অর্ধাঙ্গ পর্ব-০৬

0
21

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-৬

“পাড়া বেড়াইতে কই গেছিলা হুনি?”

বাড়ির উঠোনে পা দেওয়া মাত্রই স্বামীর গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শুনে জমেলা বেগম থমকে দাঁড়ায়! ভ্রু যুগল কুঁচকে উত্তর দেয়,

“তুমি কুন সময়ে আইলা?”
“ক্যান? আমি আইছি দেইখ্যা কি, অসুবিধা হইয়া গেছে নি তোমার?”

জমেলা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“ধুরো! কি যে কও না তুমি!”
“কি কইতাম তাইলে?”

জমেলা বেগম চুপ হয়ে এবার স্বামীর মুখশ্রীতে বেশ গভীরভাবে নজর দিলেন! কেমন যেন ঠেকছে তার কথা!

“কিছু হইছে নি?”
“কি হইব আর!”
“তাইলে?”
“তুমি হইছো বাড়ির কর্তী! সকাল হইতে না হইতেই যদি পাড়া বেড়াও, আমার সংসারের কি হইব?”

কামাল হোসেনের কথাটা শুনে রাগ হয় জমেলা বেগমের! ভাবতে থাকে এই নিশ্চয়ই পারুলের কাজ! শ্বশুড়ের কান ভাঙানো। পারুল ছাড়া আর কে করবে এসব! নিজের সন্তানরা তো আর করবে না!

“এইডি কে কইছে?”
“ক্যান? আমি কি চিনি না তোমারে?”
“ম্যালা চিনেন! হেই লাইগ্যাই এত বড় অপবাদ দিলেন, আমি পাড়া বেড়াই, আমি কূটনামী করি, মাইনষের ঘরে যাইয়া!”
“যেইডা সত্যি হেইডা কইতে আমার কুনো সমস্যা নাই! আমি সত্যি কথাই কইছি, কূটনামীর কিছু কইনাই তোমারে!”

ততক্ষণে উঠোনে এসে সজীব এবং শরীফ এসে দাঁড়িয়েছে ভেতর থেকে। পারুল উঠোনের এক দিকে, কল পাড়ে বসে আধোয়া কিছু বাসন পরিষ্কার করছে! রান্না শেষ, সবাইকে খেতে দিবে একটু পর। স্বামীর কথায় জমেলা বেগম দমলেন না, বরং গলার তেজ বাড়ালেন!
“তোমারআন্দাজি কতা, তোমার কাছেই রাহো!”
“বয়স হয়েছে, অহন অন্তত ঠিক হও! চিরকালই তো মাইনষের ঘরে যাইয়া গপ মারছো, অন্যের বিষয়ে নাক গলাইয়া!”

ছেলে বউমার সামনে স্বামীর এরূপ মন্তব্য অপমানের ন্যায় বাঁধলো জমেলা বেগমের কাছে! উত্তর তো দিতেই হবে! না হলে তার মুখ ছোটো হয়ে যাবে না? এ কি করে হতে দেন তিনি!

“আমি বেঠিক কি আছি, সজীবের বাপ?”

বউয়ের এরকম কথায় কামাল হোসেনের চোখেমুখে বিরক্তির ভাঁজ পড়লো,

“এই যে বুড়া বয়সে টইটই কইরা ঘুরো, এইডি কি? আর মাইনষেরে কাছে যাইয়া যে তুমি ঘরের কথা কও, আবার তার ঘরের কথা হুনো, কি হয় না হয় সব লইয়ক গোল মিটিং করো! হেইডাও আমি ভালা কইরাই জানি!”
“কেমনে জানো তুমি?”
“এমনেই জানি!”

জমেলা বেগম এবার চোখ বড়বড় করে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার পুত্রবধূর দিকে! অতঃপর পারুলের কাছে গিয়ে পারুলের ডান হাতটা জোরে চেপে ধরে কামাল হোসেনকে শুধায়,

“এই কালনাগিনী কইছে তোমারে না?”

জমেলা বেগমের কন্ঠে রাগ ক্ষোভ দু’টোই মিশানো, পারুল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে! শ্বশুর শাশুড়ীর কথোকপথের মাঝখানে না এসেও সে দোষী সাবস্ত!

“আম্মা, আমি কি কইছি আব্বারে? কি কইতাছেন এইডি!”
“আম্মা আমনে পারুলেরে ক্যান দোষ দিতাছেন? ও তো কিছু করে নাই!”

সজীবের কথায় জমেলা বেগম ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

“তোর বউ ছাড়া তোর বাপরে এসব কে কইব?”
“আমি কিছু কই নাই আম্মা!”
“তুই কইছস না কইছস, আমি সবই জানি! হারামজাদি! উইড়া আইয়া, জুইড়া বইছে আমার পোলার ঘাড়ে। আবার আমার সোয়ামীর কাছে আমার নামেই কান ভাঙাস তুই!”

কামাল হোসেন এগিয়ে গেলেন। তারপর ঠাস করে দু’টো চড় মেরে দিলেন স্ত্রী’র গালে! জমেলা বেগম তৎক্ষনাৎ পারুলের হাত ছেড়ে দিয়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে রইল! বিশ্বাস করতে পারছে না, এই বয়সে এসে ছেলেমেয়েদের সামনে তাকে চড় খেতে হয়েছে! অপমানে আর লজ্জায় চোখে পানি তখন টলটল করছে। অশ্রু ভর্তি চোখ নিয়ে স্বামীকে শুধালেন,

“তুমি আমারে মারলা!”

কামাল হোসেন সেই কঠোরতা বজায় রেখেই উত্তর দিলেন,
“শাষণ করা জরুরী!”

জমেলা বেগম এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে,পুনরায় তেতে উঠলেন! এবার বড় ছেলের কাছে গিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলতে লাগলো,

“তোর ওই অপয়া, বন্ধ্যা, বউর লাইগ্যা তোর বাপে আমারে মারছে! দেখলি!”
“আম্মা? অপয়া! এসব কি কইতাছেন? এইডি কওয়া কি ঠিক?”

বড় ছেলের এহেনো জবাবে যেন জমেলা বেগম কোনঠাসা হয়ে গেলেন! বুঝে গেলেন তার পক্ষে কথা বলার মতন কেউ নেই! আর সইলেন না তিনি! ঘরে গেলেন দ্রুত পায়ে। উঠোনে সবাই আগের মতনই দাঁড়িয়ে আছে। দু’টো কাপড় হাতের মধ্যে ভাঁজ করে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন জমেলা বেগম। স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“আমি যহন এতই মন্দ, তাইলে ঠিকাছে! আমনে আমনের পোলার বউ লইয়্যা থাহেন! আর বাজান! তুইও তোর বউ লইয়াই থাক! আমি গেলাম, যেদিকে দু চোখ যায়!”

ঘটনা এত দ্রুত ঘটায় সজিব কি বলবে বুঝতে পারছে না! মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্ন!

“আম্মা কই যাইতাছেন?”

ততক্ষণে জমেলা বেগম উঠেন ছেড়ে রাস্তায় পা দিয়ে ফেলেছে!
“ভাইজান, আমি আম্মার কাছে যাইতাছি।”

শরীফ জমেলা বেগমের পিছু পিছু যাওয়ার কারনে সজীব আর গেলো না, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো! কামাল হোসেন পারুলকে আদেশের সুরে বললো,

“বউমা? ভাত হইছে?”

পুরো ঘটনা যেনো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো পারুল। শ্বশুড় মশাইয়ের ডাক কান অব্দি গিয়ে পৌঁছালো না। কামাল হোসেন এবার একটু জোর গলায় বলে,
“পারুল!”

এবার পারুল নড়ে উঠে, ঘোমটাটা টেনে দেয় একটু। আমতা আমতা করে বলে,

“কন, আব্বা।”
“ভাত হইছে? না-কি অহনো চুলায়?”
“হইছে আব্বা।”
“তাইলে ভাত বারো, ক্ষিদা লাগছে! ঘুম দিমু খাইয়া।”

পারুল অবাক হয়ে তাকালো শ্বশুর দিকে। উনার যে স্ত্রী রাগ করে চলে গেলো তার কোনো ইয়াত্তাই নাই! উল্টে ভাত খাবে বলছেন!, পারুলের ইচ্ছে করছে প্রশ্নটা জিগ্যেস করেই ফেলতে, কিন্তু ভদ্রতার সহিত চুপ রইলো। সজীব যেতে যেতে তার বাবাকে শুধোয়,

“আব্বা! আম্মা কই জানি গেলো গা, তুমি হেরে না খুঁইজ্যা ভাত খাইয়া ঘুম দিবা!”

“তোর আম্মার দৌড় কতদূর আমার জানা আছে। ঠিকই চইল্যা আইব।”

সজীব মুখটা কিছুটা বিষন্ন করে বলে,
“আমনে আম্মারে না মারলেও, পারতেন আব্বা!”
“চুপ! জমেলা তোর আম্মা তার আগে হেয় আমার বউ! তোর আম্মারে কখন কি করলে, হেয় লাইনে আইব, হেইডা আমি ভালা কইরাই জানি!”

বলেই কামাল হোসেন চলে গেলেন, পারুলও ভাত বেড়ে সজীবকে ডাকতেই সজীব নাছোড়বান্দার মতন উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছে!

“কি হইলো ভাত খাইবেন না?”
“পরে খামু, তোর লগে।”
“আব্বা রাগ করবো, উনার লগেই বইয়া দুইডা খাইয়া লন তো!”

আম্মা চলে গেছে, আব্বাও এতোদিন পর ফিরেছে, কোনোরূপ অশান্তি চায় না দেখে সজীব খেতে বসে পড়লো। গরম গরম ধোঁয়া উঠা ভাত আর আলু ভর্তা সাথে কলমি শাক ভাজি আর পাতলা মসুর ডাল। সাথে লেবুর টুকরো। আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে কালাম সাহেব পারুলকে বললো,

“ভর্তা দিয়াই তো এক পেলেট ভাত শ্যাষ হইয়া যাইব, মনে হইতাছে। মজা হইছে বউমা।”

বিনিময়ে পারুল মুঁচকি হাসি দিলো। কালাম হোসেনের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সজীবের উপর!

“কি’রে, ভাত খাছ না ক্যান?”
“বেশি গরম তো আব্বা!”
ভাত পাতে নিয়া বইয়া থাকতে নাই, তাড়াতাড়ি খাইয়া নে।”

সজীবের ইচ্ছে না থাকা সত্বেও জোর করে দু লোকমা ভাত খেতেই তখন শরীফের দেখা মিলতেই, খাওয়া ছেড়ে শরীফকে জিগ্যেস করে,

“কিরে ভাই! আম্মা কই?”

শরীফ হাঁপাচ্ছিলো তাই দেখে পারুল এক গ্লাস ঠান্ডা পানি শরীফের দিকে ধরতেই শরীফ এক দমে পুরো পানি খেয়ে নেয়!

“আম্মারে ডাকলাম, হেয় তো আমার কথা শুনলোই না! উল্টা বকাবকি করতে আছিলো, মানে আম্মার আজগুবি কথা কতডি!”
“তারপরে?”
“তারপর আর কি! আমি আম্মার পিছু নিলাম, দেখতে চাইছি কই যায়। পরে দেখি আম্মা খালার বাড়ির দিকে যাওয়া ধরছে!”

সজীব কৌতুহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে শরীফকে পাল্টা প্রশ্ন করে,

“তুই কেমনে বুঝলি আম্মা খালার বাড়িতে গেছে?”
“ভাইজান! কি বোকা প্রশ্ন করো! নৌকা দিয়া তো খালাগো বাড়িতই যাই আমরা!”

কামাল হোসেন খাওয়া বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে সজীবকে বলে,

“বইনের বাড়িত গেছে, ভালা হইছে! কয়দিন বেড়াইয়া আসুক।”
“কিন্তু আব্বা, আম্মা তো রাগ কইরা গেলোগা!”

সজীবের প্রশ্নে পারুল উত্তর দিয়ে বলে,

“আম্মার মন মেজাজ ভালা হইয়া যাইব, কয়দিন পর না হয় আমনে গিয়ে নিয়া আইলেন!”

পারুলের কথায় সজীবের মুখে হাসি ফুটে,
“হ, ঠিকই কইছস, এমনে ভাবি নাই। আম্মা থাক ওইখানে কয়দিন।”
“ভাবী! আমারে কি ভাত দিবা না?”

শরীফের কথায় পারুল শরীফের জন্য ভাত বারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাবা আর ছেলেকে খাওয়ানোর পর সব গুছিয়ে, নিজে খেতে বসে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে যায় একটু বিশ্রাম নিতে। তারপর উঠোন ঝাড়ু দিয়ে বাড়ির পিছনে কতগুলো পাতা জমেছে সেগুলো কুড়িয়ে আনতে হবে।

#চলবে?