#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১০
“এই ছেমড়ি! এইডি কি পিন্দা আইছস তুই! এরম পুরান কাঁপড়? ক্যান? একটু সাজগোজ কইরা আইতে পারলি না? এইডিও শিখাইয়া দেওন লাগব?”
ঝাঁঝালো কণ্ঠে টুম্পার হাত ধরে কথাগুলো বললেন জমেলা বেগম। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাহেলা বেগম। টুম্পা আমতা আমতা করে খালার উদ্দেশ্য বলে,
“তুমি না কইলা সজীব ভাই আইছে তাড়াতাড়ি যাইতাম, হেই লাইগ্যাই তো গেলাম! এহন আবার বকতাছো কিল্লিগা খালা?”
“সজীবের সামনে একটু সাজগোজ কইরা যাবি না? এটুকুও বুঝস না ছেমড়ি?”
টুম্পা জমেলা বেগমের কথায় উত্তর দেবার আগেই তার মা বলে উঠলো,
“তুই গাধা, গাধাই রইয়া যাবি আজীবন!”
টুম্পার কান্না পেয়ে গেলো বকাবকি শুনে। দৌড়ে সেখান থেকে চলে যেতেই জমেলা বেগম তার বোনকে বলে,
“দেখছোনি আপা! তোমার মাইয়ার কারবার? গাধা মাইয়া একটা!”
“এইডা গাধাই রইয়া গেলো! এই গাধারে মানুষ কইরা তোরেই নেওন লাগব।”
“তুমি চিন্তা কইরো না। আমি আইছি না! গাধারে পিডাইয়া মানুষ কইরা নিমুনে।”
দুই বোনের কথোপকথনের মাঝখানে এসে উপস্থিত হলো সজীব। আচমকা সজীবকে দেখে দুই বোনেরই চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাঁপ!
“কি’রে বাপ তুই এনে কি করছ?”
“আম্মা আমনেরে একখান কথা কইতে আইছিলাম।”
“কি কইবি?”
“আম্মা আমনের কাপড়চোপড় গুছাইয়া রাইখেন, আমরা কাইলকাই রওনা হমু, সকাল সকাল।”
সজীবের কথা কানে যেতেই দুই বোন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো! রাহেলা বেগম কন্ঠস্বর নরম করে সজীবের কাছে গিয়ে বলে,
“বাপ? তুই যাইবিগা? আইতে না আইতেই যাওনের নাম!”
“হ খালা, বাড়িত আব্বা আর রিয়া, শরীফ একলা আছে। কি করব কে জানে।”
“কি করব কি? রিয়া আছে না? রাইন্ধা খাওয়াইতে পারব তার বাপ আরে ভাইয়েরে!”
“খালা তাও আমরা যামুগা।”
রাহেলা বেগম এবার কথার ধরন বদলালেন।
“তোর বউ নিয়া আইছস প্রথমবার! কয়ডা দিন থাইক্যা হেরপর যাবি, এইডাই আমার শ্যাষ কতা।”
“কিন্তু খালা!”
“কোনো কিন্তু না সজীব, তোরা যদি কাইলকা আমার বাড়ি থেইকা আমার বইনেরে লইয়া যাছ, তাইলে আমিও আর কুনোদিন তোগো বাইত পা রাখুম না!”
রাহেলা বেগমের এহেন কথায় সজীবের আর কিছু বলার অবকাশ রইল না। পাশ থেকে মুখ টিপে হাসলেন জমেলা বেগম। তার বোন একবারে কাজের কাজ করছে একটা!
“আইচ্ছা খালা ঠিকআছে, আমি আমনের কথা হুনমু। তয় বেশিদিন না, আমরা তিনদিন এর বেশি থাকতে পারমু না।”
“আইচ্ছা ঠিকআছে! যা তোর কথাই মাইন্যা নিলাম। এবার খুশি হইছস?”
সজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,
“হ খালা।”
“তয়লে যা, বউরে লইয়া বয়, ভাত খাইতে।”
“আইচ্ছা।”
সজীব চলে যেতেই দুই বোনে বসে আরামে পান গুঁজে দেয় গালে। গল্প করতে থাকে, ঠিক তখুনি সেখানে এসে উপস্থিত হয় টুম্পা। পড়নে আকাশী রঙের একটা নতুন কাপড়। মেয়কে দেখেই মা বললেন,
“কি’রে কই গেছিলি?”
“দেহো না,পিন্দনে নতুন কাপড়! গেছিলাম কাপড় পিনতে। এবার কও আমারে সুন্দর লাগে নি?”
জমেলা বেগম টুম্পার দিকে তাকাতেই দেখে টুম্পা ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে, চুলগুলো সুন্দর করে বিননি করে সামনে এনেছে, আগের কাপড়টা বদলে নতুন কাপড় পড়েছে। টুম্পার ফর্সা গায়ে রঙটা বেশ ভালোই ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে টুম্পাকে সুন্দরই লাগছে,
“এইবার ঠিক আছে!”
“টুম্পা, যা গিয়া ভাত বার।”
“অহন ভাত বারতাম ক্যান মা? ভাইজান কি কামে থেইক্যা আইয়া পড়ছে?”
রাহেলা বেগম মুখ থেকে পানের পিক ফেলে তারপর উত্তর দিলো,
“সজীবেরে তুই ভাত দিবি। ভালা মতন।”
টুম্পা খুশি হয়ে মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
“আমরা এনতে কবে যামু?”
মলিন দৃষ্টিতে স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে শুধালো পারুল। সজীব উত্তর দিলো,“ক্যান? তোর এনে ভাল্লাগতাছে না?”
“না তেমন কিছু না, ওনে আব্বা, রিয়া কেমনে কি করব?”
সজীব নিশ্চিত মনে উত্তর দিলো,
“আরে চিন্তা করিছ না তো, হেনে রিয়া আছে না? আমার আম্মা রিয়ারে সব কাম শিখাইয়াই রাখছে।”
পারুল পুনরায় প্রশ্ন করে,
“তাইলে আমরা কাইলকা যামু?”
“না, আমরা আরো তিনদিন পর যামু।”
সজীবের উত্তর শুনে পারুলের মুখটা তৎক্ষনাৎ কালো আঁধারে ছেয়ে যায়! তিনদিন! প্রথমবার এসেই যেরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে পারুল পারে না এখনই পালিয়ে যায়! তারউপর তাকে আরো তিনদিন থাকতে হবে”
“আমনে তো, কইছেন কাইলকাই যামুগা তাইলে?”
“খালা জোরাজোরি করলো, তাছাড়া তোরে নিয়ে কুনোখানো বেড়ানো অয় না, কয়ডা দিন থাক।”
বিনিময়ে আর কিছু বললো না পারুল। অপেক্ষার প্রহর এখন থেকেই শুরু হলো তার! এখান থেকে বের হতে পারলেই শান্তি। ঠিক তখুনি টুম্পা প্রবেশ করে।
“সজীব ভাই? বউর লগেই খালি গল্প করলে পেট ভরব নি? খাওন লাগব না?”
হাতে খাবারে প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বললো টুম্পা।
“আরে না, আয় তুই।”
টুম্পা এসে একে একে সব খাবার সামনে রাখলো। খাবার বারতে বারতে পারুলের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,
“ভাবী? খাটেই বইয়া থাকবেন? আইতেন না?”
পারুল কিছু না বলে, চুপচাপ নিচে গিয়ে বসলো খাবারের সামনে। টুম্পা পারুলের প্লেটে ভাত আর সব্জি দিয়ে সজীবের প্লেট সাজাতে লাগলো,
“আরে আরে করতাছস কি? আগে সব্জি দিয়া ভাত খাইয়্যা লই।”
“সব খাও, সব তো তোমার লাইগ্যাই রানছি না-কি।”
“তুইও খাইতে বইয়া পর।”
“তুমি খাও, আমি পরে খামুনি।”
সজীব খেতে খেতে টুম্পাকে বলে,
“তোর পিন্দনের শাড়িডার রঙ তো বেশ সুন্দর।”
সজীবের কথা শুনে টুম্পা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
“আব্বায় মেলা থেইক্যা আইন্যা দিছে।”
“খালুর পছন্দ সুন্দর আছে।”
সজীব নিজ মতন খাওয়ায় মনোযোগী হলো। এদিকে সজীবের প্রসংশা শুনে টুম্পা খুশিতে গদগদ অবস্থা।
“মুরগীর রানডা তো পইড়াই রইছে পাতে নেও।”
বলেই টুম্পা মুরগীর টুকরোটা সজীবের পাতে দিতে যাচ্ছিলো ঠিক তখুনি সজীব টুম্পাকে বলে,
“তুই তো সব আমারেই দিতাছস, আমার বউডার দিকেও নজর দে। মুরগীর রানডা আমার বউইই খাক!”
পারুলের পাতে মাংস পড়তেই পারুল বলে,
“কি করলেন? আমারে দিয়া দিলেন ক্যান?”
সজীদ মৃদু হেঁসে উত্তর করে,
“সবসময়ই গোশতের বড় টুকরা আমারে দেছ নিজে না খাইয়া, আইজকা না হয় তুইই খা। ক্ষতি কি?”
এরকম কথা শুনে পারুল আর কিছু বলতে পারলো না, শুধু ঠোঁটে লেগে রইলো খুশির উপচে পড়া হাসি। টুম্পা সেখান থেকে চলে যায়। সজীব নিজের মতন খাচ্ছিলো আর মাঝেমধ্যে পারুলের পাতে এটা ওটা নিয়ে দিচ্ছিলো। আর কেউ না জানুক সজীব তো জানে, মেয়েটা বউ হয়ে আসার পর থেকে সবার কথা ভাবতে ভাবতে নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবেইনি। সবসময় তার পাতে বড় মাছ, মাংস তুলে দিয়েছে নিজে না খেয়ে! মাঝেমধ্যে বউটার প্রতি বড্ড মায়া লাগে সজীবের, মনে হয় পারুলের জন্য সে কিছুই করতে পারেনি!
আসরের আজান পড়েছে। ঝাড়ু হাতে উঠোনে বেরিয়ে পড়েছে রিয়া। ভাবী নেই বিধায় তাকেই একা হাতে সব কাজ করতে হচ্ছে। তখনই কোথা থেকে শরীফ আসে হাতে থলে নিয়ে।
“ভাবী? ও ভাবী!”
রিয়া উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে শরীফকে উত্তর করে,
“ভাবী যে, বাইত নাই। তোমার মনে নাই?”
“দেখছস! অভ্যাস তো, হেই লাইগ্যা ভাবীরে ডাকছি।”
“কি হইছে কও আমারে?”
“এই ধর, মাছ আনছিলাম অল্প কইরা, মাছের ঝোল করিছ।”
রিয়ার হাতে মাছের থলে গুঁজে দিয়েই শরীফ যেন পেছন ফিরে তাকানোরও সময় পেল না। পা চালিয়ে আবার উধাও! নির্ঘাত পাড়ার মোড়ে ক্রিকেট খেলতে গেছে! এমন কাজে রিয়ার ভেতরে এক রাশ ক্ষোভ জমে উঠলো। সে তো ভেবেছিল, আজকের কাজগুলো মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে উঠোন ঝাড়ু দেওয়া শেষ, তরকারি বসানোও হয়ে গেছে, হয়তো একটু বসে নিজের জন্য দুচার পৃষ্ঠা বই পড়বে। সে আশা এখন চূর্ণ-বিচূর্ণ! এখন আবার মাছ কাটতে হবে, ধুয়ে মশলা মাখিয়ে রান্না বসাতে হবে। শুধুই কি রান্না? সেই কাঁটায় ভরা গন্ধমাখা মাছ পরিষ্কার করার কাজও তাকে একাই করতে হবে!
রিয়ার ভিতরে রাগ আর ক্লান্তি একসঙ্গে এসে ভর করেছে, সে গম্ভীর মুখে ফের ঝাড়ু হাতে নিয়ে উঠোনে নামলো। সূর্যটা তখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে, হয়ত আর একটু পরই ডুব দিবে। হঠাৎ যেন সবকিছু কেমন ঝিম ধরে গেলো! মাথাটা কাঁপতে লাগলো, চোখের সামনে সব আবছা হয়ে এলো। হাতের ঝাড়ুটাও আর ধরে রাখতে পারলো না, খসে পড়ে গেল উঠোনে। আর তার সঙ্গেই ভেঙে পড়লো রিয়া নিজে!
বাড়িতে তখন নিঃসঙ্গতা। কামাল হোসেন মসজিদে নামাজ পড়তে গেছেন, ফিরতেও কিছুক্ষণ দেরি। এই নিঃশব্দ সন্ধ্যায়, যখন চারপাশে শুধু শালবনের পাতার মৃদু সাঁই সাঁই শব্দ, তখনই যেন ছায়ার মতো এসে হাজির হলো কবির। রিয়াকে মাটিতে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে মুহূর্তেই তার চোখ বিস্ফারিত।
“ভাবী! ভাবী!”
অবাক চোখে ডাকতে লাগলো সে। কল থেকে পানি এনে রিয়ার মুখে ছিটাতে লাগলো বারবার। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। রিয়ার নিথর চোখদুটি যেন খোলার নামই নেইঁ
কবিরের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। এ কী হলো? কী এমন ঘটলো রিয়ার? আবারো ডাকতে লাগে পারুলকে, ভেতর থেকে যখন কোনো উত্তর আসলো না, তখন কবির টের পেল বাড়িতে বোধহয় কেউই নেই! ঠিক তখনই তার চোখে পড়লো দররজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন রিয়ার বাবা।
কবিরের চোখেমুখে তখন ভয়, উদ্বেগ আর এক অদ্ভুত সংশয়ের ছায়া, রিয়ার বাবা এসে যদি ভুল কিছু ভেবে বসেন? এই পরিস্থিতি কীভাবে বোঝাবে সে?
#চলবে?