অর্ধাঙ্গ পর্ব-১১

0
35

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব১১

“আমার মাইয়ার কি অবস্থা করছো তুমি!”

কামাল হোসেনের কথায় কবির যা ভয় পেয়ে ছিলো সেটাই হতে যাচ্ছে! ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে জবাব দেয়,

“চাচা, আমি কিছু করি নাই। আমি আইয়া দেহি, রিয়া এমনে পইড়া রইছে!”

কামাল হোসেন আর কিছু না বলে তড়িৎগতিতে মেয়ের কাছে গেলেন। কয়েক বার নাম ধরে উচ্চশব্দে ডাকাডাকি করার পর আধো আধো দৃষ্টিতে রিয়া চোখ খুলে বাবার দিকে তাকাতেই কামাল হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রেখে জিগ্যেস করে,

“কি’রে মা? তোর এই অবস্থা ক্যান?”

রিয়া চারিপাশে তাকাতেই কবিরকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

“আমনে এনে? আমনে না কইছেন আইজকা আইবেন না!”
“দাওয়াত আছিলো, ভাবছিলাম আইতে পারমু না। এহন দেখছি সময়ে কুলাইছে। তাই আছি। আর আইয়াই তো দেহি তুমি জ্ঞান হারাইয়া উডানে পইড়া রইছো!”

রিয়ার মাথাটা এখনো কেমন ঝিম ধরে আছে, পুরোপুরি দুর্বলতা কাটেনি। তাও উঠে দাঁড়ালো শক্ত পায়ে।
“নিজেও কইতে পারমু না, মাথাডা হঠাৎ কইরা ঘুরান দিলো, হেরপরই সব আন্ধার!”
“টাইম মতন খাওন খাস না, হেই লাইগ্যাই এরম!”

মেয়ের উদ্দেশ্য কথাগুলো বললো কামাল হোসেন। রিয়া একবার বাবার দিকে তাকিয়ে কোনো প্রতি উত্তর করলো না। কবির তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে! সে ভেবেছিল রিয়ার বাবা হয়ত উল্টাপাল্টাই ভেবে বসবে! ভাগ্যিস ঠিক সময়ে রিয়ার জ্ঞান ফিরলো।

“চাচা, আমি তাইলে আইতাছি।”
“তোমারে অনেক ধন্যবাদ কবির, বাড়িত কেউ নাই। পোলা আর পোলার বউ, হেগো আম্মায় বেড়াইতে গেছে। তুমি সঠিক সময় না আইলে মাইয়াডা ওমনেই পইড়া থাকতো!”

বিনিময়ে কবির সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে চলে যায়। রিয়া তখন ঝাড়ু নিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিতে যাচ্ছিলো,,বাঁধ সাধলো তার বাবা।

“রাখ তোর ঝাড়ু! আবার কিছু হইলে?”
“আরে আব্বা আর কিছু হইব না তো। আমারে কাম করতে দেন।”
“সাবধানে করিছ কইলাম।”
“কিছু হইলে আমনে তো আছেনই আব্বা, ঘরে যান। আমি কাম সাইড়া জলদি আইতাছি।”

মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে কামাল হোসেন ভেতরে যেতেই রিয়া ঝাড়ু হাতে নিয়ে কাজে লেগে পড়ে। ভাইয়ের বিয়ের আগে রিয়া কাজ করলেও ককনো একাধারা পুরো সংসারের কাজ করেনি, মা সাহায্য করতো। আজকে একেবারে সব কাজ একসাথে করতে গিয়ে এরকম! না-কি অন্য কারন? এসবে মাথা না ঘামিয়ে রিয়া ঝাড়ু দিতে যাচ্ছিলো তখুনি কোথা থেকে এক বিড়াল আসে! ঝাড়ু ফেলে রিয়া ছুট লাগায় বিড়াল তাড়াতে, না হলে মুরগীর বাচ্চা গুলো ভ্যানিশ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। রিয়া এবার একটু হলেও বুঝতে পারছে গ্রাম্য পরিবেশে একটা সংসারের কাজ করতে গেলে কেমন লাগে!

আকাশের আধখানা চাঁদের নরম আলো এসে পড়ছে উঠোনে। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। ঘরের ভেতরের কুপির আলো এসে পড়ছে উঠোনে। তেমন আলো না হলেও, অন্ধকার নয়। ভাত খাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে, অতিরিক্ত গরমের জন্য উঠোনে এসে বসেছে সজীব। পারুলও পাশে এসেই বসেছে!

“একটু চু়লগুলা টাইন্যা দে তো, বউ।”

স্বামীর আবদার ফেলতে পারলো না পারুল। সযত্নে সজীবের চুল টেনে দিতে লাগলো। আরামে সজীবের দু চোখ বন্ধ হয়ে আসলো।

“আরেকটু জোরে দে তো।”

সজীবের কথা মতন পারুল চুল জোরে টেনে দিতেই সজীব বলে উঠে,

“আহ্! এত জোরে টানতাছস, মাথার খুলিই তো উড়ে যাবে!”

পারুল রসিকতার স্বরে উত্তর করে,

“উইঠ্যা যাক, দেখমু আমনের খুলিতে বুদ্ধি কইয়া কোনো কিছু আছে নি!”
“বুদ্ধি আছে দেইখ্যাই তো তোরে বিয়া করছি।”
“হ, এখন পাম দেওন হইতাছে!”

সজীব আর কিছু বললো না। শুধু ধীরে পিছন ফিরে তাকালো। ঘরের ভেতর থেকে কুপির নরম, মৃদু আলোয় পারুলের মুখটা হলদেটে হয়ে আছে।

“আমারে বিয়া কইরা, তোর অনেক কষ্ট না’রে বউ?”

সজীবের কণ্ঠে কেমন এক অদৃশ্য পাপবোধের ছায়া। যেন কথা নয়, একটা দীর্ঘশ্বাস নিক্ষেপ করলো!
পারুলের হাত থেমে যায় সজীবের চুলের ভেতর। চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিচু গলায় বলে—

“এই যে আমনে বুঝছেন কষ্ট? এতেই যা কষ্ট দুঃখ আছে সব গেছেগা।”

পারুলের প্রতি উত্তরে সজীব পুনরায় চুপ হয়েই রইলো। কথা বলার দরকার পড়ে না সব সময়, কিছু অনুভব শুধু নিরবতায় উঁকি দেয়। মুচকি হেসে আলতো করে মাথা রাখে পারুলের কাঁধে। যেন সমস্ত ক্লান্তি, হতকশা ওই এক কাঁধে রেখেএকটু রেহাই চায়। ঠিক তখনি কানে ভেসে আসে সজীবের মা’য়ের ডাক!

“সজীব? ভিতরে আইবি না? অনেক তো রাইত হইছে।”

মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে সজীব পারুলকে বলে,

“আয় ভিতরে যাই। ঘুম ধরছে চোখে।”

দু’জনে মিলে ঘরের ভেতর চলে যায়। পারুল বিছানা ঠিক করছিলো, তখনি হুট করে হাজির হয় জমেলা বেগম।
“বাজান? একটু এদিক পানে আয় তো! কিছু কথা আছে তোর লগে আমার।”

পারুল আঁড়চোখে তার শ্বাশুড়ির দিকে তাকায়।জমেলা বেগমের চোখমুখের ভঙ্গি কেমন জানি লাগছে! সজীবও বিনাবাক্য ব্যয়ে মা’য়ের সাথে হাঁটা ধরলো। জমেলা বেগম একটু দূরে নিয়েই সজীবকে বলতে আরম্ভ করে,

“টুম্পারে কেমন লাগে রে বাপ?”

সজীব সোজাসাপটা উত্তর দিলো,

“কেমন আবার, ভালোই লাগে!”
“আম্মা একটা কথা কই? রাগ করবি না তো?”

জমেলা বেগমের কন্ঠ কেমন নরম। তা দেখে সজীব আশ্বস্ত করে বলে,

“একটা ক্যান, দশটা কও আম্মা!”
“তুই তোর বউরে ছাড়বি না, কুনো সমস্যা নাই। তুই না হয় টুম্পারেই বিয়া কর। তোর যহন ওরে পছন্দই তাইলে আর কুনো সমস্যা নাই বাজান, তোর বউও থাকব! খালি টুম্পারে বিয়াডা করবি। দ্যাখ তোর বউর বাচ্চা হইতাছে না, হেই লাইগ্যাই কইলাম।”

এক দমে কথা গুলো বলে শেষ করলো জমেলা বেগম। সজীব আগের ন্যায়ই কন্ঠস্বর রেখে জবাব দেয়,

“এই কথা কইতা কেবল?”
“হ বাজান, ভাইবা দেখ। টুম্পার অহনো বিয়াও হয় নাই। দেখতে সুন্দর সবকিছুই ঠিক আছে। বিয়া কইরালা অরে। দেখবি বছর না ঘুরতেই তোর বংশধর আইব!”

সজীব কিছু বললো না, চুপ থাকতে দেখে জমেলা বেগম সজীবকে ফের বলতে লাগলো,

“অহন তো খালার বাড়িতেই আছস, রাজি হইয়া যা বাপ, তাইলে এহন থেইক্যাই তোগো বিয়ার কথা আলোচনা কইরা যাই। টুম্পা কইলাম সুন্দরী মাইয়া, বেশি দেরি করলে টিকবো না!”

মা’য়ের কথা শেষ হতেই সজীব মুখ খুললো,

“তোমার কওন শ্যাষ হইছে আম্মা?”
“হ, অহন তুই ক তোর খালারে গিয়ে প্রস্তাব দিতাম?”
“আমনে কাল ফজরের পরপরই ব্যাগপত্র গুছাইয়া লইবেন, আমরা তিনদিন না। কাইলকাই বাড়িত রওনা দিমু। আমার কথার কোনো নড়চড় কইরেন না আম্মা!”

ছেলের কথা শুনে জমেলা বেগমের চোখ দুটো যেন এক মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল। সজীবের কণ্ঠে যে সুর তাতে বিনয়ের চেয়ে কঠোরতা বেশি৷ সেই সুরে লুকানো এক অনড় সিদ্ধান্ত স্পষ্ট যেটা মায়ের বহুদিনের ইচ্ছের ঠিক উল্টোই বোঝাচ্ছে!
তার এক বুক আশা, যেটা এতদিন ধরে সাজিয়ে রেখেছিল নতুন বউ, নতুন বংশধর, সব যেন নিমিষেই নিরাশার কুয়াশায় ঢেকে গেল। এ তো হতে দেওয়া যায় না! সে আবারো বলে,

“কি কস বাপ? তোর খালারে প্রস্তাব দিমু কহন তাইলে? যদি কাইলকা যাইগা!”

সজীব এবার কন্ঠস্বর কিছুটা কঠিন করে বলে,

“কুনো দরকার নাই! আমি টুম্পা বিয়া করুম না আম্মা! আমনে কেমনে জানেন আমার বউর বাচ্চা হইব না? আল্লাহ ঠিকই আমারে পোলাপান দিব। আমি ধৈর্য্য ধরতে পারমু। ভাবছিলাম বউরে লইয়া কয়ডা দিন ঘুরমু, কিন্তু আমনে যে কথা কইছেন তিনদিন না কাইলকাই আমরা বাইত যামু। আর এডাই শ্যাষ কথা! আশা করি আমনে আমার পৃষ্ঠে আর কুনো কথা না কইয়া কথাখানা রাখবেন।”

নিজের বলা কথা শেষ হতেই সজীব চলে গেল ঘরের ভেতর। দরজাটা ধুপ করে বন্ধ হয়ে গেলো, পেছনে পড়ে রইলেন জমেলা বেগম একা, বিস্ময়ে আর ক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে।

তিনি দেখলেন সজীব তার ডাকে সাড়া দিলো না! একবারও ফিরে তাকাল না! এমনটা কি কখনও ঘটেছে? ছোটবেলায় কাঁদতে কাঁদতে যেই ছেলেটা মা’র আঁচল ধরত, আজ সে-ই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?

“ওর মুখেই এমন কথা হুনতে হইলো? এইডা কি আমার সেই সোজা সাপটা পোলায়?”

জমেলা নিজের মনের ভিতরে এই প্রশ্নটা একশবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে, কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। ঠিক তখনই পাশ থেকে রাহেলা এসে নরম হাতে জমেলা বেগমের কাঁধে হাত রাখে।

“কিরে ডরাইছস নাকি!”

জমেলা মুখটা পানসে করে বলে,

“আমি অহন তোমারে যে কতা কমু, তুমিও ডরাইবা।”
“কি?”
“কাইলকা সকালেই আমরা যামুগা। সজীব আমারে এডাই শ্যাষ কতা কইয়া দিছে!”
“মানে তোর পোলা আমার মাইয়ারে বিয়া করতে রাজি না?”
“নাগো আপা!”

রাহেলা বেগম চোখ দু’টি বড়বড় করে রাগ স্বরে বোনকে বলে,

“যতই পিরিত থাহুক বইন, বেডা মাইনষে পোলাপান না হইলে, হেই বেডিরে খেদাইতে দুই সেকেন্ড টাইম নেয় না, বিয়া তো করবই! তয় আমিও দেখুম তোর ছেলে আমার মাইয়ার থেইকাও সুন্দর বউ পায় কি-না! ”

জমেলা বেগম বুঝলেন তার বোন বেশ চটেছে ছেলের উপর! বোনকে সামাল দিতে বললো,

“সময়ের লগে লগে ঠিক হইয়া যাইব আপা! টুম্পারেই বিয়া করব আমার পোলায়। তোমার মাইয়াডাও না! কই সজীবের আশেপাশে থাকব, তাই না দেহো সন্ধ্যা না হইতে ঘুম দিছে!”

“তোর কথা যেন সত্যি হয়।”

দুই বোনে পরামর্শ করতে করতে ধীরে ধীরে উঠোনের দিকে এগিয়ে যায়। জমেলা বেগম ভেতরে ভেতরে ঠিক কী ছক কষছে, তা কারো জানা নেই। তবে দমবার পাত্রীও তিনি নন। ঠিক তখনই আড়াল থেকে সব কথা শুনছিলো পারুল।

এই প্রথম সে দেখলো, সজীব মুখের ভাষা, চোখের চাহনি মায়ের সামনে এতটা কঠোর হতে পারে! অবাক লাগলেও মনটা যেন একটু প্রশান্তিতে ভরে যায়। বুকের গহীন কোণে এক শান্তির বাতাস বয়ে যায়। সজীব ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করতেই পারুলের দিকে ফিরে একচিলতে হাসি হেসে বলে ওঠে—

“আয়, তহনের মতো কইরা চুল টান দে তো! চোখ থেইক্যা ঘুম উইড়া গ্যাছে। ঘুম পাড়ায়া দে আমায়।”

পারুল মৃদু হাসে, আজকে যোন তার সমস্ত কষ্ট এক মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে গেল। চুপচাপ এগিয়ে এসে সজীবের চুলে আঙ্গুল চালায় যত্নে। কালকেই এই গৃহের বুক চিরে এক নতুন সকাল জন্ম নেবে। এই বাড়িতে তার অপমানের, চুপচাপ সহ্য করার সময় শেষ হবে। তার অপেক্ষার প্রহর ফুরাতে চলেছে। , এসব ভেবেই আনন্দ আর ধরছে না!

#চলবে?