অর্ধাঙ্গ পর্ব-০৫

0
16

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-৫

আজান থেমে গেছে একটু আগে। সেই শব্দের শেষ ধ্বনি এখনো যেন ভেসে আছে বাতাসে। বাড়ির চারপাশ নীরব। শুধু এক-আধটু পাতার খসখস শব্দ, কখনো দূরের গরুর ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে! পারুল গোসল সেরে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মাথা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে শাড়ির আঁচলের কোণে, কপালে পানি লেগে চুলগুলো সেঁটে আছে, চোখে মুখে ভেজা ভাব, সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে বসে পড়ে উঠোনের মাটিতে রাখা পুরোনো পিঁড়িতে। পিঁড়ির পাশেই রোদ আসায় অপেক্ষায় ভেজা কাপড়গুলো বাতাসে দুলছে।

এই শান্ত পরিবেশের ভেতরেও পারুলের ভেতরটা কেমন অশান্ত হয়ে উঠছে! একটু পরই সবাই উঠে পড়বে, সে কি রান্না করবে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার তারা, দিন আনে দিন খায়। চিন্তিত মুখ করে বসে ছিলো, ঠিক তখুনি ঘর থেকে দেখতে পায় শরীফ আসছে। কল পাড়ে গিয়ে মুখ ধুয়ে শরীফ পারুলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। গোসল করার কারনে শরীফকে দেখে পারুলের কিছুটা লজ্জা লাগলেও শরীফ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলো,
“কি হইছে ভাবী?”
“কই কিছু না তো।”
“মন খারাপ কইরা, বইয়া আছো যে?”
“এমনেই!”
“দেহি হাতখানা সামনে আনো তো?”

শরীফের এহনো আবদারে অবাক হয় পারুল, হাত এগিয়ে দিতেই শরীফ পারুলের হাতে একশো টাকার কচকচে একটা নোট দিতেই পারুলের চোখ মুখে অবাকের ছাপ দেখা যায়!

“টেকা!”
“হ, আমার জীবনের প্রথম উর্পাজন আমি তোমারে দিলাম।”
পারুল পুনরায় অবাক দৃষ্টিতে শরীফের দিকে তাকায়,
“প্রথম উর্পাজন!”
“বাজি ধইরা ফুটবল খেলছিলাম, জিত্যা আইছি। হেইডার পুরস্কার!”
“তাইলে তো, এই টেকা তোমার কাছে বহুত মূল্যবান। আর এইডা তুমি আমারে দিয়া দিতাছো?”

পারুলের কথা শুনে শরীফ মৃদু হেঁসে বলে,
“এইডার মূল্য রাহনের লাইগ্যাই, আমি তোমারে দিছি। আমি চাই আমার প্রথম উর্পাজনের টেকা আমি তোমারে দিমু। তুমি যেডা মন চায় হেইডা করো তো!”

ঠিক তখুনি সেখানে আসে জমেলা বেগম। দূর থেকে ছোটো ছেলে আর বউমার কথোপকথন শুনে চিল্লাতে চিল্লাতে আসে!
“প্রথম উর্পাজন মা’রে না দিয়া, দিতাছোস বড় ভাইয়ের বউরে! আর কি কি দেখন লাগব!”

শরীফ কিছুটা বিরক্তিকর স্বরে বললো,
“তুমি টেকা নিয়া করবা কি? তোমার তো টেকার দরকার পড়ে না, তুমি কি সংসারের কোনো কাম করো? না কাইজ করো?”

“আমি আজাইরা খাই! নিজের পোলা হইয়া এতবড় খোঁটা দিলি আমারে!”

এবার বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে এলো শরীফের। মা’য়ের এই দিকগুলোই সে পছন্দ করে না। সেজন্যই মা’য়ের সাথে তার বেশিরভাগ সময়ই দ্বিমত হয়। সজীব মায়ের বাধ্য ছেলে হলেও, শরীফ পুরোপুরি মায়ের বাধ্যগত সন্তান কখনোই ছিলো না! উত্তরে শরীফ কিছু বলবে তার আগেই পারুল পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে উঠে,
“আমনের পোলার প্রথম ইনকাম তো আমি আমনেরেই দিতাম আম্মা! লন টেকাগুলা রাখেন।”

সবগুলো টাকা পারুল তার শাশুড়ীর হাতে দিতেই,জমেলা বেগম চোখ দু’টি বড়বড় করে বলেন,

“পরের মাইয়া কদর করে, নিজের পোলায় জ্বইল্যা মরে! বলি কি, রঙ্গ দেখে অঙ্গ জ্বলে!”

“মা’গো তোমার জ্বলুনিতে মলম দিব কোথা? তোমার তো সর্বাঙ্গেই ব্যাথা!”

জমেলা বেগমের উত্তরে শরীফ কথাটা বলতেই জমেলা বেগম এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন! ততক্ষণে শরীফ দৌড়ে ছুট লাগিয়েছে!

“আল্লাহ্ গো! এইডা কি পোলা দিছো আমার পেডের মইধ্যে!”

এরকম চিৎকারের ঘুম ভেঙে যায় সজীবের! তড়িঘড়ি করে বাইরে বের হয়ে আসলো।

“কি হইছে! কি হইছে! আম্মা এমনে কানতাছে ক্যান!”
“কই আমনের আম্মা কান্দে? হুদাই!”

পারুলের উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলো না সজীব। মায়ের কাছে গেলো, জিগ্যেস করলো কি হয়েছে।

“তোর ভাই, বাজি ধইরা টেকা পাইছে, হেই টেকা মা’রে না দিয়া, দিছে তোর বউরে! আমি হেই কথা জিগাইতেই আমারে কতডি কথা হুনাইছে বাপ।”

কাঁদো কাঁদো কন্ঠে ছেলেকে বললেন জমেলা বেগম। সজীব আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আহা আম্মা! শরীফ এহনো ছুডো মানুষ। এইডা নিয়া এমন করা লাগে নি!”

সজীবের কথায় জমেলা বেগম শান্ত হলেন না! উল্টে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন!

“আইচ্ছা, এই ধর তোর ভাইয়ের টেকা! তুইই রাখ!”

টাকাগুলো সজীবের হাতে দিয়েই হাঁটা ধরলেন জমেলা বেগম। সজীব ব্যস্ত হয়ে বউকে তাড়া দিয়ে বলে,
“পারুল, আম্মা কই যাইতাছে?”
“দেখেন গিয়া শিমুর মা’র ঘরে গিয়ে এখন গপ কইব!”
“আম্মাও না! বুড়া হইছে তো, হেই লাইগ্যা এহন এরম করে।”

শ্বাশুড়ির এ সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না পারুলের। কথা ঘুরিয়ে নিলো,

“আমনে আর ভাইবেন না তো, দেখছেন বিপদের সময় আল্লাহ কেমনে রক্ষা করে? যান টেকাগুলা নিয়ে বাজারে যান। আমি ভাত দিই চুলায়।”

পারুলের কথা মতন সজীব বাজারের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। পারুল শরীফকে দেবরের চোখে নয়, ছোটো ভাইয়ের মতনই দেখে! যেই ভাই না থাকার জন্য তার বাপ তাকে এতিম করে চলে গিয়েছে। ভাবতে ভাবতে কেমন মনটা খারাপ হযে আসলো। এসব না ভেবে আর দেরি না করে পারুল রান্নাঘরের দিকে পা দিতেই দেখে সব কেমন অগোছালো হয়ে আছে! বাসন কোসন ছেটানো, পাতা গুলো ছিটিয়ে পড়ে আছে! বুঝতে আর বাকি রইলো না, কালকে জমেলা বেগম চুলায় এসে ইচ্ছে করে এমন করে গেছে! এক বেলা পারুল রান্নাঘরে আসেনি তাতেই এই অবস্থা হয়ে গেছে!অগত্যা আগে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে লাগলো, ঠিক সেই সময় চিরচেনা কারো কন্ঠ কানে আসতেই মাথার ঘোমটাটা লম্বা করে টেনে দিলো,

“বউমা! কই আছো?”
“এইতো আব্বা, আমি।”

কামাল হোসেন কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো,

“ঘরে গিয়া দেখলাম, মাইয়াডা ঘুমাইতাছে, পোলা দুইডা ঘরে নাই। হেগো কতা বাদ দিলাম! তোমার হাউরি কই গেছে? হেয় ঘরে নাই ক্যান!”

শ্বশুড় মশাইয়ের কথায় কি জবাব দিবে পারুল বুঝে পায় না, তাও আমতা আমতা করে বললো,

“আম্মা আছে, আশেপাশেই!”

কামাল হোসেন ছাতাটা মাটিতে রেখে বড় করে শ্বাস নিয়ে বললেন,
“বুঝছি, জমেলা আবার পাড়া বেড়াইতে গেছে!”

পারুল কিছু বললো না সে প্রসঙ্গে,

“আব্বা, চা খাইবেন? আমনের পোলায় অহনো বাজার কইরা আনে নাই। আনলে ভাত দিমু।”
“নাহ্, আমি ঘরে যাই।”

কামাল হোসেন ঘরে চলে যায়। পারুল আবারো তার কাজে মনোযোগী হয়। তার শ্বশুর মশাইকে বুঝে উঠতে পারে না এখনো, সেজন্য প্রয়োজন ব্যতীত কখনো কথাও বলেনি! এইতো কামাল হোসেন গেছিলেন এক আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে, সেখান থেকে এতো ভোরে বাড়িতে কেন ফিরলেন, সে প্রশ্নটুকুও পারুল করলো না।

“বুঝলা নি শিমুর মা?পোলা বিয়া করাইলে বুইঝা শুইনা করাইও! পোলা যেন হাতের থেইকা ছাড়া না হয়!”

শিমুর মা মুখে পান দিয়ে ঠোঁট দু’টো লাল টুকটুকে করে বলতে লাগলেন,
“ক্যান? সজীবরে তো তুমি তোমার হাতেই রাখছো!”

জমেলা বেগম হা হুতাশ করে বলে,

“আমি হাতে রাখলে, তার বউ তারে আঁচলে বাইন্ধা রাখছে বুঝলা! কই আমার বইনের মাইয়াডারে পছন্দ কইরা রাখলাম, আমার বড় বউ বানাইতাম! বইনে আমারে কত কিই দিতো! বড় কথা বইনের মাইয়ায় আমার কথায় উঠতো আর বইতো, আর হের জায়গায় এই অনাথ মাইয়া একটা আইছে! আইছে তো আইছে একবারে ফকির হইয়া! না কুনো অনুষ্ঠানে পোলার শ্বশুরবাড়ি থেইক্যা কুনোকিছু চক্ষে দেহি আর না ওই ছেড়ি বংশের বাত্তিও জ্বালাইতে পারলো!”

বেশ রাগ ক্ষোভ দু’টোই মিলিয়ে কথাগুলো বললেন জমেলা বেগম। শিমুর মা শেফালী প্রতি উত্তর করলেন,
“বংশের বাত্তি না দেউক, মাইয়া জন্ম দিলেও কইতাম তোমার বউমা পোলাপাইন জন্ম দিবার পারে। ছেমড়ির তো তাও হয় না! নির্ঘাত তার কুনো বাচ্চাই হইব না!”

“আমিও তাই কই গো শিমুর মা! ওই মাইয়া হইছে বান্ধ্যা। আমার পোলারে কইলাম আরেকটা বিয়া করতে। পোলাও কানে নিলো না!”

“আহারে, কষ্ট পাইও না গো!”

স্বান্তনা বানীতে শান্তি পেলেন না জমেলা বেগম। উঠে যেতে নিচ্ছিলেন ঠিক তখুনি শেফালী তাকে ডেকে বসায়।
“আরে কই যাও? দুইডা পরামর্শ দেই! হুইন্যা যাও।”

জমেলা বেগম বসলেন। তারপর শেফালী শুরু করলো তার বক্তব্য দেওয়া! তা শুনে জমেলা বেগমের ঠোঁটের কোনে দেখা দিলো মুঁচকি হাসি। কি করতে হবে সেটা মাথায় গেঁথে নিলেন বেশ ভালো করেই।

চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে পারুল। এক হাতে কাঠের ছোট্ট একটা টুকরো দিয়ে পাতাগুলো চুলোর মুখে গুঁজে দিচ্ছিল, অন্য হাতে তরকারির পাতিল সামলাচ্ছিল। গরমে মুখটা ঘেমে উঠেছে, তবুও সময় নেই তার। আজকে তো আরো দেরি হয়ে গেছে! ঠিক তখনই পাকঘরের কোণা দিয়ে রিয়া এসে দাঁড়ায়।

“আইচ্ছা ভাবী? মাইয়া মাইনষে কোন কাম পারলে বেডা মানুষরা বেশি খুশি হয়?”

পারুল চুলার আগুনে মুখটা একটু ফিরিয়ে রিয়ার দিকে তাকায়। মুহূর্তখানেক চুপ থেকে মৃদু হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে দেয়।

“সবচেয়ে খুশি হয় যখন মাইয়া মাইনষে একটা শব্দ না কইরা সব সহ্য করে।”

পারুলের কন্ঠে অভিযোগ ছিলো না, ছিলো সংসারের অভিজ্ঞতা। যেন অনেক দিনের জমে থাকা কিছু কথা আগুনের ধোঁয়ার মতন উড়ে যাচ্ছে! রিয়া চেয়ে রইলো ভাবীর মুখের দিকে। তারপর বললো,

“ধুরো ভাবী, তুমিও না! আমি একটা কথা জানতে আইছিলাম, আর তুমি কিনা উল্টা-পাল্টা কথা কইলা!”
“আচ্ছা আচ্ছা, কও না এখন—আর কী কইবা?”
“আর কইমু না, ইচ্ছাই নাই আর! তুমি থাকো তোমার মতো!”

রিয়া চলে যায় সেখান থেকে। রিয়ার মতো সে-ও একসময় বুঝত না এত কিছু। তারও একসময় জীবন ছিল সহজ, সরল। কিন্তু বিয়ের পর? সংসারের ভার কাঁধে নিয়েই যেন এক অদৃশ্য পাঠশালায় ভর্তি হয়ে গেছে সে। আগের সেই দিন আর নেই। এখন সে সংসারী নারী। একজনের স্ত্রী। এই পরিচয়টাই যেন অদ্ভুতভাবে তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন অনেক কিছুই না বুঝেও বুঝে যায়।

#চলবে?