অর্ধাঙ্গ পর্ব-০৭

0
20

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-৭

বাড়ির পেছনে, মাথা নিচু করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো আমগাছটা। তার ছায়াতলে ছড়িয়ে আছে অগণিত শুকনো পাতা হলুদ, বাদামি, কোথাও বা হালকা লালচে রঙে দাগ কাটা। হালকা হাওয়ায পাতাগুলো খসখস শব্দ তুলে এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। পারুল ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে পাতাগুলো কুড়োচ্ছে, আস্তে, খুব যত্ন করে, যাতে পাতাগুলো এদিক ওদিক উড়ে গিয়ে না ছিটায়। মাটির সোঁদা গন্ধে মিশে আছে, শুকনো পাতার গন্ধ। পারুলের আঙুলে লেগে আছে পাতার খসখসে দাগ। একেকটা পাতা হাতে নিতে নিতে তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা কিছুদিন, কিছু মুহূর্ত, যেগুলো আর কখনও ফিরে আসবে না।
প্রতিটি পাতা তাকে মনে করিয়ে দেয় কিছু না বলা কথা, কিছু মুখ, কিছু হারিয়ে যাওয়া দুপুরবেলা, যা এখন কেবল স্মৃতির পাঁকে চাপা পড়ে থাকা একেকটি স্তর। পারুল ভাবে, জীবনের মতোই এই পাতাগুলো, শুরুর সবুজ রঙ হারিয়ে, সময়ের পালায় রঙহীন বেরঙিন হয়ে, অবশেষে একদিন ঝরে পড়ে নিঃশব্দে। পাতা কুড়ানো শেষ হতেই পাতাগুলো একটা খাঁচিতে ভরে উঠোনে নিয়ে ফেলে দিলো, যাতে ভালো করে রোদে শুকায়, তবে আগুন ধরবে ভালো।

এবার দিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত পায়ে পারুল নিজের রুমে ঢোকে। দরজা ঠেলেই চোখে পড়ে সজীব চৌকিতে শুয়ে আছে, এক হাতে মাথা চেপে ধরে রেখেছে, চোখদুটো বন্ধ, মুখভঙ্গি চিন্তায় ভরা। এমন অবস্থায় সজীবকে দেখে পারুলের বুক ধক করে উঠে। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সজীবের কপালে হাত রাখে, তার স্পর্শ পেতেই সজীব ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়, যেন কোনো গভীর ভাবনার জগত থেকে ফিরেছে সদ্য।

“কি’রে, কি হইছে?”
“এমনে শুইয়া রইছেন, হেই লাইগ্যা ভাবলাম অসুখ হইছে নি কুনো!”

পারুলের প্রশ্নে সজীব মুখটা মলিন করে উত্তর দেয়,

“পুরুষ মানুষ ঘরে আজাইরা বইয়া থাকলে যা হয়।”

পারুল বুঝ করতে পারলো না, সজীবের কথা। ভ্রুযুগল কুঁচকে পুনরায় শুধোয়,

“কি হইছে, আমনের?”
“সামনে কেমনে কি হইব! কিছুই বুঝতাছি না। এইতো একটু পরই বিকাল হইয়া যাইব, তুই আবার রানতে যাবি। কিন্তু কি রানবি? ঘরে তো কিচ্ছু নাই!”
“শরীফের টেকা শ্যাষ?”
“চাল আনছি বেশি কইরা, যা বাঁচছিলো ডাইল আনলাম। শ্যাষ হইয়া গেছে রে!”

সজীবের কন্ঠে হতাশার সুর। পারুলেরও মনটা কেমন খারাপ হয়ে আসে। তাও স্বামী যাতে ভেঙে না পড়ে সেজন্য আশ্বাস দেয়,

“চিন্তা কইরেন না! রিজিকের মালিক আল্লাহ। ব্যবস্থা ঠিক হইয়া যাইব।”

সজীব কিছু বলতে যাচ্ছিলো পারুলকে, ঠিক তখনি কানে ভেসে শরীফের ডাক,

“ভাবী! ও ভাবী! কই গেছো!”
“শরীফে ডাকতাছে ক্যান, গিয়া দেইখ্যা আইও।”

,পারুল মাথার ঘোমটাটা ঠিক করে তাড়াতাড়ি উঠোনে গিয়ে দেখে শরীফ গায়ে কাঁদা মেখে, হাতে একটা পুরনোপাতিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সারা শরীর কাদায় সয়লাব, মুখেও ক্লান্তি স্পষ্ট।

“তোমার এই অবস্থা ক্যান! এমন কী হইছে?”

শরীফের শরীর থেকে গরমে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সে এক হাত দিয়ে মুখটা চুলের গোড়া পর্যন্ত মুছে নিয়ে ধীরে বলে,

“দেহো, কি আনছি তোমার লাইগ্যা!”
“কি?”

সজীব পাতিলটা পারুলের এগিয়ে দিতেই পারুল দেখে পাতিলে বেশ কয়েকটা পুঁটি মাছ! পারুল কিছুটা অবাক হয়েই বলে,

“মাছ কইত্তে আনলা?”
“শিমুর ভাইয়ের লগে গেছিলাম মাছ ধরতে! লগে দুই চাইরডা কই মাছও আছে। যে কয়ডা পাইছি নিয়া আইছি। হইব না ভাবী?”

পারুলের ঠোঁটে তখন মৃদু হাসি। উত্তর করে,

“হইব তো!”
“তাইলে কড়া কইরা পুঁটি মাছ ভাজি কইরো, আর এই কয়ডা টমেটো সহ কিছু সব্জি আছে, ক্ষেত থেইক্যা আনছি।”
“আইচ্ছা দেও।”

পারুল আর কথানা বাড়িয়ে মাছগুলো নিয়ে উঠোনের এক পাশে, যেখানে গাছের ছায়া আছে। ওই দিকটায় গিয়ে বসলো। তারপর মাছগুলো কুটতে বসলো মনোযোগ দিয়ে! মাছ কুটার সময় কয়টা বিড়াল এসে বেশ বিরক্ত করতে লাগে পারুলকে! পারুল একটা লাঠি নিয়ে ওদের তাড়াতে তাড়াতে বলে,

“হেইদিন আমার মুরগী রে দৌড়ানি দিয়া, অহন আবার আইছস মাছ খাইতে! খারা আইজকা তোগো একদিন কি আমার যতদিন লাগে!”

বিড়ালগুলো দৌড়ে পালিয়ে যেতেই পারুল একটু এগিয়ে বাড়ির পেছন দিক থেকে মুরগীগুলোকে ডেকে আনলো। ছোটো ছোটো ছানা ফুটেছে, মাছের উদ্দেশ্য বিড়াল ঘুরঘুর করছে, কখন ছানাগুলোর উপর হামলা করা বলা যায় না! সেজন্য মুরগিগুলোকে তাড়িয়ে উঠোনে এনে ছেড়ে দিয়ে, পারুল আবার মনোযোগ দিয়ে বসে পড়ে মাছ কুটতে। এই সময়েই দূর মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের সুর কানে আসতেই পারুল যেন হঠাৎ চমকে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি হাতের কাজের গতি বাড়িয়ে দেয় চোখে-মুখে তখন ব্যস্ততা

এদিকে, আজানের আওয়াজে কামাল হোসেনের ঘুম ভাঙে। হাই তুলতে তুলতে সোজা সজীবের রুমে যায়।
রুমে ঢুকে দেখে সজীব চুপচাপ বসে আছে, এক হাতে সুই-সুতো ধরা, আর অন্য হাতে নিজের পছন্দের শার্টের বোতাম লাগানোর চেষ্টা করছে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক মনোযোগ, যেন এই ছোট্ট কাজে সে নিজেকে জয় করতে চাইছে।

“তুই বোতাম লাগাইতে পারছ?”
“পারি তো আব্বা।”
“তোর বউ কই?”
“পারুল তো কাম করে।”
“আইচ্ছা এইডি রাখ অহন, আজান দিছে নামাজ পড়বি না?”
“হ আব্বা।”
“আইচ্ছা একলগে যামুনে তাইলে।”

ছেলেকে নির্দেশ দিয়ে কামাল হোসেন গোসলে যায়। দ্রুত পুকুর থেকে কোনোমতে ডুব দিয়ে নতুন পাঞ্জাবী পড়ে রেডি হয়ে যায়। তারপর পুনরায় ছেলের রুমে আসতেই দেখে সজীবও রেডি হয়ে গেছে।

“কি’রে পোলা ছুটোডায় কই?”
“অয় তো মনে হয় না, বাড়িতে আছে!”

কামাল হোসেন আক্ষেপের সুরে বললেন,
“পোলাডার বয়স কি কম হইছে? অহনো কাম কাইজে মন দেয় না!”
“আমি আছি না আব্বা? আর চিন্তা কিয়ের!”

উত্তরে তিনি আর কিছু বললেন না, শুধু চোখে ভেসে রইল একরাশ চিন্তার ছায়া। এদিকে পারুলও ততক্ষণে নামাজ পড়ে নিয়েছে। জানে, একটু পরেই সজীবরা নামাজ সেরে ফিরে আসবে, তাই সে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ভাতের হাঁড়িটা নামিয়ে রাখে। শুধু পাতে তুলে দেওয়ার বাকি।

দুপুরবেলা এখন, রোদের তেজ যেন ছাঁকা আগুন। ঘরে-বাইরে একইরকম গরম। তার ওপর পারুলের ঘন, লম্বা চুলগুলো যেন গরমটাকে দ্বিগুণ করে তুলেছে। ঘাড়জুড়ে চুলের ঘামজল লেপ্টে আছে। বিরক্ত হয়ে সে নিজের ঘরে যায় ভালো করে আঁচড়ে চুল বাঁধবে বলে। চুলগুলো জড়িয়ে খোঁপা করে যখন ঠিকঠাক হয়ে উঠল, তখনই সে পেছনে ঘুরে তাকায়। আর সেদিকেই দাঁড়িয়ে আছে সজীব। নিঃশব্দ, চুপচাপে “এতো তাড়াতাড়ি আইয়া পড়ছেন?”
“ক্যান? দেরিতে আইলে খুশি হইতি?”
“আরে কি যে কন!”

সজীব তার হাতটা সামনে এনে পারুলকে বললো,
“বউ, ধর মিষ্টি খা!”

পারুল ভ্রু কুঁচকে সজীবের হাতে ধরা জিলাপির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আইজকা কি উপলক্ষে মিষ্টি দিছে মসজিদে?”
“ভুইল্যা গেলি নি? আইজ তো শুক্কুরবার!”
“দেখছেন, মনে আছিলো না!”

সজীব পারুলকে তাড়া দিয়ে বলে,
“অহন খা তো।”
আবারও নিঃশব্দে মিষ্টিটা পারুলের দিকে এগিয়ে দেয় সজীব।
“আপনে নিজে না খাইয়া আমারে দিতাছেন ক্যান?”

সজীব ভারী কণ্ঠে শুধায়, “তুই খাবি?”

পারুল শান্ত গলায় মাথা নেড়ে জানায়, “না।”

“ভালো, খাইস না। যা।”

এইটুকু উচ্চারণ করেই আচমকা সজীব হাত বাড়িয়ে জিলাপিটা জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়! সেই মুহূর্তটা যেন স্তব্ধ হয়ে যায় সময়ের রাশিতে। এহেন হঠাৎ ও অপ্রত্যাশিত আচরণে বিস্ময়ে স্থবির হয়ে যায় পারুল। চোখ বড় বড় করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে জিজ্ঞেস করে,

“ফালাইয়া দিলেন মিষ্টিডা?”

সজীবের মুখাবয়বে ততক্ষণে জমে উঠেছে কঠোরতা, চোখে ঝিলিক দেয় চাপা ক্ষোভের ছায়া। কণ্ঠস্বরে এক ধরনের গাম্ভীর্য।

“তুই যেহেতু খাইতি না, ফালাইয়া দিছি।”

পারুল থমকে যায়। উত্তর দেবার মতো উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পায় না, সুন্দর মুহূর্তটুকু ভারী হয়ে পড়ে। তার শান্ত স্বভাবের স্বামী এতো সামান্য বিষয়েই হুট করে এতো রেগে গেলো! সজীব তো কখনো এরকম করে না, বিষয়টা কেমন জানি ঠেকলো। ঠিক তখনই বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে শ্বশুর মশাইয়ের গলা ডাকছেন তাকে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে পারুল নিঃশব্দে ফিরে যায়।

#চলবে?