পারুলের কথাটা শেষ হতেই সজীব সজীব তার দিকে এক পা এগিয়ে আসে, পারুলের হাতটা নিজের হাতের ভেতর নিয়ে নিলো। সজীব ধীরে ধীরে তার কপাল থেকে গাল, গাল থেকে থুতনিতে নামিয়ে আনে তার ঠোঁটের স্পর্শ। সময় বাইরের ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ থেমে গিয়েছে। ঘরটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে! সজীব ঘোর লাগা দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকায়, শারীরিক টানটা আর শুধুই শরীরের থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে অনুভবে, চোখে, ঠোঁটে, আঙুলের নরম ছোঁয়ায়, আর শরীরের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে। স্বামীর ভালোবাসাময় স্পর্শে!
“শরীর খারাপ হইলে নাকি ঘরের বাত্তি জ্বলে! কি মাইয়া আনছে আমার পোলায়! আমি এর ব্যবস্থা করুমই!”
পারুল আর সজীবের রুমের বাইরে আলো জ্বলতে দেখেই রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন জমেলা বেগম। মেয়ে সহ খেতে বসেছে, রিয়া তখন গরমে অস্থির হয়ে পড়নের উড়না ছুঁড়ে ফেলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। জমেলা বেগম খাবার বাড়ছে আর অগ্নিদৃষ্টি মেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“খাইতে আইবি, না আইলে না খাইয়া থাক!”
রিয়া চৌকি ছেড়ে নামতে নামতে বলে,
“আইতাছি, এরম করো ক্যা?”
“আয়, আমি যাইতাম।”
“এই না একটু আগে বাইরে থেইকা আইলা? আবার কই যাইবা এই রাইতে!”
কথাটা শুনে জমেলা বেগম রেগে গেলেন আচমকা!
“আমি রাইতে বাইরে ঘুরতে যাই?”
রিয়া থতমত খেয়ে উত্তর দেয়,
“আমি তা কই নাই আম্মা!”
“যামু চুলার কাছে, চুলা গুঁতাইতে হইব, না হইলে তরকারি যা আছে নষ্ট হইয়া যাইব!”
রিয়া অবস্থা বুঝে চুপ করে খাবার খেতে লাগলো, জমেলা বেগম খাওয়া শেষ করে রাগে গিজগিজ করতে করতে থাকে।
“মহারানী শইল খারাপের বাহানা দিয়া জামাইর লগে ঘুমাইতে গেছে, আর অহন এই তরকারি সব আমারে জ্বাল দেওন লাগব! মন চায় সব ছাইড়া বনবাসে যাই আমি।”
“এইবার বুঝছি, ছুডো ভাইজান ক্যান এমন করে!”
রিয়া মা’য়ের দিকে তাকিয়ে মিনমিনেয়ে কথাটা বললো, যাতে জমেলা বেগম শুনতে না পায়! শুনলে শনির দশা তার কপালেই নাচবে, সে কথা ভালো করেই জানা।
#চলবে?